Shodh Avik Sarkar pdf part 3

All Part links: https://pdfpoka.com/shodh-avik-sarkar-pdf/

সকালটা শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সকালের মতনই। দলের নাউরিয়া বাবুনিয়া দুসাদ সবাইকে ডেকে ডেকে দিচ্ছিল। দলের নতুন নাউরিয়াদের কাজই হল এইসব বেকার খিদমৎ খাটা, আসল কাজ শেখাবার নামই নেই, অসন্তুষ্ট মুখে বিড়বিড় করছিল বাবুনিয়া। তবে জায়গাটা খাসা, কারও সন্দেহের কোনও কারণই থাকবে না। খিজিরপুরের কাস্টমস হৌসের একটু দূরে একটা বড় আমবাগানের মধ্যেই ডেরাডান্ডা বেঁধেছিল দলের সবাই, ঠাকুর যেমনটি বলে দিয়েছিলেন! কোম্পানির ছত্রছায়ায় বসে থাকার সুবিধাও অবশ্য অনেক বেকার হাঙ্গামহুজ্জত এড়ানো যায় সহজেই।

খোদাবক্স ফিরেছিল একটু ভোররাতের দিকেই। ঘুমও আসেনা ছাই এই অসময়ে, তাই ফতুয়াটা খুলে তাকিয়া মতন করে মাথার নীচে দিয়ে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছিল আর কী! এমন সময়ে মুখের ওপর কোন বেওকুফের ছায়া পড়লো কে জানে? খোদাবক্স আধবোজা চোখটা বিরক্তির সঙ্গে খুলেই দেখে ঠাকুর!

ধড়মড় করে উঠেই বসছিল খোদাবক্স, ঠাকুর ইশারায় উঠতে বারণ করেন।নিজেই। ধপ করে বসে পড়েন পাশে।

খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে খোদাবক্স। তবিয়ত শরিফ তো? গেছিলে কোথায়? অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে মনে হচ্ছে, বলি দোস্তের বাড়ির সব খবর ভালো তো?

সতর্কহয় খোদাবক্স। এইহ্যায়ওয়ানবরাত্তনটার কাছে বেশি মুখ খোলা যাবেনা আর। এইসব ভালো ভালো প্রশ্নের মানেই হচ্ছে পাক্কা কিছু সন্দেহ করেছে শয়তানটা।মুখৌটা। পরে থাকতে হবে, হরহামেশা। যদ্দিন না…।

হাঁ ঠাকুর। অনেকটা আসতে হয়েছে হেঁটে, রাস্তা কি কম? সেই খুরাই থেকে রাত থাকতেই রওয়ানা দিয়েছি, সকাল সকাল দলের সঙ্গে মোলাকাত করতে হবে যে! আর হ্যাঁ, আপনার দোয়াতে দোস্ত আর ওর জরু ভালোই আছে। ফসল ভালোই হয়েছে এবার। নতুন বলদ কিনেছে দুটো, নানহিমুনহি একটা বেটিও হয়েছে ওদের।

বেটি? একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান ঠাকুর, বেটি বললে নাকি?

একটু ঘাবড়ে যায় খোদাবক্স, ভুল কিছু বলল নাকি? নাকি বেটা বললেই সুবিধা হত?

হ্যাঁ ঠাকুর। খুব প্যায়ারি একটা বিটিয়া রানি হয়েছে ওর। বেটি খুব হাসমুখ, সবসময় খিলখিল করছে। সতর্ক হয়ে বলে খোদাবক্স।

বেটি? বাহ, খুব ভালো। খুব গোলমাটোল হয়েছে নিশ্চয়ই? খুব গোরি? খুব হাসে বলছ? খুব প্যায়ারি হয়েছে?

খোদাবক্স একটু ঘাবড়ে যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর মোটেই তৈরি করে আসেনি সে। সিলম্যান সাহিবও এসব বলে দেননি যে!!

এই উৎকণ্ঠা থেকে ত্রাণ করলেন ঠাকুর নিজেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলেন।

খোদাবক্সকে বিমূঢ় রেখে!

*********

সগরের কোম্পানিকুঠিতে সেদিন সকাল থেকেই সাজো সাজো রব।কলকাতা থেকে খোদ ফিরঙ্গ সেপাই এসেছে পঞ্চাশজন মতন। কী তাগড়াই শরীর তাদের, কী ভাবলেশহীন। মুখ, আর কী কুচকাওয়াজের বহর। তার ওপর বড় বড় বন্দুক এক একজনের কাঁধে। সরু চোখে এসব দেখে যাচ্ছিল ফিরিঙ্গিয়া, আর ভাবছিল এই আদব, এই আরাস্তাগি আছে বলেই না এই ফিরঙ্গরা এত বড় হিন্দুস্তানে থানা গেড়ে বসেছে!

প্রাক্তন ঠগি, বেহরামের পর ভারতবর্ষের দুর্ধর্ষতম ঠগি ফিরিঙ্গিয়া একটু ম্লান হাসি হাসল। সব এদের অধিকারে যাবে। সমস্ত হিন্দুস্তান লাল হয়ে যাবে। এই ফৌজ একদিন দিল্লি থেকে কালিকট, নাগপুর থেকে কলকাত্তা দাপিয়ে বেড়াবে।দুর্বল হিন্দুস্তান চেয়ে চেয়ে দেখবে শুধু।

ভালোই হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরিঙ্গিয়া। এখনই কি খুব ভালো আছে দেশ? চোর জোচ্চর বাটপাড়ে যে ভরে গেল সব। লাখনৌ আর দিল্লিতে পুরানি খানদানি নওয়াব। আর কলকাত্তায় নয়া বড়লোকদের বাবুয়ানি ছাড়া বাকি দেশে কানুনি হুকুমত আছে। কিছু? ফিরিঙ্গিয়ারা না হয় ঠগি, মা ভবানীর আদেশ ছাড়া মানুষ খুন করে না, শাস্ত্রের আদেশ ছাড়া কাসসিতে হাত অবধি ছোঁয়ায় না। বাকিরা? ধুতুরিয়ারা?ম্যাকফানসারা? ভাঙ্গিরা? ছোটোখাটো জমিন্দারেরা? এক এক জন তো সাক্ষাৎ নরপিশাচ।ওর গাঁয়ের খুনে তহশিলদার ছোটে সিং তোমর ঘরে আগুন লাগিয়ে সব ছারখার করে না দিলে কি ফিরিঙ্গিয়া আজ নামতো এই রাস্তায়?

চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল ফিরিঙ্গিয়া, পাশে স্লিম্যান এসে দাঁড়াতে হোঁশ ফিরে পায়।

কোই হুকুম মেরে লিয়ে, সাহেব?

শুধু রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেই হবে। তোমার দোস্ত চিনতে পারবে তো?

বেশকহুজুর, খোদাবক্স খুবই হোঁশিয়ার লোক। আন্ধেরাতেও বিলকুল সাফ দেখে। বিলকুল চিন্তা না করে সাহেব।

বেশ বেশ। আর আজকেই হবে তো ব্যাপারটা? তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ, সাহেব, পিছন থেকে আওয়াজ আসে, আমার গণনা যদি ঠিক হয়, আর পণ্ডিতজি যা করছেন বলে খবর পেয়েছি তা যদি সাচ্চা হয়, আজই সেই দিন, শুক্লপক্ষের চতুর্দশী।মকরে শনি প্রবেশ করবেন আজ রাতে, কালভৈরবের পূজার জন্যে এর থেকে ভালো দিন পণ্ডিতজি আর পরের পঞ্চাশ বছরেও পাবেন না।

ঘুরে দাঁড়ান স্লিম্যান। এতক্ষণ ধরে পাশের একটা ঘরে ওল্ড কিছু স্ক্রিপচার্স নিয়ে কীসব করছিল এই ব্রাহমিন। ফিরিঙ্গিয়া দেখেই মাটিতে শুয়ে পড়ে, গোর লাগি ঠাকুর।

অনেক খুঁজেপেতে একে নিয়ে এসেছেন স্লিম্যান। এই দেশের ব্ল্যাক ম্যাজিক আর রিচুয়ালসের কিছুই বোঝেন না তিনি। তাই দরকার ছিল এমন একজনের যে পুরো ব্যাপারটা বুঝে একটা ওয়েআউট বলে দেবে। এই ডার্ক ব্রাউন কালারের, শর্ট হাইটের ব্রাহমিনটি বেঙ্গলের লোক, নর্মদার তীরে ফেমাস শিভা টেম্পলে পিলগ্রিমেজ সেরে ফিরে যাচ্ছিল। ফিরিঙ্গিয়াই খোঁজ আনে এই লোকটার। খুবই নাকি পাওয়ারফুল ব্রাহমিন। এ, আর একটা কীসে যেন খুব ফেমাস… কী যেন যেন… ইয়েস, তান্ত্রা!!

তুমি ঠিক বলছ ঠাকুর? একটু সন্দেহই যেন প্রকাশ পায় স্লিম্যানের গলায়।

মৃদু হাসেন সেই ব্রাহ্মণবটু, আমার গণনা কখনো ভুল হয় না সাহেব। তোমরা যা বললে, সব শুনে মনে হচ্ছে আজই সেই দিন। আর যদি দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত এই সাধনায় সফল হন, মহা অনর্থ হয়ে যাবে সাহেব, চোখ বুজে শিউরে উঠলেন তিনি।

কীসের অনর্থ ঠাকুর? কৌতূহলী হয়ে ওঠেন স্লিম্যান।

তুমি বুঝবে না সাহেব। আমার জ্ঞানমতে গত পাঁচশো বছরের মধ্যে এই সাধনপথে এগোবার সাহস করেনি কেউ। শবসাধনা বোঝো সাহেব? একটি সদ্যমৃত লাশ নিয়ে সারারাত একা নির্জন শ্মশানে বসে ভয়ঙ্কর সাধনা। অনেক তান্ত্রিকের জীবনে। একবারও শবসাধনা করার সৌভাগ্য হয় না। আর ইনি একের পর এক শবসাধনা। করে চলেছেন… এর একটাই মানে হয়… মুখ যেন বিবর্ণ হয়ে যায় সেই খর্বকায়। ব্রাহ্মণের, আর যদি তাই হয়, পণ্ডিতজিকে আটকানো জরুরি, খুব জরুরি। ভগবান না করুন, আজই যদি একশো আটতম সাধনা পূর্ণ হয়… বলে ফের শিউরে উঠলেন। তিনি, হাতদুটো বুকের মধ্যে রেখে বিড়বিড় করে ইষ্টনাম স্মরণ করেন।

একশো আট? মুহূর্তের মধ্যে আঁতকে ওঠেন স্লিম্যান, বুকে দ্রুত ক্রুশচিহ্ন আঁকেন, মাই গুডনেস। কী বলছ কী ঠাকুর? আর যদি দুর্গাশঙ্কর সাকসেসফুল হয়ে যায়, তা হলে কী হবে ঠাকুর? বললে না যে?

নিজের ইচ্ছেমতন একজন মৃত মানুষকে ফের বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আনতে পারবেন উনি। বুঝে দেখো সাহেব, এ কত বড় ক্ষমতা! খুবই গূঢ় তন্ত্রসাধনা এই কালভৈরবপূজা, অতি অল্পসংখ্যক লোকই জানে। কেউ প্রয়োগ করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না। উনি যে শুধু ভেবেছেন তাই নয়, নির্ভুল লক্ষ্যে মাপা ছক কেটে এগিয়েছেন, সহজে লাশ পাবেন বলে ঠগিদের দলেও ভিড়েছেন। বহুদিনের পরিকল্পনা আর অলৌকিক শক্তি ছাড়া এসব হয় না সাহেব। যেভাবে ভুকোত জমাদারকে বশ করেছেন। বলে শুনলাম, উচ্চকোটির পিশাচসিদ্ধ না হলে এ ক্ষমতা সম্ভব নয়।

একটু ইতস্তত করেন স্লিম্যান, যদি তোমার কথা সত্যি ধরে নিই ঠাকুর, যদি সত্যি দুর্গাশঙ্কর একজন কাউকে বাঁচিয়ে তোলে, তাতে কী অনর্থ হতে পারে?

