vog-by-avik-sarkar-part-1

মূর্তিটাকে দোকানে দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেলো অতীনের। কিন্তু তারপর মূর্তিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে…
পার্ক স্ট্রিটের এই কিউরিওর দোকানে প্রায়ই আসে অতীন। মালিক সুবেশ আগরওয়ালের সঙ্গে গল্পগুজব করে কিছুক্ষণ, এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখে, কিছু পছন্দ হলে ঘরে নিয়ে যায়। সুবেশের সঙ্গে মাত্র এই কয়েকবছরেই বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অতীনের। দুজনেই ব্যাচেলার, বয়েসও কাছাকাছি, একত্রিশ আর তেত্রিশ। তার ওপর সুবেশ আগরওয়াল নামেই মাড়োয়াড়ি, পাঁচ পুরুষের বাস কলকাতা শহরে। চট করে দেখলে বা কথা বললে মনে হয় মাণিকতলার গলি থেকে বগলে ব্যাগ নিয়ে বার হয়ে পান চিবোতে চিবোতে গিল্যাণ্ডার হাউসে কেরানিগিরি করতে যাওয়া বাঙালি বাবুটি বুঝি।
অতীনের সঙ্গে সুবেশের এই হৃদ্যতা দোকানদার আর খদ্দেরের সাধারণ আলাপচারিতার থেকে অনেক বেশি। ধার বাকি তো আছেই, সময় সুযোগ বুঝে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ড্যান্স বারে বসে মদ্যপান, শনিবার দেখে মাঝেমধ্যে রেস কোর্সে ঢুঁ মারা, সবই চলে। সুবেশের আরও দুটি সদগুণ হচ্ছে – এক, টাকার জন্যে অতীনকে মোটেও তাগাদা দেয় না, আর দুই, চারপেগের পর লোকটা ভারি উদার হয়ে পড়ে, কিছুতেই অতীনকে পয়সা দিতে হয় না।
আজ অক্টোবরের শেষ শনিবার। অফিস ফেরতা আজও এসেছিল অতীন, টুকটাক গল্প করে তারপর মেট্রো ধরে নেতাজিনগরের বাসায় ফিরে যাবে, এই ছিল প্ল্যান। এমনিতেও অতীন অকৃতদার, তার ওপর প্রথম যৌবনেই মা বাবা দেহ রাখেন, তার বাড়ি যাবার তেমন তাড়া থাকে না। বুড়ি কাজের লোক পুষ্পদি ছাড়া অতীনের তিনকূলে কেউ নেইও। পুষ্পরাণী এবাড়িতে সর্বক্ষণের কাজের লোক হয়ে আসেন যখন অতীন জন্মায়। সেই থেকে রয়ে গেছেন ভদ্রমহিলা, সার্বজনীন পুষ্পদি হয়ে। এই বুড়ি ছাড়া অতীনের তিনকূলে আর কেউ নেই। ফলে যখন খুশি বাড়ি ফেরার এই স্বাধীনতাটা খুব আয়েশ করেই উপভোগ করে অতীন। বাপ মা একটা দোতলা বাড়ি আর মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স রেখেই দেহ রেখেছেন, টাকার খুব একটা টানাটানি অতীনের নেই, সে নিজেও একটা এফ এম সি জি কম্পানির ট্রেড মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করে, মাইনে খারাপ নয়, তদুপরি ইন্সেন্টিভ তো আছেই।
তার স্বভাবচরিত্র ভালো, পাড়াপড়শিরা তাকে ভালোবাসেন, রাস্তায় দেখা হলে খোঁজ নেন। বার্সিলোনা, পলিটিক্স, ইস্টবেঙ্গল, সিনেমা – এসব নিয়ে অতীন সুখেই আছে।
অতীনের শখ বলতে শুধু একটিই, অ্যান্টিক কিউরিও কেনা। তার মাসিক হাতখরচের বেশিটাই চলে যায় টুকটাক পুরোনো জিনিস কিনতে। অবশ্য খুব বেশি দামি কিছু না, এই একটা টেবিলঘড়ি কি পুরোনো আফ্রিকান মুখোশ, এই আর কি। আজকাল আবার ঝুঁকেছে মূর্তি কেনার দিকে। ঘরের একটা কোণ ফাঁকা আছে। তক্কেতক্কে আছে, ভালো দাঁওতে একটা মূর্তি পেলে কিনে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখবে।
