the-art-of-war-pdf-part-1

# All part; https://pdfpoka.com/the-art-of-war-pdf-bangla/

ভূমিকা

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সু-সু-মা চেন-এর স্মৃতিস্তম্ভ একশ শতাব্দির কাছাকাছি সময়ে নির্মান করা হয়। এই স্মৃতিস্তম্ভ থেকে জানা যায়, সানজু ছিলেন চিঈ রাজ্যের বাসিন্দা। তিনিই ষষ্ঠ শতাব্দির শেষের দিকে রাজা হো-লু-এর কাছে তার ‘রণনীতি বা যুদ্ধকৌশল’ বা ‘আর্ট অব ওয়ার’ পেশ করেন। এই রাজা হো-লু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন বর্বর প্রজাতির মানুষ।

তবে অনেক চাইনিজ পণ্ডিতজজ্ঞ তার জীবনী লেখনীর সময়কাল নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন। এর ইংরেজি অনুবাদক এস.বি. গ্রিফথ এর মতানুসারে, বইটি চতুর্থ শতাব্দীতেই লেখা হয়েছিল।

অতীত সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ যেমন কম থাকে ঠিক তেমনি সানজুর এই প্রবন্ধ সিরিজ আকর্ষণ না করলেও ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ বা রণনীতিগুলো শুধুমাত্র রণনীতি বা যুদ্ধ কৌশলের চেয়েও বেশি কিছু। এটি ব্যাপক চিন্তার খোরাক যোগায় যেখানে আমাদের মননশীলতাকে প্রাচীন চাইনিজ সামরিক ইতিহাস সাহিত্য সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে।

পাশ্চাত্যে সানজুর সর্বপ্রথম পরিচয় ঘটে খ্রিষ্ট মিশনারী ফাদার জে.জে.এস অমিত এর মাধ্যমে। তার অনুদিত ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ প্যারিসে ১৭৭২ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়, ঠিক সে সময়টাতে ফ্রান্সের শিল্পি, বুদ্ধিজীবিরা চাইনিজ আর্ট এবং সাহিত্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুঁদ হয়েছিল। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা-জার্নালের বদৌলতে অমিতের এই অনুদিত গ্রন্থ যথেষ্ট পরিমাণে আলোচিত সমালোচিত হয়। ১৭৮২ সালে বইটি পুনঃ গ্রন্থিত হয়। আর ধারণা– করা হয়, নেপোলিয়ানও বইটি পড়েছিলেন।

তারপর জার্মানি, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয় বইটি।

সানজু অনুভব করতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ হল ‘একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’, যেটা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হওয়া উচিত; আর তার এই আলোচনাই হল সামরিক অভিযানের ইতিহাসে প্রথম পঠন-পাঠন। তবে বেশিরভাগ গ্রিক আর রোমান লেখকদের মত সানজু নির্দিষ্ট একটা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তার কৌশলগুলি রচনা করেননি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল শাসক এবং সেনানায়কদের জন্য যারা যুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে চায়। তার বিশ্বাস ছিল শত্রুর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ না করেও তার কৌশলগুলি অনুসরণ করে শত্রু সৈন্যকে পরাজিত করতে পারবে, শহর অবরুদ্ধ না করেই তা দখল করতে পারবে, এবং শত্রুর রাজ্য দখলে আনতে পারবে কোন প্রকার অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই।

সানজু খুব ভালো করেই জানতেন যুদ্ধ শুধুমাত্র সৈন্যসামন্তের মধ্যে লড়াই করা ছাড়াও অনেক বেশি কিছু। তিনি নৈতিকতা, পাণ্ডিত্য এবং পরিবেশ পরিস্থিতির বিভিন্ন উপাদানকে শারীরিক যুদ্ধের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, এবং যে সকল শাসকবর্গ ও সেনানায়ক শুধুমাত্র সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি যুদ্ধকে শুধুমাত্র হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে চান না; বরং একেবারে অক্ষত বা না হলেই নয় এমন ক্ষতি করে জয়ী হওয়াকে যথাযথ কৌশল বলে বিবেচনা করেন।

সানজুর মতে, উপযুক্ত কোন পরিকল্পনা শত্রুর সম্পর্কে যথাযথ তথ্যের উপর ভিত্তি করে গঠন করা হলে সামরিক অগ্রগতিতে ক্ষিপ্রতা এনে দেয়। তিনি বলেছেন, ‘কোন রাষ্ট্রই দীর্ঘ সময় ধরে চলমান কোন যুদ্ধ থেকে উপকৃত হতে পারে না।’

চাইনিজ এবং জাপানি সামরিক যুদ্ধ ইতিহাসে সানজুর ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাও সে তুং এবং চাইনিজ সেনাবাহিনীর বহু কৌশল সানজুর এই ‘আর্ট অব ওয়ার’ থেকে উদ্ভূত। পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে চিহ্নিত এটি। আর তাই ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ এই দুই রাষ্ট্র ছাড়াও বর্তমানের আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে তাদের সামরিক কৌশলে ব্যবহারের জন্য বহুল প্রচলিত ও পঠিত একটা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

মাহফজু আলম

.

সূচিপত্র

সানজুর পরিচয়

প্রথম অধ্যায় – অনুমান

দ্বিতীয় অধ্যায় – ওয়েজিং ওয়ার

তৃতীয় অধ্যায় – আক্রমণের কৌশল

চতুর্থ অধ্যায় – রণকৌশলগত বিন্যাস

পঞ্চম অধ্যায় – কমান্ডার হিসেবে আপনার সক্ষমতা যাচাই করুন

ষষ্ঠ অধ্যায় – সক্ষমতা এবং দুর্বলতা

সপ্তম অধ্যায় – রণকৌশল

অষ্টম অধ্যায় – রণকৌশলের ব্যতিক্রমী নয় ভাবনা

নবম অধ্যায় – দ্য মার্চ

দশম অধ্যায় – দ্য টেরেইন

একাদশ অধ্যায় – যুদ্ধে উদ্ভুত নয় ধরনের পরিস্থিতি

দ্বাদশ অধ্যায় – অ্যাটাক বাই ফায়ার

ত্রয়োদশ অধ্যায় – গুপ্তচর নিয়োগ

………..

০. সানজুর পরিচয়

চিঈ (Ch’i) রাজ্যের বাসিন্দা সানজু। সমর কৌশলের উপর তার লেখা পড়ে অউ (Wu) রাজ্যের রাজা হো-লু (Ho-lu) তাকে ডেকে বললেন, আমি আপনার লেখা তেরটা চ্যাপ্টার পড়েছি। আপনি কি সৈন্যদের একটা ছোট মহড়া করে দেখাতে পারবেন?

সানজু জবাব দিলেন, ‘অবশ্যই পারবে।’

হো-লু আবারো প্রশ্ন করলেন, ‘মহড়াটা কি আপনি মহিলা সৈনিক নিয়েও করতে পারবেন?’

জবাবে সানজু বলেন, হ্যাঁ, পারবো।

রাজা এবার খুশি হয়ে প্রাসাদ থেকে একশ আশি জন সুন্দরি নর্তকি পাঠালেন মহড়ার উদ্দেশ্যে।

সানজু তাদেরকে দুটো ভাগে ভাগ করে রাজার খুবই পছন্দের দুজন সুন্দরি নর্তকিকে তাদের নেতা বানিয়ে দিলেন। প্রথমে তাদেরকে শেখালেন কিভাবে অস্ত্র ধরতে হয়। তারপর বললেন, ‘তোমরা কি জান কোথায় হৃদপিন্ড থাকে, কোনদিক ডান আর বাম, আর কোনদিকটাই বা পেছনকে নির্দেশ করে?

