rabindranath ekhane kokhono asen ni pdf part 21 to 74

অধ্যায় ২১

ছােট্ট এই জীবনে অনেক চুরি করেছে বল্টু। শুরুটা হয়েছিল মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখা টাকা-পয়সা সরানাে থেকে। তার মা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারত না রান্না করার সময় আঁচল থেকে চুপিসারে টাকা সরাচ্ছে সে। কী নিখুঁতই না ছিল তার হাত! সেই প্রথম থেকেই। একটু বড়ো হবার পর বুঝেছিল, ঘরের টাকা চুরি করার মধ্যে বীরত্ব যেমন নেই, তেমনি লাভজনকও না। অর্থনীতির জটিল সমীকরণে না গিয়েই সে বুঝে গিয়েছিল, ঘরের বাইরে নজর দিতে হবে। সেই থেকে চুরি করার বিদ্যেটা ভালােমতােই কাজে লাগাতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের পকেট কেটে বিখ্যাত হারুকাটা একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে। পাশে ছাতা রেখে চায়ের দোকানে বসে এক মুরুব্বি চা খাচ্ছিল, বল্টু সেই ছাতাটা সবার অলক্ষ্যে মেরে দেয়, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হারুকাটা পকেটমার তাকে ধরে ফেলে হাতেনাতে।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল সে। ওটাই ছিল তার প্রথম কট খাওয়ার কেস। কিন্তু হারু যখন বলল, “গাধার বাচ্চা, বুইড়ার পকেটে কয়েকশাে টাকা থাকতে বালের এই ব্রিটিশ আমলের ছাত্তিটা মারলি ক্যান?”তখনই সেবুঝে গেছিল, যােগ্য ওস্তাদের খপ্পরেই পড়েছে।  এরপর থেকে হারু তার ওস্তাদ বনে যায়। কীভাবে পকেট কাটতে হয়, তালা খােলা যায়, কীভাবে বুঝবে
কার পকেটে টাকা আছে আর কার পকেটে আছে বিড়ি-গুলের মতাে অপ্রয়ােজনীয় জিনিস—সবই শিখিয়ে দিয়েছিল। বিনিময়ে প্রথম দু-বছর তাকে হারুর চ্যালা হয়ে কাজ করতে হয়। ইনকামের প্রায় বেশির ভাগই নিয়ে নিত হারুকাটা। ততদিনে তার বাবা আর-এক মহিলাকে বিয়ে করে ফেলেছে। আর তাকে ফেলে চলে গেছে জন্মদাত্রী মা। কার সঙ্গে কোথায় যে গেছে সেটা আজও জানতে পারেনি বল্টু। এরপর থেকে তার আশ্রয় জোটে হারুকাটার ঘরে। ভােরে উঠেই তাকে চলে যেতে হত বাসস্টেশনে, ইনকাম করার পরই কেবল নাস্তা জুটত কপালে। ওস্তাদ হিসেবে এমনই কঠিন ছিল হারু।  সারাটা দিন টই টই করে ঘুরে বেড়িয়ে পকেট মারত, চুরি করত। তবে আলতু ফালতু জিনিস চুরি করলে হারুকাটার লােহার মতাে শক্তহাতের থাপ্পড় জুটত দুই গালে। সেই থাপ্পড়ের ভয়ে চুরিবিদ্যেটা আরও শাণিত করে নেয় সে। বড়ো বড়ো দান মারতে শুরু করে কিন্তু তাতেও কোনাে লাভ হত না। দিনকে দিন হারু তার শােষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

অনেক রাত শুয়ে শুয়ে বল্টু ভেবেছে, হারুর কাছে তার যে ঋণ সেটা শােধ হয়ে গেছে অনেক আগেই—এখন তাকে মুক্তি পেতে হবে। তার ছােট্ট মাথা থেকে অবশ্য কোনাে উপায় বের হত না। এক পর্যায়ে সে ধরেই নিয়েছিল, হারুকাটার সঙ্গেই কাটিয়ে দিতে হবে বাকি জীবনটা।

সেটা অবশ্য হয়নি। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই মুক্তি পেয়ে যায় সে। পাশের এক টাউনে পকেট মারতে গিয়েছিল তার ওস্তাদ, বড়ো দান মারতে বেছে নিয়েছিল বিয়ে বাড়ির মতাে একটি অনুষ্ঠান। কপাল খারাপ ছিল, ধরা পড়ে যায় হাতেনাতে। মারমুখি জনতার গণপিটুনি আর সহ্য করতে পারেনি, ভবের লীলা সাঙ্গ করে হারুকাটা চলে যায় পরপারে।  ওস্তাদের মৃত্যুসংবাদ শােনার পর একটু মন খারাপ করেছিল বল্টু। ইশ ওস্তাদ যদি তার মতাে গণপিটুনি খাওয়ার সময় পায়খানা করে দিত! সেই পায়খানা হাতে নিয়ে লােকজনকে দেখিয়ে বলত : আর মাইরেন না  দেহেন, হাইগ্যা দিসি!তাহলে তার মতােই বেঁচে থাকত এখন।বল্টু এই পদ্ধতি খাটিয়ে বেশ কবার বেঁচে গেছে। লােকজন জ্যান্ত মানুষকে মারতে ভয় পায় না, কিন্তু মানুষের গু নিজের হাতে-পায়ে-শরীরে লাগাতে ভয় করে! শেষ অস্ত্র হিসেবে এটা খুবই কার্যকরী। কাঁদো কাঁদো হয়ে মানুষের মায়া-মমতা আদায় করার যে পুরােনাে টেকনিক তার ওস্তাদ তাকে শিখিয়েছে, সেটা এখন আর কাজে লাগে না। মানুষ বড়ােই পাষাণ হয়ে গেছে!

বল্টুর হাতে অনেক সময় আছে। মাস্টার এখন আছেন স্কুলে, তার আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যায়। সেজন্যে তাড়াহুড়ো করার কোনাে মানেই হয় না।  মাস্টারের ভিটের কাছে এসে সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা দেখে নিল আর-একবার। রমাকান্তমাস্টার থাকেন এমন এক ভিটায়, যার চারপাশে খুব কম বাড়িঘরই আছে। ভিটার চারদিকে খেতিজমি, সেইসব জমিতে কিছু কামলা আগাছা সাফ করতে ব্যস্ত। মাস্টারের ভিটা থেকেও তাদের অবস্থান বেশ দূরে। তার চেয়েও বড়ো কথা, সবাই মাথা নীচু করে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আজাইরা আর অকর্মা মানুষ নয় যে, আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে নজর রাখবে।  বল্টু
আস্তে করে উঁচু ভিটেতে উঠে গেল সবার অগােচরে। পুরাে বাড়িটা যেন শ্মশানের মতােই খাঁ-খাঁ করছে। চারদিকে গাছগাছালি থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। আমগাছের মুকুল থেকে গন্ধ ভেসে আসছে।

মাস্টারের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে আর-একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিল। এরকম সতর্কতা তাকে শিখিয়েছে হারুকাটা ওস্তাদই। ভুলেও ধরে নেওয়া যাবে না, আশেপাশে কেউ নেই।

বল্টুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। এখন যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা পানির মতােই সহজ। এখানে ধরা পড়ার কোনাে সম্ভাবনাই নেই। একটা মাঝারি আকারের চাইনিজ তালা মারা আছে মাস্টারের ঘরের দরজায়। ওটা খােলার জন্য তেমন কিছুই করতে হবে না। তার কাছে একটা মাস্টার-কি আছে, সেটা দিয়ে সুন্দরপুরের অর্ধেক তালা খােলা যাবে!

মানুষের বােকামির কথা ভেবে হাসি পায় বল্টুর। তালা কেনার সময়ই তারা সবচেয়ে বেশি কিপটেমি করে। লাখ টাকার জিনিস পাহারা দিতে কিনা পঞ্চাশ টাকা দামের তালা কেনে!

পকেট থেকে মাস্টার-কিটা বের করে তালাটা খুলে ফেলল সে। ঘরটাতে বেশি কিছু নেই। তবে মানুষ কোথায় কী রাখতে পারে, সেই ট্রেনিংও দিয়েছে তার ওস্তাদ।  ঘরে কাপড়-চোপড় রাখার একটা আলনা, পুরােনাে দিনের নকশাওয়ালা পালঙ্ক, বই, নানান রকম ফাইলভর্তি একটি আলমারি আর পড়ার টেবিল-চেয়ার।বল্টু প্রথমে টেবিলের ছােট্ট ড্রয়ারটার দিকেই
হাত বাড়াল। এটারও লক রয়েছে, সেই লক খুলতেও বেগ পেতে হল না।

ড্রয়ারের ভেতরে কিছু চিঠিপত্র আর একটা মােবাইলফোন আছে চার্জারসহ।  বল্টুর চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠল। চিঠিগুলােসহ ফোনটা নিয়ে নিল সে। চার্জারটা নেবার দরকার না থাকলেও বাকি জিনিসের সঙ্গে ওটা পকেটে ভরে নিল। সস্তা চাইনিজ ফোনের চার্জার, কিন্তু বিশ টাকা হলেও চোরাই মার্কেটে বিক্রি করা যাবে। তার কাজ শেষে হয়ে গেলেও স্বভাবগত কারণেই ঘরের আশেপাশে নজর বুলাল আর-একবার। মাস্টার এখন বিশাল সম্পত্তি দেখাশােনা করেন, বিরাট বড়ো একটা স্কুল আর লাইব্রেরী চালান, প্রচুর টাকা খরচ করতে হয় তাকে। নিশ্চয় ঘরে কিছু না কিছু থাকবে।

পরক্ষণেই আতর আলির সাবধান বাণীটা তার মগজে উচ্চারিত হল : কোনাে কিছু যদি সরাইসোস তাে তুই শ্যাষ! এক্কেবারে কবজি থেইক্যা হাত কাইট্যা ফালামু!

সঙ্গে সঙ্গে চার্জারটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিল বল্টু। আতর আলি তার ওস্তাদ না হতে পারে, কিন্তু এই লােককে জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়। থানার সঙ্গে তার সেইরকম খাতির। তাকে বিগড়ানো ঠিক হবে না।  এই প্রথম বল্টু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় খালি হাতেই বের হয়ে এল কোনাে বাড়ি থেকে! তবে বের হবার সময় দরজার তালাটা আর লাগাল না। আবারও তাকে আসতে হবে—একটু পরই। কী দরকার লক করে রাখার।

অধ্যায় ২২

এটা যে ঘটবে রমাকান্ত কামার জানতেন। গতকাল লােকটাকে দেখার পরই বুঝতে পেরেছিলেন, তার কাছে এসে আবারও সেই একই কথা জানতে চাইবে। তিন বছর আগে যখন অলােকনাথের নাতবউ জমিদার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল,তার সপ্তাহখানেক পরই এই লােক দ্বিতীয়বারের মতাে সুন্দরপুরে এসেছিল, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। লােকটার সন্দেহগ্রস্ত মানসিকতা পছন্দ করেন না তিনি। জগতের সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখাটা এক ধরনের বাতিক। এটাকে তিনি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে দেওয়া অভিশাপ বলেও মনে করেন।

দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল তার ভেতর থেকে। আবারও সেই একই প্রশ্ন করবে এই লােক —আপনাকে কেন ট্রাস্টি করে দিয়ে গেল মুশকান জুবেরি? সে এখন কোথায়? তার সঙ্গে আপনার কী যােগাযােগ আছে?

রমাকান্ত কামার জানেন, তার দিক থেকে জবাবটা আগের মতােই হবে—এটা আপনি ওই ভদ্রমহিলাকেই জিজ্ঞেস করলে ভালাে হয়। তার খবর আমি রাখি না।

ভদ্রমহিলা ?

ওইদিন ছফা নামের লােকটা যেন খেপে গেছিল কথাটা শুনে। আপনি তাকে ভদ্রমহিলা মনে করেন ? বলেছিল সে, মাথা দোলাতে দোলাতে। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলেনি। শুধু বলেছিল, তার নাকি কোনাে ধারণাই নেই ওই মহিলা কী করে।

“এসব জেনে আমি কী করব?” রমাকান্ত কামার সােজাসাপটা বলে দিয়েছিলেন। “ওঁর সঙ্গে তাে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই, কোনাে লেনদেন নেই।”  ডিবি অফিসার মুচকি হেসেছিল কথাটা শুনে। “কিছুই নেই, তারপরও আপনাকেই
ট্রাস্টি করে এত বড়ো সম্পত্তি দিয়ে গেল?”

রমাকান্ত কামার বিরক্ত হয়েছিলেন কথাটা শুনে। “আমাকে উনি একরত্তি সম্পত্তিও দিয়ে যাননি। আপনি ভুলে গেছেন, উনি একটি ট্রাস্টে দান করে গেছেন সবকিছু।”

“আর সেটার ট্রাস্টি করে গেছেন আপনাকে!”

লােকটার চোখেমুখে সন্দেহ উপচে পড়ছিল। যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে সেটা প্রকাশ করেননি, বরং যুক্তি দিয়ে কথা বলেছিলেন। “ওই ভদ্রমহিলা এটা করতে বাধ্য হয়েছেন।”

কথাটা শুনে ছফার ভ্র কপালে উঠে গেছিল।“বাধ্য হয়েছেন?”

“হুম। সম্পত্তিটা যার নামে, সেই রাশেদ জুবেরি এটা চেয়েছিলেন।” একটু থেমে আবার বলেছিলেন, “আর মহিলা সেটাই করেছেন।”

“তাহলে এত দিন পরে কেন? পালিয়ে যাবার ঠিক আগেই?”  “সেটা ওই মহিলাই ভালাে জানেন,”বলেছিলেন রমাকান্তকামার। “ধরে নিলাম উনি আসলেই একজন অপরাধী…তাতে কী? সম্পত্তিটা তাে ওঁর ছিল না।”

ডিবি অফিসার এ কথার কোনাে জবাব দেয়নি।

“ওঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়ে থাকলেও সম্পত্তিগুলাে দান করার অধিকার উনি রাখতেন  যদি না আদালত এ ব্যাপারে কোনাে বাধা দিত।”  তার এমন কথায় মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিল লােকটার ঠোটে।“আইন-কানুন সম্পর্কে তাে দেখি ভালাে ধারণাই রাখেন।”  টিটকারিটা গায়ে না মেখে তিনি বলেছিলেন, “তা রাখি না। তবে জগতের সকল আইন-কানুন তৈরি হয়েছে কাণ্ডজ্ঞান থেকে, সেটা নিশ্চয় আমার আছে।”  এ কথা শােনার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে চলে গেছিল ডিবি অফিসার। সেই যে গেল আর আসেনি। বিগত তিন বছরে তার টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তবে লােকটার ছায়া ঠিকই মাস্টারকে অনুসরণ করে গেছে পরবর্তী কয়েকটি মাস।

এই সুন্দরপুরের সবাই তাকে পুলিশের ইনফর্মার হিসেবেই চেনে। চুরি থেকে শুরু করে মাদক বিক্রি, হেন কাজ নেই সে করে না। মাস্টার লক্ষ করেছেন, লােকটা কেমন ছায়ার মতাে অনুসরণ করতে শুরু করেছিল তাকে। তিনি যেখানেই যেতেন, পিছু নিত আতর।

একদিন পােস্ট অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ঢাকা থেকে জরুরি একটা চিঠি এসেছিল তার। ডাক হরকরা সুবিদমিয়া তাকে দেখে পােস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা খাইয়ে চিঠিটা দিয়ে দেয়। সেই চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিশাল বড়ো এক বটবৃক্ষের নীচে একটু জিরিয়ে নেন তিনি।বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে চিঠিটা পড়তে গিয়ে টের পান দূর থেকে আতর আলি উৎসুক চোখে তাকে দেখছে। তিনি চিঠিটা পড়ার পর ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে ফেলে দেন পাশে।তারপর উঠে রওনা দেন বাড়ির দিকে। কিছুটা পথ যাবার পর একটা পুরােনাে শিব মন্দিরের ধ্বংস্তুপের কাছে এসে পেছনে ফিরে দেখেন আতর সেই চিঠির টুকরােগুলাে কুড়াতে ব্যস্ত। এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তার ভেতর থেকে।

এখনও সেই একই দীর্ঘশ্বাস আর ভাবনা তাকে পেয়ে বসল। “আদাব, মাস্টারসাহেব।” রমাকান্ত কামারের ভাবনায় ছেদ পড়ল, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ডিবি অফিসার নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে।

আপনি তাে দেখি বিশাল কাজ করে ফেলেছেন,”ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল সে।

চোখেমুখে নির্বিকার ভঙ্গি মাস্টারের। “বসুন,”তার ডেস্কের সামনের চেয়ারগুলাের একটা দেখিয়ে বললেন।

মাস্টারের এই অফিস ঘরটি এককালে জমিদার বাড়ির মূল ভবনের পাশে যে লাগােয়া দোতলাটি ছিল সেটার নীচতলায় অবস্থিত। ভেতরে এবং বাইরে, পুরােপুরি নতুন করে সাজানাে হলেও মূল স্থাপনাটি একই আছে।

একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল ছফা।“কেমন আছেন?” “ভালাে,” ছােট্ট করে জবাব দিলেন রমাকান্ত কামার। “স্কুলটার খুব নামডাক হয়ে গেছে। এত অল্প সময়ে দারুণ কাজ করেছেন মনে হচ্ছে।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন মাস্টার। এসব আলগা কথাবার্তায় তার কোনাে আগ্রহ নেই। আসল কথার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

“এখানকার নিরাপত্তা দেখি সেই রকম!”কথাটা প্রশংসার মতাে শােনালাে না অবশ্য। “আমি তাে খুবই অবাক হয়েছি। ঢাকার স্কুলেও এরকম নিরাপত্তা দেখিনি। ভালাে, খুব ভালাে।”

“এটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল,” আস্তে করে বললেন মাস্টার। “এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের দুটো ডরমিটরি আছে। এর সঙ্গে অন্য স্কুলের তুলনা করলে ভুল করবেন।”

কপালে তুলে বলল ছফা, “তা অবশ্য ঠিক।” “এখন বলুন, আমার কাছে আবার কীজন্যে এসেছেন।” মাস্টারের কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতা বর্জিত সুরটা ধরতে বেগ পেল না। “আপনার কি তাড়া আছে?”

“হুম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।”

“আচ্ছা,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল ছফা। “ওই মহিলা  মুশকান জুবেরি কি আপনার সঙ্গে যােগাযােগ করেছিল এরপর ?”

আস্তে করে গভীরভাবে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্ত কামার। “না।” “এ কয় বছরে একবারও যােগাযােগ করার চেষ্টা করেনি?” এবার শুধু মাথা দুলিয়ে জবাব দিলেন মাস্টার। “অন্য কারাের মাধ্যমেও না?”রমাকান্ত কামারের কাছ থেকে কোনাে জবাব না পেয়ে আবার বলল, “এত কিছু করলেন আর মহিলা একটা ধন্যবাদও দিল না আপনাকে? অন্তত কাউকে দিয়ে তাে এটুকু বলতেই পারত, ‘মাস্টারসাহেব, আপনি দারুণ কাজ করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ’?”

মাস্টার কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে একটু চমকে গেলেন কথাটা শুনে।

“রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরী দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিল আপনাকে ধন্যবাদ জানানাে,”আপশােশের সুরে বলল নুরে ছফা। “তার সাধের রেস্টুরেন্টটা না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিকই টিকে আছে। লােকে আগেও বলত রবীন্দ্রনাথে যাই এখনও সেটাই বলে।”

“আপনি ধরেই নিয়েছেন এমন নামকরণের সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলার সম্পর্ক আছে , একটু কষ্ট হয়ে বললেন রমাকান্ত কামার।

মুচকি হাসল ছফা। “ধরে নেবার কিছু নেই, যুক্তিবুদ্ধি সেটাই বলে।”

“আপনি সম্ভবত জানেন না, রবীন্দ্রনাথের সুন্দরপুরে আসার উপলক্ষে এখানে একটি লাইব্রেরী উদ্ববাধন করার কথা ছিল। সেজন্যে অলােকনাথ বসুর পিতা ত্রিলােকনাথ চমৎকার একটি লাইব্রেরী করেছিলেন।”

নুরে ছফা ভ্ৰ কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাস্টারের দিকে।

“বটগাছের কাছে, এখন যেখানে পেট্রলপাম্পটা আছে ওখানেই ছিল পয়ষট্টি সাল পর্যন্ত। এর পর রায়টের সময় ওটা পুড়িয়ে দেয় দাঙ্গাবাজেরা।”

ছফাও জানে, সব যুগেই দাঙ্গাবাজ আর ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়েছে গ্রন্থাগার। পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনার সঙ্গে গ্রন্থাগারের বিরােধ সুপ্রাচীন।

“পরে আর ওটা মেরামত করার চেষ্টা করেনি জমিদার বাড়ির কেউই। অলােকনাথ বসু অবশ্য আমাকে বলেছিলেন লাইব্রেরীটা আবার নতুন করে করার কথা ভাবছেন তিনি। এরপর একাত্তর চলে এলাে, জমিদারের বংশ শেষ!” দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বললেন তিনি। “স্বাধীনের পর সরকার মহাসড়ক বানানাের জন্য জমিদারদের সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ অধিগ্রহণ করে  লাইব্রেরীটা যেখানে ছিল, ওটার উপর দিয়েই চলে যায় নতুন সড়কটি।”

“তাই আপনি ঠিক করলেন আবার একটা লাইব্রেরী করা দরকার ওখানে?” মাস্টার কিছুই বললেন না। “বুঝলাম।কিন্তু এটা বুঝলাম না, মহিলার রেস্টুরেন্টের সাইনটা রেখে দিলেন কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্ত কামার। রেস্টুরেন্টটার সাইন যখন সরানাে হচ্ছিল তখন তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সেটা। ডান দিক থেকে সাইনটার একেকটি শব্দ খুলে ফেলা হচ্ছিল। শেষে যখন রবীন্দ্রনাথ’টা খুলতে যাবে তখন মাস্টারের মন সায় দিলাে না। এ নামেই তাে লাইব্রেরীটা হবে, তাহলে নামটা থেকে গেলে কী আর সমস্যা! লাইব্রেরী যদি আলাের আধার হয়ে থাকে, তাহলে আলােকিত রবীন্দ্রনাথ থাকতেই পারে! সত্যি বলতে, রবীন্দ্রনাথ নামটা অপসারণ করতে তার মন সায় দিচ্ছিল না।

“শুনুন ছফাসাহেব, বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মাস্টার।“রবীন্দ্রনাথ শুধু একজনের পছন্দের মানুষ নন। তাকে পছন্দ করে, ভালােবাসে, অনুসরণ করে এরকম মানুষ এই ভূ-ভারতে অনেক আছে। আমিও তাদের একজন। তাই বলে ভাববেন না, আমার ইচ্ছেয় নামটা দিয়েছি। সত্যিটা হল, অলােকনাথ বসুর পিতা যে লাইব্রেরীটি দিয়েছিলেন, স্বয়ং কবিগুরুর যেটা উদ্বোধন করার কথা ছিল, সেটার নাম ছিল ‘শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গ্রন্থাগার। এটা সুন্দরপুরের খুব কম মানুষই এখন জানে। বিস্মৃত ইতিহাস বলতে পারেন। আমি শুধু নতুন করে ওটা আবার দিয়েছি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। “আপনি এবার আসতে পারেন।”

ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি ঘরটা ভরে উঠল মাদকতাপূর্ণ একটি গন্ধে।  “রমাকান্ত মশাই ”সুললিত একটি কণ্ঠ বলে উঠতেই মাঝপথে থেমে গেল।

পেছন ফিরে ছফা দেখতে পেল একতরুণী দাঁড়িয়ে আছে। তাঁতের শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখেই মনে হল পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হওয়া হাজারাে তরুণীদের একজন।

মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হলাে ছফার। মাস্টারের ঘরে অপরিচিত কাউকে দেখতে পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে।  “আপনি মনে হচ্ছে ব্যস্ত, আমি তাহলে পরে আসি?”

“কোনাে সমস্যা নেই, বলুন, কী বলতে এসেছিলেন,”বললেন রমাকান্ত কামার।

ছফার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাস্টারের দিকে ফিরল তরুণী। “বােশেখের অনুষ্ঠানে তানপুরাটার তার ছিড়ে গিয়েছিল, ওটার তার কেনা লাগবে।”

“শ্যামলকে বলে দিচ্ছি, ও কিনে নিয়ে আসবে।”।

“ঠিকাছে।” বলেই ছফার দিকে আবার আড়চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল মেয়েটি।

আশ্চর্য হলেও সত্যি, মেয়েটাকে দেখে নুরে ছফার কেন জানি মুশকান জুবেরির কথাই মনে পড়ে গেল! এটার কারণও সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারল সে-তাদের দুজনের বাচনভঙ্গি আর সাজপােশাকের বেশ মিল আছে। মেয়েটা প্রমিত বাংলায় কথা বলে, মুশকান জুবেরিও এভাবে কথা বলত। বলে শুধরে দিল নিজেকে। ওই মহিলা তাে আর লােকান্তরিত হয়ে যায়নি। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও, আর শিকার করে যাচ্ছে।

“আমাদের গানের শিক্ষিকা।” “ও,”আস্তে করে বলল ছফা। “আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে?”

রমাকান্ত কামার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ছফার দিকে, তারপর আস্তে করে ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলেন।

কার্ডটা হাতে নিয়ে হতাশ হল সে, ল্যান্ডফোনের নাম্বার। “এটা তাে এখানকার অফিসের নাম্বার?”

“আপনার নিজের কোনাে ফোন নেই?” “আপনি এই নাম্বারেই আমাকে পাবেন।” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ছফা। “ঠিক আছে, আমি তাহলে আসি।”দরজার দিকে যেতেই আবার ঘুরে দাঁড়াল। “আপনার স্কুলটা কি ঘুরে দেখতে পারি? অনেক পুরােনাে স্মৃতি আছে এখানে, বুঝতেই পারছেন। তাছাড়া, স্কুলটার অনেক প্রশংসা শুনে ফেলেছি, তাই একটু ঘুরে দেখার লােভটা সামলাতে পারছি না।”

স্থিরচোখে তাকিয়ে বললেন মাস্টার, “ঘুরে দেখতে পারেন, সমস্যা নেই।” “ধন্যবাদ, আপনাকে।”কথাটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল ছফা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রমাকান্ত কামারের ভেতর থেকে। ডেস্কের বেলটা বাজাতেই কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকল মাঝবয়সি এক লােক।

“স্যার?”

“আলি, একটু আগে আমার ঘর থেকে যে লােকটা বের হয়ে গেল তাকে একটু চোখে চোখে রেখ। সে কী করে না করে লক্ষ রাখতে হবে।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

আলি নামের লােকটা ঘর থেকে চলে গেলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্ত কামার। এরকম কাজ করার কোনাে ইচ্ছে কিংবা রুচি নেই তার, কিন্তু এখন না করেও পারলেন না। নুরে ছফা নামের লােকটাকে তার সুবিধার বলে মনে হয়নি কখনও। তার চাইতেও বড়ো কথা, এর মতিগতি বুঝতে পারছেন না।

অধ্যায় ২৩

মাস্টার রমাকান্ত কামারের অফিস থেকে বের হয়ে চারপাশে তাকাল নুরে ছফা। জমিদার বাড়িটা বেশ বদলে গেছে। এক সময় জমকালাে পুরােনাে ভবনটি আর নেই।ওটা যে তিন বছর আগে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে সে-কথা তার চেয়ে ভালাে কে জানে!

তবে বাড়িটার চৌহদ্দি আগের মতােই আছে। ভেতরে কিছু নতুন স্থাপনা তৈরি হওয়াতে প্রথম দেখায় মনে হয় অন্য কোনাে জায়গা বুঝি। সামনের প্রাঙ্গনটা একেবারে পালটে ফেলা হয়েছে। ওটা এখন ইট বিছানাে একটি চত্বর। চত্বরটাতে সাদা রং দিয়ে দাগ টানা। ছাত্রছাত্রীরা এখানে জড়ো হয় ক্লাস শুরুর আগে। তারপর হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে ছফারা যেটাকে বলত পিটি ক্লাস।

আরামে দাঁড়াও  সােজা হও!

স্কুলের পিটি স্যারের পুরু গোঁফের মুখটার ছবি ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। সাদা গেঞ্জি আর সাদা প্যান্ট পরা থাকত, মাথায় থাকত সানক্যাপ। একটা হুইসেল বাজিয়ে তাদেরকে অর্ডার দিতেন। খুবই জাদরেল ছিলেন, নানান ধরনের খেলাধূলায় উৎসাহ দিতেন। লােকটার ভুড়ি ছিল বলে আড়ালে আবডালে তাকে তারা পেটালি’বলেও ডাকত।

প্রাঙ্গনের মাঝখানে ফ্ল্যাগপােলটা চোখে পড়ল এবার। সবই আছে, পতাকাটা নেই। ক্লাস শুরুর আগে, জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় ওটাতে ফ্ল্যাগ লাগানাে হয় নিশ্চয়। এখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা গেয়ে ওঠেঃ আমার সােনার বাংলা…আমি তােমায় ভালােবাসি।

ছফা পা বাড়াল সেদিকে। চত্বরটা ঘুরে দেখল সে। সীমানা প্রাচীরটা আরও উঁচু করা হয়েছে, তার ওপরে লাগানাে হয়েছে তিন ফুটের মতাে উঁচু লােহার নেট। সীমানা প্রাচীরের যেদিক দিয়ে ছফা এখানে অনুপ্রবেশ করেছিল একরাতে, সেদিকে দিকে তাকাল। গাছটা এখনও অক্ষত আছে। তবে সেটার গোঁড়ার দিক থেকে কোমর সমান উচ্চতায় সাদা রং করা।

মাঝখানে যে ফোয়ারাটা এখন নেই, সেটা ঢােকার সময়ই দেখেছিল। এখন দেখতে পেল। মেইন গেটের পাশে আগের দারােয়ানের যে ঝুপড়ি ঘরটা ছিল সেটাও নেই। পুরাে জায়গাটা যথেষ্ট পরিস্কার।

জমিদার বাড়ির দোতলা স্থাপনাটির জায়গায় এখন নতুন একটি একতলা ভবন গড়ে উঠেছে। টিনের চালার এই ভবনটি স্কুলের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই ভবনে অনেকগুলাে দরজা-জানালা। সম্ভবত শিক্ষকেরাও এখানেই বসে।ছফা এবার ভবনের পাশ দিয়ে ইট বিছানাে রাস্তা ধরে পেছনের দিকে চলে গেল। আগের রাস্তাটা আরও চওড়া করা হয়েছে। পুরােনো ইটগুলাের বদলে বসানাে হয়েছে নতুন ইট। ভবনের পেছনে যে বাগানটা ছিল, যেখানে লুকিয়ে থাকার সময় ছ্যাঙ্গার কবলে পড়েছিল ছফা, সে-জায়গাটা আর নেই। ওখানে তিনদিক ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তিনটি ভবন। কেবল উত্তর দিকটা খােলা আছে। সেদিক দিয়ে সীমানা প্রাচীর ঘেষে চলে গেছে নতুন রাস্তাটি।

নবনির্মিত ভবনগুলাের দেয়াল ইটের তৈরি, ছাদগুলাে টিনের। সারি সারি দরজা জানালা বলে দিচ্ছে এগুলােই স্কুলের ক্লাসরুম। দরজা বন্ধ থাকলেও কিছু খােলা জানালা দিয়ে সে দেখতে পেল বেঞ্চগুলাে।

রাস্তাটা ধরে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেল ছফা। ঠিক এভাবেই রাতের অন্ধকারে সে এগিয়ে গেছিল রহস্যময়ী মুশকান জুবেরিকে অনুসরণ করে। তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্য ধোঁকা খেয়েছিল দুটো দেয়ালের কারণে।  আশ্চর্য হয়ে ছফা দেখতে পেল, দেয়াল দুটো এখনও আছে। এত কিছুর পরিবর্তনের মধ্যে এরকম একটি দেয়াল কেন টিকিয়ে রাখা হল সেটা বুঝতে পারল না।

ঠিক তখনই শুনতে পেল, দূর থেকে ভেসে আসছে একদল ছেলেমেয়ের সমবেত কণ্ঠের গান :

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি আহা হাহ হাহ।

আর-একটু এগিয়ে গেল সে। গানের আওয়াজ বেড়ে গেল এবার।

– কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটির

আহহাহা হা

দেয়ালের প্রবেশ মুখ দিয়ে ঢুকে ছফা এবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক এ জায়গাতেই, একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে সে দেখেছিল মুশকান জুবেরিকে কিছু একটা মাটি চাপা দিতে।মহিলার সঙ্গে ছিল গােরখােদক ফালু।তবে এখন আর কোনাে ঝোপ নেই। জায়গাটা বেশ পরিস্কার। পুকুরপাড়ের চারপাশ ঘিরেই সবুজ ঘাসের চত্বর।

মুশকান জুবেরি যেখানে বস্তাবন্দি করে রেডওয়াইন মাটির নীচে পুঁতে ফেলছিল, ঠিক অখানেই একদল ছেলেমেয়ে বসে আছে শতরঞ্জির ওপরে। তাদের সামনে আছে ওই তরুণী-মাস্টারের অফিস রুম একটু আগে যাকে দেখেছিল।

মােড়াতে বসে আছে ওই তরুণী একটু আগে যাকে মাস্টারের রুমে দেখেছিল।

কেয়া পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে

লালদীঘিতে ভাসিয়ে দেব চলবে দুলে দুলে।

রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনুচরাব আজ বাজিয়ে।

ছেলেমেয়েরা সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে যাচ্ছে। মনােযােগ দিয়ে কথা আর সুর ঠিক আছে কিনা লক্ষ রাখছে সেই তরুণী, কিন্তু মেয়েটা চকিতে ছফাকেও দেখে নিল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। একজন আগন্তুক যে দূর থেকে তাদেরকে দেখছে সেটা গান গাইতে থাকা বাচ্চাগুলাে অবশ্য এখনও টের পায়নি।

“আমাদের গানেরমাস্টার।”

ছফা চমকে তাকাল পেছনে। দেখতে পেল বাদামি রঙের কুর্তা আর পায়জামা পরা মাঝবয়সি এক লােক নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“খুবই ভালাে গান করে…শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে।”ভ্রু কপালে তুলল ছফা।“তাই নাকি।” “জি।” “আপনি?”

“আমি এখানকার কেয়ারটেকার।

আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন?”

“ঢাকা থেকে এসেছি,”আর কিছু বলল না ছফা। পুকুর পাড়ের ওপাশে, যেখানকার ডােবায় মুশকান জুবেরি কুমির চাষ করত, সে-জায়গাটার দিকে চোখ গেল তার। একদমই বদলে গেছে। মাটি ফেলে জায়গাটা উঁচু করা হয়েছে এখন। সেখানে গড়ে তােলা হয়েছে দুটো ভবন—মূল স্কুলভবনের আদলেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলাে ইটের দেয়াল আর টিনের ছাদ।

তবে দুটো ভবনের মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে পৃথক করা। “ওগুলাে ডরমিটরি,” ছফার চোখ অনুসরণ করে কেয়ারটেকার বলল।“ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা দুটো।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা, দেখতে পেল ডরমিটরিতে ঢুকতে দুটো আলাদা মেইন গেট আছে। আর পুরাে জায়গাটা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা।

প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। “মাস্টারসাহেব দেখি ছােটোখাটো শান্তি নিকেতন বানিয়ে ফেলেছেন!”

হেসে ফেলল কেয়ারটেকার। “এটা ওঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল।” বিশাল কাজ করেছেন,” সত্যি সত্যিই বলল ছফা, কথাটার মধ্যে টিটকারির লেশমাত্রও নেই।

মাথা নেড়ে সায় দিল মাঝবয়সি কেয়ারটেকার। মুখে এখনও হাসি ধরে রেখেছে। “কিন্তু এত কিছু কীভাবে করলেন?”

লােকটার হাসি মিইয়ে গেল। ছফার এ প্রশ্নের মধ্যে কেমন যেন একটা ইঙ্গিত আছে। “কীভাবে মানে?”

“এই যে, বিরাট একটি আবাসিক স্কুল, এত বড় আয়ােজন, এসব করতে তাে অনেক টাকা লাগার কথা।”

আবারও হাসি ফিরে এল কেয়ারটেকারের মুখে। “ট্রাস্টের জমিজমার পরিমাণ তাে অনেক। তাছাড়া স্থানীয় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ডােনেশন দিয়েছে। আমাদের নতুন এমপি আবার মাস্টারসাহেবের ছাত্র ছিলেন। অনেক সাহায্য করেছেন উনি।সরকারি অনুদানের ব্যবস্থাও করেছেন।”

“হুম,”মাথা নেড়ে বলল ছফা। “কিন্তু আপনি কে, সেটা তাে বললেন না?” লােকটার দিকে স্থিরচোখে তাকাল ছফা। “আমি ঢাকা থেকে এসেছি  ঢাকার ডিবি অফিস থেকে। আমার নাম নুরে ছফা।”

কেয়ারটেকার একটু বিস্মিত হবার ভান করল। “কিছু হয়েছে নাকি আমাদের এখানে?”

বাঁকাহাসি ফুটে উঠল ছফার ঠোটে।“এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকেই জেনে নেবেন, যিনি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন আমাকে চোখে চোখে রাখার জন্য।”

অধ্যায় ২৪

স্টারের স্কুল থেকে সােজা নিজের হােটেল রুমে ফিরে এসেছে নুরে ছফা। হােটেল কামের ছােট্ট ঘরটায় পায়চারী করার মতাে জায়গা কমই আছে, তবুও সে পায়চারি করতে করতে একটা কথাই ভেবে যাচ্ছে—সুন্দরপুরে মাস্টার রমাকান্ত কামারের ঘর থেকে কী পাওয়া যেতে পারে। সে নিশ্চিত, সেলফোন অবশ্যই আছে। তবে সঙ্গত কারণেই সেটা লুকিয়ে রাখেন।  মাস্টার এখন খুবই শক্তিশালী মানুষ। যদিও ক্ষমতার দাপট দেখান না।নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেই নিমগ্ন থাকেন সব সময়। তারপরও তিনি যদি জেনে যান ছফা তার ঘরে চোর পাঠিয়েছিল তাহলে হয়ত এমপির কাছে নালিশ দেবেন। তাই ছফাকে এ ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। আতরকেও বলে দিয়েছে, খুব সাবধানে কাজটা করা দরকার।

এমন সময় দরজায় নক হলে ছফার ভাবনায় ছেদ পড়ল। “আতর?” “হ, স্যার।”দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠল ইনফর্মার। তার কণ্ঠের খুশিখুশি ভাবটা স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে।

নুরে ছফা দরজা খুলে দিলে আতর আলি রুমে ঢুকে পড়ল। কোনাে কিছু না বলে পকেট থেকে একটা কমদামি চাইনিজ মােবাইলফোন আর কিছু চিঠিপত্র বের করে আনল সে।

“এইলন,” এমনভাবে দু-হাতে ধরে রাখল ওগুলাে যেন দামি কোনাে উপহার তুলে দিচ্ছে।“কইছিলাম না বল্টুই পারব।”  ছফা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল ফোনটার দিকে। দ্রুত সেটা চালু করল সে। উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইল আতর আলি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হতাশা ভর করল ছফার চোখেমুখে। রেগেমেগে ফোনটা পেছনের অংশ খুলে ফেলল।

“ধুর!” প্রচণ্ড রাগে বলে উঠল সে। “কী হইছে?”আতর কিছুই বুঝতে পারছে না। “এটার তাে সিমই নেই।” “সিম নাই!”অবিশ্বাসে বলে উঠল ইনফর্মার। কনকি!” ছফা কিছু বলল না।

“সিম না থাকলে কি কুনাে কামে দিব না এইটা?”

আতরের দিকে তাকাল নুরে ছফা। ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মােবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টি, মানে আইএমইআই নাম্বার দিয়েও যে সিমের হদিস বের করা যায় সেটা এই স্বল্পশিক্ষিত ইনফর্মারকে বললেও বুঝবে না। তাছাড়া কাজটা করা একটু সময়সাপেক্ষ। সিম থাকলে অনেক সহজেই কল হিস্ট্রি বের করা যেত।

সিম নেই দেখে আতর মুখ বেজার করে বসে আছে।

এখন একটা ব্যাপারে ছফা নিশ্চিত—রমাকান্ত কামার নিজের মােবাইলফোনটা গােপন রাখেন, তারচেয়েও বড়ো কথা, সেই ফোনের সিম খুলে রাখেন নিরাপদ কোনাে জায়গায়। ভদ্রলােক এতটা সতর্ক কেন—এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে আছে— কারও সঙ্গে তার যােগাযােগের ব্যাপারটা যেন ফাঁস না হয়ে যায় তাই সদা সতর্ক থাকেন। আর এরকম। একজন মানুষই আছে—মুশকান জুবেরি!  মাস্টারের মােবাইলফোনটার ব্যাটারির পেছনে থাকা আইএমইআই নাম্বারটার ছবি তুলে রাখল নিজের মােবাইলফোনের ক্যামেরায়। তারপর যে চিঠিগুলাে বল্টু চুরি করে এনেছে সেগুলাের দিকে নজর দিল সে। একটু নেড়েচেড়েই বুঝতে পারল, সবগুলাে অফিসিয়াল চিঠি। খামের ওপরে প্রেরক আর প্রাপকের জায়গায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেখে সেগুলাে আর ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে করল না। নতুন স্কুল আর লাইব্রেরী দেবার মতাে বিশাল কর্মযজ্ঞ করতে গিয়ে বিভিন্ন সরকারি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তির সঙ্গে চিঠিপত্র আদান প্রদান করেছেন মাস্টার।  ‘মনে লয় মাস্টর টের পায়া গেছে,” অবশেষে বিজ্ঞের মতাে বলল আতর আলি।

“উনি কীভাবে টের পাবেন?”ছফা বিরক্ত হয়ে বললেও তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথে প্রথম দিন দেখা হয়ে যাওয়াটাই ভুল হয়ে গেছে। তাঁর উচিত হয়নি ওখানে যাওয়া। কে জানত, মাস্টার ওই সময় লাইব্রেরীতে থাকেন।

“হে অনেক বড়ো পণ্ডিত,” ব্যাখ্যা করতে শুরু করল ইনফর্মার। “সব কিছু আগে থেইক্যা বুইজ্যা ফালায়। মাথা তাে না যেন কমপিটার।”

ছফা কিছু বলল না। মাস্টার যে কাণ্ড জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। ফোনের ব্যাটারিটা আবার লাগিয়ে নিল সে।

“এখন তাড়াতাড়ি এগুলাে জায়গামতাে রেখে আসা দরকার।”

মােবাইল ফোনসহ চিঠিপত্রগুলাে ইনফর্মারের দিকে বাড়িয়ে দিল ছফা। এমন সময় দুটো খাম পড়ে গেল মেঝেতে। যেই না ও দুটো তুলতে যাবে আতর তখনই ছফার নজরে কিছু একটা ধরা পড়ল—দুটো খামের মাঝখানে ছােট্ট একটা চিরকুট আছে। উপুড় হয়ে নিজেই চিরকুটটা তুলে নিল। অন্য চিঠিগুলাের খামে ভরা থাকলেও এটার কোনাে খাম নেই। বাকিগুলাে কম্পিউটারে টাইপ করা হলেও চিরকুটটা হাতেলেখা। লেখাটা বেশ সুন্দর। মনােযােগ দিয়ে পড়ল সেটাঃ

সম্পদ-সম্পত্তি খারাপ মানুষের হাতে পড়লে দশের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। ভালাে মানুষের হাতে পড়লে মহৎ কিছুর জন্ম হয়। আপনি এ সম্পত্তি নিয়ে কী করবেন সে নিয়ে আমার মধ্যে কোনাে সংশয় নেই। শুধু ছােট্ট একটি অনুরােধ, রবীন্দ্রনাথকে চমৎকার একটি লাইব্রেরী বানাবেন। বইয়ের চেয়ে শক্তিশালী খাবার এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি!

ওই লাইব্রেরীটা যদি রবীন্দ্রনাথের নামে হয় তাহলে আমি ভীষণ খুশি হব।

একটা কথা মনে রাখবেন,এটা আমি আপনাকে দেইনি। রাশেদ জুবেরি তার জীবন বাঁচানাের জন্য আপনার কাছে চিরটাকালই কৃতজ্ঞ ছিল। সে হয়তাে মুখ ফুটে সেটা কখনও বলতে পারেনি।

ভালাে থাকবেন।

বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল ছফার ঠোটে।

অধ্যায় ২৫

স্কুল দেবার পর দুপুরের আগে কখনও নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন কিনা স্মরণ করতে পারলেন না মাস্টার রমাকান্ত কামার। এমনকি ছুটির দিনেও তিনি বিকেল পর্যন্ত স্কুল আর লাইব্রেরীতে গিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আজকে যে এর ব্যতিক্রম করলেন সেটার কারণ যুক্তিবুদ্ধি নয়, তার স্বজ্ঞা!

নুরে ছফার কিছু কথা, কিছু আচরণ তাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছেঃ রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরী দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিল আপনাকে ধন্যবাদ জানানাে —এরকম কথা কেন বলল ওই ডিবি অফিসার? সে কি কোনােভাবে টের পেয়ে গেছে, রাশেদের স্ত্রী, ওই মহিলা তার সঙ্গে যােগাযােগ করেছিল? সেজন্যে তার সন্দেহ, মহিলা আবারও যােগাযােগ করে থাকবে হয়তাে?

অসম্ভব! এ কথা সে কীভাবে জানতে পারবে? সবটাই কি তাহলে অহেতুক ভয়?  ডিবি অফিসার তার কাছে তার ফোন নাম্বারটা চেয়েছিল – আপনার নিজের কোনাে ফোন নেই? তিনি সচেতনভাবে সত্যি-মিথ্যে কিছুই বলেননি, এড়িয়ে গেছেন।

নুরে ছফা স্কুল থেকে চলে যাবার পরই রমাকান্ত কামার এই দোলাচলে দুলেছেন। তার। অন্তরাত্মা বলছিল, ওই চিরকুটটা রেখে দিয়ে মােটেও ভালাে কাজ করেননি। যদিও এতদিনে ওটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলেন।  অনেকক্ষণ স্কুলের অফিসে বসে থাকার পর হুট করেই উঠে পড়েন তিনি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, ছফা নামের ওই ডিবি অফিসারের ভাবসাব মােটেও ভালাে নয়। এক ধরনের আশঙ্কা করতে থাকেন তিনি, সেটা যে কী, নিজেও জানেন না। জরুরি একটা দরকারে বাসায় যাচ্ছেন বলে সােজা চলে আসেন নিজের বাড়িতে।

এখন ঘরেঢুকতে গিয়েই মাস্টার দেখতে পাচ্ছেন তার ঘরের তালাটা খােলা ! দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, এরপর আস্তে করে ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখে নিলেন। কেমন যেন একটা অনুভূতি হল তার। টের পেলেন, প্রচ্ছন্ন একটি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে তার পরিচ্ছন্ন ছােট্ট ঘরটাতে। তিনি যথেষ্ট সাফ-সুতরাে থাকেন। তার ঘরে আর যাই হােক, বাজে গন্ধ ভেসে বেড়ানাের কথা নয় – গাঁজার গন্ধ তাে দুরের কথা!  দেখে মনে হচ্ছে, ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তারপরও পকেট থেকে চাবি বের
ড্রয়ারটা খুলতে গিয়ে দেখলেন, সেটাও খােলা আছে ঠিক দরজার তালাটার মতােই!
ড্রয়ারটা খুলে দেখলেন এবার। যে আশঙ্কা করেছিলেন সেটাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে: জরুরি অনেক চিঠিপত্রের সঙ্গে তার মােবাইলফোনটা নেই! তারচেয়েও বড়ো কথা, ওই চিরকুটটাও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে!

মাস্টারের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। আইনের লােক হয়ে বেআইনিভাবে আর-একজন মানুষের ঘরে চোর পাঠিয়ে তার কাগজপত্র হাতিয়ে নেবার জন্য মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হলেন। তিনি নিশ্চিত, ওই নুরে ছফা লােকটি সম্ভবত আতর আলিকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে। এক সময় ওই লােকের পেশা তাে চুরিই ছিল। যে কোনাে সময় পুরােনাে পেশায় ফিরে যাওয়াটা তার জন্য এমন আর কী।  রমাকান্ত কামার চুপচাপ নিজের বিছানায় বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। গভীর করে নিশ্বাস নিলেন। তিনি যে বুদ্ধের মতাে অক্ৰোধি সেটা দাবি করেন না, তবে সজ্ঞানে সব সময়ই চেষ্টা করেন রেগে না যেতে। কিন্তু এ মুহূর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর উটকো এক লােক এসে সব কিছু তছনছ করে দেবার পায়তারা শুরু করে দিয়েছে।

এই নুরে ছফা লােকটা কি সুন্দরপুরে পা রাখার পর জমিদার বাড়িটা পুড়ে খাক হয়ে যায়নি?নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে মাস্টার রমাকান্ত কামার বেশ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন, ঠিক যেভাবে কোনাে মা তার সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, আগলে রাখার চেষ্টা করে। কতােক্ষণ বিছানায় মূর্তির মতাে বসেছিলেন তিনি জানেন না। কিছু একটা শব্দ পেয়ে সংবিৎ ফিরে পেলেন।

কেউ তার বাড়ির আঙিনায় পা রেখেছে!  জন্ম থেকে আজ অবধি, আশি বছর ধরে এ বাড়িতে বাস করছেন, বাড়িটা তার দেহেরই অংশ হয়ে গেছে। এখানকার সব কিছু যেন তার সঙ্গে কথা বলে। কেউ তার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখলে তিনি টের পেয়ে যান – যেন কেউ তার শরীর স্পর্শ করছে!

রমাকান্ত কামার আস্তে করে উঠে আলনার পেছনে গিয়ে কাপড়চোপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন, কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলেন, দরজা ঠেলে সতর্ক পদক্ষেপে ঘরে ঢুকল এক কিশাের। ছেলেটাকে চিনতে কোনাে সমস্যাই হল না তার। সুন্দরপুরের সবাই তাকে চেনে, তার নাম জানে। খারাপ সঙ্গ আর মাতৃপিতৃহীন এই ছেলেটি অকালেই নষ্ট হয়ে গেছে।

আড়াল থেকে তিনি দেখলেন, বল্টু তার সব কাগজপত্রের সঙ্গে মােবাইলফোনটাও ড্রয়ারে রেখে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে বের হয়ে গেল। তারপরই শুনতে পেলেন, বাইরে থেকে দরজার তালা লাগাচ্ছে সে।

“তালা মারার দরকার নেই… আমি ঘরে আছি!”আড়াল থেকে বের হয়ে রমাকান্ত কামার বেশ শান্তকণ্ঠে বললেন।  এরপর শুধু দৌড়ে চলে যাবার শব্দটাই শুনতে পেলেন তিনি।

প্রচণ্ড রাগ হল তার। বিছানায় বসে কয়েক বার গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলেন। পাজামার পকেট থেকে চশমার কেসিংটা বের করে সেটার ভেতর থেকে একটা সিম বের করে আনলেন এবার। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে তাতে সিমটা ভরলেন। কিছুক্ষণ পর একটা নাম্বারে ডায়াল করলেন মাস্টার।

একজনের সঙ্গে জরুরি কথা বলা দরকার।

অধ্যায় ২৬

সুরত আলির সানমুন হােটেলে বসে বসে সিগারেট ফুকছে, আর আতরের জন্য অপেক্ষা করছে ছফা।

একটু আগে ইনফর্মার মাস্টারের ফোনসহ চিঠিপত্রগুলাে নিয়ে চলে যাবার আগে তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মাস্টারের ফোন নম্বরটা জোগাড় করে নিয়ে আসছে সে।

হাতঘড়িতে সময় দেখল ছফা। বুঝতে পারছে না, আতর আলি কোত্থেকে মাস্টারের নাম্বারটা জোগাড় করবে। ধোঁয়ার কারণে ঘরটা গুমােট হয়ে গেছে, জানালাটা খুলে দিয়ে আর-একটা সিগারেট ধরাল। এখন সে পুরােপুরি নিশ্চিত। মাস্টারের সঙ্গে মুশকান জুবেরির যােগাযােগ আছে। তার অনুরােধেই লাইব্রেরীটার নাম রাখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। অথচ মাস্টার তার কাছে এটা স্বীকার করেননি। কী সব পুরােনাে ইতিহাস কপচে গেছেন।দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আবারও তার রুমের দরজায় টোকা পড়ল।

“আসাে।”

হাসিমুখে ঘরে ঢুকেই আতর আলি বলে উঠল, “নাম্বার তাে পায়া গেছি, স্যার।” – “তাই নাকি?!” দারুণ অবাক হল ছফা। “এত দ্রুত কীভাবে জোগাড় করলে?”

দাঁত বের করে হাসল ইনফর্মার। যেন ছফার বিস্ময় উপভােগ করছে, সেই সঙ্গে নিজের কেরামতি দেখাতে পেয়ে বেশ খুশি।

“মাস্টর ফোন লুকায়া রাখবার পারে, সিমও খুইল্যা রাখবার পারে,”রহস্যের ভঙ্গিতে বলে যেতে লাগল সে, “কিন্তু ফোনে তাে ট্যাকা ভরনই লাগে, লাগে না?”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। তার মাথায় এটা আগে আসেনি। মনে মনে ইনফর্মারের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না। মুচকি হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ফোনে ব্যালান্স ভরার জন্য মাস্টারকে নাম্বারটা দিতেই হয়। “তাইলেই বুঝেন।” হেসে ফেলল সুন্দরপুরের বিবিসি খ্যাত আতর আলি। “এইহানে তাে ফোনের দোকান একটাই…আমাগাে শামসু মিয়া চালায়, হের লগে আমার আবার হট টেরাম।” চরম।

মনে মনে আর-একবার ইনফর্মারের বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না সে। “মাস্টরের একটা পােলা আছে। স্কুলে কাম করে। ওই পােলায় মাজেমইদ্যে ফোনে

টাকা ভরনের লাইগ্যা শামসুর দোকানে যায়। হের তাে নিজের ফোন নাই  আমি শিয়াের, নম্বর দুইটা মাস্টরেরই হইব।”

“দুটো নাম্বার?”আশাহত হল ছফা।

“হ, স্যার। পােলাটা দুইটা নাম্বারে ট্যাকা ভরে। ওয় হইল মাস্টরের ডাইন হাত , কথাটা বলেই ছােট্ট একটা ময়লা কাগজ বের করে ছফার দিকে বাড়িয়ে দিল সে।

কাগজটা হাতে নিয়ে দুটো ফোন নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইল নুরে ছফা। নাম্বার দুটি একই টেলিকমের। তার মন বলছে, এই নাম্বার দুটোর একটা অবশ্যই মাস্টারের—আবার দুটো নাম্বারও তিনি ব্যবহার করতে পারেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এই নাম্বার দুটো থেকেই জানা যাবে মুশকান জুবেরির ফোন নাম্বারটা—যদি মাস্টারের সঙ্গে তার যােগাযােগ থেকে থাকে!

সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে তার সহকারি জাওয়াদের নাম্বারে ডায়াল করল সে।

সুন্দরপুর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে!  হনহন করে হেঁটে টাউনের বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে ভাবল
বল্টু।কি ভয়টাই না পেয়েছিল সে। রাতবিরাতে ভূতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেও এতটা ভয় পেত কিনা সন্দেহ। যে ঘরে কোনাে মানুষ নেই, পুরাে ফাঁকা দেখেছে, পনেরাে-বিশ মিনিট পরই সেখানে মাস্টার কীভাবে চলে এল সে জানে না।  একটু আগে আতর আলির কাছ থেকে মাস্টারের ঘর থেকে চুরি করা জিনিসগুলাে আবার রেখে যেতে গেছিল জায়গামতাে।তখনও সবই ঠিকঠাক ছিল, পুরাে ভিটেটা ছিল শুনসান। কাজের সুবিধার্থে সে মাস্টারের ঘর আর ড্রয়ারের তালা দুটো আর লাগায়নি। ধরেই নিয়েছিল এটা করার দরকার নেই। একটু পরই তাে চুরি করা জিনিসগুলাে জায়গামতাে রেখে দিতে হবে। কিন্তু জিনিসগুলাে জায়গামতাে রেখে যেই না দরজা লাগাতে যাবে, অমনি ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের গম্ভীর কণ্ঠটা বলে ওঠে—দরজা লাগানাের দরকার নেই! !

এটা কীভাবে সম্ভব হল?! বল্টুর মাথায় ঢুকছে না। এখনও তার বুক ধরফর করছে। কী দৌড়টাই না দিয়েছিল। পড়িমরি করে দৌড়ােতে গিয়ে পড়ে গেছিল সে,শরীরের কয়েক জায়গায় ছিলেও গেছে। কিছুক্ষণ তাে মনেই হয়েছিল, কণ্ঠটা মাস্টারের নয়, ভূতের!

বল্টুর স্পষ্ট মনে আছে, মাস্টারের ঘরে দ্বিতীয় বারের মতাে যখন ঢুকল তখনও ঘরে কাউকে দেখেনি। মুহূর্তে কী করে ওখানে একজন চলে এল? কণ্ঠটা ভূত হলে তার বিপদ কমই হবে, কিন্তু সে ভালাে করেই জানে ওটা মাস্টারের কণ্ঠস্বর। তার মানে, আগামী কয়েক সপ্তাহ সুন্দরপুরে না থাকাই ভালাে। সে এমন মানুষের ঘরে চুরি করেছে, যাকে এখানকার এমপি পর্যন্ত সালাম দেয়, সম্মান করে। এমপির ছেলেপেলেগুলাে তার হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে বেদম পেটাচ্ছে- এরকম একটি দৃশ্য ভেসে উঠল বল্টুর চোখে। নিশ্চয় তার মুখ থেকে সবকথা বের না করা পর্যন্ত চলবে এই পিটুনি। এক পর্যায়ে সব কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হবে সে।

বাসস্টেশনে আসতেই তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা চলে এল পালিয়ে গেলে বিপদ কমবে না, বাড়বে। তারচেয়ে বরং সুন্দরপুরে ফিরে যাওয়াই ভালাে। কী করলে এ মাত্রায় রেহাই পাবে সেই বুদ্ধিটাও চট করেই মাথায় এসে গেছে।

উলটো পথে হাঁটতে শুরুকরল বল্টু।মনে মনে একটাই প্রতিজ্ঞা করল,এজীবনে আর কখনও আতর আলির কাজ করবে না।

অধ্যায় ২৭

দুপুরে খেয়েদেয়ে সুরুত আলির হােটেল সানমুনের ছােট্ট ঘরটায় পায়চারি করছে নুরে ছফা। আজকে তার হােটেল রুমেই খাবার পাঠিয়েছে মুশকানের মালিক ফজলু। এটা যে আতর আলির কাজ, বুঝতে বাকি নেই তার।

যাই হােক, আতরের সংগ্রহ করা দুটো সেলফোন নাম্বার হাতে পাবার পর কাজটা সহজ হয়ে গেছে এখন।নইলে আইএমইআই নাম্বার দিয়ে প্রথমে সিমের হদিস বের করা লাগত, তারপর সেই সিম দিয়ে মাস্টার কোন কোন নাম্বারে ফোন করেছেন, তাকেই বা কোন কোন নাম্বার থেকে কল করা হয়েছে সেসব বের করা হত।

এখন এসবের দরকার নেই। জাওয়াদকে নাম্বার দুটো দিয়ে বলে দিয়েছে, কার নামে সিম দুটো রেজিস্টার্ড করা। আর সেগুলাে থেকে বিগত এক মাসে যেসব নাম্বার থেকে আউটগােয়িং-ইনকামিং কল করা হয়েছে—সবকিছু জেনে নিতে হবে।কাজটা সময়সাপেক্ষ হলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর পিএসের কল্যাণে দ্রুততম সময়েই করা যাবে।

সে এখন অপেক্ষা করছে জাওয়াদের ফোনের জন্য। তার উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠে গেল ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই। সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করতে যেয়ে থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।একটা অপরিচিত নাম্বার। মেজাজ বিগড়ে গেল তার। দরকারের সময় এরকমটা হলে মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনা।কলটা রিসিভ করে ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল, “হ্যালাে  কে বলছেন?”

“আপনে ক্যারে! উসমান কই?” ফোনের ওপাশ থেকে একটা খসখসে কণ্ঠ বলে উঠল।

“আপনি ভুল নাম্বারে ফোন দিয়েছেন।” “আপনে ক্যাঠায়… অ্যা?কই থাহুন?”

ছফার মেজাজ গেল বিগড়ে। “ফোন রাখ বানচোত!” কলটা কেটে দিয়ে জোরে জোরে সিগারেটে টান দিতেই আবার বেজে উঠল সেটা, তবে ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখে তার সমস্ত রাগ কৌতূহলে পরিণত হল। “হ্যা, জাওয়াদ… .বলাে?”

“স্যার, আশেক সাহেবের রেফারেন্স ভালােই কাজে দিয়েছে,” ওপাশ থেকে ডিবির জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর বলে উঠল। “খুব দ্রুতই অনেক ইনফো কালেক্ট করেছি। দুটো সিমই শ্যামলকুমার দাস নামে রেজিস্টার্ড করা  মদনগঞ্জের ঠিকানা দেওয়া আছে। আমি
লিংক করে দেখেছি, ওটা সুন্দরপুরের খুব কাছেই।”

“হুম,”বলল নুরে ছফা।

ওই দুটো সিম থেকে বিগত এক সপ্তাহে যেসব আউটগােয়িং-ইনকামিং কল করা হয়েছে তার সবকিছু আমি আপনাকে মেইল করে দিয়েছি।”

“এক মাসের কল-হিস্ট্রিও আমার দরকার হবে।” “ওটা করতে একটু সময় লাগবে। কালকের মধ্যে দিতে পারব আশা করি।” “ওকে।”

“স্যার, একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, দুটো নাম্বার দু-জন মানুষ ব্যবহার করে,” জাওয়াদ বলল।

“কীভাবে বুঝলে?”আগ্রহী হয়ে উঠল ছফা। “নাম্বার দুটো নিজেদের মধ্যেও কল করেছে কয়েক বার।”

“আচ্ছা,”মাথা নেড়ে সায় দিল সে। “ঠিক আছে, যত দ্রুত পারাে বাকি ইনফোগুলাে পাঠিয়ে দিয়ো।”

“ওকে, স্যার।”

ফোনটা রেখে জানালার বাইরে তাকাল। দুটো নাম্বার দু-জন মানুষ ব্যবহার করে! শ্যামল কুমার দাস। মনে মনে বলে উঠল সে। কে হতে পারে এই লােক? মাস্টারের আত্মীয়?

আতর আলিকে কল দিল এবার। “শ্যামল কুমার দাস নামের কাউকে তুমি চেনাে?”

“আরে, আমি যে পােলার কথা কইছিলাম আপনেরে, তার নামই শ্যামল! মাস্টরের ডাইন হাত।”

“যে ছেলেটা ফোনের ব্যালান্স ভরে?”

“ও তাহলে স্কুলের কর্মচারী,” প্রশ্নের মতাে করে বলল না ডিবির নুরে ছফা। “হ। মাস্টর ওরে দিয়াই সব কাম করায়।” “তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।” “ওই হালারপুতেরে ধরবেন্নি, স্যার?”