কী বলছ সাহেব? এর মানে জানো তুমি? জন্মমৃত্যু হল প্রকৃতির বিধান। বিধাতাপুরুষেরও হাত নেই এর ওপর। এ নিয়ম উলটে দিলে প্রকৃতির রুদ্ররোষ আছড়ে। পড়বে পৃথিবীর ওপর। হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হবে, খরা-বন্যা-মহামারীতে জনবসতি উজাড় হয়ে যাবে। নদীতে জলের বদলে রক্ত বইবে; ক্ষেতের ফসল আর গাছপালা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাবে; পাতাল থেকে দলে দলে উঠে আসবে নরকের মূর্তিমান পাপ।বীরভোগ্যা বসুন্ধরা প্রেতভোগ্যা হবে। প্রকৃতিদেবীর ক্রোধ বড় ভয়ানক সাহেব, কারও রেহাই মিলবে না।

ভুরু কুঁচকে শুনছিলেন স্লিম্যান। এসব সুপারস্টিশানে ওঁর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। কিন্তু দুর্গাশঙ্করকে আটকানোটা সবচেয়ে জরুরি।এই আঘাত ঠগিরা সহ্য করতে পারবে না। এরা ক্ষিপ্র, নৃশংস আর দুর্ধর্ষ বটে, কিন্তু সেই পরিমাণে কুসংস্কারগ্রস্ত। এদের অনেকটাই ঠান্ডা করে এনেছেন স্লিম্যান। একবার যদি রটে যায় যে দুর্গাশঙ্কর ধরা পড়েছে, অতবড় তান্ত্রিকও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি কোম্পানির হাত থেকে, ঠগিদের মনোবল বলে আর কিছু থাকবে না।এই সুযোগটাই স্লিম্যান খুঁজছিলেন অনেকদিন ধরে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ওঁর। এই সুযোগ ফসকে যেতে দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না।

কোনো উপায় ঠাকুর? এই শয়তানটাকে আটকাবার কোনো উপায়?

নেই বললেই চলে। এই পণ্ডিত এখনই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী। সমস্ত উদ্যোগ হেলায় বানচাল করে দিতে পারে। চেষ্টা করাটাই শুধু আমাদের হাতে সাহেব। ঈশ্বর যা চান তাই হবে, না-চাইলে কি আমরা আটকাতে পারব?

আচ্ছা? ঠিক আছে দেখা যাক কে জেতে, কোম্পানির বন্দুক না তোমাদের এইসব তান্ত্রা অ্যান্ড অল। এই বলে চোখ টিপে মুচকি হাসেন স্লিম্যান।

হেসে ফেলেন ব্রাহ্মণটি, ভালো কাজে নেমেছ সাহেব।এদেশের রাজামহারাজারা তো আর আইনের শাসন, প্রজাদের জানপ্রাণ, ভালোমন্দ এসব নিয়ে বিশেষ ব্যতিব্যস্ত নয়, খাজনা আদায় করেই কর্তব্য শেষ মনে করে। তোমরা বিদেশিরা যে নিজেদের জন্যে হলেও এইসব গুন্ডাবদমাশদের ঠান্ডা করতে নেমেছ, এই দেখে আমি প্রাণভরে আশীর্বাদ করলাম। ভয় পেও না। মনে রাখবে মানুষকে ভালোবাসার কাছে সমস্ত অশুভ পূজামন্ত্র ব্যর্থ। ভালোবাসা হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় যাদু।

বেরিয়ে যাবার জন্যে পুঁথিপত্র গোটাচ্ছিলেন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণটি। স্লিম্যান কাছে গিয়ে দাঁড়ান, তোমার নাম বলে গেলে না ঠাকুর?

উঠে দাঁড়ান ব্রাহ্মণবটু, দুচোখে কৌতুক খেলে যায়, পাল্টা চোখ টিপে মুচকি হাসেন, আমার নাম উচ্চারণ করতে গেলে তোমার দুটো জিভ লাগবে সাহেব। খুব খটোমটো নাম আমার।

হো হো করে হেসে ওঠেন স্লিম্যান, হাসি থামলে বলেন, আচ্ছা বলো তো একবার, দেখি উচ্চারণ করতে পারি কি না।

আমার নাম কৃষ্ণানন্দ, সাহেব, পুরো নাম কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।

*********

সুবন হরসুকা সত্যিই ক্ষণজন্মা তিলহাই। গতকালই খবর এনেছিল যে এক নিয়ামতে ভিটু, অর্থাৎ ধনী হিন্দু বানিয়া এদিকেই আসছে লটবহর নিয়ে। বানিয়া নিজে, দু চারটে খিদমতগার আর একটি বছর আট দশেকের খোনতুরি, এ ছাড়া আর কেউ নেই সঙ্গে।

ভালোই হল, সুবন ভাবে, দুমাইল দূরেই ঝুরকো ডোঙ্গির ডেরা, এই এলাকার মশহুর ব্রিনজার, বাচ্চা মেয়েটাকে বিক্রি করেও ভালো টাকা পাওয়া যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি। এও খবর আছে যে এই বানিয়া, নাম বনোয়ারিলাল, সঙ্গে বেশ কিছু টাকাপয়সা নিয়ে নিজের সসুরাল যাচ্ছে, পুরনো কিছু উধার চুকাবার আছে বলে। এক রাতের রাস্তা ভেবে বেশি লোকজনও সঙ্গে নেয়নি বেওকুফটা।

ভালোই, সুবন ভাবে। বেশি হাঙ্গামা হবে না। অল্প পরিশ্রম, বেশি লাভ।

ঠাকুর অবশ্য আজ ঝিরণী দেওয়ার সময় থাকবেন না। ওঁর নাকি বিশেষ কিছু কাজ আছে। ঝিরণীর পরেই আসবেন। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। উনি নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিয়ে যাবেন, এতে কার কী বলার আছে? প্রাপ্যটিও তো তেমন বিশেষ কিছু নয়, তবে কিনা বনোয়ারিলাল বেশ নাদুসনুদুস ইনসান বটে, ঠাকুরের বেশ কষ্টই হবে একে টেনে নিয়ে যেতে, ফিকফিক করে হাসতে হাসতে ভাবে সুবন।

একলা একলা এত হাসি কিসের রে সুবনা?পেছন থেকে মোরাদুন জিজ্ঞেস করে, ধাউড় জমাদারও সঙ্গেই ছিল, আরেকটা শাদি করার খোয়াব দেখেছিস নাকি কাল রাতে?