নর্তকিরা সবাই জবাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা জানি।’

এবার সানজু বললেন, আমি যখন কমান্ড দেব “সামনে”, তখন তোমরা হৃদপিন্ড বরাবর সামনে অস্ত্র তাক করবে; যখন বলব “ডানে” তখন ডানে ফিরবে; আবার যখন বলব “বামে” তখন বামে ঘুরে যাবে; আর যখন বলব “পেছনে” তখন পেছনে ঘুরে যাবে।

নর্তকিরা সবাই জবাব দিল, হ্যাঁ, বুঝেছি।

সানজু নর্তকিদেরকে নিয়ম কানুনগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আর অন্যদিকে তাদের জন্য আনা অস্ত্রগুলো যার যার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছিল।

সানুজু তার বুঝিয়ে দেয়া কমান্ডগুলো তিনবার করে বুঝালেন আর পাশাপাশি কমান্ডগুলো পাঁচবার করে ড্রিল করালেন। তারপরই তিনি ড্রামে জোর শব্দ করে ডানে ঘুর’ বলতেই নর্তকিরা সবাই হাসিতে লুটিয়ে পড়ল।

নর্তকীদের কান্ড দেখে সানজু বললেন, যদি নিয়মগুলো সৈন্যদের কাছে বোধগম্য না হয় আর সৈন্যরা কমান্ডগুলো যদি ভালো করে রপ্ত করা না করতে পারে তবে সেটা কমান্ডারেরই ভুল। তাই তিনি আবার সেই কমান্ডগুলো তিনবার ড্রিল করে পাঁচবার রপ্ত করিয়ে ড্রামে শব্দ করে বামে ঘুরার কমান্ড দিলেন। নর্তকীরা এবারও অট্ট হাসিতে লুটিয়ে পড়লো।

সানজু আবার বললেন, ‘যদি নির্দেশনাগুলো সৈন্যদের কাছে বোধগম্য না হয় এবং ভালোভাবে রপ্ত করানো না হয়, তবে সেটা কমান্ডারকে দোষারূপ করা হয়। কিন্তু যখন সেগুলো সকলের কাছে বোধগম্য হয়েছে আর তারা মানতে বাধ্য হচ্ছে না, মিলিটারি আইন অনুযায়ী তখন সেটা দলপতির উপর গিয়ে বর্তায়।’ এটা বলেই সানজু ডান এবং বামের দলপতিকে হত্যার নির্দেশ প্রদান করলেন।

এতক্ষণ অউ রাজা তার আসনে বসে সানজুর পরিচালিত সামরিক মহড়ার কার্যক্রম লক্ষ্য করছিলেন। তিনি দেখলেন তার খুব প্রিয় দুজন নর্তকীকে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এটা দেখে তিনি রেগে গিয়ে দ্রুত দূত পাঠিয়ে সানজুকে জানালেন: ‘ইতোমধ্যেই আমি বুঝে গেছি, জেনারেল তার কাজে যথেষ্ঠ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এই দুজন নর্তকী ছাড়া আমার খাবারে কোন স্বাদ থাকে না। তাই আমি চাই তাদের দুজনকে যেন হত্যা করা না হয়।’

জবাবে সানজু বললেন: ‘আপনার এই সেবক ইতোমধ্যে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং এই সৈন্যদলের প্রধান হিসেবে সৈন্যদের উপর সব ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ করার অনুমতি আমার রয়েছে।’

পরিণতিতে সৈন্যদল প্রধান দুজনের গর্দান গেল আর সানজু তাদের পরবর্তী দুজন সিনিয়র সৈন্যকে দুই দলের নতুন নেতা হিসেবে ঘোষণা করলেন।

তারপর তিনি ড্রামে জোর শব্দ করে নির্দেশ প্রদান করলে নর্তকীরা সবাই বামে, ডানে, সামনে, পেছনে, হাটু গেড়ে বসে আর শেষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ি ড্রিল করল। সৈন্যরা কোন টু-শব্দ করা সাহস পর্যন্ত করল না।

সানজু এবার দূত পাঠালেন রাজার কাছে এই তথ্য দিয়ে যে: ‘সৈন্যরা এখন যথেষ্ট পরিণত। মহারাজা এখন ইচ্ছা করলেই মহড়া দেখতে পারেন। তারা এখন রাজার সেবায় নিয়োজিত। তারা রাজার ইচ্ছায় পানি এমনকি আগুনে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত।’

অউ রাজা জানালেন, জেনারেল এখন তার তাবুতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারে। এইমুহূর্তে আমি তার মহড়া দেখতে প্রস্তুত নই।

সানজু বলে পাঠালেন, ‘জাহাপনারা শুধু ফাঁকা বুলি আওড়ানো শুনতে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু এর বাস্তবায়নটা দেখতে চান না।’

হো-লু রাজা এবার কমান্ডার হিসেবে সানজুর সক্ষমতা বুঝতে পারলেন এবং তাকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করলেন। পরবর্তীতে সানজু পরাশক্তি রাজ্য চু (Chu)-কে পরাজিত করে পশ্চিমে ইং (Ying) পর্যন্ত; উত্তরে চি (Chi) আর চিন (Chin) পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। দেখা যায় চৈনিক সাম্রাজ্যবাদের তালিকায় অউ (Wu) রাজ্যের দহরম মহরম আদতে অনেকটাই এই সানজুর অবদান। উয়েহ চুয়েহ শু (Yueh Chueh Shu) এর ভাষ্যমতে, ‘অউ রাজ্যের প্রধান ফটকের দশ লি দুরে যে বিশাল সামধিক্ষেত্র দেখা যেত, সেটা ছিল এই সানজুর।’

সানজু মৃত্যুর একশ বছর পেরিয়ে গেলে ও (O) এবং চুয়ান (Chuan) এর মধ্যবর্তী সময়ে সে রাজ্যে জন্ম নিল সান পিন। সান পিন হলেন সানজুর ই। পরবর্তী বংশধর। তিনি ছিলেন সামরিক শিক্ষায় পাং চুয়ান এর সহপাঠি। পাং চুয়ানের সামরিক শিক্ষা সমাপ্তি হলে অয়েই (Wei) রাজ্যের রাজা তাকে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন। তবে পাং চুয়ান বুঝতে পারলেন তার সামরিক দক্ষতা সান পিনের সমকক্ষ নয়। আর তাই সান পিনকে গোপনে তার আস্তানায় আসার অনুরোধ করে দুত পাঠালেন। পিন এসে পৌঁছলে ঈর্ষান্বিত পাং চুয়ান তার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। সে রাজ্যের আইন অনুযায়ি সান পিনের পা কেটে দেয়া হল। এছাড়াও তার মুখে কলব লাগিয়ে দেয়া হল দাগি আসামি হিসেবে সকলের সামনে প্রতিয়মান হওয়ার জন্য। এরপর তাকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হল যেখান থেকে কেউ তাকে দেখতে না পায়।

একদিন চি রাজ্য থেকে তা লিয়াং (Ta Liang) নামে এক পদস্থ কর্মকর্তা এলেন সেখানে। সান পিনকে একজন আসামি হিসেবেই গোপনে তা লিয়াং তার সাথে দেখা করেন। চি রাজ্যের পদস্থ কর্মকর্তা তাকে একজন অসাধারন ব্যাক্তি ভেবে গোপন পথে সান পিনকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন।

চি রাজ্যের প্রধান সেনাপতি তিয়েন চি সান পিন কে একজন অতিথী হিসেবেই গ্রহণ করল। অন্যদিকে তিয়েন চি প্রায়ই চি রাজ্যের রাজকুমারদের সাথে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় বাজি ধরত। সান পিন লক্ষ্য করলেন দুই দলের ঘোড়াগুলো শক্তির দিক থেকে বেশি একটা পার্থক্য নেই। ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা হত মুলত তিন শ্রেনীর ঘোড়ার পরস্পরের সাথে। সান পিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে তিয়েন চি কে বললেন, আপনি যদি এই প্রতিযোগিতায় জিততে চান তবে আমি আপনাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিতে পারি যেখানে আপনার জয় সুনিশ্চিত।