তাই মূর্তিটাকে দোকানে দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেলো অতীনের। ফুট তিনেক মতন লম্বা, পিতলের তৈরি দেবীমূর্তি। সারা মুর্তিটা সবজেটে নীল রঙের। মুকুট ও অন্যান্য অলঙ্কারের ডিজাইন দেখে মনে হয় তিব্বতীয় বৌদ্ধমূর্তি। আরেকটু ভালো করে দেখবে বলে মূর্তির কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দেখতে লাগলো অতীন।
দেবীমূর্তিই বটে। পদ্মের ওপর বসে আছেন দেবী, ডান পা নিচে নামানো, বাঁ পা ভাঁজ করে ডানপায়ের হাঁটুর ভাঁজে ঢোকানো। দেবীর চার হাত, নিচের বাঁ হাতে বীণা ধরে আছেন, ডানহাতে অভয়মুদ্রা। বৌদ্ধদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর প্রচলন ছিল নাকি? ধন্দে পড়ে গেলো অতীন। আস্তে আস্তে চোখদুটো ওপরে তুললো অতীন, আর ওপরের হাত দুটোর দিকে নজর পড়তেই থমকে গেলো,
ওপরে ডানহাতে খড়্গ, আর বাঁ হাতে নরকরোটি!!!
আজ অবধি এমন অদ্ভুত কম্বিনেশনের মূর্তি একটিও দেখেনি অতীন। একই সঙ্গে খড়্গ, করোটি আর বীণা?
দেবীর মুখে স্তিমিত প্রসন্ন হাসি, নেশাতুর নয়ন। আর অত্যন্ত আবেদনময়ী শরীর। সারা মুর্তি জুড়ে আঁটোসাঁটো যৌনতা ফেটে পড়ছে যেন। পীনোন্নত স্তনযুগল, তার ওপর চওড়াকাপড়ের পট্টি বাঁধা আছে কাঁচুলি হিসেবে, যদিও এই মদোন্মত্ত যৌবনদুটিকে আটকে রাখা তার সাধ্য নয়। সরু কোমর, একটা কটিবন্ধনী দিয়ে আবৃত। একটি স্নিগ্ধ রম্যশ্রী সমগ্র মূর্তি জুড়ে লেগে আছে, শান্ত শৃঙ্গাররসের এমন গ্রেসফুল প্রকাশ আর দেখেনি অতীন। সে আরও মুগ্ধ হলো মূর্তিকারের হাতের কারুকাজ দেখে। নাভি থেকে স্তনযুগলের মাঝ অবধি যে লোমরাজি উঠে এসেছে, সেটিও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটে উঠেছে মূর্তির মধ্যে। এমন সূক্ষ্ম হাতের কাজ অতীন শেষ কবে দেখেছে নিজেই মনে করতে পারলো না।
“বাহ, সুন্দর তো” তৃপ্ত মুখে উঠে দাঁড়ালো অতীন, মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে মূর্তিটি বিলক্ষণ পছন্দ হয়েছে তার। মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে গলা তোলে সে, “বাবা সুবেশ, কি রকম দাম রেখেছিস এটার? দেখিস, গলা কাটিস না কিন্তু ভাই, হ্যা হ্যা হ্যা।”
সুবেশ খিঁচিয়ে ওঠে “হ্যাঁ রে শালা, তোর গলা কেটে তো হেব্বি পয়সা পাবো কি না, চিপ্পুস কঁহিকা। শালা, নিবি তো একটা কাঁথা কি ভাঙা ঘড়ি, তার জন্যে আবার দরাদরি কিসের, অ্যাঁ? দ্যাখ ভাই, পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, ভালো মাল দেখলে কিন্তু ছাড়াছাড়ি নেই, যেমন গুড় ঢালবে ……” বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছিলো সুবেশ। হঠাৎ করে মূর্তিটার দিকে চোখ পড়তে থমকে যায়, “ওহ, ইয়ে, মানে এইটাই পছন্দ হলো নাকি তোর?”