ফিক করে হেসে ফেলে সুবন, না ভাইয়া, ভাবছি যে বানিয়াটা আজ ভবানী মাঈয়ের প্রসাদ হবে, তার কথা। ঘিউ দুধ খেয়ে যা বিশাল শরীর বানিয়েছে না, গর্দন তো বোঝাই যায় না, খোদাবক্স ভাইজান পেলহুটা কোথায় পরাবে তাই ভাবছি, হি হি।

মোরাদুন আর ধাউড়ও হেসে ফেলে। এরা দুজনেই দক্ষ সোথা। শিকারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ভুলিয়েভালিয়ে বিশ্বাস উৎপাদন করাই এদের কাজ। এই কাজে গোটা বেহড়ে এদের থেকে নামজাদা লোক আর নেই।

তা সে নামের প্রতি সুবিচার করেই বোকা বানিয়াটির ছোট বহরটিকে লাকরাদৌনের আশেপাশে তাবু ফেলাতে বেশি কসরত করতে হোল না ওদের কাউকেই।

পাঁচটি পুরুষ আর একটি নিপাপবালিকাকে ঘিরে আনন্দ-হাসি-ঠাট্টার মৃত্যুবাসর বসাল প্রায় চল্লিশটি হিংস্র শ্বাপদ!

*********

কাল থেকেই ব্যস্ত ছিলেন দুর্গাশঙ্কর। জন্মের শোধের শেষ সাধনা আজ। গত হাজার বছরেও এই পূজা করার সাহস কেউ করেনি, আগামীহাজার বছরেও কেউ করবেনা,স্থির নিশ্চিত উনি। গত তিরিশ বছর ধরে তিলতিল করে জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সম্বল একত্রিত করে আজকের দিনটির জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন তিনি।ন্যায়-অন্যায় বোধ বিসর্জন দিয়েছেন, শাস্ত্ৰাজ্ঞা উপেক্ষা করেছেন অমিত তত্ত্বজ্ঞানের জোরে, দয়ামায়ার যাবতীয় বোধ পুড়িয়ে ফেলেছেন নিজেই। সমস্ত বাধাবিঘ্ন, অন্তরাত্মার নিষেধ দুপায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট সাধনের দিকে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

তিরিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটি মুখ আবার দেখতে পাবেন বলে সর্বস্বপণ করে বিধাতাপুরুষের বিরুদ্ধে এই খেলায় নেমেছিলেন দুর্গাশঙ্কর। আজ সেই খেলার শেষ দান। দুনিয়াশুদ্ধ সবকিছু তুচ্ছজ্ঞান করে, নিজের অস্তিত্বের সব কিছু স্পর্ধাভরে বাজি রেখে জীবনের যে জুয়াখেলায় নেমেছিলেন দুর্গাশঙ্কর, আজ সেই বাজি জিতে নেবার দিন। অতুল তন্ত্রতেজে বলীয়ান হয়ে এই ক্রুর নির্দয়া প্রকৃতির বিরুদ্ধে শোধ তোলবার দিন।

আজ কোনো ভুলচুক বরদাস্ত করার প্রশ্নই ওঠে না। গত বেশ কয়েকবছর ধরে। জোগাড় করা দুষ্প্রাপ্যতম পুজোপকরণগুলি একত্রিত করেছেন আজ সকাল থেকে। সমস্ত কিছু সেই শ্মশানের পাশের কুঁড়েঘরটিতে গুছিয়ে রেখে, সমস্ত আয়োজন অনুপুঙ্খরূপে একবার দেখে নিয়ে ইষ্টস্মরণ করলেন উনি।

সব সাজাতে সাজাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল, এইবার বেরোতে যাবেন, এমন সময়ে শ্মশানের সামনের অঁড়িপথের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন দুর্গাশঙ্কর।

একশোগজ দূরে বাঁদিক থেকে ডানদিকে রাস্তা পার হচ্ছে এক বিশালদেহী সাপ, যার গায়ের খয়েরি কালো আঁশে পড়ন্ত রৌদ্রের শেষ আলো বিচ্ছুরিত হয়ে এক মায়াবী বিভ্রম সৃষ্টি করেছে। একবার থমকে দাঁড়াল সেই মহাসর্প। মাথা উঁচু করে কালো চোখ দুটি দিয়ে স্থিরভাবে দুর্গাশঙ্করকে একবার দেখে নিয়ে দীর্ঘ চেরা লকলকে জিভটি বার দুয়েক বার করে তারপর মাথা নামিয়ে আবার ধীরেসুস্থে চলতে লাগল।

শঙ্খচুড়। বিষধর সাপেদের রাজা। রাজার মতই চলন বটে। কী আভিজাত্য, কী দার্চ, চেয়ে দেখবার মতন।

কিন্তু সে জন্যে জঙ্গলাকীর্ণ ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে চষে ফেলা দুর্গাশঙ্কর বিচলিত হলেন না। হলেন এই জন্যে যে তন্ত্রসাধনায় ব্রতী হবার আগে এটি একটি অত্যন্ত দুর্লক্ষণ। যদিও এসব ছোটোখাটো বাধা নিষ্প্রভাব করা ওঁর কাছে কিছুই না। তবুও মহাযজ্ঞের আগে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।

দ্রুত চলতে লাগলেন দুর্গাশঙ্কর। কিছু তন্ত্রাভ্যাসের ফলে অস্বাভাবিক দ্রুত চলতে পারেন তিনি, একটু দূর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন কেউ উড়ে চলেছে। খবর পেয়েছেন যে এইবার থাপ বা তাঁবু কোথায় পড়েছে।

এমন সময়ে, তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, স্পষ্ট শুনতে পেলেন কাছেই কোনো গাছের ডালে ঘুঘু ডাকছে।

মুহূর্তের মধ্যে গতি শ্লথ হয়ে এল। তারপর ক্রমে ক্রমে থেমে গেলেন। রাত্রিবেলা ঘুঘুর ডাক শাস্ত্রোক্ত দুর্লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম।

কী হচ্ছে এসব? আজই কেন? একশো সাতটি শবসাধনা সুসম্পন্ন করেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই ওঁর তুল্য পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক এ দেশে আর নেই। বাকি আর একটি, মাত্র একটি। জীবনের জুয়াখেলায় আজই তো শেষদানে সবকিছু একলপ্তে জিতে নেবার দিন। আর আজই এসব দুর্লক্ষণ কেন? আজই কেন?