“হ্যা।” নম্বর দুটো কে বা কারা ব্যবহার করে, সেটা বের করার সহজ উপায় হল শ্যামলের স্বীকারােক্তি। যদিও সে নিশ্চিত, একটা নাম্বার অবশ্যই মাস্টার রমাকান্ত কামার ব্যবহার করেন। কিন্তু ছেলেটাকে স্কুলে গিয়ে ধরতে চাইছে না সে।যদিও, চাইলে এখানকার যে কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তারপরও, স্কুলের বাইরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলেটা নাজুক অবস্থায় থাকবে। কারাের কাছ থেকে সত্য কথাটা বের করার সময় ভঙ্গুর আর নাজুক নার্ভই বেশি কার্যকরী।

“কিন্তু স্কুলে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলাটা ঠিক হবে না। স্কুলের বাইরে ধরতে হবে ওকে।

“ওই পােলায় রােজ বিকেলে ফজলুর হােটেল থিকা কার লাইগা যেন খান লইয়া যায়,”আতর জানাল।

“তাহলে তুমি আর আমি একটু পরেই চলে যাব রহমান মিয়ার দোকানে ওখান দিয়েই যাবে, নাকি?”  “হ, স্যার, ”বলল আতর।

“তাহলে তুমি আমার হােটেলে চলে আসাে একটু পর।”

অধ্যায় ২৮

রহমান মিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, বেচা-বিক্রি ভালাে হয়নি আজ। শহর থেকে কোনাে কাস্টমারও আসেনি বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই রেস্টুরেন্টের খোঁজে। এরকম কেউ চলে আসার পর যখন দেখে ওটা লাইব্রেরীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তখন খুবই অবাক হয়, সবচেয়েও বেশি হয় হতাশ।রহমান তখন আগ বাড়িয়ে তাদের হতাশা দূর করে দেওয়ার কাজটা করে-“ওই হুটেল তাে এহন টাউনে সইরা গেছে…এইখান থিকা রিস্কা দিয়া গেলে দশ টাকা নিব।”

এমন কথায় বেশ কাজে দেয়। খাদ্যরসিকেরা এত দূর এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যায় না। তারা রহমানের নির্দেশনা পেয়ে খুশিমনে চলে যায় হিটলুুর ওই রেস্টুরেন্টে। কেউ কেউ এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দোকানিকে উপকারের প্রতিদান দেয়, কেউ বা হাসিমুখে ধন্যবাদ দিয়ে রিকশা ধরে-তাতে অবশ্য রহমানের কোনাে আক্ষেপ থাকে না। প্রতিটি কাস্টমারের জন্য হিটলুু তাকে দশ টাকা করে দেয়।

রহমান অবাক হয়ে লক্ষ করেছে, এখন পর্যন্ত কোনাে কাস্টমারই হিটলুুর চালাকিটা ধরতে পারেনি। জমিদারের বউয়ের রেস্টুরেন্টের নামটা হুবহু নেয়নি সে, কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল, খেতে এসে কোনাে খাদ্যরসিক ‘খেতে-টা যে নেই, সেটাই লক্ষ করে না। বড়ােজোর পুরােনাে কাস্টমাররা বলে, আগের মতাে আর অতাে স্বাদের হয়না খাবারগুলাে। তবে একদম নতুন যারা আসে, তারা সেটাও বুঝতে পারে না।  তিক্ত মুখে রহমান ওয়াক করে থুতু ফেলল দোকানের পাশে। আর তখনই শব্দটা কানে গেল তার। আতর আলি আসছে মােটরসাইকেলে করে। তার পেছনে বসে আছে শহর থেকে আসা পুলিশের সেই লােকটি। সুন্দরপুরে যে আবারও খারাপ কিছু ঘটবে সেটা নিশ্চিত। তারপরও আপাতত দু-জন কাস্টমার পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

বাইকটা দোকানের সামনে এসে থামতেই শহুরে লােকটা নেমে গেল আস্তে করে। “রহমান মিয়া, কেমন আছেন?” “ভালা, ছার। আপনে কিমুন আছেন?”বিগলিত হাসি দিয়ে বলল দোকানি।

আমি ভালাে আছি। তা, আপনার ব্যাবসা কেমন চলছে?” নুরে ছফা দোকানের সামনে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল।

ব্যাবসা মন্দা  কাস্টমার নাই,” হাসিমুখটা আবারও বেজার করে বলল টঙের
মালিক।

“আমাগাে কি কাস্টমার মনে করাে না তুমি?”বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে বলল, আতর আলি।

‘তা ক্যান মনে করুম না। আমি কইতাছি সারাদিনের কথা।”

“হুম,”আতর বিজ্ঞের মতাে বলে বসে পড়ল ছফার পাশে। “এহন পেচাল ছাইরা  দুই কাপ গুড়ের চা বানায়া ফালাও জলদি।”  “প্যাচাল পাড়লাম কুনহানে?” মর্মাহত হল রহমান। “তুমার খালি আজাইরা কথা, এই বলে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

“মাস্টর কী ওইহানে আছেনি?”রাস্তার অপর পাশে রবীন্দ্রনাথের দিকে ইশারা করে বলল ইনফর্মার।

“হ, বিকালে তাে ওইহানেই থাহে,” চামচ নেড়ে নেড়ে চায়ের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে বলল রহমান। “সারা দিন স্কুলে কাম করার পরও মাস্টর জিরায় না….এইহানে আহে আবার। বিয়াশাদিও তাে করে নাই, বাড়িত গিয়া করবােটা কী।” কথাটা বলে ছফা আর আতরের দিকে কাপ দুটো বাড়িয়ে দিল। “আপনেরা কি স্কুলে যাইবেন্নি ?”  রহমানের প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত হল আতর। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল—আদার ব্যাপারী তুমি, এত জাহাজের খবর লও ক্যান,কিন্তু সে প্রসন্নভাবে হেসে বলল, “না….শ্যামলরে একটু দরকার আছিল। হেরে দেখছনি?”

শ্যামলের কথা শুনে রহমানের ভ্রু কুঁচকে গেল।“হেরে আবার কী দরকার?” – “সব কথা তােমার জানন লাগব, না?” এবার আর বিরক্তি লুকাল না ইনফর্মার। “সুন্দরপুরের বিবিচি হইবার চাও মনে হইতাছে।”  “ওইসব হওনের কুনাে শখ আমার নাই,”আস্তে করে বলল রহমান। “নিজের কাম নিয়া থাহি, অইন্যের খবর জাইন্যা আমার কী লাভ!”

আতর কিছু বলতে যাবে কিন্তু ছফার চোখের ইশারা পেয়ে থেমে গেল।

“শ্যামল কি স্কুল থেকে বের হয়েছে?” নুরে ছফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল। – গাল চুলকাল রহমান। “হেয় তাে একটু আগে ওইদিকে গ্যাছে,” টাউনের দিকটা দেখিয়ে বলল সে।

“কতক্ষণ আগে?”

“দশ-পােনের মিনিট তাে হইবই।”

নুরে ছফা আর আতর আলি একে অন্যের দিকে তাকাল। রহমানের টঙে বসেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল তারা।

চা শেষ করেছফা যখন সিগারেট ধরাবে,তখনই আতর তাকে ইশারা করল সুন্দরপুরের মহাসড়কের দিকে। এক তরুণ হাতে পলিব্যাগ নিয়ে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

ইশারা পেয়েউঠে দাঁড়াল আতর। তাকে রাস্তার দিকে যেতে দেখে রহমান মিয়ার তুহলী চোখ স্থির হয়ে রইল যেন। ছেলেটাকে ইশারায় ডাকল ইনফর্মার। অবাক হল শ্যামল।

রহমান মিয়া এখন চোখের পলক ফেলছে না। পুরাে নাটকটার এক মুহূর্তও মিস করতে চাইছে না সে-রসিয়ে রসিয়ে মানুষের কাছে যখন গল্পটা বলবে, তখন যেন একটুও খামতি না থাকে। শ্যামল কিছুটা ভীরু পায়ে এগিয়ে এল আতরের কাছে। ঠিক তখনই রহমান মিয়ার দোকানে নুরে ছফাকে দেখতে পেল। এই লােক যে পুলিশ এরইমধ্যে জেনে গেছে সে। তার চোখেমুখে ভয় জেঁকে বসল।

এই যে, আমাগাে ছফা স্যার,”রহমানের দোকানের কাছে এসে বলল আতর আলি। সলাম দে স্যাররে।” ধমকে উঠল শ্যামল নামের ছেলেটাকে। “তরে কিছু পুছতাছ করবাে…ভালায় ভালায় সব কইবি, ঠিক আছে?”

শ্যামল ভ্যাবাচ্যাকা খেল। রহমানের দিকেও তাকাল চকিতে। দোকানি হঠাৎ করেই গুড়ের পিণ্ডের ওপর থেকে মাছি সরানাের কাজে ব্যস্ত হবার চেষ্টা করল, কিন্তু একটা মাছিও নেই সেখানে।

“তােমার নাম কি শ্যামল ?”নুরে ছফা সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইল। “হ,” ছেলেটা ঢোঁক গিলল। “তুমি মাস্টারের স্কুলে কিসের কাজ করাে?” “আ-আরদালির,” ছেলেটা নার্ভাস ভঙ্গিতে জবাব দিল।

ছফা আর প্রশ্ন না করে পকেট থেকে এক টুকরাে কাগজ বের করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিল। “এই নম্বর দুটো কার?”

কাগজটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল শ্যামল, যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।

“তাের তাে নিজের ফোন নাই, তাইলে এইগুলান কার নাম্বার?” চোখমুখ শক্ত করে বলল আতর।

শ্যামল আস্তে করে আবারও ঢোক গিলল।

“তুই এই নম্বরে ট্যাকা ভরােস। ভালা কইরাই জানােস কার নাম্বার এইগুলা। না চিনার তাে কথা না।”  “চিনুমনা ক্যান, আজিব,”
ঢোক গিলে বলল ছেলেটা।“এইগুলা আমাগাে মাস্টার কাকা

আর দিদির নম্বর।”

আতর আর নুরে ছফা দৃষ্টি বিনিময় করল।

দিদি?”ইনফর্মারই প্রশ্নটা করল অবশেষে।“কার কথা কস”

ওহ যে, আমাগাে গানের টিচার  এইটা ওই দিদির নম্বর।” দুটো নম্বরের একটা দেখিয়ে বলল শ্যামল।

“কিন্তু এই সিম দুটো তো তােমার নামে রেজিস্টার্ড করা।” ছফার দিকে অবাক হয়ে তাকাল শ্যামল। “হ, আমিই কিনছিলাম আমার কার্ড দিয়া।” “তাদের সিম তুমি কেন তােমার নামে কিনলে?”

“মাস্ট কাকা তাে আইডিকার্ড হারায়া ফেলছেন সেই কবে। ঢাকায় গেছিলেন, বাসে কইরা ফিরার সময় ব্যাগ হারায়া ফেলছিলেন, হের পর আর কার্ড তােলেন নাই।”

ছফা ছেলেটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “আর তােমাদের গানের টিচার? তারও কি আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে?”

“দিদি তাে শান্তিনিকেতন থেইকা আসছে, তার কেমনে কার্ড থাকব?” “হুম।”মাথা নেড়ে সায় দিল সে। কথাটা আগেও শুনেছে।

“এইজন্যেই মাস্টকাকা আমারে কইল আমি যেন আমার আইডি দিয়া দিদির জইন্যও একটা সিম কিইন্যা দিই।”  “ব্যাটা, তুই এক নামে এতগুলান সিম কিনছােস ক্যান, অ্যা? কাহিনি কী?” ধমকের সুরে বলল আতর।  “একটা কার্ড দিয়া সাতটা সিম কিনা যায়…এইটা সরকারি নিয়ম,”ব্যাখ্যা করে বলল। শ্যামল।  আতর কিছু বলার আগে তাকে ইশারায় থামিয়ে দিল ছফা। ছেলেটা মিথ্যে বলেনি। একটা কার্ড দিয়ে সর্বোচ্চ সাতটা সিম কেনা যায়। ফালতু নিয়ম! মনে মনে গজ গজ করল সে।‘কার জন্য এই খাবার নিয়ে যাচ্ছ?” ছেলেটার হাতে থাকা পলিব্যাগের দিকে ইশারা করল।

“এইগুলান দিদির  ফজলুর হােটেলের ক্র্যামচপ দিদি খুব পছন্দ করে।”

“ঠিক আছে, তুমি যাও,” ছফার আর কিছু জানার নেই এই ছেলের কাছ থেকে।

তবে আতরকে দেখে মনে হল সে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শ্যামলকে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ভাবছিল। এত দ্রুত এই পর্ব শেষ হবে আশা করেনি।

ছেলেটা চুপচাপ চলে গেল, একবার পেছনে ফিরেও তাকাল সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে।

“পােলাটা মাস্টরের কিমুনজানি আত্মীয় হয়,”রহমান মিয়া বলে উঠল এবার, অনেকক্ষণ ধরে চুপ ছিল সে। “গানের মাস্টার্নিও মনে লয় মাস্টরের আত্মীয়। হিন্দু মানুষ তাে, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন থাকবারই পারে।”

ছফা কিছু বলল না।রহমান মিয়া হয়ত নির্দোষ ভাবেই কথাটা বলেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে দোকানিকে দিয়ে এবার আতরকে বলল, “তুমি এখানেই থাকো, আমি আসছি।”

ইনফর্মার কিছু জানতে চেয়েও চাইল না। সে দেখতে পেল নুরে ছফা রাস্তা পার হয়ে রবীন্দ্রনাথের দিকে যাচ্ছে।

অধ্যায় ২৯

পড়ন্ত বিকেলে রমাকান্ত কামার নিজের অফিসে বসে আছেন। প্রায় প্রতিদিনই স্কুল থেকে বের হয়ে সুন্দরপুর মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এই রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগারে গিয়ে বসেন। এখানে সময় কাটাতে তার অদ্ভুত রকমের আনন্দ হয়।

দিন দিন লাইব্রেরীর সদস্য বাড়ছে, বাড়ছে পড়ুয়াদের আগমন। নিত্য নতুন বইয়ের খোঁজ করে তারা। মাস্টার সে-সব টুকে রাখেন, মাস শেষে সেখান থেকে বাছাই করা বইগুলাে সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। যে বইগুলাে যুগ যুগ ধরে আগলে রেখেছিলেন, সেগুলাের একটা সদগতি হয়েছে দেখাটা তার কাছে ভীষণ আনন্দের। তারচেয়েও বেশি আনন্দ পান যখন দেখেন অল্পবয়সিরা সে-সব বই পড়ছে। ছােট্ট একটা কামরায় বসে জানালা দিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখেন পড়ুয়াদের।

এ মুহূর্তেও তিনি সেটাই করছেন, কিন্তু আজকে সেই আনন্দে ভাটা পড়েছে খানিকটা। আইনের লােক হয়ে তার ঘরে চোর পাঠিয়েছে। কিছু জিনিস ফিরিয়ে দিলেও ওই চিরকুটটা আর ফেরত দেওয়া হয়নি। এটা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হলেও মাস্টারের মানসপটে ভেসে উঠল কিছু দগদগে স্মৃতি।

সদ্য ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছেন। দিনের বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকেন শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি পাঠাগারে। তার কাছে সুন্দরপুরের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল ওটাই। কী মনােরম পরিবেশ! বিশাল এক বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার নীচে অবস্থিত দোচালা ঘরের মাঝারি আকৃতির একটি পাঠাগার। দু-পাশে অসংখ্য জানালা, সেই জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যেত দেখা যেত সুন্দরপুরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমেও সুশীতল বাতাসের কমতি ছিল না। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।বইয়ে ডুবে থাকার জন্য চমৎকার একটি জায়গা।

তারপরই একদিন শুরু হল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। সুন্দরপুর থেকে হাজার মাইল দূরে কাশ্মীর নিয়ে দুই প্রতিবেশীর লড়াই। সেই লড়াইয়ের হিংস্র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল সুন্দরপুরেও। চারদিকে ফিশফাশ শােনা যেতে শুরু করল। এক বিকেলে বাল্যবন্ধু কিসমত জানাল, তার কাছে নাকি পাক্কা খবর আছে। আজ সন্ধ্যায় মুসলিমলিগার হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে একদল দাঙ্গাবাজ লােক রবীন্দ্রনাথ-এর নামনিশানা মুছে দেবে—সেরকমই পিরকল্পনা। থানার পুলিশকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা যেন চোখকান বন্ধ রাখে!

রমাকান্ত কামারের বুক ভেঙে গেছিল কথাটা শুনে। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না হিংস্র আর ধর্মান্ধ রাজনীতির শিকার হতে পারে একটা লাইব্রেরী! তারপরই মনে পড়ে গেল, যারা দেশ চালাচ্ছে তারা কোন প্রকৃতির মানুষ। এরাই কি ক্ষমতায় আসার পর রবীন্দ্রসংগীতকে নিষিদ্ধ করার মতাে জঘন্য কাজ করেনি? বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিককে শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করেনি, শুধুমাত্র হিন্দু হবার কারণে? যদিও মুখ আর ধর্মান্ধ গুলাের জানা ছিল না, কবিগুরু ধর্মে ছিলেন ব্রাহ্ম! হিন্দু আর ব্রাহ্মর মধ্যে তফাত বােঝার মতাে মানুষ অবশ্য তারা ছিল না।

রমাকান্তের আরও মনে পড়ে গেল সেই বিকেলের শেষ দিকে, কিসমতকে নিয়ে তিনি কী করেছিলেন। তারা দুই বন্ধু গেছিলেন জমিদার অলােকনাথের সঙ্গে দেখা করে এ কথাটা বলার জন্য। সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বয়ােজ্যেষ্ঠ জমিদার বলেছিলেন, তিনি কীই বা করতে পারবেন! নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েই এখন চিন্তিত, লাইব্রেরী নিয়ে ভাবার সময় কই!

জমিদারের এমন অসহায় অবস্থা দেখে রমাকান্ত কামার আর দেরি করেননি, একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন দ্রুত। কিসমতকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করার কাজে। লুটেরা আর দাঙ্গাবাজদের হিংস্র আগুনে রবীন্দ্রনাথ পুড়ে যাবার আগেই ওটার মূল্যবান সম্পত্তিগুলাে রক্ষা করতে হবেঃ দেশ মানে যদি মৃন্ময় না হয়ে চিন্ময় হয়ে থাকে, তাে গ্রন্থাগার মানে দোচালার একটি ঘর নয়, এর সমস্ত বইগুলাে!  চটের বস্তায় সেই বইগুলাে ভরে, খেতের আইল ধরে মাথায় করে দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে গেছে তারা দুই বন্ধু। এভাবে সন্ধ্যার আগে রবীন্দ্রনাথ যখন অর্ধেক রক্ষা করে ফেলল তখনই দূর থেকে দেখতে পায় আগুনের মশাল নিয়ে দাঙ্গাবাজেরা ধেয়ে আসছে।

অ্যাকশন অ্যাকশন! ডাইরেক্ট অ্যাকশন! ভারতের দালালেরা নিপাত যাক নিপাত যাক!

এমন শ্লোগান তাদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। রমাকান্ত কামার আর তার বন্ধু কিসমত অসহায়ের মতাে শেষ একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তারপরও, কিন্তু এক বস্তার বেশি বই সংগ্রহ করার আগেই হিংস্র লােকগুলাে চলে আসে রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে। ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয় কিসমত। অবশ্য দরজা খােলার চেষ্টাও করেনি দাঙ্গাবাজেরা। তারা লাইব্রেরীর চারপাশে কেরােসিন ঢেলে নিজেদের হাতের মশালগুলাে নিক্ষেপ করতে থাকে ঘৃণ্য উল্লাসে। কেউ কেউ জানালা ভেঙে ভেতরেও ছুঁড়ে মারে আগুনের মশাল। দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ!

রমাকান্ত কামার আর কিসমত পেছনের একটা জানালা ভেঙে এক বস্তা বই নিয়ে বের হতে সক্ষম হয়। তারা যখন মাথায় বস্তা নিয়ে একটু দূরে খেতের আইলের ওপর দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকায়, দেখতে পায় সন্ধ্যার ফিকে হয়ে আসা আলােকে সমৃদ্ধ করে জ্বলন্ত চিতার মতােই জ্বলছে রবীন্দ্রনাথ!

বইরক্ষা করতে না পারার আক্ষেপটা সারা জীবন তাকে পীড়া দিয়ে গেছে।

তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশাল পরিমাণের বই রক্ষা করার আনন্দটাও কম ছিল না।জানালাটা দিয়ে লাইব্রেরীর ভেতরে আর-একবার চোখ বুলালেন রমাকান্ত। এর অজস্র নতুন বইয়ের ভিড়ে সেই সব দুষ্প্রাপ্য বইগুলাে এই গ্রন্থাগারের শােভা বর্ধন করছে।

একাত্তরে পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ,ধরেই নিয়েছিলেন, সংগৃহিত বইগুলাে শেষ হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে তার মৃত্যুও সন্নিকটে। ধীরস্থিরভাবে মৃত্যুকে মেনে নেবার জন্য মানসিকভাবে তৈরিই ছিলেন। কিন্তু সবই দিলমিয়া নামের স্থানীয় এক ছােকরা, যে কিনা মসজিদের পাশে নিমের মাজনসহ সবিহ টপি, আতর বিক্রি করত, সে তাকে প্রস্তাব দেয় ধর্মান্তরিত হবার জন্য-আল্লাহর পাকিস্তানে মালাউনদের কোনাে ঠাই নাই! ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে রমাকান্ত কামার বেঁচে যাবেন।পাকবাহিনী তাে সাচ্চা মুসলমান, তারা কি আর-এক মুসলমানকে হত্যা করবে?

দিলুর একথা শুনে পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিল মাস্টারের ঠোঁটে। পাকবাহিনী যে অকাতরে মুসলমানও হত্যা করে বেড়াচ্ছে সেটা কে না জানত। তাদের কাছে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই ছিল বাঙালি। তবে অস্বীকার করবার উপায় নেই, হিন্দুদের ওপরে নির্যাতনের মাত্রাটা অনেক বেশি ছিল।  দিলুমিয়া যখন জানায়, ধর্মান্তরিত না হলে মিলিটারিরা তাকে তাে মেরে ফেলবেই, তার ঘরে আগুন দিয়ে ভিটায় ঘুঘু চড়াবে। কথাটা শুনে তিনি আঁৎকে ওঠেন—তার ঘরে আছে সেইসব দুষ্প্রাপ্য বইপত্র! আর কোনাে দ্বিধা না করে তিনি ধর্মান্তরিত হবার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

যুদ্ধশেষে অনেক বছর পর সুন্দরপুরে আবারও কালােছায়া নেমে আসে—কোলাবরেটর হামিদুল্লাহর ছেলে আসাদুল্লাহ এই এলাকার এমপি হয়ে যায়। স্বাধীনতাবিরােধী বদনাম ঘােচাতে স্কুলের নামকরণ করতে চাইল বাবার নামে। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মাস্টার। তার সঙ্গে যােগ দিল আরও অনেকে। কিন্তু এমপিকে থামানাের মতাে শক্তি তাদের কারাের ছিল না। মাস্টারের পুরােনাে অনেক ছাত্র সরকারি চাকরিতে বড়ােসর পদে অধিষ্ঠিত আছে। তাদের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতাবিরােধী হামিদুল্লাহর নামে স্কুলের নামকরণের পায়তারা থামিয়ে দিতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। এই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ এমপি মাস্টারের চাকরিটা খেয়েছিল রিটায়ারমেন্টের অল্প কিছুদিন আগেই। এতেও ক্ষান্ত হয়নি আসাদুল্লাহ, লােক দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গেছিল। অনেক শাসিয়েছিল কিন্তু তার চোখ রাঙানিকে একটুও পাত্তা দেননি রমাকান্ত কামার।  স্মৃতি থেকে ফিরে এসে ছােট্ট জানালাটা দিয়ে লাইব্রেরীর ভেতরে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল।

এই লােক আবার কেন তার কাছে আসছে।

অধ্যায় ৩০

ছফা যখন রবীন্দ্রনাথে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করল তখন ভেতরটা বেশ নিরিবিলি-মাত্র দুজন পাঠক বই পড়ছে। এর কারণ হয়ত একটু পরই লাইব্রেরীটা বন্ধ করে দেওয়া হবে।  এমন পরিবেশ দেখে খুশিই হল সে। ভালাে করেই জানে, ভেতরের ছােট্ট একটা প্রাইভেট রুমে আছেন মাস্টার রমাকান্ত কামার—আগে যেখানে মুশকান জুবেরি বসত।  লাইব্রেরীর ভেতরে ঢােকার সময় দু-জন মগ্ন পাঠকের কেউই মুখ তুলে তাকাল না। বইতে পুরােপুরি ডুবে আছে তারা। যতটা সম্ভব কম আওয়াজ করে
ধীর পদক্ষেপে লাইব্রেরীর শেষ মাথায় ছােট্ট রুমটার দিকে এগিয়ে গেল ছফা। আলতাে করে টোকা দিল দরজায়। পর পর দু-বার।

“দরজা খােলাই আছে।”

ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের কণ্ঠটা ভেসে এল। ছফাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে মােটেও অবাক হলেন না প্রবীণ শিক্ষক।

“আদাব, স্যার,” ভেতরে ঢুকে বলল সে।“কেমন আছেন?” “ভালাে,” ছােট্ট করে জবাব দিলেন মাস্টার।

স্বল্প পরিসরের ঘরটায় একমাত্র টেবিলের ওপাশে বসে আছেন তিনি। টেবিলের সামনে মাত্র দুটো চেয়ার। দড়ি দিয়ে বাঁধা কিছু বইয়ের স্তুপ আছে ঘরে, আর দেয়ালে তিনটি সাদা-কালাে ছবি টাঙানাে।

খালি চেয়ারটায় বসে পড়ল ছফা।“এরা কারা?” দেয়ালের ছবিগুলাে দেখিয়ে জানতে চাইল সে।

“ত্রিলােকনাথ বসু, অলােকনাথ বসু আর রাশেদ জুবেরি,” বললেন মাস্টার। “এই লাইব্রেরীর পেছনে তাদের অবদানই বেশি।”

“তাহলে তাে আর-একজনের ছবি থাকার কথা ছিল এখানে!” মাস্টার স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন।

“নতুন করে এই লাইব্রেরীটা দেবার পেছনে মুশকান জুবেরির অবদানই সবচেয়ে বেশি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রমাকান্ত কামারের ভেতর থেকে। “আপনি কী জন্যে এসেছেন সেটা বলেন।”

“বলছি বলছি,”মুচকি হেসে বলল ছফা। “আমি আগে ভাবতাম আপনি সত্য কথা বলেন সব সময়।অন্তত সুন্দরপুরের মানুষ তা-ইভাবে—রমাকান্ত কামার কখনও মিথ্যে বলেন না।” একটু থেমে আবার বলল, “সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!”

মাস্টার এবারও নির্বিকার রইলেন। “কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতাে আপনিও মিথ্যে বলেন!”

“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলুন, কী জানতে এসেছেন?” রমাকান্ত কামারের কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে গেছে।

কয়েক মুহূর্ত মাস্টারের দিকে চেয়ে থেকে বলল ছফা, “আপনি যে মােবাইলফোন -ব্যবহার করেন, সেটা আমাকে বলেননি।”

“আমি তাে অনেক কিছুই ব্যবহার করি ” গম্ভীর মুখে বললেন মাস্টার।“ তার সবই কি আপনাকে বলেছি? আর আপনিও কি আমার কাছ থেকে সব কিছু জানতে চেয়েছেন?”

“সব কিছু না হােক, ফোনের কথা বলেছিলাম আপনাকে  গতকালই।” “আমি আপনাকে স্কুলের ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম।” “তা ঠিক। কিন্তু মােবাইল
ফোনটার নাম্বার দেননি।” “আপনি সেটা চানওনি,”চট করে জবাব দিলেন মাস্টার।  মুচকি হাসল ছফা। “তা চাইনি। তবে আজকাল নিজের ফোন মানে কিন্তু মােবাইল
ফোনই বােঝায়। সেটা কারও কাছে গােপন করার মানে বিশেষ কোনাে কারণ আছে!”

ছফার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন মাস্টার। বিশেষ কারণ তাে আছেই।” “সেটা কী, জানতে পারি?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্তকামার। “আপনার কাছে কৈফিয়ত দেবার কোনাে দরকার নেই আমার, তারপরও বলছি। ধরে নিন আপনার সন্দেহগ্রস্ত মনটাকে শান্ত করার জন্যই বলা, একটু থেমে আবার বললেন, “যে জিনিস আমি সব সময় ব্যবহার করি না, খুব দরকার পড়লে ব্যবহার করি, সেটার নাম্বার সবাইকে কেন দেব?”

“বিশেষ কারাের সঙ্গে যােগাযােগ করার দরকার পড়লেই ব্যবহার করেন?”

ছফার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও মাস্টার মাথা নেড়ে সায় দিলেন। “হ্যা।”  “সেই বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে কি
মুশকান জুবেরিও আছে?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে মাস্টারের দিকে দৃষ্টিবিদ্ধ করে রাখল, কিন্তু লােকটার অভিব্যক্তি হতাশ করল তাকে।

মাস্টার নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার কোনাে ধরনের যােগাযােগ নেই— এ কথা সেদিনও বলেছি, আজকেও বলছি। চাইলে আপনি এটা খতিয়ে দেখতে পারেন।”

‘তা আমি দেখব। আপনার মতাে যুধিষ্ঠির তাে নই  ডিবির সামান্য একজন
ইনভেস্টিগেটর। সন্দেহবাতিকতা আমার যােগ্যতারই অংশ। ওটা না থাকলে আমি সুন্দরপুরবাসিদের মতাে যাকে-তাকে দেবতাজ্ঞান করে বসে থাকতাম!” মাস্টারের মুখ পাথরে খােদাই করা গ্রিক দেবতাদের মতাে হয়ে গেল।

“ওই মহিলা যে আপনার সঙ্গে যােগাযােগ করে, তার কিন্তু শক্ত প্রমাণ আছে আমার কাছে।”

ছফার প্রশ্নটা শুনে মাস্টার একটুও অবাক হলেন না। সেটা যে কী তা আমি জানি , একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “আমার ঘরে চোর পাঠিয়ে তল্লাশি করিয়েছে কেউ। কিছু জিনিস নিয়েও গিয়েছিল, আবার ফেরত দিয়ে গেছে।”

একটু হেসে বলল সে, “চোর না বলে আপনার বলা উচিত অনুসন্ধানকারী।” “বলতাম, যদি সে সত্যি সত্যি চোর না হত!”

অবাক হল ছফা-ভদ্রলােক কী করে এটা বুঝলেন? যাই হােক, সিদ্ধান্ত নিল সরাসরিই বলবে এখন, ঘােরপ্যাচের আর দরকার নেই।

“মুশকান জুবেরির চিঠি পেয়েছিলেন আপনি, আর সেটা বেমালুম অস্বীকার করেছেন আমার কাছে।”

“ওটা চিঠি না  চিরকুট,”আস্তে করে বললেন মাস্টার।“চিঠি আর চিরকুটের মধ্যে পার্থক্য আছে।” বাঁকাহাসি দিল নুরে ছফা।“কোনটা চিঠি আর কোনটা চিরকুট সেটা যদি একটু বলতেন
উপকৃত হতাম।”

নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন মাস্টার, “চিঠিতে প্রেরকের নাম লেখা থাকে…ডাকের মাধ্যমে আসে ওটা। আর চিরকুট লােকমারফত দেওয়া হয়। অনেক সময় নাম-ধামেরও বালাই থাকে না।” এ মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “ধন্যবাদ। অনেক কিছু শিখলাম,” একটু থেমে আবার বলল, “তাহলে আপনি স্বীকার করছেন, মুশকান জুবেরি আপনাকে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিল।”

“উনি পাঠিয়েছিলেন কিনা বলতে পারব না।”

নুরে ছফার ভুরু কুঁচকে গেল। “আপনি বলতে চাইছেন, ওটা কে পাঠিয়েছিল। সে-ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত নন?”

“চিরকুটে ওঁর নাম লেখা ছিল না, আর ভদ্রমহিলার হাতের লেখার সঙ্গেও আমি পরিচিত নই, নিশ্চিত হব কী করে?”

“ফেরারি আসামি হিসেবে নিজের নাম না লেখাটাই তাে স্বাভাবিক।” মাস্টার নির্বিকার রইলেন, কিছুই বললেন না।

“তবে আমি নিশ্চিত, ওটা কোনাে মহিলার হাতের লেখাই। নারী-পুরুষের হাতেরলেখা দেখলেই আমি চিনতে পারি। আপনি এটাকে আমার আর-একটি গুণ হিসেবে ধরে নিতে পারেন।

শুধু সন্দেহবাতিকতা দিয়ে তাে ইনভেস্টিগেশনের কাজ চালানাে যায় না,”বাঁকা হাসি দিয়ে আবার বলল সে, ‘চিরকুটের কথাগুলাে পড়লে দুধের বাচ্চাও বলে দেবে ওটা মুশকান জুবেরিই পাঠিয়েছে।”

মাস্টার এ কথারও কোনাে জবাব দিলেন না। “এখন বলুন, চিরকুটটা আপনাকে কে দিল?” আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাস্টার। “এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কি আমি বাধ্য?” মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা।“অবশ্যই আপনি বাধ্য। কারণ যে জানতে চাইছে সে যদুমদু জাতীয় কেউ নয়, আইনপ্রয়ােগকারী সংস্থার একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা। বেশ কয়েকজন মানুষের নিখোঁজ এবং সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডে কেস তদন্ত করছে। আপনার উচিত তাকে সর্বাত্মক সহযােগীতা করা। অবশ্য, আপনি যদি কোনাে ক্রিমিনালকে রক্ষা করার পণ না করে থাকেন তাে।”রমাকান্ত কামার খোঁচাটা হজম করে নিলেন নির্বিকার থেকেই। আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি, “ট্রাস্টের ল-ইয়ার ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার। উনিই চিরকুটটা দিয়েছিলেন আমাকে ট্রাস্টের কাগজপত্রের সঙ্গে।”  অবাক হল নুরে ছফা।তার উচিত ছিল ট্রাস্টেরল-ইয়ার কে সেটা খতিয়ে দেখা, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা কিন্তু সে তার সমস্ত মনােযােগ নিবদ্ধ করেছিল ডাক্তার আসকারের ওপরে।

“ওঁকে আপনি আগে থেকে চিনতেন?” “চেনার প্রশ্নই ওঠে না। ওই মহিলা এখান থেকে চলে যাবার কিছু দিন পর এই ভদ্রলােক ডাকযােগে আমাকে সব কিছু জানান। ট্রাস্টের কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে তখন চিরকুটটাও দিয়েছিলেন।”  মাথা দোলাল নুরে ছফা। অবশেষে একটা সূত্র তাহলে পেল। এই সুন্দরপুর থেকে! ‘যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইক্যাই উঠতে হইব’-কেএস খানের আপ্তবাক্যটি তার মাথার ভেতরে অনুরণিত হল আবার। এই ময়েজ উদ্দিন খােন্দকারের সঙ্গে মুশকান নিশ্চয় যােগাযােগ রাখে! হয়ত সে-ই তাকে নিয়ােগ দিয়েছে।

হঠাৎ কিছু একটা টের পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাল সে। দেখতে পেল তিন-চারজন যুবক ঘরে প্রবেশ করেছে। তাদের সবার চোখমুখ বেশ শক্ত।

অধ্যায় ৩১

সুন্দরপুরের নতুন এমপি জোনায়েদ রহমানের পৈতৃক বাড়িটি বেশ ছিমছাম আর বিশাল। মূল বাড়িটি কাঠের তৈরি, এখনও ভিটেয় পাকা দালান ওঠেনি।

ছফা অবাকই হল। এই দেশে এমপি হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে ওঠে আর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বাড়িঘর!

এমপির বাড়ির বিশাল উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছে ছফা। তার সামনে আর-একটা খালি চেয়ার আছে।স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছে, এমপি এখানে এসে বসবেন। ছফাকে যে-চারজন যুবক নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি তিনজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যজন গেছে বাড়ির ভেতরে। ইচ্ছে করেই এইসব চ্যাংড়াদের কাছে নিজের ক্ষমতা জাহির করেনি সে। এরা এমপির চ্যালাচামুণ্ডা। নেতার পেছনে ঘুরে গর্ব বােধ করে। এককালে জমিদার, জোতদার, তালুকদার আর গ্রাম্য মােড়লেরা লাঠিয়াল নিয়ে ঘুরে বেড়াত, এখনকার দিনে নেতারা এরকম যুবকদেরকে সে-কাজে ব্যবহার করে। পিএসের ক্ষমতা বরং ওদের নেতাকে দেখানােই বেশি ভালাে হবে।  ঘৃণাভরে মাটিতে থুতু ফেলল ছফা। তাকে একাজ করতে দেখে চোখমুখ আরও শক্ত করে ফেলল এমপির ছেলেগুলাে। এমন সময় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা এক তরুণ বের হয়ে এল বাড়ির ভেতর থেকে। তার সঙ্গে এই যুবকদের একজন। ছফা বুঝতে পারল, এই তরুণই নতুন এমপি জোনায়েদ রহমান। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে সালাম দেওয়া সরকারি কর্মকর্তা ছফার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু সেটা করল না সে। ব্যাপারটা যেমন তরুণ এমপির চোখ এড়াল না, তেমনি এড়াল না তার সাঙ্গপাঙ্গদেরও।

এমপির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মুহূর্তে। ছফার সামনে চেয়ারে বসে পড়ল সে। “আপনি একজন ডিবি অফিসার?”শান্তকণ্ঠেই জানতে চাইল।

“হ্যা।” ইচ্ছে করেই ‘স্যার’সম্বােধন করা থেকে বিরত থাকল। “সুন্দরপুরে কী কাজে এসেছেন?” “একটা কেস ইনভেস্টিগেট করতে।” “কোন কেস?” “কিছুমানুষের নিখোঁজ হবার কেস তদন্ত করছি আমি। আর ওই মুশকান জুবেরি সেই কেসের প্রাইম সাসপেক্ট।”

‘বুঝলাম, কিন্তু আপনি মাস্টার সাহেবের পেছনে লেগেছেন কেন?” “আমিওঁর পেছনে লাগিনি, শুধুমাত্র একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, তা-ওখুবই ভদ্রভাবে।” “এই কেসে ওঁকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন?”কুঁচকে ফেলল এমপি। “কারণ ওঁর সঙ্গে ওই মহিলার যােগাযােগ আছে।”

অবিশ্বাসে মাথা দোলালাে জোনায়েদ রহমান।“এটা সুন্দরপুরের কেউ বিশ্বাসকরবে?” নিজের চ্যালাদের দিকে তাকাল সে।“মাস্টারসাহেব ওই মহিলার সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে

যাবেন কেন? আশ্চর্য!”

“কেন রাখবেন সেটা মাস্টারসাহেবই ভালাে জানেন। আমি শুধু সেই কারণটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”

এমপি স্থিরচোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “মহিলা এখান থেকে চলে যাবার পর দেখা গেল, জমিদার বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দিয়ে গেছে তার প্রয়াত স্বামী রাশেদ জুবেরি। তিনিই মাস্টারসাহেবকে সেই ট্রাস্টের ট্রাস্টি করেছেন। এখানে ওই মহিলার কোনাে অবদান নেই।” এ মুচকি হাসল ছফা। পলিটিশিয়ানদের কথার মারপ্যাচ তার ভালাে করেই জানা আছে। মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে পালিয়েছে না বলে এমপি বলছে, সে চলে গেছে—এটাই প্রমাণ করে মহিলা এবং মাস্টারের ব্যাপারে তার পক্ষপাত।

“আপনি কি জানেন, আমিও সেই ট্রাস্টের একজন মেম্বার ?” এমপি বলল। “কিন্তু আপনার সঙ্গে সম্ভবত ওই মহিলা যােগাযােগ রাখেন না।”ছফার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইল তরুণ এমপি।  “শুনুন,” শীতল কণ্ঠে বলল নুরে ছফা। “আমি একটা কেস তদন্ত করছি, দরকার পড়লে যে-কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি। আপনি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমার কাজে বাধা দিতে পারেন না, এটা আপনাকে বুঝতে হবে।” [ “আমি বাধা দিলাম কোথায়?”অবাক হবার ভান করল জোনায়েদ রহমান।

“এই যে, মাস্টারের ওখান থেকে এইসব ছেলেপেলেদের দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন…এটাকে আপনি কী বলবেন?”

এমপি হেসে ফেলল।“এটাকে তদন্ত কাজের বাধা হিসেবে দেখছেন আপনি? আশ্চর্য!” কাঁধ তুলল জোনায়েদ রহমান।“যাই হােক, আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন, আমার কিছু করার নেই। আমি শুধু আপনাকে একটা কথা পরিস্কার বলে দেবার জন্য ডেকে নিয়ে এসেছি—মাস্টারসাহেবকে কোনাে রকম ডিস্টার্ব করবেন না।” শেষ কথাটা তর্জনি উচিয়ে, একেবারে রাজনৈতিক নেতাদের মতাে করে বলল।

“ডিস্টার্ব বলতে কী বােঝাচ্ছেন?”শান্তকণ্ঠে জানতে চাইল ছফা। এমপির হুমকিকে পাত্তাই দিল না সে।“ওঁকে কোনাে রকম জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না আর?”

নিজের রাগ দমন করলেও বেশ ধমকের সঙ্গে বলল সুন্দরপুরের এমপি, “ডিস্টার্ব বলতে, ওঁর বাসায় চোর-বাটপার পাঠিয়ে চুরি করাকে বুঝিয়েছি! এ কাজ করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

“আমি চুরি করিয়েছি কে বলল?”ছফা একটুও বিচলিত হল না।

জোনায়েদ রহমানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। “যাকে দিয়ে চুরি করিয়েছেন, সে তাে নিজেই মাস্টারসাহেবের কাছে গিয়ে পা ধরে মাফ চেয়ে গেছে। এ-ও বলে গেছে, ওই আতর হারামজাদা তাকে এ কাজ করতে বলেছিল।”

ছফার কপালে হালকা ভাঁজ পড়ল। “ভাই, এই লােক তাে ওই ইতরের মােটরসাইকেলে কইরা ঘুইরা বেড়ায়,”যুবকদের একজন বলে উঠল।  ‘ইতরটা এখন
জাতে উঠে গেছে, নিজে আর এ কাজ করে না।”বলল এমপি।“আপনি আতরকে বলেছেন মাস্টারসাহেবের বাড়িতে চুরি করার জন্য, সে নিজে না করে ওই ছেলেকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে।”

ছফা বুঝতে পারল,বল্টু নামের ছেলেটা চুরির কথা স্বীকার করে ফেলেছে। এখন এটা অস্বীকার করলে খামােখাই আতরের ওপরে নির্যাতন নেমে আসবে।ইনফর্মারকে আগেই বলেছিল যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ না করাতে।

“আপনি চাইলে আমি সেই চোরকেও হাজির করতে পারি।” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে বলল এমপি।

“শুনুন,” গভীর করে দম নিয়ে বলল ছফা। “তদন্তের প্রয়ােজনে পুলিশকে অনেক কিছুই করতে হয়, আমিও তাই করেছি।এরজন্যে কারাের কাছে জবাবদিহি করার দরকার দেখছিনা। তবে আপনাকে শুধু এটুকু বলব, আপনি যে-দলের এমপি, সেই দলের অনেক ওপরের দিকের একজন এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী। এখানে ওঁর স্বার্থ জড়িত। আপনি যদি এই তদন্তে কোনাে রকম নাক গলান তাহলে আমি বাধ্য হব তাকে সব কিছু জানাতে।

কথাটা যেন এমপিসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের গায়ে জ্বলুনি ধরিয়ে দিল। ছেলেদের মধ্যে একজন তেড়ে এসে কিছু বলতে যাবে অমনি হাত তুলে থামিয়ে দিল জোনায়েদ রহমান। “আপনি কার কথা বলছেন?” নিজের রাগ দমন করে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।

“আপনার সঙ্গে ফোনে আলাপ করিয়ে দেব?” ছফা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল। এমপির ভ্রু কুঁচকে গেল।“ঠিক আছে, ফোন দিন।” ছফা পকেট থেকে ফোনটা বের করে পিএসের নম্বরে ডায়াল করল। তিনবার রিং হবার পর কলটা ধরল আশেক মাহমুদ। নীচুকণ্ঠে পিএসকে জানাল সুন্দরপুরের এমপি তার কেসে ইন্টারফেয়ার করছে, রীতিমতাে নিজের লােকজন দিয়ে তার বাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছে।

এমপির দিকে তাকালো ছফা।

তরুণ এমপি রেগেমেগে চেয়ে আছে তার দিকে।ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ শুনে গেল। “ওঁকে বলে দিন, আমার কেসের ব্যাপারে যেন নাক না গলায়।

কথাটা বলে জোনায়েদ রহমানের দিকে তাকাল, তারপর ফোনটা বাড়িয়ে দিলে তার দিকে। “নিন  ওঁর সঙ্গে কথা বলুন।”

জুনায়েদ রহমান দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা হাতে নিয়ে কানে চেপে ধরল। “সুন্দরপুরের এমপি জোনায়েদ রহমান বলছি। আপনি কে বলছেন?” ওপাশ থেকে আশেক মাহমুদের পরিচয় পেয়ে বেশ অবাক হল এমপি। এরকম কাউকে যে আশা করেনি বােঝাই যাচ্ছে।

তার মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি।

“স্লাইমালেকুম, ভাই  ভালাে আছেন?”ছফার দিকে তাকাল চকিতে। “জি, ভাই  আমি ভালাে আছি।” তারপর ঘিরে থাকা ছেলেগুলােকে এক হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ইশারা করল, মনােযােগ দিয়ে শুনে গেল ফোনের ওপাশের কথা।

এমপির ছেলেগুলাে অবাক হলেও চুপচাপ চলে গেল উঠোন ছেড়ে। তারাও ভড়কে গেছে কিছুটা।

“ভাই..বুঝতে পেরেছি, কিন্তু মাস্টারসাহেব এই অঞ্চলের সম্মানিত একজন মানুষ  সবাই উনাকে–” এ ছফা বুঝতে পারল, এমপির কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কথা বলছে আশেক মাহমুদ। অনেকক্ষণ ফোনের ওপাশের কথা শুনে গেল জোনায়েদ রহমান।  “জি, ভাই..ঠিক আছে”মাথা নেড়ে সায় দিল। “হুম, বুঝতে পেরেছি…স্লামালেকুম, ভাই।” ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ছফার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল সুন্দরপুরের নতুন এমপি। “আশেক ভাইয়ের সঙ্গে এই কেসের সম্পর্ক কী?”  উঠে দাঁড়াল ছফা। হাত বাড়াল ফোনটা নেবার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোনটা দিয়ে দিল এমপি।

“এসব আপনার জানার দরকার নেই।” ফোনটা পকেটে ভরে নিল সে। “আপাতত মাস্টারের সঙ্গে আমার কাজ শেষ। ভদ্রলােক আমার কাছে স্বীকার করেছেন, মুশকান জুবেরি কবে কীভাবে ওঁর সঙ্গে যােগাযােগ করেছিল। ওঁর কোনাে দরকারই ছিল না আপনাকে এসব জানানাের।” এ হতভম্ব এমপি চেয়ে রইল ছফার দিকে।

আতরআলি আর তার ওই ছেলেটা,”শান্তকণ্ঠে বলল নুরে ছফা। “তারা আমার হয়ে কাজ করেছে তাদেরকে কিছু করবেন না, ঠিক আছে?”

জোনায়েদ রহমান হা না কিছুই বলল না। চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে রইল।

তাকে একা রেখে চলে গেল ছফা। এখানে আর কোনাে কাজ নেই। সুন্দরপুরের পাট চুকে গেছে আপাতত।

অধ্যায় ৩২

রমাকান্ত কামার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে এলেন।

একটু আগে তার স্নেহধন্য ছাত্র জোনায়েদ লােকমারফত তার কাছে খবর পাঠিয়েছে। ওই নুরে ছার পেছনে নাকি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মতাে ক্ষমতাবান একজন মানুষ। তিনি যেন ঘুণাক্ষরেও সন্দেহভাজন কারাের সঙ্গে যােগাযােগ না করেন। এসব থেকে তার দুরত্ব বজায় রাখাই ভালাে হবে।

অলােকনাথের নাতবউ তিন বছর আগে তার কাছে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিল ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন খােন্দকারের মাধ্যমে—সে কথা ডিবি অফিসারকে বলা উচিত হয়েছে। কিনা বুঝতে পারছেন না এখন। এরকম সততা না দেখালে কী এমন ক্ষতি ছিল? যুধিষ্ঠিরও প্রয়ােজনে মিথ্যে বলেছিলেন—তিনি কি বলতে পারতেন না? তার তাে মিথ্যে বলারও দরকার ছিল না। স্রেফ বলে দিলেই পারতেন, কে পাঠিয়েছিল সেটা তার মনে নেই।তিন বছর আগে কে একটা চিরকুট পাঠিয়েছে সেটা তার মতাে বয়স্ক মানুষের স্মরণে না থাকারই কথা। তার চেয়েও ভালাে হত, চিরকুটটা নষ্ট করে ফেললে।

উকিল ভদ্রলােককে পুরাে বিষয়টা জানিয়ে সতর্ক করার দরকার কিন্তু জোনায়েদের সতর্কবাণীর কারণে সে কাজও করতে পারছেন না। ডিবি অফিসার কিছুক্ষণ আগেই সুন্দরপুর ছেড়ে চলে গেছে, তার পরবর্তী টার্গেট যে উকিল হবে তাতে কোনাে সংশয় নেই।

ডাক্তার আসকারের সঙ্গে যে তার যােগাযােগ হয় মাঝেমধ্যে সেটাও ছফা বের করে ফেলবে খুব দ্রুত। আজকাল মােবাইলফোন হয়ে উঠেছে খুবই দরকারি আর ক্ষতিকর একটি জিনিস। এটা না থাকলে চলে না, আবার এটাই হয়ে উঠেছে সব নষ্টের মূল।  অবশ্য ডাক্তারকে তিনি ট্রাস্টের সদস্য করেননি, করার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রলােকের সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল না। তিনি জানতেন না, লােকটার সঙ্গে রাশেদের স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল। ভদ্রমহিলা যখন সুন্দরপুরে ছিল তখন নাকি মাঝেমধ্যে এখানে আসতেন—এ কথা তিনি জেনেছেন অনেক পরে।  ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন অবশ্য দাবি করেছে, রাশেদ জুবেরি নিজেই নাকি তাকে সদস্য করার কথা বলে গেছিলেন। অন্যদিকে, ভদ্রলােককে ট্রাস্টের সদস্য করায় বেশ উপকারও হয়েছে। প্রখ্যাত চিকিৎসক তিনি, তার সামাজিক অবস্থান আর উচুমহলে ভালাে
যোগাযোগ টাস্টের বেশ কাজে লেগেছে। যখনই দরকার পড়েছে ভদ্রলােক সাহায্যের বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি সাহায্য করেছেন।মাস্টারের সঙ্গে খুব অল্প ক-দিনেই তার সঙ্গে বেশ সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তার ফোনে যে কয়জনের নম্বর আছে, তার মধ্যে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ অন্যতম। তাকে কি ফোন করে সব কিছু বলা দরকার?

রমাকান্তকামার এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। তার ধারণা, ডাক্তারের সঙ্গে রাশেদের স্ত্রীর যােগাযােগ আছে।

মন্থর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন।

আর-একটা বিষয় তার মাথায় ঢুকছেনা—প্রধানমন্ত্রীর পিএস কেন মুশকান জুবেরির কেসে আগ্রহী?ভদ্রলােকের সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?

এরআগে সুন্দরপুরেরঅনেকের মতাে তিনিও মনে করতেন, প্রয়াত এমপি আসাদুল্লাহ ছফাকে লেলিয়ে দিয়েছিল মহিলার পেছনেতার উদ্দেশ্য ছিল, অলােকনাথের সমস্ত সম্পত্তি করায়ত্ত করা। কিন্তু সুদূর ঢাকা থেকে এরকম ক্ষমতাবান একজন মানুষ কেন ওই ভদ্রমহিলার পেছনে লাগবে? তার উদ্দেশ্যটাই বা কী? এ কোনাে কিছুই বােধগম্য হচ্ছেনা রমাকান্ত কামারের।

অধ্যায় ৩৩

ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আইন পেশায় নিয়ােজিত আছে। এই পেশায় সুনাম-দুর্নাম দুটোই সমানভাবে হাত ধরাধরি করে চলে। উকিলদের দুর্নাম থাকবে না তা কি হয়—ময়েজ উদ্দিন ওসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না। পেশাদার আইনজীবি হিসেবে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ সে। ঢাকা ক্লাবের মতাে বনেদি জায়গায় সুযােগ না পেলেও সদ্য গজে ওঠা উত্তরা ক্লাবে ঠিকই ঠাঁই করে নিতে পেরেছে।

তার গ্রামের ক-জন আসতে পেরেছে এমন অবস্থানে? ঝালকাঠি নামের এক জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের কৃষকের ছেলে হিসেবে তার পক্ষে বড়ােজোর সারের ডিলার হওয়া ছাড়া আর কিছু হবার সুযােগ ছিল না। তার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে তাকে বাদ দিলে, ওই সারের ডিলারই সবচেয়ে ভালাে পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়।

আদালতে গিয়ে কালাে কোট পরে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার যে পরিচিত দৃশ্যটি দেখা যায় নাটক-সিনেমায়, সেরকম কোনাে আইনজীবি ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার নয়। তার কাজকারবার সব কাগজে-কলমে। অসংখ্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার সে, পাশাপাশি আরও অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল পেপারওয়ার্কের কাজ করে থাকে। যে-কোনাে ব্যবসায়িক দলিল-চুক্তি আর বেচাকেনার কাজগুলােক্লায়েন্টের স্বার্থে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেই সে জীবিকা নির্বাহ করে। এতে তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়। আর বলাই বাহুল্য, ক্লায়েন্টের হয়ে এরকম কাজ করতে গেলে প্রায়শই অনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিতে হয়। এসব নিয়েও ময়েজ উদ্দিনের কোনাে মাথাব্যথা নেই। নীতি-নৈতিকতা হল অতি আদর্শবাদীদের মানসিক সমস্যা। ওই দলে সে পড়ে না। তবে এসব করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে যে পুলিশি ঝামেলায়ও পড়তে হয় সেটাই একমাত্র বিড়ম্বনা। আইনের সমঝদার হিসেবে এসব ঝামেলা থেকে কীভাবে নিস্তার পাওয়া যায় তাও সে ভালাে করেই জানে।

এ মুহূর্তে দুপুরে লাঞ্চ করে পুরানা পল্টনের চেম্বারে বসে আছে সে, তার সামনে বসে আছে ডিবির এক কর্মকর্তা। আইনজীবি হিসেবে এসব আইনপ্রয়ােগকারী সংস্থার লােকজনকে ময়েজউদ্দিন ভয় পায় না কখনও। তাদের হম্বিতম্বিকে ঠান্ডা মাথায় দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয় খুব সহজেই। এখনও সেটাই করছে।

“আমি তাে বললামই, মুশকান জুবেরি নামের কাউকে চিনি না,”কথাটা বেশ জোর দিয়ে কিন্তু ধীরস্থিরভাবে বলল উকিল ভদ্রলােক। “আপনি আমার কাছে কেন এই মহিলা সম্পর্কে জানতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।”

বাঁকাহাসি দিল নুরে ছফা।

“আপনি তাে এটাও বলছেন না, মহিলা করেছেটা কী?” যেন নির্দোষ ভাবেই জানতে চাইল উকিল।

“মুশকান জুবেরি বেশ কয়েকজন মানুষ হত্যা এবং গুমের সন্দেহভাজন আসামি।”

আইনজীবী ভ্রু কপালে তুলে ছফার কথাটা পুনরুক্তি করল, “সন্দেহভাজন আসামি। আচ্ছা মহিলা কেন ওইসব লােকজনকে গুম করল? মানে, তার উদ্দেশ্যটা কী ছিল?”

বাঁকাহাসি দিল ছফা।“এটা আপনার না-জানলেও চলবে।”

কাঁধ তুলল ভদ্রলােক। “তা ঠিক। এসব আমার জানার দরকার নেই।” একটু থেমে আবার বলল, “যাই হােক, আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে এই মুশকান জুবেরি নামের সন্দেহভাজনের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল, তবে যে-সব লিগ্যাল পেপারওয়ার্ক করেছি ট্রাস্টের ট্রাস্টি রমাকান্ত কামারের হয়ে, তার সঙ্গে এই মহিলার কোনাে সম্পর্ক নেই।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইল ছফা। তারপর পকেট থেকে ছােট্ট একটা কাগজ বের করে বাড়িয়ে দিল উকিলের দিকে।“এটা একটু দেখুন।”

ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট ওলটাল। “এটা কী? কে লিখেছে…কাকে লিখেছে?”

হেসে ফেলল ছফা। “আপনার স্মৃতিশক্তি দেখি বেশ দুর্বল।”

“তা বলতে পারেন, বয়স তাে কম হল না। সামনের বছর ষাটে পা দেব।” নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছে সে।

মুচকি হাসল ছফা।“রমাকান্ত কামার আমার কাছে গতকালই স্বীকার করেছেন, মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর আত্মগােপনে থাকা অবস্থায় এটা পাঠিয়েছিল আপনার মাধ্যমে  তিন বছর আগে।”

“তিন বছর আগে?” অবাক হবার ভান করল আইনজীবী। বলেন কী! যে মহিলার সঙ্গে জীবনে যােগাযােগ হয়নি, তার চিঠি আমি রমাকান্তবাবুকে দিয়েছি?”  চোয়াল শক্ত করে ফেলল ছফা।“এটা চিঠিনা, চিরকুট। চিঠিতে প্রেরক আর প্রাপকের নাম লেখা থাকে, চিরকুটে থাকেনা।”  ঠোঁট ওলটাল উকিল। “চিঠি হােক আর চিরকুট, আমার আসলেই মনে পড়ছে না এটা আমি রমাকান্ত কামারকে দিয়েছিলাম কিনা। তিন বছর আগের কথা কত কাগজপত্রই তাে লেনদেন করতে হয় আমাকে, সব কি মনে রাখা সম্ভব ?” একটু থেমে আবার বলল, “আমার ক্লায়েন্ট রমাকান্তবাবুরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে, উনি হয়ত গুলিয়ে ফেলেছেন। ভদ্রমহিলা তাে খুব সহজেই বেনামে ডাকযােগে ওঁর কাছে এটা পাঠাতে পারতেন।”

ছফার ইচ্ছে করল উকিলের গালে কষে একটা চর বসিয়ে দিতে। কিন্তু লােকটা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তাছাড়া একজন আইনজীবীকে চর মেরে খামােখা মামলা খাওয়ারও কোনাে ইচ্ছে তার নেই। এরা পান থেকে চুন খসলেই মামলা ঠুকে দেয়,

“তা পারতেন, কিন্তু মহিলা সেটা করেনি। সে আপনাকেই বেশি বিশ্বস্ত মনে করেছে।

দাঁত বের করে হাসল আইনজীবী। “আমার পেশায় কিন্তু বিশ্বস্ততা বিরাট বড় একটি রেপুটেশন। অনেক সময় লেগে যায় এটা অর্জন করতে। কিন্তু যার সঙ্গে পরিচয় নেই তিনি কেন আমাকে বিশ্বাস করতে যাবেন?”

“তাহলে অস্বীকার করছেন, এটা মাস্টারকে দেননি আপনি?”

আবারও নিঃশব্দে হাসল আইনজীবী। “বললাম না, মনে নেই। আন্দাজে কেন বলব এটা আমি পাঠিয়েছি?আর অস্বীকারই বা করব কেন! কত চিঠিপত্র লেনদেন করতে হয় আমাকে…সব কি মনে থাকে?”  “শুনুন, আমি শুধু একটা তথ্য জানতে চাই,” ধীরকণ্ঠে বলল নুরে ছফা, “মুশকান জুবেরির সঙ্গে আপনার কখন কোথায় যােগাযােগ হয়েছিল—এখনও যােগাযােগ আছে। কিনা। সে এখন কোথায় আছে।”

হেসে ফেলল উকিল। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে জোর দিয়ে বলল, “তার সঙ্গে আমার কোনাে যােগাযােগ নেই। আর ওই মহিলা আমার ক্লায়েন্টও না। এটা বিশ্বাস না করলে আপনার এই তদন্ত কানাগলিতে ঢুকে পড়বে।” এরপর আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিল সে।“আমার ধারণা, আপনি এরইমধ্যে কানাগলিতে ঢুকে পড়েছেন।”

গভীর করে দম নিয়ে নিল ছফা। “আচ্ছা। তাহলে বলুন, কীভাবে রমাকান্তকামারের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হলেন আপনি?ভদ্রলােক বলেছেন, আপনি কাগজপত্র পাঠানাের আগে উনি আপনাকে চিনতেনই না।”

মাথা দোলাল আইনজীবী। “কথা সত্যি।” “রমাকান্তকামারের সঙ্গে কীভাবে কন্ট্যাক্ট হয়েছিল আপনার? কে করিয়ে দিল সেটা?”

মাথা দোলাল ময়েজ উদ্দিন। “এটা তাে বলা যাবে না। কেউ যদি নিজের পরিচয় গােপন রেখে তৃতীয় পক্ষ হয়ে অন্য কারাের ক্লায়েন্ট হবার জন্য আমাকে অনুরােধ করে সেটা কিন্তু বেআইনি নয়। এরকমটা প্রায়ই হয়ে থাকে আমাদের পেশায়। তবে আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, মুশকান জুবেরি একাজ করেনি।”

ছফার ধৈর্যসীমা শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকল। “মনে হচ্ছে ওই মহিলাকে রক্ষা করতে আপনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করতেও রাজি আছেন।”এবার আইনজীবী ভদ্রলােকের কৃত্রিম হাসিহাসি ভাবটা উবে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। “আমি কিন্তু এটাকে হুমকি হিসেবে দেখব।আপনি সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন আমাকে!

“আমি হুমকি দিচ্ছি না  বলছি, ওই মহিলাকে রক্ষা করতে আপনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করতেও রাজি আছেন বলে মনে হচ্ছে,” শুধরে দিল ছফা। “এটা আমার পারসেপশান।”

“আচ্ছা,” মাথা দোলাল উকিল। “তাহলে সম্ভবত আপনি এটাও আন্দাজ করতে

পারছেন, কীভাবে কারা আমার ক্ষতি করতে পারে?”