সান পিনকে বিশ্বাস করে তিয়েন চি রাজা আর তার পুত্রদের সাথে প্রতিটা প্রতিযোগিতায় এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বাজি ধরল। সান পিন তাকে বললেন, ‘আপনার দুর্বল ঘোড়াটি রাজার সবচেয়ে শক্তিশালি ঘোড়ার সাথে প্রতিযোগিতায় পাঠান, তারপর আপনার সবচেয়ে শক্তিশালি ঘোড়াটি রাজার মাধ্যম শক্তিশালি ঘোড়ার সাথে আর শেষে আপনার আপনার মধ্যম শক্তিশালি ঘোড়া রাজার দুর্বল ঘোড়ার সাথে।’ প্রতিযোগিতা শেষ হলে দেখা গেল তিয়েন চি প্রথম প্রতিযোগিতায় হেরে গেলেও পরের দুটোতে জয় লাভ করায় তার হাতে রয়ে গেল এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।

এরপর সান পিনকে রাজার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তিয়েন চি। রাজা সামরিক বাহিনী নিয়ে কিছু আলোচনা করে অভিভুত হলেন তার জ্ঞানের পরিধী দেখে। পরে তাকে সেখানকার সামরিক বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।

কিছু দিন পরে যখন চাও রাজ্য অয়েই (Wei) রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হল, চাও রাজ্য থেকে চি রাজার কাছে দ্রুত সাহায্যের জন্য অনুরোধ করল। অয়েই রাজা সান পিনকে তাদের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ দানে ইচ্ছা প্রকাশ করলে সান পিন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তা নাকোজ করে দিয়ে বলেন; যেহেতু পুর্বে আমি একজন দাগি আসামি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছি সেহেতু এই পদটা আমার জন্য শোভা পায় না। পরবর্তীতে তিয়েন চি কমান্ডার ইন চিফ আর সান পিন নিযুক্ত হলেন তার প্রধান উপদেষ্টা।

সান পিন যাত্রা শুরু করলেন সৈন্যদলের মালামালের একটা গাড়িতে করে। যাওয়ার পথেই তিনি যুদ্ধের ছক একে নিলেন। তবে তিয়েন চি চেয়েছিল সরাসরি চাও রাজ্যের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু সান পিন পরামর্শ দিলেন: ‘একটা এলোমেলো সুতার গিট খুলতে যেমন পুরো গিটটাকে একসাথে ধরতে নেই ঠিক তেমনি যুদ্ধ-বিগ্রহের মিমাংশা কখনও শুধুমাত্র অস্ত্রের মুখে সম্ভব নয়। আঘাত যদি করতেই হয় তবে শক্রর একেবারে মুলে অথবা তাদের কোন অরক্ষিত অংশে আঘাত করতে হবে। আর যখন দু পক্ষেরই মধ্যে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, তখন পরিস্থিতি আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে অয়েই আর চাও দুদিক থেকেই আক্রমণ চলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে উভয়ের সৈন্যদের এখন নাকানি চুবানি অবস্থা। আর বাড়িতে দুর্বল আর বৃদ্ধরাও ক্লান্ত। তাই এটাই মোক্ষম সুযোগ তা লিয়াং আক্রমণ করে প্রধান রাস্তা আর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার। এখনই তাদের রাজধানী সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। সেখানে আক্রমণ করলে ওয়েইরা দ্রুত চাওদেরকে ফেলে নিজেদের রাজধানী বাঁচানোর জন্য পড়ি কি মরি ছুটবে। এভাবেই আমরা চাও রাজ্যকে অয়েইদের দ্বারা আক্রমণ থেকে রক্ষাও করতে পারবো অন্যদিকে অয়েইদের পরাজয়ও সুনিশ্চিত।

সান পিনের পরামর্শ মেনে নিলেন তিয়েন চি। অয়েই সৈন্যরা নিজেদের রাজধানী রক্ষার্থে হান তাই (চাও এর রাজধানী) অবরোধ ছেড়ে দিয়ে পথিমধ্যে কুয়েই লিংয়ে চি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে চি সৈন্যদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

পনের বছর পরে চাও রাজ্যের সাথে মিত্রতা গড়ে অয়েই রাজ্য আক্রমণ করে বসল। হান দেরি না করে চি এর সহযোগিতা কামনা করলে চি রাজা তিয়েন চি কে আদেশ দিলেন তা লিয়াং আক্রমণ করার আদেশ দিলেন।

তখনকার অয়েই কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন পাং চুয়ান। সে খবর পেয়ে হান ছেড়ে দিয়ে নিজ দেশ রক্ষার্থে ছুটে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে চি সৈন্যরা বর্ডার পার করে অয়েই রাজ্যের পশ্চিমে ঢুকে পড়েছে।

যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সান পিন তিয়েন চি কে বলেছিলেন; “চিনের তিনটা রাজ্যেরই সৈন্যরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ, সাহসি আর তার চি রাজ্যের সেনাদেরকে কাপুরুষ ভেবে সবসময়ই অবজ্ঞা করে। দক্ষ যোদ্ধারই এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করে এখানে ফায়দা লুটে। রননীতি (The Art of War) অনুযায়ী, যদি কোন সেনাবাহিনী একশ লি (এক লি সমান ৫০০ মি.) দুরে থেকে যুদ্ধে জিততে চায় তবে তাদের সামনের দলের কমান্ডার শত্রুদের হাতে ধরা পড়বে; যদি পঞ্চাশ লি দুরে থেকে জিততে চায় তবে তাদের মাত্র অর্ধেক সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে। তারপর তিনি নির্দেশ দিলেন যখন চি সেনাবাহিনী বর্ডার পার করে অয়েই রাজ্যে ঢুকে পড়বে তখন তারা যেন প্রথম রাতে এক লক্ষ, দ্বিতীয় রাতে পঞ্চাশ হাজার আর তৃতীয় রাতে ত্রিশ হাজার সৈন্য শিরিরের রান্নার চুলা জ্বালায়।

পাং চুয়ান তিন দিন ধরে শত্রু শিবির লক্ষ করে আসছিল। সে খুবই আনন্দিত হয়ে বলল; আমি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম, চি সৈন্যরা যে কাপুরুষ। তারা আমাদের আক্রমণ করতে মাত্র তিন দিনই এখানে আছে আর ইতোমধ্যে তাদের অর্ধেকেরও বেশি অফিসার আর সৈন্য নিশ্চিন্ন হয়ে গেছে!

এটা নিশ্চিত হয়ে পাং চুয়ান তার নিয়মিত শক্তিশালি ভারী অস্ত্রসস্ত্রের বাহিনী রেখে হালকা বর্মের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেল শত্রুর মোকাবেলা করতে। আর অন্যদিকে সান পিন হিসাব করে দেখলেন পাং চুয়ান সন্ধানাগাদ এসে পৌঁছুবে। আর মা লিং রাস্তাটা সরু এবং দু পাশে খানা খন্দে ভরা যেখানে তার সৈন্যরা অনায়াশেই গর্তে পড়ে যাবে।

সান পিন রাস্তার দুপাশের চোখে পড়ার মত বড় বড় সব গাছের ছাল বাকল তুলে নিয়ে সেগুলোর গায়ে লিখে রাখলেন, ‘পাং চুয়ান এই গাছের নিচেই মারা পড়বে।’ রাস্তার ঝোঁপঝাড়ে সান পিন দক্ষ দশ হাজার তীরন্দাজ নিযুক্ত করলেন যাদের উপর নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন পাং চুনের সৈন্যদের জ্বালানো আগুন লক্ষ্য করা মাত্রই সেখানে তীর নিক্ষেপ করতে। আসলেই পাং চুয়ান সে রাতে এসে পৌঁছল তীরন্দাজদের এলাকায়। আর যখনই সে গাছের গায়ে লেখা পড়ার জন্য আলো জ্বালালো সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাকে তীর এসে পড়ল তাদের উপর পাং চুনের সৈন্যরা একেবারে হতবিহল হয়ে পড়ল। পাং চুয়ান তখনই বুঝতে পারল যে তার যতই সৈন্য-শক্তি থাকুক না কেন সে নিশ্চিত সান পিনের কাছে হেরে যাবে। সাথে সাথে সে নিজের টুটি কেটে আত্মহত্যা করল, আর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে বলে গেল, অতঃপর আমিও সেই হতচ্ছাড়াটার খ্যাতি ছড়িয়ে দিতে অবদান রেখে গেলাম।