মনকে শক্ত করেন উনি। এইসব ছোটোখাটো বিঘ্ন এড়াবার অজস্র উপায় উনি জানেন, এগুলি তন্ত্রসাধনার অতি নিম্নস্তরের শিক্ষা। কিন্তু তবুও, আজ এই শেষ বিজয়ের লগ্নে এইসব দুর্লক্ষণ ওঁর মনকে অজানিতেই দুর্বল করে দিচ্ছিল। আজই কেন? এতদিন তো নির্বিঘ্নেই সব কিছু সুসম্পন্ন হয়ে এসেছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল দুর্গাশঙ্করের।

থামলে চলবে না। লগ্ন বয়ে যায়। শনি মকরে থাকতে থাকতে সেরে ফেলতে হবে সব কিছু, মায় শবদেহটিকে সেই প্রাচীন কুয়োতে বিসর্জনের কাজটি অবধি।

আর যদি, ঈশ্বর না করুন, কোনো অলৌকিক প্রকরণে আজকের এই সাধনা শেষ। করতে পারেন দুর্গাশঙ্কর? তবে?

সেই পরিণতি ভাবতেও ঘাম ছুটে গেল ওঁর। শাস্ত্রানুসারে, যে শবসাধনার সংকল্প। করে তান্ত্রিক ব্রতী হন, সেই শবসাধনা সম্পূর্ণ না করলে তদবধি সাধিত শবেদের অতৃপ্ত আত্মারা ভয়ঙ্করতম শোধ নেয় তান্ত্রিকের ওপর! আর সেই প্রতিশোধ আটকাবার ক্ষমতা স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবেরও নেই।

এই সব ভাবতে ভাবতে হাঁটার সময় খেয়াল করেননি দুর্গাশঙ্কর।একটু দূরে জঙ্গলে মধ্যে আলো দেখেশে এলেন।একদম কাছাকাছি এসে পড়েছেন। ছোট্ট বুটির মধ্যে আলো, হাসি গান ঠাট্টার দমক ভেসে আসছে। তাঁবুর বাইরেও কয়েকজন অন্ধকারে মিশে আছে। পিশাচসিদ্ধ দুর্গাশঙ্কর অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পান, তাই দেখলেন যে এরা ওঁর নিজের দলেরই সদস্য।ঝিরণীর অপেক্ষা করছে। দু-একজন বনোয়ারিলালের ঘোড়াটার পরিচর‍্যা করছে।– দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। ঝিরণীর একটু পরেই ঢুকবেন না হয়। এখন অচেনা মানুষ হুট করে ঢুকে পড়ে গোল বাঁধাবার কোনো মানেই হয় না।

দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন দুর্গাশঙ্কর, নিবাত নিষ্কম্প কৃষ্ণবর্ণ দীপশিখাঁটির মতন। স্থির, অচঞ্চল, একাগ্র, দৃঢ়সংকল্প। এই দীপশিখায় আলো নেই। শুধু স্বার্থসাধনের ত্রুর ঘনকৃষ্ণ আকাঙ্ক্ষাটি আছে!

হঠাৎ কেমন যেন মনে হল ওঁর, তাঁবুর ওইপারেও কতগুলি ছায়া যেন একবার। নড়েই স্থির হয়ে গেল না?

ঠিক দেখলেন? নাকি দৃষ্টিবিভ্রম?

মনটা বড় দুর্বল আর অশান্ত হয়ে হয়ে আছে সন্ধে থেকেই। বার বার চিত্তবিক্ষেপ হচ্ছে, না হলে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কে কোথায় কী করছে সে কথা দুর্গাশঙ্কর মুহূর্তে বলে দিতে পারেন। মনঃসংযোগ না করলে চিত্তপটে কিছুই উদ্ভাসিত হয় না। আর আজ…

কিছুক্ষণ ভ্রূকুঞ্চন করে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। সব স্থির। নাঃ, বোধহয় রেকলান বা শিয়াল-টিয়াল হবে।

ক্ষণমুহূর্তের মধ্যে তাঁবু থেকে কে উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, সাহেব খান, তামাকু লাও।

তাঁবুর ভিতরে আলোছায়ার মধ্যে কতগুলি প্রাণীর ছটফট দেখতে পাচ্ছিলেন দুর্গাশঙ্কর। প্রত্যেকের পিছন থেকে একজন করে ঠগি গলায় পরিয়ে দিয়েছে কালান্তক পেলহু। প্রতিটি শিকারের পা দুটো ধরে আছে একেকজন চুমিয়া, যাতে ছটফট না করতে পারে শিকার, শিকারের হাত দুটি ধরে আছে একেকজন চুমোসিয়া, যাতে হতভাগ্য মানুষটি বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ না গড়ে তুলতে পারে!এর সঙ্গে প্রধান ঘাতক যে পেলহুধারী ঠগি, ওদের ভাষায় ভুরকুত, সে হাঁটু দিয়ে ক্রমাগত শিরদাঁড়ায় চাপ দিতে থাকে, যাতে মেরুদণ্ড ভেঙ্গে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়!

এসব মৃত্যুনাটিকা অনেক দেখেছেন দুর্গাশঙ্কর। এসব ওঁকে বিচলিত করে না আর অনেক আগে থেকেই।

শব পাওয়া নিয়ে কথা।

সাধনা শেষ করা নিয়ে কথা।

সেই চাঁদমুখটি আবার বুকের মধ্যে পিষতে পারার আনন্দ নিয়ে কথা ।

আজ পৃথিবী জানবে এক বাবা তার মৃত মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কী কী করতে পারে!

শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ মাথার ওপর প্রায়। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। সামনে ছায়ার মতন এক ছোটো তাঁবুতে অভিনীত হচ্ছে এক অসহায় মৃত্যুনাটিকার ইতিকথা।নির্বাক নিরাসক্ত দর্শক হয়ে দেখছেন দুর্গাশঙ্কর।দেখছে গাছে। আড়ালে লুকিয়ে থাকা আরও বেশ কয়েকজন মৃত্যুব্যবসায়ী ঠগিও। হাওয়াও বইছে।

একটুও, প্রতিটি গাছের পাতা স্থির। তাঁবু থেকে ভেসে আসা হাঁচোরপাঁচোরের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দও নেই।

এমন সময়ে দিগবিদিক সচকিত করে ভেসে এলো এক অপার্থিব আর্তনাদ, বাপু, কোথায় তুমি? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!

এক মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কে আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন দুর্গাশঙ্কর!

সেই গলা, সেই ডাক, সেই আকুতি, যেন ত্রিশ বছর আগেকার এক আগুনে পুড়ে-যাওয়া শাপগ্রস্ত সন্ধে থেকে উঠে এসে দুর্গাশঙ্করের বুকে দীর্ঘ ভল্লার মতই বিধে দিল!

মুন্নিইইইইই বলে উন্মত্ত পিশাচের মতন তাঁবুর দিকে ছুটে চললেন দুর্গাশঙ্কর।

ত্রিশ বছর আগে হেরে গেছিলেন। আজ নয়, আজ নয়, আজ কিছুতেই নয়, কিছুতেই নয়। এর জন্যেই, এর জন্যেই এত সব কিছু…

উন্মাদের মত ছুটে চললেন দুর্গাশঙ্কর।

*********

জঙ্গলের মধ্যে পঞ্চাশ জনের ব্রিটিশ আর্মি, দশজন দেশি সিপাই, ফিরিঙ্গিয়া আর। খোদাবক্সকে নিয়ে থাপ বা তাঁবুর কাছেই স্থির দাঁড়িয়েছিলেন স্লিম্যান।

শঙ্কা আর কর্তব্যের দোলাচলে দুলছিলেন স্লিম্যান। আজ যদি দুর্গাশঙ্কর ধরা পড়ে, ঠগিদের নির্মূল করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর যদি না ধরা পড়ে?সত্যিই যদিঅকাল্ট পাওয়ার বলে কিছু থাকে? সৈনিক তিনি, নিজের জন্যে ভাবেন না। কিন্তু এমিলি।

একটু দূরেই টেন্টটা দেখা যাচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে যে হুল্লোড় চলছে খুবই। শরীরটা টানটান হয়ে উঠল স্লিম্যানের। শুনেছেন যে এটাই সেই সময়। যে কোন মুহূর্তে ঝিরণী উঠতে পারে। শিকারী বাঘের মতন তীক্ষ্ম স্নায়ু আর পেশী নিয়ে সতর্ক হলেন উনি। সুশিক্ষিত ব্রিটিশ সৈন্যদল নিঃস্পন্দ রইল। দেশি সিপাই, খোদাবক্স আর ফিরিঙ্গিয়াও এই স্তব্ধ জ্যোৎস্নার মাঝে অজানা আশঙ্কায় শ্বাস অবধি বন্ধ করে রইল। ( যেন এক আসন্ন মূর্তিমান অমঙ্গলের ছায়া চারিদিকে!

এমন সময়ে সেই স্তব্ধতা খানখান করে অমোঘ মৃত্যু পরোয়ানা নেমে এলো শিকারি। বাজের মতই, সাহেব খান, তামাকু লাও।

দৌড়েই যাচ্ছিলেন স্লিম্যান, পিছন থেকে খোদাবক্সের হাত টেনে ধরে। এখন নয়, মনে পড়ে যায় স্লিম্যানের, আজকে দুর্গাশঙ্কর ঝিরণী দেওয়ার পর ঢুকবেন। অতএব আরও খানিকক্ষণ ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই। দাঁতে দাঁত চিপে চাঁদনি রাতের শিলুয়েটে তাঁবুর মধ্যেকার অসহায় মানুষগুলির ছটফটানি দেখছিলেন স্লিম্যান। দুরন্ত অসহায় ক্রোধেশপথ নেন স্লিম্যান,হয় দুর্গাশঙ্কর সহ পুরো দলকে ধরে কঠিনতম শাস্তি দেবেন, অথবা নিজেকেই নিজে গুলি করে মারবেন, দেখা যাক কে জেতে আজ, অকাল্ট হিউম্যানিটি অ্যান্ড জাস্টিস!

এমন সময় যেন করুণ নিয়তির মতই দিকবিদিক শিউড়ে দিয়ে ভেসে এল সেই আর্তনাদ, বাপু, কোথায় তুমি? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

লাফিয়ে ওঠেন স্লিম্যান, একটা বাচ্চার গলা না? চাবুকের মতন আছড়ে দেন। নির্দেশটা কাম অ্যালং, তারপর ঝোঁপঝাড় ভেঙে দৌড়তে থাকেন তাঁবুর দিকে।

*********

তাঁবুর মধ্যে ঢুকেই দুর্গাশঙ্করের চোখ পড়ল মাটিতে রাখা লাশেদের স্তূপ এবং সেই লাশেদের মাঝে শোয়ানো একটি আট-দশ বছরের মেয়ের মৃত শরীরের ওপর।

সেই নিষ্পাপ শিশু যেন ভয়ে, আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওপরের দিকে, অব্যক্ত আকুতিতে যেন কাকে খুঁজছে, শেষ আশ্রয় হিসেবে। গলায় তখনও খয়েরি কালো রঙের খুনি রুমালটি জড়িয়ে, যেন শেষ বিকেলে দেখা সেই শঙ্খচুড়টির মতন!

স্থির হয়ে বিস্ফারিত চোখে সেই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইলেন দুর্গাশঙ্কর, সারা শরীর কাঁপছে শুকনো বাঁশপাতার মতন, হাতে পায়ে বশ নেই, ঠোঁটের পাশ গড়িয়ে নামছে সাদা ফেনার মতন কষ, থরহর কাঁপছে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক দুর্গাশঙ্করের সমস্ত আত্মা, সমস্ত সত্ত্বা!