– “তা তাে পারছিই।”

“কারা?” “সেটা কিছুক্ষণ পরই টের পাবেন।” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল আইনজীবী।“কারকথা বলছেন?কাদের কথা বলছেন আপনি?” “এমন একজন যার কথা আপনি কোনােভাবেই ফেলতে পারবেন না।”

“হা-হা-হা,” ময়েজ উদ্দিনের অট্টহাসিতে ছােট্ট চেম্বারটা ভরে গেল। “অনেক ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে সেই লােক?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চেয়ারে আয়েশ করে হেলান দিল নুরে ছফা।

“আইনের দিক থেকে আমাকে ধরা, আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ করার মতাে কিছু আপনার এবং আপনার ওই ক্ষমতাধর মানুষটার কাছে নেই—এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।”  “তা মাথায় রাখছি, কিন্তু আপনাকেও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এই দেশে সব কিছু আইন মােতাবেক চলে না,”একটু থেমে আবার বলল,“এটা আমার মতাে আপনিও ভাল করেই জানেন ক্ষমতাবানেরা আইনের পরােয়া করে না।”  আইনজীবী ভদ্রলােকের কপালের ভাঁজ আরও ঘন হল।“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? যা বলার স্পষ্ট করে বলুন।”

“এই মুশকান জুবেরির একজন শিকার হল প্রাইমিনিস্টারের পিএস আশেক মাহমুদের ভাগ্নে।”

কথাটা শুনে উকিল একটু অবাক হল।

কি হল। “তিনি এখন নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে একটা তথ্যই জানতে চাইছেন মুশকান জুবেরি কোথায় আছে।”

ময়েজ উদ্দিন অপেক্ষা করল আরও কিছু শােনার জন্য।

“আমি তাকে এই চিরকুটটা দেখিয়েছি…বলেছি, এটা আপনার মাধ্যমে রমাকান্তবাবুকে দিয়েছে ওই মহিলা। উনি আমাকে বলেছেন, আপনি যদি ভালােয় ভালােয় বলে দেন ওই মহিলা এখন কোথায় আছে তাহলেই আপনার মঙ্গল।নইলে আপনার কাছ থেকে যেভাবেই হােক এটা বের করে নেবেন।”

“তাহলে উনি আপনাকে কেন পাঠিয়েছেন  নিজে ফোন করলেন না কেন? নাকি সরাসরি ফোন করে হুমকি দিতে ভয় পাচ্ছেন?” মাথা দোলাল ছফা।উকিল সম্ভবত ভাবছে ক্ষমতাধর একজনের নাম ভাঙিয়ে সে ভয় দেখাচ্ছে তাকে। “উনি কিছু করার আগে আমি নিজে একবার চেষ্টা করে দেখতে এসেছি।”  “ওঁর হয়ে হুমকিটা দিতে?” বাঁকাহাসি দিয়ে বলল উকিল।

“না। আপনার পাছা বাঁচাতে।”ভদ্রলােকের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল আপত্তিকর শব্দটা শুনে। কোনাে রকম রাগ দমন করে বলল, “আমার পাছা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের পাছা রাখার ক্ষমতা আমার আছে।” কথাটা বলে গভীর করে দম নিয়ে নিল। “আপনার কেসটা নিয়ে কিছুই করতে পারছেন না সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আপনার পিএস হয়তাে অধৈর্য হয়ে আপনাকে খুব চাপের মধ্যে রেখেছে, এখন নিজের বাঁচাতে এসেছেন আমার কাছে অদ্ভুত এক আবদার নিয়ে রাশেদ জুবেরির স্ত্রীর হদিস জানতে চাইছেন!” এ ছফার চোখমুখও শক্ত হয়ে গেল, তারপরও উকিলকে অবাক করে দিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিল সে। “ঠিক বলেছেন, উনি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। বলতে পারেন, ওঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।” এ দাঁত বের করে হাসল উকিল। “এটাই স্বাভাবিক। তিন বছর ধরে একটা কেস সমাধান করতে পারছেন না, অধৈর্য হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।”

“শুনুন, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ক্ষমতাবান মানুষেরা তার চেয়ে কম ক্ষমতাবান মানুষজনের সঙ্গে ডিল করার সময় খুব বেশি ধৈর্য দেখান না।”

“এটাই স্বাভাবিক। আপনি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।” মুচকি হেসে মাথা দোলাল নুরে ছফা।“শুধু আমার কথা না ভেবে নিজেকেও হিসেবের মধ্যে রাখবেন।”

“আপনি আবারও হুমকি দিচ্ছেন কিন্তু!” তেঁতে উঠল ভদ্রলােক। গভীর করে দম নিয়ে নিল ছফা। “একটু ঠান্ডা মাথায় আমার কথাটা শুনুন, এই তদন্তের জন্য দরকার শুধু সামান্য একটি তথ্য। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়তাে আপনি দেবেন কিন্তু অনেক জল ঘােলা করে।”

ছফার কথাটা শুনে চিন্তিত দেখাল আইনজীবীকে কিন্তু মেজাজের ঝাঁঝ একটুও কমাল না। “জল ঘােলা করতে কী বােঝাচ্ছেন? উনি কী করবেন, অ্যা?”  “কী আর করবেন, সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়ােগ করে জেনে নেবেন মুশকান জুবেরি এখন কোথায় আছে।”

“আরে, বারবার এক কথা বলছেন কেন!” চটে গেল উকিল। “বললাম না, ওই মহিলার সঙ্গে আমার কোনাে যােগাযােগ নেই! জীবনে তার সঙ্গে আমার কথাও হয়নি, দেখা হবার তাে প্রশ্নই ওঠে না! আমি কীভাবে তার খোঁজ দেব?!”  “তাহলে ওঁর চিরকুটটা রমাকান্ত কামারকে দিলেন কীভাবে?”উকিলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।“আমি সেটা কাউকে বলতে বাধ্য নই। আপনার ওই ক্ষমতাধর পিএস কি
বাল ফেলবে ফেলুক!”ময়েজ উদ্দিন ক্ষেপে গেল এবার।“ওকে বলে দেবেন, এইসব মাস্তানি আর গুন্ডামি আমার সঙ্গে যেন করতে না আসে!”

আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা দোলাল ছফা। “তাহলে ওঁকে বলে দেই, আমি ব্যর্থ… যা করার উনিই করুক।”

ছফারক কণ্ঠে শীতলতা টের পেয়ে উকিল বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।কী করবে আপনার ওই পিএস, অ্যা? আমাকে তুলে নিয়ে যাবে?” চেঁচিয়ে উঠল এবার। “গুম করবে?”

“সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

ভদ্রলােকের চেহারায় রাজ্যের বিস্ময় নেমে এল, কপাল গেল কুঁচকে। চট করে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে।“গেট লস, ইউ স্কাউন্ডরেল!”রীতিমতাে কাঁপতে লাগল সে।“গুম-খুন করতে করতে সাহস অনেক বেড়ে গেছে, অ্যা? দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে শালারা!

যা খুশি তাই করবে ?!”

ছফা নির্বিকার মুখে বসে রইল চেয়ারে হেলান দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল লম্বা, পেটানাে শরীরের একজন মানুষ। ছােটো করে ছাটা চুল, শ্যাম বর্ণের কঠিন মুখ। লােকটাকে ঢুকতে দেখে উকিল ভদ্রলােক ভড়কে গেল।

অধ্যায় ৩৪

“কে আপনি?”

“চুপ!”উকিলের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠল এইমাত্র ঘরে প্রবেশ করা বলিষ্ট দেহের লােকটি। “কথা বললেই গুলি করে দেব!” কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে আনল সে, উকিলের মুখের কাছে অস্ত্রটা নেড়ে ইশারা করল তাকে বসে পড়ার জন্য।

“আস্তে,”ছফা বলল সেই লােকের উদ্দেশ্যে।“সেফটি লক অফ আছে তাে? গুলিটুলি আবার বের হয়ে যায়!”  বলিষ্ঠ দেহের লােকটা পিস্তলনামিয়ে রাখলেও জায়গা থেকে একচুলও সরে দাঁড়াল
না।

“আপনি বসুন,”ছফা আদেশের সুরে বলল ময়েজ উদ্দিনকে। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বসে পড়ল উকিল, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। “ও একা না, বাইরে আরও লােকজন আছে, একটা মাইক্রোবাসও আছে।” ঢোঁক গিলল ভদ্রলােক।

“তবে আমি ঝামেলা করতে চাইছি না। আপনাকে তুলে নিয়ে যাবার কোনাে ইচ্ছেও আমার নেই।পিএসকে আমি কথা দিয়েছি, আপনি যদি আমার সঙ্গে কো-অপারেট করেন। তাহলে এসবের কোনাে দরকারই হবে না।”

ছফার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার।“ওটা যে মুশকান জুবেরির চিরকুট আমি জানতাম না  সত্যি বলছি,”মৃয়মান কণ্ঠে বলল সে। “আমি শুধু কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে ওটা রমাকান্তবাবুকে দিয়েছিলাম।”

“চিরকুটটা আপনাকে কে দিতে বলেছিল?” কয়েক মুহূর্তচুপ থেকে উকিল বলল, “ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ।”  তথ্যটা বিস্মিত করল ছফাকে। মুশকানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ডাক্তারকে আগে থেকেই সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত ছিল, কিন্তু প্রবীন এই ভদ্রলােককে মুশকান জুবেরি ব্যবহার করেছে, আদতে ডাক্তার আসকার এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মােটেও জড়িত নন, মুশকানের কারণেই ভদ্রলােক আমেরিকায় পালিয়ে যান ঝামেলা থেকে বাচতে কিছু দিন তার পেছনে সময় ব্যয় করার পর এমন ধারণাই পোষ
ণ করত ছফা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, লােকটার পেছনে আরও সময় এবং শ্রম ব্যয় করা উচিত ছিল।

“উনি কেন আপনাকে দিয়ে এটা পাঠালেন?”

ইতস্তত করল উকিল। “উনিই আমাকে ট্রাস্টের ল-ইয়ার হিসেবে নিয়ােগ  দিয়েছেন।”।

নুরে ছফা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এটা। পরক্ষণেই তার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হল-ডাক্তার আসকার আমেরিকায় যাবার আগে না পরে এ কাজ করেছেন?

“চিরকুটটা উনি কবে দিয়েছিলেন আপনাকে?” “অনেক দিন আগে, তিন বছর তাে হবেই।” “আমি সঠিক সময়টা জানতে চাইছি।”

“আমাকে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। ট্রাস্টের কাগজপত্র তৈরি করে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম রমাকান্তবাবুকে  ওটার রেকর্ড আছে।”

“তাহলে কাগজপত্র দেখে বলুন,”ছফা আদেশের সুরে বলল।

উকিল ভদ্রলােক প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে ডেস্কের ড্রয়ার ঘেঁটে অবশেষে একটা নথি বের করে আনল।“এটা ”

উকিলের হাত থেকে নথিটা নিয়ে তারিখটা দেখে নিল ছফা। “চিরকুটটা পাঠিয়েছি এই তারিখে, তবে ওটা পেয়েছি আরও দুদিন আগে।”

ছফা নড়েচড়ে বসল। মুশকানের কেসের অনেক কিছুই তার মুখস্ত। সে ভালাে করেই জানে, কবে কখন ডাক্তার দেশ ছেড়েছিলেন।

“এটা কীভাবে সম্ভব! ডাক্তার তাে তার আগেই আমেরিকায় চলে গেছিলেন!”অনেকটা আপন মনেই বলে উঠল সে।

“তা তাে জানি না। উনি আমার চেম্বারে না এসে বাসায় গিয়ে চিরকুটটা দিয়েছিলেন। একটা মুখবন্ধ খামে ছিল।”  মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। মুশকান জুবেরি নিজে এসে চিরকুট দেবার মতাে কাঁচা কাজ করবে না। তাছাড়া আইনজীবির সঙ্গেও তার সম্ভবত কোনাে রকম যােগাযােগ নেই—এসব কাজ ডাক্তার আসকারই করেছেন।

“ডাক্তার তাহলে ঢাকায়ই ছিলেন!” কথাটা প্রশ্নের মতাে শােনাল না। ভদ্রলােক যে আমেরিকায় চলে গেছেন এটা খতিয়ে দেখা দরকার ছিল। সম্ভবত দেশের ভেতরেই কিছু দিন আত্মগােপন করেছিলেন, তারপর হয়তাে বিদেশে চলে যান। আবার এমনও হতে পারে, ডাক্তার বিদেশে গিয়ে কিছুদিন পর দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ততদিনে ছফা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছিল তার ব্যাপারে। ধরেই নিয়েছিল, ভদ্রলােক সহসা দেশে ফিরে আসবেন না।

“উনি কোথায় ছিলেন না ছিলেন সেটা তাে আমি জানি না,” উকিল এখন পরাভূত মানুষ, নিজ থেকেই বলতে লাগল। “আমি যা জানি তা-ই বললাম আপনাকে। এটাই সত্যি। বিশ্বাস করুন।”

“এরপর কি আপনার সঙ্গে ওঁর আর যােগাযােগ হয়নি?”

হয়েছে, তবে ফোনে।” “কোত্থেকে ফোন করেছিলেন উনি?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল ছফা। একটু ইতস্তত করল উকিল।“দেশের বাইরে থেকে।” “কোনদেশ থেকে?” “নাম্বার দেখে মনে হয়েছে আমেরিকা থেকেই কলটা করেছিলেন।”

ছফার সমস্ত উত্তেজনা দপকরে নিভে গেল। কয়েক মুহূর্ত উকিলের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “শেষ কবে যােগাযােগ হয়েছিল ওঁর সঙ্গে?”

“গত বছর।” “ডাক্তার যে নাম্বার থেকে আপনাকে ফোন… ”

কথাটা শেষ করার আগেই ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার মাথা দুলিয়ে অপারগতা প্রকাশ কবল।“এক বছর আগের ঘটনা, নাম্বারটা আর কললিস্টে নেই।”

একটু ভেবে নিল ছফা।“উনি আপনাকে কী জন্যে ফোন দিতেন?” ‘ট্রাস্টের কাজকর্ম ঠিকমতাে হচ্ছে কিনা, খোঁজখবর নিতেন আর কী।” “উনি ট্রাস্ট নিয়ে এত মাথা ঘামান কেন?”

প্রশ্নটা শুনে ময়েজ উদ্দিন একটু অবাক হল যেন। “ট্রাস্ট্রের একজন মেম্বার হিসেবে খোঁজখবর নেবেন না?”

ছফা চমকে গেল। ডাক্তার আসকার ট্রাস্ট্রেরও সদস্য ! এটা সে জানত না। আসলে, রমাকান্ত কামার ছাড়াও যে ট্রাস্টে আরও কয়েকজন সদস্য আছে সেটা নিয়ে কখনও আগ্রহ দেখানাের প্রয়ােজন বােধ করেনি। “ওঁকে কি মাস্টার নিজে ট্রাস্টের মেম্বার করেছেন নাকি ?”

“এটা রাশেদ জুবেরির ইচ্ছেতে হয়েছে। ডাক্তারের সঙ্গে মি.জুবেরির ঘনিষ্ঠতা ছিল।”

“হুম  বুঝতে পেরেছি,” শুধু এটুকুই বলল ছফা। মাস্টার তাকে এটা বলেননি। সেজন্যে ভদ্রলােককে দোষও দেওয়া যায় না। দরকারের বাইরে আগ বাড়িয়ে কোনাে কিছু বলার মতাে লােক নন তিনি।

“দেখুন, আমি যা জানতাম বলে দিয়েছি, এর বেশি কিছু জানি না,”উকিল ভদ্রলােক বলল।“এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা, তারপর পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন চেহারার লােকটার দিকে তাকাল, সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে গেল ময়েজ উদ্দিনের দিকে।

“কী হচ্ছে! কী হচ্ছে!”একদম ভড়কে গিয়ে বলে উঠল উকিল, নিজের চেয়ারে সেঁটে থাকার চেষ্টা করল। “আমি সত্যিই বলেছি  বিশ্বাস করুন!”

জাঁদরেল চেহারার লােকটি উকিলের কলার ধরল আস্তে করে।

ময়েজউদ্দিন সাহায্যের আশায় তাকাল ছফার দিকে। “আ-আপনি আমাকে বলেছিলেন সত্যিটা বললে আমার কোনাে ক্ষতি করবেন না  আমি কিন্তু সব সত্যি বলেছি!”

“হুম, তা বলেছিলাম,”বলল ছফা। “কিন্তু সত্যি বলেছেন নাকি মিথ্যে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে আমাকে।”  উকিলের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। “খতিয়ে দেখবেন মানে?” একটা ঢোঁক গিলে আবার বলল, “কীভাবে?”

এবার মুচকি হাসি দিল ছফা। “ভয়ের কিছু নেই। আপনি আপনার ফোনটা ওকে দিয়ে দিন।” পিস্তল হাতে লােকটাকে দেখিয়ে বলল সে। “ডেস্ক-ড্রয়ার আর ক্যাবিনেটের চাবিটাও।”  উকিল ভদ্রলােক স্থিরচোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু অস্ত্রধারী অপেক্ষা করল , ময়েজ উদ্দিনের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মােবাইলফোনটা বের করে আনল, তারপর আইনজীবীর কাঁধে টোকা দিয়ে চাবিগুলাে চাইল সে।  মন্ত্ৰতাড়িতের মতাে ময়েজ উদ্দিন ডেস্কের উপরের দিকে একটা ড্রয়ার থেকে চাবির গােছাটা বের করে দিয়ে দিল লােকটাকে।

নুরে ছফা ষণ্ডাটার কাছ থেকে মােবাইলফোনটা নিয়ে নিল। “তুমি সবগুলাে ড্রয়ার চেক করে দেখাে। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে।”

“জি, স্যার,” লােকটা বলল, তারপর উকিলের দিকে তাকাল।“চুপচাপ এখানেই বসে থাকুন। একদম শব্দ করবেন না।”

উকিলের ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করে দিল ছফা। ওদিকে পিস্তল হাতে লােকটা উকিলের ফাইল কেবিনেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“আপনি আমার কাগজপত্র এভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারেন না!”আহত কণ্ঠে বলল ময়েজ উদ্দিন। “অনেক জরুরি কাগজপত্র আছে  ক্লায়েন্টদের অনেক গােপনীয়”

ছফা শীতল চোখে তাকালে উকিল ভদ্রলােক কথার মাঝপথে থেমে গেল, আবারও নিজের কাজে ফিরে গেল সে।

কয়েক মুহূর্ত পর, আইনজীবী ভদ্রলােকের দিকে তাকাল নুরে ছফা। ফোন ঘাঁটতে গিয়ে সে দেখেছে, রুবিনা নামের একজনের সঙ্গে ডাক্তারের প্রণয়ঘটিত অসংখ্য মেসেজ। এই সেলফোন জিনিসটা যে আজকাল মানুষের সবচাইতে বড়ো প্রাইভেসি স্টোররুম হয়ে উঠেছে সেটা তার মতাে তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে ভালাে আর কে জানে। কারাের ফোন মানেই অসংখ্য গােপনীয় কাজকারবারের ভাণ্ডার।

“আমার কথা আপনি বিশ্বাস করেননি!” আশাহত কণ্ঠে বলল উকিল।

“এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার না,” চোখ না তুলেই বলল ছফা।“এটা একেবারেই বিশুদ্ধ একটি তদন্তের বিষয়।”

“অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করাকে আপনি তদন্ত বলছেন?”

মুচকি হাসল ছফা, তার চোখ এখনও ফোনের দিকে নিবদ্ধ। তদন্ত করার প্রাইভেসি লঙ্ঘন হল কী হল না এসব নিয়ে মাথা ঘামালে এগােনােই যায় না।”তার মুখ তুলে আশ্বস্ত করে বলল, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, আমার কেসের  সম্পর্ক নেই এরকম কোনাে কিছু নিয়ে আগ্রহ দেখাব না। সেটা কোনাে পরনারীর  সম্পর্কের ব্যাপারই হােক কিংবা গােপন কোনাে ক্লায়েন্টের কথাই হােক না কেন।”

উকিলের চেহারা আরক্তিম হয়ে গেল কথাটা শুনে। আবারও মনোযােগ দিয়ে কললিস্ট আর মেসেজ বক্স ঘাঁটতে লাগল ছফা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ময়েজ উদ্দিনের ভেতর থেকে।“আপনি আমার ফোনটা রাখুন, মি.ছফা,”কয়েক মুহূর্ত পর আস্তে করে বলল সে। “আর ওকেও থামতে বলুন,” ষণ্ডাটাকে ইঙ্গিত করল এবার।

মুখ তুলে তাকাল ছফা। তার চোখেমুখে প্রশ্ন।

গভীর করে দম নিল ভদ্রলােক।“এসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ডাক্তারের খোঁজ পাবেন না,” ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বলল উকিল।“ডাক্তার আসকার আমাকে না বললেও আমার ড্রাইভার জানে উনি কোথায় থাকেন।”

অধ্যায় ৩৫

ময়েজ উদ্দিন খােন্দকারের চেম্বার থেকে বের হয়েই প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদকে ফোন করেছিল ছফা। উকিল ভদ্রলােক যে অবশেষে মুখ খুলেছে সেটা জানিয়ে দেওয়া হয় তাকে।  তিন বছর আগে সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পর মুশকান জুবেরি উঠেছিল ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের ফ্ল্যাটে। তারপর একই ভবনে অন্য একটি ফ্ল্যাটে থাকা নিঃসঙ্গ এমপি
আসাদুল্লাহকে হত্যা করার পর পর আত্মগােপনে চলে যায় সে। মহিলার সঙ্গে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদও লাপাত্তা হয়ে যান। সুতরাং মুশকানকে ধরতে হলে ডাক্তারকে কব্জায় নিতে হবে সবার আগে। ডাক্তারই জানেন মুশকান কোথায় আছে। তাই ছফা এখন পিএসের ব্যক্তিগত গানম্যান আসলামকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বনানীতে। – ময়েজ উদ্দিনকে যতটা ভয় দেখানাের দরকার ছিল ততটাই করেছে। একটুও বাড়াবাড়ি করেনি। তা করার অবশ্য দরকারও ছিল না। তার মেদহীন পেটানাে শরীর আর জাঁদরেল চেহারাটাই যথেষ্ট ছিল। পিস্তল হাতে অমন কঠিন মুখের কাউকে দেখলে ভয় পাবারই কথা। তার আর-একটি গুণ হল, দরকার না পড়লে সে খুব একটা কথা বলে না। বাড়তি কোনাে প্রশ্নও করে না।  এত দিন ছফা জানত, ডাক্তার আমেরিকায় চলে গেছেন, কিন্তু ট্রাস্টের উকিল তাকে জানিয়েছে, ভদ্রলােক আমেরিকায় গেলেও মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসেন। আর ঢাকায় কোথায় থাকেন সেটাও উকিলের জানা আছে।

এখন দরকার আসকার ইবনে সায়িদকে নিজের কব্জায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার। স্বনামখ্যাত ডাক্তার হিসেবে তার সঙ্গে রয়েছে সমাজের উঁচুমহলে ভালাে যােগাযােগ। পিএস যেন ছফাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন।

এমন অনুরােধের কথা শুনে আশেক মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছে, এ নিয়ে চিন্তার কোনাে কারণ নেই। প্রশাসন কিংবা বড় কোনাে রাজনৈতিক নেতা তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এগুলাে সামাল দেবার ক্ষমতা তার রয়েছে।

যে গাড়িটা আসলাম চালাচ্ছে সেটা পিএসের দুটো সরকারি গাড়ির একটি পথে কোনাে রকম ট্রাফিক পুলিশের চেকিংয়ে যেন পড়তে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা আশেক মাহমুদ যেচে এই গাড়িটা আর নিজের গানম্যান আসলামকে দিয়েছে তাকে। আরও বলে দিয়েছে,

লােকবলের দরকার পড়লে ছফা যেন কোনাে রকম সঙ্কোচ না করে। অবশ্য সেটার কোনাে দরকারও দেখছে না সে। সত্তরউর্ধ এক ডাক্তার, কেএস খানের মতো ভঙ্গুর একজন সাবেক ডিবি অফিসারের সামনেই ঘাবড়ে গিয়ে সব গরগর করে বলে দিয়েছিলেন, ছফার মুখােমুখি হলে কী করবেন তিনি?

মুচকি হাসল নুরে ছফা। উকিল ভদ্রলােক যখন বুঝতে পারল নিজের উপরে ভয়ানক বিপদ নেমে এসেছে তখন ঠিকই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার আসকার কখন উকিলকে বলেননি তিনি কোথায় আছেন, কিন্তু ময়েজ উদ্দিন অদ্ভুতভাবেই জেনে গেছিল তার বাড়ির হদিস।

প্রায় বছরখানেক আগে তার দীর্ঘ দিনের ড্রাইভার চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে গেলে একজন নতুন ড্রাইভারের দরকার পড়ে, তখন পরিচিত একজনের রেফারেন্স নিয়ে এক ড্রাইভার আসে তার কাছে ইন্টারভিউ দিতে। ময়েজ উদ্দিন যখন জানতে চায় এর আগে সে কোথায় কাজ করেছে, তখন ওই লােক জানায়, দীর্ঘদিন সে কাজ করেছে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ নামের এক ডাক্তারের ড্রাইভার হিসেবে।

নড়েচড়ে ওঠে উকিল। ডাক্তারের চাকরিটা তাহলে ছেড়ে দিলে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভারা জানায়, ডাক্তার এখন ঘন ঘন দেশের বাইরে যান, মাসের পর মাস বাইরে থাকেন, সেজন্যে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন।

ডাক্তারের সাবেক ড্রাইভারকেই ময়েজ উদ্দিন তার ড্রাইভার হিসেবে নিয়ােগ দিয়েছে ওই ইন্টারভিউয়ের পরে। ফলে নিজের ড্রাইভারকে ফোন করে ডেকে, খুব সহজেই তার পুরােনাে মনিবের বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নেয় উকিল।  ময়েজ উদ্দিন খােন্দকারের পু
রানা পল্টনের অফিস থেকে বিকেলে বের হলেও বনানীতে পৌছাতে পাক্কা দেড় ঘণ্টা লেগে গেল ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের কারণে। বনানীর তিন নাম্বার রােডের ১২ নাম্বার বাড়িটার সামনে ছফাদের গাড়ি থামল সন্ধ্যার একটু আগে।

গাড়ির ভেতর থেকেই বাড়িটার দিকে তাকাল সে। এটা বনানীর খুব কম সংখ্যক অভিজাত বাড়ির একটি, যা এখনও ডুপ্লেক্স হিসেবে টিকে আছে। আশেপাশে সবগুলাে বাড়ি সময়ের আবর্তে মাল্টিস্টোরড অ্যাপার্টমেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল নুরে ছফা, বন্ধ গেটটায় টোকা মারল সে। আসলাম ড্রাইভিং সিট থেকে বের হয়ে এসে গেটের ডানদিকে থাকা কলিংবেলের সুইচ টিপে দিল।

প্রায় তিন-চার মিনিট পর বিশাল গেটটার মাঝে যে ছােটো দরজা আছে সেটা খুলে মাথা বের করল এক লােক। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ছফা মুখ খুলল।

“ডাক্তারসাহেব আছেন না?” ভুরু কুঁচকে গেল তার। “আপনারা কারা?” আসলাম খপ করে তার কলার ধরে ফেলল। “ডাক্তার কোথায়?”

আসলামের এমন আচরণে ভড়কে গেল লােকটা। “আমরা পুলিশ। বুঝতে পেরেছিস?”

লােকটার চেহারা দেখে মনে হল এই জীবনে কখনও কোনাে পুলিশ তার কলার ধরে কিছু জানতে চায়নি।

“ডাক্তার ছাড়া আর কে থাকে এখানে?” ছফা বেশ শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল। তার ভাবভঙ্গিটাই এমন, ভালাে করেই জানে এখানে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ থাকেন।

লােকটা ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে আছে দেখে আসলাম একটা ঝাঁকুনি দিল তাকে। “স্যারের কথার জবাব দে, বানচোত!”

“আ-আর তাে কেউ থাকে না।” ছফা আর আসলাম আস্তে করে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। “দরজা বন্ধ করে দে,”হুকুমের স্বরে বলল আসলাম। দারােয়ান ভড়কে গেলেও কথামতােই কাজ করল। “স্যার, একে কী করব?”ছফার কাছে জানতে চাইল গানম্যান। “ওকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসাে,”কথাটা বলেই ছােট্ট লনটা পেরিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল সে।

আসলাম যুবকের এক হাত শক্ত করে ধরে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলল ছফার পেছন পেছন।

“ডাক্তার কি নীচতলায় থাকেন?” পেছনে না তাকিয়েই জানতে চাইল ছফা। “না, উপর তলায় থাকেন,”জবাব দিল যুবক।

নীচ তলায় ঢুকে একটা আধপেঁচানাে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল তারা তিনজন। কেউ কোনাে শব্দ করল না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ছফা দেখতে পেল ডাক্তার আসকার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দোতলার ল্যান্ডিংয়ের কাছে। নিরিবিলি বাড়িতে শােরগােলের আওয়াজ শুনে হয়তাে খোঁজ নেবার জন্য নীচে নামতে যাচ্ছিলেন তিনি।

অধ্যায় ৩৬

সিল্কের নাইট গাউন পরা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সৌম্যকান্তির অবয়বটি সামান্য কুঁজো হয়ে আছে, মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার ল্যান্ডিংয়ের কাছে। একটু আগে, কলিংবেলের শব্দ শুনে তিনি যথেষ্ট অবাক হয়েছিলেন। এরকম কিছুর আশঙ্কা যে তার মনে উঁকি দেয়নি তা নয়, কিন্তু সত্যি বলতে, নুরে ছফাকে মােটেও আশা করেননি তিনি!

“কেমন আছেন, ডাক্তার সাহেব?”সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে মুচকি হেসে বলল ছফা। “খুব অবাক হয়েছেন মনে হয়।”

ঘটনার আকস্মিকতায় ডাক্তার কোনাে কথা খুঁজে পেলেন না। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও প্রকট হল।

“আপনার পেছনে আমাকে আরও সময় ব্যয় করা দরকার ছিল,”অনেকটা আফসোসের সুরে বলল সে।“বলতে লজ্জা নেই, আপনাকে আমি খাটো করে দেখেছিলাম।”

ডাক্তার কিছুই বললেন না। “তো, আমেরিকা থেকে কবে এলেন?”

“যাওয়া আসার মধ্যেই আছি। শেষবার এসেছি গত মাসে,”বেশ শান্ত কণ্ঠেই বললেন ভদ্রলোেক।

কপালে চোখ তুলে ফেলল ছফা। “এতে অবাক হবার কিছু নেই, আমি ফ্রিকোয়েন্টলি ট্রাভেল করি….এটা সবাইজানে।”

“কিন্তু সবাই যেটা জানে না তা হল, আপনি আগে কখনও ঢাকায় এসে চোরের মতাে ঘাপটি মেরে থাকতেন না।”

ডাক্তার নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেন, তবে চোর শব্দটার ব্যবহারে ভেতরে ভেতরে যে রুষ্ট হয়েছেন সেটা অবশ্য বােঝা গেল।“দেশে ফিরে এলে ঘােষণা দিয়ে জানাতে হবে তা তাে জানতাম না,”আস্তে করে বললেন তিনি। “নাকি আমি কোনাে ফেরারি আসামি ? থানায় গিয়ে রিপাের্ট করার কথা ছিল?”

ছফা অবাক হল ডাক্তারের এমন কথায়। কেএস খান আর জাওয়াদের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছে, এই লােক খুব সহজেই ভেঙে পড়েছিলেন-নরম, ভঙ্গুর আর ভদ্র একজন মানুষ। কিন্তু এখন তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, লােকটা অত নরম স্বভাবের নয়।

“আপনি তাে আপনার নিজের হাসপাতালকেও কিছু জানাননি?”

“আমার নিজের হাসপাতাল, আমি কাকে জানাব?” মাথা দোলালেন ডাক্তার। “আপনাকে মনে রাখতে হবে, ওখানকার কারও কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয় না, বরং হাসপাতালের সবাই আমার কাছে জবাবদিহি করে।”  মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “হুম, তা ঠিক। এই সুবিধাটুকু আপনার আছে। হাজার হলেও, ওটার ত্রিশ পার্সেন্ট মালিক তাে আপনিই।”

“তিন বছর আগের কথা,”ডাক্তার বললেন। “মনে হচ্ছে আপনি পুরােপুরি আপডেটেড নন। পার্সেন্টেজটা এখন পাঁচচল্লিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।”

কপালে চোখ উঠে গেল নুরে ছফার। “তাহলে কংগ্রাচুলেশন্স, ডাক্তার।”

শুভেচ্ছাটি গ্রহণ করার মতাে কোনাে লক্ষণ দেখা গেল না আসকার ইবনে সায়িদের অভিব্যক্তিতে। “এখন বলুন, জোর করে আমার বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?”

হাসল নুরে ছফা, আসলামের দিকে তাকাল সে। চোখমুখ কঠিন করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পেছনে ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে এই বাড়ির দারােয়ান।

“আমি যে মুশকান জুবেরির খোঁজ করছি আপনি সেটা ভালাে করেই জানেন।” বাঁকাহাসি দিলেন ডাক্তার। “আপনার ধারণা, সে এই বাড়িতে আছে?”

মাথ দোলাল ছফা। “নাহ আমার মনে হয় না, ওই মহিলা এরকম কাঁচা কাজ করবে।” ডাক্তারের দিকে চোখ স্থির করে বেশ জোর দিয়ে বলল, “তবে সে কোথায় আছে, আপনি জানেন।”

আসকার ইবনে সায়িদের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। “তিন বছর ধরে তাকে খুঁজে না পেয়ে শেষে আমার কাছেই এলেন?”

ছফা এ কথার কোনাে জবাব না দিয়ে আশেপাশে তাকাল। “চলুন, কোথাও বসি আপনার সঙ্গে অনেক কথা বলতে হবে আমাকে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার, ড্রইংরুমের দিকে যেতে যেতে পেছন দিকে না তাকিয়েই বললেন, “ওয়াহাবকে ছেড়ে দিন, ও গেটের কাছে থাকুক, ও এ বাড়ির দারােয়ান, ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।”

আসলামকে ইশারা করল ছফা। দারােয়ান ছেলেটাকে হাত নেড়ে নীচে চলে যেতে বলল সে।  ডাক্তার তার বিশাল ড্রইংরুমের একটা সিঙ্গেল সােফায় বসে পড়লেন। “আপনার ধারণা, মুশকান কোথায় আছে সেটা আমি জানি ?”

আসলামকে নিয়ে বড়ো সােফাটাতে বসে পড়ল ছফা। “হ্যাঁ, আমার সেরকমই ধারণা।”

“তাহলে তাে, আমার মতাে মানুষকে এরকম একটি তথ্য জানিয়ে দিয়ে মুশকান বেশ কাঁচা কাজই করে ফেলেছে,”ব্যঙ্গ করে বললেন আসকার ইবনে সায়িদ।

“মানুষ তাে, ভুল করতেই পারে,”ছফা হেসে বলল।“কেউই ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়।

যতই বদ্ধিমান মানুষ হােক, ভল তাে করেই।”

“তা ঠিক, আর সেটা আপনার বেলায়ও খাটে।”

“তবে মুশকান জুবেরি কোথায় আছে সেটা কেবল আপনিই জানেন-এব্যাপারে একদম নিশ্চিত। এখানে আমার কোনাে ভুল নেই।”

“আপনার এমন ধারণার কারণ ?”

পকেট থেকে রমাকান্ত কামারকে দেওয়া সেই চিরকুটটা বের করে ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিল নুরে ছফা।“এটা দেখুন, আশা করি চিনতে পারবেন।”

চিরকুটটা হাতে নিয়ে একটু দূর থেকে দেখার চেষ্টা করলেন ডাক্তার, তারপর নাইটগাউনের বুক পকেট থেকে রিডিং গ্লাসটা বের করে নাকের উপর চাপিয়ে দিলেন। একটু সময় নিয়ে পড়লেন চিরকুটটা।“এটা কার ?” পড়া শেষে জানতে চাইলেন।

“আপনি বলতে চাইছেন, আপনি জানেন না?” “আমি কীভাবে জানব? মুখবন্ধ একটা খাম দিয়েছিলাম উকিলকে সেটা তাে খুলে দেখিনি। অন্যের চিঠি পড়ার মতাে বদ অভ্যেস আমার নেই।”

“কিন্তু অন্যের হয়ে চিঠি পাঠানাের অভ্যেসটা ঠিকই আছে।” “কী বলতে চাইছেন?” চোখমুখ শক্ত করে জানতে চাইলেন ডাক্তার।

“রমাকান্ত কামার স্বীকার করেছেন আমার কাছে, এটা তাকে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দির খােন্দকার দিয়েছিল তিন বছর আগে  সুন্দরপুর থেকে মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার ক-দিন পর।”

ডাক্তার অপেক্ষা করলেন আরও কিছু শােনার জন্য।

“আর ময়েজ উদ্দিন খােন্দকারও একটু আগে স্বীকার করেছে, চিরকুটটা আপনি তাকে দিয়েছিলেন।” – আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। “হ্যা। মুশকান আমার ফ্ল্যাট থেকে চলে যাবার আগে একটা মুখবন্ধ খাম রেখে গেছিল,” একটু থেমে আবার বললেন তিনি,“সেই সঙ্গে ছােট্ট একটা নােট। তাতে সে অনুরােধ করেছিলাে, আমি যেন খামটা রমাকান্ত কামারকে দেবার ব্যবস্থা করি।”

ছফার মুখে হাসি দেখা গেল কিন্তু সেই হাসি সন্তুষ্টির নয়।

“আমার পক্ষে সুন্দরপুরে গিয়ে এটা দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে মি খােন্দকারের মাধ্যমে খামটা মাস্টারের কাছে পাঠিয়েছিলাম।”

“ওই উকিলকেও আপনিই নিয়ােগ দিয়েছিলেন।”

“হ্যা। রাশেদ আমাকে বলেছিল, আমি যেন ভালাে কোনাে ল-ইয়ারকে অ্যাপ দেই ট্রাস্টের জন্য।”

“মি জুবেরিকে আপনি তাহলে ভালাে করেই চিনতেন?”

“অবশ্যই। ও আমার দূরসম্পর্কের কাজিন হয়। আমার মাধ্যমেই ওর সঙ্গে মুশকানের পরিচয় হয়। আমার হাসপাতালেই দীর্ঘদিন ট্রিটমেন্ট নিয়েছে।”  একটু ভেবে নিল ছফা। “মুশকান জুবেরির সঙ্গে আপনার শেষ যােগাযােগ করে হয়েছিল ?”

“প্রায় তিন বছর আগে।” মুচকি হাসি দেখা দিল তার ঠোটে। “এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?”

“নাহ”শান্তকণ্ঠেই বললেন ডাক্তার। “আপনি একজন পুলিশ অফিসার  তদন্ত করে দেখেন, তারপর কী বিশ্বাস করবেন না করবেন সেটা আপনার ব্যাপার।”

মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা। “ভালাে কথা, মুশকানের বিরুদ্ধে আপনার অভিযােগটা আসলে কী?”

ডাক্তারের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে দারুণ অবাক হল। “আমার তাে ধারণা, এটা আমার চেয়ে আপনিই ভালাে জানেন।”আসলামের সামনে এসব কথা বলতে একটু দ্বিধা কাজ করলেও এখন সেটা না বলে উপায় নেই। এমুহুর্তে তাকে এই আলাপ থেকে সরিয়ে দেওয়াটা খুবই বেমানান দেখায়। “মুশকান জুবেরি অনেকগুলাে মানুষ হত্যা করে গুম করে ফেলেছে।”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “ও কেন এটা করবে?” “এ কথা জানতে চাইছেন আপনি?!” “আপনার কথা বুঝলাম না?” দাঁতে দাঁত পিষে ফেলল নুরে ছফা। “আপনি সব কিছু অস্বীকার করতে চাইছেন?” “সব কিছু মানে?”

“মি.খান. আমার সিনিয়র  আপনি তার কাছে যা যা বলেছিলেন তিন বছর আগে, সেসবের কথা বলছি।”

বাঁকাহাসি দিলেন ডাক্তার। “এরকম আজগুবি কথা তাহলে আপনিও বিশ্বাস করে বসে আছেন!”

ভুরু কুঁচকে গেল ছফার।

“আপনি কী করে বিশ্বাস করলেন, আমি যা বলেছি তার সবই সত্যি?” ডাক্তারের দিকে চেয়ে রইল নুরে ছফা। ভদ্রলােক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছে না।“আপনি বলতে চাইছেন, আপনি আমার সিনিয়রকে ওরকম কথা বলেননি?”

আসকার ইবনে সায়িদ আলতাে করে মাথা দোলালেন। “না, সেটা আমি বলছি না। ওই ক্রনিক ডিজিজে ভােগা ভদ্রলােককে আসলেই এরকম উদ্ভট কথা বলেছিলাম। যাই হােক, সেটা যে কেউ বিশ্বাস করবে জানতাম না।”

“কী বলতে চাইছেন, আপনি? সব কিছু অস্বীকার করতে চাইছেন এখন?” কাঁধ তুললেন ডাক্তার।“ওটা অবশ্য কোনাে জবানবন্দি ছিল না। আর যিনি এসেছিলেন,তিনিও রিটায়ার্ড করা এক ডিবি অফিসার। তার কাছে কী বলেছি না বলেছি ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।” – ছফার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন”

তার কথা শেষ করা আগেই আসকার ইবনে সায়িদ বলতে শুরু করলেন, “যা বলেছিলাম সেটা একজনের অনুরােধেই বলেছিলাম। ওসব কথা মােটেও সত্যি নয়।”

অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে তাকাল ছফা। “খুবই উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য একটি গল্প বলেছিলাম তার অনুরােধে।”

অধ্যায় ৩৭

মুশকান জুবেরি আন্দিজের বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়নি?

হবার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ওই সময় তার জন্মই হয়নি!  তিন বছর আগে কেএস খানের কাছে যে কাহিনি বলেছিলেন ডাক্তার, সেখান থেকে পুরােপুরি ইউ-টার্ন নিয়ে, সব কিছু অস্বীকার করে নতুন আর-একটি গল্প বলছেন এখন। নুরে ছফার মনে হচ্ছে, সে একটা গােলকধাঁধায় পড়ে গেছে। সব কিছু ঘােলাটে আর প্রহেলিকাময় করে তুলছেন আসকার ইবনে সায়িদ।  গভীর করে নিশ্বাস নিল সে।

“আমি অবশ্য এমন গল্প বলতে রাজি হইনি,”বললেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “কিন্তু ও যখন সবটা খুলে বলল, তখন তাকে বাঁচাতে এমন কাজ করতে রাজি হই।”

“সবটা মানে?”

“সুন্দরপুরের এমপি তার নামে আজগুবি সব অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিল, মানুষের কাছে তাকে ডাইনী বলে প্রচার করেছে, যাতে করে সে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।“লােকটার আসল উদ্দেশ্য ছিল জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দখল করা।”

ছফাও এরকম কথা শুনেছিল আতরের কাছ থেকে।

“মুশকানের ধারণা, ওই এমপিই আপনাকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিল। তাই আপনাকে উদ্ভট একটা গল্প বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল সে।”

“আমি এমপির হয়ে কাজ করেছি?!”অবিশ্বাসে বলে উঠল ছফা। মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “ও সেরকমই ধারণা করেছিল।”

ছফা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। সুন্দরপুরের অনেকেই এমন ধারনা করে ইদানীং কিন্তু তাই বলে স্বয়ং মুশকান জুবেরি?! “আপনি আমাকে হাসালেন, ডাক্তার,” বলল সে। “তাহলে যেসব মানুষকে সুন্দরপুরে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলেছে মুশকান, তাদের ব্যাপারে কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?” ইচ্ছে করেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়ার কথাটা এড়িয়ে গেল আসলামের উপস্থিতির কারণে।

“এ ব্যাপারে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “সুন্দরপুর থেকে ঢাকায় এসে আমার ফ্ল্যাটে ওঠার পর।

“সে আপনাকে কী বলেছিল?” “ওর ধারণা, এমপি আসাদুল্লাহই ওদেরকে কিছু করেছে।”

“কী ?!” নুরে ছফা আৎকে উঠল। “এমপি!” মাথা দোলাল সে। “আপনার মুশকান এমন একজনের উপর পিণ্ডি চাপিয়ে দিচ্ছে, যে এখন মৃত! দারুণ অ্যালিবাই!”

“দেখুন, বিশ্বাস করা বা না-করা আপনার ব্যাপার। আমি শুধু, ও কী বলেছে সে,সেটাই বলছি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ছফা, “আচ্ছা, বলুন..মুশকান আপনাকে কী বলেছে।”কথাটা একটু তীর্যক শােনাল যদিও।

“ওখানকার এমপি কড়া নজরদারিতে রাখত ওকে। ওর সঙ্গে কোনাে ছেলের সম্পর্ক হােক, তা সে চাইত না। ওর ধারণা, সম্ভবত ওই দু-জন লােক সুন্দরপুরে যাবার পর থেকে এমপির লােকজন তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছিল। সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার সময় ওই লােকগুলােই তাদেরকে গুম করে ফেলে।” একটু থেমে ছফার দিকে তাকালেন তিনি। সে এখন অবিশ্বাসে হাসছে।“তবে ও নিজেও এ ব্যাপারে পুরােপুরি নিশ্চিত ছিল না।এটা নিছকই ওর ধারণা।”

“তাহলে এমপি আসাদুল্লাহই সব করেছে….মুশকান জুবেরি ধোঁয়া তুলসীপাতা?”

কাঁধ তুললেন ডাক্তার। “একজন ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সব কিছু খতিয়ে দেখে, প্রমাণের উপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করাটাই আপনার উচিত হবে। ও কোনাে অপরাধ করেছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখেন। আর সত্যি বলতে, ও যা বলেছে তা-ই আপনাকে বললাম। এখানে আমার নিজস্ব কোনাে মতামত নেই।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “সেটা তাে আমি করবই,” একটু থেমে আবার বলল, “তাহলে কি প্রতিশােধ নেবার জন্য এমপিকে খুন করেছে মুশকান?”

ঠোঁট ওলটালেন ডাক্তার। “সেটা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সে এমপির সঙ্গে দেখা করে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল।”

“মুশকান যে এমপির সঙ্গে দেখা করেছিল সেটা আপনাকে বলেছে?”

“অবশ্যই। ও আমাকে বলেছিল এমপির সঙ্গে কথা বলবে। সম্ভবত রাশেদের সম্পত্তিগুলাে যে ট্রাস্টের নামে দান করেছে সেটা জানানাের জন্য  সেইসঙ্গে, মাস্টারের যেন কোনাে ক্ষতি না করে সেটাও হয়তাে বলতে চেয়েছিল।” গভীর করে নিশ্বাস নিলেন আবার। “হয়তাে ভদ্রলােকের কাছে জানতে চেয়েছিল, কেন সে তার পেছনে এভাবে লাগল, এসব করে তার কী লাভ হল  এই আর কী।”

“নুশকান তাহলে এমপির সঙ্গে কথা বলেছিল ?”

“বলেছিল। ওর সঙ্গে কথা বলার পর, সেদিন রাতেই ভদ্রলােক মারা যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিল লােকটা। মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করায় হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়।”

“দারুণ! সব পাজল মিলিয়ে দিচ্ছে আপনার বলা এই গালগল্প!”তিক্ত মুখে বলল ছফা, “এমপির মৃত্যুর জন্য তাে কেউ মুশকানকে সন্দেহই করেনি পােস্টমর্টেম রিপাের্টও বলেছে ওটা মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্কের ফলাফল, তাহলে সে চোরের মতাে পালিয়ে গেল কেন?”

“ও আগেই ঠিক করে রেখেছিল এমপির সঙ্গে কথা বলে দেশ ছাড়বে। এমপির মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই।”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ছফার মুখে। “তা এখন বলুন, আপনার মুশকান জুবেরি কোন দেশে গেছে?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার।“সেটা আমাকে বলেনি। আর আমিও জানতে চাইনি।”

“এত কিছু বলল আর এটা বলল না আপনাকে? আপনি বলতে চাইছেন, মুশকান আপনাকে বিশ্বাস করত না?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “সত্যি বলতে, আমি নিজেই জানতে চাইনি। ওটা জানা থাকলে আমি হয়তাে পুলিশি জেরার মুখে সব বলে দিতাম।”

বাঁকাহাসি দিল ছফা। “সবই না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনি দেশ ছাড়লেন কেন?”গভীর করে দম নিলেন আসকার ইবনে সায়িদ।“দুটো কারণে দেশের বাইরে গেছিলাম কিছুদিনের জন্য আপনার জ্বালাতন থেকে বাঁচতে আর আমার হার্টের চেকআপ করাতে।”

“আপনার নিজের হাসপাতাল থাকতে আমেরিকায় কেন? আপনার তাে দেখি নিজের হাসপাতালের উপরেই ভরসা নেই।”

মাথা দোলালেন ডাক্তার।“বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার হাসপাতালেই চেক আপ করি, আমেরিকার মতাে উন্নত দেশে গেলে সেখানেও করাই। এর মানে, নিজের হাসপাতালের উপর ভরসা নেই যদি ভাবেন তাে কিছু করার নেই।”

ছফা কিছু বলল না। ডাক্তারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে সে। “যাই হােক, কয়েক মাস পরই আবার দেশে ফিরে এসেছিলাম আমি।” “কাউকে না জানিয়ে!”

“দেশে এসে আমি যদি সেটা গােপন রাখি তার কারণও কিন্তু আপনি। উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতেই এটা করেছি।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিল নুরে ছফা। “আপনি মনে করছেন আমি আপনার এই নতুন গল্পটা বিশ্বাস করব? আমার কাছে প্রমাণ নেই বলতে চাইছেন?”

মুচকি হাসলেন ডাক্তার।“থাকলে তাে আপনি মুশকানের বিরুদ্ধে হিউম্যান অর্গান পাচারের সন্দেহ করে মামলা করতেন না! সম্ভবত আপনি তার বিরুদ্ধে এমন অভিযােগই করেছেন, তাই না?”

ছফা টের পেল রাগে রীতিমতাে তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। সত্যিটা হল, মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ হিসেবে সে মানব-অঙ্গ পাচারের মতাে গুরুতর অভিযােগও করতে পারেনি সেই সব অঙ্গ ভক্ষণের অভিযােগ তােলা তাে দূরের কথা। সে কেবল ওই মহিলার বিরুদ্ধে কিছু লােকজনকে গুম করার প্রাথমিক অভিযোগ করে একটি মামলা করেছে। সেই মামলায় এমনকি এটারও উল্লেখ নেই, মহিলা লােকজন কী উদ্দেশ্যে গুম করেছে, কেন করেছে! তবে সরকারি তদন্তে বাধা দেওয়া হত্যাপ্রচেষ্টাসহ তার অস্ত্র কেড়ে নেবার মতাে গুরুতর অভিযােগ তুলে আরও দাম মামলা করেছে সুন্দরপুর থানায়।

“এ থেকেই বােঝা যায়, ওর ধারণাই সত্যি,”ডাক্তার বললেন। সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাকাল ছফা। “এই উদ্ভট গল্পটা যে কেউ বিশ্বাস করবে না সেটা আপনি নিজেও জানতেন।”

ভুরু কুঁচকে তাকাল ডিবির জাঁদেরল ইনভেস্টিগেটর। “আপনি কী বলতে চাইছেন আন্দিজের ঘটনা মিথ্যে?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “এটাই তাে এই ঘটনার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট।”

“আপনি পরিষ্কার করে বলেন, হেয়ালি করবেন না। আমি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং কোনাে গল্প শুনতে আসিনি।” “আপনার কাছে গল্প বলে সময় নষ্ট করার কোনাে ইচ্ছে আমারও নেই।”একটু থেমে আবার বললেন, “তাহলে শুনুন, সংক্ষেপেই বলি। আন্দিজের ঘটনাটা যে মিথ্যে নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।ওটা সত্যি সত্যি ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যবশত, সেখানে আঠারােজন বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে এক বাংলাদেশি তরুণী ডাক্তারও ছিল। এর এক বর্ণও মিথ্যে নয়। সেই তরুণীও অন্যদের মতাে নরমাংস খেয়েই জীবন বাঁচায়।”

কথাটা শুনে এই প্রথম আসলামের অভিব্যক্তিতে বিস্ময় দেখা গেল। অনেকটা আঁতকে উঠল সে।

“কিন্তু ওই তরুণী মুশকান ছিল না!”

“তাহলে সে কে ছিল?” অবিশ্বাসে প্রশ্নটা করলেও ছফার ইচ্ছে করছে ডাক্তারের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। তাকে ছেলে ভােলানাে গল্প বলে বিশ্বাস করাতে চাইছে! লােকটার দুঃসাহসের তারিফ না করে পারল না।

“সমস্যা হল, আমি যা বলব সেটা আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। ওই আজগুবি গল্পটাই বিশ্বাস করতে চাইবেন আপনি। তবে সবটা শােনার পর, আশা করি সন্তুষ্ট না হলেও কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝে নিতে পারবেন।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইল নুরে ছফা। ডাক্তার যেন সাসপেন্স গল্প বলছেন। ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছেন উত্তেজনা।

“আমি যে তরুণীর কথা বলছি সে কে ছিল, জানেন?” নুরে ছফা চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। “রুখসান!” “এই রুখসানটা কে?”অধৈর্য হয়ে বলে উঠল ছফা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। “সত্যি বলতে, মুশকানের মেয়ে!”

অধ্যায় ৩৮

নুরে ছফার মনে হচ্ছে তাকে ঠেলেঠুলে প্রহেলিকাময় গােলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারের কথার মাথামণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে। শুধু বুঝতে পারছে, তার সঙ্গে বিরাট কোনাে চালাকি করা হচ্ছে!

কথাটা শােনার পর থেকে সে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তার আসকারের দিকে। নতুন একটি চরিত্র রুখসান আমদানি করে মুশকানের সঙ্গে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু ছফার কাছে এমন কিছু আছে যা ডাক্তারের এসব গল্পকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে  দেবে এক লহমায়।

“আপনি যদি জানতেন আমার কাছে কতশক্তিশালী প্রমাণ আছে, তাহলে এসব বলার আগে অন্তত একশাে বার ভেবে নিতেন,”তিক্তমুখে বলল। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে অবার।

– ডাক্তার আসকারের নির্বিকার মুখ দেখে বােঝা গেল না তিনি ভড়কে গেছেন কিনা। পিএসের গানম্যান আসলাম শক্তমুখে চেয়ে আছে তার দিকে।  নুরে ছফা সামনের দিকে ঝুঁকে এল।“পৃথিবীটা অনেক বেশি ছােটো,বুঝলেন ডাক্তার?

আর কেন জানি বাঙালিদের জন্য এই পৃথিবীটা আরও বেশি ছােটো।”

ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে গেল সামান্য।

“মুশকান জুবেরির যে শিকারের কেসটা নিয়ে আমি তদন্ত করছি, সেই হাসিবের মা। সত্তর দশকে আমেরিকায় ছিলেন স্বামীর সঙ্গে। ওখানে তিনি প্রতিবেশী হিসেবে কাকে পেয়েছিলেন, জানেন?”জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, “মুশকান জুবেরিকে!”

এ কথা শােনার পরও ডাক্তার নির্বিকার থাকলেন। ছফার কাছে মনে হচ্ছে, ডাক্তার জোর করে অভিব্যক্তি লুকানাের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। “খুব বেশি কাকতালীয় মনে হচ্ছে?”

স্মিত হাসলেন আসকার ইবনে সায়িদ, তবে কিছু বললেন না।

“হাসিবের মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশী মুশকানের বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল। তিনি এ-ও জানতেন, আন্দিজে প্লেন ক্র্যাশের শিকার হয়েছিল মুশকান, মৃত মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচে ছিল আশি দিনেরও বেশি সময়।”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলেন ডাক্তার আসকার, যেন কী বলবেন গুছিয়ে নিচ্ছেন।

“ওই ভদ্রমহিলা এখন দেশে আছেন. মৃত্যুপথযাত্রী। তার মাধ্যমে মুশকানের একটি ছবিও জোগাড় করেছি আমি।”

আসকার ইবনে সায়িদের ভুরু কুঁচকে গেল সামান্য।

“আপনার এই বানােয়াট গল্পটা যে এভাবে ধরা খাবে সেটা হয়তাে ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। আমার কথাটা পুরােপুরি না শুনেই” হাত তুলে ডাক্তারকে থামিয়ে দিল ছফা। “অনেক হয়েছে, আর এসব গাঁজাখুরি গল্প বলবেন না আমাকে। আমার ধৈর্য কিন্তু অসীম নয়।”

কাঁধ তুললেন আসকার ইবনে সায়িদ।“পুরােটা শুনতে না চাইলে কী আর করা!”

ছফার ভুরু কুঁচকে গেল।“পুরােটা বলতে আপনি কী বােঝাচ্ছেন?” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আবার বলল সে, “আমি যা বললাম তারপরও আপনার বলার কিছু আছে নাকি?”  ‘সত্যটাকে যদি গল্পই বলেন তাহলে বলব, আমি তাে কেবল শুরু করেছি। এখন আপনি শুনতে চাইলে বলতে পারি, নইলে নিজেই তদন্ত করে বাকিটা জেনে নেবেন। এক সময় না এক সময় এই সত্যটাই আবিষ্কার করবেন আপনি।”  ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন ডাক্তারের দিকে। এই ভদ্রলােক কেএস খানের সামান্য চাপেই ভেঙে পড়েছিলেন, গরগর করে বলে দিয়েছিলেন সবকিছু। কিন্তু এখন তার মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছে, তাতে আগের বারের সঙ্গে কোনাে মিলই পাচ্ছে না সে।

“আপনি এমন চালাকি করেছেন, যেটা আমাকে ভুলপথে পরিচালিত করবে, তদন্তটাকে কানাগলিতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে।”

এবার পরিহাসের হাসি হাসলেন ডাক্তার। “অবশ্য, আগের বার আমি সেটাই করেছিলাম। একটু থেমে আবার বললেন, “সেজন্যে আপনাকে দোষও দিতে পারছি না।”  ছফা কিছু বলল না। তার কাছে মনে হচ্ছে, যে ডাক্তার এখন তার সামনে বসে আছে। সে
অন্য কেউ। ছফার সহকারী জাওয়াদ তাকে সবটাই বলেছিল। কীভাবে মি.খান কথার মারপ্যাচে স্বনামধন্য ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদকে কাবু করেছিল কোনাে রকম হুমকি-ধামকি ছাড়াই।

“এবারও যে আপনি চালাকি করছেন সেটার প্রমাণ তাে আমিই দিলাম।” “কীসের প্রমাণ?” ডাক্তার যেন বুঝতে পারেননি কিছু। “এতক্ষণ আমি আপনাকে যা বললাম সেটা শােনার পরও বুঝতে পারছেন না?” কাঁধ তুললেন আসকার ইবনে সায়িদ। “আসলেই বুঝতে পারছি না।” দাঁতে দাঁত পিষে ছফা বলল, “আর্জুমান্দ বেগম মুশকান জুবেরিকে চিনতেন… তারা দীর্ঘদিন প্রতিবেশী ছিল।”

“হ্যা, সেটা তাে বুঝেছি কিন্তু আপনি এটাকে প্রমান বলছেন কেন?”

“এজন্যে বলছি, আর্জুমান্দ বেগম মুশকানের মায়ের বান্ধবী ছিলেন না, উনি মুশকানের বান্ধবী ছিলেন!”

হাসলেন ডাক্তার। “আপনার ওইপিএসের বােন, তিনি কি কখনও মুশকানের মেয়েকে দেখেছেন?” একটু থেমে হিসেব করে নিলেন যেন। সম্ভবত দেখেননি। দেখার কথাও না। ওর তখন বিয়েই হয়নি  মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিল।”  ‘কার কথা বলছেন আপনি?” ছফা অবাক হয়ে জানতে চাইল।

“মুশকান জুবেরির মায়ের কথা বলছি।”

“উফ!” অধৈর্য হয়ে উঠল ছফা। বারবার এক প্যাচাল পাড়ছেন কেন! আর্জুমান্দ বেগম মুশকান জুবেরিকে চিনতেন  তার মাকে না!”

“আমি তাে সেটাই বলছি,”চট করে বললেন ডাক্তার। “তাহলে বারবার তার মায়ের কথা কেন বলছেন?”

“কারণ ওই মহিলাই মুশকান জুবেরির মা ছিল, আপনি যে মুশকানকে খুঁজছেন সে ছিল তার মেয়ে!”  ‘স্টপইট!”ধমকে
উঠল ছফা।“মুশকান..মুশকান জুবেরির মা! বারবার কী সব বলে যাচ্ছেন! আপনি ভেবেছেন কী, আমি আপনার গােলকধাঁধায় পড়ে খাবি খাব?”  মাথা দোলালেন ডাক্তার। “দুঃখিত, আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা। আসলে আপনাকে দোষ দেওয়া যায় না, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না  আর মাঝখানে অনেক প্রশ্ন করায় তালগােল পাকিয়ে ফেলেছি।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইল নুরে ছফা। গভীর করে দম নিয়ে নিল সে।“ঠিক আছে, বলুন আপনার আজগুবি গল্প!”

“যে মুশকানকে আপনি চেনেন তার আসল নাম রুখসান! আর তার মায়ের নাম ছিল। মুশকান সােহেলি!”

অধ্যায় ৩৯

মুশকানের নাম আসলে রুখসান! আর তার মায়ের নাম মুশকান সােহেলি?

এরকম অসম্ভব কথা শােনার জন্য প্রস্তুত ছিল না ছফা। তার কাছে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন জানি অনুভূতি হল। বুঝতেও একটু সময় নিল সে। ডাক্তার আসকারই সায়িদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

“এসবের মানে কী?”

মুচকি হাসলেন ডাক্তার, তবে সেই হাসিতে কোনাে তাচ্ছিল্যভাব নেই। যেন তিনিও জানেন, এ কথা শুনে যে কেউ অবাক হবে।

“আপনার ওই পিএসের বােন যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন,” আস্তে করে বললেন বয়ােজ্যেষ্ঠ চিকিৎসক।কিন্তু মহিলা তাে আর জানতেন না, পরবর্তীকালে মুশকান সােহেলি বিয়ে করে ফুটফুটে এক মেয়ের জন্ম দেয়,” একটু থেমে ছফাকে দেখে নিলেন তিনি। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। “আর সেই মেয়ে দেখতে হয়েছিল অবিকল তার মায়ের মতােই।”

এতে অবাক হল না ছফা। অনেক ছেলে-মেয়েই দেখতে বাবা-মায়ের মতাে হয়। একেবারে হুবহুও হয়। তার নিজের মা-ই দেখতে ছিল হুবহু তার নানির মতাে। তবে নানিকে তারা দেখেছে বয়সকালে, ফলে তাদের কাছে মিলটা তেমনভাবে ধরা না পড়লেও, পরিবারের বয়ােজ্যেষ্ঠদের কাছে ঠিকই ধরা পড়েছিল। নানির যুবা বয়সের ছবি দেখেও ছফা বুঝতে পেরেছিলাে মিলটা ছিলাে বিস্ময়কর রকমেরই। একই বয়সের নানি আর তার মায়ের ছবি দেখলে মনে হত একজনের ছবিই দেখছে-কিংবা যমজ বােনের!

“নিউটনের বাবার নাম কী ছিল জানেন?” ডাক্তারের এমন প্রশ্ন শুনে ভুরু কুঁচকে তাকাল ছফা।

“নিউটন! ওয়েস্টে এটা খুবই পপুলার ট্রেন্ড-বাবার নামে সন্তানের নাম রাখা। সন্তানের বেলায় কেবল যােগ করা হয় জুনিয়র’শব্দটি। যেমন জুনিয়র বুশ, ওর বাবার নামও ছিল বুশ।”

“আপনি বলতে চাইছেন, মুশকানের মা নিজের মেয়ের নাম রেখেছিল মুশকান? ছফার কথায় মাথা দোলালেন ডাক্তার আসকার। “না, না…ওর মা এ কাজ করেনি “তাহলে?”

মুশকানের মেয়ের নাম ছিল রুখসান”দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডাক্তার।

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইল, কিছুই বলল না। মুশকান আর রুখসানের গোলকধাঁধা থেকে এখনও বের হতে পারছে না।

সন্দেহ নেই কিন্তু পরবর্তীকালে কিছু ঘটনার কারণে রুখসান তার নামটা পালটে ফেলে।”

“কী ঘটনা?”ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল নুরে ছফা!