এই সুযোগে সান পিন তার সমস্ত শক্তি নিয়ে আঘাত হানলেন অয়েই সৈন্যদের শিবিরে। তাদেরকে সম্পূর্ণ পরাস্থ করেন এবং অয়েইদের পরবর্তী উত্তরসুরীকে বন্দী করেন। এরপর তিনি নিজ রাজ্য চি ফিরে যান।

সান পিনের এই যুদ্ধ কৌশলের জন্য পুরো পৃথিবীতে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তার পরবর্তী বংশধর পর্যন্ত সেই খ্যাতি অক্ষুণ্ণ থাকে।

 

০১ অধ্যায় – অনুমান

সানজু বলেন:

যুদ্ধ হল একটা রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; জীবন-মরনের; কেননা এটা হল জীবন অথবা মৃত্যুর প্রশ্ন, এই পথটা হল বেঁচে থাকা বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার। তাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন অতীব প্রয়োজনীয় ব্যাপার।

লি চুয়ানের ভাষ্যমতে, ‘অস্ত্র হল অশুভ শক্তির উপাদান।’ যুদ্ধ খুবই ভাবনা চিন্তার একটা বিষয়; কেউ চাইলেই যেকোন সময় একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে না।

তাই পরিবেশ পরিস্থিতি যুদ্ধের জন্য কতটা অনুকুলে সেটা পাঁচটা মৌলিক উপাদানের ভিত্তিতে যাচাই করতে হবে এবং সব মিলিয়ে সাতটা বিষয়ের সাথে তুলনা করতে হয়। যাতে করে আপনি এর গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারেন। প্রথম উপাদানটা হল মোরাল ইনফ্লুয়েন্স বা নৈতিক প্রভাব। দ্বিতীয়ত, আবহাওয়া; তৃতীয়ত, ‘টেরেইন বা নির্ধারিত যুদ্ধক্ষেত্র; চতুর্থত, কমান্ড; এবং পঞ্চমত, ‘ডক্ট্রিন’ বা পদসোপান বা সৈন্যবাহিনীর সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য-জ্ঞান।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, উপরে প্রদত্ত যুদ্ধের সব নিয়মগুলো একেবারে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। যখন সৈন্যরা তাদের শত্রুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য তৈরি হয়, তখন টেম্পল কাউন্সিল প্রথমে তাদের শাসকদের যথাযথ উদারনৈতিকতা এবং জনগনের মধ্যে যুদ্ধের প্রতি আস্থার বিবেচনা করে; এরপরেই বিবেচনা করে অনুকুল পরিবেশের প্রতি, এবং শেষে যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকার ভূমিটাকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি শুরু করে। এই তিনটা বিষয়ের ফয়সালা হয়ে গেলে আক্রমণের জন্য একজন জেনারেল নিয়োগ করা হয়। আর সৈন্যরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রের সীমানায় পৌঁছে যায় তখন থেকে সকল আদেশ প্রদানের দায়িত্ব ঐ জেনারেলের উপর বর্তায়।

এক. নৈতিক প্রভাব বলতে সকলকে তাদের নেতার প্রতি অনুগত থাকার কথা বুঝিয়েছি যাতে করে তারা সকলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ পর্যন্ত একতা থাকতে পারে। কোন ভয় তাদেরকে ছুঁয়ে যেতে না পারে।

চ্যাং ইউ বলেন, যখন কেউ সৈন্যদের সাথে উদারতা, সাম্যবাদ, অধিকার সচেতনতা আর সকলের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের চোখে দেখেন তখন সৈন্যদের মাঝে একতার একটা মানসিকতা গড়ে উঠে এবং সাথে সাথে নেতার প্রতি খুশি মনে আনুগত্য প্রকাশ করে।

দুই. আবহাওয়া বলতে প্রাকৃতিক ঋতুগত পরিস্থিতিকে আমি প্রাধান্য দিয়েছিঃ শীতের ঠান্ডা এবং গ্রীষ্মের গরমের কিরুপ প্রভাব পড়তে পারে এবং এইসব ঋতুগত পরিস্থিতিতে সামরিক আক্রমণগুলোর ক্ষেত্রে যোগাযোগের উপযোগিতাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

তিন. ‘টেরেইন বা নির্ধারিত যুদ্ধক্ষেত্র বলতে সৈন্যশিবির আর নির্ধারিত যুদ্ধক্ষেত্রের দুরত্বের ব্যাপারটাকে প্রাধান্য দিয়েছি যেখানে দেখতে হবে দুটো জায়গার মধ্যে সহজ একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে কিনা। দেখতে হবে জায়গাটা কি কোন খোলা প্রান্তর নাকি চারিদিকে ঘেরাও কোন জায়গা, এবং সেখানে জীবন-মৃত্যুর কতটুকু ঝুঁকি আছে।

মেই ইয়াও চেন বলেন, আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠানোর আগে যুদ্ধক্ষেত্র দূরত্বটাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। দূরত্বটা জানতে পারলে আক্রমণের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। আসা যাওয়ার পথটার খানা খন্দ অনুমান করে তারপরই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পদাতিক সৈন্যবাহিনী নাকি অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধের সুবিধাটা নেয়া হবে। যদি জানা যায় যে যুদ্ধক্ষেত্রটা খোলা প্রান্তর অথবা চারিদিক ঘেরাও কোন জায়গা তখনই হিসাব করা যায় যে কতটুকু সৈন্য পাঠানো হবে। যদি যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতে পারা যায় তখনই কমান্ডার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে সৈন্যবাহিনী কি এক সাথে পাঠাবেন নাকি ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে স্থাপন করবেন।

চার. কমান্ড বলতে একজন জেনারেলের সামরিক জ্ঞান, আন্তরিকতা, মানবিকতা, সাহসিকতা, আর প্রয়োজনবোধে কঠোরতার কথা বলছি।

লি চুয়ান বলেন, এই পাঁচটা গুন একজন জেনারেলের প্রধানতম গুন। আর এই কারনেই বিশাল একটা সৈন্যবাহিনী তাকে সকলের সম্মানিত’ বলে মান্য করে থাকে।

তু মু (Tu Mu) বলেন, একজন কমান্ডার তখনই জ্ঞানী বলে খ্যাতি লাভ করবেন যখন তিনি পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তনটাকে বুঝতে পারবেন এবং সাথে সাথে সে প্রয়োজন অনুযায়ি যথাযথ কোন পদক্ষেপ নিতে পারবেন। যদি আন্তরিক হন তবে কোন সন্দেহ নেই তার সৈন্যবাহিনী পুরস্কার বা শাস্তির কথা সবসময় খেয়াল রাখবে। যদি তার মধ্যে মনুষ্যত্ব বিরাজ করে তবে তিনি সকলের প্রতি দয়ালু, অন্যের প্রতি সহানুভুতিশীল হন, তবে তাদের কঠোর পরিশ্রমের মূল্য দিতে জানেন। যদি সাহসি হন, তবে যে কোন সুযোগ গ্রহন করে জয়ের স্বাদ লাভ করতে সক্ষম হন। যদি কঠোর হন, তবে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় থাকে কারণ তারা সকলে শাস্তির ভয়ে তাকে মান্য করে।

সেন পাও-সু বলেন, ‘যদি একজন জেনারেল অসম্ভব সাহসি না হন তবে তিনি সকল সন্দেহ জয় করে ভালো কোন পরিকল্পনা করতে পারবেন না।

পাঁচ. ডক্ট্রিন’ বলতে সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা, বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সৈন্যদের মধ্যে পদসোপানের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত যোগান, এবং সৈন্যদের মাঝে প্রধান মৌলিক চাহিদাগুলির যথাযথ ভাগ বন্টন।

পৃথিবীতে এমন কোন সেনানায়ক নেই যে এই পাঁচটা প্রধানতম বিষয় সম্পর্কে জানেন না। যারা এই পাঁচটা গুনে গুনান্বিত তারা জয় লাভ করে; বাকিরা পরাজয়ের গ্লানি বহন করে। তাই প্রাথমিক পরিকল্পনায় এই উপাদানগুলোকে তুলনামুলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সাজাতে হয়।

.

