rabindranath ekhane kokhono asen ni pdf part 98 to last link
অধ্যায় ৯৮
অভিজাত এলাকা বারিধারায় এসে নুরে ছফা আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টি শেষে সব মেঘ উধাও হয়ে গেছে, এখন বিশাল ফাঁকা শূন্যতা মাথার ওপরে। শহরের ওপর দিয়ে বইছে ঠান্ডা বাতাস। তার শরীরে লেপটে আছে ভেজা জামা-কাপড়।
বিগত দেড়-ঘণ্টা ধরে সে আর তার সহকারী জাওয়াদ ভীষণ ব্যস্ত। পিএসের বাড়ির সিসিক্যাম ফুটেজ দেখা থেকে শুরু করে তাদের অনুসন্ধান, সেখানে মুশকান জুবেরির ফুটেজ পেয়েছে। আরও দেখেছে বাড়ি থেকে বের হবার পর মহিলা কোথায় গেছে সেটাও। তবে পিএস, কেএস খান আর আসলামের ফোন নাম্বারগুলাে পুলিশের টেলিকমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে ট্র্যাক করার জন্য দিলে তারা জানায়—সবগুলাে ফোনই বন্ধ আছে এখন। উদ্বিগ্ন ছফা কেএস খানের ল্যান্ডফোনে কল দিয়ে জেনে নিয়েছে, আইনস্টাইন পুরােপুরি সুস্থ আছে।মি.খান জানতে চেয়েছিল, এখন কী অবস্থা, ছফা তাকে বলেছে এ মুহূর্তে সে ব্যস্ত আছে মুশকানকে ধরার কাজে, পরে তাকে সব জানাবে। যাই হােক, পিএসের অ্যাপার্টমেন্টের দারােয়ান যেরকমটি বলেছে- মুশকান কিছুটা পথ হেঁটে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকারে গিয়ে ওঠে। এটা তারা দেখেছে রাস্তায় বসানাে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের সিসিক্যামগুলাে থেকে।পিএসকে
দিয়ে ছফা তাদেরকে অনুরােধ করেছে, এই ট্র্যাক ডাউনের কাজে যেন তাকে সর্বতােভাবে সাহায্য করা হয়। গুলশানসহ এর আশেপাশের এলাকাগুলােতে অসংখ্য বিদেশি দূতাবাস আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিসসহ বিদেশি নাগরিকদের বসবাস রয়েছে, সেখানকার রাস্তার সিসিক্যামগুলাে অবশ্যই সচল থাকবে- যেমনটি শহরের অন্য অংশে থাকে না। ডিএমপির ক্যামেরায় গাড়ির ফুটেজ পেলেও বৃষ্টির কারণে প্লেট-নাম্বারটা স্পষ্ট বােঝা যায়নি। তবে ছফা তাদেরকে বলে দিয়েছে- সময়ের হিসেব করে গাড়িটাকে ট্রাক করে যেতে। জাওয়াদের কানে ইয়ারফোন লাগানাে আছে, ডিএমপির কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কানেক্টেড আছে সে। কিছুক্ষণ পর পর সেখান থেকে আপডেট দেওয়া হচ্ছে তাকে। তাদের থেকে তথ্য পেয়েই ছফারা চলে এসেছে গুলশান দুই নম্বর থেকে বারিধারার লেকের পাশ দিয়ে যাওয়া ইউনাইটেড নেশন রােড হিসেবে পরিচিত জায়গাটিতে। সেখান থেকে বারিধারার এগারাে নম্বর রােডে।
কিন্তু ছফার একটাই আশঙ্কা মনে, যে-কোনাে মুহূর্তে ডিএমপি থেকে জানানাে হবে গাড়িটার কোনাে খোঁজ পাচ্ছে না, কারণ অমুক রাস্তার পর তাদের সিক্যিামগুলাে বিকল হয়ে আছে। কিংবা সেখানে আদৌ কোনাে সিসিক্যাম নেই!
“স্যার, আরও সামনে গেছে,”জাওয়াদ বলল।
তাদের বাইকটা এগারাে নাম্বার রােডের পূর্ব দিকে এগিয়ে গেল। চার রাস্তার মােডের কাছে এসে বাইকটা থামাল সে। আর একটু সামনে এগােলে প্রগতি সরণি, আর ডান থেকে বাঁয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটার নাম পার্ক রােড।
“ওকে,” ইয়ারফোনে কিছু শুনে বলল জাওয়াদ। “ডানে গেছে।” বলেই বাইকটা নিয়ে ডান দিকে ছুটে গেল। কিছুটা পথ গিয়েই থামল সে। “স্যার, অবশেষে গাড়িটার প্লেটনাম্বার স্পষ্টভাবে দেখা গেছে,” উত্তেজিত হয়ে বলল সহকারি। ইয়ারফোনে শুনে। আবার বলল, “ঢাকা-ট ১১-২৫৭৭।”
বাইক থেকে নেমে পড়ল ছফা।“ওদেরকে বলে দাও এই নাম্বারটা যেন এক্ষুণি পুলিশ আর ট্রাফিকের সবগুলাে পেট্রল টিমের কাছে সার্কুলের করে দেয়। ট্রাফিক কন্ট্রোলরুমেও জানিয়ে দিতে বলাে!” ছফাও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে খবরটা শােনার পর। “গাড়িটা যেখানেই পাবে সেখানেই যেন আটকে দেয়। ভয়ংকর এক খুনি খুন করে এই গাড়িতে করে পালাচ্ছে।”
জাওয়াদ সেটাই করল।
নির্জন রাস্তায় পায়চারি করছে ছফা সিনিয়রের উত্তেজনা টের পেয়ে বাইকটা স্ট্যান্ড করে চলে এল জাওয়াদ।“স্যার, সিগারেট খাবেন?” সে ভালাে করেই জানে, টেনশনের মুহূর্তে সিগারেট না খেলে তার বসের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।
“হুম,” সংক্ষেপেই বলল নুরে ছফা। একটা সিগারেটের বড্ড দরকার এখন। তার প্যাকেটটা অনেক আগেই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।
পকেট থেকে প্যাকেট বের করে ছফার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল।সিগারেটটা ঠোটে চেপে ধরতেই জাওয়াদতার লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল তাতে। পর পর বেশ কয়েকটি লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ছফা।
“ডিএমপি এত দেরিতে আপডেট দিচ্ছে কেন?”
জাওয়াদ এর জবাব না দিয়ে ইয়ারফোনে বলল, “এনি আপডেট ?”তার মুখটা কালাে হয়ে গেল।“পুরাে রাস্তার সবগুলােই অচল?”
চমকে উঠল ছফা। “আচ্ছা, আরও সামনে দেখুন হুম,”কথাটা বলেই সিনিয়রের দিকে তাকাল। “কী হয়েছে?” “এই পার্ক রােডের বাকি সিসিক্যামগুলাে নাকি বিকল।”
হতাশ হয়ে পড়ল ছফা। একটু আগেই এরকম আশঙ্কা করেছিল সে। সিগারেটে জোরে জোরে কয়েকটা টান দিল।
এমন সময় জাওয়াদ আবার ইয়ারফোনে মনােযােগ দিল। “হুম বলেন ” মাথা দোলাল। “পার্কের মােড়েরটা? তাই নাকি!”