“মুশকান সােহেলি, মানে মুশকানের মা আন্দিজ থেকে ফিরে আসার পর বাঙালি কমিউনিটিতে কোণঠসা হয়ে পড়ে, বাধ্য হয়ে সে চলে যায় ব্রিটেনে, মেডিকেল প্র্যাকটিস শুরু করে সে। ওখানেই এক বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, প্রেম হয়, তারা বিয়েও করে ফেলে। তাদের ছােট্ট সংসারে আসে রুখসান।” একটু থামলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “রুখসানের জন্মের কয়েক বছর পরই দেশের টানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চলে আসে ঢাকায়। মেয়েটার বয়স যখন ছয় কী সাত, তখনই ওর বাবা আন্দিজের ঘটনাটা জেনে যায়।” ডাক্তার গম্ভীর হয়ে চুপ করে গেলেন। “দোষটা মুশকানেরই  আন্দিজ সারভাইভারদের উপরে অনেকগুলাে পেপার ক্লিপিংসের একটি অ্যালবাম সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল ও। ঘটনাচক্রে অ্যালবামটা ওর স্বামী দেখে ফেলে।”

ছফার মনে পড়ে গেল তিন বছর আগের ঘটনাটি। মুশকান জুবেরি তাকে এরকম একটি অ্যালবাম দেখিয়েছিল। কয়েকটি ছবি দেখার পর সে অচেতন হয়ে পড়ে। এখন কেবল ঝাপসা একটা স্মৃতি আছে। কখনও কখনও স্বপ্নে হানা দেয় সেই মুহূর্তটির কিছু অংশ। একেবারেই বিক্ষিপ্তভাবে।

“এই ঘটনার পর থেকে স্বামীর সঙ্গে ওর দূরত্ব বেড়ে যায়,”ডাক্তার বললেন। “মুশকান কেন স্বামীকে বিয়ের আগে এটা বলেনি, কেন সে কথাটা লুকিয়ে রেখেছিল —এই ছিল ভদ্রলােকের অভিযোগ। তাে, ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদের দিকেই মােড় নেয়। ও খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আর স্বাধীনচেতা ছিল, স্বামীর এমন আচরণের পর একসঙ্গে আর থাকেনি, মেয়েকে নিয়ে আলাদা বসবাস করতে শুরু করে। ওর বাবাও কখনও মেয়ের দাবি নিয়ে সামনে আসেনি আর। ভদ্রলােক ডিভাের্সের এক বছরের মাথায় আবার বিয়ে করে ফেলে। তবে মুশকান আর সে পথে যায়নি। পুরুষবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল সম্ভবত। একমাত্র সন্তান রুখসানকে নিয়ে একাকী জীবন বেছে নেয়, নিজের মতাে করে গড়ে তােলে মেয়েকে। ও আবার রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত ছিল। রুখসানও মায়ের প্রভাবে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু মা-মেয়ের সুখের এই ছােট্ট সংসারটি বেশি দিন টেকেনি। রুখসানের বয়স যখন চোদ্দ, ওর মা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পায় রুখসান। বলতে পারেন, ভয়াবহ এক ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়। নানান রকম অ্যাবনরমালিটি গ্রো করে ওর মধ্যে। সম্ভবত, সে কারণেই মায়ের মৃত্যুর পরের বছর যখন এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার সময় এল, নিজের নাম পালটে সে মুশকান সােহেলি রাখল।”

ছফার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। আগে ক্লাস নাইনে থাকতে এসএসসি পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশন করা হত, তখন ইচ্ছে করলে নিজের নাম, জন্মসাল, তারিখ, সব কিছুই বদলে ফেলার সুযােগ ছিল। এখনকার মতাে স্মার্টকার্ড, ভােটার আইডিকার্ড জন্মসনদের বালাই ছিল না তখন।  ছফার মনে পড়ে গেল, তার নিজের নামটাও পালটানাের খুব ইচ্ছে ছিল-জ্ঞান
হওয়ার পর থেকে নুরে ছফা নামটার মধ্যে গেঁয়ো একটা গন্ধ পেত সে। আর লােকজনও ঠিকমত ধরতে পারত না প্রথমবার শােনার পর। অন্য অনেকের মতাে সে-ও চেয়েছিল নামটা একটু ‘স্মার্ট’ করতে, কিন্তু তার কঠিন শাসনের বাবার কড়া ধমক খেয়ে নিজেকে বিরত রাখে।

দুই-দুইটা খাসি জবাই দিয়া আকিকা কইরা আমার বাপে এই নাম রাখসে!  আর পােলায় কিনা সেয়ানা হইয়া এখন সেই নাম বাদ দিবার চায়! এত্ত বড়ো সাহস হইসে এমুন পােলারে কাইট্টা ! নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তার জাঁদরেল বাবার এইসব গালমন্দ আর রাগি চেহারাটা এখনও চোখে ভাসে।

আজাদ রহমান নিজের পছন্দ করা নামটা এখনও তার মনে আছে।

‘সম্ভবত মায়ের মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারেনি বলে এমনটা করেছিল,”ছফাকে চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার আবার বললেন।“মায়ের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যেও করে থাকতে পারে কে জানে।”একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আসকার ইবনে সায়িদের ভেতর থেকে। “এভাবেই সে রুখসান থেকে হয়ে গেল মুশকান সােহেলি। তারও অনেক বছর পরে, বিয়ের পর হল মুশকান জুবেরি।”

“আপনি এত সব জানলেন কীভাবে?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইল ছফা। “এসব কথা তাে সত্য না-ও হতে পারে ?”

হেসে ফেললেন ডাক্তার। “তখন তাে কেউ মুশকানের পিছে লাগেনি যে, নিজেকে বাঁচানাের জন্য বানােয়াট একটা গল্প বলবে সে।তাছাড়া মুশকানের সঙ্গে মানে, রুখসানের মায়ের সঙ্গে বেশ ভালাে বন্ধুত্ব ছিল আমার। বয়সেও আমরা প্রায় সমবয়সি ছিলাম। একসঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি আমরা।ও মারা গেলে আমিই ওর মেয়ের অভিভাবক হয়ে উঠি। যা বললাম, তার অনেক কিছুই নিজের চোখে দেখেছি আমি।”  চুপ করে রইল নুরে ছফা। ডাক্তারের বয়স আর পেশা হিসেবে নিলে, রুখসানের মায়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের ব্যাপারটা খাপ খেয়ে যায়।  “আমার কী মনে হয় জানেন?” আসকার ইবনে সায়িদ বললেন। “ও ওর মায়ের ব্যাপারে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড হয়ে পড়েছিল
কাইন্ড অব অবসেস।” এ মাথা নেড়ে সায় দিতে গিয়েও দিল না ছফা।

“মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ছিল একেবারে অন্য রকম। বন্ধ..  একমাত্র
সঙ্গী… একমাত্র অভিভাবক!” আবারও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ডাক্তারের ভেতর থেকে। ঘরে নেমে এল কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।

“কিন্তু আপনি কেন আমার সিনিয়র মি.খানের কাছে এরকম উদ্ভট গল্প বললেন?” জানতে চাইল ছফা।

গভীর করে নিশ্বাস নিলেন ডাক্তার।“এটা আগেই বলেছি…ও মনে করেছিল আপনি সুন্দরপুরের এমপির হয়ে ওর পেছনে লেগেছেন, ওই এমপি যেহেতু ওর রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করার উদ্ভট একটি অপবাদ রটিয়েছিল, তাইও মনে করেছিল আপনাকেও এরকম কথা বিশ্বাস করাতে, যাতে সবাই বােঝে আপনি এমপির লােক। আপনার উপরে ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল সে। আপনাকে নাজেহাল করার জন্যই এটা করতে বলেছিল আমাকে।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইল ছফা।

“ও জানত, এরকম উদ্ভট গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না। বড়ো কর্তাদের কাছে আপনি হাস্যকর পাত্র হয়ে উঠবেন।”

ছফার ভুরু কুঁচকে গেল।

“ওর ধারণাটা যে ঠিক ছিল তার প্রমাণ তাে আপনি নিজেই। ওই অভিযােগ তুলে মামলা করার সাহসও দেখাননি।”

ছফার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মহিলা এদিক থেকে সফলই বলা যায়। সে নিজেও এমন উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য গল্পটা চেপে গেছে সবার কাছ থেকে। এসব বললে যে তাকে পাগল, নয়তাে উর্বর মস্তিষ্কের মানুষ ভাববে শুধু সে কারণে নয়, বরং তার আর-একটা ভয় ছিল-মানুষ চিরযৌবন লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।

‘মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অর্গান খেলে চিরযৌবন লাভ করা যায়—এ কথা তাে বিশ্বাস করবে অতি আশাবাদী মানুষ, নয়তাে বােকারহদ্দরা।”  ছফার কাছে মনে হল ডাক্তার প্রকারান্তরে তাকে বােকা বলছেন! এমন সময় কিছু একটা মনে পড়ে গেল তার, সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠল সে।

“কিন্তু যতটুকু জেনেছি, আপনার অরিয়েন্ট হাসপাতালে আমেরিকা থেকে এক ডাক্তার এসে মুশকান জুবেরিকে নিয়ে এসবকথা রটিয়েছিল  ওই লােকের ব্যাপারটা কী তাহলে?”  আক্ষেপে মাথা দোলালেন ডাক্তার।“মায়ের নামটা নিয়ে নেওয়ার ফলে যে ভবিষ্যতে ঝামেলা হতে পারে সেটা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। ওই ডাক্তারের আবির্ভাবের পরই সেটা প্রথম টের পায়।”

ছফা তাকাল আসলামের দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে সে ঘরের আসবাবপত্রের মতােই নিশ্চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে।

“হাসপাতালের একজন ওঁর হিসেবে ওই সিচুয়েশনটা সামাল দিতে গিয়ে আমাকে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভদ্রলােককে বােঝাতেই পারছিলাম না, মুশকান তার মায়ের নামটা নিয়ে নেওয়াতে এই ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। লােকটা যেন একটা ঘােরের মধ্যে চলে গেছিল, চিরযৌবন লাভের সিক্রেট জানতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে।

একেবারে ছেলেমানুষি ভাবনা! যাই হােক, শেষ পর্যন্ত ওই লােককে তা বোঝাতে পেরেছিলাম, তবে ওই ঘটনার কিছু দিন পর মুশকান ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়।” একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “অবশ্য তার চাকরি ছাড়ার কারণ ছিল। এখানকার রােগীদের আত্মীয়স্বজন রােগী মারা গেলে ডাক্তারদের উপর চড়াও হয়, সেটা ওকে ভীষণ আপসেট করত। চোখের সামনে এরকম কয়েকটা দেখে ভড়কে গেছিল। আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিল বলতে পারেন। আর জানিয়েছিল, হাসপাতালে চাকরি আর করবে না।”

“যে ডাক্তার মুশকানের বিরুদ্ধে অভিযােগ তুলেছিল সে এখন কোথায়?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। ছফার সন্দেহটা বুঝতে পেরেছে তিনি। “চার-পাঁচ বছর আগে ভদ্রলােক দুবাই-এর এক হসপিটালে কাজ করত, এখন কোথায় আছে জানি না।”

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। লােকটার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না সে, তবে এ নিয়ে কিছু বললও না।  হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন ডাক্তার। আমার শরীর ভালাে নেই, একটু পর ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা কিন্তু উঠে দাঁড়াল না, তার বদলে গানম্যান আসলামের দিকে ফিরল। লােকটা কয়েক মুহূর্ত চোখের ভাষা পড়েই উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল ডাক্তারের দিকে।

“আপনার মােবাইলফোনটা দিন,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে।

অসহায়ের মতাে তাকালেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “আ-আমার ” কণ্ঠ ধরে এল তার। ছফার দিকে ফিরলেন। “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?”

“আমি সত্যি-মিথ্যা খতিয়ে না দেখে কোনাে কিছু বিশ্বাস করি না।” ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলেন আসকার ইবনে সায়িদ।

“মুশকানকে হাতের মুঠোয় না পেলে কী করে বুঝব আপনার গল্পটা সত্যি নাকি মিথ্যে!”

ডাক্তারের নিশ্বাস দ্রুত হতে শুরু করল। আক্ষেপে মাথা দোলালেন তিনি।“কিন্তু ও কোথায় আছে সেটা তাে আমি জানি না।”

এবার বাঁকাহাসি দিল ছফা।“এতক্ষণ ধরে আপনি যা বলেছেন তাতে হয়তাে সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন যেটা বলছেন সেটা একদমই নির্জলা মিথ্যে। মুশকানের সঙ্গে আপনার বেশ ভালােই যােগাযােগ আছে, আর আমি সেটাই প্রমাণ করব এখন।

স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার। “আপনার ফোন আর পাসপাের্ট দুটো হাতে পেলেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে’ “আ-আমি তাে সেলফোন ইউজ করি না।”

কথাটা শুনে হেসে ফেলল ছফা, আদেশ করল গানম্যানকে, “সার্চ করাে।”

ডাক্তার হতভম্ব হয়ে তাকালেন ছফার দিকে। “আপনি বিনা ওয়ারেন্টে আমার বাসায় ঢুকেছেন, এখন আবার আমাকে সার্চ করতে বলছেন। আপনি এটা করতে পারেন না!”

“আইনত করতে পারি না,”জবাব দিল সে, “কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে আইন-টাইন দেখাচ্ছিনা এখন।”

আসলাম আগ্রাসি মনােভাব নিয়ে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানাের ইশারা করল।

চুপচাপ উঠে দাঁড়ালেন আসকার ইবনে সায়িদ। “আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আপনার নামে কমপ্লেন করব?”অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করার পরও হুংকার দেবার চেষ্টা করলেন তিনি।“ওকে আমি বলব”

“আপনি প্রাইমমিনিস্টারের কাছেও যেতে পারেন,”ডাক্তারের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল নুরে ছফা।“ওসব জুজুর ভয় আমাকে দেখাবেন না। ভালােয় ভালােয় যা চাই তা দিয়ে দিন, নইলে আপনার সঙ্গে অসম্মানজনক কিছু করা হবে।”

সন্দেহভাজনদের যেভাবে দেহতল্লাশি করে পুলিশ, তেমনিভাবে ডাক্তারের সারা শরীর তল্লাশি করল পিএসের গানম্যান আসলাম, কিন্তু কিছুই পেল না।

“ফোন তাে নাই, স্যার। আমি এই লােকের ঘরগুলাে তল্লাশি করি?”

ডাক্তারের দিকে তাকাল ছফা, “নিজে থেকে আপনার পাসপাের্ট আর ফোনটা দিয়ে দিন  নইলে ও কিন্তু ঠিকই তল্লাশি করে ওগুলাে খুঁজে বের করবে, মাঝখান থেকে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে আপনার ঘরগুলাে।”

ডাক্তার আসকার বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। “আপনি আমার পাসপাের্ট চাইছেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “আমি যা যা চাইব তার সবই আপনাকে দিতে হবে, নয়তাে সেটা আদায় করে নেব।”

“আপনি বেআইনি কাজ করছেন, অফিসার!”

হেসে ফেলল নুরে ছফা। “মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করার জন্য যা যা করার করার দরকার সবই আমি করব।”

ডাক্তার তাকিয়ে রইলেন ছফার দিকে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না কী শুনছেন! “আসলাম, তুমি ওঁর ঘরগুলাে সার্চ করাে।”

অধ্যায় ৪০

“দাঁড়ান!”

দাঁতে দাঁত পিষে বললেন ডাক্তার আসকার।

ছফা তার দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন ভদ্রলােক। তার শােবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসলাম। দরজার নবের দিকে হাত বাড়াতে উদ্যত সে।

“আমি নিজেই এনে দিচ্ছি।”কথাটা বলে নুরে ছফার জবাবের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

আসলামকে ইশারা করল ছফা, দরজার নবটা ছেড়ে সরে দাঁড়াল সে। ডাক্তার তার শােবার ঘরে ঢােকার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও ঢুকে পড়ল ভেতরে। দরজাটা হাট করে খুলে রাখা হল, সেই খােলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার তার ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে কী যেন খুঁজছেন। তাকে শ্যেনদৃষ্টিতে বিদ্ধ করে রেখেছে আসলাম।

ডাক্তার নীলরঙের একটি পাসপাের্ট বের করে আসলামকে দেখাচ্ছেন, গানম্যান সেটা হাতে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আবার ফিরিয়ে দিল তাকে, তারপর পুরাে ঘরটা তল্লাশি করতে নেমে পড়ল। হতভম্ব ডাক্তার তাকালেন ছফার দিকে, হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করল সে। দূর থেকেই বুঝতে পারল, ডাক্তারের ব্রিটিশ পাসপাের্ট রয়েছে।

হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার আসকার চুপচাপ ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। “আমি আসলেই মােবাইলফোন আর ইউজ করি না  আগে করতাম।”

ছফা এ কথার কোনাে জবাব দিল না। এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য কথা। তার মতাে একজন মানুষ মােবাইলফোন ব্যবহার না করে থাকতেই পারে না।

“আপনারা চাইলে আমার ল্যান্ডফোনটা ট্র্যাক করে দেখতে পারেন।”

“দরকার হলে সব কিছুই করব আমি,”জবাব দিল ছফা। হাত বাড়িয়ে দিল ডাক্তারের দিকে।

ভদ্রলােক আস্তে করে পাসপাের্টটা দিয়ে দিলেন তাকে। “তাহলে আপনি ডুয়েল সিটিজেন,” প্রশ্নের মতাে শােনাল না ছফার কথাটা। ডাক্তার এই পাসপাের্ট দিয়ে তিন বছর আগে যে আমেরিকায় গেছিলেন সেটার সত্যতা পাওয়া গেল ভিসার সিল দেখে। কিন্তু নুরে ছফা অবাক হল, খুব বেশি ভ্রমণের উল্লেখ নেই তাতে। এই পাসপাের্ট দিয়ে তিন বছরে পাঁচ বার বিদেশ যাবার নজির আছে। দু-বার আমেরিকায় আর ব্রিটেনে, একবার কানাডায়। শেষ বার তিনি যে আমেরিকায় গেছিলেন সেই সময় ওখানে মাত্র এক মাস ছিলেন, তারপরই ফিরে আসেন দেশে।

অবাক হয়ে তাকাল সে।“আপনি আপনার ড্রাইভারকে বলেছেন, খুব যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন, তাই তাকে নিয়মিত রাখার দরকার নেই?”।

এমন তথ্য শুনে আসকার ইবনে সায়িদ চমকে উঠলেন একটু। “আমার ড্রাইভার!”

“হ্যা। আপনার আগের ড্রাইভার,” ছফা আত্মতুষ্টির সঙ্গে বলল। “ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। ও বলেছে, আপনি অনেকটা সময় বাইরে থাকেন, দেশে আসেন অল্প সময়ের জন্য, তাই রাখার দরকার নেই। কিন্তু এখানে যা দেখছি তাতে তাে কথাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে না?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন ডাক্তার। “আমি আসলে ওকে ভুল বলেছিলাম।” “কেন?” “ওকে রাখব না তাই।” “কেন রাখবেন না? সমস্যা কী ছিল?”

“আমি খুবই কম বাইরে যাই এখন,” গভীর করে দম নিয়ে নিলেন।“এত অল্প মুভ করি যে, তার জন্যে ড্রাইভার রাখার কোনাে দরকার দেখি না। তাছাড়া, চাইলে আমি হাসপাতালের গাড়ি ব্যবহার করতে পারি নিজের জন্য আলাদা ড্রাইভার রাখার কোনাে দরকার নেই।”

ছফা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “বুঝতেই পারছেন, সহজ অঙ্ক  সহজ হিসেব।”

এমন সময় গানম্যান আসলাম সবুজ রঙের একটি বাংলাদেশি পাসপাের্ট হাতে নিয়ে শােবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল।  ডাক্তারের দিকে তাকাল ছফা। আসলামের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছেন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। তার কপালে রীতিমতাে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।

সবুজ রঙের পাসপাের্টটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিল গানম্যান।“আমার মনে হয় এই লােক তার মােবাইলফোনটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, স্যার।”

ডাক্তারের দিকে তাকাল নুরে ছফা। পরাজিত সৈনিকের মতাে লাগছে তাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। দৃষ্টিতেশূন্যতা।

“ভেঙেটেঙে কমােডে ফ্ল্যাশও করে দিতে পারে,”আসলাম যােগ করল।

দেশি পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে ভালাে করে দেখল ছফা। “আপনার কথাই ঠিক,” পাসপাের্টের পাতাগুলাে উলটে উলটে দেখতে লাগল সে। “আপনি ঘন ঘন বিদেশে যান।”

কপালে সদ্য জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। কোনাে কথা বললেন না।

ভ্রু কুঁচকে গেল ছফার। পাসপাের্টের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলল, “ইন্ডিয়াতে গেছেন অনেক বার !”

আসকার ইবনে সায়িদ অনেক চেষ্টা করেও চোখেমুখে ভড়কে যাবার অভিব্যক্তিটা লুকাতে পারলেন না।

ডাক্তারের দিকে স্থিরচোখে তাকাল নুরে ছফা। “কলকাতায়!” আস্তে করে শ্বাস নিয়ে নিলেন ভদ্রলােক।“ওখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা। “তা থাকতেই পারে কিন্তু আপনি সেটা লুকানাের চেষ্টা করলেন কেন? আর এই পাসপাের্টটার কথাই বা চেপে গেলেন কেন?”

ডাক্তার ভড়কে গেলেন সামান্য।

“ব্রিটিশ পাসপোর্ট দেখিয়ে বিভ্রান্ত করলেন…এই পাসপোর্টটা, যেটা দিয়ে আপনি ঘন ঘন কলকাতায় যাতায়াত করেছেন, সেটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন  কেন?”

আসকার ইবনে সায়িদ কিছুই বললেন না। সম্ভবত বলতে পারলেন না।

“আপনি কিছু না বললেও উত্তরটা আমি জানি, ডাক্তার, নুরে ছফা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রবীন চিকিৎসককে বিদ্ধ করল যেন।“মুশকান থাকে ওখানে!”

চোখ বন্ধ করে ফেললেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ।

“আমি নিশ্চিত!”ডাক্তারকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল ছফা, “ওখানে কোথায় থাকে সে? আপনাকে বলতেই হবে।” শেষ কথাটা বেশ ধমকের সঙ্গে বলল।

ডাক্তারকে দেখে মনে হচ্ছে, ছফার ধমকে তাসের ঘরের মতােই ভেঙে পড়েছেন তিনি।

অধ্যায় ৪১

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যে কোনাে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না তাতে নুরে ছফার রাগ হবার কথা কিন্তু এ মুহূর্তে সে বরং উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে ভদ্রলােকের দিকে। বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, শুধু দেখতে পাচ্ছে প্রবীন লােকটির কপালে ঘাম ছুটছে, নিজের বুকের ওপর একটা হাত রেখে ম্যাসাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তীব্র ব্যথা হচ্ছে বুকে।

একটু আগে ছফার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার নিশ্চুপ ছিলেন বলে আসলাম তাকে ভয় দেখানাের জন্য কোমর থেকে পিস্তল বের করেছিল, এর পরই ভড়কে যায় ভদ্রলােক।এই কাজটা করার কোনাে দরকারই ছিল না। খুব সহজেই ছফা তার কাছ থেকে জরুরি তথ্যটা আদায় করে নিতে পারত।

“কী হয়েছে?” বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল সে।“বুকে ব্যথা হচ্ছে আপনার?”

আলতাে করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। তার চোখেমুখে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে।

মনে মনে প্রমাদ গুনল ছফা।“ঘরে এসি আছে?” জানতে চাইল।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডাক্তার। সােফার সামনে টেবিলের ওপর থাকা সাদা রঙের একটি রিমােট দেখিয়ে দিলেন ইশারায়।

“এসিটা ছাড়ো, আসলাম।” নিজের পিস্তলটা কোমরে রেখে, রিমােটটা হাতে নিয়ে এসিটা অন করে দিল গানম্যান। “আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?” ছফা ঝুঁকে এল ডাক্তারের দিকে।

খুব কষ্টে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলােক। “আ-আমাকে ”কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তার, “ হাসপাতালে নিয়ে যান  প্লিজ!”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না, এমন পরিস্থিতির জন্য মােটেও প্রস্তুত ছিল না সে।

যন্ত্রণাকাতর অবস্থায়ই আঙুল তুলে সােফার এক পাশে ল্যান্ডফোনটার দিকে ইশারা করলেন তিনি। “৯-১১ ”

ছফা উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিল।

“ ৪-৬-৭-৮-৪-২  আমার হাসপাতালে  ওদেরকে বলুন আমার কথা
এ-একটা অ্যাম্বুলেন্স ” ডাক্তারের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে পড়ল। “এ-এক্ষনি , জড়িয়ে এল তার কণ্ঠ।

উদ্বিগ্ন হয়ে অরিয়েন্ট হাসপাতালে ফোন করে ডাক্তার আসকারের বাসায় একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠানাের অনুরােধ করল সে। রিসিভারটা ক্র্যাডলের ওপর রেখে চেয়ে রইল যন্ত্রণাকাতর ডাক্তারের দিকে। আসলাম মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে আছে, কোনাে হত করুণা কিংবা সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে না তার অভিব্যক্তিতে। বরং ডাক্তারের আচমকা শরীর খারাপ হওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত সে।

নুরে ছফার আশঙ্কা, বৃদ্ধ এই চিকিৎসক হয়তাে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে আছেন। ডাক্তারের কাছ থেকে মুশকান জুবেরির অবস্থানের ব্যাপারে মূল্যবান তথ্য জানা দরকার, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব নয়। এরকম অবস্থায় ভদ্রলােককে চাপ দিয়ে কিছু আদায় করাটা বিপজ্জনক। তার নাজুক হৃৎপিণ্ড হয়তাে সহ্য করতে পারবে না। মরেটরেও যেতে পারেন!

তার চেয়েও বড়ো দুশ্চিন্তার বিষয় হল, ডাক্তার যদি এ যাত্রায় বেঁচেও যান, তাহলে বলে দেবেন, ছফা আর আসলাম তার বাড়িতে বেআইনিভাবে ঢুকে পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়েছিল তাকে বিনা ওয়ারেন্টে সার্চ করেছে তার ঘর।  ডাক্তার মরে গেলে ছফা আরও বেশি বিপদে পড়ে যাবে। এ বাড়ির দারােয়ান ছেলেটা তাদেরকে দেখেছে। পুলিশকে সে জানাবে তাদের কথা।

প্রধানমন্ত্রীর পিএস হয়তাে সব কিছু সামলাতে পারবে, কিন্তু সেই পদ্ধতিটা যে কী হতে পারে, ভেবে গা শিউরে উঠল— নিরপরাধ মানুষ হত্যা?

কক্ষনােই না!

মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ডাক্তারের কাছে জানতে চাইল ছফা, “আপনার এখন কেমন লাগছে?”

মাথা দোলালেন আসকার ইবনে সায়িদ। যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বললেন, “বুকে ব্যথা হচ্ছে  খু-উ-উ-ব!”

সর্বনাশ! যা ভেবেছিল তা-ই। লােকটা হার্ট অ্যাটাকের শিকার! কিংবা কে জানে, এরইমধ্যে হয়ে গেছে কিনা!

সােফা থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে পকেট থেকে দ্রুত ফোনটা বের করে পিএসের নম্বরে কল দিল সে।

“হ্যালাে, স্যার?”নীচুস্বরে বলল। “কী হয়েছে?” ওপাশ থেকে জানতে চাইল পিএস।

ছফা তাকে জানাল— ডাক্তার আসকারকে জেরা করতে গেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সম্ভাব্য হৃদ্‌রােগে আক্রান্ত হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।

এ কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস শান্তকণ্ঠে বলল, “অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই আপনি আসলামকে নিয়ে ওখান থেকে চলে যান। এ মুহূর্তে ওখানে থাকার কোনাে দরকার নেই আপনাদের।”

“কিন্তু এরকম অবস্থায় ডাক্তারকে একা রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে স্যার?”নুরে ছফা দ্বিধাভরা কণ্ঠে জানতে চাইল।

এ প্রশ্নের জবাবেও একই কথা বলল প্রধানমন্ত্রীর পিএস আর সেটা আগের চেয়েও জোর দিয়ে, “আপনারা এক্ষুনি ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্স চলে আসারআগেই।”

“কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স চলে আসার আগেই যদি ডাক্তারের কিছু হয়ে যায়?”ছফা আতঙ্কের সঙ্গে বলল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশেক মাহমুদ।“সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন সময় নষ্ট না করে ওখান থেকে চলে আসুন।”

“ঠিক আছে, স্যার।” নুরে ছফা মােবাইলফোনটা পকেটে রেখে কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। আসকার ইবনে সায়িদের কাছে এসে জানতে চাইল সে, “এখন কী অবস্থা, আপনার ?”

“বুকে ব্যথা হচ্ছে!” ডাক্তার তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, তার চোখমুখ কুঁচকে আছে।

“অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়বে এক্ষুনি,”কথাটা বলে আসলামকে নিয়ে ঘরের এক কোনে চলে গেল সে, নীচুকণ্ঠে বলল, “এই পাসপাের্টার সবগুলাে পেইজের ছবি তুলে নাও  আমাদেরকে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে।”  পাসপাের্টটা হাতে নিয়ে পকেট থেকে মােবাইলফোন বের করে ঝটপট ছবি তুলতে শুরু করে দিল আসলাম।“বুড়া অ্যাক্টিং করছে”ছবি তুলতে তুলতেই নীচু কণ্ঠে বলল সে।

ছফা কিছু বলল না। তার কাছে মনে হচ্ছেনা ডাক্তার অভিনয় করছেন। লক্ষণ বলছে, হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন ভদ্রলােক।

****

প্রায় পাঁচ মিনিট পর অসুস্থ ডাক্তার চোখ খুলে তাকালেন। তার ঘরে এখন কেউ নেই। একটু আগে দু-জন মানুষ কোনাে কিছু না বলে তাকে একা রেখে চলে গেছে। সামনের টেবিলের ওপর তার ব্রিটিশ আর বাংলাদেশি পাসপাের্ট দুটো পড়ে আছে। নিজের শারীরিক অবস্থার কথা বাদ দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, এই পাসপাের্ট থেকে নুরে ছফা নামের ওই ডিবি অফিসার কী-ই বা বের করতে পারবে?

আর যাই হােক, ওর ব্যাপারে কিছু জানার কথা নয়! অবশেষে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি।

অধ্যায় ৪২

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিজ বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন রমাকান্তকামার চারপাশ ঘিরে থাকা গাছগাছালি থেকে ঝিঝিপােকার দল একচ্ছত্র শুনসান পরিবেশকে বিরামহীন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে যেন। কালচে আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। সেখানে অন্ধকারের সঙ্গে পেরে উঠছেনা ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলাে। দৃশ্যটা একটু উদাস করে  দিল তাকে। তাহলে কী আবারও তার জীবনে কালােছায়া নেমে এল?

সারা দিন স্কুলে সময় দিয়ে বিকেলের দিকে চলে যান রবীন্দ্রনাথে, সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়-আজও তার ব্যতিক্রম করেননি, কিন্তু অন্যসব দিনের মতাে ঘরে বসে বই পড়ে কিংবা স্কুলের কাগজপত্র নিয়ে না বসে একমনে ভেবে যাচ্ছেন। একটু আগে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন খােন্দকার তাকে ফোন করেছিল। ভদ্রলােক অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই জানতে চেয়েছেন, চিরকুটের বিষয়টা নুরে ছফা নামের ডিবি অফিসারকে তিনি কেন বলতে গেলেন! ভদ্রলােককে নাকি পিস্তল দেখিয়ে বাধ্য করেছে স্বীকার করতে, চিরকুটটা ডাক্তার আসকার তাকে দিয়েছিলেন। উকিলের কাছ থেকে সব শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন রমাকান্ত কামার।  এ জীবনে কখনও সজ্ঞানে আইন ভঙ্গ করেননি তিনি, অপরাধীর সঙ্গে যােগাযোগ রাখার তাে প্রশ্নই ওঠেনা। সমাজের হীন আর কুটিল লােকজনকে ঘেন্না না করে বরং সব সময়ই এড়িয়ে চলেন—এটাই তার নীতি। ওই ছফাকেও এড়িয়ে যেতেন, কিন্তু সে আইনপ্রয়ােগকারী সংস্থার লােক, তাকে সাহায্য করা নৈতিক কর্তব্যই নয়, আইনত বাধ্যও তিনি। তাই চিরকুটের ব্যাপারে সত্যিটা বলেছিলেন। বেনামি একটি চিরকুট পাঠিয়ে শুধু নির্দোষ একটি অনুরােধ করেছিল মহিলা—অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টটির জায়গায় একটি গ্রন্থাগার করা। রাশেদের স্ত্রী এমন অনুরােধ না করলেও সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি লাইব্রেরী করতেন মাস্টার-আর সেটা হত বহুকাল আগের বিস্মৃত আর ধ্বংস হওয়া একটি প্রতিষ্ঠানকে পুণরুজ্জীবিত করার শামিল।  তিন বছরেরও বেশি আগে, রাশেদ জুবেরির স্ত্রী সুন্দরপুর ছাড়ার আগে তাকে পাঠিয়েছিল।সত্যি বলতে,এখানে আসার পর থেকে বার কয়েকই চেষ্টা করেছিল ভদ্র তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, কিন্তু মাস্টার এড়িয়ে গেছেন। মহিলা যে রাশেদের এ নিয়ে তার মনে ছিল সন্দেহ।তবে সমস্ত সন্দেহ, সংশয় আর দুরত্ব ঘুচিয়ে অবশে
ষে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে সেটা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। মহিলা তাকে বলেছিল, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহর কারণেই এই ট্রাস্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। যদি সে ট্রাস্টের ঘােষণা দিত, এমপি নির্ঘাত মাস্টারের ক্ষতি করত। আর সেটা যে কী, না বললেও চলে। তাই আসাদুল্লাহ লােলুপ দৃষ্টি থেকে জমিগুলো আগলে রাখার চেষ্টাই করে গেছে এতদিন। মাস্টারের কাছেও মনে হয়েছে, কথাটার মধ্যে সত্যতা রয়েছে। আসাদুল্লাহর রূপ তাে তিনি কম দেখেননি।

ক্ষয়িষ্ণু চাঁদটার দিকে তাকালেন রমাকান্ত কামার। তিনি এখনও বিশ্বাস করেন গাছের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য আছে। আম গাছে জাম হবে না, আমই হবে। কিন্তু মানুষের বেলায় এটা খাটে না। চোরের ছেলে চোর হবে এমন কোনাে কথা নেই। আবার সাধুর ছেলে যে চোর হবেনা তা-ও জোর দিয়ে বলা যায় না। তারপরও বাস্তবতা হল, অনেক সময়ই দেখা যায় চোরের ছেলে চোরই হয়! এ হল সঙ্গদোষের ব্যাপার। পরিবেশ আর সময় তাকে প্রভাবিত করে। জন্মের পর মানবশিশু সাদা কাগজের মতােই নিষ্কলঙ্ক থাকে, কিন্তু তাতে দাগ ফেলে তার অভিভাবক, পরিবার, পরিবেশ আর সময়। এসব যদি শিশুর অনুকূলে না থাকে, সে শিশু মানুষ হবে কীভাবে? কয়জন পারে নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ আর সময়কে জয় করতে?

সুন্দরপুরের মুসলিম লিগের পাণ্ডা হামিদুল্লাহর ছেলে আসাদুল্লাহ কি তার বাপের মতাে হয়নি?

হামিদুল্লাহ ছিল আগাগােড়া সাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু জনগােষ্ঠী ছিল তার দুচক্ষের বিষ—জমিদার থেকে মুচি; ব্রাহ্মণ থেকে নমশূদ্র, এমনকি ব্রাহ্মরা পর্যন্ত। তার কাছে তাদের সবার পরিচয় ছিল একটাই—মালাউনের বাচ্চা! ইন্ডিয়ার দালাল! ব্রাহ্মরা যে হিন্দু না এটা বােঝার মতাে কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও রাজনৈতিক আর জাগতিক ফায়দার কথা ভেবে চেপে যেত। এই ঘেন্নার রাজনীতি তাকে শেষ পর্যন্ত অমানুষে পরিণত করে। একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাস সুন্দরপুরের সবাই সেই অমানুষটাকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছে।

কী একটা সময়ই না ছিল! নিজের অজান্তেই, কখন যে স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন টেরই পেলেন না রমাকান্ত কামার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বড্ড বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। এই নিঃসঙ্গ জীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আগের চেয়ে অনেক বেশি পুরােনাে স্মৃতি তাকে কাতর করে তােলে। এই যেমন এখন, একাত্তরের নানান ঘটনা তার মানসপটে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

রাশেদ জুবেরির মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। কী সহজ সরল আর ভালাে মানুষই না ছিল! এত সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও জাগতিক বিষয়ে এক ধরণের বৈরাগ্য ছিল তার মধ্যে। সম্ভবত এক লহমায় বাবা-মা, নানাসহ পরিবারের সবাইকে হারানাের কারণে তার এই বৈরাগ্যভাবের জন্ম। সেদিন যমের তালিকায় সে-ও ছিল কিন্তু রমাকান্ত কামারের বাসায় থাকার দরুণ বেঁচে যায়। বইয়ের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে টেনে এনেছিল এই বাড়িতে।সুন্দরপুরে সপরিবারে বেড়াতে এসে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। একটাও লাইব্রেরী নেই, এ কেমন মফস্সল! কিন্তু সে তখনও জানত না, এক সভা এই সুন্দরপুরে ছিল রবীন্দ্রনাথের নামে সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার, ঘেন্নার রাজনীতিতে সে রবীন্দ্রনাথ পুড়ে খাক হয়ে গেছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের অমূল্য সম্পদের বিরাট একটি অংশ রক্ষা করতে পেরেছিলেন মাস্টার। পয়ষট্টি থেকে গত বছর রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরীটি পুণরায় দেবার আগ পর্যন্ত সযত্নে নিজের বাড়িতে আগলে রেখেছেন বইগুলাে। একটা বইও পােকায় খেতে পারেনি, অনাদরে নষ্ট হয়নি। সন্তানের স্নেহে সেগুলাে আগলে রেখেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশটি বছর।  রাশেদের মা অঞ্জলি জানত এটা। মাস্টারের সঙ্গে তার ছিল বেশ ভালাে সম্পর্ক। অঞ্জলিই ছেলেকে গল্পটা বলেছিল এক সময় সুন্দরপুরে ছিল রবীন্দ্রনাথের নামে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরী, আর সেটা দিয়েছিলেন ত্রিলােকনাথ বসু। পয়ষট্টির দাঙ্গায় লাইব্রেরীটা কীভাবে পুড়ে যায়, আর বইগুলাে কীভাবে মাস্টার রমাকান্ত কামার রক্ষা করেছিলেন, এই গল্পটাও করেছিল সে। রাশেদ সব শুনে আগ্রহী হয়ে ওঠে, মাস্টারের বাড়িতে হানা দেয়। বইয়ের সংগ্রহ দেখে ছেলেটার ভুরু কপালে উঠে গেছিল। বহু দুষ্প্রাপ্য বই তাকে আকর্ষিত করেছিল পতঙ্গের মতােই। বইয়ের টানে মাস্টারের বাড়িতে পড়ে থাকার সময়ই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি। সুন্দরপুরে হানা দেয় পাক-হানাদাররা, আর তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই জঘন্য লােকটি—আসাদুল্লাহর বাপ, মুসলিম লিগের হামিদুল্লাহ নয়টা মাস সে কখনও যমের দোসর ছিল তাে কখনও নিজেই যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কত মানুষ হত্যা করেছে, কত লুণ্ঠন আর ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল কে জানে। তার নয় মাসের পশুরাজত্ব শেষ হয় পনেরােই ডিসেম্বর—স্বাধীনতা পাবার ঠিক এক দিন আগে।

একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের আগের দিন সুন্দরপুর যখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা মুক্ত করে ফেলল তখন হামিদুল্লাহ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তার লুণ্ঠিত ধনসম্পদের কিছু অংশ নিয়ে, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা তাকে ধরে ফেলে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, যে বাড়িতে মিলিটারি ক্যাম্প করে মানুষজন হত্যা করত, নির্যাতন করত সেই জমিদার বাড়িতে নিয়ে গিয়েই তাকে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযােদ্ধারা। অনেক বছর পর সেই আল-বদর নেতার ছেলে যখন এলাকার এমপি হয়ে গেল তখন মাস্টারকে একদিন ডেকে নিয়ে গেছিল একটা কথা জানার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সেই দলে রাশেদ জুবেরি ছিল কিনা!

রমাকান্ত কামার জানতেন, এতদিন পর এই লােক এটা কেন জানতে চায় — জমিদারের সম্পত্তিগুলাে জবর দখল করার জন্য যুতসই একটি বাহানা খুঁজছে বাপের যােগ্য ছেলে।

মাস্টার তাকে বলেছিলেন, ওইদিন রাশেদকে দেখেননি তিনি। তখন সে সুন্দরপুরে এসেছিল কিনা তা-ও তার জানা নেই। তার সঙ্গে জুবেরির দেখা হয়েছিল সতেরােই ডিসেম্বর সকালে। সমগ্র জীবনে সজ্ঞানে মাত্র তিনটি মিথ্যা বলেছিলেন তিনি দ্বিতীয় মিথ্যাটি বলার সময় তার মধ্যে কোনাে অনুশােচনা বা অপরাধবােধ তৈরি হয়নি। যুধিষ্ঠিরকেও তাে মিথ্যে বলতে হয়েছিল সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ! নিজেকে এভাবেই বুঝ দিয়েছিলেন মাস্টার।  তবে এটাও ঠিক, তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না আসলেই ওইদিন মুক্তিযােদ্ধাদের যে দলটি হামিদুল্লাহকে হত্যা করেছিলাে সেই দলে রাশেদ ছিল কিনা। যুদ্ধফেরত ছেলেটার সঙ্গে তার দেখা হয় হামিদুল্লাহর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর। নরম স্বভাবের রাশেদ জুবেরির চোখমুখ দেখে মাস্টার শুধু কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

স্বাধীনতার পর, মাঝেমধ্যে কিছু দিনের জন্য সুন্দরপুরে এসে মাস্টারের বাসায় উঠত রাশেদ, নানার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেও যেত না। সম্ভবত ওখানে বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছিল বলে পারিবারিক বধ্যভূমিটা এড়িয়ে চলত সে। তাে, এরকমই একদিন রাশেদ জুবেরি মাস্টারের বাড়িতে বেড়াতে এসে এ কথা ওকথা বলার এক পর্যায়ে বলেছিল, যুদ্ধের আগে একটা মুরগি কাটতে দেখলেও তার বুক কেঁপে উঠত, মায়া হত, এমনকি যুদ্ধের সময় হানাদার পাকবাহিনী মারতেও তার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করত, কিন্তু খুন হবার আগে হামিদুল্লাহর করুণ চেহারাটা দেখলে নাকি তার একটুও মায়াদয়া হত না!

নাকি হয়নি!

মাথা থেকে আবারও পুরােনাে স্মৃতিগুলাে বিদায় করে হাই তুললেন মাস্টার। বর্তমান সমস্যাটা নিয়ে আবার ভাবতে লাগলেন। ট্রাস্টের সদস্য ডাক্তার আসকার কোথায় আছে সেটা নাকি ময়েজ উদ্দিন বলে দিতে বাধ্য হয়েছে। ভদ্রলােকের সঙ্গে ছফা কী করে কে জানে! তাকে আগেভাগে বলে দিলেই পারতেন! কিন্তু জীবনে প্রথম তিনি স্বার্থপরের মতাে হাত পা গুটিয়ে রেখেছেন। আর এটা মােটেও নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য নয়-তার স্বপ্নের গায়ে যাতে আঁচড় না লাগে সেজন্যে।

অধ্যায় ৪৩

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বাড়ি থেকে দশ-পনেরাে গজ দূরে, ছায়াঘন একজায় ইনসাইড লাইট বন্ধ করে গাড়ির ভেতরে বসে আছে নুরে ছফা আর আসলাম। গাড় হয়ে উঠেছে সন্ধ্যা, জ্বলে উঠেছে রাস্তার বাতিগুলাে।

একটু আগে ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের মধ্যে আর কোনাে কথা হয়নি। এখনও কোনাে কথা হচ্ছে না। দু-জনেরই দৃষ্টি ডাক্তারের শুনসান বাড়িটার দিকে।ওখান থেকে বের হবার আগে দারােয়ানকে অবশ্য ডাক্তারের অসুস্থতার কথা বলে এসেছে। আরও বলেছে, কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে, চিন্তার কিছু নেই, সে যেন ডাক্তারের সঙ্গে থাকে।

এ কথা শুনে দারােয়ান যা বলেছে সেটা নিয়ে নুরে ছফা এখন চিন্তিত। লােকটা তাদের দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন, দু-দুজন দস্যু জোর করে বাড়িতে ঢুকে ডাক্তারকে হত্যা করার জন্য পয়জন ইনজেকশান দিয়ে চলে যাচ্ছে!

“হায় আল্লাহ! স্যাররে আপনেরা কী করছেন?”  লােকটা ভয়ার্ত চোখেমুখে এ প্রশ্ন করলে আসলাম রেগেমেগে তার কলার ধরে বসেছিল, অবশ্য ছফা তাকে বিরত রাখে। তার নিজেরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল দারােয়ানের এমন কথা শুনে। তারপরও রাগ সামলে ঠান্ডা মাথায় বলেছিল, এসব উলটাপালটা কথা যেন সে না বলে। তার স্যারের তেমন কিছু হয়নি। বৃদ্ধ মানুষ, একটু জিজ্ঞাসাবাদের কারণে ঘাবড়ে গেছেন। সম্ভবত তার প্রেসার বেড়ে গেছে, তাই বুকে একটু ব্যথা হচ্ছে। তার নিজের হাসপাতালে ফোন করা হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে।

কিন্তু সেই অ্যাম্বুলেন্স এখনও আসেনি। ছফার চিন্তা এখন একটাই-ডাক্তারের না আবার খারাপ কিছু হয়ে যায়!

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার জন্য গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিল সে। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আসলাম তাকাল তার দিকে। “স্মােক করব,”আস্তে করে বলল ছফা। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে একটাতে আগুন ধরাল। সিগারেটে যখন দ্বিতীয় টানটা দেবে তখনই দেখতে পেল অরিয়েন্ট হাসপাতালের লােগো আর নাম লেখা একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির ডাক্তারের বাড়ির সামনে। তড়িঘড়ি করে দারােয়ান ভেতর থেকে গেটটা খুলে দিল, অ্যাম্বুলেন্সটা বাড়িতে ঢুকতেই বন্ধ করে দিল আবার।

সব ভুগিচুগি,”আসলাম বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল। তার দিকে তাকাল ছফা।বিরক্তভরা দৃষ্টি নিয়ে ডাক্তারের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে পিএসের গানম্যান।

অ্যাক্টিং করেছে,”দৃঢ়ভাবে বলল সে।“আমি একদম শিয়াের।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছফা, তবে কিছুই বলল না। ডাক্তার যদি অভিনয় করে থাকেন তাহলে বলতেই হবে, তিনি বেশ পাকা অভিনেতা। কিন্তু ভদ্রলােকের ঘর্মাক্ত কপাল, অনুণাকাতর চোখমুখ-এসব দেখে অভিনয় বলে মনে হয়নি তার কাছে। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে সেটা বের করে দেখল পিএস আশেক মাহমুদ কল দিয়েছে। সন্দেহ নেই, তার মতােই ক্ষমতাধর এই মানুষটিও চিন্তিত।

“স্যার?” “এনি আপডেট?”ওপাশ থেকে জানতে চাইল আশেক মাহমুদ,তার কণ্ঠেও উদ্বিগ্ন।

“অ্যাম্বুলেন্স এসেছে,” ছফা বলল। “এখন বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে ডাক্তারকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।”

“আপনারা কোথায়?” “ডাক্তারের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আছি, স্যার।” কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে পিএস বলল, “মরেটরে যাবে না তাে?” “বুঝতে পারছি না।” “আচ্ছা, ওই দারােয়ান ছাড়া আর কে দেখেছে আপনারা বাড়িতে ঢুকেছেন?”

জবাবটা দেবার আগে একটু সময় নিল ছফা। পিএস কি উইটনেস এলিমিনেট করার কথা ভাবছে? চিন্তাটা আবারও ভড়কে দিল তাকে। “আর কেউ না, স্যার,” বলল সে। “কিন্তু ওই দারােয়ান সম্ভবত অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে হাসপাতালে যাবে।” ছফার আশঙ্কা, পিএস হয়তাে তার গানম্যানকে নির্দেশ দেবে, একমাত্র সাক্ষী দারােয়ানকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু সেটার জন্যেও যে একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই যেন বলতে চাইল।

কয়েকমুহূর্তচুপ মেরে রইল পিএস। “আরেকটু পর আমি আবার কল দেবাে আপডেট জানতে। দেখা যাক কী হয়।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

ফোনটা পকেটে রেখে আনমনা হয়ে গেল ছফা। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আসলামের দিকে চকিতে তাকাল। গানম্যানের দৃষ্টি এখনও গেটের দিকেই নিবদ্ধ। সামনের দিকে তাকাল সে। দারােয়ান নির্ঘাত এরইমধ্যে তাদের কথা অ্যাম্বুলেন্সে করে আসা লােকজনকে বলে দিয়েছে। তাছাড়া, ডাক্তার যদি মারা যাবার আগে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে পারেন, তাহলেও তাদের কথা জানিয়ে দিতে পারবেন নিজেই। সব দিক থেকে ভালাে হয়, ভাক্তার যদি এ যাত্রায় টিকে যান। নুরে ছফা মনে মনে সেই কামনাই করল।

“মরবেনা,”আস্তে করে বলল আসলাম, যেন ছফার আশঙ্কাটা টের পেয়ে “চিন্তার কিছু নেই।”

গানম্যানরে দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি এখনও সামনের দিকেই নিবদ্ধ। এই লোকটা কি তার মনের কথা পড়তে পেরেছে? নাকি তার উবিগ্নতা আঁচ করতে পেরেছে? – “হুম।” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মাথা নেড়ে সায় দিল সে। ডাক্তার যেন যাত্রায় বেঁচে যান!কিছুক্ষণ পরই ডাক্তারের বাড়ির মেইন গেটটা খুলে গেল আবার। অ্যাম্বুলেন্সটা বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে একটু সময়ের জন্য থামল। এই ফাঁকে মেনগেট বন্ধ করে তালা মেরে অ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে উঠে বসল দারােয়ান। কোনাে রকম সাইরেন না বাজিয়ে, অনেকটা চুপিসারে চলে গেল গাড়িটা।’

ওটা ফলাে করাে—এরকম কোনাে আদেশ দিতে হল না ছফাকে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটাকে অনুসরণ করতে শুরু করে দিল আসলাম।  কিন্তু ছফাকে হতাশ করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত এই অনুসরণ পর্বটি শেষ হল অরিয়েন্ট হাসপাতালে গিয়েই। দূর থেকে তারা দেখতে পেল অ্যাম্বুলেন্সটি ঢুকে পড়ছে হাসপাতালের ভেতরে।

“ওখান দিয়ে তাে লাশ বের করে,” আসলাম বলল সন্দেহের সুরে। “আমি এই হাসপাতালে এর আগেও এসেছি  ওটা এমার্জেন্সি এন্ট্রান্স না।”

তার দিকে তাকাল নুরে ছফা।“লাশ বের করে ওখান দিয়ে?”কথাটা বলার সময় তার কাছে মনে হল ডাক্তার বুঝি মারাই গেছেন।

“গত বছর আমার এক খালাতাে ভাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিল এই হাসপাতালে, ওর লাশটা ওখান দিয়েই বের করেছিল।”

ছফা কিছুই বলল না। ‘বুড়ো অ্যাক্টিং করেছে,”আসলাম আবারও বলল কথাটা।  পিএসের গানম্যানের দিকে তাকাল সে, তার চোখেমুখে রাগ, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।

অধ্যায় ৪৪

“তাহলে আপনি মনে করছেন ওই মহিলা কলকাতায় আছে?

“জি, স্যার,”বলল ছফা। “আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়াের।”

তারা এখন বসে আছে গুলশান নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে। জায়গাটা ডাক্তার আসকার  সায়িদের বনানীর বাসা আর অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে খুব একটা দূরে নয়। আসলাম তাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে আবার চলে গেছে অরিয়েন্ট হাসপাতালে। ডাক্তার সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে গেছে সে।

“ডাক্তারের পাসপাের্ট সেটাই বলছে।উনি যে ঘন ঘন কলকাতায় যান সেটা লুকোনাের চেষ্টা করেছেন। এর মানে একটাই— মুশকান জুবেরি কলকাতায় আছে। তা না-হলে ভদ্রলােক এটা করতেন না।”

মাথা নেড়ে সায় দিল আশেক মাহমুদ। “হুম। ইট ডাজ মেক সেন্স।”

ছফা বুঝে উঠতে পারছে না, ডাক্তার যে নতুন গল্পটা বলেছেন মুশকানের ব্যাপারে সেটা পিএসকেপ বলবে কিনা। তার কাছে মনে হচ্ছে, আগেভাগে না বলাই ভালাে, আর-একটু খতিয়ে দেখা দরকার। ওই ভদ্রলােকের কোন কথাটা যে সত্যি, সে নিজেও জানে না। একটা প্রহেলিকা তৈরি করেছেন বৃদ্ধ ডাক্তার। গােলকধাঁধাতুল্য সেই প্রহেলিকা থেকে বের হবার একটাই উপায়-মুশকানকে হাতের মুঠোয় নেওয়া।

“তাহলে এখন কী করবেন?”ছফাকে চুপ থাকতে দেখে জানতে চাইল পিএস আশেক মাহমুদ।

ছফা কোনাে সময় না নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “আমার কলকাতায় যাওয়া দরকার। বেশি দেরি করলে ওই মহিলা ওখান থেকেও সটকে পড়তে পারে।”

“এতক্ষণে সটকে পড়েছে কিনা কে জানে,”তিক্তমুখে বলল পিএস।

আমার মনে হয় না, স্যার,” জোর দিয়ে বলল। “ডাক্তার যদি এরইমধ্যে মুশকানকে সব জানিয়েও দেন, অত দ্রুত কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না মহিলা।”

“আপনার কেন এটা মনে হচ্ছে?”ডাক্তার জানেন আমি কেবল তার ঘনঘন কলকাতায় যাবার বিষয়টি আবিষ্কার করেছি।তিনি কোথায় উঠতেন, কোথায় যেতেন সেটা আমি জানি না। তাছাড়া আমার “, ডাক্তারের সাহায্য ছাড়া ওই মহিলা আবারও নতুন কোনাে আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে সহজে। একটু সময় লাগবেই।”

“হুম,”গম্ভীরভাবে বলল পিএস।

“কলকাতার মতাে শহরে একজন মানুষকে খুঁজে বের করা অসম্ভব না হলেও কঠিন, আর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”

“তাহলে আপনি তাকে কীভাবে খুঁজে বের করবেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো আশেক মাহমুদ।

একটু ভেবে নিল ছফা। প্রথমেই তার মনে পড়ল কেএস খানের কথা। সাবেক এই ইনভেস্টিগেটর তাকে নিশ্চয় এ ব্যাপারে ভালাে সাহায্য করতে পারবে। “ওই মহিলাকে খুঁজে বের করার একটা উপায় বের করতে হবে দ্রুত,”বলল সে।

মাথা নেড়ে সায় দিল পিএস।

“ওখানে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আমার বেশ ভালাে জানাশােনা আছে, আশা করছি তার কাছ থেকে সাহায্য পাব।”

“তাহলে আপনি কবে যেতে চাইছেন?” একটু থেমে আবার বলল পিএস, “আপনার  কি ভিসা আছে?”

“আমার পাঁচ বছরের ভিসার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি, স্যার।”

“গুড। আপনি তাহলে আমাকে জানান, কবে যেতে চান। এয়ার টিকিট নিয়ে ভাববেন না রিগ্যাল এয়ারওয়েজের মালিক আমার পরিচিত। টিকিট না থাকলেও যখনই চাইবেন,আপনার জন্যে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে সে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“ওই ডাক্তার যাতে বিদেশে চলে যেতে না পারে, সেটার ব্যবস্থাও করা যাবে। আপনি তার পাসপাের্টের ছবি আসলামের ফোনে সেন্ড করে দেবেন। আমি ইমিগ্রেশনে বলে দেব, ওই ডাক্তার দেশের বাইরে যেতে পারবে না।”ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবার বলল, “ওই ডাক্তার যদি বেঁচে থাকে তাহলে আপনি ওখান থেকে ফিরে এসেও তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।”

“আমি খুব দ্রুতই যেতে চাইছি, স্যার  কাল-পরশুর মধ্যেই।”

“হুম,”গম্ভীর হয়ে সায় দিল পিএস।“একটা কথা। আপনি যদি ওই মহিলাকে ওখানে ট্র্যাক ডাউন করে ফেলতে পারেন তখন কী করবেন?”

“মুশকানকে ওখানে খুঁজে পেলেও তাকে গ্রেফতার করে দেশে আনাটা সহজ হবে না। ওদের সঙ্গে আমাদের এক্সট্রাডিশান প্যাক্ট রয়েছে, কিন্তু সেটা করতে অনেক সময় লাগে, মামলার নথিপত্রও সাবমিট করতে হয়। এ কাজটা আমি একটু অন্যভাবে করতে চাই।”

“কীভাবে?”

“আমার ধারণা ওই মহিলা অবৈধভাবে ওখানে গেছে। এখান থেকে সরকারিভাবে অনুরােধ জানালে তাকে পশ্চিবঙ্গের অথরিটি খুব সহজেই পুশব্যাক করে দিতে পারবে সীমান্ত দিয়ে। সেখান থেকে আমি তাকে নিজের হেফাজতে নিয়ে নেব।”

মাথা নেড়ে সায় দিল পিএস। এভাবে অসংখ্য পুশব্যাকের মাধ্যমে আসামি আদানপ্রদান করে দুই প্রতিবেশী দেশ। “আর মহিলা যদি বৈধভাবে ওখানে গিয়ে থাকে, তাহলে?”

“তাতেও সমস্যা নেই। তার বিরুদ্ধে যে কেসগুলাে আছে, সেগুলো ওদেরকে জানাব, আসামিকে পুশব্যাক করতে বলব।”

একটু ভেবে নিল পিএস।“সে যদি ওখানকার সিটিজেনশিপ বাগিয়ে নেয়? তিন বছর আগে গিয়ে থাকলে তাে এই দীর্ঘ সময়ে নাগরিকত্ব নিয়ে নেওয়াটা অসম্ভব কিছু না।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। এটারও সম্ভাবনা আছে।

“নিরাপদ থাকার জন্য, সম্পূর্ণ নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে ভিন্ন একটি দেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারে ওই মহিলা।”  একটু চিন্তায় পড়ে গেল নুরে ছফা।ওখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে নিলে মুশকানকে দেশে নিয়ে আসাটা সহজ হবে না।

“আপনি কোনাে চিন্তা করবেন না,” ছফাকে আশ্বস্ত করে বলল আশেক মাহমুদ। “ওরকম কিছু হলে তাকে সবার আগে নিজের ঢাকায় নিয়ে নিরাপদ কোথাও রেখে দেবেন, বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা আমি করতে পারব।”

অধ্যায় ৪৫

গভীর করে শ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকাল আসলাম।অরিয়েন্ট হাসপাতালের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের সামনে যে ওয়েটিং এরিয়ায় আছে, সেখানে বসে আছে। অন্য রােগীদের উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজনও আছে বাকি চেয়ারগুলাে দখল করে। কেউ কেউ পায়চারি করছে চিন্তিত মুখে। তাকে দেখলে, ওইসব আত্মীয়স্বজনদেরই একজন বলে মনে হবে। আদতে সে এসেছে চতুর আর ধূর্ত ডাক্তার আসকারকে নজরদারি করতে—আসলাম পুরােপুরি নিশ্চিত, বুড়ােটা অসুস্থ হবার ভান করেছে।

এরকম কাজ পিএসের গানম্যান হিসেবে চাকরি নেবার পর আরও দুয়েক বার করেছে, সুতরাং সে জানে, কতটা বিরক্তিকর হতে পারে এটা। চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ এমনিই তাকে নিয়ােগ দেয়নি। যদিও নুরে ছফার মতাে অনেকেই জানে না, সে আসলে পিএসের নিছক কোনাে গানম্যান নয়। আশেক মাহমুদের এমন সব ব্যক্তিগত কাজ সে করে দেয়, যেগুলাে অন্য কাউকে দিয়ে করানাে যায় না। গানম্যান কিংবা গানম্যান থেকে তার কাজ আরও বিস্তৃত-বহুমুখী! নিয়ম অনুযায়ি, প্রধানমন্ত্রীর পিএস হিসেবে পুলিশ বাহিনী থেকে একজন গানম্যান পায় আশেক মাহমুদ, কিন্তু ওকে নিয়ে খুব একটা ঘুরে বেড়ায় না। কেবলমাত্র সরকারি অনুষ্ঠানেই ওই গানম্যান তার সঙ্গে থাকে। বাকি সময়ে তার সারাক্ষণ সঙ্গী হয় আসলাম।

‘ এমুহূর্তে তার হাতে একটি পত্রিকা। মাঝে মাঝে ওটা খুলে পড়ার ভান করছে। তবে তার নজর আসলে ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের দরজার দিকেই নিবদ্ধ। এর আগেও এক আত্মীয়ের হার্ট অ্যাটাক হলে এই হাসপাতালে এসেছিল, তখন দেখেছে কীভাবে এই হাসপাতালটি চলে।এখন অপেক্ষা করছে ডাক্তারের সত্যিকারের হালহকিকত জেনে নিতে।  আসলাম জানে, তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এই ইউনিটে এখন পর্যন্ত পাঁচজন রােগীর নাম সে মুখস্ত করেছে। সিকিউরিটি
অফিসার-কাম-রিসেপশনিস্ট বসে আছে সে মাঝেমধ্যেই রােগীর নাম ধরে তার আত্মীস্বজনদের খোঁজ করছে। একজন রােগীর নাম উচ্চারণ করে আর ওয়েটিং এরিয়ায় বসে থাকা উদ্বিগ্ন আত্মীয়ের দল ছুটে যায় তার কাছে। সে তখন জানায় তাদের মধ্যে একজন ভেতরে ঢুকতে পারে রোগীকে দেখার জন্য। রােগী নিজেই নাকি বলেছে অমুকের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।

আবার অনেক সময় রােগীর আত্মীয়েরা হন্যে হয়ে খোঁজ নেয় রিসেপশনিস্টের কাছে তাদের রােগীর অবস্থা জানতে।তখন ওই লােক ইন্টারকমের মাধ্যমে ভেতরের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে একজন-দুজনকে অনুমতি দেয় দেখা করার জন্য।

শিকারির মতাে ধৈর্য নিয়ে আসলাম এখন বসে আছে ওয়েটিং এরিয়ায়। খিদেয় তার পেট চোঁ চোঁ করলেও সেটা দমিয়ে রেখেছে। সব কিছু দেখে তার মনে হচ্ছে, একটু পরই আইসিসিইউ-তে ঢােকার সুযােগ পেয়ে যাবে।

যেহেতু ডাক্তারের কোনাে আত্মীয়স্বজন এখনও আসেনি, ইচ্ছে করলে সে আত্মীয় সেজে ভেতরে ঢােকার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে জানে, এটা করা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি বিরাট বড়ো বােকমি হবে। এই হাসপাতালটি ডাক্তারের নিজের, তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এখানে ঢােকা সম্ভব নয়। এখানকার অনেকেই লােকটার নিকটাত্মীয়দের চেনে। তাছাড়া, অন্য রােগীর তুলনায় তার বেলায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।বুড়ােটা যদি ভান করে থাকে, তাহলে সতর্কতার মাত্রা হবে আরও বেশি। আসলাম তাই অন্যভাবে কাজটা করবে।

একটা হাই তুলে পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরল আবার।কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেল রিসেপশন থেকে বলা হচ্ছেঃ

“আবিদুর রহমানের লােক আছে এখানে?”