২.

সানজুর মতে, যদি আপনি বলেন যে শাসক নৈতিকতা ধারন করে, যে কমান্ডার বেশি যোগ্য বা সামর্থবান, যে সৈন্যবাহিনী ঋতুগত পরিবর্তন মানিয়ে নিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের যোগাযোগ দুরত্বের সম্পর্কে ভাল অনুমান করে নিতে পারে, যে যুদ্ধের নিয়ম-কানুনগুলো সম্পর্কে ভাল ধারনা রাখতে পারে, যে সৈন্যরা অপেক্ষাকৃত বেশি দূর্ধর্ষ।

চ্যাং ইউ বলেন, সৈন্যদের যুদ্ধ গাড়িগুলো অসম্ভব শক্ত, ঘোড়াগুলো যতটা পারা যায় ক্ষিপ্র, সৈন্যরা অসম্ভব সাহসি, অস্ত্রগুলো অত্যন্ত শানিত হলে যখনই যুদ্ধ ধ্বনি শোনে তখনই যারা আক্রমনের জন্য হাসিমুখে তৈরি হয়ে তারাই সবচেয়ে শক্তিশালি সৈন্যবাহিনী।

যার অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ উপদেষ্টা আর সৈনিক আছে;

তু-ইউ বলেন, আর তাই মাস্টার ওয়াং বলেছিলেন: যদি পদস্থ উপদেষ্টারা যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে যথাযথ উপযুক্ত না হয় তবে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আতঙ্কিত হয়ে যাবে এবং আক্রমণ করতে ইতস্তত করবে; যদি জেনারেল যথাযথ ট্রেনিংপ্রাপ্ত না হয় তবে শত্রু দেখামাত্র তারা ভয়ে পিছিয়ে আসবে।

এবং যে কতৃপক্ষ সৈন্যদের পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপারে যতটা সাবলীল ও যথাযথভাবে করবে;

তু-মু বলেন, অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি যাতে না হয়।

তবে আমি আগে থেকেই বলে দিতে পারব কোন দল বিজিত আর কোন দল পরাজিত হবে। একজন সেনানায়ক যদি আমার এই কৌশলগুলি অনুসরন করেন তবে তার জয় সুনিশ্চিত। জয়ী সে হবেই! আর যদি কেউ আমার এই কৌশলগুলি অমান্য করে যুদ্ধে যায় তবে তার পরাজয় নিশ্চিত। সর্বনাশ তার হবেই!

.

৩.

সানজু বলেন, আমার এই কৌশলগুলোর সুবিধা নিতে হলে, সেনানায়ককে অবশ্যই সেই উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেগুলো সৈন্যদেরকে তাদের অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সাহায্য করবে। সকল যুদ্ধ বিগ্রহের ফলাফল নির্ভর করে কৌশলের উপর। যেমন :

এক. যখন আপনি সক্ষম, তখন ভান করুন অক্ষমের; যখন দক্ষ, তখন অদক্ষের ভান করুন। কাছে থাকলে নিজেকে বহু দূরে উপস্থাপন করুন; আর যখন বহু দূরে তখন উপস্থাপন করুন আপনি একেবারে কাছে আছেন। শত্রুকে একটু প্রলোভন দেখাবেন; সৈন্যদের মাঝে বিশৃঙ্খলার ভান করবেন আর সুযোগ বুঝেই আঘাত হানবেন।

তু-মু বলেন, চাও সেনাবাহিনী লি মু গবাদি পশুর পালের সাথে তাদের মেষ পালকগুলোকে ছেড়ে দিয়েছিল; যখন সিয়াং নু খুব কাছে চলে আসার একটা ভান করেছিল, তবে তার পেছনে ছিল কয়েক হাজার সৈন্যবাহিনী। খবরটা খান শোনামাত্র আনন্দিত হয়ে শক্তিশালী একটা বাহিনী তার বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিল। লি মু তার বেশিরভাগ সৈন্য ডান এবং বামে সুসজ্জিত করে রেখেছিল, যারা তীব্র আঘাত হানে আর হান সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের এক লক্ষ ঘোড়াসওয়ারকে হত্যা করে।

দুই. যখন কেউ খুব মনোযোগি, সব দিক থেকে প্রস্তুত; যে আপনার থেকে বেশি শক্তিশালী তখন তাকে এড়িয়ে যান। শত্রুর সেনানায়ককে রাগিয়ে দিন, তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করুন।

লি চুয়ান এর মতে, যখন সেনানায়ক বদরাগী হয়, তখন কতৃপক্ষ খুব সহজেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ তার চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকে না।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, শত্রুর সেনানায়ক যদি একগুয়ে আর ক্রোধান্বিত হয়, তবে তাকে অপমানিত করুন আর ক্রুদ্ধ করুন যার কারনে সে নিজেই বিরক্ত আর হতভম্ভ হয়ে যাবে এবং কোন পরিকল্পনা ছাড়াই সে আপনার দিকে অগ্রসর হবে।

তিন. শত্রুর থেকে অনুত্তম বলে নিজেকে প্রতিয়মান করুন আর তার অহংকার জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট থাকুন।

তু-মু বলেন, চিন রাজবংশের শেষের দিকে, মো-তুন এর সিয়াং নু ক্ষমতায় আরোহন করেন।পাশের রাজ্য ইস্টার্ন হু ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী আর তারা একজন রাজদুত পাঠালেন সিয়াং নু এর কাছে। তারা জানিয়েছিল, ‘আমরা এক হাজার ঘোড়া চাই।’ মোতুং তার উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। খবরটা শুনে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল: ‘এক হাজার ঘোড়া! আমাদের সবচেয়ে দামি জিনিস এটা! তাদরকে ঘোড়া উপহার দেয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না! মোতুং জবাবে বলেছিলেন : কেন কিছু ঘোড়ার জন্য প্রতিবেশির সাথে যুদ্ধে যাব?’ আর তাই ঘোড়া পাঠানো হল।

অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইস্টার্ন হু থেকে আবার দূত এল। সে বলল: ‘আমরা একজন রাজকুমারি চাই।’ মোতুং আবার তার উপদেষ্টা পরিষদদের সাথে আলোচনায় বসলেন যারা সকলেই রাগান্বিত হয়ে বললেন: ‘ইস্টার্ন হু রা তো দুবৃত্ত! আর তাই তারা এখন আমাদের একজন রাজকুমারি চাইছে! আমরা অনুরোধ করছি তাদেরকে আক্রমণ করার জন্য!’ মোতুং জবাবে বললেন; কেন একজন রাজকুমারির জন্য প্রতিবেশির সাথে বিরুপ পরিবেশ সৃষ্টি করব? আর তাই একজন রাজকুমারিকে পাঠানো হল ইস্টার্ন হু রাজ্যে।

তারপর একেবারে অল্প কিছুদিন পরে আবারও ইস্টার্ন হু রাজ্য থেকে খবর পাঠানো হল এই বলে আপনাদের একহাজার লি জমি পতিত রয়েছে, সেগুলো আমরা চাই। যথারীতি মোতুং তার উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জমি দিতে রাজি হলেও বাকিরা সরাসরি তা নাকোজ করে দিল। এবার মোতুং বললেন: “জমি হল একটা রাজ্যের অস্তিত্ব, ভিত্তি। কিভাবে তার জনগন সেটা ছেড়ে দিতে পারে? আর তাই যারা জমি ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল তাদের সকলের গর্দান গেল।