ছফার ভ্রু কুঁচকে গেল। মাথা নেড়ে সায় দিল সহকারি, সিনিয়রের দিকে তাকাল সে।“স্যার, সামনে পার্কের যে মােড়টা আছে, তার ডানদিকে আট নাম্বার রােডটা চলে গেছে, ওখানকার সিসিক্যামে গাড়িটার কোনাে ফুটেজ পাওয়া যায়নি।”
অধ্যায় ৯৯
ডিএমপির সিসিক্যামে গাড়িটার যে কোনাে ফুটেজ পাওয়া যায়নি তাতে ছফা হতাশ। হবার কথা কিন্তু তার বদলে সে আশার আলাে দেখতে পেল। জাওয়াদকে নিয়ে আরও সামনে এগিয়ে গেল সে। যেতে যেতেই দেখল পার্কের বাঁ-দিকের প্রায় সব বাড়ির মে
ইনগেটেই সিসিক্যাম আছে।
“এখানে বাইকটা থামাও,”পেছন থেকে বলল ছফা, নেমে পড়ল সে। পার্কের বিপরীতে যতগুলাে বাড়ি আছে গুণে দেখল। “দশ-বারােটা।” রাস্তাটা পূর্ব-পশ্চিমমুখী।ডিএমপির ফুটেজে দেখা গেছে, এই রাস্তায় গাড়িটা ঢুকেছে। কিন্তু পুরাে রাস্তায় যেহেতু ডিএমপির কোনাে ক্যামেরা কাজ করছেনা, তাইছফা একেবারে
পুবদিকের বাড়িটার সিসিক্যাম চেক করে দেখার সিদ্ধান্ত নিল।
ওই বাড়ির সিসিক্যামে গাড়িটার কোনাে ফুটেজ না পেয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। মানেটা তার কাছে পরিস্কার- এই দশ-বারােটা বাড়ির যে-কোনাে একটাতে ঢুকে পড়েছে ওই গাড়িটা!
“লােকাল থানায় ফোন করে একটা ব্যাকআপ টিম পাঠাতে বলাে, দ্রুত!”জাওয়াদকে তাড়া দিল সে। ছেলেটা তাই করল, তবে সরাসরি লােকাল থানায় ফোন করল না সে। ডিমএমপি-কে জানিয়ে দিল অনুরােধটি। পিএস আশেক মাহমুদর ডিএমপিকে আগেই বলে দিয়েছিল, তাদেরকে সব ধরণের সহযােগিতা করার জন্য।
“কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে, স্যার।”জাওয়াদ বলল।
মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। এ জায়গাটা তাকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে রাস্তার ডান পাশে পার্ক,বাঁ-দিকে একসারি আবাসিক ভবন।সংখ্যায় দশ বারােটা হবে। রাস্তার দুপাশে বাড়ি থাকলে এই সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যেত। গভীর রাতে বারিধারার পার্ক রােডে প্রবল উত্তেজনায় সিগারেট খেতে খেতে পায়চারি করতে লাগল ছফা। পার্কের বিপরীতে থাকা বাড়িগুলাের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। এইসব বাড়িগুলাের যে-কোনাে একটাতেই আছে মুশকান জুবেরি। সম্ভবত সুস্মিতাও! ও তার থেকে একটু দূরে স্ট্যান্ডের ওপর রাখা আছে জাওয়াদের বাইকটা। সে আবারও ডিএমপি-র সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। এখানকার থানার যে কয়টি পুলিশ পেট্রল টিম আছে
তাদের সবচেয়ে কাছেরটা পাঠানাের অনুরােধ জানাচ্ছে এবার। সে-ও বুঝতে পারছে, ঘটনার গুরুত্ব।
ছফা অধৈর্য হয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকাল। স্থানীয় থানায় ব্যাকআপ চেয়ে কল করার পর তিন-চার মিনিট সময় অতিক্রান্ত হলেও এরইমধ্যে বেশ কয়েকবার ঘড়ি দেখে ফেলেছে।
ছফার দিকে এগিয়ে এল জাওয়াদ। “এক্ষুণি এসে পড়বে, স্যার।” মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা। “ওর কাছে পিস্তল আছে।” সহকারী বুঝতে পারল কার কথা বলছে।“আমাদের কাছেও আছে।” “তারপরও, খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমি কোনাে রকম ক্যাজুয়ালটি চাই না।” “জি, স্যার।”
“আমরা যদি লােকেট করতে পারি, এখানে কোনবাড়িতে মুশকান আছে তাহলে ধরে নাও, সে কাউকে জিম্মি করতে পারে খুবই মরিয়া হয়ে উঠবে সে ধরা দিতে চাইবে
না।” জাওয়াদকিছুবলতে যাবে, অমনি দেখতে পেল দূরের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে স্থানীয় থানার ব্যাকআপ টিম। ছফাও সেদিকে তাকাল। জোরে জোরে সিগারেটে টান দিয়ে কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। পুলিশের একটা জিপ
আর পিকআপভ্যান এসে থামল তার সামনে। গাড়ি থেকে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ নেমে এল, স্যালুট দিল ছফাকে।
দলটির নেতৃত্বে যে এসআই আছে তার বুকে নেমপ্লেটে লেখা আছে সমীর। সে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল।
“এখানকার দশ-বারােটা বাড়ি সার্চ করতে হবে,” সিগারেটে টান দিয়ে বলল ছফা। “আমরা সার্চ টিম হিসেবে কাজ শুরু করব এখন।”
“জি, স্যার।”
“আসুন আমার সঙ্গে,” বলেই পুলিশের ছােটোখাটো দলটি নিয়ে সামনের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল ছফা। “এই বাড়ি থেকে এক এক করে সবগুলাে বাড়ি সার্চ করব।”
“সাসপেক্ট কয়জন, স্যার?”