ওয়েটিং এরিয়ার দিকে তাকাল আসলাম। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সম্ভবত এই রােগীর আত্মীয়স্বজন নীচে গেছে চা-সিগারেট খেতে। চট করে উঠে দাঁড়াল সে, এগিয়ে গেল রিসেপশনের দিকে।

“কী হয়েছে, বলুন?” উদ্বিগ্ন আত্মীয় হিসেবে জানতে চাইল সে।

“আপনার সঙ্গে ডাক্তারসাহেব কথা বলবেন  ভেতরে যান,” বলল রিসেপশনের লােকটা।

আসলাম আর কোনাে কথা না বলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ভেতরে ঢােকার পর একজন পুরুষ নার্স তাকে গাউন আর হেডক্যাপ পরতে বলল। দরজার পাশে থাকা র্র্যাক থেকে গাউন আর হেড-ক্যাপটা নিয়ে পরে ফেলল সে। এরপর নার্স ইশারা করল বিশাল বড়ো রুমটায় ঢােকার জন্য।  আইসিসিইউ-র বিশাল রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল আসলাম। দু-পাশে সারি সারি বেড, প্রত্যেকটাই
কার্টেন দিয়ে আড়াল করা। প্রত্যেক বেডের পাশেই অনেকগুলাে যন্ত্রপাতি আর মনিটর আছে। রােগীদের বেশির ভাগ অক্সিজেন মাস্ক পরা। এক দু-জন বাদে সবাই নিথর হয়ে পড়ে আছে। ঘরের শেষ মাথায় কম্পিউটার আর কিছু মেশিনসহ বিশাল একটি ডেস্কের ওপাশে অ্যাপ্রােন পরা এক ডাক্তার বসে আছে। বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ নার্স থাকলেও তারা বলতে গেলে নিঃশব্দেই চলাফেরা করছে এক বেড থেকে আর-এক বেডের দিকে।

আসলাম ভালো করে দু-পাশে তাকাল, ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখে গেল কোনবেডে ডাক্তার আসকার আছেন। তার এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধীরগতির ভ্রমণটি শেষ হল ঘরের শেষ মাথায় থাকা ডেস্কের সামনে এসে।

এখানে ডাক্তার নেই। বিস্ময়ের সঙ্গেই আবিষ্কার করল সে।

“আমি আবিদুর রহমানের ছােটোভাই,”ডেস্কে বসে থাকা ডাক্তারকে বলল “আমার রােগীর কী অবস্থা, বলেন?”কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা ফুটিয়ে তােলার চেষ্টাও করলো না।

ডেস্কের ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে করুণ মুখেবলল, “আপনার রােগীর অবস্থা ভালাে না। তার হার্ট মাত্র টোয়েন্টি পার্সেন্ট কাজ করছে, অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল,,,

আসলামের মধ্যে কোনাে ভাবান্তর হল না।“এখন কী করব তাহলে?” “অবস্থা বেশি খারাপ হলে কী লাইফ সাপাের্ট দেব?”  শালা বানচোতের দল! গালিটা মনে মনেই দিল সে। লাইফ সাপাের্ট দিয়ে কোনাে রােগী বাঁচাতে পেরেছিস! অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা জানে, তারপরও বি
লের অঙ্ক ভারী করার জন্য হাসপাতালগুলাে এ কাজ করতে দারুণ তৎপর থাকে সব সময়।

“না। তার কোনাে দরকার নাই,” কাটাকাটাভাবে বলল সে। অচেনা রােগীর আত্মীয়-স্বজনদের টাকা বাঁচিয়ে দেবার মত পূণ্য কাজটা করল।

ভান্ডার কয়েক মুহূর্তকাল আসলামের দিকে, যেন পাষণ্ড কোনাে ছােটোভাইকে দেখছে। “আমার ভাই বলে দিয়েছেন তাকে যেন লাইফ সাপাের্টে দেওয়া না হয়।” “ওহ”আশাহত ডাক্তার শুধু এটুকুই বলল, তারপর তাকাল কম্পিউটার মনিটরের দিকে।

আসলাম তিক্তমুখে ঘুরে দাঁড়াল, যা বােঝার বুঝে গেছে সে। মাত্র পা বাড়াবে দরজার দিকে অমনি একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। আবারও ফিরল ডেস্কের দিকে।

“আচ্ছা, আমি শুনেছি এখানে ডাক্তার আসকার অ্যাডমিট…ওঁর কী অবস্থা?” তরুণ ডাক্তার বেশ অবাক হল কথাটা শুনে।“ডাক্তার আসকার অ্যাডমিট ?!”

“হুম, সেরকমই তাে শুনলান। আমার বাবার বন্ধু উনি,” মিথ্যেটা সুন্দরভাবে বলল পিএসের গানম্যান।“এখানে আসার পর শুনলাম ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে…অ্যাডমিট হয়েছেন আজই।”

ডাক্তার কী বলবে ভেবে পেল না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “উনি তো এখানে অ্যাডমিট হননি,”অবশেষে বলল সে।“আমি এরকম কিছু শুনিওনি।”

– “তাহলে কি ওঁকে ইমার্জেন্সি থেকেই রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে?”,

ঠোট ওলটাল তরুণ ডাক্তার। “নিজের হাসপাতালে এলে ইমার্জেন্সি থেকে চলে যাবেন?” মাথা দোলালাে। “মিনিমাম কয়েক দিন অবজার্ভেশনে থাকবেন না?”

আসলাম কিছুই বলল না।  মাথা দোলাতে দোলাতে তরুণ ডাক্তার কম্পিউটার মনিটরের দিকে মনােযােগ দিল আবার।নীচের ঠোট কামড়ে আছে এখনও  ডাক্তার আসকারের এমন খবর শুনে সে-ও ভিরমি খেয়েছে।

উলটো দিকে ঘুরে চুপচাপ আইসিসিইউ থেকে বের হবার জন্য পা বাড়াল আসলাম।

ডাক্তার এই হাসপাতালে নেই!

অধ্যায় ৪৬

সবিশাল একটি ড্রইংরুমে বসে আছে আশেক মাহমুদ। ঢাকা শহরে তিনটি ফ্ল্যাটের মধ্যে এই ফ্ল্যাটটায় মাঝেমধ্যেই রাত্রি যাপন করে। তার বােন যে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে আছে, সেটার ওপর তলায় থাকে সে। এছাড়া অন্য ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।

গুলশান নিকেতনের এই ফ্ল্যাটটা বলতে গেলে খালিই পড়ে থাকে, তবে বিশেষ দরকারে এখানে আসে- একাকীত্ব ঘোঁচায়! আজ রাতেও সেটা করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা উপঢৌকন চলে আসবে তার কাছে!

হাতে দামি হুইস্কির গ্লাসটায় চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে, কিন্তু তার ভাবনা বারবার চলে যাচ্ছে নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ের দিকে। প্রথম প্রথম বউ-বাচ্চাদের যখন কানাডায় পাঠিয়ে দিল, তখন প্রতিদিন বাসায় ফিরে তাদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা হত, তারাও খোঁজখবর নিত তার। ইদানীং সেটা ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে সপ্তাহে একবারে গিয়ে ঠেকেছে। এর কারণ এই নয় যে, তার ব্যস্ততা। বরং অবাক হয়েই লক্ষ করেছে, তার স্ত্রী আর সন্তানেরা ফাস্ট ওয়ার্ল্ডে গিয়ে নিজেদের নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তার সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখতেও হিমশিম খায়। তবে মাস শেষ হবার আগে এই যােগাযােগ সামান্য একটু বেড়ে যায় ওদের পক্ষ থেকে।বিশেষ করে তার স্ত্রী তখন প্রতিদিনই খোঁজ নেয়। এই নশ্বর পৃথিবীর আসল ঈশ্বর যে কী, সেটা আশেক মাহমুদ বুঝে গেছে এত দিনে।

এখন তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠজন হল আসলাম। তার সব গােপন কাজের তদারকি করে সে। হােক সেটা ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক।

সরকার থেকে গানম্যান পেলেও তাদেরকে নিয়ে সবখানে যাতায়াত করে না। করা সম্ভবও নয়, আর সেজন্যেই পিএসের চাকরিটা পাবার পর থেকেই একজন বিশ্বস্ত আর সাহসী লােকের দরকার পড়েছিল। আসলাম ছিল পুলিশের একজন এসআই, নিজের অবিশ্বস্ত বউকে পুলিশ সাের্স দিয়ে হত্যা করিয়ে ফেঁসে যায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজের কারণে। তদন্তে বেরিয়ে আসে সব কিছু। কিন্তু পুলিশে তার অতীত কর্মকাণ্ডের অবদানের পাশাপাশি, পুলিশ বাহিনীর সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া হয় উচ্চপর্যায় থেকে। তারা চায়নি, জনগণ জেনে যাক এই বাহিনীতে এমন লােকও রয়েছে যে নিজের স্ত্রীকে খুন করাতে পারে!

আসলাম স্ত্রী-হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেলেও চাকরিটা বাঁচাতে পারেনি। স্বয়ং ডিআইজি ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, তাকে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে, যদি সে নিজ থেকে চাকরিতে ইস্তফা দেয়-আসলাম সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারেনি। এক ঘনিষ্ঠ লােকের পরামর্শে তাকে গানম্যান হিসেবে নিয়ােগ দেয় আশেক মাহমুদ। আজ প্রায় চার বছর ধরে আছে সে। দিন দিন বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে।

কলিংবেলটা বেজে উঠলে বর্তমানে ফিরে এল আশেক মাহমুদ। আসলামের এই ফ্ল্যাটের বাড়তি একটা চাবি আছে, তাকে উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হবে না।

একটু পরই এক মেয়েকে নিয়ে ঢুকল গানম্যান। প্রধানমন্ত্রীর পিএসকে দেখে নিঃশব্দে সালামঠুকল মেয়েটি।

ওই ঘরে যাও  আমি আসছি,”বেডরুমের দিকে ইশারা করে মেয়েটাকে বলল। চুপচাপ শােবার ঘরে চলে গেল মিডিয়াতে একটু-আধটু
নামকরা অভিনেত্রী মেয়েটি। আসলাম দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। এরকম মুহূর্তে সে বলতে গেলে কথাই বলে না। “ওই ডাক্তারের কী খবর?”

“আমি আইসিসিইউতে গিয়ে দেখেছি, ডাক্তার ওখানে নেই। লােকটা হাসপাতালে অ্যাডমিট কিনা ওখানকার কেউ জানে না, স্যার।”

মুচকি হাসল পিএস, মদের গ্লাসে আর-একটা চুমুক দিল।“মনে হচ্ছে, তােমার কথাই ঠিক—ডাক্তার অভিনয় করেছে।”

আসলামের মুখে সামান্য হাসি দেখা দিল। লােকটা যে ধোঁকা দিয়েছে, সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ওই ডিবি অফিসার ছফা ধরতে পারেনি। সে যতই তুখােড় ইনভেস্টিগেটর হােক না কেন, এক বুড়ো ভামের অভিনয়ে পটে গেছে। ছফা যদি ডাক্তারকে তার হাতে ছেড়ে দিত তাহলে, পাঁচ মিনিটেই সব কথা তার পেট থেকে বের করে ছাড়ত সে। কীভাবে করত সেটা নিয়ে তাকে খুব একটা মাথাও ঘামাতে হত না। সরাসরি নাইন এমএমের পিস্তলটার নল ঠেকাত বুড়োর কপালে, তারপর চোখমুখ শক্ত করে যা জানতে চাইত সবই বলে দিত ওই শয়তানটা।

“ওটা ওর নিজের হাসপাতাল, সত্যি সত্যি অসুস্থ হলে হইচই পড়ে যেত। অথচ কেউ কিছু জানে না!”

মাথা নেড়ে সায় দিল গানম্যান। “কিন্তু সে এখন কোথায় আছে সেটা তাে বের করতে হবে।” “আমি কি আবারও ডাক্তারের বাড়িতে যাব? ওই দারােয়ান ব্যাটা—”

“না।”আসলাম কথা শেষ করার আগেই বলল পিএস।“কোনাে দরকার নেই। আমি এটা জেনে নিতে পারব… অন্যভাবে।”

হাফ ছেড়ে বাঁচল গানম্যান, তবে সেটা তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করল না। ডাক্তার এখন কোথায় আছে, সেটা বের করা সহজ কাজ হত না। তবে আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে, সবখানে তার লােক আছে। এসব খবর বের করা তার পক্ষে

খুব একটা কঠিন কিছু হবে না নিশ্চয়।  “তুমি বাসায় যাও  বিশ্রাম নাও।” কথাটা বলেই হুইস্কির গ্লাসটা ঠোটের কাছে রেখে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল পিএস।

“জি, স্যার।” ঘর থেকে চলে গেল আসলাম। কাল সকালে তাকে আবারও আসতে হবে এখানে। যেটাকে নিয়ে এসেছে সেটাকে আবার পৌছে দিয়ে আসবে।

বাইরের দরজাটা বন্ধ হবার শব্দ কানে গেলে পকেট থেকে কোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করল আশেক মাহমুদ। একবার রিং হবার পরই তার কলটা রিসিভ করা হল। এরকম লােকজন তার কল পেলে ধন্য হয়ে যায়। সরকারদলীয় ডাক্তারদের যে অঙ্গসংগঠনটি আছে সেটার মধ্যমগোছের নেতা সে।  “ওয়ালাইকুম আসালাম। কেমন আছাে, ডাক্তার?” প্রধানমন্ত্রীর পিএস হাসিমুখে বলল।

ওপাশ থেকে গদগদ ভঙ্গিতে কথা বলে গেল সেই ডাক্তার। পিএসের ফোন পেয়ে যে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে, সেটা প্রকাশ করতে মােটেও কুণ্ঠিত হল না।কিছুক্ষণ এ-কথা ও-কথা বলার পর আসল কথায় চলে এল আশেক মাহমুদ।

“আসকার ইবনে সায়িদ তােমাদের হাসপাতালের একজন  না?” “জি, ভাই। বলতে গেলে উনিই মালিক। লায়ন শেয়ার তাে ওঁরই।” “হুম। ভদ্রলােক কী এখন তােমাদের হাসপাতালে অ্যাডমিট?”

“নাহ তাে!” বিস্ময় ঝরে পড়ল ওপাশ থেকে। “এরকম কোনাে কথা শুনিনি, ভাই। কে বলল আপনাকে?”

“শুনলাম আর কি।”একটু থেমে আবার বলল, “তুমি একটু খোঁজ নিয়ে কাল সকালে আমাকে জানাও। ব্যাপারটা জরুরি, বুঝতে পেরেছ?”

“জি, ভাই। কাল সকালে আমি খোঁজ নিয়েই আপনাকে জানাচ্ছি।” “ওকে।”

কলটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়াল পিএস। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল শােবার ঘরের দিকে। খােলা দরজার কাছে আসতেই টের পেল কড়া পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে।

এসব মেয়েরা কেন যে সব সময় কড়া মেকআপ আর এরকম সেন্ট ব্যবহার করে সে জানেনা।

অধ্যায় ৪৭

সকালে নাস্তা করেই কেএস খান একটি বই নিয়ে বসেছে—খুবই মনােযােগ দিয়ে পড়ছে সেটা। নাকের ওপরে থাকা রিডিংগ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখছে অক্ষরগুলাে। গতকাল থেকে পড়তে শুরু করার পর আর বিরতি দেয়নি। এমুহূর্তে, দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হবে গবেষণার কাজে মগ্ন একজন অধ্যাপক।

খােদাদাদ শাহবাজ খান সব সময় নিজের বিছানায় শুয়ে-বসে বই পড়ে। ঘরে একটা টেবিল আছে কিন্তু ওটাতে বসে পড়ার অভ্যেস তার নেই।বিছানায় শুয়ে দু পাশ করে পড়তেই বেশি ভালাে লাগে। অবশ্য পাশে গরম চা থাকলে তার এই পাঠ আরও বেশি সুখকর হয়ে ওঠে। অল্পবয়সি আইনস্টাইন সেটা জেনে গেছে এতদিনে, সাবেক ইনভেস্টিগেটরকে বই পড়তে দেখলেই এক কাপ চা বানিয়ে বেডসাইড টেবিলে রেখে যায় সে।

বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বেডসাইড টেবিলে হাত বাড়াল কেএস খান, কিন্তু সেখানে কোনাে কাপ-পিরিচের নাগাল পেলনা। এ পড়া থেকে বিরতি দিয়ে তাকাল পাশের ঘরের দরজার দিকে। আধখােলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন মেঝেতে বসে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে মটু, পাতলু নামের স্থূল এক কার্টুন দেখছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল তার ঠোটে। ছেলেটা যতই পাকনামি করুক, তার শৈশব এখনও অটুট আছে।

খােদাদাদ শাহবাজ খান আবারও নজর দিল বইয়ের পৃষ্ঠায়। এখন যে বইটা পড়ছে সেটা পল্টনের ফুটপাত থেকে কয়েক দিন আগে কিনেছে মাত্র আশি টাকা দিয়ে। দোকানির বইয়ের স্তুপে অবহেলায় পড়েছিল। গ্রাহাম হ্যানককের বেস্টসেলার নন-ফিকশন ম্যাজিশিয়ান্স অব দি গডস যে পল্টনের ফুটপাতে গড়াগড়ি খাবে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি। বইয়ের কাভারটা ছেড়াফাড়া হলেও ভেতরের পাতাগুলাে সব অক্ষত ছিল। দোকানদার সম্ভবত কাভারের করুণ দশার জন্য বেশি দাম হাঁকেনি তার কাছে।

এই লেখকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট অব গড আগেই পড়া ছিল তার। ম্যাজিশিয়ান্স পড়ে আরও মুগ্ধ হচ্ছে। তুরস্কের গােবেক্লি তেপে নামক একটি জায়গায় প্রায় ১২০০০ বছরের প্রাচীন পূরাকীর্তি পাওয়া গেছে, আর সেটা নাকি তৈরি করেছিল মহাপ্লাবন সংঘটিত হবার পর বেঁচে যাওয়া উন্নত প্রজাতির কিছু মানুষ! লেখক বলার চেষ্টা করছেন, এরা সেই আটলান্টিসের অধিবাসী যাদের উন্নত মহাদেশটি তলিয়ে গেছিল জলরাশির তলে।

এমন সময় কেএস খানের ফোনটা বেজে উঠলে বিরক্তি ভর করল চোখেমুখে। পড়ার সময় দু-জন মানুষের ফোন তাকে বিরক্ত করে না। একজনের ফোন পেলে বরং খুশিই হয়, আর অন্যজনের ফোন নিয়মিত ব্যাপার, অনেকটা তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল এদের কেউ না, ফোনটা দিয়েছে ডিবির ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা। সঙ্গে সঙ্গে চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠল তার।

“আরে, ছফা যে….কী খবর আপনের?” হাসিমুখে বলল খােদাদাদ শাহবাজ খান। “স্যার, খবর ভালাে। আপনি কেমন আছেন?” “আছি ভালাই….আপনের খবর বলেন, সুন্দরপুরেই আছেন নাকি ঢাকায়?”

সুন্দরপুর থেকে ফিরে এসে কেএস খানের সঙ্গে দেখা করেনি ছফা, এমনকি ফোনও দেয়নি। সােজা চলে গেছিল। অ্যাডভােকেট ময়েজ উদ্দিনকে ধরার জন্য। “আমি কালকে এসেছি, স্যার।”

“ওইখানকার খবর কী?কিছু পাইলেন?”আগ্রহী হয়ে উঠল সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

“জি, স্যার….দারুণ খবর আছে, সেজন্যেই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনি কি ফ্রি আছেন?”

“বলেন, আমি বাসায়ই আছি  কোনাে ক্লাস নাই আজ।”

এরপর টেলিফোনেই ছফা সংক্ষেপে জানাল মাস্টার রমাকান্ত কামারের ঘর থেকে মুশকান জুবেরির চিরকুট পাবার কথা, সেখান থেকে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিনকে ধরা, তার স্বীকারােক্তি মােতাবেক ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাসায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা, আর ডাক্তারের পাসপাের্টের কথাটা। কিন্তু বৃদ্ধ ডাক্তার অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে যে নতুন কাহিনিটা তাকে বলেছে সেটা একেবারে চেপে গেল। তার ধারণা, ওই কাহিনি শােনার পর কেএস খান মাথা ঘামাতে শুরু করে দেবে। ছফার আশঙ্কা, সম্ভবত কাহিনিটায় বিশ্বাসও করে বসবে তার সিনিয়র। সব সময় যৌক্তিক বিষয়েই তার পক্ষপাতিত্ব থাকে বেশি। আর ডাক্তারের নতুন গল্পটি যে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভদ্রলােকের কথা বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই। লােকটা ধূর্ত। তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য, ওই মহিলাকে রক্ষা করার জন্য সম্ভবত নতুন একটি গল্পের অবতারণা করেছেন।

“আপনের মতাে আমার মনে হইতাছে, ওই ডাক্তারই মুশকান জুবেরিরে কলকাতায় নিয়া গেছে,”সব শােনার পর বলল মি.খান।

“জি, স্যার। ভদ্রলােক এটা লুকানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি নিশ্চিত, তিন বছর আগে ডাক্তার যখন আমেরিকায় চলে যাওয়ার কথা বলে দেশ ছাড়লেন, তখনই মুশকান জুবেরিকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেছিলেন।”

“হুম,”গম্ভীর কণ্ঠে বলল কেএস খান। “এত জায়গা থাকতে কলকতায় কেন সেইটা বুঝবার পারতাছি। বাড়ির একেবারে পাশে….পাসপাের্ট ছাড়াও বর্ডার দিয়া বর্ডার দিয়া যাওন যায়।

“জি, স্যার। ইন্ডিয়ান বর্ডার কিন্তু সুন্দরপুর থেকে বেশি দূরেও নয়….ঘন্টা পথ সম্ভবত।”

মাথা নেড়ে সায় দিল সাবেক ডিবি অফিসার। “তাছাড়া কলকাতায় ডাক্তারের পরিচিত মানুষজনও থাকতে পারে।”

“হুম….তা হইতে পারে। নামকরা ডাক্তার, দেশ-বিদেশে ঘুইরা বেড়ায়, বিরাট হাসপাতালের ওঁর…. রিসাের্সফুল তাে হইবই।”

“ডাক্তারের পাসপাের্ট বলছে, তিনি অনেক বছর আগে থেকেই ফ্রিকোয়েন্টলি কলকাতায় যাতায়াত করছেন।”

“এইটা একটা ভালা পয়েন্ট,” কৌতূহলী হয়ে বলল কেএস খান। “তার মাইনে, ওইখানে ডাক্তারের রিসাের্স আছে, জানাশােনা লােকজন আছে।”

“জি, স্যার। কিন্তু ওঁর পেট থেকে সব কথা বের করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এখন আছেন আইসিসিউ-তে… মনে হয় না সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার নাগাল পাব।”

“আমার তো মনে হয় ভদ্রলােক দেশ ছাড়ব। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চইলা গেলে তারে কেমনে আটকাইবেন?  “ওঁর পক্ষে সেটা করা সম্ভব হবে না স্যার। পিএস আশেক মাহমুদ এই বিষয়টা
দেখবেন, ইমিগ্রেশনে বলে দিয়েছেন তিনি।”

“ও,”মি.খান আর কিছু বলল না। সব ধরণের ক্ষমতার অপব্যবহার তার ভীষণ অপছন্দ, সেটা যদি তদন্তের কাজে সাহায্য করে তারপরও।

“আমার তাে ইচ্ছে, আজকের দুপুরের ফ্লাইটেই কলকাতায় চলে যাওয়া, কিন্তু অত বড়ো শহরে কী করে মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করব বুঝতে পারছি না, স্যার।”

“হুম।”গম্ভীর হয়ে বলল ছফার সিনিয়র। চিন্তিত মুখে ঘরের সবচাইতে দূরের দেয়ালের দিকে তাকাল। আইনস্টাইনের জিভ বের করে রাখা সাদাকালাে ছবিটার দিকে তাকালেই একটা কথা মনে পড়ে যায় তার : জটিল চিন্তা বােকার হদ্দরা করে! বুদ্ধিমানেরা করে সহজ চিন্তা!

কিন্তু সহজ চিন্তা যায় না করা সহজে।

তারপরই বলার মতাে কিছু একটা পেয়ে গেছে এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। “শুনেন….মনে হইতাছে মুশকান জুবেরিরে ট্রেস করার সহজ রাস্তা একটাই আছে।”

“সেটা কী, স্যার?” ফোনের ওপাশে থাকা নুরে ছফা খুবই আগ্রহী হয়ে উঠল।

গভীর করে দম নিয়ে নিল সবেক ইসভেস্টিগেটর। “মানুষ সব কিছু পালটাইতে পারে, সিটিজেনশিপ, ধর্ম, এমনকি চেহারাও বদলাইতে পারে, কিন্তু অভ্যাস  এ
ইটা বদলানাে এত সহজ না। মনে রাখবেন, অভ্যাসের চায়া বদঅভ্যাস হইল আরও কঠিন জিনিস।” একটু থেমে আবার বলল, “আপনে মহিলার বদঅভ্যাসটা ফলাে করেন।”

অধ্যায় ৪৮

সকাল দশটায় পিএসের সেই ফ্ল্যাটে আবারও ফিরে এসেছে আসলাম, যেখানে গত রাতে এক মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। একটু আগে আশেক মাহমুদ তাকে ফোন করে জানিয়েছে, মেয়েটাকে ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যাবার জন্য।

পিএস আরও সকালে উঠে পিএমের অফিসে চলে গেছে। সারা রাত যতই মদ্য পান করুক, মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করুক, সকাল সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে, তারপর দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ে কর্মক্ষেত্রে যাবার জন্য।

আশেক মাহমুদের এই ফ্ল্যাটের বাড়তি একটি চাবি আছে তার কাছে। পিএস ফ্ল্যাট থেকে বের হবার সময় বাইরে থেকে দরজা লক করে গেছে। আসলাম এসে দরজা খুলে মেয়েটাকে পৌছে দিয়ে আসবে তার বাসায়—এমনটাই সব সময় হয়ে আসছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আসলাম ভাবল, সে যদি ফ্ল্যাটে যাবার পথে অ্যাকসিডেন্টের শিকার হয়, কিংবা খারাপ কিছু হয়ে যায় তার, তাহলে কী হবে? মেয়েটা নির্ঘাত আটকা পড়ে যাবে। পিএসের ফোন নম্বর এসব মেয়ের কাছে থাকে না, আর নিরাপত্তার কারণে মেয়েটাকেও সঙ্গে করে মােবাইলফোন আনতে দেওয়া হয় না। ফলে তাকে কোনােভাবেই জানাতে পারবে না যে, ফ্ল্যাটে আটকা পড়ে গেছে সে। বাধ্য হয়ে তখন চিৎকার চঁচামেচি করে লােকজনকে ডাকবে সাহায্যের জন্য, আর সেটা হবে আশেক মাহমুদের জন্য বিরাট কেলেংকারির ব্যাপার।  মুচকি হাসল সে। আসলে এরকম কিছু হবে না। তার যদি কিছু হয়, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যেই পিএস সেটা জেনে যাবে। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারবে, তার ফ্ল্যাটের মেয়েটা নিশ্চয় আটকা পড়েছে। তখন অন্য কাউকে দিয়ে মেয়েটাকে জায়গা মতাে পৌছে দেওয়া হবে। এরকম লােকজনের কোনাে অভাব নেই আশেক মাহমুদের।

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে পিএসের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে ডাের লকের ভেতরে চাবি ঢােকাতেই এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেল তার মধ্যে। আস্তে করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

পুরাে ফ্ল্যাটটা সুনশান—তার মানে মেয়েটা এখনও ঘুমােচ্ছে। এরকমটিই হয় সব সময়। এরা বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে।

শােবার ঘরের সামনে এসে দেখতে পেল দরজাটা খােলাই আছে, বিছানায় পড়ে আছে প্রায় নগ্ন সেই মেয়েটি।

ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে ভালাে করে দেখল আসলাম। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘুমােচ্ছে।

তাকে দেখে চেনাই যাচ্ছেনা।মুখের কড়া মেকআপের কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। মাহমুদের লালসায় ধুয়েমুছেতার আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে, আর সেটা মােটেও আকর্ষণীয় নয়। তবে তার দেহসৌষ্ঠব কামনা জাগানাের জন্য যথেষ্ট।

পাশ ফিরে শুয়ে আছে মেয়েটি। টিভিতে টুকটাক অভিনয় করে। একটি টেলিকম অ্যাডেও দেখা গেছেকিছুদিন আগে। ওই টেলিকমই কর ফাঁকির এক তদন্তে ফেঁসে গিয়ে পিএসের দ্বারস্থ হয়েছিল। আশেক মাহমুদ সেটা মিটমাট করে দেবার ব্যবস্থা করে দিলে বিনিময়ে যেমন বেশ মােটা অঙ্কের টাকা ঢুকেছে তার অ্যাকাউন্টে, তেমনি উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হয়েছে একে!

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটাকে দেখে গেল সে। ধীরে ধীরে নিজের ঘুমন্ত কামনা মাথাচাড়া দিতে শুরু করল। এর আগেও এরকম কাজ করেছে আসলাম। পিএসের পরে সে-ও একটু পরখ করে দেখেছে। ভালাে করেই জানে, এ ধরণের মেয়েগুলাে চুপচাপ এসব ব্যাপার হজম করে নেয়। কেউ কেউ খুশি হয়েও নিজেকে সমর্পণ করে, কখনও কারাের ওপরে জোর খাটাতে হয়নি তাকে। কিন্তু এখন তার খুব জোর খাটাতে ইচ্ছে করছে! ইচ্ছে করছে অন্যভাবে কামনা মেটাতে। দিনকে দিন স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার থেকে তার আগ্রহ উবে যাচ্ছে! ধর্ষকামীতার পাশাপাশি ধর্ষক সত্তাটাও যেন জন্ম নিচ্ছে ক্রমশ।

এই মেয়েটাকে ধর্ষণ করলে কী হবে? বিচার দেবে? কার কাছে?

মুচকি হাসি ফুটে উঠল তার লম্পট ঠোটে। এ সমাজে বেশ্যাদের ধর্ষণ করা জায়েজ। যারা টাকার বিনিময়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে শােয়, তাদের সঙ্গে জোর খাটালে কী আর এমন হবে!পিএসের কাছেও নালিশ দেবেনা।এর আগে টাকার বিনিময়ে পুরুষমানুষের সঙ্গে শুতে যেয়ে কত বার ধর্ষিতা হয়েছে কে জানে!

আসলাম জানে, প্রতিটি পুরুষের মধ্যেই একজন ধর্ষক বাস করে— দরবেশ থেকে প্রতিবন্ধী—সব পুরুষই জোর করে পেতে আনন্দ পায়। সম্ভবত পৌরুষের অংশ এটা। আদিমকাল থেকেই চলে আসছে! নারীকে জোর করে ভােগ করাটা বীরত্বই ছিল তখন। জৈবিক তাড়না থেকে যে সঙ্গম হয় সেখানে এরকম ব্যাপার-স্যাপার হতেই পারে!  তার খুব ইচ্ছে করছে ঘুমন্ত মেয়েটার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে। টের পাচ্ছে, তার শরীর রীতিমতাে কাঁপছে ধর্ষণ করার প্রবল বাসনায় ! নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। একটু উপুড় হয়ে যেই না মেয়েটার ওপরে হামলে পড়বে অমনি তার ফোনটা বেজে উঠল।

মাথায় খুন চেপে গেল আসলামের। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগই পেল সে। কিন্তু যেই না দেখল কলটা করেছে পিএস, হকচকিয়ে গেল। এরকম সময় আশেক মাহমুদ সচরাচর তাকে ফোন দেয় না।

কলটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে টের পেল, ভেতরের সমস্ত উত্তেজনা দপ করে নিতে গেছে। নেতিয়ে পড়েছে তার ধর্ষকামী ছােট্ট পশুটি!

অধ্যায় ৪৯

কলকাতা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে দমদম নামক স্থানে যে বিমানবন্দরটি অবস্থিত, সেটার অফিশিয়াল নাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর,কিন্তু লােকমুখে দমদমই বেশি উচ্চারিত হয়।

এই বিমানবন্দর দিয়ে কলকাতায় প্রবেশের অভিজ্ঞতা ছফার জন্য নতুন নয়, তবে বিগত দু-বছরে এই প্রথম পদার্পণ করল সে। ছাত্রজীবনে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অবশ্য দুয়েকবার সড়কপথে যশাের-বেনাপােল সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যাবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে চাকরি জীবনে ঢােকার পর যতবারই গেছে কাজের প্রয়ােজনেই গেছে। দু-বছর আগে, একমহিলা আর তার পাঁচ বছরের শিশুকন্যার রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হবার যে কেসটা তদন্ত করেছিল, সেটার এক পর্যায়ে তাকে কলকাতায় যেতে হয়। ওই সময়ই প্রথমবারের মতাে কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার, আর তখন বেশ কিছু পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেই সব অফিসাররা ছফার মতােই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। তাদের কারও কারও সঙ্গে বিদেশের মাটিতে ইন্টারপােলের সম্মেলনে দুয়েকবার দেখাও হয়েছে, তবে নিয়মিত যােগাযােগ মাত্র একজনের সঙ্গেই হয়—ছফার গন্তব্য এখন সেই মানুষটির অফিস।

কোনাে এক অদ্ভুত কারণে, প্রিয় মানুষজনের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখতে পারে না সে। এক ধরণের অনীহা জেঁকে ধরে তাকে। এমন না যে, ওইসব মানুষের সঙ্গ কিংবা আলাপচারিতা তার ভালাে লাগে না। সম্ভবত দীর্ঘকাল একা একা থাকার কুফল এটি।

রিগ্যাল এয়ার ওয়েজের বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করতেই নুরে ছফার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হল। তার মন বলছে এখানেই আছে মুশকান জুবেরি। যুক্তিবুদ্ধিও তাতে পুরােপুরি সায় দিচ্ছে। ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সে কখনও এমনও দেখেছে, যুক্তি নয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে পরিচালিত করে নিয়ে গেছে সত্যের কাছাকাছি। কিন্তু এবার তার যুক্তি-বুদ্ধি আর সজ্ঞা একই কথা বলছে!

কলকাতায় আসার আগেই ওখানকার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সহকারি নগরপাল সুশােভন মিত্রের সঙ্গে সে যােগাযােগ করেছে। বয়সে তার থেকে কয়েক বছরের বড়ো হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে দারুণ বন্ধুত্ব। সুশােভনকে এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে ওয়াকিবহাল করেছে সে। তবে কাজটা কীভাবে করবে সে নিয়ে কিছু বলেনি।

অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, সব কথা আর অনুরােধ টেলিফোনে সেরে ফেলাটা বোকামি, ঢাকা থেকে কলকাতায় উড়ে এসে কোনাে অনুরােধ করলে সেটা রক্ষা করার  অনেক বেশি অনুভব করবে। সেজন্যে ছফা  জানিয়েছে, তার কাছে
নিশ্চিত তথ্য আছে, বাংলাদেশ থেকে এক সাসপেক্ট কলকাতায় আত্মগোপন করে আছে, তাকে নিয়ে ট্র্যাক ডাউন করতে চাইছে সে।এ কথা শুনে সুশোভন তাকে আশ্বাস দিয়েছে যথাসম্ভব সাহায্য করার জন্য।

ছফাও জানে তার কাছ থেকে ভালােরকম সাহায্য পাওয়া যাবে, কিন্তু সমস্যা হলো এই সাহায্যের আবেদনটি ইন্টারপােলের মাধ্যমে করা হয়নি, কিংবা দু-দেশের পুলিশ বিভাগের মধ্যেকার কোনাে অনুরােধের ভিত্তিতেও নয়—এটা হচ্ছে একান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে। এর কারণও রয়েছে-মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ আনা যায়নি যে, ইন্টারপােলে মহিলাকে ফেরারি আসামি হিসেবে তালিকাভুক্ত করানো যাবে। তাছাড়া, মুশকানের সত্যিকারের কাহিনিটাও কারও কাছে বলেনি ছফা। তাই অন্য অনেকের মতাে সুশােভন মিত্রের কাছেও গােপন রেখেছে। আমি কি তাকে উদ্ভট গল্পটা বলব? কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ এটা বিশ্বাস করবে?  নিজেকে অনেকবার এ প্রশ্ন করেছে। কেউ যদি মুশকানের এই গল্পটা বিশ্বাসও করে, তাতেও ঝুঁকি আছে। যে কারণে খােদাদাদ শাহবাজ খান ছাড়া আর কাউকেই বলেনি, মানুষের শরীরের বিশেষ একটি প্রত্যঙ্গ খেয়ে মুশকান জুবেরি নিজেকে চিরযৌবনা করে রেখেছে। গল্পটা যে বিশ্বাস করবে সে হয়তাে হন্যে হয়ে জানতে চাইবে। ঠিক কোন প্রত্যঙ্গটি খেলে এমন আরাধ্য লাভ করা যায় আর এটা করার একটাই উপায় আছে—মুশকান জুবেরিকে নিজের কব্জায় নিয়ে, নির্যাতন করে তার কাছ থেকে তথ্যটা জেনে নেওয়া। সিক্রেটটার আর্থিক মূল্য হতে পারে কয়েক কোটি টাকা। আর এজন্যে যে-কোনাে কিছু করতেও পিছপা হবে না এ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ।

বিমানবন্দর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছফা চলে গেল লালবাজারে অবস্থিত কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সদর দপ্তরে। সুশােভন মিত্র বর্তমানে সেখানেই কর্মরত আছে। লালবাজারের লাল ইটের বিশাল আর মনােরম ভবনের সামনে যখন ছফার ট্যাক্সিটা থামল তখন বিকেল প্রায় চারটা।

মেইন গেটের সিকিউরিটিকে আগেই বলে দিয়েছিল সুশােভন, তাই পরিচয় দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলে দেওয়া হল কত তলার কত নম্বর রুমে যেতে হবে।

“আরে ছফা, তুমি দেখি একই রকম আছ,” তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়াল সুশােভনমিত্র।“একটুও বদলাওনি! ঘটনা কী?”সহাস্যে বলল কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সহকারি নগরপাল।

অমায়িক হাসি দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল নুরে ছফা। “তুমিও তাে খুব একটা বদলাওনি, দাদা আগের চেয়ে একটু স্লিমও হয়ে গেছ।”

করে প্রাণখােলা হাসি দিল সুশােভন। তার কারণ ডায়েট নয….কাজের ভীষণ চাপ। সেই সঙ্গে তােমার বৌদির দারােগাগিরি।”

হেসে ফেলল ছফা।

কালাে ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসার ইশারা করে নিজেও বসে পড়ল।“এক বছর ধরে আমাকে ভেজ থাকতে বাধ্য করছে সে।”

দিদি কিন্তু ঠিকই করছে,”বলল ছফা।“এখন বলাে, আছ কেমন?”, বলল সুশােভন মিত্র।“চলে যাচ্ছে। তােমার কী খবর? ক-টা প্রমােশন বাগালে?” ‘মাত্র দুটো, তবে কাজের অনেক চাপ বেড়ে গেছে।”

“চাপে না পড়লে কী ঢাকা থেকে উড়ে আসতে কলকাতায়,”হেসে বলল নগরপাল। “কতদিন থাকছ এখানে?”

“সত্যি বলতে, কাজটা করতে কতদিন লাগবে সে-ব্যাপারে আমার কোনাে ধারণাই নেই। বুঝতে পারছি না কত দিন থাকতে হবে।”

“সাসপেক্ট ট্র্যাক-ডাউন করাটা খুবই কঠিন কাজ,” সুন্দর করে ছাটা পুরু গোঁফের বামপ্রান্ত মােচড়াতে মােচড়াতে বলল সুশােভন মিত্র। এই গোঁফ নিয়ে তার বাতিকের কথা ছফা জানে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সাক্ষাতের সময় থেকেই। ফ্রান্সের লিঁওঁ-তে ইন্টারপােলের সদর দফতরে এক সেমিনারে দেখা হয়েছিল, তারা উঠেছিল একই হােটেলে। রাতে ছফার রুমে এসে বেশ গল্প করত নগরপাল।

“এক হপ্তায় তােমার কাজ হয়ে যাবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

“না হলে আর কি, তােমাকে আর-একটু জ্বালাতে হবে,”হেসে বলল। “তবে কাজটা দ্রুত করার তাড়া আছে।”

“ইনভেস্টিগেশনের টাইমফ্রেম দেওয়া আছে নাকি?” “হুম।” “তাহলে কঠিন হয়ে যাবে তােমার জন্য।”

“তা বলতে পারাে।” পকেট থেকে মুশকান জুবেরির একটা ছবি বের করে দেখাল সে। “সাসপেক্টের ছবি।”

ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুশােভন।“এটা কবেকার ?”। ভিরমি খেল ছফা। ছবিটা যে বেশ পুরােনাে সেটা যে-কোনাে অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলে,একারণে ডিবির ফটো রিকন্সট্রাকশন করে যে ছেলেটা তাকে দিয়ে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড কাট-আউট করে নিয়েছে, যাতে করে পেছনের পার্কে থাকা অন্যসব মানুষজনের সত্তর দশকের বেলবটম প্যান্ট পরা কাউকে দেখে সময়টা ধরতে না পারে। তারপরও সুশােভনের অভিজ্ঞ পুলিশি চোখ ধরে ফেলেছে, এটা বেশ পুরােনাে ছবি। ছফা যদি বলে এটা ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে তােলা তাহলে মুশকানের বয়স এখন সত্তরেরও বেশি ! এই মলের একজন সাসপেক্ট বেশ কিছু তরতাজা যুবকের অন্তর্ধানের সঙ্গে জড়িত, এমন কথা কোনাে মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর সেই মানুষটা যদি পুলিশ হয় , তাে কথাই নেই।  “কত পুরােনাে জানি না, মনে হয় নব্বইয়ের দিকে হবে,”অবশেষে মিথ্যেটাই বলল ছফা।

সুশােভনের কপালের ভাঁজ আরও ঘন হল। “নব্বই!? বলাে কী! দেখে তাে মনে হচ্ছে আরও পুরােনাে,”ছবির দিক থেকে মুখ না তুলেই বলল।“হেয়ারস্টাইলটা একেবারে মিড-সেভেন্টির মতাে।”

মনে মনে প্রমাদ গুনল ছফা। “আচ্ছা, তুমি কী সাসপেক্ট করছ?”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা বুঝতে পারলনা কী বলবে।“কী সাসপেক্ট করছি?” প্রশ্নটাই আওড়ালাে আবার।“এই মহিলা হিউম্যান অর্গান পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করছি।”

“তুমি বলেছিলে সে একজন মেডিকেল ডক্টর?”

“হুম, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিল, ওখানেই পড়াশােনা করেছে। তারপর বেশ কবছর আগে বাংলাদেশে চলে আসে।তবে আমার মনে হয়, এখানে আসার পর ওই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মহিলা।”

মাথা নেড়ে সায় দিল সুশােভন। “মহিলা দেখতে কিন্তু সেই রকম মাইরি।” কথাটা বলেই হেসে ফেলল সে।“সি হ্যাড দ্য গ্ল্যামার ইন হার আর্লি এইজ।”

এখনও তা-ই আছে, মনে মনে বলল সে। সত্যিটা তুমি যদি জানতে! “তুমি শিয়োর, মহিলা একাই অপারেট করে?” একটু গাল চুলকালাে ডিবির নুরে ছফা।“সম্ভবত….তবে নিশ্চিত নই।”

“আমার তাে মনে হয় না সে একা একা অপারেট করে,”ছবিটা ডেস্কের ওপর রেখে বলল সুশােভন।“অর্গান স্মাগলারদের চক্রটা বেশ বড় হয়ে থাকে। অনেকগুলাে ধাপ থাকে, প্রতিটি ধাপেই থাকে একাধিক লােক। আমাদের এখানেও এরকম কিছুচক্র রয়েছে। ওদের সঙ্গে এই মহিলার কোনাে যােগসাজশ নেই তাে?”

কাঁধ তুলল ছফা। “এটা তাে জানি না। তবে আমার ধারণা এই মহিলা ওভাবে কাজ করে না, সে একা একাই কাজ করে। কালেক্ট করার পর হয়তাে তার পরিচিত স্মাগলারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেজন্যে তার সম্পর্কে তথ্য আদায় করা সহজ হয়নি, শক্ত কোনাে প্রমাণও জোগাড় করতে পারিনি।”

“এরকম একজন বয়স্ক মহিলা কী করে এটা করে? এ ছবিটি যদিনব্বইর দিকের হয়ে থাকে তাহলে তাে এখন তার বয়স কম হবে না।” অবাকই হল কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল।

“মহিলা একজন মেডিকেল ডক্টর,” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলল ছফা। তার কাজের ধরনটাও বেশ আলাদা। সে প্রতিটি ভিক্টিমের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক করে তাদেরকে নিজের ডেরায় নিয়ে কাবু করে ফেলে।”কথাটা বলার পর নিজের কাবু হওয়ার ঘটনাটির কথা মনে পড়ে গেল তার। মুশকান ঘরে ঢোকার পর কি বােকার মতােই না সে নাকাল হয়েছিল।

মাথা দোলাল সুশােভন মিত্র। “তুমি শিয়োর, মহিলা এখন কলকাতাতে?” “হুম। যতটুকু জানি, সে পালিয়ে এখানেই চলে এসেছে।”

“আচ্ছা,”মাথা নেড়ে সায় দিল কলকাতা পুলিশ ফোর্সের ‘নগরপাল। তাহলে কিভাবে কাজটা শুরু করতে চাইছ তুমি ?

“বিগত তিন বছরে কলকাতা মহানগরীতে যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, তাদের তালিকাটা আমার দরকার….ইন ডিটেল।”

“শুধু কলকাতার ?” অবাক হয়ে জানতে চাইল সুশোভন।

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর নামক প্রত্যন্ত এক মফস্বলে বসে শিকার করলেও তার সব শিকার এসেছিল ঢাকা শহর থেকে। অন্তত ছফার জানা যে কয়জন শিকার আছে, তাদের বেলায় এ কথা খাটে। সুতরাং মহিলা কলকাতায় থাকলেও এখান থেকেই শিকার খুঁজে বের করবে। শহুরে শিকার।

‘সাসপেক্ট পুরাে রাজ্যে অপারেট করছে না, কী করে শিয়োর হলে?”

একটু ভাবল ছফা।“প্রথমে আমি শুধু কলকাতা মহানগরীর তালিকাটাই খতিয়ে দেখব, যদি ওখান থেকে কিছু না পাই তাহলে পুরাে পশ্চিমবঙ্গের তালিকা দেখতে হবে।”

চোখ কপালে তুলল সুশােভন। “গােটা রাজ্যে প্রচুর মানুষ নিখোঁজ হয় প্রতি বছর। সংখ্যাটা অনেক হবে কিন্তু।”

‘তা জানি, তবে শুধুমাত্র ২০ থেকে ৩৫ বছরের পুরুষ মানুষই খুঁজব….আর অবশ্যই মার্জিত এবং শিক্ষিত।”  অবাক হল সুশােভন।“মার্জিত আর শিক্ষিত? বাপরে! অর্গ্যান সিলেক্ট করার বেলায় মহিলা এসবও দেখে নাকি!”  ছফা একটু হাসার চেষ্টা করল। “তা জানি না, তবে এখন পর্যন্ত সে এভাবেই টার্গেট সিলেক্ট করেছে। এটা তার প্যাটার্ন বলতে পারাে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল নগরপাল। তারপরও সংখ্যাটা নেহাত কম হবে না মনে হচ্ছে।”

“সবার ডেটা তাে থাকে তােমাদের কাছে, তাই না?”

“তা থাকে। রাজ্যের সবগুলাে পুলিশস্টেশন থেকে সব ধরণের ক্রাইমের ডেটাই সংরক্ষণ করা হয়। বিশাল ডেটা-বেইজ। তবে মার্ডার, হাইজ্যাক, ছিচকে চুরি থেকে শুরু করে নিখোঁজদের তালিকাগুলাে ক্যাটাগরাইজড করা আছে।”

ছফা হাফ ছেড়ে বাঁচল। তাদের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ এখনও পুরােপুরি ডিজিটাল হতে পারেনি। যেটুকু তথ্য সংরক্ষণ করা হয় তা বেশ অপ্রতুল। ওসব তথ্য থেকে অনেক  সময়ই সাহায্য পাওয়া যায়
না।

“ডেটা বেইজ থেকে তথ্যগুলাে পেতে কি কোনাে সমস্যা হবে?” এর প্রসঙ্গে চলে এল সে।

“উমমম….”একটু ভেবে নিল সুশােভন।“অফিশিয়াল রিকোয়েস্ট ছাড়া ডেটা অন্য কারাের সঙ্গে শেয়ার করি না আমরা। তবে, আমি চাইলে তােমাকে সেটা পারব। আমার অ্যাকসেস আছে ওটাতে। মাঝেমধ্যে এরকম রিকোয়েস্ট অব নন-গভমেন্ট অর্গানাইজেশন থেকেও পেয়ে থাকি।বিভিন্ন ধরণের অপরাধের স্টেটিস্টিক্স চায় তারা।প্রেসও চায়।তারপরও বলব, তুমি যদি তােমাদের ওখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিকোয়েস্ট করাে তাহলেই বরং বেটার হয়। নইলে সাসপেক্টকে লােকেট করার পর অ্যারেস্ট করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ তাে?”  মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “আমিও সেটা বুঝি। কাল-পরশুর মধ্যেই ওখান থেকে একটা রিকোয়েস্ট করা হবে। তবে আমি চাইছি তার আগেই সাসপেক্ট লােকেট করার কাজটা শুরু করে দিতে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল সুশােভন। “আচ্ছা, তুমি ইন্টারপােলের হেল্প নিচ্ছ না কেন?”

“অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। খুব দ্রুত মহিলাকে ট্র্যাক করতে না পারলে সে হয়তাে এখান থেকেও সটকে পড়বে, তাই আমি সময় নষ্ট করতে চাইছি না। তােমার কাছ থেকে একটু হেল্প পেলেই আশা করি কাজটা শুরু করতে পারব।”

“ওকে কালকেই পেয়ে যাচ্ছ ওটা।” “থ্যাঙ্কস দাদা।”

“এখন বলাে, উঠবে কোথায়? তুমি তাে সঙ্গে করে ছােট্ট একটা হ্যান্ডলাগেজ ছাড়া আর কিছুই আনোনি দেখছি।”

ছফা কখনও ভ্রমণের সময় বড়ােসড়ো লাগেজ বয়ে বেড়ায় না। ব্রিফকেস আকারের ছােট্ট একটা হ্যান্ডলাগেজই তার সম্বল। প্রয়ােজনীয় জামা-কাপড় আর দরকারি জিনিসপত্র ছাড়া বাড়তি কিছুই সঙ্গে নেয়নি।

“কোথায় উঠলে সুবিধা হয়, বলাে তাে?”

সুশােভন একটু ভেবে বলল, “চাইলে হােটেলের খরচাটা সেভ করতে পারাে। তবে শেষ পর্যন্ত ওটা অবশ্য জলেই যাবে!” চোখ টিপে দিল নগরপাল।

হেসে ফেলল ছফা। জলে যাবে বলতে, মদের পেছনে যে ব্যয় করতে হবে সে বুঝতে পারছে।

“তােমার বউদিবাপের বাড়িতে আছে এখন। তুমি আমার ওখানেই উঠছ, ঠিক আছে?” ‘বাপের বাড়িতে চলে গেছে? ঝগড়া করেছ নাকি?” “আরে না, মেয়েদের সঙ্গে আমি ঝগড়া-টগড়া করতে পারি না। ওকে কয়েকটা মাস ওখানেই থাকতে হবে।”

“কেন? অসুখ করেছে?”

“হুম।” সশােভনের মুখের হাসি দেখে ছফা অবাক হল, কারণটাও ধরতে পারল না সে। “আরে, সিরিয়াস কিছু না  সি কন্সিভ।”

“ওহ” হেসে ফেলল ছফা। হাতটা বাড়িয়ে দিল সুশােভন মিত্রের দিকে। “কংগ্রাচুলেশন্স।”

“থ্যাঙ্কস,”করমর্দন করতে করতে বলল সহকারি নগরপাল। “ফার্স্ট ইস্যু?” মাথা নেড়ে সায় দিল সুশােভন।“তুমি তাহলে আমার ওখানেই উঠছ।” মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা।

অধ্যায় ৫০

ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে….

বিকেলের পরই নতুন এই লাইব্রেরীটা ফাঁকা হয়ে যায়, আর তখনই সে চলে আসে এখানে। লােকজন থাকলে কখনও আসে না।  একজন নারী হিসেবে লক্ষ করে দেখেছে, তাকে দেখলেই নােকজন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অবশ্য এটা এ দেশের সবখানেই দেখা যায় একজন মেয়েমানুষ আশেপাশে থাকবে, হেঁটে যাবে আর তার দিকে তাকাবেনা, মনােযােগ আকর্ষিত হবে না কোনাে পুরুষ
মানুষের?  এমনকি, মেয়েরাও মেয়েদের দিকে তাকায়, যদি সেই মেয়েটি চোখে পড়ার মতাে হয়, কিংবা তার ব্যক্তিত্ব হয় প্রখর। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এই তাকানাের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে—ছেলেগুলাে যেখানে চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলতে চায়, মেয়েগুলাে সেখানে অবধারিতভাবেই ঠোঁট বেঁকিয়ে, এমন একটি অভিব্যক্তি করে, যেনাে নিজের ভেতরে বাম্পায়িত ঈর্ষা ঠেলেঠুলে উদগীরিত করতে চাইছে।

লালসা আর ঈর্ষা-মুগ্ধতার দেখা সে খুব কমই পেয়েছে।

অবশ্য এটাও ঠিক, এরকম প্রত্যন্ত এক গ্রামে তাকে দেখে হয়তাে বেমানান লাগে লােকজনদের কাছে। তার বেশভূষা আর সৌন্দর্য তাদেরকে বাধ্য করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে। আর এই ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন খুবই বিব্রতকর অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে কারও কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে সে ঘাবড়েও যায়—তাকে চিনে ফেলল না তাে!  না। এখন পর্যন্ত এরকমটি হয়নি। তবে যে-কোনাে সময়ই যে হতে পারে সে-ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সতর্কতার অংশ হিসেবেই, এই প্রত্যন্ত গ্রামে যারা বেড়াতে আসে তাদের কাছ থেকে নিজেকে সযত্নে আড়ালে রাখে সে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। যখনই কোনাে জায়গার প্রতি তার মায়া জন্মে, সেটা ছেড়ে চলে যেতে হয় তাকে–এখন পর্যন্ত এরকমটিই হয়ে আসছে।

ঔষধি গাছ আর নানান ধরণের ফুলের বাগান করার বাতিক জন্মেছে এখানে আসার পর। তার ঘরের সামনে এক চিলতে জায়গাটা ভরিয়ে তুলেছে শুভ্র কালেনডুলা, লালাভ ল্যাভেন্ডার, গােলাপি-বেগুনির পাঁচ পাপড়ির ক্যালােট্রপিস, সাদা মুক্তোর দানার মতাে পার্থেনিয়াম,সবুজ-লাল পাতার ক্যালাডিয়াম, লালচে-গােলাপির ওলিয়েন্ডার, সাদা-লালের অশ্বগন্ধা, শুভ্র-বেগুনির স্বর্পগন্ধা, শুভ্র লিলি, সবুজ আইভি, মধুনাশিনী, গােলাপি জটামানসি আর শুভ্র-গােলাপির নাগালিঙ্গ দিয়ে। ওদের পরিচর্যা করেই কাটিয়ে দেয় অখণ্ড অবসরের কায়সবটুকু। যাতে বড়ো করা গাছগুলো, এখানকার প্রকৃতি আর এই লাইব্রেরীটার প্রতি তার মায়া জন্মে গেছে অল্প ক-দিনেই।

চারপাশে তাকাল সে। দিন দিন নতুন নতুন বইয়ের আগমণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে গ্রন্থাগারটি। এখানকার খুব কম মানুষজনই জানে, নতুন এই লাইব্রেরীটির পেছনে তার অবদানের কথা।

রবীন্দ্রনাথের স্মরণে দেওয়া এই লাইব্রেরীটির দক্ষিণ দিকের এককোণের ফ্রেঞ্চ জানালার পাশে যে রিডিং টেবিলটা আছে, সেটা তার খুব প্রিয়। একান্তে, নির্জন লাইব্রেরীটি হয়ে ওঠে তার সময় কাটানাের জায়গা।ইচ্ছে করলে এখান থেকে বই নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েও পড়তে পারে, লাইব্রেরী থেকে খুব কাছেই সেটা, কিন্তু তার এখানে এসে বই পড়তেই বেশি ভালাে লাগে।  এ মুহূর্তেও তার কানে গোঁজা আছে হেডফোন, বাজছে আর-একটি প্রিয় একটি রবীন্দ্রসংগীত :

আমি নিশিদিন তােমায় ভালােবাসি,

তুমি অবসরমত বাসিয়ো।

নিশিদিন হেথায় বসে আছি,

তােমার যখন মনে পড়ে আসিয়া

কিছু একটা টের পেয়ে পাশ ফিরে তাকাল।

“নমস্কার দিদি,লাইব্রেরীতে কর্মরত এক ছেলে এক কাপ গরম চা টেবিলের ওপর রেখে চুপচাপ চলে গেল।

ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে নেবে, এমন সময় বন্ধ হয়ে গেল গান। থমকে গেল সে। পরক্ষণেই বেজে উঠল ফোনের রিংটোন।

হাতেগােনা দুয়েকজন ছাড়া তাকে সচরাচর কেউ ফোন দেয় না। কিন্তু এখন যে তাকে ফোন দিয়েছে, সে তার সবচাইতে কাছের একজন মানুষ। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে খুব কমই ফোন করে সে। তারপরও যখন ফোন দেয়, দেখা যায় সেটা সুসংবাদ দেবার জন্য নয়। এখনও সেরকমই কিছু আশঙ্কা করছে।

কলটা দ্রুত রিসিভ করল। ওপাশে যে আছে তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা শুনেই বুঝতে পারল, সত্যি খারাপ কিছু ঘটে গেছে। তারপরও ধীরস্থিরভাবে শুনে গেল কিছুক্ষণ। তার প্রশান্তিময় অভিব্যক্তি পালটে গেল সবটা শােনার পর। নীচের ঠোটদুটো কামড়ে ধরল।চা পানের রুচি উবে গেছে। দু-চোখ বন্ধ করে ফেলল কয়েক মুহূর্তের জন্য। এরকম পরিস্থিতিতে কি করতে হবে, আর কতটা সতর্ক থাকতে হবে ঠান্ডা মাথায় বলে দিয়ে ফোনালাপটি শেষ করল সে।

অনেক সতর্ক আর সজাগ থাকলেও এরকম খবর শােনার জন্য মােটেও প্রস্তুত না। কলটা শেষ হতেই এক ধরণের বিষন্নতা জেঁকে বসল। তার কারণে ঘনিষ্ঠ কোনো মানুষের ওপর দুর্ভোগ নেমে আসুক এটা সে চায় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। জানালা দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাকাল। গাছগাছালির ভিড়ে অনতি দূরে প্রবাহিত ভৈরব নদীটি এখান থেকে দেখা না গেলেও ভেসে আসা শীতল বাতাসে নদীর গন্ধটা ঠিকই অনুভব করা যায়।

জায়গাটা তার নামের মতােই সুন্দর!

অধ্যায় ৫১

সুশােভন মিত্রের ফ্ল্যাটটা লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটার্স থেকে খুব কাছেই, বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে অবস্থিত।

গৃহকর্তীর অনুপস্থিতি ছফাকে এক ধরণের স্বস্তিই দিল। তবে গৃহকর্তার বেলায়ও একই কথা খাটে! সুশােভনের ভাষায়, নিজেকে নাকি আপাতত ব্যাচেলর ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। ডিনারের পরই সিগারেট নিয়ে বসল সে, তারপর অর্ধেক খাওয়া হুইস্কির একটি বােতল। কিন্তু দুই পেগের পরই ছফা ক্ষান্ত দিল। হালকা মাথাব্যথার কারণে রাত একটার পরই ঘুমােতে গেল সে। হ্যাঙওভারের জন্য ভালাে ঘুমও হল না, তারপরও খুব সকালেই বিছানা ছাড়ল। নিজের ঘর থেকে বের হয়েই দেখতে পেল ড্রইংরুমে ইয়ােগা ম্যাট বিছিয়ে ধ্যানে মগ্ন সুশােভন। কোনাে এক দুর্বোধ্য যােগাসনে বসে আছে মূর্তির মতাে।

ছফার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। হুইস্কির বােতল শেষ করেও সাত সকালে এমন ধ্যানমগ্ন ঋষিকে দেখবে আশা করেনি।

ছফা যে-ই না ধ্যানমগ্ন সুশােভনকে একা রেখে চলে যাবে ঠিক তখনই সে বলে উঠল“ফ্রেশ হয়েছ?”