বাকিঠগিরা স্তব্ধ হয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখছিল তাদের নিষ্ঠুর নির্দয় ভয়ংকর, কিন্তু এই মুহূর্তে বেপথু বেএক্তিয়ার অচেনা ঠাকুরকে। একটি শিশুর লাশ দেখে ঠাকুর অত ব্যাকুল হয়ে পড়লেন কেন সেটা ওরা কেউই বুঝতে পারছিল না। ছুটনিয়া হাতজোড় করে নিবেদন করে গুসসা না করে ঠাকুর, একে তো জিন্দা রাখতেই চেয়েছিলাম, ঝুরকো মাহাতোকে বেচলে ভালো দাম পাওয়া যেত। তাই তাঁবুর বাইরেই বাবুনিয়া খে লাকরছিল একে নিয়ে, কী যে হল, ঠিক ঝিরণী দেবার সময়েই দৌড়ে এসে ঢুকল, তখন কি আর বাঁচিয়ে রাখা যায় ঠাকুর? আপনিই বলুন–

এসব কথার বিন্দুবিসর্গ দুর্গাশঙ্করের কানে ঢুকছিল না; থরথর দেহে, বিস্ফারিত চোখে তিনি চেয়েছিলেন সেই শিশুটির আতঙ্কিত চোখদুটির দিকে, কুঁকড়ে যাওয়া আঙুলগুলির দিকে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁটদুটির দিকে…

তিরিশ বছর, তিরিশটা বছর অপেক্ষা করেছেন দুর্গাশঙ্কর। যে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে ফের ফিরে পাওয়ার জন্যে জীবনের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছেন, নরকের দরজায় নিজের আত্মাকে বলি দিয়েছেন নিজের হাতে, আজ সেই মেয়ে ফের একটি লাশ হয়ে শুয়ে আছে দুর্গাশঙ্করের সামনে। হুবহু সেই মুখ, সেই চোখ, সেই কোকড়ানো চুল, সেই গোলমটোল শরীর। যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে দুর্গাশঙ্কর স্বর্গসুখ পেতেন, যার অভিমানে ফোলানো ঠোঁট দেখলে দুর্গাশঙ্করের বুকে শেল বিদ্ধ হত, একটা পুঁতির হারছড়া হাতে পেলে যার মুখের হাসি দেখে দুর্গাশঙ্কর নিজেকে ধন্য মনে করতেন, যে মেয়ে তিরিশ বছর আগেকার এক সর্বনাশা আগুনে সন্ধ্যায় দুর্গাশঙ্করের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছিল, ঠিক সেই মেয়েই যেন কোন এক অলঙ্ঘনীয় অলৌকিক শক্তির ইশারায় তান্ত্রিকশ্রেষ্ঠ ঠগি দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিতের তিরিশ বছরের সাধনাকে এক লহমায় মাটিতে মিশিয়ে দেবে বলে মাটিতে শুয়ে আছে!

মুন্নিইইইইইইই, বেটি আমার, কোথায় গেলি তুই!–বলে একটা আর্তনাদ করে সেই শিশুটির লাশের ওপর আছড়ে পড়লেন দুর্গাশঙ্কর!

হতভম্ব ঠগিদের দল বুঝতেও পারল না যে তাদের ঘিরে ফেলেছে গোরা সিপাহিদের লালমুখো ফৌজ।

বুঝলেও অবশ্য কিছু করার ছিল না আর!

*********

গভীর রাতে যখন কোমরে দড়ি পরা দুর্গাশঙ্করকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্লিম্যান, তখনও দুর্গাশঙ্কর প্রলাপ বকে চলেছেন। রক্তজবার মতন লাল চোখ, শনের মতন উসকোখুসকো চুল উড়ছে হাওয়ায়। ইতিউতি চাইছেন, পাশে খোদাবক্সকে দেখেও চিনতে পারলেন না। মুখে শুধু, মুন্নি, মুন্নি মা আমার গোঙানি। থেকে থেকেই হাঁট ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন, ফিরিঙ্গিয়া আর খোদাবক্স ধরে তুলে দিচ্ছে সেই অবশ থরোথরো। দেহ, ফের টানতে শুরু করছেন স্লিম্যান।

ব্রিটিশ আর দেশি সিপাইরা বাকি ঠগিদের মহড়া নিচ্ছে এখন। অবশ্য হতবাক সেই খুনিগুলোকে কজা করতে শিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বেশি দেরি হবার কথাও নয়। এখন। স্লিম্যানের দরকার খোদাবক্সের দেখে যাওয়া কুয়োটা, যাতে এভিডেন্স-সহ ওয়াটারটাইট কেস খাড়া করতে পারেন এই ডেমোনিক পণ্ডিতটির ওপর।

একে জায়গাটা বেশি দূর নয়, তার ওপর শুক্লপক্ষ চতুর্দশী, খুব দ্রুতই সেই প্রাচীন। কয়োটির কাছে পৌঁছে গেল এই ছোট দঙ্গলটি। তার ক্ষণিক পরেই খুব দ্রুত সেই কুঁয়োর ওপরের ডালপালা সরিয়ে সেই প্রাচীন গহুরটির মুখ উন্মোচন করে খোদাবক্স। আর ফিরিঙ্গিয়া।

ফের সেই বিষণ্ণ কটু মড়াপচা গন্ধ ধাক্কা মারে সবার নাকে, নাকে হাত চাপা দেয়। তিনজন, দুর্গাশঙ্কর ক্রমাগত বকতে থাকেন। কী মনে হতে বাঁ হাতে নাক চাপা দিয়ে ডানহাত দিয়ে দুর্গাশঙ্করের হাত চেপে ধরেন স্লিম্যান, সঙ্গে সঙ্গে শিউড়ে উঠে হাত ছেড়ে দেন…

প্রবল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে দুর্গাশঙ্করের উত্তপ্ত গা, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। যেন, ছোঁয়া অবধি যায় না।

ততক্ষণে একটা মশাল জ্বালিয়ে ফেলেছে ফিরিঙ্গিয়া, সেইটা হাতে নিয়ে কুয়োর। ওপরে তুলে ধরেন স্লিম্যান, পিছন থেকে উঁকি দেয় খোদাবক্স আর ফিরিঙ্গিয়া, এবং তিনজনেই শিউড়ে ওঠেন!