“হ্যাঁ, আপত্তি আছে তোর?” হাসতে হাসতেই বলে অতীন, কিন্তু পরক্ষণেই সুবেশের মুখ দেখে একটু সিরিয়াস হয়ে পড়ে, “কি রে, কি হলো রে? গম্ভীর হয়ে গেলি কেনো? এনিথিং রংউইথ দ্যট স্ট্যাচু?”
সুবেশ কিছু কথা না বলে পকেট থেকে একটা গোল্ড ফ্লেক কিং সাইজ বার করে অতীনকে দেয়, নিজেও একটা বার করে, তারপর তার ফিল্টারের দিকটা অন্যমনস্কের মতন দোকানের কাউন্টারের ওপর ঠুকতে থাকে।
সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে সরু চাউনিতে সুবেশকে একবার মেপে নেয় অতীন। যথেষ্ট প্র্যাকটিক্যাল চালু জিনিস এই সুবেশ আগরওয়াল। এসব নাটক করে দাম বাড়াচ্ছে না তো?
“মূর্তিটা তুই এমনিই নিয়ে যা। আসলে ওটা আমি কিনিনি, একজন দিয়ে দিয়েছে, বুঝলি। এমনিই দিয়েছে, ফ্রি তে, একপয়সা নেয়নি। শালা কিসের, কার মূর্তি আমি নিজেও জানি না। ভাবলাম একবার প্রফেসর বিনয়তোষ ভট্টাচার্যর কাছে নিয়ে যাই। তিব্বতি মূর্তিটুর্তি লাইনে উনিই অথেনটিক কি না। তারপর তো খোঁজ নিতে গিয়ে শুনি উনি অনেক দিন আগেই অফ হয়ে গেছেন। এখন ভাবছি কার কাছে যাই। ভালো করে না জেনে শালা দামও হাঁকতে…. “
“আহহ, বড্ড বাজে বকিস তুই সুবেশ”, ধমক দেয় অতীন, “মালটা পেলি কি করে আগে সেইটা বল”।
“ওহ, হ্যাঁ, দাঁড়া বলছি”, বলে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা সুখটান দেয় সুবেশ, তারপর শুরু করে,
“লাস্ট উইকে, বুঝলি, বামুনগাছি গেছি। চিনিস তো? দমদম ক্যান্টনমেন্ট লাইনে। খবর ছিল এক পুরোনো জমিদারবাড়ি ভাঙা পড়ছে। পুরোনো মানে প্রায় ছ’শো বছরের পুরোনো স্ট্রাকচার। প্রতি একশো দেড়শো বছর অন্তর অন্তর রিমডেলিং আর সারাই করে জমিদার ফ্যামিলি ওখানেই আছে ছ’শো বছর ধরে। লাস্ট মেজর রিস্ট্রাকচারিং নাকি সিপাই বিদ্রোহের পরের বছর হয়, প্রায় একশো সত্তর বছর আগে। বাড়ির তখনকার মালিক নাকি নুনের আর কাটা কাপড়ের ট্রেডিং করে প্রচুর পয়সা কামায়। প্রচুর মানে প্রচুর। পরের সাত জেনারেশন বসে খেতে পারে এমন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে আর পাঁচটা বাঙালি জমিদারবাড়ির মতন এদের মধ্যে কোনও শরিকি বিবাদ দেখা দেয় নি। যার আলাদা হবার কথা, নির্বিবাদে নিজের পাওনাটা নিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েছে। নো মামলা মোকদ্দমা, নো হ্যাঙ্গাম।