“না। মাত্র উঠলাম।” “ঘুম ভালাে হয়েছে তাে?” জানতে চাইল কলকাতা পুলিশের সহকারি নগরপাল। মাথা দোলাল ছফা।

“চাইলে আর-এক দফা ঘুমিয়ে নিতে পারাে। হ্যাঙওভার খুব বাজে লাগে আমার কাছে।” ইয়ােগা ম্যাট থেকে উঠে দাঁড়াল। “আমি একটু পর অফিসে চলে যাব। বাসু আছে  তােমার ব্রেকফাস্ট রেডি করে রাখবে ও। যে-কোনাে দরকারে ওকে বললেই হবে।”

“ঠিক আছে।” “আমি অফিসে গিয়েই তােমাকে ওই লিস্টটা পাঠিয়ে দেব।” “থ্যাঙ্কস।”

গত রাতে প্রথম কয়েক পেগ পেটে যেতেই সুশােভন কবি হয়ে উঠেছিল, তারপর রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভারতবর্ষের রাজনীতি নিয়ে তিক্ত বক্তৃতা। শেষে চড়াও হয় হাল আমালের সংগীত নামের অসঙ্গতির ওপরে! সুরের নামে নাকি অসূরের বজ্জাতিক অটোটিউন নিয়ে কী সব বলেছে, ছফার মনেও নেই। এককালে সে ক্লাসিক গান করেছিল। সে কথা জানিয়ে একটা ঠুমরির কয়েক লাইন গেয়েও শুনিয়েছে। এর মন্দ ছিল না তার গান। চর্চা করলে আরও ভালাে গাইতে পারবে সন্দেহ নেই।ছফা এক মনে শুনে গেছে তার কথা। বেশির ভাগ সময় মাথা নেড়ে, হু-হা করে দিয়ে গেছে।হুইস্কির বােতল যখন অর্ধেক খালি তখনও ছফার গ্লাস শেষ হয়নি।সশোভন অবশ্য তাকে আরও বেশি পান করার জন্য বললেও জোর খাটায়নি।  এরপর নিজের ঘরে ফিরে এসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে যায় আবার সুশােভন কখন অফিসে চলে গেছে টেরই পায়নি ছফা।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেলা প্রায় ১১টা বেজে গেছে। বিছানা থেকে জোর করে নিজেকে তুলতে হল। ঘর থেকে বের হয়েই দেখতে পেল ড্রইংরুমের ফ্যাক্স মেশিনে একটি লম্বা ফ্যাক্স চলে এসেছে। সুশােভন যে এতটা করিৎকর্মা বুঝতে পারেনি। অফিসে গিয়ে প্রথমেই তার কাজটা করেছে।ফ্যাক্সের কাছে গিয়ে চোখ বুলালো সে। যেমনটা আশা করেছিল,সুদীর্ঘ তালিকা। এটাতে মনোযােগ দেবার আগে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবে।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখতে পেল ডাইনীং টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে। সুশোভনের হাউজকিপার ছেলেটার নাম সম্ভবত বাসুদেব।

দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে নিল সে। চোখ বুলালো এরপর ফ্যাক্সের কাগজে। এতগুলাে মানুষের মধ্যে থেকে নুশকান জুবেরির শিকার খুঁজে বের করা সহজ হবে না। তবে সে ভেবেছিল, বয়স আর লিঙ্গ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে তালিকাটি অত বড়ো হবে না হয়তো এখন যে সুদীর্ঘ তালিকা দেখতে পাচ্ছে, সেটা তাকে ভাবনায় ফেলে দিল কিছুটা।  ডাইনীং টেবিলের ওপর আজকের আনন্দবাজা
র আর আজকালসহ ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান রাখা থাকলেও তাতে চোখ বুলালাে না। নাস্তার পর চমৎকার এক মগ কফি ভােরে তালিকাটা নিয়ে চলে এল গেস্টরুমে। রােল করা দীর্ঘ লম্বা কাগজের শুরু থেকে পড়তে শুরু করল। ভালাে করেই জানে, এ কাজ করতে যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি দরকার হবে সেটা হল ধৈর্য। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও, যেন নিখোঁজদের মধ্যে কোনাে প্যাটার্ন তার চোখ এড়িয়ে না যায়।

শোভনের ছিমছাম নির্জন ফ্ল্যাটে বসে একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করতে করতে নিখোঁজদের তালিকায় চোখ বুলিয়ে যেতে শুরু করল নুরে ছফা। বিগত তিন বছরের সুদীর্ঘ তালিকা দেখে বুঝতে পারছে, সারাটা দিন এ কাজেই চলে যাবে।

অধ্যায় ৫২;

আসলাম আবারও ফিরে এসেছে অরিয়েন্ট হাসপাতালের সামনে।

গতকাল পিএস তাকে ফোন করে মূল্যবান একটি তথ্য দিয়েছিল বুড়ো ডাক্তার নিজের হাসপাতালের একটি সুরক্ষিত স্পেশাল কেবিন’-এ আছে। তবে ভদ্রলােক মােটেও অসুস্থ নয়।

আসলাম অবাক হয়নি একটুও। এরপরই সে হাসপাতালে চলে আসে, ডাক্তারকে নজরদারি করতে শুরু করে দেয়,কিন্তু সারা দিনেও উল্লেখযােগ্য কিছু চোখে পড়েনি। জানতেও পারেনি নতুন কিছু।

কিন্তু একটু আগে আশেক মাহমুদ আর-একটি তথ্য দিয়েছে তাকে ডাক্তারের সব চাইতে বড় দূর্বলতার সন্ধান পাওয়া গেছে। আর সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে, ওই ধুরন্ধর লােকটাকে বাগে আনা যাবে খুব সহজে। পিএসের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালােই অবগত আছে সে। অরিয়েন্ট হাসপাতালের ভেতরেও তার লােক আছে, সম্ভবত ওই লােকই এরকম খবর দিয়েছে।

এখন কালাে রঙের গাড়িটা নিয়ে হাসপাতাল থেকে একটু দূরে পার্ক করে বের হয়ে এল সে। মেইনগেটের পরে যে বিশাল ওয়েটিং এরিয়া আর রিসেপশনটি আছে সেখানে এসে কিছু উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেল। হাসপাতালে এমন দৃশ্যই স্বাভাবিক রােগীর নিকটাত্মীয়েরা বসে থাকে রাজ্যের যত দুশ্চিন্তা নিয়ে। কাচের বিশাল দরজাটার পাশেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির রিসেপশন ডেস্ক, ওখানে বসে আছে এক তরুণ আর তরুণী। ছেলেটা মনোযােগ দিয়ে কী যেন দেখছে, কিন্তু মেয়েটা কানে ফোন ঠেকিয়ে আলাপে ব্যস্ত। তার দিকে তাকাল মেয়েটা। গতকাল থেকে দেখছে তাকে, চেহারাটা চিনে ফেলেছে সম্ভবত। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। রােগীর আত্মীয়স্বজন তাে ঘনঘন হাতপাতালে আসতেইপারে।

রিসেপশন এরিয়া থেকে সােজা লিফটের দিকে চলে গেল সে। তার গন্তব্য আবারও পাঁচ তলায়-ওখানেই এক স্পেশাল কেবিনে আছে বুড়ােটা।

প্রায় বিশ মিনিট ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের সামনে অপেক্ষা করার পর দেখতে পেল, ওয়াশরুমের পাশে ছােট্ট একটি প্যাসেজ দিয়ে এক তরুণী আর অল্পবয়সি এক ছেলে বেরিয়ে আসছে।পিএসের দেওয়া তথ্যমতে ওখানেই আছে স্পেশাল কেবিনটা।

তাহলে এই মেয়েটাই ডাক্তারের দুর্বলতা।

ওয়েটিং এরিয়া থেকে উঠে দাঁড়াল আসলাম। তরুণী আর ছেলেটা লিফটের সরে দাঁড়িয়ে আছে এখন।চুপচাপ তাদের পেছনে এসে দাঁড়াল সে। লিফটের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ওই দুজন, তাদের পেছন পেছন ঢুকে পড়ল আসলাম। তিন জন মানুষকে নিয়ে লিফটটা নামতে শুরু করল এবার।  লিফটের ভেতরে কেউ কোনাে কথা বলছেনা। আসলাম ভালাে করে তরুণীকে দেখে নিল। চেহারাটা তার মুখস্ত করে রাখা দরকার। সঙ্গে থাকা তরুণকেও দেখে নিল। একেবারেই সাদামাটা চেহারার। দেখে মনে হয়, মেয়েটার বাসায় কাজ করে।বড়ােলােকের বাড়িতে যে-রকম গরিব আর অভাবী আত্মীয়স্বজন আশ্রয়ে থাকে, ঠিক সেরকম।

গ্রাউন্ডফ্লোরে থামলে ওই দু-জন লিফট থেকে বের হয়ে গেলে আসলামও তাদের অনুসরণ করল নির্দিষ্টদূরত্ব বজায় রেখে।ওরা কেউই তাকে একবারের জন্যে লক্ষ করেনি। আসলাম মেয়েটার দিকে একঝলক না তাকিয়ে পারল না। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে কাচের দরজাটা খুলে বের হয়ে এল সে। ওদের আগে তাকে তার গাড়ির কাছে পৌঁছােতে হবে।  হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে উঠে বসল ওই তরুণী আর ছেলেটা। গাড়িটা সম্ভবত উবার হবে। দূর থেকে দেখল, ড্রাইভার মােবাইলফোন হাতে নিয়ে ট্রিপটা কনফার্ম করছে।গুলশান থেকে উবারের গাড়িটা চলে যাচ্ছে ঢাকা শহরের আর-এক অভিজাত এলাকা বনানীর দিকে। যেমনটা ভেবেছিল, গাড়িটা এসে থামল বনানীর তিন নাম্বার রােডে ডাক্তারের বাড়ির সামনেই। – তরুণী আর অল্পবয়সি ছেলেটা গাড়ি থেকে নামতেই ভেতর থেকে গেটটা খুলে দিল দারােয়ান, বাড়িতে ঢুকে পড়ল ওরা।

গাড়িতে বসে, একটু দূর থেকে সবটাই দেখল আসলাম। তার ঠোটে ফুটে উঠল হাসি। পিএসের তথ্য একেবারেই ঠিক।

অধ্যায় ৫৩

এদিক থেকে আধঘন্টা পিছিয়ে থাকা কলকাতা মহানগরীর বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে সিগারেট ফুকতে ফুকতে প্রায় উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই হেটে যাচ্ছে নুরে ছফা। তার মাথায় একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকেই। চিন্তাভাবনা পরিষ্কার করার জন্যই ঘর থেকে বের হয়েছে সে। প্রায় সারাটা দিনই সুশােভনের ফ্ল্যাটে ছিল।  সন্ধ্যা নামার একটু আগে মাথাটা ভার হয়ে এলে সুশােভনের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পড়ে একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য। বিকেলের দিকে সহকারি
নগরপাল ফোন দিয়ে জানিয়েছিল তার ফিরতে একটু দেরি হবে আজ।কাজ শেষে শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে বউকে দেখে আসবে। ছফার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিল সে। তাকে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত নিখোঁজদের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে মাত্র দু-জনকে পেয়েছে যাদের ব্যাপারে আর খোঁজ নেওয়া দরকার। সুশােভন তাকে বিস্তারিত তথ্য দেবার আশ্বাস দিয়েছে।

যাই হােক, নিখোঁজদের তালিকার বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবর্গের। কিছু অপ্রকৃতস্থ লােকজনও আছে। ছফা মনে করে না, মুশকান জুবেরি প্রতিবন্ধীদের ওপর চড়াও হবে! মহিলার রুচিবােধ আছে। তার আগের কোনাে শিকারই এমন ছিল না। কিন্তু তারপরও কথা থাকে-অভাবে পড়লে বাঘ যেমন ঘাস খাওয়া শুরু করে, তেমনি মুশকানের পক্ষেও শিকারের ধরন পালটানাে সম্ভব। হয়তাে সফট টার্গেট’ বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে মহিলা। তবে এটাও ঠিক, কলকাতা মহানগরীতে শিক্ষিত আর মার্জিত পুরুষ মানুষের অভাব হবার কথা নয়।বিগত তিন বছরের তালিকায় কিছু শিক্ষিত-মার্জিত পুরুষ মানুষও রয়েছে যারা মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর নিখোঁজ হয়েছে, তবে তাদের মধ্যে কেবল দুজনই সব দিক থেকে শিকার হবার যােগ্যতা রাখে বলে মনে করছে ছফা।

নিখোঁজদের অনেকের বিরুদ্ধে ড্রাগ অ্যাডিকশনের অভিযােগ থাকায় ছফা তাদেরকে বাদ দিয়েছে। সে মনে করে না, নেশাগ্রস্ত কোনাে মানুষকে মুশকান জুবেরি শিকার বানাবে। যে প্রত্যঙ্গটি ওই মহিলার বিশেষভাবে দরকার, সেটা সুস্থ থাকা চাই।  তবে দু-জন সম্ভাব্য শিকারের মধ্যে একজনকে নিয়ে ছফা বেশি আগ্রহী—ভদ্রলােক একজন ডাক্তার! বয়স আটত্রিশের মতাে হবে। মুশকানের শিকার হিসেবে সামান্য বেশি কিন্তু পদমর্যাদা আর শিক্ষার ব্যাপারটা হিসেবে নিলে তার দিকেই মনােযােগ চলে যায়। ও
ই ডাক্তার নিখোঁজ হয়েছে মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার প্রায় এক বছর পর।

কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেবার পর পরই মহিলা শিকারে নামবে, এমনটা আশা করে না ছফা।তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।মুশকান ঠিক কবে থেকে শিকার শুরু করে কে জানে!

তালিকাটা এখনও পুরােপুরি শেষ করতে পারেনি, ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে বাকি নামগুলো দেখবে। আশা করছে, সুশােভন ফিরে আসার আগেই কাজটা শেষ করতে পারবে।দীর্ঘ তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জনকে শিকার বানানাের কথা ওইমহিলার-এটা বিবেচনা নিলে তালিকাটি এখন পর্যন্ত ছফার জন্য হতাশাজনকই।তবে, নতুন জায়গায় এসে মুশকান যদি নিজেকে সংযত রেখে থাকে, তাহলে এরকমটি হতেই পারে।তালিকায় নিখোঁজদের শুধু নাম, বয়স, নিখোঁজ হবার দিনক্ষণ আর পেশার উল্লেখ আছে। তার দরকার সম্ভাব্য দু-জন শিকারের ব্যাপারে আরও বিস্তারিত তথ্য।

দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ করে নুরে ছফা পা বাড়াল সুশােভনের ফ্ল্যাটের দিকে।

অধ্যায় ৫৪

রাত দশটার পর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরল সুশােভন। সঙ্গে করে একটা বােতলও এনেছে। ছফার বুঝতে বাকি রইল না ওটা কী। আঁতকে উঠল সে। আবারও মদ্যপান! না। তার পক্ষে আজ আর এ জিনিস পান করা সম্ভব হবে না। সে ওকেশনাল ড্রিঙ্কার, বছরে টেনেটুনে তিন-চার বার খায়। তা-ও এক বসায় দুই পেগের বেশি না। কাল রাতে হাফ গ্লাস শেষ করতেই বেগ পেয়েছে, বুঝে গেছে তার শরীর এর চেয়ে বেশি অ্যালকোহল সহ্য করতে পারে না।

“আজকে আমি কিন্তু নেই,”ছফা আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল।“তােমাকে একাই  ড্রিঙ্ক করতে হবে, দাদা।” সে বসে আছে সুশােভনের ড্রইংরুমে। ডিনারের পর টিভি
দেখছিল।

সুশােভন হেসে ফেলল। “তুমি না বড্ড ইয়ে….এত কম খাও এ জিনিস!লিঁও-তে কনিয়াক-এর মতাে জিনিসও ছুঁয়ে দেখলে না।” ছফার পাশে এসে বসল সে।

“ওসব খেলে আমার হ্যাঙওভার হয়  কালকেও হয়েছিল।”

“বেশি করে মেরে দিলে হ্যাঙ্গওভার হত না,” বােতলটায় টোকা মেরে বলল,“লন্ডন থেকে এক বন্ধু গিফট করেছে  গ্লেনফিডিখ  কুড়ি বছরের পুরােনাে মাল! চেখে না দেখলে হয়?”

“একশাে’বছরের হলেও আমি নেই আজ,”ছফা হেসে বলল।

কাঁধ তুলল সুশােভন। “কী আর করা।” একটু থেমে আবার বলল সে, “তা বলল, সারাদিন খেটেখুটে কী পেলে?”

“এই লিস্ট থেকে মাত্র দু-জনকে পেয়েছি যারা ওই মহিলার সম্ভাব্য টার্গেট হতে পারে,”বলল ছফা। , “সেটা তাে বিকেলেই বলেছ, এরপর আর কাউকে পাওনি?”  মাথা দোলাল সে। “তবে যে-দুজনকে পেয়েছি, তাদের ডিটেইল ইনফো লাগবে আমার।”

“ও তুমি পেয়ে যাবে। ওদের নিখোঁজ কেসগুলাের তদন্ত চলছে এখনও।” “তাহলে তদন্তকারী অফিসারের কাছ থেকে হেল্প পাওয়া যাবে নিশ্চয়?” “সেটার ব্যবস্থা করা যাবে, চিন্তা কোরাে না।” একটু ভেবে আবার বলল সুশােভন,

“তুমি বলেছিলে দুজনের মধ্যে একজন ডক্টর আছে?”

“হুম। কিন্তু কীসের ডাক্তার, কোথায় কাজ করতাে সেসব কিছু ডিটেইল নেই তালিকায়।”

“ডেটাবেইজে অত ডিটেইল থাকে না। যেগুলাে দিয়েছি, তার সবগুলো হচ্ছে, কেস প্রগ্রেস করলে আপডেট করা হয়।”

“আনসলভ্ কেসগুলাের লিস্ট দিয়েছ বলে থ্যাঙ্কস। এটা আমার আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিল তােমাকে।”

হেসে ফেলল সুশােভন মিত্র। “আরে ভুলে যাচ্ছ কেন, আমিও পুলিশ! ঘটে কিছু বুদ্ধি তো রাখিই, নাকি?”

“রাখাে মানে বেশিই রাখাে।” “হা-হা-হা,” করে প্রাণখােলা হাসি দিল সহকারি নগরপাল। “তবে তালিকা অনেক বড়ো দেখে আমি কিন্তু অবাক হয়েছি, দাদা।”

“কেন? কলকাতা মহানগরী কি কম বড়ো নাকি? কত মানুষ থাকে জানাে? দিন দিন এসবের সংখ্যা বাড়ছে।”

আমাদের এখানেও তাই।” একটু চুপ থেকে বলল নগরপাল,“ডিনার করে ফেলেছ তাে?” “হুম। তুমি তাে ফোনে বলেই দিয়েছিলে তােমার জন্য ওয়েট না করতে।”

“হ্যা, আমি ওখান থেকেই খেয়ে এসেছি,”উঠে দাঁড়াল সুশােভন। “তুমি বসাে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।” বােতলসহ শােবার ঘরের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়াল সে।

“তােমার ওই ডাক্তারের নামটা কী?” “ডা: দয়ালপ্রসাদ মল্লিক।” “কী!”অবাক হল নগরপাল। ভুরু কুঁচকে গেল তার।“ডিপি মল্লিক?” “চেন তাকে?” “আমি তাে ভেবেছিলাম তার কেসটা এরইমধ্যে সলভ্্ করে ফেলেছে পুলিশ।” ছফা আরও কিছু জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল। “তােমার ওই সাসপেক্ট….কী যেন নাম?” “মুশকান জুবেরি।” “হুম। মহিলা তাে দারুণ টার্গেট বেছে নিয়েছে, মাইরি,” প্রশংসার সুরে বলল। “কী রকম?”উৎসুক হয়ে উঠল সে। “ডিপি মল্লিক একজন ফেমাস প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জন, বুঝতে পেরেছ তাে? কথাটার মধ্যে যে ইঙ্গিত আছে সেটা ধরতে পারল ছফা।

অধ্যায় ৫৫

মুশকান জুবেরির সম্ভাব্য শিকার একজন প্লাস্টিক সার্জন!

চিন্তাটা ছফার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিগত দশ-পনেরাে মিনিট ধরে।

একজন সন্দেহভাজন পালিয়ে গেল পাশের দেশে, তারপর দ্বারস্থ হল এক প্লাস্টিক সার্জনের। কেন-এর জবাব পেতে কোনাে কিছু ভাবার দরকার নেই। সুশােভনের মতাে সে-ও জানে জবাব একটাই—মুশকান জুবেরি সম্ভবত তার চেহারাটা পালটে ফেলার চেষ্টা করেছে।

পালটে ফেলেছে! নিজেকে শুধরে দিল মনে মনে। “মহিলা দারুণ স্মার্ট,”বলল সুশােভন মিত্র। “এক ঢিলে দুটো পাখি মেরেছে।” ছফাও জানে কথাটা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি।

“চেহারাটা পালটে ফেলে শিকারকে হত্যা করে তার অর্গানটারও একটা বন্দোবস্ত করেছে।”

মাথা নেড়ে সায় না দিলেও মনে মনে ঠিকই সায় দিল ছফা।“এই কেসটা যে অফিসার দেখছে তার সঙ্গে কথা বলা যাবে?”

“অবশ্যই যাবে,” জোর দিয়ে বলল সুশােভন। চাইলে এখনই কথা বলিয়ে দিতে পারি।”

– “এখনই?”অবাক হল সে।

“যদি তুমি চাও তাে  রাত খুব একটা বেশি হয়নি কিন্তু।”

একটু ভেবে নিল ছফা। তর সইছেনা তার, তবে রাত দশটার পর কোনাে অফিসারকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। ডিউটি শেষে নিশ্চয় বাড়িতে গিয়ে বউ-বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। “এখন কল করলে বিরক্ত হবে না?”  “তা তাে হবেই,” হাসিমুখে বলল সুশােভন। “কিন্তু আমার কাছ থেকে রাত দশটার পর ফোন পেলে মােটেও বিরক্ত হবে না, এ আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি।”

হেসে ফেলল ছফা। “তাহলে কল দাও।”  “ওকে।” উঠে পাশের ঘরে গিয়ে মােবাইলফোনটা নিয়ে এল। “আমি জানি কোন অফিসার এই কেসটা দেখছে,”এ কথা বলে একটা নম্বরে ডায়াল করে ছফার পাশে এসে বসল সে। কলটা রিসিভ হতেই কানে চেপে বলল : “হ্যা  দেবাঞ্জন, একটা ভীষণ দরকারে ফোন না দিয়ে পারলাম না”ওপাশ থেকে কিছু শুনে গেল নগরপাল। “
তুমি তাে ওই প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের কেসটা দেখছ, তাই না?  কেসের আপডেট জানতে চাইছি আমি, একটু থেমে উৎসুক
ছফার দিকে তাকাল সে, মুচকি হেসে চোখও টিপে দিল। ওপাশের কথা শুনে গেল কিছুক্ষণ।“কোনাে কুলকিনারাই করা যায়নি বলো কী!”ছফার দিকে তাকিয়ে ঠোট ওলটাল। “আচ্ছা  বুঝতে পেরেছি  হুম  সেটাই ঠিক আছে, থ্যাঙ্কস.
…পরে দরকার হলে আবার কল দেব তােমাকে।”

“কী বলল?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাে ছফা। “কানাগলিতে গিয়ে আটকে আছে কেসটা। কোনাে কুলকিনারা করা যায়নি।” “কাউকে সাসপেক্ট হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়নি ?”

“প্রাইমারালি মি.মল্লিকের কিছু কলিগকে সাসপেক্ট মনে করলেও সেগুলাের কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি। দেবাঞ্জন বলছে, ওর ধারণা ভদ্রলােক ইলিগ্যাল প্র্যাকটিস করত….বুঝতেই পারছাে কী রকম। এসবের সঙ্গে তার নিখোঁজের সম্পর্ক থাকতে পারে।”

ছফাকে আশাহত দেখাল।  “ও বলল, কেসটা নাকি খুবই রহস্যময়। মি
.মল্লিক একদিন বলা নেই কওয়া নেই, হুট করেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। নিজের বাসা থেকে বের হয়েছিল, কী কাজে সেটাও কাউকে বলেনি,” একটু থেমে আবার বলল সুশােভন, “এজন্যে সামান্য ক্লুও বের করা যায়নি কেসটার।”

ছফার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল কথাটা শুনে। “কী?” আগ্রহী হল কলকাতা পুলিশের নগরপাল।

“মুশকান জুবেরি এর আগে যাদেরকে শিকার করেছে, তাদের কেসগুলােও এমনই ছিল, একদম ক্লুলেস। পুলিশ সামান্য অগ্রগতিও করতে পারেনি বলে আমাকে কেসটা দেওয়া হয়।”

“তুমি তাে তাহলে বেশ ভালাে কাজ দেখিয়েছ, সাসপেক্টকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলে। নিখোঁজদের কী হয়েছিল সেটাও বের করে ফেলেছিলে।”

“কিন্তু ওই মহিলাকে”…. কথাটা আর শেষ করল না। নিজের ব্যর্থতার কথা বলতে সব সময় তার খারাপ লাগে।

“তুমি বসাে, আমি আসছি,” শােবার ঘরে চলে গেল সুশােভন।  ছফার মাথায় এখন অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে, উঁকি দিচ্ছে অনেক সম্ভাবনা।তাহলে কি কেএস খানের কথাটাই সত্যি? সে যেমুশকানকে রমনা থেকে ফেরার সময় দেখেছিল, সবটাই ছিল হেলুনিসেনাশন? কিংবা ডিলুশন!

এখন যা বুঝতে পারছে মুশকান জুবেরি ঢাকায় গিয়ে থাকলেও তাকে দেখে চিনত পারতাে না ছফা।

“তুমি বসে বসে মাথা ঘামাও,”বােতল আর গ্লাসসহ ঘরে ঢুকে বলল সুশােভন মিত্র,

“আমি একটু চেখে দেখি।”

“বৌদির অ্যাবসেন্সটার ভালােই ফায়দা নিচ্ছ।”

হেসে ফেলল নগরপাল।“আমার কি সেটা নেওয়া উচিত হচ্ছেনা?” তারপর চোখ টিপে দিল। “বিয়ে থা করাে, তখন বুঝতে পারবে। এখন তাে ঝাড়া হাত-পা, ব্যাচেলর মানুষ….আমাদের দুঃখ বুঝবে না তুমি।

কিছু বলল না ছফা। তার মাথায় এখন অজস্র চিন্তা। একটু উদাস হলেও আড়চোখে দেখতে পাচ্ছে সুশােভন বেশ আয়েশ করে গ্লাসে হুইস্কি ঢালছে। লালচে তরলে ভর্তি গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নিল কয়েক মুহূর্ত, তারপর সন্তুষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের লিঁও-তে ইন্টারপােলের সদর দফতরে এক সেমিনারে অংশ নিতে গেলে ওখানে প্রথমবারের মতাে সুশােভনের সঙ্গে একরুমে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। যে ক-দিন তারা ছিল, প্রতি রাতেইদামি দামি সব ফরাসি মদ নিয়ে আসত কলকাতার এইন গরপাল।বেশ আয়েশ করে মদ্যপান করত।এক্ষেত্রে সে আবার ফরাসিদের সমকক্ষই বলা চলে—কোন মদের জন্য কোন গ্লাস, কী তার প্রিপারেশন সবই তার নখদর্পনে।হুইস্কি পানের সময় গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঠিক এভাবেই ঘ্রাণ নিত তখন।

“কঠিন জিনিস, বুঝেছ?” সুশােভনের কথায় লিঁও থেকে কলকাতায় ফিরে এল ছফা।

“আস্তে আস্তে গলা দিয়ে নামতে দেবে….এ জিনিস সরবতের মতাে খেতে হয় না।” ছােট্ট একটা চুমুক দিল এরপর।“আহ”আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল।“দুর্দান্ত জিনিস।”

“ডিপি মল্লিক যদি মুশকান জুবেরির শিকার হয়ে থাকে, তাহলে ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভ নয়তাে ডিলিট করা থাকবে।”

“তাই নাকি?” গ্লাসের তরলে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল নগরপাল।

“এর আগের প্রায় সব শিকারের সঙ্গেই মহিলা এ কাজ করেছে, শুধু একটার বেলায় এটা করতে পারেনি, আর সেই ভিক্টিমের সূত্র ধরেই তাকে আমি খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল সুশােভন মিত্র।“তাহলে ফেসবুক ঘেঁটে দেখাে ডিপি মল্লিকের আইডিটার কী অবস্থা। আমার তাে ওয়াইফাই আছে, সেলফোন থেকে লগ-ইন করাে।”

পকেট থেকে মােবাইলফোনটা বের করল ছফা। “পাসওয়ার্ডটা বলাে?” “শিভাস রিগ্যাল।” “কী!” হেসে ফেলল সুশােভন। “মজা করলাম। এবার আসলটা বলছি। এসএইচভিএন ০২০৩১৯৭৮।”

“তােমার ডেট অব বার্থ নাকি?” পাসওয়ার্ডটা ইনপুট দিতে দিতে বলল ছফা। মাথা নেড়ে সায় দিল নগরপাল।“সহজ আর মনে থাকবে এমন পাসওয়ার্ড, দেই। লম্বা ডিজিট আমার মুখস্ত থাকে না। তবে ভেবনা, ফেসবুক, ইমেইল কিংবা কার্ডের বেলায়ও একই কাজ করি।”

মুচকি হাসল ছফা। “তুমি অতটা বােকা নও, সেটা আমি জানি।”  হা-হা করে হেসে চোখ টিপে দিল। “ওকে
….তুমি কাজ করাে, আমি একটু মদমত্ত করি।

ছফা ফেসবুকে ঢুকে সার্চ করতে শুরু করে দিয়েছে এরই মধ্যে। “আমার ধারণা ভদ্রলােকের আইডিটা ডিঅ্যাক্টিভ….অথবা ডিলিটেড।”

সুশােভন গ্লাসে আর-একটা চুমুক দিল। “তা হলে তাে হয়েই গেল, স্পষ্ট হয়ে যাবে, ওটা তােমার ওই সেক্সি-গ্লামারাস মহিলারই কাজ।”

ছফা বুঝতে পারল, সুশােভন এখন আস্তে আস্তে অশােভন হতে থাকবে। “আচ্ছা, এখানকার মানুষজন ইংরেজিতে এভাবে মল্লিক লেখে কেন?”ভ্রু তুলল নগরপাল।“এম-ইউ-এল-এল-আই-সি-কে?” “হুম।” “কেন, তােমাদের ওখানে অন্যভাবে লেখে নাকি?” “এম-ও-এল-এল-আই-কে লিখতে দেখেছি অনেককে।”  মাথা দোলালাে সুশােভন। চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবছে।

ছফা আর কথা না বাড়িয়ে নামটা টাইপ করে সার্চ দিল। কিছুক্ষণ পরই ভেসে উঠল রেজাল্ট। আঁৎকে উঠল সে। “ওরে বাপরে! এত দয়ালপ্রসাদ মল্লিক আছে ভারতে!”

“কলকাতায় এ নাম কমই আছে কিন্তু সারা ভারতবর্ষ হিসেবে নিলে অনেক হবারই কথা।”

“তুমি কি ভদ্রলােককে কখনও দেখেছ?” ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল ছফা।

“না। তবে পত্রিকায় ছবি দেখেছি।” “তাহলে তাে ছবি দেখলে চিনতে পারবে?”

“হুম।” গম্ভীর হয়ে জবাব দিল নগরপাল।“এক কাজ করাে, নামের আগে ৬৪ লাগিয়ে সার্চ করাে। ডক্টরদের মাইরি অদ্ভুত বাতিক থাকে, বুঝলে?” গ্লাসে চুমুক দিনে বলল আবার, “নামের আগে ডক্টর’বসাতে না পারলেওদের পোঁদের মধ্যে এক ধরনের চুলকোনি হয়। আমি কখনও ‘ডক্টর’পদবি ছাড়া কোনাে ডক্টরকে তার নাম লিখতে দেখিনি।

মুচকি হাসল ছফা। পনেরাে বছরের পুরােনাে দ্রব্যের প্রভাব পড়তে শুরু করে সামান্য মাতলামিতে ধরেছে সুশােভনকে।

নামের আগে সংক্ষেপে ‘ডক্টর’যােগ করে সার্চ দিল এবার।

ডা.দয়ালপ্রসাদ মল্লিক।

রেজাল্ট আসতেই চমকে উঠল—এ নামে কোনাে আইডিই নেই। নুরে ছফা হতাশ হয়ে তাকাল সুশােভনের দিকে।

“কী?”নগরপাল আবারও মদ ঢালতে উদ্যত হচ্ছিল গ্লাসে। “এ নামে কোনাে ফেসবুক আইডি নেই দেখছি!”

একটা ঢেকুর তুলে তার দিকে তাকাল সুশােভন মিত্র। আইডি না পেয়ে ছফার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কেন বুঝতে পারছে না সে।

অধ্যায় ৫৬

প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের আইডিটা খুঁজে না পেয়ে মনে মনে ছফা এখন একটাই কামনা করছে—এই সার্জনের নিখোঁজের পেছনে যেন মুশকান জুবেরিই জড়িত থাকে।

“একটু চেখে দেখবে নাকি? টেনশনে এ জিনিস ভালাে কাজে দেবে।”

মাথা দুলিয়ে না করে দিল ছফা। সে এখন ভাবছে, ডিপি মল্লিকের ব্যাপারে কীভাবে তথ্য জোগাড় করা যায়।

“একা একা মদ খাওয়া কী রকম, জানাে?”সহকারি নগরপাল বলল হতাশার সুরে। “হস্তমৈথুনের মতাে। মজাটা তুমি পাবে কিন্তু আসলটার মতাে না!”

“কীসের সঙ্গে যে কী বলাে না!” ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়েই বলল ছফা। তার হাসিই পাচ্ছে।  “সত্যি বলছি, মাইরি,”সুশােভন ঝুঁকে এল একটু।“এ জিনিস খেতে হয় কয়েক জনে মিলে, তাহলে জমে ভালাে। বুঝতে পেরেছ?”

মাতালের সঙ্গে তাল মেলানাের জন্যই মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা।

“তিনজন হলে তাে কথাই নেই,”জোরে ঢেকুর তুলে বলল এবার। “অসাম! একেবারে থ্রি-সামের ফিলিংসটা পাবে।”

আক্ষেপে মাথা দোলালাে নুরে ছফা।“দাদা, সাবধান! তুমি অন্য দিকে চলে যাচ্ছ।” “কথা কিন্তু সত্যি বলেছি। আর চার-পাঁচ জন হলে কী হয় জানাে তাে? গ্যাং ব্যাং!”

ফোনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নগরপালের দিকে তাকাল। মাতালের সঙ্গে তাল দেবার দরকার নেই আর। একা একা যতক্ষণ পারে বকবক করুক। আবারও সে মনোযােগ দিল ফোনের স্ক্রিনের দিকে।

“তােমার ওই গ্লামারাস সাসপেক্ট কিন্তু কঠিন মাল,”সুশােভন বলে যেতে লাগল। “নিজের চেহারাটাই পালটে ফেলেছে। এখন যদি সে কোনােভাবে এখানকার পাসপোর্ট বাগিয়ে নিতে পারে তাহলেই হয়েছে, একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।”

ছফাও এরকম আশঙ্কা করছে এখন।

“না না, ভুল বললাম,”মাতাল কণ্ঠে বলল সহকারি নগরপাল। “ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে না!”

কৌতূহলী হয়ে সুশােভনের দিকে তাকাল ছফা।

আই উড রাদার সে….মহিলা আরও কাছে চলে আসবে। কিন্তু কোন শালা তাকে চিনবে উম?” এবার কণ্ঠটা গম্ভীর করে বলল, “কিপ ইয়াের ফ্রেন্ডস ক্লোজ…. ইয়াের এনিমিজ ক্লোজার!”

ছফা কিছু বলল না, চেয়ে রইল নগরপালের দিকে।

“ওই ডেঞ্জারাস লেডি তােমার খুব কাছে আসার প্ল্যান করেছে, বুঝতে পেরেছ! তােমাকেও তার শিকার বানানাের প্ল্যান-ট্যালান করছে বােধহয়।”

ছফা মাথা দোলালাে মাতালের কথা শুনে।

“হতাশ মনে হচ্ছে?” ঢুলু ঢুলু চোখে জানতে চাইল। “এত সহজে হতাশ না হয়ে ডিপি মল্লিকের কোনাে পেজ আছে কিনা খুঁজে দেখাে,”মদে চুমুক দিয়ে বলল সুশােভন। “অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা, ডি-অ্যাক্টিভ করা সহজ, পেইজের বেলায় কাজটা কিন্তু অত সহজ না।”

নড়েচড়ে উঠল ছফা।

“ফেমাস প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জন….তার তাে পেজ থাকবেই।”একটা ঢেকুর তুলে আবার বলল, “বিশেষ করে তার ক্লিনিক কিংবা হসপিটালের নামেও থাকার কথা।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দ্রুত ফেসবুকে পেজটার সার্চ করতে শুরু করে দিল সে। পাঁচ মিনিট পরই খুঁজে পেল, ডিপি মল্লিকের আসলেই একটা পেজ আছে! সেটাতে ক্লিক করল ছফা।

হাসি হাসি মুখের, সাদা অ্যাপ্রােন পরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ডা.দয়াল প্রসাদ মল্লিকের প্রােফাইল পিকটা ভেসে উঠল। সুন্দর করে ছাটা গোঁফ, ছােটো করে ছাটা পরিপাটি চুল, হালকা নাদুসনুদুস শরীর, বড়ো বড়ো চোখ।  ছফা জানে প্লাস্টিক আর কসমেটিক্স সার্জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে লােভনীয় পেশা হিসেবে প্লাস্টিক সার্জনেরা কসমেটিক্স সার্জারির দিকেই ঝুঁকে পড়ে বেশি। ডিপি মল্লিকও তাই করেছে সম্ভবত।

নিখোঁজ হবার আগে এই সার্জন কাজ করত চেঞ্জমেকার নামের একটি ক্লিনিকে। “কিছু পেলে?”সুশােভন অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জানতে চাইল। “পেজটা দেখছি,” ফোনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল সে।

“ওই সার্জন কিন্তু সেলিব্রেটিদের সঙ্গে ইয়ে করে বেড়াত। আমার এক কলিগ বলেছিল, এখন মনে পড়েছে। ওই যে, এক অ্যাকট্রেস আছেনা?….আরে ওই যে ”সুশােভনের বেয়াড়া স্মৃতি এখন সাড়া দিচ্ছে না ঠিকমতাে।“ওই মেয়েটার সঙ্গে একটা কেলেংকারির খবর বেরিয়েছিল।”

“কী রকম কেলেংকারি?”

“আরে আজকাল যা শুরু হয়েছে….ও রকম,”একটু থেমে আবার বলল, “ওই যে মিটু মুভমেন্ট চলছে না? ওটাতে ওর নাম ছিল। এক অ্যাকট্রেস অ্যাকুইজ করেছিল ওকে।”

ছফা অবশ্য এ মুহূর্তে কেলেংকারি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।তার চোখ ফোনের ছােট্ট পর্দায়। প্রায় সব পােস্টই আগ্রহী কসমেটিক্স ক্লায়েন্টদের।কোনটা করতে কত টাকা লাগতে পারে, কত দিন লাগবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা এসব জানতে অনেকেই আগ্রহী। ডা.মল্লিকও সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। এসব জবাব ভদ্রলােক নিজে দেয়নি। এরকম পেজগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কেউ চালায়, এখানেও সম্ভবত তাই হয়েছে। ডাক্তারের মতো ব্যস্ত কেউ দিন রাত প্রশ্নের জবাব দেবার কথা না।

বেশিরভাগ পােস্টই ছবিসহ। সেইসব ছবি স্ক্রল করতে করতে একটা ছবিতে। থমকে গেল ছফা। কুঁচকে তাকাল সে।  ‘মাই গড!”অস্ফুটস্বরে বলে উঠল।

অধ্যায় ৫৭

ডা.ডিপি মল্লিকের পেজে তার অসংখ্য সাফল্য আর কর্মকাণ্ডের ছবি রয়েছে। সেসব ছবির সংখ্যা কয়েকশাে হবে।বিদেশের কোন মেডিকেল থেকে কী কোর্স করেছে, কোথায় কোন সম্মাননা পেয়েছে, তার চেঞ্জ মেকার ক্লিনিক কী কী সুবিধা দিয়ে থাকে, কত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, এ পর্যন্ত কতজন ক্লায়েন্টকে সেবা দিয়েছে, সে-সবের ছবিসহ ফিরিস্তি দেওয়া আছে। তবে তার সেলিব্রেটি ক্লায়েন্টের মধ্যে খুব কমই নিজেদের পরিচয় কিংবা ছবি দেখাতে রাজি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ডাক্তার এটা নিজেই স্বীকার করেছে। তার দাবি, প্রচুর সেলিব্রেটির কসমেটিক্স সার্জারি করেছে সে, তাদের অনুরােধেই নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে কিছু কিছু সেলিব্রেটি উদারতা দেখিয়ে তাদের নাম আর ছবি দিয়েছে, সেইসঙ্গে ডাক্তারের প্রশংসা করতেও ভােলেনি। তাদেরকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করেছে ডিপিমল্লিক।

এসব কিছু নিয়ে ছফার মধ্যে কোনাে আগ্রহ নেই, থাকার কথাও নয়, কিন্তু একটা ছবি দেখে তার চোখ আটকে গেছে একটু আগে। এখন সেই ছবিটার দিকেই ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে আছে সে।

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ!

ডিপি মল্লিকসহ আরও অনেক ডাক্তারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলােক। ছবিটা ২০১৩ সালের অক্টোবরের। আর সেটা বাংলাদেশেই!

ছবির নীচের ক্যাপশন বলছেঃ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার নামকরা অরিয়েন্ট হাসপাতালের আমন্ত্রণে ডাক্তার ডিপিমল্লিক গিয়েছিল সেখানকার প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জারি ডিপার্টমেন্টের একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়।  ছফা টের পেল উত্তেজনায় তার রক্ত টগবগ করছে। সে আরও কিছু ছবি দেখল। মােট তিনটি ছবি পাওয়া গেল যেগুলাে ডিপি মল্লিকের অরিয়েন্ট হাসপাতাল সফরের সময়ে তােলা। তবে কেবলমাত্র একটি ছবিতেই ডাক্তার আসকারের সঙ্গে, আর সেটা ডিপি মল্লিক নিজেই তুলেছে—সেলফি। এই ছবির নীচে ক্যাপশনটা দেখল ছফাঃ প্রখ্যাত সার্জ
ন এবং অরিয়েন্ট হাসপাতালের কর্ণধার ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সঙ্গে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইল সে। ওই সময়ে মুশকান জুবেরি অরিয়েন্ট হাসপাতালে কাজ করত না, ততদিনে সুন্দরপুরে চলে গেছে।

“হােগা!” বেশ জোরে বলে উঠল সুশােভন, সেই সঙ্গে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ছফা যারপরনাই অবাক, কিছুই বুঝতে না পেরে চেয়ে রইল তার দিকে। “কী হয়েছে, কী বলছাে এসব?”  কোনােমতে হাসির দমক থামিয়ে সুশােভন বলতে লাগল, “তােমার এই
ডিপি মল্লিকের কথা শুনে আর-এক মল্লিকের কথা মনে পড়ে গেছে আমার।”  মল্লিকের সঙ্গে ‘হােগার কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা ছফার মাথায় ঢুকছে না।

“স্কুলে আমাদেরএকটিচার ছিলেন, আমরা সবাই তাকে মল্লিকস্যার বলে ডাকতাম….একটা ঢেকুর তুলল নগরপাল। “মল্লিকস্যার একবার আমাদেরকে খুব মজার একটি গল্প বলেছিলেন,”কথাটা বলেই আবারও হেসে ফেলল সে।

“কী বলেছিলেন?”

হাসি থামিয়ে ছফার দিকে স্থিরচোখে তাকাল সুশােভন। তারপর গ্লাসের তলানিতে যতটুকু হুইস্কি ছিল শেষ করে ফেলল এক ঢােকে।“ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন….ভালােই পড়াতেন।”

মুচকি হাসল ছফা।তার মাথায় ঘুরছে ডা.আসকার, মুশকান আর ডিপিমল্লিক, এদিকে আর-এক মল্লিকের গল্প বলে যাচ্ছে তার হােস্ট। না শুনেও উপায় নেই।“প্রায়ইক্লাসে পড়ার ফাঁকে মজার মজার গল্প করতেন, আমরাও বেশ এনজয় করতাম। ভগবানই জানে, বানিয়ে বানিয়ে বলতেন নাকি আসলেই সব সত্যি ঘটনা ছিল,”হুইস্কির বােতলটা হাতে তুলে নিল সে।  ‘আর খেয়ােনা, দাদা.
…অনেক তাে খেলে,”বারণ করল ছফা।“কী বলেছিলেন উনি, সেটা বলাে?”  কয়েক মুহূর্ত ভেবে বােতলটা রেখে দিল সুশােভন। “ভদ্রলােক আবার পূর্ববাংলার লােক ছিলেন, আদিবাড়ি ছিল তােমাদের বরিশালে।ওখান থেকেইস্কুল পাস দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন কলেজে পড়ার জন্য। যাই হােক, হকসাহেবের বাড়ি ছিল ওঁর গ্রামেই।”

“শেরেবাংলা ফজলুল হক?”

“হ্যা  ও-ই….ফজলুল হক। ঘটনাটা সম্ভবত চল্লিশের দশকে। ভারতবর্ষ তখনও ব্রিটিশরাজের অধীনে। হকসাহেব তাে করতেন মুসলিমলিগ….তার এক বাল্যবন্ধু ছিল বেশ নামকরা রাজনীতিক। সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টি করত সে। তাে, হকসাহেব সবাইকে অবাক করে দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধলে ওঁর সেই বাল্যবন্ধু ভীষণ ক্ষেপে যায়। ওদের গ্রামের বাড়ি ছিল আবার খুব কাছাকাছি  খাল-বিল দিয়ে যেতে হত নৌকোয় করে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা।

“হকসাহেব গ্রামের বাড়িতে গেলে সেই বাল্যবন্ধুর বাড়িতে একবার হলেও দেখা করে যেতেন। তাে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধার পর গ্রামে গেলে এক বিকেলে তিনি নৌকো নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে গেলেন। নৌকোটা যখন ঘাটে ভিড়ছে, তখন সেই বন্ধু ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। হকসাহেবকে দেখে রাগে ক্ষোভে বলে উঠল, “কিরে ফৈজ্যা, তর লাইগ্যা তাে মাইনষের কাছে আর মুখ দেহাইতে পারতেসিনা।”সুশােভন বেশ চেষ্টা করল বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাটা বলার জন্য, তার প্রচেষ্টা মােটামুটি সফলও বলা যায়। “হকসাহেব ছিলেন খুবই আউটম্পােকেন পার্সন, বুঝলে  সেইরকম রসবােধও ছিল। কথাটা আর মাটিতে পড়তে দিলেন না। নৌকো থেকে নামতে নামতেই জবাব দিলেন, মুখ দেহাইতে না পারলে হােগা দেখা গিয়া!” কথাটা বলার পর ছফা আর কী হাসবে, সুশােভন হাসতে হাসতে সােফার ওপর গড়িয়ে পড়ল।

ছফাও হাসি ধরে রাখতে পারল না। “ওঁর সেন্স অব হিউমারটা দেখেছ? মুখ না দেখাতে পারলে হােগা দেখা! হা-হা-হা!” হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবার উপক্রম হল তার। “চিন্তা করাে, কী জবাবটাই না দিয়েছিলেন! আই ক্যান ইমাজিন….সেই বন্ধুর চেহারাটা কেমন হয়েছিল এ কথা শুনে! একেবারে লা-জওয়াব।”  গল্পটা সত্যি হােক আর মিথ্যে, হাসি পাবার মতােই। কিন্তু ছফার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। সুশােভনের হাসিটা যেন ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড হয়ে গেল নিমেষে। আবারও সে মনোযােগ দিল ফোনের পর্দার দিকে। বেশ ধৈর্য নিয়ে ডা
. ডিপি মল্লিকের পেজের বাকি ছবিগুলাে স্লাইড করে করে দেখতে শুরু করল। এভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবি দেখে নড়ে চড়ে উঠল সে-সার্জন দয়াল প্রসাদ মল্লিকের অসংখ্য সেলফির একটি ছবিতে ভদ্রলােক একাই আছেন। তবে তার ব্যাকগ্রাউন্ডে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা নুরে ছফা মােটেও আশা করেনি।

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি।

অধ্যায় ৫৮

ডাক্তার দয়ালপ্রসাদ মল্লিক রবীন্দ্রনাথে গেছিল!

নুরে ছফা প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে, ওদিকে সুশােভন মিত্র আর-একটি নতুন উপাখ্যান শুরু করেছে কলেজ জীবনের এক বান্ধবীকে নিয়ে কিন্তু সেটা তার কানে ঢুকলেও মনােযােগ পাচ্ছে না একদমই। নগরপালের কথাগুলাে দূর থেকে ভেসে আসা শব্দের মতাে লাগছে যেন!

ডিপি মল্লিকের পেজটার সবগুলাে ছবিই দেখে ফেলেছে ছফা। ওই দুটো ছবি ছাড়া উল্লেখযােগ্য আর কিছু পায়নি। কিন্তু দুটো ছবিই যথেষ্ট একটি সংযােগ স্থাপনের জন্য—নিখোঁজ প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের সঙ্গে ডাক্তার আসকারের সম্পর্ক ছিল, আর সুন্দরপুরের মতাে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বাদও নিয়েছে ভদ্রলােক। রবীন্দ্রনাথকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে যে সেলফিটা তুলেছে সার্জন, তার ক্যাপশনে লেখা আছে :অদ্ভুত নামের এক রেস্টুরেন্ট! অসাধারণ সব খাবার!

তাহলে কি মুশকানকেও ডিপি মল্লিক চিনত?

অবশ্যই চিনত, নুরে ছফা মনে মনে বলল। ডাক্তার আসকারের আমন্ত্রণে গেছিল ভদ্রলােক।সম্ভবত সুন্দরপুরেও তার সঙ্গী ছিলেন অরিয়েন্ট হাসপাতালের মালিক। ওখানে যাবার একটাই উদ্দেশ্যই থাকতে পারে—রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ খাবারের আস্বাদন। তার মানে মুশকান জুবেরি তাকে আগে থেকেই চিনতাে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতায় আসার পর তাকে শিকার বানানাের একটাই কারণ থাকতে পারে—সার্জন ডিপিমল্লিককে দিয়ে নিজের চেহারা পালটে ফেলার পর ব্যাপারটা চিরতরের জন্য গােপন রাখতে তাকে হত্যা করা। তবে এরকম মার্জিত আর তরতাজা একজনকে নিশ্চয়ই অপচয় করেনি মহিলা! শিকার হিসেবে ভদ্রলোক যথেষ্ট উপযুক্ত।

“বুঝলে, মেয়েটা আবার প্রটেকশান ছাড়া ওসব করতে রাজি ছিল না।” সুশােভন মিত্রের এমন কথায় সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাকাল ছফা। “কীসে রাজি ছিল না?”

“আরে প্রটেকশানের কথা বলছি….” এক কথা দু-বার বলতে গিয়ে সামান্য বিরক্ত হল মাতাল।

“ও।”

“কিন্তু আমি তখন ওরকম সময়ে কী করে ও জিনিস জোগাড় করি, বলাে?” হা-না কিছুই বলল না। ছফার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। “আমি বললাম, তুমি কিছু চিন্তা কোরাে না, বাইরেই–”

“আহ দাদা!” কথার মাঝখানে থামিয়ে দিল তাকে। “কী শুরু করলে?” এ মুহূর্তে পর্নোগ্রাফির বয়ান শােনার মেজাজে নেই সে।

“আরে শালা! লজ্জা পাচ্ছাে নাকি!” কুঁচকে তাকাল সুশােভন। মাথা দোলালাে ছফা।

একটা ঢেকুর তুলল মাতাল। যাই হােক, ও তাে রাজিই হয় না, তখন আমার কী ইচ্ছে করল জানাে?” প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল, “রেপ করে বসি!”

ভ্র কপালে তুলল ছফা। “তুমি কি সেটা করেছ নাকি?”

“আরে ধুর,”হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল কথাটা।“আমি কি অতটা ইয়ে নাকি। রিল্যাক্টান্ট কারাের সঙ্গে আমি কখনও কিছু করিনি,” একটু থেমে আবার বলল, “তুমি কখনও করেছাে?”

ছফার ভ্রু কপালে উঠে গেল। আমাকে আবার এরমধ্যে টানছাে কেন?”

“তুমি দেখি এসব কথা শুনতেও লজ্জা পাও, বলতেও লজ্জা পাও  বােকাচোদা !” বলেই মদের বােতলটা হাতে তুলে নিল আবার।

“আর খেয়ো না, দাদা,”ছফা তাকে বাধা দিল দ্বিতীয়বারের মতাে। অনেক খেয়েছাে, এবার থামাে। শােবার ঘরে চলে যাও, রাত অনেক হয়েছে। কাল তােমার অফিস আছে না?”

যেন বিষম খেল কলকাতা পুলিশের সহকারি নগরপাল। “কাল তাে হলিডে অফিস থাকবে কেন?”

“ওহ যাই হােক, তােমার রেস্ট নেওয়া উচিত।”  “গেস্ট রেখে রেস্ট নেব আমি?!” খুবই অবাক হল সুশােভন। “তুমি আমাকে কী ভাব, অ্যা?”

“আমিও একটু পর শুয়ে পড়ব। তুমি শােবার ঘরে চলে যাও, আমি ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ব।”

সুশােভন তার লালচে আর ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে রইল ছফার দিকে। “আমি এখন ঘুমােবাে? হাহ নাইট ইজ স্টিল ইয়াং….ম্যান। আর বােতলটা তাে অর্ধেকও খালি হয়নি!”

ছফা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সুশােভন মিত্র সােফার ওপরে শুয়ে পড়ল।

“ধুর  তুমি একটা মাজুল! মদ খাও না, ইয়েও করাে না, কিচ্ছু করাে না। শুধু ওই ডেঞ্জারাস লেডিকে নিয়ে পড়ে আছাে। তুমি যে বড্ড বােরিং একটা মানুষ সে-কথা কি কেউ কোনাে দিন বলেছে তােমায়?” সােফায় শুয়ে শুয়েই জিজ্ঞেস করল সহকারি নগরপাল।

মাথা নেড়ে সায় দিলছফা। অনেকেই বলেছে। যদিও সামনাসামনি তাকে এ কথা বলেনি, তবে তার ধারণা, মানুষ হিসেবে সে যথেষ্ট বােরিং।

“যারা বলেছে তাদেরকে আমি স্যালুট দেই,”বলেই সােফা থেকে ওঠার চেষ্টা করলো সুশােভন। আধশােয়া অবস্থায় স্যালুট ঠুকেই ধপাস করে শুয়ে পড়ল।তারপর আর কোনো রা নেই।

ছফা ভালাে করে দেখল তাকে। বেঘােরে চলে গেছে। বাঁচা গেল! মনে মনে বললো সে।

অধ্যায় ৫৯

সুশােভনের এক হাত আর এক পা সােফার প্রান্ত থেকে ঝুলছে।বেঘােরে পড়ে আছে সে। তার ভারী নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনাে শব্দ নেই এ মুহূর্তে। পুরাে ঘরটা অন্ধকারে ঢাকা।

নুরে ছফা নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে আছে বিছানার পাশের চেয়ারে। তার হাতে মােবাইলফোন। চার্জ শেষ হয়ে যাওয়াতে রিচার্জ করতে দিয়েছে, তবে ফোনটা এখনও তার হাতে। রাত প্রায় একটা বাজে। কলকাতা শহরও ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে।  ছফা টের পেল তার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। দীর্ঘক্ষণ ফোনের ছােট্ট ডিসপ্লেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এ অবস্থা। আজকে সে যা জানতে পেরেছে তারপর মনে হয় না রাতে ঘুমােতে পারবে।  ছফা এখন আর ডিপি মল্লিকের পেজ
ব্রাউজ করছে না। ওটা এ পর্যন্ত কতবার দেখেছে তার কোনাে ইয়ত্তা নেই। পুরাে পেজের হিস্ট্রি যতটুকু সম্ভব ঘেঁটে দেখেছে, কোথাও নতুন কিছু পায়নি। যতটুকু পেয়েছে তাতেই সে বিস্মিত।

ডাক্তার আসকারের সঙ্গে কলকাতার নিখোঁজ প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের সখ্য আছে। আর সেই নিখোঁজ সার্জন বাংলাদেশ সফর করার সময় সুন্দরপুরেও গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথে! ছফা ধরেই নিল, মুশকান জুবেরির সঙ্গে ভদ্রলােকের পরিচয় কিংবা সখ্য ছিল। ছফা একদম নিশ্চিত, ডিপিমল্লিককে হত্যা করার পর তার নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দিয়েছে মুশকান।

পেজটা কেন ডিলিট করতে পারল না, সে প্রশ্নের জবাব একটু আগে দিয়ে দিয়েছে সুশােভন:পেজটা ডিপিমল্লিক একা চালাত না। আরও দু-জন অ্যাডমিন আছে, এ কারণে মুশকানের পক্ষে ওটা ডিলিট করা সম্ভব হয়নি।

আবার এমনও হতে পারে, মুশকানের হয়তাে পেজের কথা খেয়ালই ছিল না। ভুল তাে সবারই হয়, আর ভুলের চেয়েও বেশি হয় সমস্যা। হাসিবের বেলায়ও মুশকান হয়তাে সমস্যায় পড়ে গেছিল।কারণ যা-ই হােক, তার অ্যাকাউন্টটা হাতিয়ে নিতে পারেনি।

কয়েক মুহূর্ত ফোনটা নামিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে রাখল সে। একমনে অনেকক্ষণ ভেবে গেল। কিছুবিষয়ে ছফা এখন অনেকটাই নিশ্চিত : মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে যায়, সেখান থেকে কলকাতায়। আর পুরাে কাজে তাকে সাহায্য করেছেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। কলকাতায় আসার পর এখানেও শিকারের সন্ধান করেছে মহিলা। এটা না করে সে থাকতে পারেনি। নেশায় আসক্ত মানুষ নেশাদ্রব্য খুজে বেড়ায় হন্যে হয়ে। মুশকানও কয়েক মাস পরে শিকারে নেমে পড়ে।আর তার প্রথম শিকার সম্ভবত প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকই। লােকটাকে দিয়ে নিজের চেহারা পালটে নিয়েছে মহিলা। তারপর ব্যাপারটা চিরকালের জন্য গােপন রাখতে তাকে হত্যা করে। এখানেই থেমে থাকেনি, এর পরও শিকার করেছে, আর ছফার কাছে আর-একজনের খোজও আছে।

দ্বিতীয়জন!

হঠাৎকরেই তার মনে পড়ে গেল, দ্বিতীয় শিকার নিয়ে সে এখনও কোনাে খোঁজ করেনি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে কোনটা নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

মুশকানের সম্ভাব্য দ্বিতীয় শিকারের নাম সুকুমাররঞ্জন। আইডিয়াল অ্যানালিটিকস্্ সলিউশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের একজিকিউটিভ।বয়স ২৮। অবিবাহিত।নুশকানের শিকারের জন্য একদম উপযুক্ত।

সুকুমার নিখোঁজ হয়েছে বছরখানেক আগে। তার নিখোঁজের সময়কাল হিসেব করে দেখল ছফা ডিপি মল্লিকের নিখোঁজ হবার প্রায় এক বছর পর। দুটো মানুষ নিখোঁজ হবার সময়ের মধ্যে যে ব্যবধান আছে সেটা একটু বেশি বলেই মনে হচ্ছে। তবে সে নিশ্চিত করে জানেও না, মুশকান জুবেরি আসলে কতদিন পর পর শিকার খোজে, কিংবা কতদিন পর তার ওই বিশেষ প্রত্যঙ্গটির দরকার পড়ে! তাছাড়া, এই সময়ের মধ্যে যদি শিকার করেও থাকে ছফার পক্ষে সবগুলাে জানা সম্ভবও নয়।

যাই হােক, সুকুমার রঞ্জনসম্পর্কেআর কোনােতথ্য নেইসুশােভনের দেওয়া তালিকায়।

ছফা অবশ্য একটা বিষয় বুঝতে পারছে, সুকুমার নামটা এমনই কমন যে, ফেসবুকে সার্চ করতে গেলে হাজারটা রেজাল্ট চলে আসবে।তারচেয়ে বরং আইডিয়াল অ্যানালিটিকস্ সলিউশন নামের প্রতিষ্ঠান সার্চ করাটা বেশি বুদ্ধিমানের হবে।

কলকাতার বেশি রাতে নুরে ছফা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মােবাইলফোন নিয়ে। মুশকান জুবেরিকে ধরার যে মিশনে নেমেছে তাতে বিরতি দেবার কোনাে ইচ্ছে নেই তার।

ফেসবুকে সার্চ দিতেই আইডিয়াল অ্যানালিটিকস্ সলিউশন, সংক্ষেপে আইএএস-এর পেজটা পেয়ে গেল। প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই নতুন একটি ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করেঃডেটা অ্যানালিসিস।

বর্তমান দুনিয়ায় যে-কোনাে ব্যাবসার ক্ষেত্রে যে ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ডেটা অ্যানালিটিকস্ সেটা পেইজের শুরুতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে। ব্যাবসার অগ্রগতি দুর্বলতা, উন্নতির সুযােগ বুঝতে তথ্য বিশ্লেষণ করা জরুরি। সারা বিশ্বজুঙ্গে অ্যানালিটিক্যাল টুলের চাহিদা বাড়ছে দিনকে দিন। বিভিন্ন ধরণের কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ি তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রডাক্ট। আর তাকে ঘিরেই শুরু হচ্ছে নানান স্টার্টআপ।

এসব পড়ে হাঁপিয়ে উঠল নুরে ছফা। আইটিবিষয়ক টপিকে তার কোনাে আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই প্রতিষ্ঠানটি কবে থেকে কাজ শুরু করেছে কলকাতায়।  ছফা এর কর্মীবাহিনীর দিকে নজর দিল। প্রচুর ছবি আছে প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ আর হর্তাকর্তাদের। অসংখ্য গ্রুপ ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল সব তরুণ তুর্কিদের যারা কিনা নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন ধরণের এই ব্যাবসাটি। ছবিগুলাে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেল সে।

অধ্যায় ৬০

শেষ রাতের দিকে ঘুম এলেও ছফা উঠে পড়ল সকাল আটটার পরই। এর কারণ হয়তাে দমিয়ে রাখা উত্তেজনা।  ওদিকে সুশােভন যত ড্রিঙ্কই করুক না কেন, তার আগেই উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। এখন ড্রইংরুমে বসে পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে জামা পালটে ফেলল সে। মােবাইলফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করল। কয়েকবার রিং হবার পর কলটা ধরা হল ওপাশ থেকে।

“আসলাম….ঘুমাচ্ছনাকি?” “না,”ওপাশ থেকে বলল পিএসের গানম্যান। “ডাক্তারের কী খবর?” “আইসিসিইউ-র এক স্পেশাল কেবিনে আছে এখন।” “তার শরীর কি বেশি খারাপ?”ছফার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা।

“আরে নাহ!” তিক্ততার সঙ্গে বলল কথাটা। “বুড়ো অ্যাক্টিং করেছে  আগেই বলেছিলাম আপনাকে।”  নীচের ঠোট কামড়ে ধরল ছফা। ডাক্তার তাকে ধোঁকা দিয়েছে ভাবতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

“তবে চিন্তার কিছু নেই,”ছফা চুপ করে আছে বলে আসলাম বলল। “বুড়ো কয়েকটা দিন ওখানেই থাকবে, বের হবে না। আমার নজরদারিতে আছে  চাইলেও বিদেশে যেতে পারবে না, স্যার সেই ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন।”

“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে।“আমি এখানকার কাজ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসতে পারব বলে মনে হচ্ছে। এখানকার কাজে বেশ কিছুটা ডেভেলপমেন্ট হয়েছে, স্যারকে ফোন দিয়ে জানাব।”

আসলাম কিছু জানতে চাইল না আর। “ঠিকআছে। পরে কথা হবে।তুমি ডাক্তারের দিকে নজর রেখাে।”কলটা কেটে দিয়ে উদাস হয়ে চেয়ে রইল নুরে ছফা। এর পর ডাক্তারকে যখন ইনটারােগেট করবে তখন বিন্দুমাত্রও অনুকম্পা দেখাবে না।

“ব্রেকফাস্ট করতে আসাে।”

চমকে তাকাল কণ্ঠটা শুনে। পত্রিকা হাতে সুশােভন দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের দরজার সামনে।

“বসে বসে কী ভাবছ?” “দ্বিতীয়জনের ব্যাপারে আমার কিছু ইনফর্মেশন লাগবে।” কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারল না সুশােভন মিত্র। “দ্বিতীয়জন?” “মুশকান জুবেরির সম্ভাব্য দ্বিতীয় শিকারের কথা বলছি।” “ও….সমস্যা নেই। ব্রেকফাস্টের পর তদন্তকারী অফিসারকে ফোন করে জেনে নেব। এখন চল, ব্রেকফাস্ট করে নেই।বড্ড খিদে পেয়েছে।”

ডাইনীং টেবিলে বসেই তাদের মধ্যে কথা হল।

“দ্বিতীয়জন যে নিখোঁজ হয়েছে তার নাম সুকুমাররঞ্জন,”পরােটা, সবজি টোস্ট আর হরেক রকম ফল সাজানাে আছে টেবিলে।“এক ডেটা অ্যানালিসিস ফার্মে চাকরি করত, নিখোঁজ হয়েছে ডিপি মল্লিকের প্রায় এক বছর পর।”

“আচ্ছা,”মুখে খাবার নিয়ে বলল নগরপাল।

“তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করা তাে প্রায় অসম্ভব, তাই আমি তােমার কথামতাে, ও যেখানে কাজ করত সেই ফার্মের পেজে ঢু মেরেছিলাম, কিন্তু ওখানে সুকুমাররঞ্জন নামে কোনাে এমপ্লয়ির খোঁজ পাইনি।”

“না পাওয়ারই কথা, বছরখানেক আগে নিখোঁজ হয়েছে….পেজটা যেহেতু নিয়মিত আপগ্রেড করা হয় তাই ওর নাম নেই।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। সে-ও খাবারের দিকে মনোযােগ দিল।

“সুকুমার রঞ্জনের কেসটা যে থানা তদন্ত করছে সেখানে ফোন করে জেনে নেব একটু পর, ঠিক আছে?”