“একজন,” সুস্মিতাকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখছে না সে। “তবে মহিলা দেখে আন্ডারএস্টিমেট করবেন না।”
মহিলা সাসপেক্টের কথা শুনে সমীর নামের এসআই বেশ অবাক হল। “সাসপেক্টের কাছে পিস্তল আছে।” মাথা নেড়ে সায় দিল পুলিশ। “মহিলা দেখতে ত্রিশ-বত্রিশের মতাে,” জানিয়ে দিল ছফা।
নিজের টহল দলের দিকে ফিরল এসআই। “সাসপেক্ট মহিলা। ত্রিশের মতাে বয়স। পিস্তল আছে তার কাছে।সবাই সাবধান!” এরপর ছফার দিকে ফিরল সে। চলুন স্যার।”
নিজের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে সেফটি লক খুলে রাখল নুরে ছফা। এটা দেখে এসআই সমীরও তার পিস্তলটা হােলস্টার থেকে বের করে নিল। একই কাজ করল জাওয়াদ।
কিন্তু ছফার নেতৃত্বে প্রথম বাড়িটার মেইনগেটের সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই ঘরঘর একটা শব্দ শুনতে পেল তারা। পাশ ফিরে তাকাল সবাই। তাদের থেকে পাঁচ-ছয়টা বাড়ির পরের বাড়িটার মেইনগেট খােলা হচ্ছে ভেতর থেকে। তারপরই সেখান থেকে বের হয়ে এল সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার- যে গাড়িটাকে ছফা এতক্ষণ ধরে খুঁজছে।
গাড়ির হেডলাইট জ্বালানাে নেই, ইনসাইড লাইটও বন্ধ। তাই দেখা গেল না কে চালাচ্ছে- পেছনের যাত্রীই বা কারা। দেরি না করে ছফা পিস্তল হাতেই দৌড়ে গেল সেদিকে। জাওয়াদ আর বাকি পুলিশের দলটিও একই কাজ করল। কিন্তু ছফা চিৎকার করে পিস্তল উচিয়ে গাড়িটাকে থামার জন্য বলতেই সেটা আচমকা গতি বাড়িয়ে ছুটে গেল রাস্তার ডান দিক দিয়ে। পলায়নরত গাড়িটাকে গুলি করবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পিস্তল নামিয়ে সহকারীর বাইকের দিকে ছুটে গেল সে। জাওয়াদও ততক্ষণে দৌড়ে চলে এসেছে তার বাইকের কাছে।
“আপনারা আপনাদের গাড়িতে উঠুন!”চিৎকার করে পুলিশের টহল দলটিকে বলল ছফা।
বাইকটা স্টার্ট দিতেই পেছনে উঠে বসল নুরে ছফা। জাওয়াদ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল গাড়িটাকে ধরার জন্য।
নির্জনরাতে এরকম জনমানবশূন্য রাস্তায় প্রচণ্ড গতি তুলতে কার্পণ্য করল না গাড়িটা। জাওয়াদও পাল্লা দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিল তার বাইকের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটার প্রায় পেছনে চলে এল তারা। ছফা পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার ভঙ্গী করল সতর্কতার অংশ হিসেবে, যাতে ড্রাইভার সাইড মিরর দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়। – কিন্তু গাড়িটা যে চালাচ্ছে সে অনেক বেশি মরিয়া। গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে। পেছনে তাকিয়ে ছফা দেখতে পেল, ব্যাকআপ টিমের জিপ আর ভ্যানটা তাদের পিছু পিছু আসছে।
“তুমি গাড়িটার ডানদিকে থাকো!” চিৎকার করে বলল ছফা।
জাওয়াদ তাই করল, গতি বাড়িয়ে প্রাইভেটকারটার ডানদিকের ড্রাইভিং ডােরের সমান্তরালে নিয়ে এল তার বাইকটা।ইনসাইড লাইট বন্ধ থাকার কারণে ঘন কালাে কাচের ভেতর দিয়ে ছফা দেখতে পেল না গাড়িতে যাত্রী হিসেবে কে আছে, কে চালাচ্ছে ওটা। তবে সে নিশ্চিত, মুশকান জুবেরি বসে আছে সেখানে। সঙ্গে হয়তাে সুস্মিতাও!
ছফা যে বাড়িগুলাে তল্লাশি করবে সেটা সম্ভবত দেখে ফেলেছে জানালা দিয়ে। বুঝে গেছে বাড়িতে থাকলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে। তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও গাড়িতে করে পালানাের চেষ্টা করেছে।
পিস্তলটা আবারও উঁচিয়ে ধরল সে-একেবারে ড্রাইভিং ডােরের কাচ বরাবর। আর তখনই গাড়িটার গতি আর একটু বেড়ে গেল, সেই সঙ্গে দ্রুত চাপতে শুরুকরল ডানদিকে। বাইকের গতি কমিয়ে গাড়িটার পেছনে চলে আসতে বাধ্য হল জাওয়াদ,নইলে গাড়িটার সঙ্গে ধাক্কা খেত তার বাইক। জাওয়াদ তার বাইকের গতি কমিয়ে প্রাইভেটকারের পেছনে চলে আসতেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল, কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। গাড়িটা আচমকা গতি কমিয়ে, সজোরে ব্রেক কষে ফেলল। জাওয়াদ না পারল তাল মিলিয়ে গতি কমাতে, না পারল ঠিক সময়ে ব্রেক কষতে। তার বাইকের সামনের চাকা গাড়ির পেছনের বাম্পারে গিয়ে সজোরে আঘাত হানল।
জাওয়াদ দেখতে পেল, বাম্পারের সঙ্গে আঘাত লাগতেই তার বাইকের সামনের চাকা বামদিকে ঘুরে গেল পুরােপুরি! হাত থেকে ছুটে গেল বাইকটার নিয়ন্ত্রণ, সজোরে বাড়ি খেল গাড়ির বুটের সঙ্গে। জাওয়াদ শুধু টের পেল তার ডান পা-টায় জোরে আঘাত লেগেছে। সেই সঙ্গে শুনতে পেল নুরে ছফার চিৎকারটাঃ “জাওয়াদ!”
বাইকসহ রাস্তায় পড়ে গেল জাওয়াদ আর ছফা। তবে পেছনে বসার কারণে গাড়ির সঙ্গে আঘাত হানার আগেই লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিল নুরে ছফা। তাদের কারােরই মাথায় হেলমেট নেই, ভয়ংকর কিছু হয়ে যেত আর একটুর জন্যে। ছফা দেখতে পেল, জাওয়াদ বাইকসহ পড়ে গেলেও তার মাথা রাস্তার পিচে গিয়ে আঘাত হানেনি। তবে ছেলেটার ডান পা আহত হয়েছে নির্ঘাত।
রাস্তায় পড়ে থেকেই ছফা দেখতে পেল সাদা রঙের গাড়িটা আচমকা ব্রেকমুক্ত হয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে গেল আবার। রাস্তায় আছড়ে পড়লেও হাত থেকে পিস্তলটা বেহাত হয়নি ছফার। রাস্তায় শুয়ে থাকা অবস্থায়ই সে গাড়ি লক্ষ করে পর পর দুটো গুলি চালাল। নিস্তব্ধ এলাকা প্রকম্পিত হল গুলির শব্দে। তার লক্ষ ছিল গাড়িটার পেছনের চাকাদুটো, কিন্তু একটা গুলিঁও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। গতি বাড়িয়ে গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যাকআপ টিমের জিপ আর ভ্যানটা দূর থেকে দেখেছে সব কিছু। জিপটা ছফাদের অতিক্রম করে চলে গেলেও ভ্যানটা থামল তাদের কাছে এসে। গাড়ি থেকে তিন-চারজন পুলিশ নেমে এল দ্রুত।
“ওকে দেখাে,” জাওয়াদকে দেখিয়ে বলল সে, হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দেখতে পেল বাইকের নীচে চাপা পড়ে আছে জাওয়াদের একটা পা। পুলিশদের দু-জন বাইকটা ধরে তুলে ফেলল, অন্য এক জন তুলে দাঁড় করাল জাওয়াদকে। ডান পা-টা সামান্য শূন্যে তুলে রেখেছে সে।
“তুমি ঠিক আছাে?” “পা-টা ভেঙে গেছে মনে হয়,”তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে বলল ছেলেটা।
“ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাও,”পুলিশদের বলল ছফা।
অমনি একজন পুলিশের ওয়াকিটকি ঘরঘর শব্দ করে উঠল, একটা কণ্ঠ বলে উঠলো“চার্লি টু। আমরা গাড়িটা আটকে ফেলেছি এগারাে নম্বর রােডের শেষে
প্রগতি সরণিতে যাবার আগে যে মােড়টা আছে সেখানে!”