মোতুং সাথে সাথে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন, সকলকে আদেশ দিলেন যারা এখনও চুপ করে বসে থাকবে তাদের সকলের গর্দান যাবে। আর ইস্টার্ন হু রাজ্য অতর্কিত আক্রমণ করে বসলেন। ইস্টার্ন হু রাজ্যের সকলে ভয়ে পালাতে শুরু করল। কারণ তাদের কোন প্রস্তুতিও ছিল না। আক্রমণ করে তাদের নিশ্চিন্ন করতে শুরু করলেন। সেখান থেকে পশ্চিমে এগিয়ে গেলেন আর ইয়েহ তি আক্রমণ করে নিজের কজ্বায় আনলেন। দক্ষিণে দখল করে নিলেন লো ফান এবং শেষে জয় করলেন ইয়েন। আর এভাবে তিনি সিয়াং নু এর সকল জমি দখল করলেন যেগুলো অতীতে চিন সেনানায়ক মেং তিয়েন জয় করেছিলেন।

চার. শত্রুকে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখতে হয়। শত্রু যখন শান্তি খুজবে তখনই তাকে জ্বালাতে হবে। অস্থির করে তুলতে হবে তাকে।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, হান রাজ্যামলের শেষের দিকে লিউ পেই পরাজিত হন তাদের কাছে। পেই সেখান থেকে ইউয়ান সাও রাজ্যে পালিয়ে যায়। সেখানে আবার সৈন্য একত্রিত করে তাদেরকে আক্রমণ করে বসে। তিয়েন ফাং ছিলেন ইউয়ান সাওয়ের একজন কর্তব্যরত অফিসার। তিনি বলেছিলেন: “তাও সৈন্য পরিচালনায় অত্যন্ত সুদক্ষ ছিল। তার কাছে থেকে দূরে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ ছাড়া আর কিছু নয়। একজন সেনানায়ক হিসেবে আপনার উচিত পাহাড়-নদী পেরিয়ে দূরে সরে যাওয়া। বাহ্যিকভাবে সেখানে ক্ষমতাবান নোত আর নিজেদের মধ্যে তৈরি করুন সুদক্ষ সামরিক পরিকল্পনা। পরে সেখান থেকে অসাধারণ দক্ষ একটা দল গঠন করে, যখনই সুযোগ পায় শত্রুর অপ্রস্তুতার সুযোগটা গ্রহণ করে। দক্ষিণ দিকে নদী থেকে তাকে বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে। যখনই সে ডানের সমস্যাটা সামাধান করে তখনই বাম দিক থেকে আক্রমণ করে; তাকে দৌড় করিয়ে অশান্ত করে তোলে। আর যদি এই যুদ্ধ কৌশলটা কেউ এড়িয়ে গিয়ে সরাসরি সম্মুখ আক্রমনের ঝুঁকিটা গ্রহণ করে; তবে সেটা হবে সেই ভুল শুধরানোর জন্য দেরি। ইউয়ান সাও এই যুদ্ধ কৌশলটাকে অনুকরণ করেনি বলে শেষে পরাজিত হয়।

পাঁচ. যখনই শত্রু সৈন্যরা একত্রিত অবস্থায় থাকে, তাদেরকে ছন্ন ছাড়া করে দিন।

চ্যাং ইউ বলেন: মাঝে মাঝে ক্ষমতা এবং এর মালিকের মধ্যে একটা দুরত্ব সৃষ্টি করতে হয়; অন্যদিকে তার মিত্রদেরকেও আলাদা করে দিতে হয়। তাদের নিজেদের মধ্যে সন্দেহের চির ধরিয়ে দিতে হয় যাতে করে তারা আলাদা হতে পারে। তারপরই শত্রু শিবিরে আঘাত হানতে হয়।

ছয়. আক্রমণ করুন শত্রুর সবচেয়ে অরক্ষিত স্থানে; যেখানে শক্র কখনও ভাবেও নি যে সেই দিক দিয়ে আক্রমণ হতে পারে।

হো ইয়েন’সি বলেন, তাং রাজ্যের লি চ্যাং দশটা কৌশলের প্রস্তাব করে সিও সি দের বিরুদ্ধে করার জন্য। সৈন্যদের নির্দেশনা দেয়ার সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তার ওপর। আট মাসের মধ্যে সে কিউই চাও-এ তার সকল সৈন্যবাহিনী জড়ো করে।

শরৎকালে ইংতি নদীর পানি বেড়ে গিয়ে রাস্তা ঘাট সব তলিয়ে গেল। আর সিও সিয়েহ ভাবল লি চিং এই পরিস্থিতে নিশ্চই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাই সে যুদ্ধের কোনরুপ প্রস্তুতি গ্রহন করল না।

নবমতম মাসেই লি চিং তার সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন; যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ক্ষিপ্রতা; সুযোগ ছেড়ে দেয়ার মত মানুষ আমরা নই। আর আমরা যুদ্ধে মনোনিবেশ করব যেটা সিও সিয়েহ জানতেও পারবে না। নদীর এই ফুলে উঠাটাকেই আর্শিবাদ হিসেবে নিয়ে হঠাৎ সিও সিয়েহ এর রাজধানী আক্রমণ করব। ঠিক যেমনটা প্রবাদে আছে, ‘হাত তালি দেয়ার জন্য হাত দুটোকে একত্রিত করার পরে কান ঢেকে রাখার জন্য আর কিছুই বাকি রইল না। যদি সে আমাদের খবর পায়ও ততক্ষণে সে পরিকল্পনা করতে করতেই আমরা তাকে কুপোকাত করে দিতে পারব।

সৈন্যরা আই লিং এর দিকে আগানো শুরু করল আর সিও সিয়েহ তা দেখে ভরকে গেল। সাথে সাথে সে নদীর দক্ষিণে সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করল। কিন্তু সৈন্যরা সময় মত সেখানে পৌঁছতেই পারল না। লি চিং শহর অবরুদ্ধ করে রাখলে সিও সিয়েহ শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করে।

সাত. এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করুন যে জায়গা দিয়ে শত্রু আক্রমনের কোন আশংকাই করে নি।

অয়েই সেনানায়ক জেনারেল চাং হুই এবং তেং আই কে পাঠায় সু রাজ্য আক্রমণের জন্য। শীতের সময় অর্থাৎ দশমতম মাসে জেনারেল আই ইন পিং ছেড়ে হাজার লি দুরে গমন করলেন। এই জায়গাটায় কোন বাধার সম্মুখিন সে হয় নি। জায়গাটায় উঁচু উঁচু পাহাড় আর খোলা প্রান্তর ছিল। তাই শক্রর সম্মুখিন না হলেও এই পাহাড়গুলোর কারনে তাকে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে। তেং আই নিজেকে মোটা কার্পেটে জড়িয়ে পাহাড়ের ঢালে গড়াতে শুরু করল; আর তার উপদেষ্টারা পাহাড়ের গাছগুলো ধরে কোনমতে নিচে নামল। আর সৈন্যরা সেখানকার নদী থেকে মাছ খেয়ে শক্তি জোগাড় করে এগিয়ে চলে।

তেং আই প্রথমে সু রাজ্যের চিয়াং ইউ নামক জায়গায় পৌঁছুল। পাল্টা আক্রমণে না গিয়ে জেনারেল মোউ আত্মসমর্পন করল। হত্যা করা হল চাও কো চাং কে। আর এরই সাথে সাথে পতন ঘটল সু রাজ্যের।

এগুলো হল জয়ী হওয়ার আসল চাবিকাঠি। আর এগুলো হাতে কলমে না দেখানো পর্যন্ত ঠিকভাবে রপ্ত করাও সম্ভবপর নয়।