“ওকে,” ছােট্ট করে বলল ছফা। “আজকে তাে তুমি ফ্রি আছ, নাকি?”

“শ্বশুড়বাড়ি যাবে না?” “কাল তাে গেছিলাম।”

এ সময় সুশােভনের গৃহকর্মী ছেলেটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। ডাইনীং টেবিলে চা-কফি রেখে চুপচাপ চলে গেল সে।

“অবাঙালি নাকি?” ছেলেটাকে ইঙ্গিত করে বলল ছফা। “দার্জিলিংয়ের।” নাস্তা পর্ব দ্রুত শেষ করে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল ছফা। “আমি যে সূত্র ধরে কলকাতায় এসেছি ওই মহিলাকে খুঁজতে, সেই ডাক্তার আসকারের সঙ্গে ডিপি মল্লিকের ঘনিষ্ঠতার খোঁজ পেয়েছি ফেসবুক থেকে। ভদ্রলােক সুন্দরপুর গেছিল  ওই মহিলার রেস্টুরেন্টে।”

“বলাে কী!” যারপরনাই অবাক হল সুশােভন মিত্র। “তােমাকে তাে আগেই বলেছি, মহিলা ওখানে একটা রেস্টুরেন্ট চালায় “হ্যা-হ্যা  রবীন্দ্রনাথ খেতে যাননি নাকি কী যেন বলেছিল?” “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি।” “মাইরি, নামও দিয়েছে দুর্দান্ত।” প্রশংসার সুরে বলল সহকারি নগর
পাল।

“ডিপি মল্লিক ওই রেস্টুরেন্টের সামনে একটা সেলফি তুলে পােস্ট দিয়েছিল।নাস্তা পর্ব শেষ করে ফেলল ছফা।

“তাহলে তাে ফেসবুক তােমার বেশ কাজে দিচ্ছে।” মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হল নুরে ছফা, যদিও এই সােশ্যাল নেটওয়ার্কের উপর ভীষণ খ্যাপা সে। দিন দিন এটা যে আসক্তি তৈরি করছে সেটা আশঙ্কার বিষয়ঃ অফিসাররাও আজকাল অফিসে ফোন নিয়ে বসে থাকে চোখের সামনে। এ তদন্তনাধীন মামলা নিয়ে ফেসবুকের বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলে! কেউ কেউ এক কাঠি উপরে-তারা নিজেকে জাহির করার জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানায়, আজকে কি করল, কাকে ধরল, কীভাবে ধরল! – “আমি যে তালিকাটি তােমাকে দিয়েছি সেটা নিয়ে আসাে। ওই কেসটা কোন থানা দেখছে দেখি।” ন্যাপকিন দিয়ে ঠোঁট মুছে নিল সুশােভন। তারও নাস্তা পর্ব শেষ।

ছফা উঠে বেডরুমে চলে গেল, ফিরে এল একটু পরই। তালিকাটা নগরপালের হাতে তুলে দিয়ে দেখিয়ে দিল নামটা।

কেস নাম্বারটা দেখে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করল সুশভােন। কল রিসিভ হতেই নিজের পরিচয় দিল সে। সুকুমাররঞ্জনের নাম আর কেস নাম্বারটা বলে বিস্তারিত জানতে চাইল।

ছফা তার দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে। ফোনের ওপাশে যে আছে সে নিশ্চয় কম্পিউটার দেখে তথ্যটা জেনে নিচ্ছে বলে একটু সময় লাগছে।

“ওয়াটগঞ্জ থানা ? আচ্ছা থ্যাঙ্ক ইউ,” ফোনটা রেখে দিল সুশােভন। “ওয়াটগঞ্জ থানা এই কেস তদন্ত করছে।” ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে আর-একটা নাম্বার ডায়াল করল নগরপাল।

সুশােভন নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে শুরু করল ওয়াটগঞ্জ থানার কোন অফিসারের সঙ্গে। “আমার একটা ইনকোয়ারি ছিলাে ”তালিকাটা দেখেনি। নাম আর কেস নাম্বারটা বলল সে।“এই কেসটা যে দেখছে সে কি এখন ডিউটিতে আছে?তার নাম্বারটা দিন ” একটু থেমে ছফার দিকে তাকাল, তার হাতে থাকা প্যাড আর কলমটা ইশারায় চেয়ে নিল সুশােভন। দ্রুত ফোন নাম্বারটাকে টুকে নিলো থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। নােটপ্যাড থেকে নাম্বারটা ডায়াল করল এবার।একটু অপেক্ষা করার কলটা সিরিভ করা হল।

ফোনের ওপাশে তদন্তকারী অফিসারের কাছে সুশােভন আবারও নিজের পরিচয় জাবিয়ে জানতে চাইল, সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজ হবার কেসটা কী অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে একটু কথা বলতে চাইছে।ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ শুনে গেল সে।“হুম..কোনাে সাসপেক্ট?  ছফার দিকে চকিতে তাকাল, “ওহ পালিয়েছে?
….তারপর?”

উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল নুরে ছফা। “সাসপেক্ট ওই ছেলেটার ফ্রেন্ড সার্কেলেরই একজন?”

পরিচিত! মনে মনে বলে উঠল ছফা। মুশকান জুবেরি পরিচিত সার্কেলে কখনও শিকার করবে না বলেই তার ধারণা। তারপরও, কলকাতায় এসে ডিপি মল্লিককে শিকার বানিয়েছে। সুতরাং আবারও পরিচিত মহল থেকে শিকার করার সম্ভবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

“নাম কী ? আচ্ছা….হুম,” ছফার দিকে তাকাল নগরপাল।“নাে প্রবলেম  আমি একটু পর কল দিচ্ছি,”বলেই কলটা কেটে দিল।

“কী বলল?” “ও….অফিসের পথে আছে হেভি নয়েজ। একটু পর কল দিতে বলল।” “সাসপেক্ট পালিয়ে গেছে বলল না?”উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল ছফা। “হুম,”সহকারি নগরপাল বলল। “নাম কী?” “বলল তাে ওর ফ্রেন্ডসার্কেলেরই এক মেয়ে  সুস্মিতা সমাদ্দার।”

অধ্যায় ৬১

সাসপেক্ট একজন মেয়ে।

সুকুমাররঞ্জনের নিখোঁজ ঘটনায় পুলিশ প্রাথমিকভাবে সুস্মিতা সমাদ্দার একজনকে সন্দেহ করেছিল, কিন্তু তদন্ত এগােতেই মেয়েটা পালিয়ে যায়। ছফার কাছে এর অর্থ একদম পরিষ্কার-সুস্মিতাই সত্যিকারের খুনি! আর মহিলা খুনির কথা জানতে পেরে সে আরও বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে।

“কিছু বুঝতে পেরেছ, দাদা?”

মাথা নেড়ে সায় দিল সুশােভন।“সাসপেক্ট একজন মেয়ে  তােমার ওই ডেঞ্জারাস লেডিই হবে মনে হচ্ছে।”

“আমি নিশ্চিত,”জোর দিয়ে বলল নুরে ছফা।“এটা মুশকান।”  “তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে আর-একটু কথা বললেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।” “হুম,”বলল ছফা। এমন সময় সুশােভন মিত্রের ফোনে ইনকামিং কল এল।

“অতনুু মজুমদার….ওই ইন্সপেক্টর,”বলল নগরপাল। তারপরই কলটা রিসিভ করল। “হ্যা, বলুন।” কথাটা বলেই ফোনের স্পিকার অন করে দিল ছফা যাতে শুনতে পায়। কানে চেপে না রেখে হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরে রাখল সেটটা।

“কেসটার এখন কী অবস্থা? আর কোনাে ডেভেলপমেন্ট?”

“খুব বেশি ডেভেলপমেন্ট হয়নি, স্যার,” ওপাশ থেকে অতনুু মজুমদারের কণ্ঠটা শুনতে পেল ছফা।“মরেটরে গেলে তাে একটা ডেডবডি পাই, ওটার সূত্র ধরে এগােতে পারি, কিন্তু নিখোঁজ কেসগুলাে বড্ড টাফ হয়….বুঝতেই পারছেন।”

“হুম,তাঠিক।”সায় দিল সুশােভন মিত্র। পুলিশ হিসেবে সে-ও জানে, অনেক বিচিত্র কারণে মানুষ নিখোঁজ হয়-প্রেমের বিরহে বিবাগী হয় অনেকে; নায়িকা হবার বাসনায় বাড়ির কাউকে না জানিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে চলে আসে কেউ কেউ; টাকা ধার নিয়ে উধাও হয়ে যায় মানুষজন; এমনকি, হুট করে ইসকনে যােগ দেবার ঘটনার কথা তার জানা আছে। বলা নেই কওয়া নেই একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না-অনেক পরে খােজ নিয়ে দেখা গেল, ইসকনের কোনাে আশ্রমে পড়ে আছে।

“ফাইল দেখে ডিটেল বলা যেত….এখন যতটুকু মনে আছে ততটুকুই বলতে পারব।

“সমস্যা নেই, বলুন।”

একটু থেমে ফোনের ওপাশ থেকে বলতে শুরু করল অতনুু মজুমদার, “তদন্তের শুরুর দিকে সুকুমারের পরিচিত অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি, ও প্রায়ই সল্টলেকে যেত সাসপেক্টের বাড়িতে, বন্ধুবান্ধব মিলে গান-বাজনা করত, মস্তি করত,” একটু থেমে আবার বলল, “তাে, ওর এক বন্ধু আমাকে জানাল, ঘটনার দিন সুকুমার ওর কাছ থেকে বেশ ভালাে ব্র্যান্ডের একটি হুইস্কির বােতল নিয়েছিল সুস্মিতাকে গিফট দেবে বলে। আমি সেই সূত্র ধরেই মেয়েটার বাড়িতে গেছিলাম।”

“তারপর ?”

“মেয়েটা যেহেতু অস্বীকার করেছিল সুকুমার ওইদিন ওর ওখানে যায়নি, তাই আমি এটা ডাবল চেক করে দেখলাম। মেয়েটার বাসায় যে দারােয়ান ছিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, সে কদিন আগে জয়েন করেছে মানে, ওই ঘটনার পরে। আমার তখন সন্দেহ হল। আশেপাশের বাড়ির দারােয়ানদের সঙ্গে কথা বলে আগের দারােয়ানকে খুঁজে বের করলাম, স্যার।”

“দ্যাটস গ্রেট,”অতনুুর এই বুদ্ধিটার প্রশংসা না করে পারল না। প্রতিটি মানুষই কোনাে কোনাে কমিউনিটিতে বিলঙ করে। দারােয়ানদেরও নিজস্ব একটি কমিউনিটি আছে। আশেপাশের অন্য দারােয়ানদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তােলাটাই স্বাভাবিক। সারাদিন বাড়ি পাহারা দেবার মতাে বিরক্তিকর কাজ করতে যেয়ে আশেপাশের বাড়ির দারােয়ানদের সঙ্গে খােশগল্প করে তারা। ওইসব দারােয়ানদের অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায়। সুতরাং ওদের মধ্যে কেউ না কেউ তার খোঁজ দিতে পারবেই।

“ওই দারােয়ানকে আমি সুকুমারের ছবি দেখালে সে চিনতে পারে।ও আমার কাছে স্বীকার করে, ওইদিন সুকুমার সল্টলেকের সমাদ্দার ভিলায় গেছিল। দারােয়ানের কাছ থেকে আরও কিছু কথা জানার পর বুঝতে পারি, মেয়েটা  মানে, সাসপেক্ট আমাকে অনেক মিথ্যে বলেছে।”

ছফা এবং সুশােভন উন্মুখ হয়ে রইল পরবর্তী কথাগুলাে শােনার জন্য।

“ওই দারােয়ানের সঙ্গে কথা বলার পরই আমি মেয়েটার বাড়িতে আবার যাই, কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি বাড়িতে তালা ঝুলছে। মেয়েটাকে আর পাইনি, স্যার।” হতাশ কণ্ঠে জানাল অতনুু।“আগের দারােয়ান আমাকে বলেছিল, ওই বাসার তিন তলায় মেয়েটার এক কাজিন থাকত, সেই মেয়েটাও উধাও। এমনকি দারােয়ানও নেই। প্রথমবার জিজ্ঞাসাবাদের সময় মেয়েটার ফোন নাম্বার নিয়ে নিয়েছিলাম, ওই নাম্বারে কল করে দেখি ফোনটা বন্ধ। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না  সাসপেক্ট পালিয়েছে।” একটু থেমে আবার বলল ইন্সপেক্টর, “আমি তখন মেয়েটার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে তালা ভেঙে বাড়িটা তল্লাশি করি।”

“ওখান থেকে কিছু পেয়েছিলেন?”

“দেখে মনে হয়েছে, খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ছেড়েছে সাসপেক্ট, কোনো আসবাবপত্রই নিতে পারেনি। দোতলায় মেয়েটা যে ঘরে থাকত সেখানে তল্লাশি চালিয়ে কিছু পাইনি। তবে নীচতলার একটি ঘরে মেয়েটার একটি ছবি পেয়েছিলাম। সম্ভবত ওটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছিল।”

“তার মানে সাসপেক্টের ছবি আছে আপনার কাছে?” “হ্যা, স্যার। ওই ছবিটাই আমি কপি করে সবখানে সার্কুলের করে দেই তখন।” “হুম,” গম্ভীর হয়ে বলল সুশােভন। “এরপর পুরাে বাড়িটা সিল করে দেই। এখনও বাড়িটা অমনই আছে।”

“স্ট্রেঞ্জ,”অস্ফুটকণ্ঠে বলে উঠল সহকারী নগরপাল।“এরকম জায়গায় একটা বাড়ি ফেলে চলে গেল, আর এতদিনেও কেউ এসে দাবি করল না?”

“সেটাই, স্যার। আমি খোঁজনিয়ে দেখেছি, বাড়ির মালিকানা সাসপেক্টের মা শুভমিতা সমাদ্দারের নামে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, মেয়েটার মা মারা গেছে ক-বছর আগে  লন্ডনে।তার কোনাে আত্মীয়স্বজনের টিকিটাও খুঁজে পাইনি। আশপাশের বাড়ির লােকজনও আমাকে কিছু বলতে পারেনি, স্যার। ওরা সুস্মিতাকে ঠিকমতাে চেনেও না। মেয়েটা বেশির ভাগ সময় লন্ডনেই ছিল, কিছুদিন ছিল শান্তি নিকেতনে।”

“আচ্ছা, মেয়েটার ছবি কি দেওয়া যাবে?” “যাবে, স্যার। আমি স্টেশনে গিয়ে ফাইল থেকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিতে পারব।” “গুড। আপনি আমার হােয়াটসআপে দিয়ে দেবেন, ঠিক আছে?”

“ওকে, স্যার,”অতনুু মজুমদার বলল।মেয়েটা আমায় বলেছিল, ওর বাবা বিদেশে থাকে, ওর সঙ্গে তেমন একটা যােগাযােগ নেই। ওর বাবা-মার ইন্টার-রিলিজিওন ম্যারেজ  বাবা মুসলিম, মা ব্রাহ্ম। সল্টলেকের বাড়িটা ওর মা পেয়েছিল বড়ােবােনের কাছ থেকে  ভদ্রমহিলা বিয়েটিয়ে করেননি মারা যাবার আগে ওই বাড়িতেই ছিলেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিল সুশােভন মিত্র।   “আমি আর-একটু খোঁজবর নিয়ে জানতে পারলাম, সাসপেক্ট মেয়েটা শান্তিনিকেতনে ভর্তি হলেও পড়াশােনার পাট সম্ভবত চুকোতে পারেনি,”একটু থামল পুলিশ অফিসার। “মায়ের মৃত্যুর পরও ওখানেই ছিল কিছু দিন তারপর হুট করেই আবার চলে আসে কলকাতায়।”

ছফা আস্তে করে সুশােভনের কনুইতে হাত রাখল। ইশারা করল-ঘটনাটা কবেকার। “এটা কবেকার ঘটনা  মানে, মেয়েটা কলকাতায় এসেছিল কবে?”  “সম্ভবত সুকুমার নিখোঁজের কয়েক মাস আগে।”

ছফার দিকে তাকাল সুশােভন। সে এর মধ্যেই নােটপ্যাডে টুকে রাখতে শুরু করে দিয়েছে তথ্যটা।

“মেয়েটাকে যখন প্রথমবার জিজ্ঞেস করি তখন সে আমায় বলেছিল, ওর সঙ্গে

সুকুমারের পরিচয় শান্তিনিকেতনের এক বন্ধুর মাধ্যমে।”

“হুম,”আস্তে করে বলল সুশােভন।

“মেয়েটা ব্রিটিশ সিটিজেন,”একটু থেমে আবার বলল ইন্সপেক্টর,“ও আমাকে বলেছে, বাবার সঙ্গে ওর কোনাে সম্পর্ক নেই। ওর মা কখনও বাবার নামও বলেনি। আমার কাছে এটা ক্রেডিবল মনে হয়নি, স্যার।”

ছফা আর সুশােভনের মধ্যে চোখাচোখি হল। তাদের কাছেও এটা অবিশ্বাস্য লাগছে।

“এ কারণে আমি মেয়েটাকে তখনই বলে দিয়েছিলাম, লােকাল থানায় ইনফর্ম না করে যেন কলকাতার বাইরে না যায়।”

মাথা নেড়ে সায় দিল নগরপাল।“ও কোথায় গেছে বলে আপনি মনে করছেন?”

“নিশ্চিত করে তাে বলতে পারব না, স্যার। তবে ভারতবর্ষ অনেক বড়ো  সম্ভবত অন্য কোনাে রাজ্যে চলে গেছে।” একটু থেমে আবার বলল, “আমার ধারণা ওকে পালাতে সাহায্য করেছে ওর বাবা।”

অবাক হল সুশােভন।“ওর বাবা!” “হ্যা, স্যার।”

‘আপনি না বললেন, ওর বাবার সঙ্গে ওর কোনাে সম্পর্ক নেই..এমনকী নামটাও জানে না?”

“মেয়েটা আমাকে সেরকমই বলেছিল কিন্তু আগের দারােয়ানআমাকে বলেছে, মেয়েটার বাবা সল্টলেকের বাসায় মাঝেমধ্যেই আসত।”

ভুরু কপালে তুলে পাশ ফিরে তাকাল সুশােভন। ছফারও একই অবস্থা। উদগ্রীব হয়ে বাকিটা শুনতে চাইছে সে।

“ও কেন ওর বাবার পরিচয় লুকোল সেটা আমার কাছে খুবই রহস্যময় লেগেছে।” “হুম,”মাথা নেড়ে সায় দিল সহকারি নগরপাল।

“বাবার নামটা কি বের করতে পেরেছিল,অফিসার?”সুশােভনের কানে ফিশফিশিয়ে বলল ছফা।

“ওর বাবার নামটা কি আপনি বের করতে পেরেছিলেন?”

“হ্যা, স্যার। ওই দারােয়ানই আমায় বলেছিল, ভদ্রলােক নামকরা ডক্টর  লন্ডনে থাকেন। আসকার না কী যেন নাম বলেছিল আমায়। ফাইল দেখে নিশ্চিত করে বলতে পারব।”  কথাটা শুনে সােজা হয়ে বসল ছফা। সে এখন পুরােপুরি নিশ্চিত-এই সুস্মিতা আসলে কে! এ নিয়ে তার মধ্যে আর কোনাে সংশয় নেই!

অধ্যায় ৬২

দৃশ্যপটে ডাক্তার আসকারের আবির্ভাব নুরে ছফাকে খুব একটা বিস্মিত করেনি। ঢাকায় থাকতেই বুঝে গেছিল, এই ভদ্রবেশি ডাক্তার মুশকানের একমাত্র সহযােগী।

এখন ছফার কাছে সবটাই পরিষ্কার। মুশকানকে মেয়ের পরিচয় দিয়ে কলকাতায় নিজের শ্বশুড়ালয়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ডাক্তার। তারপর পূর্ব-পরিচিত এক প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়ে মুশকানের চেহারাটাও পালটে ফেলার আয়ােজন করেন। কাজশেষে, চেহারা পালটানাের কথাটা চিরতরে গােপন রাখার জন্য ওই সার্জনকে হত্যা করে মহিলা।

সুশােভন এখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে অতনুু মজুমদার নামের পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। ছফা আবারও তাদের ফোনালাপে মনােযােগ দিল।

“ওকে,”বলল সুশােভন মিত্র।“থ্যাঙ্ক ইউ, ফর ইওর কোঅপারেশন।”কলটা কেটে দিয়ে ছফার দিকে তাকাল সে।‘কী বুঝলে?”

“আমি জানতাম মুশকান জুবেরি আমেরিকান সিটিজেন, এখন দেখছি তার ব্রিটিশ পাসপাের্ট আছে।” “আমেরিকান পাসপাের্ট হােল্ডারদের পক্ষে ব্রিটিশ সিটিজেনশিপ বাগানােটা কী আর এমন কঠিন কাজ।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেছে তার। ডাক্তার আসকারও তাকে বলেছিলেন, আন্দিজের কথা জানাজানি হয়ে গেলে মুশকান আমেরিকা ছেড়ে ব্রিটেনে চলে যায়। তবে ডাক্তারের নতুন এই গল্পে ওই মুশকান হল মুশকান জুবেরির মা! ভদ্রলােকের নতুন গল্পটি জটিল আর দুর্বোধ্য গােলকধাঁধা তৈরি করেছে। মুশকান যদি রুখসান হয়ে থাকে, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভক্ষণ করে চিরযৌবন লাভের কথাটা যদি সত্যি না হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতায় এসে মুশকান কেন পুরুষ শিকার কবল? চেহারাই বা পালটানাের চেষ্টা করবে কেন? চেহারা পালটানাের ব্যাপারটা গােপন রাখার জন্য যদি ডিপি মল্লিককে হত্যা করে থাকে, তাহলে সুকুমাররঞ্জনকে কেন শিকার বানাতে গেল।

তার মানে, ডাক্তার আসকার সুকৌশলে সত্য-মিথ্যার মিশেলে এমন এক গল্পের অবতারণা করেছেন, ছফা যাতে বিভ্রান্ত হয়। ডাক্তারের কোন কথাটা সত্য আর কোন মিথ্যে তা জানতে হলে, মুশকান জুবেরির রহস্যের সবগুলাে পাজলের টুকরাে মেলাতে চাইলে ওই মহিলাকে হাতের মুঠোয় নিতে হবে সবার আগে।

“এখন কি করবে তাহলে?”

সংবিৎ ফিরে পেয়ে সুশোভনের দিকে তাকালো ছফা।অতনুু সল্টলেকের ঠিকানাটা টেক্সট জোরে পাঠিয়ে দিয়েছে,নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল সুশোভন।সরজমিনে গিয়ে দেখা উচিত,যদিও গিয়ে কোনো লাভ হবে না।আমিও ভাবছি…বলল নুরে ছফা।দেখে মনে হয় টেনশনে আছে।….সিগারেট খাবে?

সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল ছফা।

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে।দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ বসে রইলো কয়েক মুহূর্ত।

“তুমি যে এত তাড়াতাড়ি সাপেক্টকে ট্রেস করতে পারবে আমি কিন্তু আশা করিনি,” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সহকারী নগরপাল বলল।

“এজন্যে তোমার কাছে আমি ঋণী। তুমি অনেক হেল্প করেছ, তুমি না থকলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব হত না।” প্রসন্ন হাসি দিল সুশোভন,কিছু বলতে যাবে অমনি ফোনটা বেজে উঠলো। “অতনুু মনে হয় সাসপেক্টের ছবি পাঠিয়েছে।”

কথাটা শোনামাত্রই উন্মুখ হয়ে উঠলো।মুশকান জুবেরি চেহারা পাল্টে কি অবস্থানে আছে সেটা দেখতে তর সইছে না তার।  “এই
যে, দেখাে,”ফোনটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিল সুশোভন।

ফোনের ডিসপ্লেতে যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছে সেটা নুরে ছফাকে ঝাকুনি দিল যেন বিস্ময়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত হবার উপক্রম হল তার!

‘মাই গড!” তার মুখ দিয়ে অস্ফুট ধ্বণি বের হয়ে গেল।

অধ্যায় ৬৩

ঢাকায় ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাড়ি থেকে একটু দূরে কালাে রঙের একটি প্রাইভেট কারে বসে আছে আসলাম। সকাল এগারােটা থেকে ধৈর্য নিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়িটার দিকে নজর রাখছে সে।বাড়িতে যে ওই মেয়েটা আছে সেটা জানে। সঙ্গে আছে আর-একটা ছেলে। এখন পর্যন্ত দারােয়ান একবারের জন্যেও গেটের কাছে আসেনি। মেইন গেটের নীচে, মেঝে থেকে যেটুকু ফাঁক আছে সেখানে কড়া নজর রেখেছে সে, কোনাে মানুষজনের পা দেখতে পায়নি।

এই বিশাল বাড়িতে মাত্র তিনজন মানুষ আছে দু-জন পুরুষ আর এক তরুণী। আসলাম মেয়েটার সাহসের প্রশংসা করল মনে মনে। দু দুটো সিংহের সঙ্গে একই খাঁচায় একটা হরিণ কীভাবে অক্ষত থাকে! সে নিজেও একজন পুরুষ মানুষ, ভালাে করেই জানে, এরকম অবস্থায় বেড়ালও সিংহ হয়ে যেতে পারে। আর সেই সিংহ প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়বে হরিণের উপরে। ছিড়ে খুবলে খাবে তাকে।

তার বস পিএস আশেক মাহমুদ গােপন এক সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ওই তরুণী ডাক্তারের খুবই ঘনিষ্ঠ কেউ হয়। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এই বিশাল বাড়িতে মেয়েটার কোনাে ক্ষতি করার সাহস হয়তাে করবে না কেউ। তারপরও কথা থাকে, পুরুষগুলাের যদি মতলব খারাপ হয়, তাহলে যে কোনাে কিছুই ঘটে যেতে পারে। বহু বছর আগে এক শিল্পপতির মেয়ের ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের কথাটা মনে পড়ে গেল। তার বাড়ির কাজের লােকেরাই করেছিল জঘন্য কাজটা। শিল্পপতি ভেবেছিলেন, এতগুলাে কাজের লোক-যাদের মধ্যে মেয়েছেলেও আছে তার মেয়েটা নিরাপদেই থাকবে। কিন্তু সেটা হয়নি। কিশােরী মেয়েটাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে ধর্ষকের দল।

ওই মেয়েটাকে দেখে তার অন্য একজনের কথা মনে পড়ে গেছিল, যার সঙ্গে তার এখন কোনাে সম্পর্কই নেই।

মনীষা দেওয়ান!

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আসলামের ভেতর থেকে। পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দেবার আগে রাঙামাটি থানাই ছিল তার শেষ পােস্টিং। সন্তানের স্কুল বদলাতে হবে বলে তার স্ত্রী আর রাঙামাটিতে আসেনি, ঢাকাতেই নিজের বাপ-মায়ের কাছে থেকে গেছিলো আসলামও এ নিয়ে জোর করেনি। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে তার শীতল সম্পর্ক। তাদের বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবে, বাবা-মায়ের পছন্দে। কিন্তু বিয়ের দু-বছরের মাথায় এসে আসলাম যখন জানতে পারে তার স্ত্রী সােমার সঙ্গে এক ছেলের সম্পর্ক আছে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের প্রথম এবং একমাত্র সন্তান আরাফ তখন মায়ের পেটে বেড়ে উঠছে। তার স্ত্রী স্বীকার করে বলেছিল, কলেজ জীবনের বন্ধু, এর বেশি কিছু না। নিছক খোঁজখবর নেবার জন্য ফোন দেয় ছেলেটা। আসলাম বিশ্বাস করেছিল তার স্ত্রীকে কিন্তু সন্তান জন্মাবার পরও সােমা তার সেই কথিত বন্ধুর সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ রাখত। আসলামের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলে সে ইনফর্মার লাগিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলে স্ত্রীকে। এরপর তাদের সন্তানের মাথা ছুঁয়ে কসম খেয়ে সােমা বলেছিল, ওই ছেলের সঙ্গে তার কোনাে সম্পর্ক নেই। সে আর যােগাযোেগও রাখবেনা ওর সঙ্গে। আসলাম আবারও বিশ্বাস করেছিল স্ত্রীর কথা, ক্ষমাও করে দিয়েছিল। কিন্তু বছর গড়াতেই টের পায়, ভেতরে ভেতরে স্ত্রীর এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি সে। তার ভেতরে ছাইচাপা আগুন ঠিকই জ্বলছিল।

পুলিশের জীবনে অনেক লাশ দেখেছে আসলাম। সব লাশই বরফের মতাে হিম শীতল হয়ে থাকে। ঠিক সেভাবে, সম্পর্কের মৃত্যু ঘটলেও সেটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। এক সময় বরফ-শীতল হয়ে ওঠে। ধৈর্য কিংবা অভিনয় দিয়ে সেই শীতলতা বেশি দিন সহ্য করা যায় না।  তাে, এমন সময় রাঙামাটিতে পােস্টিং হলে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিল সে। স্ত্রীর অভাব বােধ করত না, তবে তার সন্তান আরাফের জন্য খুব খারাপ লাগত। রাঙামাটি থানা থেকে নিজের বিশাল কোয়ার্টারে ফিরে এসে নিঃসঙ্গ সময় কাটাত আসলাম। কালেভদ্রে তার স্ত্রী খোঁজ নিত। আর যখন নিত, তখন সেটার মধ্যে কোনাে আন্তরিকতা খুঁজে পেত
না। তার কাছে মনে হত পুরােপুরি আন্তরিকতা বিবর্জিত একটি ফোনকল দায় সেরে নেবার জন্যই করা।  এরকম নিঃসঙ্গ আর একাকী সময়েই তার সঙ্গে পরিচয় হয় কলেজ পড়ুয়া মনীষা দেওয়ানের সঙ্গে।মিষ্টি চেহারার হালকা-পাতলা গড়নের এই চাকমা মেয়েটি তার হৃদয় হরণ করে ফেলে খুব দ্রুত। চমৎকার বাংলা বলত
মনীষা। এই মেয়ে তাকে যে ভালােবাসা দিয়েছিল সেটার কোনাে তুলনাই হয় না। আসলাম সেই প্রথম সত্যিকারের ভালােবাসার দেখা পেয়েছিল। তার এমন আহামরি সম্পদ ছিল না যে, নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো কারাের সঙ্গে প্রেম করতে যাবে মনীষা।বয়স-জাতি-ধর্ম সব পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছিল মনীষার সেই অপ্রতিরােধ্য নিখাদ ভালােবাসা। এমন ভালােবাসা পেয়ে তার উচিত ছিল সব কিছু ভুলে গিয়ে স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেওয়া, কিন্তু আসলাম সেটা করেনি। মাথা গরম করে হুট করেই একদিন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যেটা তার জীবনটাই পালটে দেয়।

সেলফোনের রিংয়ের শব্দ আসলামের অতীত চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাল। পকেট থেকে ফোনটা বের করেই দেখতে পেল পিএস কল করেছে।

-“কী অবস্থা?”

“বাড়ির বাইরে আছি ওরা কেউ বের হয়নি।”

“শােন, আমাদের প্ল্যানে একটু পরিবর্তন করতে হচ্ছে। তােমাকে এখন একটা কাজ করতে হবে খুবই সাবধানে।”

বলন, স্যার,” উদগ্রীব হয়ে বলল আসলাম। তারপর ওপাশ থেকে শুনতে পিএসের নতুন প্ল্যানের কথা। তবে খুব একটা অবাক হল না সে। আগেই জানত, এরকম কিছু করার দরকার হতে পারে। পিএসের কথা শােনার পর সে বলল, “কোনাে সমস্যা নেই।”

“গুড। লােকেশন আগেরটাই, ওকে। তাহলে সেলিম আর বদরুলকে পাঠিয়ে দেই?” ‘না, স্যার  দরকার নেই। আমি একাই পারব।” “একাই পারবে?”অবাক হল পিএস।  “জি, স্যার।”আশ্বস্ত করে বলল সে। “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ফোনের ওপাশে নীরবতা নেমে এল।“ওকে….সাবধানে কাজটা কোরাে।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

ফোনটা কেটে গেলে আসলাম তার সমস্ত মনােযােগ নিবদ্ধ করল বাড়িটার দিকে। তার বসের কোনাে ধারণাই নেই কতাে সহজে আর নিখুঁতভাবে কাজটা করবে সে। এই জীবনে একটা কাজেই ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছিল, আর সেটাই তাকে বিরাট রকমের শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। বার বার ভুল করার মতাে লোক সে নয়।

বাড়িতে ঢুকে একটা হট্টগােল সৃষ্টি করার চেয়ে আসলাম যেটা করবে সেটা অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত আর শৈল্পিক হবে।

এখন শুধু ঠান্ডা মাথায় অপেক্ষা করার পালা।

অধ্যায় ৬৪

রাতে ভাল ঘুম হয়নি সুস্মিতার। ওষুধ ছিল না বলে সারাটা রাত জেগে জেগে কাটাতে হয়েছে। তবে ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে মশগুল না থাকলে ঘুমটা ঠিকই আসত।। সত্যি বলতে, আগে তার এই বদঅভ্যেস ছিল না। কিন্তু এই নিঃসঙ্গ জীবনে ভার্চুয়াল দুনিয়াই হয়ে উঠেছে তার একমাত্র সঙ্গি। রীতিমতাে আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে এটা। একটু পর পর ফেসবুকে আর মেসেঞ্জোরে ঢুঁ মারাটা তার বাতিক হয়ে গেছে। ক-দিন আগে নেটে একটা আর্টিকেল পড়েছিল, হারভার্ডের এক দল গবেষক নাকি দীর্ঘদিন রিসার্চ করে দেখেছে, ১৬ থেকে ৩০ বছরের ছেলেমেয়েদের ৪৫ বার প্রায় সারাক্ষণই কোনাে না কোনাে অনলাইন সাইটে ঢুঁ মারে। গড়ে ৯ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে এসবের পেছনে। প্রতিদিন এরা গড়ে ৯৬ বার ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম আর মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সাইটে ঢুঁ মারে। ত্রিশের উপরে যারা আছে, তাদের আসক্তির হারও অবিশ্বাস্য রকমের বেশি-দিনে ৩৫ বার। স্বাভাবিক মানসিক সুস্থতার জন্য ঢুঁ মারার এই হারটা নাকি ১০-এর নীচে থাকা বাঞ্ছনীয়।

প্রথমে তার বিশ্বাসই হয়নি। ৩৫ থেকে ৯৬ বার! এত! নিজেকে প্রশ্ন করেছিল সে: কী করে সম্ভব! এটা হতেই পারে না। সে বড়জোর ৭/৮ বার ঢুঁ মারে,এর বেশি না। কিন্তু হারভার্ডের মতাে প্রতিষ্ঠানের উপর তার অগাধ আস্থা রয়েছে, তাই নিজের আসক্তিটা কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটা যাচাই করে দেখেছিল খুবই নিরপেক্ষ আর নির্মোহ উপায়ে। অ্যাডিটেক্ট’ নামের ছােট্ট একটি অ্যাপ নামিয়ে ইন্সটল করে নিয়েছিল।ওই আর্টিকেলেই দেওয়া ছিল অ্যাপটার লিঙ্ক-ওটার কাজই হল, ইউজার কতবার কোনসাইটে কখন ঢুঁ মারল সে হিসেব রাখা। ইন্সটল করার পর দিন সকালে খুব অবাক হয়ে দেখে, আগের দিন ৮৮ বার ঢুঁ মেরেছে! সে কোনাে টিনএজার নয়, তার জন্য সংখ্যাটা অনেক অনেক বেশি!  যাই হােক, রাতে ঘুমােতে যাবার আগেও এই স্মার্টফোনটা থাকে তার হাতে। আর নিদ্রাহীনতার কারণও এটাই! তবে গতকাল সে পণ করেছিল ঘুমােতে যাবার আগে ফেসবুক-মেসেঞ্জারে
ঢুঁ মারবে না। কারণ পরদিন এয়ারপাের্টে যেতে হবে তাকে। ঢাকা টু যশাের, তারপর ওখান থেকে সােজা চলে যাবে সুন্দরপুরে। তার ছােটো ছােটো ছাত্রছাত্রীদের খুবই মিস করছে। তাছাড়া ঢাকা শহর তার একটুও ভালাে লাগে না। শহরটার শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য-কোনােটাই সহ্য হয় না তার। সুন্দরপুরের মনােরম পরিবেশ আর প্রকৃতির মধ্যেই আপাতত থিতু হয়েছে সে।

কিন্তু যে পণ করেছিল সেটা আর রাখতে পারেনি-রাত দুটো পর্যন্ত ফেসবুক-মেসেঞ্জারে ঢুঁ মেরেছে। কেন করেছে সে নিজেও জানে না। যেমন জানে না এ গ্রহের শত মানব সন্তান।

এখন ঢুলু ঢুলু চোখে বিছানায় শুয়ে আড়মােড়া ভেঙে দেয়াল ঘড়িতে তাকাল। বারােটা।এখনও আলসেমি ছাড়েনি তাকে। বিছানায় একটু গড়াগড়ি দিল। উঠতে চাইছে না। তার হাতে এখনও দু-ঘণ্টার মতাে সময় আছে। তারপর ঢাকা শহর বলে কথা, অনেক জ্যাম হয় এয়ারপাের্ট রােডে,হাতে তাই সময় নিয়ে বেরােতে হবে। অগত্যা জোর করেই বিছানা থেকে শরীরটা তুলে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল।

আধঘণ্টা পর পুরােপুরি ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এল সে। সকালে শাওয়ার না নিলে তার ভালাে লাগেনা। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যেস। গায়ে একটা টি-শার্টআর ট্রাউজার পরে ড্রইংরুমে এসে দেখল শ্যামল টিভি দেখছে চুপচাপ।“ব্রেকফাস্ট করেছ, শ্যামল?”

– “হ্যা, দিদি।”হাসি দিয়ে বলল ছেলেটা।“আপনিও করে নেন। টেবিলে নাস্তা রেডি এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে মনে হয়।প্রসন্নভাবে হেসে ডাইনীং টেবিলে চলে গেল সে। নাস্তা শেষ করে আরও পনেরাে মিনিট সময় নিল জামাকাপড় পালটাতে। ড্রইংরুমে এসে বলল, “আমরা এক্ষুনি বের হচ্ছি।”

“আচ্ছা, দিদি,”কথাটা বলেই পাশের ঘরে চলে গেল ছেলেটা।  ফোনটা হাতে নিয়ে উবার ডাকল সে।মিনিটখানেক পরই ড্রাইভার কল দিলে তাকে এই বাড়ির লােকেশন জানিয়ে দিল।  ফোনের ডিসপ্লে-তে নেভিগেশন বলে দিচ্ছে, উবারের ড্রাইভার ঠিক মতােই এগােচ্ছে। অ্যারাইভাল টাইম পাঁচ মিনিট।

কিছুক্ষণ পরই শ্যামলকে সঙ্গে নিয়ে নীচে চলে গেল সে। ছেলেটার হাতে ছােট্ট একটা লাগেজ।এ বাড়ির কেয়ারটেকার ওয়াহাব তাদেরকে দেখেই মেইনগেটটা খুলে দিল। গেটের বাইরে কালাে রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াহাবকে দুশাে টাকা বখশিশ দিয়ে বের হয়ে  গেল সে।পেছনের সিটে শ্যামলকে নিয়ে বসতেই সানক্যাপ পরা
উবারের ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল।

গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকাল। ঢাকা শহরের অন্য অংশের তুলনাম  বনানী বেশ ছিমছাম। তারপরও এখানে থাকতে পারেনি বেশিদিন।এবার ফোনের দিকে নজর দিল, যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফেসবুক নিয়ে। তার পা
শে চুপচাপ বসে ঢাকা শহর দেখে যাচ্ছে শ্যামল। এর আগে ছেলেটা কখনও ঢাকায় আসেনি, তার কাছে নিশ্চয় শহরটা ভালােই লাগছে।

খুব দ্রুতই ফেসবুকের বিচিত্র সব মানুষজনের বিচিত্র সব পােস্ট আর কমেন্টে হারিয়ে গেল সে। তার কাছে মনে হয়, এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষই নানান রকম মানসিক রােগে আক্রান্ত। সােশ্যাল নেটওয়ার্কের এই আসক্তি তাকেও রেহাই দেয়নি। সেই আর্টিকেলের কথাটা আবারও মনে পড়ে গেল। ওটাতে গবেষকেরা জানিয়েছে, মদ্যপান আর জুয়াখেলায় আসক্ত হলে মানুষের মস্তিষ্কে নাকি এক ধরণের পদার্থ নির্গত হয় নামটা এ মুহূর্তে মনে করতে পারছে না সে ওই একই পদার্থ ফেসবুক আসক্তির বেলায় প্রায় তিনগুণ বেশি নির্গত হয়!  পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান! মাথার ভেতরে গুনগুনিয়ে উঠল গানটা।  হঠাৎ করে তার মাথায় আর-একটি চিন্তার উদ্রেক হল। বিষে বিষক্ষ
য়! পুরােনাে বাংলা প্রবাদ এটি, খনার বচন কিনা সে জানে না-যাই হােক, সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে অতিরিক্ত ফেসবুক আসক্তি দূর করতে হলে আরও বেশি করে আসক্ত হবার দরকার আছে, নাকি? বেশি আসক্তির ফলে একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। এভাবে কেটে যেতে পারে আসক্তিটা!

মনে মনে হেসে ফেললাে সুস্মিতা। এটা হল মানুষের মস্তিষ্কের সেই অংশের কারসাজি,  যেটা সব রকম অনিয়ম আর অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গায়, যুক্তি খুঁজে বেড়ায়! তার মধ্যে
এই যে চিন্তার উদ্রেক হয়েছে, সেটাও মস্তিষ্কের সেই অংশের কাণ্ড!

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেটিয়ে বিদায় করার আগেই প্রবলভাবে ঝাকি খেল সে। সামনের দিকে হুড়মুড় করে ছিটকে গেল, হাত থেকে পড়ে গেল তার স্মার্টফোনটা।অবিশ্বাসে চেয়ে দেখল, একটা বাড়ির ড্রাইভওয়েতে হার্ড ব্রেক করে থেমে পড়েছে উবারের গাড়িটা!

ড্রাইভারকে যেইনা বলতে যাবে, কী হয়েছে—তার আগেই দেখতে পেল অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য! উবারের ড্রাইভারের হাতে পিস্তল! আর সেটা তাক করে রেখেছে ঠিক তার  দিকেই!

চিৎকারটা না দিয়ে পারল না সে।  “একদম চুপ!” উবারের ড্রাইভার পিস্তলটা নেড়ে ধমকের সুরে বলল। “আওয়াজ করলেই গুলি করে দেব!”  মুখে হাতচাপা দিল সে। এদিকে মূৰ্ছা যাবার উপক্রম হল শ্যামলের। জীবনে কখনও এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি সে।

অধ্যায় ৬৫

লাঞ্চের পর আয়েশ করে এক চা কাপ খাওয়া খােদাদাদ শাহবাজ খানের – অভ্যাস। শরীর ভালাে থাকুক আর খারাপ, চা কখনও বাদ যায় না। আজ ঘুম থেকে তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে ওঠার পরই বুঝতে পেরেছিল, সারাটা দিন মাথার ওপর দিয়েই যাবে।গতকাল এটা গিয়েছিল ঘাড়ের ওপর দিয়ে!

আইনস্টাইনকে চা আনতে পাঠাবেন কিনা বুঝতে পারছে না। একটু আগেই খাবার খেয়েছে। এখন যদি চায়ের কথা বলে পিচ্চি আইনস্টাইন বয়ােজ্যেষ্ঠদের মতো শাসনকরে বলবে, এই অবেলার চা খাওয়া ঠিক না।  মুচকি হাসি ফুটে উঠল কেএস খানের ঠোটে দিন দিন ছেলেটার খবরদার
ি বাড়ছে—আর সে-ও এটা উপভােগ করে। সবাই কমবেশি শাসিত হয় কিন্তু কয়জনের ভাগ্যে ভালােবাসার শাসন জোটে?

নিজের সিঙ্গেল বিছানাটায় বসে আছে সে। এই অখণ্ড অসের বই পড়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজে, কিন্তু মাথাব্যথা সেটা থেকে বিরত রাখছে তাকে। তার শরীর যত খারাপইহােক,বইপড়ায় বিরতি দেয় না কখনও, কিন্তু মাথাব্যথা হলেই ছেদ পড়ে তাতে।

বিছনায় বসে উশখুশ করতে লাগল কেএস খান। ঘুমিয়ে যে সময় পারবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। অবেলায় তার ঘুম আসে না কখনও কিছু একটা দরকার, কিন্তু কী করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। নতুন একটা মােবাইলফোন কিনেছে গতকাল, সেই সঙ্গে সিমও। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার এই নতুন নাম্বারের কথা জানে না। ডাক্তার লুনাকে ফোন করবে কিনা বুঝতে পারল না। তার খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু এ সময় হাসপাতালের ডিউটিতে ব্যস্ত আছে সে।

এমন সময় তার ল্যান্ডফোনটার রিং বেজে উঠলে খুশি হল কেএস খান। রিসিভারটা ক্র্যাডল থেকে তুলে নিল সঙ্গে সঙ্গে।

“হ্যালাে?”

“স্লামালেকুম, স্যার,”ফোনের ওপাশ থেকে বলল নুরে ছফা। “ওয়ালাইকুম সালাম,” ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিল সে। “কেমন আছেন, স্যার?….শরীর ভালাে?” “আর শরীর! একদম কী সুস্থ থাকি,”কথাটা হাসিমুখেই বলল সাবেক ডিবি অফিসার। “কলকাতার খবর কী? ওইখান থেইকা আইসা পড়ছেন যে এত তাড়াতাড়ি। কিছু পান নাই ?”

“স্যার, আমি এখন বেনাপােল বর্ডার পার হয়ে সুন্দরপুরে যাচ্ছি।” কথাটা শুনে অবাক হল খােদাদাদশাহবাজ খান।“আবার সুন্দরপুর যাইতাছেন ক্যান? আপনে তারে কলকাতায় ট্রেস করবার পারেন নাই?”  “ওখান থেকেই তার হদিস পেয়েছি, স্যার।”

“মুশকান জুবেরি এখন সুন্দরপুরেই আছে!”

‘সুন্দরপুরে আছে!?” কেএস খান যেন সাসপেন্স নভেল পড়ার উত্তেজনায় পড়ে গেল। “এইটা কেমনে সম্ভব! আপনে না ওইখানে গেছিলেন কয়দিন আগে….তখন তাে তারে পান নাই!”

“স্যার, লম্বা গল্প  দেখা হলে সবটাই বলব, এখন সংক্ষেপে বলছি।” “বলেন বলেন,”তাড়া দিল সে।“আমি তাে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবার পারতাছি না।”

এরপর ফোনে যতটুকু সম্ভব কলকাতা থেকে কীভাবে নিখোঁজদের তালিকা অনুসন্ধান করে প্লাস্টিক সার্জনের খোঁজ পেয়েছিল, আর সেখান থেকে মুশকান জুবেরির নতুন পরিচয় সুস্মিতা সমাদ্দারের হদিস পেয়েছে, সবটাই বলল। এ-ও জানাল, ওখান থেকে নিশ্চিত হবার পর আর দেরি করেনি। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা থেকে রওনা দেয় যশােরের উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে সুন্দরপুরে।  “পুরাই তাে দেখি রিটার্ন টু ইডেনের কাহিনি!” ছফার কথা শেষ হলে বলল কেএস খান।

“কীসের কাহিনি?!” ছফা বুঝতে পারল না তার সিনিয়রের কথা।

“একটা সিনেমার কাহিনি! অনেক আগে টিভিতে দেখাইতাে  রিটার্ন টু ইডেন  ওইটাতে এক মহিলা তার হাজব্যান্ডের ওপর রিভেঞ্জ নেওনের লাইগা প্লাস্টিক সার্জারি কইরা নিজের চেহারা পাল্টায়া ফালায়….নতুন একটা আইডেন্টি নিয়া ফিরা আসে আবার,” দ্রুত বলে গেল। “একই রকম ঘটনা মুশকান জুবেরিও ঘটাইছে! আনবিলেভেবল!” একটু থেমে আবার বলল, “মহিলার সাহসের তারিফ না কইরা পারতাছি
না।

“জি, স্যার।” ফোনের ওপাশ থেকে সায় দিল ছফা।“বেনাপােল দিয়ে দেশে ঢুকতেই মনে হল, মুশকানকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনিই বলেছিলেন, সুন্দরপুর থেকে তদন্তটা আবার নতুন করে শুরু করতে, মহিলার বদঅভ্যেসটা ফলাে করতে। আর সে কারণেই আমি মুশকানের হদিস বের করতে পেরেছি।”  “কী যে বলেন না,”বিনয়ের সঙ্গেই বলল মি.খান। “আমি আবার কী হেল্প করলাম! সব তাে করলেন আপনে। আমার দেখা সবচায়া কঠিন একটা কেস ছিল এইটা  শেষ
পর্যন্ত আপনে সলভ্ করবার পারলেন। কংগ্রাচুলেশন্স, ছফা। ইউ ডিড ….অ্যাবসলিউটলি ব্রিলিয়ান্ট।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“এখন যত তাড়াতাড়ি পারেন, ওই মহিলারে অ্যারেস্ট কইরা ঢাকায় নিয়ে আর একটু সতর্ক থাকবেন, আগেরবারের মতাে যেন না হয়।”

“জি, স্যার।”

“আর আমার ওই কথাটাভুইলা যায়েন না কিন্তু,”মনে করিয়ে দিয়ে বললেন খােদাদাদ শাহবাজ খান।

“কোন কথাটা, স্যার?”বুঝতে না পেরে বলল ছফা।  “ওই যে….মুশকানেরে অ্যারেস্ট করার পর তারে ভুলেও জিগায়েন না, কোন অর্গানটা।খাইলে….বুঝবারই তাে পারছেন।”

“বুঝতে পেরেছি। আমি সেটা করব না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।” “ঢাকায় আসেন….আপনের মুখ থেইকা ডিটেইল শুনতে হইব সবটা।”

“জি, স্যার।”

ফোনের রিসিভারটা বুকের কাছে রেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে রইল কেএস খান। মুশকান জুবেরির এমন নাটকীয় আচরণ তাকে বিস্মিত করেছে। মহিলা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছে, তাতে করে এমন কাজ করার কথা নয়। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। মানুষ সব সময় নিজের সর্বোচ্চ বুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে কাজ করে না বেশির ভাগ সময়ই তাকে পরিচালিত করে আবেগ, রাগ-ক্ষোভ, হতাশা, উচ্চাভিলাষী, প্রতিশােধপরায়ণতা আর প্রেম-বিরহ। না জানি আরও কত কী! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে।

সংবিৎ ফিরে পেয়ে আইনস্টাইনের ঘরের দিকে তাকাল। “ফ্লাস্কটা লইয়া চা নিয়া আয় তো  মাথাব্যথায় মইরা যাইতাছি।” বেশ জোরে বলল কথাটা, যাতে করে মটু পাতলু কার্টুনের শব্দ ছাপিয়ে ছেলেটার কানে সেটা পৌছােয়।

“আইচ্ছা।” ঘরের ভেতর থেকে আইনস্টাইনের কণ্ঠটা ভেসে এল। মাথাব্যথার মতবিচ্ছিরি যন্ত্রণার মধ্যেও কেএস খানের মুখে ফুটে উঠল প্রসন্ন হাসি। অবশেষে মুশকান জুবেরির রহস্য অবসান হতে চলেছে। মহিলা নতুন পরিচয়ে, নতুন একটা মুখ নিয়ে আবারও ফিরে গেছে সুন্দরপুরে- আর ছফা সেটা উদঘাটনও করে ফেলেছে!

অবিশ্বাস্য!

অধ্যায় ৬৬

রমাকান্ত কামার এ জীবনে কখনও সন্দেহগ্রস্ত হননি তা নয়, তবে এর আগে আর কখনও এই বাতিক তাকে এতটা গ্রাস করেনি। সন্দেহগ্রস্ততা সব সময়ই সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন তিনি।

লাইব্রেরীর ছােট্ট অফিস ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এখনও চার-পাঁচজন পাঠক বইয়ে নিমগ্ন।এরকম দৃশ্য দেখতে তার বেশ ভালাে লাগে, তবে অন্যদিনের মতাে আজকে সেটা হল না। সন্দেহগ্রস্ততার পাশাপাশি দুশ্চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। না চাইলেও, কখনও কখনও সন্দেহ জোর করে অক্টোপাসের মতাে জাপটে ধরে,এর থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে।

সুস্মিতার সঙ্গে ডাক্তার আসকারের সম্পর্কটা নিয়ে মাস্টারের মনে এক ধরণের সন্দেহ তৈরি হয়েছিল গতকালই। ডাক্তার ভদ্রলােক তাকে বলেছিলেন, সুস্মিতা তার এক প্রয়াত বন্ধুর মেয়ে হয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আদতে তাদের সম্পর্কটা অনেক বেশি গভীর।

বেশ কয়েক মাস আগে সুস্মিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন ট্রাস্টি বাের্ডের সম্মানিত সদস্য ডাক্তার আসকার, আর ওই সময়েই স্কুলের জন্য গানের শিক্ষক খুঁজছিলেন মাস্টার। কথাটা তিনি জানিয়েছিলেন ভদ্রলােককে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, সুস্মিতার মতাে শান্তিনিকেতন থেকে আসা কেউ সুন্দরপুর স্কুলে বাচ্চাদের গান শেখাতে আগ্রহী হবে। ডাক্তার তার বন্ধুর মেয়েকে প্রস্তাবটা দিতেই সানন্দে রাজি হয়ে যায় সে! মাস্টার অবাক হলেও, ভালাে একজন শিক্ষক পেয়ে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, খুব একটা মাথা ঘামাননি এ নিয়ে। গতকাল বিকেলের দিকে তিনি যখন স্কুলের অফিস থেকে। রবীন্দ্রনাথে যাবার জন্য বের হবেন, তখন উদ্বিগ্ন হয়ে সুস্মিতা এসেছিল তার কাছে। মেয়েটা সব সময় যেভাবে পরিপাটি থাকে সেটা দেখতে ভালাে লাগে তার—যেন রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস থেকে উঠে আসা কোনাে নায়িকা। কিন্তু গতকাল সেই পরিপাটি সুস্মিতার দেখা পাননি রমাকান্তকামার। সচরাচর বাঙালি মেয়েরা যে-রকম সালােয়ার-কামিজ পরে থাকে সেরকমই কিছু পরেছিল, আর তার অভিব্যক্তি দেখে বােঝা। যাচ্ছিল সে ভীষণ বিচলিত।

“মাস্টারমশাই,”ঘরে ঢুকেই মলিন কণ্ঠে বলেছিল সে। “ডক্টর আসকার হসপিটালে অ্যাডমিট। ওর কন্ডিশন নাকি খুবই ক্রিটিক্যাল!”

রমাকান্ত নড়েচড়ে বসেছিলেন কথাটা শুনে।‘বলেন কী?”

“এখন আইসিসিসিইউ-তে আছে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, প্রায় কাঁদো কাঁদে কণ্ঠে বলেছিল কথাগুলাে।

মেয়েটার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মাস্টার। তখনই প্রথম বারের মতাে এই সন্দেহগ্রস্ততার শিকার হন তিনি—এই মেয়ের সঙ্গে ডাক্তারের সম্পর্ক কী? ভদ্রলােকের অসুস্থতার খবর পেয়ে তার চোখ এভাবে ছল ছল করে উঠবে কেন?

“ওর বাসায় পুলিশের দু-জন লােক গেছিল ওকে ইন্টেরােগেট করার জন্য  তখনই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ে।”  মাস্টারের ভ্রু কুঁচকে গেছিল কথাটা শুনে। কারা গেছিল- প্রশ্নটা করতে গিয়েও করেননি। ভালাে করেই জানতেন, এটা ওই নুরে ছফার কাজ। উকিল ভদ্রলােক তাকে ফোন করে সবই জানিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্যে নিজেকে কিছুটা দায়ীও মনে করেন মাস্টার। তার বলা উচিত হয়নি চিরকুটটা তাকে কে দিয়েছিল। এই চিরকুটের সূত্র ধরেই উকিলকে হেনস্তা করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ডাক্তারের নাগাল পেয়ে গেছে ডিবি অফিসার।

– “এখন ডাক্তারসাহেবের কী অবস্থা?” আস্তে করে জানতে চেয়েছিলেন রমাকান্ত কামার। একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এসেছিল ভেতর থেকে।ঠোট ওলটায় সুস্মিতা। “কিছুই বােঝা যাচ্ছে না। ওর ফোন বন্ধ, তাই বাসার দারােয়ানকে ফোন দিয়েছিলাম  সে-ই আমায় বলল। এরপর হসপিটালে যােগাযােগ করেছিলাম, কিন্তু ওরা কিছুই জানে না! খুবই অদ্ভুত ঠেকছে ব্যাপারটা। ভীষণ চিন্তাও হচ্ছে।”

মাস্টারের ভ্রু কুঁচকে গেছিল। “হাসপাতালও কিছু জানে না? ওটা না ওঁর নিজেরই….।

“হুম, সেজন্যেই আমার খুব টেনশন হচ্ছে।”

সুস্মিতার দিকে ভালাে করে তাকিয়ে মাস্টার দেখতে পেয়েছিলেন, মেয়েটা আসলেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

“আমাদের কি ঢাকায় গিয়ে ওঁকে দেখে আসা দরকার ?” ট্রাস্টের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে এটা করা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলে মনে করেছিলেন রমাকান্ত কামার। যদিও জানতেন, তিনি গেলে ওই নুরে ছফার সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়বেন আবার, সে নিশ্চয় নজরদারিতে রেখেছে ডাক্তারকে। তার লােকজন থাকতে পারে হাসপাতালের আশেপাশে। তার চেয়েও বড়ো কথা, স্কুলের গুরুদায়িত্ব ফেলে তার পক্ষে দু-দিনের জন্যে ঢাকায় যাওয়াটাও খুব কঠিন। অন্য দিকে ট্রাস্টের একজন সদস্য ছাড়া ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সঙ্গে তার তেমন সম্পর্কও নেই। তার চেয়ে বরং সুস্মিতা গেলেই ভাল হয়।তবে মেয়েটাকে একা ছাড়েননি তিনি। সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন শ্যামলকে। শত হলেও ঢাকা শহর, তিনি নিজেই ওখানে গিয়ে ….।

এমন সময় লাইব্রেরীর ছােট্ট অফিস ঘরের দরজায় টোকা দিলে মাস্টারের চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়ল। তিনি কিছু বলার আগেই দরজাটা খুলে গেল, দেখতে পেলেন নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে।

যারপরনাই বিস্মিত হলেন রমাকান্তকামার। অনেক অনেক বছর পর, তার সমস্ত শরীর রাগে কেঁপে উঠল।  ছফার ঠোঁটে লেগে আছে বাঁকা হাসি। যেন বিশাল একটি বিজয় অর্জন করে এসেছে।

“মাস্টারসাহেব, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে,” ঘরের ভেতরে ঢুকে বলল ছফা।

“আমার সঙ্গে! কী কথা?”মাস্টার খুবই অবাক হলেন। বেশ বেগ পেতে হল নিজের ভেতরে ফুঁসে উঠতে থাকা এই ক্রোধকে দমন করতে গিয়ে।

“আপনার স্কুলে যাচ্ছি, আপনাদের গানের শিক্ষিকা সুস্মিতাকে গ্রেপ্তার করতে।”

“কী!”মাস্টার যেন আকাশ থেকে পড়লেন।“সুস্মিতাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন!” এই লােক কি তার সঙ্গে তামাশা করতে এসেছে—রমাকান্ত কামার ভেবে পেলেন না। “ও কী করেছে? ওকে কেন গ্রেপ্তার করতে চাইছেন আপনি?”

বাঁকাহাসি দিল ছফা। “আসলে আমার বলা উচিত ছিল মুশকান জুবেরিকে গ্রেপ্তার করতে এসেছি, তাহলে আপনার জন্য বুঝতে সুবিধা হত।”

মাস্টার বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। কথাটা হজম করে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। “আপনি কী আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?”।

বাঁকা হাসি দিল ছফা।“রমাকান্তবাবু, আজকেই কলকাতা থেকে ফিরেছি আমি, সেখান থেকেই জেনে এসেছি, মুশকান জুবেরি সুস্মিতা সমাদ্দার সেজে আপনার স্কুলে চাকরি নিয়েছে। সম্ভবত আপনিও সেটা জানতেন।”

মাস্টার যেন বজ্রাহত হলেন।“কী যা-তা বলছেন! সুস্মিতাকে আপনি দেখেছেন না? ও কীভাবে মুশকান জুবেরি হতে যাবে? আমার সঙ্গে এসব তামাশা করার মানে কী?”

“লম্বা গল্প  আমার হাতে এখন অত সময় নেই। পরে যখন আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব তখন সবটাই বলব।”

মাস্টারের কুঁচকে গেল।

“বাইরে পুলিশের ভ্যান অপেক্ষা করছে, আমি আপনার স্কুলে যাচ্ছি ওদের নিয়ে, বলল ছফা। আশা করি, এখানকার এমপিকে আর জড়াবেন না। জড়ালেও কোনাে ফায়দা হবেনা,”কথাটা বলে যেই না ঘর থেকে বের হতে যাবে অমনি মাস্টারের কথায় থমকে দাঁড়াল সে।

“কিন্তু সুস্মিতা তাে স্কুলে নেই।” মাস্টারের দিকে ফিরে তাকাল ছফা। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস। “নেই মানে,

ও ঢাকায় চলে গেছে….গতকাল।”

“ঢাকায় গেছে?!” বিস্ময় আর হতাশায় বলে উঠল ছফা। “ঢাকার কোথায়, গেছে?!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে।  “জানি না।”মিথ্যেটা অনেক কষ্টে বললেন রমাকান্ত কামার। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই লােকের কাছে সত্যি বলা মানে কাউকে বিপদে ফেলা।

ছফার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।রাগে ক্ষোভে ফুঁসে উঠল সে।একহাত দিয়ে অন্যহাতের তালুতে আঘাত করল জোরে। দাঁতে দাঁত পিষে অনেকটা আর্তনাদের মতাে করে বলল। “পালিয়েছে! ওই ডাইনীটা আবারও পালিয়ে গেছে!”