“স্যার, ওরা গাড়িটাকে আটকে ফেলেছে!”
ওয়াকিটকিটা পুলিশের কাছ থেকে প্রায় কেড়ে নিল ছফা। “চার্লি টু সাবধান। গাড়িতে যে মহিলা আছে সে খুবই ডেঞ্জারাস! আগেই বলেছি, ওর কাছে পিস্তল আছে। সবাই সাবধান! আমি আসছি।” জাওয়াদের দিকে ফিরল চট করে। “কাছের একটা হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলাে আমি ভ্যানটা নিয়ে যাচ্ছি।”
“সাবধানে, স্যার!” জাওয়াদ বলল।
কিন্তু নুরে ছফা সেটা শুনল কী শুনল না বােঝা গেল না, সে ততক্ষণে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসেছে। ভ্যানটা চলতে শুরু করল দ্রুত।
এগারাে নম্বর রােডের মােড়ের কাছে আসতেই ছফা দেখতে পেল, সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি রাস্তার বামপাশে থেমে আছে, আর তার সামনে আড়াআড়ি করে রাখা আছে পুলিশের জিপটা। তিনজন পুলিশ সেই জিপকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের রাইফেল আর পিস্তল তাক করে রেখেছে প্রাইভেটকারটার দিকে।
পুলিশের পিকআপ ভ্যানটা প্রাইভেটকারের দশ গজ পেছনে এসে থেমে গেল, দ্রুত পিস্তল হাতে নেমে পড়ল ছফা। টের পেল হাঁটু আর বাম কনুইতে ব্যথা করছে। সম্ভবত ছিলে গেছে। এসব তুচ্ছ বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে সে অরক্ষি তভাবেই পিস্তল হাতে এগিয়ে গেল গাড়িটার দিকে।
সাদা রঙের গাড়িটার সব দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে কেউ তখনও বের হয়ে আসেনি। পুলিশের একজন ওয়ার্নিং দিচ্ছে চিৎকার করেঃ “অস্ত্রটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দাও!”
“স্যার, সাবধানে!”
পুলিশদের মধ্যে আর একজন বলে উঠল, কিন্তু ছফা গ্রাহ্যই করল না। প্যাসেঞ্জার ডোরের দিকে পিস্তল তাককরে হুংকার দিল সেঃ“দরজা খােলাে, মুশকান!”
কোনাে সাড়া না পেয়ে ছফা আবারও হুংকার দিতে যাবে, অমনি খট করে ডােরলক খােলার শব্দটা শুনতে পেল। ডান হাতের পিস্তলটা তাক করে রেখেই বাঁ হাত দিয়ে দরজার হ্যান্ডেলটা টান দিল সে।
কিন্তু পেছনের সিটে কেউ নেই!
অধ্যায় ১০০
কিছুক্ষণ আগে বারিধারার পার্ক রােডে অরিয়েন্ট হাসপাতালের মালিকানাধীন একটি অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুশকান দেখতে পায়, রাতের এ সময়েও নির্জন রাস্তায় একজন লােক সিগারেট ফুকতে ফুকতে পায়চারি করছে আর ভবনগুলাের দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার একটু দূরেই বাইক চালক কানে ইয়ারফোন গুঁজে কথা বলে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখলেও পায়চারি করতে থাকা নুরে ছফাকে চিনতে পারে সে!
তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল, এই ডিবি অফিসার তাদের এখানকার অবস্থান জেনে গেছে, পিএসের বাড়ি থেকে বের হবার সময় বেশ সতর্ক ছিল সে। তারপরও ছফা কীভাবে জেনে গেল?
মুশকানের শক্ত নার্ভ আজ রাতে আর একবার টলে গেছিল, কিন্তু বরাবরের মতােই দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। জানালার পর্দার আড়াল থেকে ছফার মধ্যে অস্থিরতাও দেখতে পায় সে।বারবার ঘড়ি দেখছিল সে।মুশকান ভড়কে না গিয়ে বােঝার চেষ্টা করে ঘটনা কী – তাদের বাড়িটা এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি, তবে যেভাবেই হােক, ডিবি অফিসার জেনে গেছে এখানকার কোনাে এক বাড়িতেই আছে তারা!
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, এখান থেকে বেরােতে হবে। ছফার হাত থেকে বাঁচতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
নীচে একটা গাড়ি আছে, আসকার তার বিশ্বস্ত একজনকে পাঠিয়েছে তাদেরকে এখান থেকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌছে দেওয়ার জন্য। আর একটু পরই তাদের রওনা দেবার কথা।
মুশকান গভীর করে শ্বাস নিয়ে নেয় বেশ কয়েক বার। স্নায়ুকে স্থির করে মাথা খাটাতে থাকে দ্রুত। তারপরই ঠিক করে, কী করতে হবে। চট করে ঘড়ি দেখে নেয় সে। যেকাজটা করবে, তার জন্যে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ছফার কথা। তাদের পরিকল্পনাটা আগের মতাে থাকলেও সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। তার কাছ থেকে সব শুনে ডাক্তার দ্রুত কাজে নেমে পড়েন।মুশকানকে সামান্য চিন্তিত দেখে সুস্মিতা জানতে চেয়েছিল কিছু হয়েছে কিনা, কিন্তু তাকে কিছু বলেনি। শুধু বলেছে, একটু পরই তারা এ বাড়ি থেকে বেরােবে। সুস্মিতা কোনাে প্রশ্ন না করে চুপচাপ ড্রইংরুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিয়ে একের পর চ্যানেল ব্রাউজ করতে শুরু করে দেয়।
ডাক্তারের কাছ থেকে ফোন পেয়ে জানালার সামনে আবারও দাঁড়ায় মুশকান। ছফা আর তার সহযােগী কথা বলছে। আসকারকে সে বলে দেয়, কী করতে হবে। আর এক ফোনে ডাক্তারের সঙ্গে তার বিশ্বস্ত লােকটা সংযুক্ত থাকায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন। আর তখনই মুশকান দেখতে পায় ছফা আর তার সহযােগীর কাছে এসে দাঁড়ায় পুলিশের একটা জিপ আর পিকআপভ্যান। গাড়ি থেকে পুলিশের দলটি নেমে ছফার সঙ্গে কথা বলতে থাকে। দৃশ্যটা দেখে ভড়কে যায় মুশকান। দেরি না করে ডাক্তারকে বলে দেয়। নীচে তার যে বিশ্বস্ত লােকটা আছে সে যেন এখন বাড়ি থেকে বের না হয়! আসকার জানতে চান কী হয়েছে, কিন্তু মুশকান আর তাকে কিছু বলেনি, শুধু একটু অপেক্ষা করতে বলে তাকে।
এর পরই দেখতে পায়, পিস্তল হাতে পুলিশদের দলটি নিয়ে বাঁ-দিকের কয়েকটি বাড়ির পরের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ডিবি অফিসার। দ্রুত বুঝে যায় মুশকান। আর দেরি করা সম্ভব নয়। ডাক্তারকে সে বলে দেয়, তার ওই লােক যেন এক্ষুণি বের হয়ে যায়।
একটু পরই জানালা দিয়ে সে দেখতে পায় নীচের মেইনগেটটা খুলে ফেলছে দারােয়ান। আর গেট খােলার ঘর্ঘর শব্দ শুনে ছফাসহ পুলিশের দলটি সেদিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য মুশকানের মনে হয়েছিল, তার পরিকল্পনাটা বুঝি ভেস্তে গেল। এর পরই যে গাড়িটা তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিল সেটা বেরিয়ে পড়ে হেডলাইট না জ্বালিয়ে। গাড়িটা দেখামাত্রই ছফা কালক্ষেপন করেনি,পিস্তল উঁচিয়ে ছুটে যায়, গাড়িটাকে থামানাের চেষ্টা করে। কিন্তু আসকারের বিশ্বস্ত লােকটা তখন গতি বাড়িয়ে পালানাের চেষ্টা করে। ছফার সহযােগী নিজের বাইকের দিকে ছুটে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দেয়, ছফাও চড়ে বসে বাইকের পেছনে। পুলিশের দলটিও দৌড়ে তাদের জিপ আর পিকআপভ্যানে উঠেপড়ে।
এটাই চেয়েছিল মুশকান!