মেই ইয়াও চেন এর ভাষ্যমতে, শত্রুর দ্বারা আক্রমণ হওয়া ছাড়া তো তেমন পরিবেশই সৃষ্টি করা যাবে না। তাই কৌশলগুলি সেই পরিবেশ পরিস্থিতি ছাড়া কিভাবে আলোচনা করা যাবে? আর এখন আমার এই অনুমানগুলো যদি নিজেরা কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই চর্চা করে তবে সেটা বিজিত হওয়ার সুযোগটা বাড়িয়ে দেবে কারণ অনুমান বলছে সেখানে সেই উত্তম; আর যদি সেটা পরাজিত হওয়ার নির্দেশ করে তবে সেটার কারণ হবে সে নিজেকে শত্রুর থেকে কম শক্তিশালি বলে মনে করে। যত বেশি হিসাব-নিকাশ করে যুদ্ধ করে তার জয়ী হওয়ার সুযোগ ততটা বেড়ে যাবে। এর দ্বারা আমি বোঝাতে চাইছি যদি পরিবেশ পরিস্থিতিটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন তবে ফলাফলটা খুব সহজেই আগ থেকেই বোঝা সহজ হয়ে যায়।

 

০২ অধ্যায় – ওয়েজিং ওয়ার

সানজু বলেন:

সাধারণত একটা সামরিক অভিযানে এক হাজার দ্রুত গতি সম্পন্ন চার ঘোড়াওয়ালা যুদ্ধ রথ, এক হাজার চার ঘোড়াওয়ালা ওয়াগন, আর এক লক্ষ পদাতিক সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন হয়।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, প্রাচীন কালের যুদ্ধ গুলোতে চামড়ায় জড়ানো রথগুলোর হালকা আর কতগুলো প্রকান্ড হত। প্রকান্ডগুলোতে অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জামাদি, মুল্যবান দ্রব্য সামগ্রী, যুদ্ধ পোষাক রাখা হতো।

সু-মা ফা এর মতে, একটা রথ তিনজন পদাতিক উপদেষ্টা অফিসার বহন করতো; যাদের সাথে থাকতো বাহাত্তর জন পদাতিক সৈন্য। এছাড়াও থাকতো দশজন রাধুনি ও সাহায্যকারী, পাঁচজন থাকতো যুদ্ধ পোষাক দেখাশুনা করার জন্য আর পাঁচজন থাকতো আগুন জ্বালানো আর পানি সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। বড় একটা রথে মোট পঁচাত্তর জন থাকতো যাদেরকে একটা ছোট পঁচিশ জন ওয়ালা ওয়াগন সহযোগিতা করে একশ জনের একটা দল তৈরি করতো।

যুদ্ধের জিনিসপত্র বাড়ি থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেয়া হয়ে গেলে দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা এবং পর্যবেক্ষণকারী সেগুলো ভালোভাবে পরিদর্শন করে নেন যেগুলোর জন্য প্রতি রথ অনুসারে দিনে একহাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করতে হয়। আর এর খরচের অর্থ যদি হাতে থাকে তবে এক লক্ষ সৈন্যও যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।

লি চুয়ানের মতে: যখন সৈন্যবাহিনী বাড়ি থেকে রওয়ানা দিতে দেখবেন তখন তাদের বাড়ির ধন-সম্পদ সব খালি হয়ে গেছে।

তু-মু এর ভাষ্যমতে: সে সময় এক ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল। সৈন্যদেরকে মাঝে মাঝে সামন্ত প্রভুরা দেখতে আসতো। আর তাই সানজু ‘উপদেষ্টা এবং পরিদর্শনকারী’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

.

২.

যুদ্ধে জিততে পারাটাই মুখ্য বিষয়। যদি যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হয় তবে অস্ত্রের ধার কমে আসবে এবং সৈন্যদের মনোবল কমতে থাকে। শেষে তারা যখন শহর আক্রমণ করতে যাবে ততক্ষণে তাদের সকল শক্তি নিঃস্বের পর্যায়ে চলে যায়। একদিকে সৈন্যদের মাঝে শহর রক্ষার জন্য বলা হবে ততক্ষণে রাজ্যের সম্পদ একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছবে।

চ্যাং ইউ এর মতে: হান রাজ্যের সম্রাট অউ (Wu) যখন প্রচারণা চালাচ্ছিলেন রাজ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ততক্ষণে যুদ্ধের খরচ বহন করতে গিয়ে তার ভান্ডার খালি হয়ে গেল।

যখন আপনার অস্ত্র ভোলা হয়ে যাবে; সমস্ত শক্তি আর সম্পদ শেষ হয়ে যাবে, এই সুযোগটা প্রতিবেশি রাজ্য কাজে লাগিয়ে ভয়ানক কিছু একটা করে ফেলতে পারে। আর তখন আপনার যতই জ্ঞানী উপদেষ্ট থাকুক না কেন কারও কোন পরামর্শ ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতে পারবে না। আর যখন আমরা যুদ্ধের ময়দানে অসম্ভব সাবলীল যুদ্ধের কথা শুনি, তখন কিন্তু সেখানে যে বড় ধরনের কোন চালাকি লুকিয়ে আছে সেটা কখনও কল্পনাও করতে পারিনা।

তু-ইউ এর ভাষ্যমতে: কোন আক্রমণে হয়তো বুদ্ধির খেল কম থাকতে পারে; তবে সেখানে জয়ী হওয়ার জন্য অতিপ্রাকৃত ক্ষিপ্রতা থাকতে হবে।

এমন কোন দীর্ঘায়িত যুদ্ধ নেই যেই যুদ্ধ থেকে দেশের কোন মঙ্গল হয়েছে।

লি চুয়ানের ভাষ্যমতে: বসন্ত এবং শরৎ ঋতুতে সংঘটিত যুদ্ধগুলো বলছে: ‘যুদ্ধ হল আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত; যারা অস্ত্রের ভাষায় কথা বলবে তাদেরকেও সেই অস্ত্রের মুখে পড়তে হয়েছে।’

আর এভাবে যারা সৈন্যবাহিনী ব্যবহারের ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞ তারাই এর ব্যবহারের সুবিধাটাও সম্পর্কে অজ্ঞ।

.

৩.

সানজু বলেন, যুদ্ধের ময়দানে দ্বিতীয় সুযোগ বলে কিছু নেই, প্রথম সুযোগেই কুপোকাত করতে হয়। সৈন্যরা তাদের নিজ দেশ থেকে যুদ্ধের সরজ্ঞামাদি বহন করে নিয়ে আসে। তবে ময়দানে থাকার সময়কালে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া সরজ্ঞামাদি দিয়েই নির্বাহ করে। এভাবেই সৈন্যদের মাঝে পর্যাপ্ত রসদ পৌঁছে দিতে হয়। যদি সামরিক অভিযান করতে গিয়ে দেশ নিঃস্ব হয়ে যায় তবে সেটা হবে পরিবহন ব্যায়ের কারনে; সরঞ্জামাদি দুরে পরিবহন করার পারিশ্রমিক দিতে গিয়েই মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়।

চ্যাং ইউ এর মতে: যদি সৈন্যদের এক হাজার লি দূরে তাদের যুদ্ধ সরঞ্জামাদি পরিবহন করার জন্য মুদ্রা খরচ করতে হয়; তবে তারা যেন প্রচন্ড রাগত চোখে দেখবে সব কিছু।

.

৪.