নীচে গাদাগাদি করে পড়ে আছে একগাদা লাশ।

বেশিরভাগই কঙ্কাল, সাদা হাড়গুলো হা হা করে হাসছে যেন।কিছু লাশ আধপচা, মাংস গলে খসে পড়ছে, চোখের গর্ত থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে মাংসখেকো পোকার দল। একটি দুটি লাশ দেখলে বোঝা যায় যে তখনও পচন ধরেনি, সদ্য এখানে ফেলা হয়েছে।

একরাশ ঘৃণা আর বিস্ময় মিশিয়ে সেই অপ্রকৃতিস্থব্রাহ্মণের দিকে ফিরলেন স্লিম্যান, এইসব তোমার কাজ পণ্ডিত? এদের নিয়ে তুমি ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছ?

জবাফুলের মতন লাল টকটকে চোখ মেলে চাইলেন দুর্গাশঙ্কর, সম্পূর্ণ ফাঁকা ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশে কী যেন দেখলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন ওরা আমাকে ডাকছে।

কথাটা ভালো করে শুনতে পাননি স্লিম্যান, তাই ফের জিজ্ঞেস করেন কে ডাকছে পণ্ডিত?

ওরা আমাকে ডাকছে, তোমরা কেউ শুনতে পাচ্ছ না? ওরা সবাই মিলে আমাকে ডাকছে যে। পাতাল থেকেওরা উঠে আসতে চাইছে, শুনতে পাচ্ছ না তোমরা? ডাকছে। আমাকে, আমাকে যেতে হবে, ডাকছে ওরা, আমাকে যেতে হবে, যেতে হবে… বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে সেই কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত!

দ্রুত হতভম্ব ভাব কাটিয়ে মশাল নিয়ে সেই কুয়োর মধ্যে উঁকি দিলেন তিনজনে, চেঁচিয়ে উঠলেন স্লিম্যান, মাই গুডনেস, এই পাগল লোকটাকে তুলতে হবে এক্ষুণি। খোদাবক্স, ফিরিঙ্গিয়া জলদি চলো, লম্বা দড়ি লাগবে আর আরও কিছু লোক, কাম কুইক।

মশাল হাতে জঙ্গলের বাইরের দিকে দৌড়তে লাগলেন তিনজন।

********

লোকলশকর নিয়ে যখন ফিরে এলেন স্লিম্যান, তখন রাত্রির তৃতীয় প্রহর। মরা চাঁদের মৃত্যুশীতল জ্যোৎস্নার বিষণ্ণ হিম ছড়িয়ে আছে বিশ্বচরাচরে। সেই চোরা আলো-আঁধারিতে, আধোচেনা গুঁড়িপথ বেয়ে মশালের আলো আর ধোঁয়ায় সদলবলে এসে পৌঁছালেন স্লিম্যান, তখনও অপার্থিব আশঙ্কায় মূক চারিদিক। একটি পাতাও নড়ছে না, জঙ্গল যেন ভুলে গেছে নিঃশ্বাস নিতেও, আর কোনো শব্দ নেই, কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই, শুধু সেই ম্লান রক্তজ্যোৎস্নায় ধুয়ে আছে এই বনভূমি।

কুয়োটির এককোণে জড়ো হয় ক্ষুদ্র দলটি। মশাল নিয়ে একজন দেশি সেপাই প্রথমে সেই কুয়োর মুখে যায়, ধীরে ধীরে উঁচু করে তুলে ধরে সেই আলো এবং প্রায় তৎক্ষণাৎ আর্তনাদ করে মূর্ছা যায় সে, ভূলুণ্ঠিত মশাল নিভে যায় দ্রুত।

সঙ্গে সঙ্গে অজানা আশঙ্কায় দলটি পিছু হটে যায়। স্লিম্যান বিরক্ত গলাখাঁকাড়ি দেন, ওহে খোদাবক্স, ফিরিঙ্গিয়া, এদিকে এসো তো একবার, দেখা যাক কী হাতি ঘোড়া লুকিয়ে আছে কুয়োর নীচে যে বেওকুফ লোকজন দেখেই ফেইন্ট হয়ে যাচ্ছে, কাম হিয়ার। এই বলে মশাল ফের জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে স্লিম্যান আর বাকি দুই শাগরেদ সেই কুয়োর মধ্যে উঁকি দেন। এবং তিনজনেই সেই হাড় হিম করা বিভীষিকার সামনে স্তব্ধ আতঙ্কে স্থবির হয়ে যান।

তাদের সামনে, কুয়োর মধ্যে দুর্গাশঙ্করের শতচ্ছিন্ন মৃতদেহ, মাথাটা সম্পূর্ণ উলটো করে মুচড়ে ছিঁড়ে ওপরের দিক মুখ ফেরানো, মুখে ভয়াবহ এক অপার্থিব হিংস্র হাসি, হাত দুটো দেহবিচ্ছিন্ন হয়ে দুই কোণায় পড়ে, পা দুটো কুঁচকি থেকে মুচড়ে আধছেঁড়া, যেন কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক যন্ত্র শরীর থেকে পা দুটো ছিঁড়ে নিতে গিয়ে এই মশালের আলো দেখে থমকে আছে, অন্ধকার হলেই শুরু করবে এই অসমাপ্ত কাজ। চোখ দুটো কে যেন খুবলে নিয়েছে, কালো গহ্রদুটি ঠা ঠা করে হাসছে এবং কামড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে খুবলে খুবলে খাওয়া হয়েছে দুর্গাশঙ্করের সারা শরীর, রক্তে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত দেহ। কে বা কারা খেয়েছে তান্ত্রিকশ্রেষ্ঠ দুর্গাশঙ্করকে, সেটা বুঝতে বেশি কষ্ট করতে হয় না। কারণটা খুবই স্পষ্ট, প্রতিটি খুলি আর আধাপচা শবের মুখে-দাঁতে লেগে আছে তাজা রক্তের দাগ!

All Part links: https://pdfpoka.com/shodh-avik-sarkar-pdf/

Back to top button
error: Content is protected !!