সুস্মিতাকে নিয়ে দ্রুত নীচে নেমে আসে সে। বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় তারা দুজন। আসকারের সঙ্গে তখনও ফোনে যুক্ত ছিল। এর আগেই তাকে বলে দিয়েছিল, কী করতে হবে। সে জানত, ছফাকে খুব বেশিক্ষণ ফাঁকি দিতে পারবে না আসকারের ওই লােক। সুতরাং তাদের হাতে সময় খুব কম।
যে বাড়িতে তারা ছিল, সেই বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা বাড়ির পরই সাত নাম্বার রােডটার মােড়। সেখানে এসে আসকারকে বলে দেয় জায়গাটার অবস্থানের কথা, তারপর অপেক্ষায় থাকে সুস্মিতাকে নিয়ে। অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে আরও আগেই একটা অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিয়ে দিয়েছিল বারিধারার উদ্দেশ্যে, আসকার সেই গাড়ির ড্রাইভারকে বলে দেন মুশকানদের অবস্থানের কথা।
কিছুক্ষণ পরই অরিয়েন্ট হাসপাতালের লাশ পরিবহনের কাজে নিয়ােজিত সেই অ্যাম্বুলেন্সটি এসে হাজির হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মুশকান। সুস্মিতাকে নিয়ে দ্রুত উঠে বসতেই গাড়িটা ছুটতে শুরু করে নিঃশব্দে-ছফা আর পুলিশের দল যেদিকে গেছে, ঠিক
তার বিপরীত দিক দিয়ে।
এখন নিশুতি রাতে প্রায় ফাঁকা এই শহরে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে সেই অ্যাম্বুলেন্সটি। গাড়ির ভেতরে ছােট্ট উইন্ডােটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মুশকান। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় তাদের জন্য সুবিধাই হয়েছে। তবে সেই অস্বস্তি আবারও তাকে জেঁকে ধরেছে। কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে সে-ভয়ংকর কিছুর!
“তুমি ওই লােকটার সঙ্গে আর কিছু করােনি তাে?” সুস্মিতার দিকে ফিরল সে, কথাটা। আর না বলে পারল না।
“ওকে আবার কী করব?”অবাক হবার ভান করল মেয়েটা। স্থিরচোখে চেয়ে রইল মুশকান।“তুমি ভালাে করেই জানাে আমি কী বলতে চাইছি।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল আসকারের মেয়ে। তারপর যেন হার মানল এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। “ওকে অপচয় করাটা কি ঠিক হত ?!”
মুশকানের কপালে ভাঁজ পড়ল। “কত কষ্ট করে ওটা কালেক্ট করেছি, জানাে ? গাড়ির কাচ ভেঙে-”
“চুপকরাে!”দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল মুশকান। তারপরই কিছু একটা মনে পড়ে গেল তার। কিন্তু তুমি কী করে এটা জানলে?” রহস্যময় হাসি দিল সুস্মিতা, কিন্তু কিছুই বলল না। যেভাবে প্রথম বার ভেন্টিলেটর দিয়ে তার বাপাই আর মুশকানকে ডিনার করতে দেখেছিল, ওদের কথা শুনে ফেলেছিল, ঠিক একইভাবে সুকুমারের ডেডবডি থেকে সিক্রেট অর্গানটা নেবার দৃশ্যও দেখেছিল সে। প্রশ্নের জবাব না পেয়ে গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মুশকান। যেভাবেই হােক, মেয়েটা জেনে গেছে সিক্রেট অর্গানটার কথা। আর এটার পরিণাম কী হতে পারে ভেবে পেল না সে।
“যাহ” এমন সময় সুস্মিতা অনেকটা আঁৎকে উঠে বলল। চমকে তাকাল মুশকান।“কী হয়েছে?”
“তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে ওটা তাে ফেলে এসেছি ওই বাড়িতে!”আফসোসের সুরে বলল।
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল মুশকান তারপর আক্ষেপে মাথা দোলাল। তাকে মােটেও চিন্তিত দেখাল না।
“এখন কী হবে?” চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটিয়ে তুলল আসকারের মেয়ে।“তুমি ভাবতেও পারবে না, কত কষ্ট করে ওটা কালেক্ট করেছিলাম!”
“আমি ওটার গন্ধ পাচ্ছি!” কথাটা বলে অ্যাম্বুলেন্সের ছােট্ট উইন্ডাে দিয়ে আবারও বাইরে তাকাল সে। “ওটা তােমার পার্সেই আছে।”
বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল সুস্মিতা। তারপর জিভে কামড় দিয়ে বলল, “সরি!” তার দিকে ফিরেও তাকাল না মুশকান।
অধ্যায় ১০১
নুরে ছফার ইচ্ছে করছে সাদারঙের প্রাইভেটকারটা যে চালাচ্ছে তার বুক গুলি করে ঝাঁজরা করে দিতে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেল সে।
প্যাসেঞ্জার সিটে কেউ নেই!
তাকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। গাড়িটা যে চালাচ্ছে সে বারবার বলছে, রাত-বিরাতে ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছে ভেবে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। এছাড়া তার আর কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না।
লােকটার কথা বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। তাকে জেরা করা হবে, গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাবার আদেশ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের জিপে করে সে রওনা দেয় ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে এই গাড়িটা বের হয়েছে। যদিও জানত, ওখানে গিয়ে কিছুই পাবে না। এতক্ষণে তাদের সবাইকে বােকা বানিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। মুশকান জুবেরি।
আবারও!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ছফার ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পরই চলে এল পার্ক রােডের ওই বাড়িটার সামনে। জিপ থেকে নেমে বাড়িটার দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। দারােয়ান আর কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার, কিন্তু হুট করেই তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা চলে এল। জেরাটেরা বাদ দিয়ে নজর দিল আশেপাশের বাড়িগুলাের দিকে। এখানকার প্রায় সবগুলাে বাড়ির মেনগেটেই সিসিক্যাম দেখতে পেল সে। মুশকান যে বাড়িতে অবস্থান করছিল তার পাশের বাড়িতে নক করল সঙ্গে করে পুলিশ নিয়ে। বাড়ির দারােয়ান সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঢুলু ঢুলু চোখে অবাক হয়ে তাকালাে তাদের দিকে।
“এইখানে ইউএনসিএইচআরের–”
হাত তুলে দারােয়ানের ফাঁপড়বাজি থামিয়ে দিল ছফা। তাকে বলল, মেইনগেটের সিসিক্যামটা দেখতে চায়, আর কিছু না। বিরক্ত হলেও দারােয়ান তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিল।
পনেরাে মিনিট পর ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এল ছফা। একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স।
এই বাড়ির মেইনগেটের সিসিক্যাম ফুটেজে দেখেছে, তারা সাদা রঙের প্রাইভেটকারটার পেছনে ছুটে যেতেই মুশকান আর সুস্মিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই অরিয়েন্ট হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স চলে যায় সেদিকে। যদিও তাদেরকে সেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে দেখেনি, তারপরও ছফার বুঝতে বাকি রইল না।
দাঁতে দাঁত পিষে আকাশের দিকে তাকাল। ভােরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু রাত। ঢাকা থেকে বের হবার সবগুলাে পয়েন্টে গাড়িটার নম্বর জানিয়ে দেওয়া উচিত। মােবাইলফোনটা বের করে কল করতে যাবে এমন সময় রিংটোন বেজে উঠল। ল্যান্ডফোন থেকে পিএস আশেক মাহমুদ কল দিয়েছেন।
“স্যার?”
“আসলামকে ওই মেয়েটা”বিমর্ষকণ্ঠে বলল আশেক মাহমুদ, তার গলা ধরে এল। “ মেরে ফেলেছে!”
‘কী!”যারপরনাই বিস্মিত হল ছফা। যে লােকের সঙ্গে সে অস্ত্র হাতে পেরে ওঠেনি, তাকে কিনা হালকা-পলকা এক মেয়ে খালি হাতে মেরে ফেলল!
পিএস আরও জানাল, পুলিশ গুলশান অ্যাভিনিউর নির্জন রাস্তায় আগুনে ভষ্মীভূত একটি গাড়ির কথা জানতে পায়, ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়ে সেখানে দ্রুত ছুটে যায় তারা। নম্বরপ্লেট সার্চ দিয়ে তারা জানতে পারে, ওটা পিএস আশেক মাহমুদের গাড়ি। ড্রাইভিং সিটে একজনের ভষ্মীভূত দেহও খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।
গাড়িটা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে! ছফার বিস্ময় যেন কাটেই না। পিএস আরও জানাল, তার অসুস্থ বােন প্রলাপ বকে মুশকান জুবেরি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চলে যাবার পর থেকেই। বােনের শরীর ভীষণ খারাপ। ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে। ছফাকে সাবধানে থাকার কথা বলে ফোন রাখে আশেক মাহমুদ।
কলটা শেষ হতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য ঝিম মেরে রইল ছফা, তারপরই কাজে নেমে পড়ল আবার। সারা দেশের সবগুলাে সড়কের ট্রাফিক পুলিশকে জানিয়ে দিল লাশবাহী কোনাে অ্যাম্বুলেন্স যেখানে পাবে সেখানেই যেন আটক করা হয়। সেই সঙ্গে এ কথাটা বলতেও ভুলে গেল না-ওই গাড়িতে কোনাে লাশ নেই, আছে দু-জন দুর্ধর্ষ মহিলা খুনি!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পা বাড়াল পুলিশের জিপটার দিকে। জাওয়াদের কী অবস্থা কে জানে। হাসপাতাল হয়ে বাসায় যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল, আর মনে মনে একটাই আশা করল, ঢাকা থেকে বের হবার সময় কোনাে চেকপয়েন্টে যেন ওই অ্যাম্বুলেন্সটা ধরা পড়ে।এ মুহূর্তে এরকম আশা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই!
উপসংহার
চারপাশে সবুজ আর সবুজ। একটু দূরে দূরেই আছে ছােটোখাটো কিছু জলাশয়। এরকম অসংখ্য জলাশয়ে পরিপূর্ণ ফুলপুর নামে পরিচিত এই উপজেলাটি। এর উত্তর-পূর্ব দিকে বয়ে গেছে ভৈরব নামের একটি নদী।
কলকাতা ছাড়ার পর এটাই হয়ে উঠেছে মুশকানের ঠিকানা। জায়গাটার প্রতি তার মমত্ব তৈরি হয়ে গেছে। এখানে আবারও ফিরে আসতে পেরে খুব খুশি সে।বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল তাজা বাতাসে।
গতকাল এখান থেকে ঢাকায় চলে যাবার পর, এক পর্যায়ে তার আশঙ্কা হচ্ছিল, সুস্মিতাকে সম্ভবত মুক্ত করা সম্ভব হবে না। সেজন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতও হয়ে গেছিল। সে, কিন্তু যেমনটা বলা হয়- সাহসীদের পক্ষেই থাকে ভাগ্য, সেটাই আর একবার প্রমাণিত হয়েছে। ডাক্তারের দেওয়া মূল্যবান তথ্যটি একেবারে সময়মতাে পেয়ে যায় সে। একটু দেরি হলেই সুস্মিতার যে কী হত কে জানে!
এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতাে তাকে ধরতে ব্যর্থ হল ডিবি অফিসার নুরে ছফা। নিশ্চয় রাগে-ক্ষোভে ফুসছে এখন। তবে একটা বিষয়ে তাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে-ডিপি মল্লিক আর সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজের কথা জেনে গেছে সে। এমনকি, কলকাতায় আসকারের শ্বশুরবাড়ির খোঁজও পেয়ে গেছে। আর গত রাতে যেভাবে তাদের সাময়িক আশ্রয়টিও প্রায় চিহ্নিত করে ফেলছিল, সেটা ছিল অবিশ্বাস্য। তার ধারণা, লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটাও চিহ্নিত করতে পারবে ছফা। যদিও ওই গাড়ির ড্রাইভার বড়ােজোর তাকে জানাতে পারবে, পুরােনাে ঢাকার জনসন রােডে তাদের দুজনকে নামিয়ে দিয়েছে সে। ছফা হয়তাে এটা জানতে পেরে সাময়িক বিভ্রান্তির মধ্যেও পড়ে যাবে, তাদের আসল গন্তব্য কোথায় ছিল সেটা বের করতে পারবে না সহজে।
জনসন রােডে তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল ডাক্তারের আর এক বিশ্বস্ত কর্মচারী, সেখান থেকে তাদেরকে সদরঘাটের রকেট স্টিমারে তুলে দেওয়া হয়। স্টিমার ছাড়ার কথা রাত পৌনে তিনটায়। তারা ওখানে পৌছােয় তারও কয়েক মিনিট পর। কিন্তু রকেট স্টিমারের ঘাটে যখন ওরা পৌছােলাে তখনও ব্রিটিশ আমলের সেই চমৎকার স্টিমারটি নিজের নামের প্রতি চরম অবিচার করে নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিল। রাত সাড়ে তিনটার পর খুলনাগামী রকেট স্টিমারটি যাত্রা শুরু করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মুশকান। ছফা যে নদীপথটাকে হিসেবের মধ্যে রাখবে না, এ ব্যাপারে সে প্রায় নিশ্চিত ছিল। আর সড়কের মতাে নদীপথে চেক-পয়েন্ট বলে কিছু থাকেও না।
কেবিনে বসেই রুম সার্ভিসে অর্ডার দিয়ে কিছু খাবার আনিয়ে খেয়ে নেয় তারা। তারপর ক্লান্তিতে দুচোখে ঘুম নেমে আসে দু-জনেরই। ডাক্তারকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছে, নিরাপদ চ্যানেলে জানানাের কথা, তারা ঠিকমতাে পৌঁছে গেছে। ফোন করে তাকে জানাতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। ডাক্তারের হাসপাতালের সমস্ত ফোন সম্ভবত ট্যাপকরা হচ্ছে।
ভােরের দিকে ঘুম দিয়ে মুশকান আর সুস্মিতা জেগে ওঠে সকাল দশটার দিকে। এর কিছুক্ষণ পরই স্টিমারটা খুলনায় পৌছে যায়। খুলনা শহর থেকে একটা ইজিবাইকে করে প্রায় উনিশ কিলােমিটার পাড়ি দেবার পর তারা পৌছােয় ফুলপুর উপজেলায়। সেখান থেকে কয়েক কিলােমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতে হয় দক্ষিণডিহি নামের এই প্রসিদ্ধ গ্রামটিতে। চারপাশে খুব বেশি মানুষের আবাস নেই। তবে জায়গাটা একদম নিরিবিলিঁও থাকে না। প্রতিদিনই কিছু উৎসাহী পর্যটকের দেখা মেলে।
“ওয়াও!”সুস্মিতাও দারুণ উচ্ছ্বসিত এমন একটি জায়গায় আসতে পেরে। “আমরা এখানে থাকব?”