অধ্যায় ৬৭

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ এবার সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দুশ্চিন্তায় তার প্রেসার বেড়ে গেছে। ডুয়েল সিটিজেন তিনি, ব্রিটিশ পাসপাের্ট আছে তার, চাইলে যে-কোনাে সময় ভিসা ছাড়াই সেকেন্ডহােমে যেতে পারেন। তারপরও বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন তাকে লন্ডনের ফ্লাইটে উঠতে দেয়নি। এরজন্যে কোনাে কারণও দেখায়নি তারা। শুধু বলেছে, ওপর মহল থেকে নির্দেশ আছে, ডাক্তার আসকার যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারেন। তার সঙ্গে আসা হাসপাতালের কর্মচারীরা অনেক অনুরােধ করেও তাদেরকে বােঝাতে পারেনি। তবে ডাক্তার জানতেন, ইমিগ্রেশনে যারা আছে তাদেরকে অনুরােধ করে কোনাে ফায়দা হবেনা, সেজন্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি, যদি কোনাে সাহায্য পাওয়া যায়। তার নামে কোনাে মামলা নেই, কোনাে কেসে তিনি সন্দেহভাজন আসামিও নন, এমনকি বিরােধী কোনাে রাজনৈতিক দলের নেতা নন—তাহলে কীসের ভিত্তিতে তাকে ইমিগ্রেশন আটকে দিল?  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে দারুণ অবাক হয়েছিলেন, কেননা এ কাজ তাঁর মন্ত্রণালয়ই করে থাকে সব সময়।জানামতে, ডাক্তারের ব্যাপারে এরকম নিষেধাজ্ঞা দেয়নি তাঁর মন্ত্রণালয়। কিন্তু ইমিগ্রেশনের সঙ্গে যােগাযােগ করার পর তিনি জানতে পারেন, সত্যি সত্যি সরকারের ওপরমহল থেকে বিশেষ একজন ব্যক্তির নির্দেশে ডাক্তারকে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেই বিশেষ ব্যক্তিটি কে, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানাতে অপারগ হলেও ডাক্তার আসকার বুঝে গেছেন- এটা প্রধানমন্ত্রীর পিএসের কাজ। ক্ষমতাধর ব্যক্তি তিনি, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। আর এর পেছনে যে নুরে ছফার হাত আছে সেটাও বুঝতে পেরেছেন।

ইমিগ্রেশন থেকে বিমুখ হয়ে নিজের হাসপাতালের অফিসে ফিরে এসেছেন অনেকক্ষণ হল কিন্তু অন্য একটি দুশ্চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সুস্মিতার ফোন বন্ধ। তিনি ঢাকা ছাড়ার পর মেয়েটা ঢাকা টু যশাের ফ্লাইটে সুন্দরপুরে চলে যাওয়ার কথা। ঘণ্টখানেক আগে সে ফোন দিয়ে বলেছেও, একটু পরই রওনা দেবে। রওনা দেবার পর এসএমএসও পাঠিয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনাে খবর নেই।

প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তাে সুস্মিতার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, যে ফ্লাইটে সুস্মিতার যশাের যাবার কথা, সেটা সে মিস করেছে। গতকালই হাসপাতালের অ্যাডমিনের একজনকে দিয়ে মেয়েটার জন্য দুটো

টিকেটের ব্যবস্থা করেছিলেন।

এখন তার মনে খারাপ কিছুর আশঙ্কা দানা বাঁধছে।

ওর কিছু হল না তাে?! আসকার ইবনে সায়িদ নিজের মাথা থেকে এই দুশ্চিন্তা কোনােভাবেই দূর করতে পারছেন না। পথে কোনাে দুর্ঘটনা? এরকম আশঙ্কাও হচ্ছে তার। তবে মন বলছে, যে লােক তাকে দেশের বাইরে যেতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেই একই লােক সুস্মিতাকেও কিছু করেছে।

কিন্তু কী করেছে? কেন করবে? ডাক্তার টের পাচ্ছেন, তার নাজুক হৃৎপিণ্ডটা এবার সত্যি সত্যি বিপাকে পড়ে গেছে। বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যথাটা বাড়ছে ক্ৰমশ।তার হার্টে তিনটা রিং লাগানাে হয়েছিল কয়েক বছর আগে।তারপর বে শসুস্থই ছিলেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছেহৃদপিণ্ডটা দিনকে দিন নাজুক হয়ে উঠছে আবার।  পকেট থেকে সদ্য কেনা সেলফোনটা হাতে নিলেন ডাক্তার। নুরে ছফা আর গ
ুন্ডা প্রকৃতির ওই লােক যখন তার বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়েছিল তখন তিনি দ্রুত নিজের মােবাইলফোন থেকে সিমটা খুলে ফোনটা কমােডে ফ্ল্যাশ করে দিয়েছিলেন, সিমটা লুকিয়ে রেখেছিলেন মেঝেরকার্পেটের নীচে।তবে পাসপাের্টটার কথা মাথায়ই আসেনি। এলেও ওটা তিনি নষ্ট করার বিলাসিতা দেখাতে পারতেন না।  স্মৃতি থেকে একটা নম্বর প্রেস করলেন। এই নম্বরটা তার স্মৃতি ছাড়া আর কোথাও সংরক্ষণ করেননি নিরাপত্তার কারণে। এখন এই সঙ্কটময় মুহূর্তে এসে শেষ দুটো ডিজিট তালগােল পাকিয়ে ফেলেছেন।

৪৮ নাকি ৮৪? মনে মনে আওড়ালেন ডাক্তার। এ অবশেষে প্রথমটাই বেছে নিলেন। রিং হতেই কর্কশকণ্ঠের এক লােকের কণ্ঠ শুনেই কলটা কেটে দিলেন। এবার শেষ দুটো ডিজিটে ৮৪ যােগ করে কল করলেন। কিন্তু রিং হতে থাকলেও কেউ ধরলনা কলটা। আবারও ডায়াল করলেন তিনি।

ফোনটা ধরাে  প্লিজ!

অধ্যায় ৬৮

তার কোনাে ধারণাই নেই কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। তার চেয়েও বড়ো কথা, কে বা কারা তাকে এভাবে অপহরণ করেছে সে সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারছে না। তার নার্ভ বেশ শক্ত, সহজে ভেঙে পড়ার মতাে নয়। কিন্তু আকস্মিক এই ঘটনায় সাময়িক নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়েছিল।  একটা ঘরে হাত-পা-মুখ আর চোখ বেঁধে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কোনাে রকম নড়াচড়া করলে তার ভালাে হবে না বলেও শাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার জন্য কিছুটা সময় পেতেই প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিতে পেরেছে সে কিন্তু তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে শ্যামলকে নিয়ে। ছেলেটাকে কোথায় রেখেছে সে জানে না। এই বাড়িতে ঢােকার সঙ্গে সঙ্গে উবার ড্রাইভার ছাড়াও আরও দু-জনকে দেখেছে। তারপরই পিস্তলের মুখে তার হাত-মুখ আর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। সে বার বার জানতে চেয়েছে, তারা কারা, কেন তাদের সঙ্গে এরকম করা হচ্ছে—কিন্তু উবারের ড্রাইভার আর বাকি লােকগুলাে কিছুই বলেনি। তবে এটা বুঝতে পারছে, ওই ড্রাইভারই এই অপহরণ দলের নেতা।  শ্যামলের হাত-মুখ-চোখ বাঁধার সময় বেশ কান্নাকাটি করেছিল ভয় পেয়ে। তাকে সজোরে এক থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দেয় এক ষণ্ডা।

আমি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছি! মনে মনে বলল সে।নাকি এরা অন্য কেউ? কোনাে সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। সবটাই তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে।

এরা পুলিশ নয়। ভালাে করেই বুঝতে পারছে। পুলিশ হলে তাকে থানায় নিয়ে যেত। কিংবা ওরকম কোথাও। কিন্তু এ জায়গাটা একেবারেই সুনশান। চোখ বাঁধার আগে যতটুকু দেখেছে, একটা পরিত্যক্ত বাড়ি বলেই মনে হয়েছে তার কাছে।

তাহলে এরা কারা?

এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই। তাই এসব চিন্তা বাদ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। গভীর করে নিশ্বাস নিল বার কয়েক। নিজেকে আর-একটু ধাতস্থকরা দরকার।  সে আছে এই বাড়ির দোতলায়। শ্যামলকে কোথায় নিয়ে গেছে জানে না। সিঁড়ি দিয়ে প্রায় টেনে নিয়ে এসেছে তাকে। বার কয়েক সে জোরাজুরি করেছিল, কিন্তু ওই ড্রাইভার পেছন থেকে তার চুলের মুঠি ধরে কানের কাছে মুখ এনে বলেছে—তার কথা না
শুনলে, বাড়াবাড়ি করলে অকল্পনীয় শাস্তি দেওয়া হবে।

এর পর আর কিছু করেনি সে। লােকটার হুমকি তার কাছে নিছক কথার কথা বলে মনে হয়নি। যে-লােক উবারের ড্রাইভার সেজে, পিস্তলের মুখে দুদুজন মানুষকে দিনে-দুপুরে অপহরণ করতে পারে, তার কোনাে হুমকিকে হালকাভাবে দেখার উপায় নেই।

চোখ বাঁধার আগে সে আরও অবাক হয়েছে, ড্রাইভারের চেহারা দেখে তার যতটা মনে পড়ে, উবারে রিকোয়েস্ট দেবার পর উবার অ্যাপসে ড্রাইভারের যে ছবি দেখেছিল এই লােক সেই লোক নয়—এ ব্যাপারে সে পুরােপুরি নিশ্চিত। ছবির ড্রাইভার ছিল হ্যাংলা-পাতলা এক তরুণ। পুরু গোঁফ, মাথার চুল কোকড়ানাে, চোখদুটো সামান্য ট্যারা। একারণে অ্যাপসে লােকটার ছবি অল্প কিছুক্ষণ দেখলেও তার মনে আছে। কিন্তু যে-ড্রাইভার তাকে অপহরণ করেছে, সে বেশ পেটানাে শরীরের, ক্লিনশেভড, ছােটোছােটো করে ছাটা চুল। লােকটার চোখমুখ দেখলেই মনে হয় ষন্ডা প্রকৃতির।

কী কারণে আমাকে অপহরণ করেছে এরা? মনে মনে আবারও প্রশ্নটা আওড়াল টাকা? তার কাছে অবশ্য মনে হচ্ছে না। এরা তাকে টার্গেটই বা করল কীভাবে? জানলই বা কীভাবে সে ঢাকায় আছে? আর সে যে উবারে কল দিয়েছিল সেই খবরই বা পেল কোত্থেকে?—এসবের কোনাে উত্তরই পেল না।

হঠাৎ টের পেল ঘরে কেউ ঢুকেছে। গভীর করে নিশ্বাস নিল সে। ঘরে যে উবারের ড্রাইভার ডুকেছে সেটা বুঝতে পারল। লােকটার শরীরের গন্ধ তার মুখস্ত হয়ে গেছে এরইমধ্যে!

একটুও চমকাল না। নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করার কোনাে ইচ্ছে তার নেই। যা কিছু মােকাবিলা করতে হবে, শক্ত থেকেই করবে।

অধ্যায় ৬৯

আসলাম ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে বন্দি মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েটা স্থির হয়ে বসে আছে, একটুও চমকায়নি। খুবই স্বাভাবিক হত, যদি চমকে উঠত। বােঝাই যাচ্ছে এই মেয়ের নার্ভ বেশ শক্ত। আসলাম এরই মধ্যে সেটা টেরও পেয়েছে।

একটা পুরােনাে ডাবল সােফা আর কাঠের চেয়ার ছাড়া ঘরটা প্রায় খালি। এই বাড়িটা ক-দিন পরই ভেঙে ফেলা হবে, এখানে গড়ে উঠবে দশতলার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এটা ডেভেলপ করবে সেটা পিএস আশেক মাহমুদের নিজেরই। যদিও কাগজে-কলমে চারজন পার্টনার আছে কিন্তু আসল পুঁজি আসে আসলামের বসের কাছ থেকে। এরকম আরও অনেক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানেই পিএসের বিনিয়ােগ রয়েছে।  ঘরের এককোণে থাকা সােফাতে গিয়ে বসল আসলাম। টর্চার করার কিছু সাধারণ ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে এসেছে সে একটা কাটার প্লাঞ্জার, পলিথিনের কিছু ব্যাগ আর স্কচ টেপ, এসবই যথেষ্ট। যদি টর্চার করার আদৌ কোনাে দরকার পড়ে তাে! আসলামের অবশ্য ইচ্ছে নেই, এই মেয়েকে এসব জিনিস দিয়ে টর্চার করার। তার চেয়ে বরং মেয়েদের কাছে যেটা সবচে বিভীষিকাময়, সেই অস্ত্রটা প্রয়ােগ করতে পারলেই সে বেশি খুশি হবে। আর বলাই বাহুল্য, সেটা কাজেও দেবে বেশ!

মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না সে। তার দেহসৌষ্ঠব যে-কোনাে পুরুষের কাছেই লােভনীয়। আর সেটা তাদেরকে পতঙ্গ বানিয়ে কাছে টেনে পুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। একেবারে হালকা-পাতলা গড়ন- গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের মতাে যা-পাও-তাই-খাও-টাইপের নয়, বেশ সচেতন। কথাবার্তাও বেশ মার্জিত, অন্তত যতটুকু আসলাম শুনেছে। প্রবল একটা ব্যক্তিত্ব আছে। দেখে মনে হচ্ছে, বয়স ত্রিশের নীচেই হবে। মেয়েটার মসৃণ গ্রীবা থেকে সুডৌল বুকের দিকে তার চোখ আটকে আছে। পরনে ঘিয়েরঙা ফতুয়া আর কালাে জিনস প্যান্ট। চুলগুলাে সামনে থেকে টেনেঝুটি করে বাঁধা। ঘরে ফ্যান নেই বলে শরীরটা ঘেমে আছে, গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে ফতুয়াটি।

মণীষা দেওয়ানের কথা মনে পড়ে গেল। ওর-ও এমন মসৃণ গ্রীবা আর সুডৌল বুক ছিল। আরও ছিল….

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। মেয়েটাকে হারানাের পর সারা দিনে কত বার যে ওর কথা মনে পড়ে ইয়ত্তা নেই।  মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে বন্দির দিকে তাকাল। তার ইচ্ছে
করছে তােয়ালে দিয়ে মেয়েটার মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীর মুছে দিতে।

নিজের ভেতরে জান্তব পশুটা জেগে ওঠা টের পেতেই ওটাকে দমন করার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করে পুরােনাে মেসেজগুলাে পড়তে লাগল। পিএস এসে পড়বে আর-একটু পরই। তার বস কল্পনাও করতে পারেনি এত সহজে মেয়েটাকে তুলে আনতে পারবে সে।  ডাক্তার আসকারের বাড়ির মে
ইন গেট থেকে একটু দূরে কালাে রঙের গাড়িটা নিয়ে নজর রাখছিল সে। এমন সময় তার বস ফোন করে বলে, তাদের প্ল্যানে একটু পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের প্ল্যানটা ছিল অনেকটা এরকম-নুরে ছফা যদি কলকাতা থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তাহলে ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ এই তরুণীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, ভদ্রলােককে বাধ্য করা হবে মুশকান জুবেরির খোঁজ দিতে। কিন্তু একটু আগে তার বস তাকে বলে, আসলাম যেন সময় নষ্ট না করে দ্রুত এই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসে এখানে।  কথাটা শুনে একটু অবাকই হয়েছিল সে। ছফা কি তাহলে মুশ
কানের হদিস বের করতে পারেনি? কিন্তু গতকাল তার সঙ্গে যখন কথা হল, তখন তাে ডিবি অফিসার বলেছিল তার কাজ বেশ ভালােভাবেই এগােচ্ছে! অবশ্য পিএসকে এ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন করেনি আসলাম।  যাই হােক, পিএস আশেক মাহমুদই তাকে জানিয়েছিল মেয়েটা কখন বাড়ি থেকে বের হতে পারে। বসের ক্ষমতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ তার নেই, তারপরও কোত্থেকে কীভাবে এরকম মূল্যবান খবর জোগাড় করেছে সেটা ভেবে একটু অবাকই হয়েছিল। যাই হােক, মেয়েটার গন্তব্য যেহেতু এয়ারপাের্ট, সে নিশ্চয় উবারই ব্যবহার করবে। হাসপাতাল থেকেও উবারে করেই এসেছে এখানে।  উবার ব্যবহার করবে!

পিএস তাকে পর্যাপ্ত লােকবলও দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মাথায় চট করেই একটা বুদ্ধি চলে আসে।

বাড়িতে ঢুকে হৈহল্লা করার কোনাে দরকার নেই। অনেক সহজেই কাজটা করা যেতে পারে। আর সেটা করার জন্য সে একাই যথেষ্ট। – ডাক্তারের বাড়ির সামনে একটা প্রাইভেট কার থামতেই নড়েচড়ে ওঠে আসলাম।দূর থেকেই দেখে ড্রাইভার ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। উবার!বুঝে যায় সে। সঙ্গে সঙ্গে ড্যাশবাের্ড থেকে সানক্যাপটা নিয়ে মাথায় চাপিয়ে নেয়।নজরদারী করার সুবিধার্থে গাড়িতে রেখেছিল ওটা। এরপর নিজের গাড়িটা নিয়ে দ্রুত চলে আসে উবারের ঠিক সামনে, একেবারে পথরােধ করে। ড্রাইভার হতবাক হয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে কিছু বললেও আসলাম সেটা আমলে নেয়নি। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করেই হ্যান্ড ব্রেকটা টেনে দরজা খুলে বের হয়ে আসে সে। বিস্মিত ড্রাইভার কিছু বলার আগেই একহাতে পকেট থেকে তার পুরােনাে আইডি কার্ডটা বের করে দেখায়,অন্য হাতে কোমর থেকে বের করে আনে পিস্তলটা। নিজেকে পুলিশের অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াডের সদস্য পরিচয় দিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনে নেয়, গাড়িটা উবারের কিনা। নিশ্চিত সবার পর, ডাইভারকে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, এই বাড়িটা তার স্কোয়াড কর্ডন করে রেখেছে সকাল থেকে। এখানে এক মহিলা জঙ্গি আছে, সে যেন এক্ষুণি তার গাড়িটা নিয়ে চলে যায়।ওই মহিলা কাস্টমার তাকে ফোন দিলে সে যেন বলে, বাড়ির সামনে চলে এসেছে। ঠিক আছে? মাথা নেড়ে সায় দেয় বেচারা ড্রাইভার। তারপর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি। গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে নিয়েই সােজা বাম দিকে টার্ন নিয়ে চলে যায়।

এর পর আসলাম তার গাড়িতে উঠে ঝটপট একটু পিছিয়ে নিয়ে মেইনগেটের সামনে এনে রাখে। মাথার ক্যাপটা আরও নীচু করে দেয়, দারােয়ান যাতে তাকে দেখলেও চিনতে না পারে।কয়েক মিনিট পরই বাড়ির গেটটা খুলে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে আসে ওই তরুণী, তার সঙ্গে সেদিনের ছেলেটাও।  বনানীর অভিজাত অ্যাভিনিউ থেকে বের হবার সময় রিয়ার মিরর দিয়ে দেখে, পেছন সিটে বসে থাকা মেয়েটি কোনাে কথাই বলছে না। মােবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত সে। তার সঙ্গি ছেলেটা গােবেচারার মতাে বসে আছে। গাড়িটা কোনদিকে যাচ্ছে সে খেয়াল ছিল না তাদের কারােরই।এরপর আস্তে করে বামহাতে ফোনটা নিয়ে এই বাড়িতে থাকা বদরুলের নম্বরে মিসকল দেয় গেটটা খুলে রাখার সংকেত হিসেবে। ”

গুলশান ২নম্বরের নির্জন এক রােডে গাড়িটা ঢুকে পড়লেও পেছনের সিটের যাত্রীদের কারও চোখে সেটা ধরা পড়েনি। মেয়েটা তখনও ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আর ছেলেটা সম্ভবত এই এলাকাটা চেনে না। তার হাবভাব দেখে তা-ই মনে হয়েছে।’

দুর থেকেই আসলাম দেখতে পায় এই বাড়ির খােলা মেইনগেটটা। গাড়ি নিয়ে সােজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তেই ব্রেক কষে সে। মেয়েটা বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে থাকলেও যেই না মুখ খুলতে যাবে, অমনি আসলাম পেছন ফিরে তার পিস্তলটা তাক করে। কিন্তু তাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে কানফাটা চিৎকার দেয় মেয়েটি। অবশ্য তার সেই চিৎকার ঢাকা পড়ে যায় মেইনগেটটা টেনে বন্ধ করার ঘরঘর শব্দে, আর আসলামের হুমকির কারণে।

এমন সময় ফোনের রিংয়ের শব্দ হতেই তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখল পিএস কল দিয়েছে।’

“স্লামালেকুম, স্যার।”

এখন কী অবস্থা?”

“কাজ হয়ে গেছে, স্যার।” ,

“দ্যাটস গ্রেট।” প্রশংসার সুরে বলল আশেক মাহমুদ। “তােমার জন্য বড়সড় পুরস্কার অপেক্ষা করছে।”  গানম্যান কিছুই বলল না। পুরস্কার বলতে টাকা-পয়সা বােঝাচ্ছে নিশ্চয়।শেষে যদি এই মেয়েটাকেই দিয়ে দেয় তার বস তাহলে বরং সে বেশি খুশি হবে। তার আবার খুব ধর্ষণ করতে ইচ্ছে করে সহজলভ্য মেয়েগুলাে আর তাকে তা করে না!

“শােনাে,”পিএস বলল।“শেষ মুহূর্তে পিএম একটা কাজ দিয়েছেন….আটকে গেছি। আমার একটু দেরি হবে আসতে।”

“সমস্যা নেই, স্যার। আপনি কাজ সেরে আসুন।” মুচকি হাসি তার ঠোটে। বাড়তি কিছুটা সময় হাতে পেয়ে খুশি। তার বস এমনিতেও সন্ধ্যার পর আসত, এখন মনে হচ্ছে আরও ঘণ্টাখানেক দেরি হবে।

পিএস কলটা কেটে না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইল।“এই মেয়েটা খুবই ডেঞ্জারাস, বুঝতে পেরেছ?”  “জি, স্যার।” কিন্তু আসলাম আসলে বুঝতে পারছে না। মেয়েটাকে দেখে মােটেও সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না তার।

“অনেকগুলাে মানুষ খুন করেছে ও। একটু সাবধানে থাকবে।” এ কথাটা শুনে খুবই অবাক হল গানম্যান, কিন্তু নিজে থেকে প্রশ্ন করল না।“ঠিক আছে স্যার।”

ফোনের ওপাশে পিএস যে দ্বিধার মধ্যে আছে সেটা বুঝতে পারল। “একেই আমরা খুঁজছিলাম!”আস্তে করে বলল আশেক মাহমুদ।

আসলাম যারপরনাই অবাক হল। এই মেয়েটাই মুশকান জুবেরি? কিন্তু ওই ডাইনীর ছবি সে দেখেছে, সেই ছবির সঙ্গে কোনােভাবেই এই মেয়ের চেহারার মিল নেই! – “প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পালটে ফেলেছে। দেখা হলে সব বলব  লম্বা
ঘটনা।”পিএস আর কিছু না বলে কলটা কেটে দিল।

পকেটে ফোন রেখে সােফা থেকে উঠে দাঁড়াল আসলাম। – কুঁচকে তাকাল বন্দির দিকে। দেখে মনেই হচ্ছে না, এই হালকা-পলকা মেয়েটি খুনখারাবি করতে পারে, তা-ও আবার অনেকগুলাে! তার বস হন্যে হয়ে যাকে খুঁজছে, এই হালকা-পলকা মেয়েটাই মুশকান জুবেরি! যতটুকু তার কানে গেছে, তাতে করে ভিরমি খেয়েছে সে মহিলা নাকি মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ খেয়ে নিজেকে চিরযৌবনা করে রেখেছে।

মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বন্দির দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল আসলাম। মেয়েটার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ফতুয়ার প্রশ্বস্ত গলা দিয়ে মসৃণ পিঠের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। হালকা ঘামে ভিজে আছে ফরসা ত্বক। ঝুটি করে বাধা চুলের কারণে পিঠ উন্মক্ত আসলাম আস্তে করে তার মুখটা নামিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিল।

মেয়েটা চমকে উঠল একটু। সে বুঝতে পারছে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে, কিন্তু হাত বেঁধে রাখার কারণে কিছুই বলতে পারছে না। আবারও ঘ্রাণটা নিল স্ত্রীহত্যার দায়ে চাকরিচ্যুত সাবেক এসআই মাহবুব আসলাম।বন্দির ঝুটি করা চুলের কাছে নাক নিল সে। মেয়েটা বুঝতে পেরে মাথা সামান্য সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতেই বামহাত দিয়ে তার হাতটা ধরে নিজের নাকের খুব কাছে নিয়ে এল। বেয়ারা মেয়েমানুষ তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়। আর এই মেয়েটা মুশকান জুবেরি জানার পর তার মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে!

চাপা গােঙানি দিল মেয়েটি। সম্ভবত গালাগালি করছে। মাথাটা সরানাের অনেক চেষ্টা করলেও আসলামের শক্ত হাতের সঙ্গে পেরে উঠছেনা।বুকভরে চুলের গন্ধটা নিল সে।সুগন্ধিটা বেশ ভালাে কিন্তু মণিষার মতাে নয়। ওই মেয়ে কী সব ভেষজ সুগন্ধি মাখত চুলে, মুখে, শরীরে। পাহাড়ে ওসব জিনিস পাওয়া যায়।

বন্দিকে ছেড়ে দিয়ে সােজা হয়ে দাঁড়াল। আস্তে করে মেয়েটার চোখ আর মুখের বাধন খুলে দিল সে।

“ইউ পারভার্ট!”রেগেমেগে বলল সুস্মিতা। দম ফুরিয়ে হাপাচ্ছে। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে আসলামের দিকে। “আমার ধারে কাছেও আসবি না! আই উইল কিল ইউ!” চিৎকার করেই বলল কথাটা। ; কিন্তু আসলাম তার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে নির্বিকার চেয়ে রইল। পারভার্ট সে ছিল না কখনও, যদি না সােমাকে হত্যা করার মতাে ভুল সিদ্ধান্তটা নিত। যদি না, এসব ঘটনা জানাজানি হত। যদি না, সব জানাজানি হবার পর মণিষা তাকে ছেড়ে চলে যেত!

মুচকি হাসল গানম্যান। “তাের আর আমার মধ্যে একটা মিল আছে কিন্তু!” কথাটা শুনে বন্দির কপালে ভাঁজ পড়ল। “আমরা দুজনেই মানুষ খুন করেছি!” বিস্ময়ে চেয়ে রইল সুস্মিতা। এ কথা এই স্কাউড্রেলটা জানল কী করে! মনেমনে বলে উঠল সে।

অধ্যায় ৭০

“হাসিবকে তুই কী করেছিস?”দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল আসলাম।

“হাসিব কে?”বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল বন্দি।“তার আগে বল তােরা কে?তুই কে,, পালটা প্রশ্ন করল সে।

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আসলামের। বন্দি অবস্থায়ও ভেঙে পড়েনি, পালটা তুই-তােকারি করছে তাকে! “আমার পরিচয় তাের জানা দরকার নেই। তুই শুধু বল হাসিবকে কী করেছিস।”

“আশ্চর্য,”রাগে-ক্ষোভে বলে উঠল সে।“বার বার এক কথা বলছিস কেন! বললাম , হাসিব নামের কাউকে চিনি না।”

“তাহলে তুই স্বীকার করবি না?” “অসহ্য!” বিরক্ত হয়ে বলল বন্দি। “কী স্বীকার করব?”

আসলাম মুচকি হাসি দিল। “তুই কে, আমরা সেটা জেনে গেছি। এসব নাটক করে কোনাে লাভ হবে না।”

“কী জেনে গেছিস তােরা?” চেঁচিয়ে বলল। “কী বলতে চাস”।

আসলাম বাঁকা হাসি দিল। “তুই কী ভেবেছিস, চেহারা পালটে ফেললেই তােকে কেউ ধরতে পারবে না?”  “কী!” বিস্ময়ের সীমা রইল না বন্দির, চোখমুখ কুঁচকে গেল তার। “আমি চেহারা পালটে ফেলেছি! কী যা-তা বলছিস! আমাকে কিডন্যাপ করেছিস কেন, সেটা আগে বল—টাকার জন্য? তােদের ডিমান্ড কত, শুনি?”  চোখমুখ শক্ত করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আসলাম।“তােকে যদি টাকার জন্যই তুলে আনতাম, তাহলে সবার আগে তাের নাগর ওই বুড়ো ডাক্তারকে ফোন দিতাম।”

‘শাট আপ, ইউ ব্লাডি সােয়াইন!” চেঁচিয়ে উঠল এবার। অপহরণকারীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, “ডাক্তার আসকার আমার বাবা হয়।”

আসলামের ঠোটে হাসি ফুটে উঠল। “নিজের চেহারা প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়ে পালটে নতুন একটা নাম নিয়ে, এখন নাগরকে বাবা বলে চালাতে চাইছিস, বেজন্মা মাগী!”

“ইউ ডার্টি সোয়াইন!” তিক্তমুখে বলল বন্দি। “বেজন্মা তাে তুই! যার পােষা কুকুর হয়ে এসব করছিস, তাকে গিয়ে বল আমি কে। ডাক্তার আমার কী হয়!”

গালি শুনে আসলামের মেজাজ খারাপ হল না, উলটা তার অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।মনীষা তার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর যত মেয়ে তার সঙ্গে শুয়েছে, টাকার বিনিময়েই তার সঙ্গে শুয়েছে।আর তাদের সবাইকে বাধ্য করেছে ওসব করার সময় তাকে গালি দেবার জন্য।মেয়ে গুলাের কাছ থেকে গালি শােনার পর সে জেগে উঠত। এখনও ঠিক সেটাই হচ্ছে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আসলাম বলল, “নুরে ছফাকে তো চিনিস, নাকি?” ভ্রু কুঁচকে গেল বন্দির, “এ আবার কে?”

হেসে ফেলল চাকরিচ্যুত পুলিশ অফিসার।“ছফাকেও চিনিসনা! বাহ ভালােই অভিনয় করতে পারিস তাে!”

“স্টুপিড!”দাঁতে দাঁত পিষে বলল বন্দি।“যে তােকে এসব ভুয়া খবর দিয়েছে, আগে তাকে গিয়ে ধর!”

হেসেই বলল আসলাম, “ছফা কলকাতায় গেছিল ক-দিন আগে,” একটু থেমে মেয়েটার অভিব্যক্তি দেখে নিল সে। ভড়কে যাবার চিহ্ন দেখতে পেয়ে খুশিই হল।“তাের সব কিছু সে জেনে গেছে। সব!”

বন্দি স্থির চোখে চেয়ে রইল অপহরণকারীর দিকে। তারপর ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, “কী জেনেছে ওই লােক?”

“হা-হা-হা,” হাসিতে ফেটে পড়ল পিএসের গানম্যান।“বললাম না, সব কিছু। তুই কোথায় থাকতি, কী করেছিস  সব।”

বন্দির কপালে ভাঁজ পড়ল।

“এখন শোন একটা কথা বলি। বুদ্ধিমান হলে টর্চার হবার আগেই সব স্বীকার করে ফেল নয়তাে শেষ পর্যন্ত সবই বলবি, মাঝখান থেকে….”কথাটা আর শেষ করল না।

“কী করবি তুই?” রেগেমেগে জানতে চাইল। “ইউ স্কাউন্ট্রেল!”

লম্পটের মতাে হাসি দিল আসলাম, তারপর আস্তে করে প্যান্টের জিপারটা টেনে খুলে ফেলল সে।“কী করব জানতে চাস, নাকি দেখতে চাস!” একটু থেমে মেয়েটার কাছে মুখ এনে আবার বলল, “নাকি, ফিল করতে চাস”। কথাটা শুনে ভড়কে গেল সুস্মিতা। তারপরও রাগ একটুও কমল না। “ইউ ব্লাডি সোয়াইন!”

“আরও বল” বন্দির চুলের মুঠি ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বলল। ভড়কে গেল মেয়েটা। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। “খানকি!” গর্জে উঠল আসলাম। “যত গালি জানিস সব দে আমাকে!”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইল বন্দি। – “গালি দে, খানকি!” বলেই মেয়েটার চোয়াল শক্ত করে ধরল। “দিচ্ছিস না কেন, ডাইনী!”

সুস্মিতা আবারও গভীর করে দম নিয়ে নিল। “শ্যামলকে আগে ছেড়ে দে,তারপর বলব।”

মুচকি হেসে মাথা নাড়ল আসলাম।

“ও ঢাকা শহর চেনে না। ওকে বহু দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দে। ও কিচ্ছু করতে পারবে না…. গ্রামে চলে যাবে।”

“শর্ত দেবার জন্য একটা পজিশন থাকে, তাের সেটা নেই।বুঝতে পেরেছিস, ডাইনী। গভীর করে দম নিয়ে নিল সুস্মিতা। বাঁকাহাসি দিল আসলাম। “তাহলে তুই বলবি না?” “না।” সােজা জবাব বন্দির। “তােকে আমি এখন কী করব, জানিস?” সুস্মিতার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল আবার। লম্পটের মতাে হাসি দিয়ে মেয়েটার ফতুয়ার গলা ধরল দু-হাতে। “তাের জামাকাপড় সব ছিড়ে ফেলব! ন্যাংটা করে” এক হাত জিপারে রাখল সে। লম্পটের হাসি দিল।

‘ইউ সান অব অ্যা বিচ!” রেগেমেগে বলল সুস্মিতা।

আসলাম সঙ্গে সঙ্গে একটা চড় মারল বন্দিকে। তারপর আর-একটা। তৃতীয় চড়টা মারার আগে থমকে গেল একটা কণ্ঠ শুনে।

“আসলাম!”

বন্দিকে ছেড়ে দিয়ে সােজা হয়ে দাঁড়াল সে। আশেক মাহমুদ কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি।

‘ইউ ডিড অ্যা গ্রেট জব!”বন্দির দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। “থ্যাঙ্কস, বস”

বন্দি বুঝতে পেরেছে, এই লােকই তাকে কিডন্যাপ করিয়েছে। “আপনি কে? আমাকে কিডন্যাপ করেছেন কেন?”

পিএস আশেক মাহমুদ চোখমুখ শক্ত করে তাকাল চেয়ারে বসা বন্দির দিকে। “মুশকান জুবেরি! কেমন আছেন?” দাঁতে দাঁত পিষে বলল সে। এই মহিলা তার বড়বােনের সমবয়সি বলেই হয়তাে অজ্ঞাতসারেই আপনি সম্বােধনটা চলে এসেছে।

বন্দি অবিশ্বাস্যে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “কী বলছেন?! আমি সুস্মিতা! সুস্মিতা সমাদ্দার।”

হা-হা-হা করে অট্টহাসি দিল আশেক মাহমুদ। অনেক দিন পর আসলাম তার বসকে এভাবে হাসতে দেখল।

অধ্যায় ৭১

মুশকান জুবেরি এখন পিএসের হেফাজতে আছে। ছফার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে ব্যাপারটা।

রমাকান্তকামার যখন জানালেন সুস্মিতা সুন্দরপুর থেকে চলে গেছে, তখন সে ভেবেছিল আবারও পালিয়ে গেছে ওই ডাইনী—তারপরও মাস্টারের কথাটাকে বেদবাক্য হিসেবে মেনে নেয়নি সে। পুলিশ ফোর্স নিয়ে পুরাে স্কুলটা চষে বেড়িয়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মচারীকেও জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে, মাস্টার সত্যিই বলেছেন। শ্যামল নামের ছেলেটাকে নিয়ে সুস্মিতারূপী মুশকান গতকাল ঢাকায় চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে কেউ জানেনা।

ছফা অনেকটা হতাশ হয়েই পিএস আশেক মাহমুদকে ফোন দেয়, কিন্তু তার ফোনটা বন্ধ পেয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে সে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কী করবে। তবে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। একটু পরই পিএস তাকে ফোন দেয়। ছফা যখন জানাল, সুস্মিতারূপী মুশকান সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে গেছে, তখন দুঃসংবাদটি শুনে আশেক মাহমুদ উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে, সুস্মিতা যদি মুশকান জুবেরি হয়ে থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই, সে এখন তার হাতে বন্দি।

কথাটা শুনে যারপরনাই অবাক হয় ছফা। পিএস তখন সংক্ষেপে সবটা জানায়। হাসপাতালে তার পরিচিত এক ডাক্তার তাকে জানিয়েছিল, ডাক্তার আসকারকে দেখতে এক মেয়ে এসেছে, নাম তার সুস্মিতা। ডাক্তারের খুবই ঘনিষ্ঠ, কেননা তাকে স্পেশাল কেবিনে ঢুকতে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।পিএস তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বুড়ােকে বাগে আনার জন্য, তার কাছ থেকে মুশকানের খবর আদায় করার জন্য ওই মেয়েকেও নজরদারিতে রাখবে। দরকার হলে তাকে কব্জায় নিয়ে নেবে যাতে করে ডাক্তারকে বাধ্য করা যায় মুশকানের সন্ধান দিতে।কিন্তু আজকে কলকাতা থেকে রওনা দেবার আগে ছফা যখন তাকে জানিয়ে দিল, মুশকান জুবেরি কলকাতায় প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পালটে ফেলেছে, সুস্মিতা সেজে সুন্দরপুরে আছে, তখন আর দেরি করেনি আশেক মাহমুদ। আসলামকে দিয়ে মেয়েটাকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়। খবরটা ছফাকে তখনই জানাতে গেছিল, কিন্তু ওই সময় তার ফোন বন্ধ পায়। ছফা তখন কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছে, নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল সম্ভবত। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি এক মিটিং-এ চলে গেলে নিজের ফোনটাও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় পিএস, তাই একটু আগে ছফাও তাকে ফোন করে পায়নি। যাই হােক, সুসংবাদটি শােনার পর ছফা আর দেরি করেনি, দ্রুত সুন্দরপুরের এসপির গাড়িটা ধার নিয়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

” এখন ঢাকার প্রবেশপথে আছে নুরে ছফা। টের পেল উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছে সে। অবশেষে মুশকান জুবেরিকে সে ট্র্যাক ডাউন করতে পেরেছে! মহিলা এখন তাদের হাতে বন্দি!

****

ডাক্তার আসকার একটু আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবারও ফোন দিয়েছিলেন। ভদ্রলোেক যখন বিরােধীদলে ছিল তখন নিয়মিত অরিয়েন্ট হাসপাতালের সেবা নিত বিনে পয়সায়। প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালই কিছু রাজনীতিককে এভাবে বিনে পয়সায় সেবা দিয়ে থাকে, অরিয়েন্ট হাসপাতালও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সরকারের তিন-চারজন মন্ত্রী আর বেশ কয়েকজন এমপির সঙ্গে ডাক্তারের সখ্যতা রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার সেই সখ্য আরও বেশি। যে-কোনাে সময় যে-কোনাে প্রয়ােজনে তাকে ফোন করতে পারেন তিনি। তারপরও এখন মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখে প্রধানমন্ত্রীর পিএস!

মন্ত্রীকে তিনি জানিয়েছেন, তার মেয়ে সুস্মিতা বনানীর বাসা থেকে উবারে করে এয়ারপাের্টে রওনা দিয়েছিল, কিন্তু ফ্লাইট মিস করেছে। তারপর থেকেই ওর কোনাে হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছেন। কথাটা শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব অবাক হয়েছে। ডাক্তার কি কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করছেন? এমন প্রশ্নে আসকার ইবনে সায়িদ কোনাে রকম ভণিতা না করেই বলেছেন, তাকে যে ব্যক্তি ইমিগ্রেশন পার হতে বাধা দিয়েছে, সেই একই ব্যক্তি নুরে ছফা নামের ডিবি অফিসারকে দিয়ে সুস্মিতাকে অপহরণ করেছে বলেই তার বিশ্বাস।  কিন্তু মন্ত্রী খুব অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন,কী এমন ঘটে গেছে যে, তার মেয়েকে অপহরণ করবে ওরা ? ডাক্তার পরিহাসের হাসি দিয়ে বলেছিলেন, তিনিই বা কী অপরাধ করেছেন যে, তাকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়া হল?

এ কথা শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেছে, সে খোঁজ নিয়ে দেখবে, কী ঘটেছে আসলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনাে আপডেট জানতে পারেননি তিনি।

যেভাবে উদ্বিগ্নতা তাকে চেপে ধরছে, একটু পর হয়তাে সত্যি সত্যি আইসিসিইউ-তে নেওয়ার দরকার হবে। এর আগে নুরে ছফার হাত থেকে বাঁচতে সামান্য নার্ভাস ব্রেক ডাউনকে হার্ট অ্যাটাকের অভিনয় করে পার পেয়ে গেছিলেন।কিন্তু এখন সত্যি সত্যি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন।

অধ্যায় ৭২

সুস্মিতা হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ মেরে গেছে এখন।

বারবার বলে যাবার পরও এ ঘরের দু-জন মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারেনি সে মুশকান জুবেরি নয়। তার নাম সুস্মিতা সমাদ্দার। ডাক্তার আসকার তার বাবা।

“সুস্মিতা সমাদ্দার কী করে ডাক্তার আসকারের মেয়ে হয়?”আশেক মাহমুদ জানতে চাইল।

বিরক্তিতে ভরে উঠল বন্দির মুখ। অসভ্য আর অশিক্ষিতের মতাে প্রশ্ন! আর এটা তাকে এই প্রথম শুনতে হচ্ছেনা।

“আপনি যদি মনে করে থাকেন আপনাকে ধরে এনে এটা জানতে চাচ্ছি, আপনি মুশকান জুবেরি কিনা তাহলে ভুল করছেন। প্রধানমন্ত্রীর পিএস বেশ আয়েশ করে এক পায়ের ওপর আর-এক পা তুলে সােফায় বসে আছে এখন। বন্দির চেয়ারের কাছে। দাঁড়িয়ে আছে আসলাম।

“এসব করে সময় নষ্ট করার কোনাে ইচ্ছেও আমার নেই,” আশেক মাহমুদ বলল। “এর চেয়ে অনেক জরুরি প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতে হবে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সুস্মিতা।

“আমি আপনাকে দুটো প্রশ্ন করব। আপনি যদি ভেবে থাকেন ছলচাতুরি করে পার পেয়ে যাবেন, তাহলে বিরাট বড়ো ভুল করবেন।”

“কী প্রশ্ন, আপনার?” গভীর করে দম নিয়ে সন্দেহের সুরে জানতে চাইল সুস্মিতা। “তার আগে বলুন, আপনি কে।”

“চুপ, খানকি!” তেঁতে উঠল আসলাম। পিএসের সামনে এই ডাইনীকে গালি দিতে মোটেও দ্বিধা করল না সে।“বস যা বলবে তার জবাব দিবি, পালটা কোনাে প্রশ্ন করবি না!”

সুস্মিতা কয়েক মুহূর্ত কটমট চোখে আসলামের দিকে চেয়ে থেকে আশেক মাহমুদের দিকে ফিরল। তার মার্জিত পােশাক আর অভিজাত ভাবভঙ্গি দেখে গােলকধাঁধায় পড়ে গেছে সে। লােকটা কে হতে পারে, কোনাে ধারণাই করতে পারছে না।

মেয়েটার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল পিএস,

“হাসিবকে কী করেছেন?”

– বন্দি আবারও গভীর করে দম নিয়ে নিল। “আমি মুশকান জুবেরি নই। আর নামের কাউকে কখনও চিনতামও না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে কিচ্ছু করার নেই। কিন্তু বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করবেন না। বড্ড অসহ্য লাগছে।”

চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইল আশেক মাহমুদ, তারপর আসলামের দিকে ‘আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলব।”

চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল পুলিশের সাবেক এসআই। বসের ইশারা বুঝতে এক সেকেন্ডও দেরি হয় না তার।

“মুশকান জুবেরি!” ঘর থেকে আসলাম চলে যাবার পর দাঁতে দাঁত পিষে বলল আশেক মাহমুদ। “আমি জানি হাসিবের সঙ্গে কী করেছিস তুই!”  মুখ তুলে তাকাল সুস্মিতা। তাকে একা পেয়ে লােকটার ভাবভঙ্গী যে বদলে গেছে বুঝতে পারল। কিন্তু সে-ও কম যায় না। রেগেমেগে বলে উঠল, “ফাক ইউ!”

নিজের রাগটা দমন করে বেশ শান্তকণ্ঠে বলল পিএস, “তুই কী চাস, ওই ছেলেটা বেঘােরে মারা যাক?”  এ কথায় কাজ হল, অস্থির হয়ে উঠল বন্দি। “ও একটা নিরীহ ছেলে….ওর কিছু করবেননা!”কাকুতি মিনতি করে জানাল সে।তার কণ্ঠ এখন ভঙ্গুর শােনাচ্ছে। “প্লিজ!”  শীতল চোখে তাকাল আশেক মাহমুদ।“যে তােকে এখানে তুলে এনেছে, সে কতটা ভয়ংকর তাের কোনাে ধারণাই নেই। আমি চাইলে সে তােকে ছিড়ে-খুবলে খাবে!” এ
তে বন্দির নিশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল।

“যা জানতে চাই তা বল, নইলে ওই ছেলেটা মরবে।”

গভীর করে দম নিয়ে নিল বন্দি। তার নার্ভ ভেঙে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। “আপনি আসলে কী চান, বলুন তাে?”

হেসে ফেলল আশেক মাহমুদ।“দ্যাটস গুড,” একটু থেমে সরাসরি বন্দির চোখের দিকে তাকাল।“হাসিব আমার বড়াে বােনের ছেলে ছিল, ওই বােনই আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। আর তুই তাকে…. ”অসমাপ্ত রাখল কথাটা।

সুস্মিতার কপালে ভাঁজ পড়ল আবার। ‘আমি জানতে চাই, ওকে খুন করলি কেন।”  মাথা দোলাল সুস্মিতা। ভঙ্গুর কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল সে, “আমি মুশকান না!”

পিএসআর সুস্মিতার দৃষ্টিআঁটকে রইল কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত। অবশেষে চোখটা সরিয়ে নিলবন্দি, কিছুই বলল না। চোখ বন্ধ করে রাখল কয়েক মুহূর্ত। যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। – “ওকে,” মাথা নেড়ে সায় দিল আশেক মাহমুদ।“সােজা আঙুলে ঘি উঠবে না মনে হচ্ছে।”

সুস্মিতা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ‘আসলাম?”বেশ জোরেই ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল পুলিশের সাবেক এসআই। “আঙুল বাঁকা করতে হবে।”

মুচকি হাসি দিল লােকটা। ঘরের এককোনে গিয়ে একটা কাগজের ব্যাগের ভেতর থেকে পলিথিনের ব্যাগ আর চওড়া স্কচটেপ বের করে নিয়ে এল। জিনিসগুলাের দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল বন্দি।  আশেক মাহমুদ ঘর থেকে চলে যাবার আগে সুস্মিতার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আক্ষেপে মাথা দোলাল।

পিএস ঘর থেকে চলে যেতেই আসলাম এসে দাঁড়াল সুস্মিতার ঠিক পেছনে। মেয়েটা আসন্ন বিপদ টের পেয়ে ছটফট করতে শুরু করে দিল। সে পেছনে ফিরে তাকানাের আগেই আসলাম মেয়েটার মাথা গলিয়ে পলিথিনের ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিল, তারপর গলার কাছে পলিথিন ব্যাগের মুখটা চেপে ধরে চারদিক স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে রােল থেকে এক ঝটকায় ছিড়ে ফেলল সেটা।  উদ্ভ্রান্তের মতাে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করে দিল সুস্মিতা। বুঝে গেছে কী হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে। সামনে এসে আগ্রহভরে চেয়ে রইল আসলাম।  এখন পলিথিন ব্যাগের ভেতরে সুস্মিতার মাথাটা। সে চিৎকার দিলেও ভোঁতা গােঙানি ছাড়া আর কিছুই শােনা যাচ্ছেনা। কয়েক মুহূর্ত পরই সে হাসফাঁস করতে শুরু করে দিল অক্সিজেনের অভাবে। দম নেবার চেষ্টা করতেই পলিথিনের ব্যাগটা লেপটে যেতে শুরু করল তার মুখে। মুখ হা করে অক্সিজেন নেবার চেষ্টা করেও কিছুই পাচ্ছে না। তার চোখ দুটো বিস্ফোরিত হবার উপক্রম হল।

আসলামকে দেখে মনে হল, দৃশ্যটা বেশ উপভােগ করছে সে।

অধ্যায় ৭৩

বার কয়েক মৃত্যুর খুব কাছে চলে এসেছিল সুস্মিতা। তবে সে জানত তাকে মেরে ফেলা হবে না, ভয় দেখানাের জন্যই মৃত্যুর স্বাদ দিচ্ছে কেবল।

পলিথিন ব্যাগের ভেতরে আবদ্ধ থেকে তার দম যখনই ফুরিয়ে যাচ্ছিল, নিশ্বাস নেবার জন্য ফুসফুস ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছিল, ঠিক তখনই তার অপহরণকারী পলিথিন ব্যাগটা দু-হাতে টেনে ছিড়ে ফেলেছে। একটু আগেও তাই করেছে লােকটা।

উদ্ভ্রান্তের মতাে বুকভরে নিশ্বাস নিল সে। তারপর শ্বাসপ্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে ঘৃণাভরে তাকাল অপহরণকারীর দিকে। আস্ত একটা পিশাচ। তার সুতীব্র যন্ত্রণা উপভােগ করেছে পশুটা। অসূর বােধহয় এমনই হয়!

“এখনও বলবি না?” আসলাম মুচকি হেসে বলল। “নাকি আরও ব্যাগ নষ্ট করতে হবে?”

“তােকে আমি ছাড়ব না, ইউ ব্লাডি মাদার ফাকার!”  হা-হা করে হেসে উঠল আসলাম। “আমিও চাইনা তুই আমাকে ছেড়ে দে।”কথাটা বলল লম্পটের মতাে হাসি দিয়ে। তারপর সুস্মিতার খুব কাছে এসে, তার চোখে চোখ রেখে বলল,“আমি চাই….আমাকে ধরে রাখবি  অনেকক্ষণ! ধরবি আর ছাড়বি! ছাড়বি আর ধরবি! অনেকক্ষণ ধরে করবি এটা!”

অসহায়ের মতাে তাকাল সুস্মিতা। এরকম পারভার্ট আর সাইকোপ্যাথের খপ্পরে যে পড়বে কখনও ভাবেনি।

বেশ শান্তকণ্ঠে বলল গানম্যান, “ভেবে দেখ এখন যদি স্বীকার না করিস তাে অন্য মেথড ইউজ করব। সেটা কিন্তু তাের জন্য ভালাে হবে না।”কথাটা বলার সময় জিপারে হাত রাখল ইঙ্গিতপূর্ণভাবে।

কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল বন্দি। সে জানে তথ্যটা আদায় না করে তাকে হত্যা করবেনা এরা। সুতরাং নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তথ্যটা বলে দেওয়া মানে মৃত্যুকে স্বাগত জানানাে। গভীর করে দম নিয়ে নিল। “আমার একটা সামান্য শর্ত ছিল, ওটা মানলে আমি সব বলে দেব।”

মেয়েটার এমন দৃঢ়তা দেখে দারুণ অবাক হল আসলাম। “তাের বসকে বল এসব করে করে শুধু সময় নষ্ট করছে  মরে গেলেও
বলব না।”

“খানকি মাগি!” দাঁতে দাঁত পিসে বলে উঠল আসলাম। সজোরে চড় মারল একটা। সেই চড়ের জোর এতটাই যে, কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করল বন্দি। আর-একটা চড় মারার জন্য যেই না হাত তুলবে, অমনি পিএসের কণ্ঠ শুনে থমকে গেল আসলাম।

“দরকার নেই।” আশেক মাহমুদ ঘরে ঢুকেছে এইমাত্র। আসলাম সরে এল বন্দির কাছ থেকে।

“ছেলেটার জন্য তার অনেক দরদ!”শান্তকণ্ঠে বলল পিএস।“কত দরদ সেটাও একটু পরই জানা যাবে,”মুচকি হাসল সে।“নীচে গিয়ে ওই ছেলেটার একটা আঙুল কেটে এনে ওকে দেখাও। তারপরও যদি না বলে তাহলে আর-একটা আঙুল কাটবে। দেখি, কতক্ষণ এসব সহ্য করে সে।”

সুস্মিতা তীব্র আতঙ্কে চেয়ে রইল। শ্যামলের জন্যে তার মমত্ব প্রকাশ করে যে বিরাট বড়ো ভুল করে ফেলেছে তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।

আসলাম মাথা নেড়ে সায় দিল।

উদ্ভ্রান্তের মতাে বলে উঠল বন্দি, “ওকে টর্চার করে আমার কাছ থেকে কথা আদায় করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না, করলে আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেব।”

অবাক হল পিএস। “কী সিদ্ধান্ত নিবি তুই?” “আমি তখন ধরেই নেব,শ্যামল এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন না আপনারা। সুতরাং যা জানতে চান, সেটাও আমি বলব না। যত ইচ্ছে টর্চার করুন।”

বন্দির এমন দৃঢ়তা দেখে পিএস একটুও হতােদ্যম হল না, মুচকি হাসি দিল শুধু। “আসলাম, তুমি নীচে যাও। যা বললাম তাই করাে।”

পিএসের কৌশলটা বেশ ভালাে লাগল গানম্যানের। হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হবে অমনি বন্দি হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠল। “প্লিজ! ওই ছেলেটার কিচ্ছু করবেন না। প্লিজ! আমি সব বলব আপনাকে!”

হাত তুলে আসলামকে থামিয়ে দিল আশেক মাহমুদ। তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। “তাহলে দেরি করছিস কেন? বল” ধমক দিয়ে বলল আসলাম।

এমন সময় পিএসের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কলার আইডি দেখে থমকে গেল সে।“আমি একটু আসছি,”আসলামকে বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল আশেক মাহমুদ।  কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল গানম্যান। প্রায় মিনিটখানেক পর বাইরে থেকে পিএসের কণ্ঠটা ভেসে এল।

“আসলাম….একটু বাইরে আসাে।” সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে গেল আসলাম। পিএসের চোখেমুখে অসন্তুষ্টি।

“কী হয়েছে, স্যার?”

“নুরে ছফা চলে আসার আগেই যা করার করতে হবে।”

আসলাম জানে, করার মতাে দুটো কাজই আছে :মুশকানের কাছ থেকে একটা আদায় করা, আর তার সঙ্গে যে ছেলেটা আছে তাকে সরিয়ে দেওয়া।

অরিজিনাল রােলেক্স ঘড়িতে সময় দেখে নিল পিএস। “আমাদের হাতে বেশি নেই। তুমি এখানেই থাকো, আমি একটু একা ওর সঙ্গে কথা বলব।”

অধ্যায় ৭৪

আশেক মাহমুদকে ঘরে একা ঢুকতে দেখে সুস্মিতা অবাক হল একটু।অপহরণকারী লােকটা কোথায় গেছে অনুমান করতে পেরে ভড়কে গেল সে।

বন্দির দিকে ধীরপায়ে হেটে এসে পিএস বলল, “এখন বল ঠিক কোন জিনিসটা তুই খাস? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবি না।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইল সুস্মিতা। “শেষ পর্যন্ত তুই কিন্তু বলবি  ভালাে হয় ওই ছেলেটার সঙ্গে খারাপ কিছু করার আগেই বলে দিলে।”

গভীর করে দম নিয়ে নিল সুস্মিতা। নিজের সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম করছে যেন। “বল”দাঁতে দাঁত পিষে বলল আশেক মাহমুদ। নিজেকে ধাতস্থ করে স্থিরচোখে তাকাল পিএসের দিকে। “আমি সেটা বললেই কি আপনি ওই জিনিস সংগ্রহ করতে পারবেন? কী করে পারবেন?” সুস্মিতা কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল যেন।

“সেটা নিয়ে তােকে ভাবতে হবে না,”দাঁতে দাঁত পিষে বলল আশেক মাহমুদ। “আমি যা জানতে চাইছি সেটা বল” ধমক দিয়ে উঠল আবার।

“ধমক দিচ্ছেন কেন?”শান্তকণ্ঠে বলল সুস্মিতা।“বলছি তাে, ওটা আমি বলব।” “জাস্ট নেম ইট!” চোয়াল শক্ত করে বলল পিএস। সুস্মিতা কিছু একটা বলল প্রায় অস্ফুটস্বরে। “কী বললে?” মেয়েটা থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে পিএস। তার বলা কথাটা শুনতে পায়নি স্পষ্টকরে।

“বেশি জোরে বলতে পারব না, তাহলে ও শুনে ফেলবে,” দরজার বাইরে থাকা আসলামের দিকে ইংগিত করল।

“ও শুনবে না,” জোর দিয়ে বলল পিএস। “যদি শুনে ফেলে?” গভীর করে নিশ্বাস নিল আশেক মাহমুদ। “শুনলে কী হবে?ও আমার অনেক বিশ্বস্ত।” “আপনি শিয়াের, ও শুনে ফেললে কিচ্ছু হবে না?” সুস্মিতার হেঁয়ালিটা মােটেও ভালাে লাগল না পিএসের। রেগেমেগে কাছে এসে তার চুলের ঝুঁটিটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল।“জাস্ট সেইট….ইউ বিচ!”

বন্দি বেশ শব্দ করে নিঃশ্বাস নিল, যেন আশেক মাহমুদের শরীরে গন্ধ নিচ্ছে। মেয়েটার এমন আচরণে ভড়কে গিয়ে চুলের মুঠিটা ছেড়ে দেবে পিএস,তার আগেই দেখল ফিশফিশিয়ে কী যেন বলে উঠল সে।

‘কী বললে?”উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল আশেক মাহমুদ। “অত জোরে বলতে পারব না….কাছে এসাে, পিএস দেখতে পেল, বন্দির অভিব্যক্তি পালটে গেছে, নেশাগ্রস্তের মতাে দেখাচ্ছে তাকে!

“আমি চাইনা এটা অন্য কেউ জেনে যাক!”নীচু কণ্ঠে বলল সে।

আশেক মাহমুদ বন্দির খুব কাছে চলে এল।হাত-পা বাঁধা এক মেয়ে কীইবা করতে পারবে! সুতরাং মেয়েটা মুশকান জুবেরি জানা সত্ত্বেও পিএস বিন্দুমাত্র ভয় পেল না। ঘরের বাইরে তার গানম্যান আসলাম আছে, উলটাপালটা কিছু করলে একে ছিড়ে খুবলে খাবে সে।

“আবার বল”তাড়া দিল পিএস।

বন্দি খুবই নীচুকণ্ঠে বলে দিল যেটা জানার জন্য আশেক মাহমুদ উতলা হয়েছে। কান খাড়া করে শুনে গেল সেটা। তারপর একটু পিছিয়ে গেল সে। তার চোখেমুখে বিজয়ীর অভিব্যক্তি, যেন মহার্ঘ্য কিছুজানতে পেরেছে।

“ওই ষণ্ডাটা জানলে কিন্তু তােমাকেই খেয়ে ফেলবে!”

কথাটা শুনে স্থির চোখে চেয়ে রইল আশেক মাহমুদ।তবে নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হল।“ওকে নিয়ে তাের চিন্তা না করলেও হবে, ভাইনি কোথাকার!”

“ডাইনী বলে গালি দেবে না, বলে দিচ্ছি!” নেশাগ্রস্তের মতাে করে বলল মেয়েটি। যেন দীর্ঘসময় ধরে বন্দি অবস্থায় থেকে, টর্চার হতে হতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তারপর হেসে ফেলল বন্দি।“গান্ডু কোথাকার!”  আশেক মাহমুদ সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। এই গালিটার মানে তার জানা নেই।“কী বলতে চাইছিস, তুই?”অবশেষে বলল সে।  সুস্মিতা আরও কিছু বলতে যাবে, অমনি তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ফোনের ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখেই
ভ্রু কুঁচকে গেল তার!আস্তে করে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল আবার। আসলামকে ইশারা করল ঘরের ভেতরে যাবার জন্য।

“হা, বলুন….”সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে এসে বলল পিএস!তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করেছে।“ডাক্তার আসকারের সঙ্গে আপনার সমস্যাটা কী, একটু বলবেন? তাকে আপানি দেশের বাইরে যেতে দিচ্ছেন না কেন? তিনি তাে খুব অসুস্থ, বিদেশে যাওয়াটা খুবই জরুরি।”

গভীর করে দম নিয়ে নিল প্রধানমন্ত্রীর পিএস। তার দল ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আর উপমন্ত্রী রিক্রুট করার সময় অনেকেই জোর লবিং শুরু করেছিল, আশেক মাহমুদকে ধরেও ছিল অনেকে। যেন তাদের ভাগ্যে মন্ত্রীত্বের শিকে ছেড়ে। পিএস তখন এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হয়ে তদবির করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তবে এটাও ঠিক, তার তদবিরে ভদ্রলােক মন্ত্রীত্ব পায়নি। প্রধানমন্ত্রীর গুডবুকে আগে থেকেই নামটা ছিল। সম্ভবত মন্ত্রীত্ব লাভের পর ভদ্রলােক এটা জেনেও গেছে, তাই পিএসের প্রতি খুব একটা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে না।

“আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলব। আপনি ডাক্তারকে নিয়ে চিন্তা করবেন না  পুরােপুরি সুস্থ আছে, অসুস্থতার ভান করে বিদেশে যেতে চাইছে সে।”  ফোনের ওপাশে নীরবতা নেমে এল। “ওঁর মেয়ে ”কয়েক মুহূর্ত পর দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল মন্ত্রী, “ বাড়ি থেকে বের হবার পর আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তার।”

“তাই নাকি।” রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটাই ব্যবহার করল সে।

“মেয়েটার ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার সঙ্গে আর-একটা ছেলেও আছে  একেবারেই নিরীহ একটা ছেলে।”

পিএস আরও কিছু শােনার জন্য চুপ মেরে রইল। মন্ত্রীর ইংগিতটা ধরতে বেগ পেতে হল না তার নিরীহ কারাের ক্ষতি যেন না করা হয়।

“ওদের সঙ্গে খারাপ কিছু হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া খুবই কঠিন হয়ে যাবে।”

“আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?” এবার একটু আগ্রাসি না হয়ে পারল না আশেক মাহমুদ।

ফোনের ওপাশে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শােনা গেল। “ডাক্তার আসকারের সন্দেহ, যে লােক তাকে বিদেশে যেতে বাধা দিয়েছে, সে-ই তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে।”

আশেক মাহমুদ নিজের ক্রোধ সংবরণ করে নিল দ্রুত। এরকম পরিস্থিতি যে হবে ধারণাও করতে পারেনি। তবে সমস্যা মােকাবিলা করার অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদতে নিজেদেরই লােক, তারা সবাই একে অন্যকে চেনে। এমন নয় যে, সরকারের এক মন্ত্রী কোনাে কিছু করল আর বাকিরা সেটা জানতে পারল না— এটা আসলে ওপেন সিক্রেট ক্লাব। প্রায় সবাই সবার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল থাকে। সুতরাং তার কাছে মুখােশ পরে থাকার কোনাে দরকার নেই।

“শুনুন, আশফাক সাহেব,” শান্তকণ্ঠে বলল পিএস। “আগেই বলেছি, দেখা করে আপনাকে সব খুলে বলব। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। তবে আপনাকে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ডাক্তার আসকার যাকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করছে, আদতে সে তার মেয়ে তাে দূরের কথা, কোনাে রিলেটিভও নয়।”

“বলেন কী!” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঁৎকে উঠল। “তাহলে ডাক্তার কেন এটা বলছেন?”

“কারণ সে একজন অপরাধীকে বাঁচাতে চাইছে।” “কীসের অপরাধী? কার কথা বলছেন আপনি?”

এবার পিএস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “বললাম তাে, আমি আপনাকে খুলে বলব জলদি।” একটু থেমে আবার বলল, “আপনি শুধু আপাতত কয়েকটা দিন ওই ডাক্তারকে অ্যাভয়েড করুন। বুঝতে পেরেছেন?”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কিন্তু উনি যদি কেসটেস করে বসেন, মাথা দোলালাে আশেক মাহমুদ। যদিও ফোনের ওপাশে যে আছে, সে এটা দেখতে পাচ্ছে না। “ট্রাস্ট মি, ডাক্তার এটা করবে না  ভুলেও না।”

ফোনের ওপাশ থেকে আবারও নেমে এল নীরবতা। “ওই নিরীহ ছেলেটা”স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশফাক ম্রিয়মান কণ্ঠে বলল, “ আমি চাই না কোনােরকম কোলাটেরাল ড্যামেজ হয়। বুঝতে পেরেছেন তাে?”

আশেক মাহমুদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।“ডােন্ট ওরি।”কলটা ওপাশ থেকে কেটে দেওয়া হলে উদাস হয়ে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।তারপর সংবিৎ ফিরে পেতেই ফোনটা পকেটে রেখে আবারও ফিরে গেল ঘরে।

Back to top button
error: Content is protected !!