“তা প্রেজেন্ট জেনারেশনের যিনি মালিক, নারায়ণ চক্রবর্তী, তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে থাকে ইউ এস এতে। ছেলে সফটওয়্যারে আছে, হেবি উঁচু পোস্ট আর সেই রকম মাইনে। সাউথ সিটিতে পনেরোশো স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট, বুঝলি? দুই ভাইবোনে হেব্বি ভাব মাইরি, না দেখলে বিশ্বাস হয় না শালা, আমাদের ফ্যামিলিতে তো ভাবাই যায় না।
“সে যাক গে। তা এই চক্কোত্তি মশাই তো গত মাসে পটল তুলেছেন। ইউ এস থেকে মেয়ে জামাই, কলকাতা থেকে ছেলে বউ, দুই পক্ষের একগাদা বাচ্চাকাচ্চা মিলে এসে হাজির। প্রচুর খরচাপাতি করে, আশেপাশের দশ গ্রামের লোক খাইয়ে তারা চক্কোত্তি ফ্যামিলির নাম রাখলো। তারপরেই তো চিত্তির। অত বড় প্রপার্টি দেখবে কে? দুদিনে পার্টির পেটে যাওয়া তো নিশ্চিত। তা ছেলে আর জামাই দুজনেই বুদ্ধি করে বামুনগাছি আসার আগেই দালাল লাগিয়ে এসেছিলো। খাঁটি ঘি দুধ খাওয়া ব্রেন ভাই, তোর আমার মতন নাকি?
“তা শ্রাদ্ধশান্তি শেষ, দালাল তো খুবই চটপটে লোক, কেনার লোক এনে হাজির। দুদিনের মধ্যে সইসাবুদও শেষ। শোনা যায় কোটি টাকার কাছাকাছি ডিল, গ্রামের হাওয়া তাই নিয়েদেখলাম খুব গরম।
“তা এই যে দালাল, বুঝলি, আমারই জাতভাই, নাম রাজকমল গিলরা, সেই আমাকে নিয়ে যায় জমিদারবাড়িতে। তোকে তো আর বলতে হবে না, বেঙ্গলের এইসব পুরোনো জমিদারবাড়ি এক একটা অ্যান্টিক আর কিউরিওর ডিপো। পুরোন বই থেকে শুরু করে ঝাড়লন্ঠন, ওয়াল ক্লক, পেইন্টিং, সেজবাতি, এমনকি রাইটিং ডেস্ক আর থালাবাসন অবধি!
“তা আমিও দালালের দেশোয়ালি ভাই হবার সুবাদে বেশ কিছু ভালো জিনিস বেশ সস্তা দরেই পেয়ে গেলাম, বুঝলি? তারপর টাকাপয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় ওদের যে পুজো করার ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক, তিনি এসে এইটে রাখলেন আমার সামনে, বললেন “এইটে নিয়ে যান, পয়সা দিতে হবে না”।”
এতটা বলে একটু থামলো সুবেশ। অতীন বলে উঠলো, “সে কি রে, ওদের জিনিস, পুরুত মশাই এসে বিলিয়ে দিলেন? ওরা কিছু বললো না?”
ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবলো সুবেশ, তারপর বললো, “যেটা বুঝলাম, এই পুজারী ব্রাহ্মণটি অনেকদিন ধরে এই জমিদারবাড়ির সঙ্গে যুক্ত। খুব সম্ভবত জেনারেশন ধরে এরা পুজো করে এসেছে। বুঝিসই তো, এই সব জায়গায় একটা জোর এসেই যায়। জামাই বোধহয় একবার বলতে গেছিলো যে অমন অ্যান্টিক মূর্তি ফ্রিতে দিয়ে দেওয়াটা ঠিক কি না। মেয়ে তো দাবড়েই থামিয়ে দিলো, বলে জ্যেঠু যা করছে নিশ্চয়ই ভালোর জন্যেই করছেন। বুঝলাম, এই ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকটিকে ওরা খুব রেসপেক্ট দেয়।”
আবার থামলো সুবেশ। সেই সুযোগে সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অতীন বললো “তা ফোকটে পেয়েছিস ভালো কথা। এখন কথা হচ্ছে নিশ্চয়ই এটা পুজো করা হতো না, কারণ পুজো করা মুর্তি কেউ বিক্রিও করে না, কাউকে এই ভাবে দেয়ও না। দিলে মন্দিরে দেয় বা কারও বাড়িতে দেয়, যাতে পুজোটা বরকরার থাকে, তাই না? তা এই অ্যান্টিক জিনিসটা তোকে এমন ফ্রিতে বিলিয়ে দেওয়ার কারণটা জিজ্ঞেস করিস নি?”
বেশ খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবলো সুবেশ, “একটা কথা কি মনে হলো জানিস? হয়তো বা মনের ভুলই হবে, বাকি কাজের লোকজনকে দেখলাম মূর্তিটাকে এড়িয়ে চলতে। ইন ফ্যাক্ট বাড়ির লোকজনেরও দেখলাম, মূর্তিটার প্রতি একটা ভয় বা দূরে রাখার প্রবণতা আছে। পুরুতমশাই ছাড়া কেউ ছোঁয়নি ওটা। উনি এসে রাখলেন, আমিও তুলে নিয়ে এলাম। যখন নিয়ে আসছি, ঠাকুরমশাইকে দেখলাম বিড়বিড় করে কি একটা মন্ত্র পড়তে। কি জানি, নিয়ে আসার সময় একটু অস্বস্তিই হচ্ছিলো আমার, বুঝলি?”
দু মিনিট কি একটা ভাবলো অতীন, তারপর বললো “আসলে একটু বিটকেল দেখতে তো, তাই বোধহয়… গ্রামের দিকের লোকজন সব, এমনিতেই সুপারস্টিশনের ডিপো। তুই আমাকে দে তো। আমি নিয়েই যাই। পয়সাকড়ি না হয় তুই যা বলবি সেরকম দিয়ে দেবো’খন পরে, কেমন?”
হেসে ফেললো সুবেশ, “আরে তুই নিয়ে যা তো। তোর সঙ্গে কি টাকার সম্পর্ক নাকি রে আমার? যখন যা মনে হয় দিস। তবে সাবধানে রাখিস ভাই। আমারই একটু কেমন কেমন লাগে মূর্তিটার দিকে তাকালে।”
এবার অতীনও হেসে ফেলো, “এই বয়সে তোর কি ভীমরতি ধরলো সুবেশ, দিস ইজ জাস্ট আ স্ট্যাচু, ইয়ার।”
সুবেশ একটু সিরিয়াস হয়ে যায়, “তবুও, তুই একটু নিজের পুরুতঠাকুরকে দিয়ে দেখিয়ে নিস, বুঝলি? এই, জাস্ট মনে পড়ে গেলো একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা। ওদের ওই পূজারী ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক কিন্তু সাধারণ অং বং চং আওড়ানো পুরুত নয়। এটা আসার সময় আমার কাজিন রাজকমল বলেছিলো, উনি কিন্তু ওদিককার একজন বিশিষ্ট ইয়ে, বুঝলি? শুধু উনি কেন,ওনার বাপ, দাদা, মানে ফ্যামিলি ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ওনারা খুব বিখ্যাত ইয়ে।”
“আহ, ইয়েটা আবার কি?” অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে অতীন।
কাছে এসে, কাউন্টারের ওপর মুখ নামিয়ে খুব গোপন খবর দেবার ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলে সুবেশ, “তান্ত্রিক, ওনারা ওদিককার খুবই বিখ্যাত তান্ত্রিক, বুঝলি?”