“না।এখানে কেউ থাকেনা,”মুশকান বলল।“আমরা থাকব এই কমপ্লেক্সের বাইরে ওই যে, ওখানে ” হলুদ রঙের পাকা দালানটির পশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করল সে। কমপ্লেক্সের সীমানা প্রচীরের বাইরে কিছু ঘরবাড়ি আছে। “এই কমপ্লেক্সের ভেতর দিয়ে গেলে শর্টকাটে যাওয়া যায়, তাই এখানে এসেছি।”
“তাহলে এখানে থাকে কারা?” বাড়িটার সামনে, সিঁড়ির দিকে তাকালাে মুশকান। তার দৃষ্টি অনুসরণ করল মেয়েটি। সিঁড়ির দু-পাশে দুটো আবক্ষ মূর্তি দেখতে পেয়ে অবাক হল সুস্মিতা।
“এটা রবীন্দ্রনাথের বাড়ি!” বিস্ময়ের চেয়ে অবিশ্বাসই বেশি তার অভিব্যক্তিতে। “ওটা আবার কার স্ট্যাচু?”ভ্রু কুঁচকে সিঁড়ির ডান দিকে থাকা আবক্ষ মূর্তিটার দিকে ইঙ্গিত করল সে।
“মৃণালিনী দেবীর,”বলল মুশকান। “রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী। “আমি জানতাম না এখানেও রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ছিল।”
“এটা ওর শ্বশুরবাড়ি,” শুধরে দিল মুশকান।“হােয়াট!”অবাক হল সুস্মিতা।“তাহলে এটার নাম রবীন্দ্র কমপ্লেক্স কেন?শ্বশুরবাড়ি বললেই পারত,” সাইনবাের্ডটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল।
“এটা এখন জাদুঘর।”
“মিউজিয়াম!” মেয়েটার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। “রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িও মিউজিয়াম! হাউ কাম!”
মুশকান কিছু বলল না, সে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। “তােমার মায়ের বাবা প্রাণেশ সমাদ্দারের পৈতৃক নিবাসও কিন্তু এখানেই।”
“তাই নাকি?”
“এই কমপ্লেক্সের বাইরে, সবচেয়ে কাছের যে বাড়িটা দেখছ, ওটাই প্রাণেশ সমাদ্দারের চার-পাঁচ পুরুষের ভিটে। এই এলাকার নামকরা ব্রাহ্ম ছিল ওরা।রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গেও ওদের সম্পর্ক ছিল।”
সুস্মিতাকে দেখে অবশ্য মনে হল না, এইসব ইতিহাস কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায় নিয়ে তার কোনাে আগ্রহ আছে। সে বরং বর্তমান নিয়ে বেশি কৌতূহলী“এখন ওখানে কারা থাকে?”
“কেউ না,” একটু থেমে আবার বলল মুশকান, “তােমার মায়ের পূর্বপুরুষদের ভিটে সংরক্ষণের জন্য আসকার ওটা কিনে নিয়েছে অনেক বছর আগেই। কেনার পর থেকেই স্থানীয় এক প্রভাবশালী লােকের সঙ্গে মামলা চলছিল বাড়িটা নিয়ে। গত বছর আসকার মামলায় জিতে যায়। তাই কলকাতা ছাড়ার পর ওখানে উঠি আমি।”
“তুমি এতদিন এখানে ছিলে?” আশাহত দেখাল সুস্মিতাকে। মুশকান কিছুই বলল না।
“তাহলে তাে ইচ্ছে করলে আমাকেও এখানে এনে রাখতে পারতে, অন্য দিকে তাকাল অভিমানে। “তুমি আসলে চাওনি আমি জানি।”
“হ্যা, চাইনি,”সরাসরিই বলল মুশকান।“আর কেন চাইনি সেটা তুমিও ভালাে করে জান।”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল আসকারের মেয়ে। “তুমি ভুলে যাও আমি তােমার বাবার বন্ধু।” ঠোঁট বাঁকাল সুস্মিতা। “বাবার বন্ধু মা তাে নও!” মুশকান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাম দিকের বিশাল ঝিলের দিকে তাকাল।
যাই হােক, এখন তাে আমরা এখানেই থাকব, তাই না?” কিছু বলল না মুশকান।
সুস্মিতা মুগ্ধ হয়ে দেখল আশপাশটা। “অনেক সুন্দর জায়গা! আই জাস্ট লাভ ইট। এই জায়গাটা কিন্তু ওই সাফা না ছফা খুঁজে বের করতে পারবে না।”
মেয়েটার দিকে তাকাল মুশকান। ছফা এখন পর্যন্ত যা করেছে সেটা আমলে নিলে, নিশ্চিন্তে থাকার কোনাে সুযােগই নেই। তার মনের কোণে একটি আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে সে এখানেও চলে আসবে! এ জায়গায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না হয়তাে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। সম্ভবত বাকিটা জীবন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পালিয়েই বেড়াতে হবে তাকে।
“কিন্তু ছফার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে আমাদেরকে,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে। তার দিকে ফিরে তাকাল সুস্মিতা। “ভুলে যেও না, ও কলকাতা পর্যন্ত পৌছে গেছিল। আমাদের সব কিছু জেনে গেছে।”
কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে চেয়ে রহস্যময় হাসি দিল মেয়েটি। ধীরপায়ে মুশকানের কাছে এসে দাঁড়াল সে।“ওকে নিয়ে একদম ভাববে না!”