সানজু বলে, যেখানে সৈন্যদেরকে বেশি খরচ করে নিজের বাগে আনতে হয়; সেখানে সব কিছুরই দাম বেড়ে যায়, জনগণ অতিষ্ট হয়ে ওঠে।

চিয়ান লিন এর ভাষ্যমতে, সৈন্য জোগাড় করা শুরু করলে বাজার দর বেড়ে যায়, কারণ দ্রব্যের যোগান কমে গেলে সকলে তার দ্রব্যের থেকে বেশি মুনাফা আদায় করে নেয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে সকল সম্পদ খরচ করে দেয়ার পর জনগণের হাতে খরচ করার মত কিছু থাকে না। তাদের সকল সম্পত্তি নিঃশ্বেস হয়ে যায়। ভেঙ্গে যাওয়া রথ মেরামত করতে, আহত ঘোড়ার চিকিৎসা করতে, সুরক্ষা শিল্ড আর হেলমেট মেরামত করতে, তীর-ধনুক আর সৈন্যদের হাত এবং বর্মগুলো ঠিক করতে, ওয়াগনের যোগান দিতে গিয়ে রাজ কোষাগারের ষাট ভাগই খরচ হয়ে যায়। আর তাই বিজ্ঞ জেনারেল খেয়াল রাখেন যাতে তার সৈন্যরা আক্রমণ করে ছিনিয়ে আনা রসদ তাৎক্ষণিক যুদ্ধের পুরস্কার হিসেবে বন্টন করে দেয়া হয়েছে কিনা। এতে করে তার সৈন্যরা শত্রু থেকে তাদের খাবার আর অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে উৎসাহ বোধ করবে। কারণ নিজেদের এক ভাগ খাবার শত্রুদের বিশ ভাগ খাবারের সমান।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, সরঞ্জামাদি এক হাজার লি দুরে পরিবহনে বিশ ভাগ সৈন্যদের রসদ শেষ হয়ে যায়। আর যদি যোগাযোগ ব্যবস্থাটা দুর্গম হয় তবে সেক্ষেত্রে ক্ষতি আরও বেশি হয়।

আর সৈন্যদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন তারা শত্রুদের সৈন্য আরও বেশি হত্যা শুরু করে।

হো ইয়েন-সি এর মতে, যখন ইয়েন সৈন্য চারিদিক থেকে সি-মো দেরকে চি-তে ঘিরে ফেলল; তারা সকল সি-মো সৈন্যদের আটককৃতদের নাক কেটে দিল। সৈন্যরা শক্তিশালী একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তিয়েন তান গোপনে দুত পাঠালেন: ‘আমরা খুবই ভীত কম্পিত এটা শুনে যে ইয়েনের মানুষ শুনুন শত্রুরা আপনাদের পূর্বপুরুষদের দেহ পর্যন্ত করব খুড়ে তুলে ফেলবে। এই অবস্থায় আমরা কিভাবে শান্ত থাকি?’

ইয়েন সৈন্যরা তাৎক্ষণিক তাদের কবরগুলিকে ধ্বংস করে মৃতদেহগুলি পুড়িয়ে ফেলতে শুরু করল। সেই প্রতিক্ষিরা সেগুলো শহরের সুরক্ষা সীমানা থেকে তা পর্যবেক্ষণ করল। আর চোখের পানি ফেলা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। এর সাথে সাথে তাদের ক্ষোভকে দশগুণ শক্তিতে রুপান্তরিত করল। তিয়েন তান বুঝতে পেরে তার সৈন্যদেরকে তৈরি হতে বলল এবং আক্রমণের নির্দেশ দিলে ইয়েন সৈন্যরা পরাজিত হল।

সানজুর মতে, শত্রু থেকে তাদের ধন-সম্পদ লুট করে আনার কারণ ওগুলো সৈন্যদের প্রাপ্য।

তু-মু এর ভাষ্যমতে: হানদের শেষের দিকে তু সিয়াং সেই পাওদের আক্রমণ করে এবং পান হায় ও আরও কিছু রাজ্য নিজের দখলে করে নেয়। তিনি নান হাই রাজ্যের ভেতরে ঢুকে তাদের তিনটা ক্যাম্প ধ্বংস করে এবং প্রচুর সম্পদ ছিনিয়ে আনে। যাইহোক, পান হাং এবং তার অনুসারিরা তখনও অত্যন্ত ক্ষমতাধর আর সংখ্যায় বহু সৈন্য ছিল আর অন্যদিকে তু সিয়াংদের সৈন্যরা সম্পদশালী আর অহংকারী হয়ে উঠল। একারনে তাদের মধ্যে যুদ্ধ করার সামান্যতম ইচ্ছা ছিল না।

সিয়াং এর ভাষ্যমতে: ‘পু ইয়াং আর পাং হান টানা দশ বছর বিদ্রোহ করে। দুজনই আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষায় ছিল অত্যন্ত সুদক্ষ। তাই সকল শক্তি একত্রিত করে তাদেরকে আক্রমণ করি। এর জন্য একটা পরিকল্পনা করা হল। সৈন্যদের মধ্যে চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার জন্য শিকারের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।’ যেখানে সকল সৈন্যরাই অংশ নেয়ার জন্য শিবির ছেড়ে বেড়িয়ে যায়।

যখনই সৈন্যরা শিবির ছেড়ে গেল তু সিয়াং গোপনে নির্দেশ দিলেন তার সৈন্যদের শিবিরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিতে। আর এতে তাদের সকল সম্পদ পুড়ে ছাই হল। ফিরে এসে অবস্থা দেখে তাদের সকলে কান্না জুড়ে দিল।

তু সিয়াং বলেন: ‘পু ইয়াং আর তার সৈন্যদের যতটা সম্পদ আছে সেগুলো তোমাদের এবং কয়েক প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট। তোমরা তোমাদের পুরো শক্তি দিয়ে কখনও আক্রমণ করো নি। শত্রু শিবিরে যা আছে তার সামান্যই তোমরা এখানে হারিয়েছে। এটা নিয়ে এত চিন্তিত কেন তোমরা?’

সৈন্যরা এটা শুনে বিপুল উৎসাহিত হল এবং যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তু সিয়াং তাদের ঘোড়াগুলোকে খাবার খাওয়ানোর নির্দেশ দিলেন এবং সকলকে তাদের বিছানায় যেতে নির্দেশ দিলেন। সকালে সৈন্যরা বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য রওয়ানা দিল। আর হাং তখন প্রস্তুত ছিল না আর তু সিয়াংয়ের সৈন্যরা প্রবল উৎসাহে তাদের আক্রমণ করে পরাস্থ করল।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, এই সার্বভৌম রাজবংশের সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠাতা যখন তার সেনানায়ককে সু রাজ্য আক্রমণের আদেশ দেন তখন তিনি এভাবে ঘোষণা দেন: যে সকল শহর এবং তার অধীনস্ত রাজ্য দখল করা হবে, তোমরা আমার জয়গান ছড়িয়ে দেবে আর তাদের সম্পদগুলি ছিনিয়ে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। রাজ্যের নামে আসবে শুধু এর জমিগুলো।

তাছাড়া, আক্রমণের সময় সেখানে যদি দশটাও রথ ছিনিয়ে আনা যায় তবে যারাই প্রথম রথ ছিনিয়ে আনতে পারে তাদেরকে পুরস্কৃত করুন। শত্রুর পতাকার জায়গায় নিজেদের পতাকা প্রতিস্থাপন করুন, রথগুলো নিজেদের রথের সাথে যুক্ত করে সেগুলোকেও কাজে লাগান। যুদ্ধ বন্দিদের সাথে ভালো আচরণ করুন।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, সকল আটকৃত সৈন্যদেরকে সুস্থ করে তুলে তাদেরকে নিজেদের পক্ষে যুদ্ধে কাজে লাগাতে হয়।

একেই বলা হয় একটা যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী করে ভোলা। আর তাই যুদ্ধের মুখ্য বিষয় হল জয় লাভ করা, যুদ্ধে লিপ্ত থাকা নয়। আর তারপরই সেনানায়ক বুঝতে পারবেন যুদ্ধ হল জনগণের ভাগ্য আর মিমাংশা হল জাতির নিয়তি।

হো ইয়েন সি এর মতে, বর্তমানে একজন সেনানায়কের নিয়োগ দান যেমন সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং কঠিন ব্যাপার ঠিক তেমনি প্রাচীন কালেও ছিল।

 

# All part; https://pdfpoka.com/the-art-of-war-pdf-bangla/

 

Back to top button
error: Content is protected !!