সামান্য চোখ কুঁচকালাে মুশকান। “ও যদি এখানে চলে আসে, সেটা হবে ওর জীবনের শেষ ট্যুর!” মাথা দোলালাে মুশকান। “আমরা ওরকম কিছুই করব না, ঠিক আছে?”
এ কথার কোনাে জবাব দিল না মেয়েটি। “শােনাে, আপাতত ওর চিন্তা বাদ দাও,” বলেই চারপাশে চোখ বুলাল আবার। “এখন শুধু তুমি আর আমি! ঠিক আছে?”
মুশকান কিছু বলার আগেই পা থেকে জুতােটা খুলে সবুজ ঘাসের ওপর হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সুস্মিতা। আকাশের দিকে মুখ করে মুক্তির স্বাদ নিল বুক ভরে, গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল একটা গান :
“কেন গাে সে মােরে যেন করে না বিশ্বাস।
কেন গােবিষন্ন আঁখি আমি যবে কাছে থাকি,
কেন উঠে মাঝে মাঝে আকুল নিঃশ্বাস।
আদর করিতে মােরে চায় কতবার, সহসা কী ভেবে যেন ফেরে সে আবার…. ”
মুশকানের চোখেমুখে বিব্রত ভঙ্গি ফুটে উঠল। শক্ত নার্ভের মানুষ হিসেবে এটা তার ভন্য বিরলতম অভিজ্ঞতা! কিন্তু গানের মাঝখানে বাধা দিতে মন সায় দিল না। মেয়েটা দারুণ গায়। তারপরও দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে ফেলার চেষ্টা করল সে।
“প্রাণেশ সমাদ্দারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বেণীমাধবদের বেশ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল….পাশাপাশি বাড়িতে থাকত ওরা।”
গান থামিয়ে পেছন ফিরে তাকাল সুস্মিতা।“রবীন্দ্রনাথ বােধহয় খুব ঘন ঘন আসতেন এখানে, তাই না? বাঙালি পুরুষগুলাে তাে আবার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড। শ্বশুরবাড়ি মধুর হাড়ি-এরকমটা বলে না?” বাঁকাহাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। “ওই মেলশভনিস্ট পিগগুলাে যে মধুর হাড়ি বলতে কী বােঝায় আমি জানি।” “শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্যায়নকে বােঝায়, আর কী বােঝাবে, আজব!”
হা-হা-হা করে হেসে উঠল সুস্মিতা।“তুমি মেলশভনিস্ট পিগগুলাের সাইকোলজিটাই বুঝতে পারাে না।”
কিছু বলল না মুশকান। “ওরা আসলে অল্পবয়সি শ্যালিকাদেরকেই মধুর হাড়ি বুঝিয়েছে!”
মাথা দোলাল সে। এসব আলাপ করতে ভালাে লাগছে না তার। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। যে জায়গাতেই সে কিছু দিন থাকে সে জায়গার ওপরে তার মায়া পড়ে যায়। এই জায়গাটার ওপরেও মায়া জন্মে গেছে এ কয়দিনে।
“ওঁর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে, তাই না?”
সুস্মিতার কথা শুনে পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল মুশকানের ঠোটে। আদতে রবীন্দ্রনাথ যে শ্বশুরালয়ে এসেছিলেন তার কোনাে স্মৃতি এখানে নেই। এ নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা আছে। কবির শ্বশুরবাড়িটা খুলনার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠলেও সত্যিটা বেশ অবাক করার মতাে। কমপ্লেক্সের প্রবেশপথে এবং ভেতরে রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীর বাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া আছে তার কোথাও উল্লেখ নেই- রবীন্দ্রনাথ কখনও এ বাড়িতে এসেছিলেন কিনা। বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও জানা যায়, বিয়ের আগে, ১৮৮৩ সালের দিকে বেনীমাধব রায়চৌধুরীর যে বাড়িটি এখানে ছিল, সেটি ছিল টিনের তৈরি।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে ভবতারিনী দেবী, ওরফে ফেলীর বিয়ের পর নাকি এখনকার অবকাঠামােটি তৈরি করা হয়। তবে কে এটা তৈরি করেছে সেটা নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। স্থানীয়দের অনেকেই বলে থাকে, বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই এটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য এর কোনাে প্রামাণ্য তথ্য পায়নি। তবে রবীন্দ্রনাথ যে দক্ষিণডিহি গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন, সেটা নিয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।কন্যাদর্শনের কাজটি সম্ভবত সেরেছিলেন এ গ্রামেই তার এক মামার বাড়িতে।মজার ব্যাপার হল, ঠাকুরবাড়ির অনেক মেয়েই এসেছিল এই দক্ষিণডিহি গ্রাম থেকে। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরমা থেকে শুরু করে নিজের মা-সহ কয়েকজন বৌদিও এই গ্রামেরই মেয়ে। এখানে কবির বেড়াতে আসাটা তাই স্বাভাবিকই ছিল। তবে এখন ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঁটে কবির পায়ের চিহ্ন কখনও পড়েছে বলে কোথাও উল্লেখ নেই। ঠাকুরবাড়িতে আবার অদ্ভুত বিয়ের রীতি ছিল – পাত্র নয়, কন্যাপক্ষ চলে যেতো পাত্রের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বিয়েটাও ওভাবেই হয়েছিল।
ভবনের নীচতলার দিকে তাকাল মুশকান। সম্প্রতি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে একটি লাইব্রেরী করা হয়েছে,আর এর পুরাে কৃতিত্ব তার। যদিও বিষয়টা দুয়েকজন ছাড়া বাইরের মানুষজন জানে না। এই লাইব্রেরী করার কারণে কমপ্লেক্সে তার কিছুটা প্রভাবও তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাকে এখানকার কর্মচারীরা বেশ সমীহ করে। ওরা জানে, এই মহিলা কবির জ্ঞাতিগুষ্টি হয়।
“নমস্কার, সুস্মিতাদি,” এক হ্যাংলা-পাতলা গড়নের মাঝবয়েসি লােক তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় হাসিমুখে বলল।
অবাক হয়ে তাকাল সুস্মিতা। এই লােক তার নাম জানে! কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুলটা ভাঙল।দু-হাত জড়ো করে নমস্কারের জবাব নিল মুশকান। লােকটা চলে যেতেই বিস্ময়ে
তাকাল সে।
সুস্মিতা! তুমি?” মুচকি হাসল মুশকান। “ওরা আমাকে এ নামেই চেনে এখানে।” কথাটা শুনে মেয়েটার মুখ হা হয়ে গেল। মুশকান কিছু বলল না।
সুস্মিতা মুখ টিপে হেসে আবারও প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইল। আবারও গান ধরল সেঃ
“পাগলিনী, তাের লাগি কী আমি করিব বল।
কোথায় রাখিব তােরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল ”
এবার আর পারল না। বড্ড বেশি ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করছে মেয়েটি। তাই গানের মাঝখানেই বলে উঠল সে, “জানাে, একদিক থেকে সুন্দরপুরের সঙ্গে এ জায়গাটার অদ্ভুত মিল রয়েছে।”
“সেটা কী রকম?”গান থামিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইল সুস্মিতা। – ছােট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুশকান, কিন্তু সত্যিটাই বলল সে-“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি!”
সমাপ্ত