*************************************
পরের দিন সকালে ভবেশবাবু অভ্যেসমতন এককাপ চা খেতে এসে ঘরের কোণে রাখা মূর্তিটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন, “এটা আবার কোত্থেকে জোটালে, অতীন?”
ভবেশ ভট্টাচার্য অতীনের বাবা অজয় মুখুজ্জের বাল্যবন্ধু, প্রায় ঘুনসি পরার সময়কার ইয়ারি, আর কি! সেই থেকে ভদ্রলোক অতীনের বাড়ির একজন হয়ে গেছেন। ইতিহাসের প্রফেসর ছিলেন, সদ্য রিটায়ার করেছেন। অকৃতদার, গোঁড়া ব্রাহ্মণ এই ভদ্রলোকের একমাত্র নেশা বই। অতীনের মা এঁকে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, দাদা বলে ডাকতেন ও মান্য করতেন। তবে এ বাড়িতে এঁর সবচেয়ে বড় পরিচিতি হচ্ছে যে ইনি অতীনের ঠাকুর্দা, বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আশুতোষ মুখার্জির প্রিয়তম শিষ্য। দরিদ্র উদ্বাস্তু পরিবারের এই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রটিকে আশুতোষবাবু প্রায় বুকে তুলে মানুষ করেছেন। শোনা যায় এককালে কিশোর ভবেশের খাওয়াপরার খরচাও আশুতোষবাবু নিজের পকেট থেকে দিতেন। ভবেশবাবু অবশ্য নিরাশ করেননি শিক্ষাগুরুকে, বিএ, এমএ, দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে এলাকার মুখোজ্জ্বল করেন। আধা খ্যাপাটে, আজীবন ব্যাচেলর এই ইতিহাসের প্রোফেসরটি এলাকাতে যুগপৎ ভীতি ও সম্মানের উদ্রেক করে থাকেন। তবে মুখুজ্জে পরিবারের প্রতি এঁর আজন্মলালিত টান আজও যায় নি। রোজ সকালে আসেন, এককাপ চা খান, অতীনের কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন, তারপর পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে বসেন। এঁর জন্যেই অতীনের মনে হয় মাথার ওপর একটা ছাদ এখনও যেতে যেতেও যায় নি।
ভবেশবাবু যখন প্রশ্নটা করেন, তখন অতীন স্নান করে এসে তোয়ালে দিয়ে মাথা ঘষছিলো। হাসিমুখে বলে, “মূর্তিটা ভালো না কাকু? সুবেশের দোকান থেকে কাল নিয়ে এলাম । আরে আমার ওই বন্ধু, যার কিউরিওর দোকান আছে। আপনি দেখেছেন ওকে বেশ কয়েকবার।”
ভবেশবাবু মূর্তিটাকে দেখছিলেন, চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন “কত পড়লো?”
অতীন হেসে ফেলে, “এখন এমনিতেই দিয়েছে, পরে পয়সা নেবে যদিও। কি করে ও মূর্তিটা পেলো সেটা কিন্তু একটা বেশ ইন্টারেস্টিং কিস্যা, শুনবেন নাকি?”
জবাবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন ভবেশবাবু। অতীনও বেশ গুছিয়ে পুরো ঘটনাটি বিবৃত করে।
ততক্ষণে চায়ের তলানিটুকু অবধি খেয়ে মূর্তির কাছে গিয়ে অত্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে হাঁটু গেড়ে বসেছেন ভবেশবাবু। খানিকক্ষণ বাদে উঠে এসে নিজের চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে তারপর বলেন, “দেখো অতীন, যতটুকু বুঝলাম, এই মুর্তি কোনও সাধারণ দেবীমূর্তি নয়। সম্ভবত ইনি কোনও তান্ত্রিক মতের দেবী। স্যার, মানে তোমার দাদু তন্ত্রমন্ত্র নিয়েও যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন, জানো নিশ্চয়ই। তোমার বাবা অবশ্য কমিউনিস্ট হয়ে গিয়ে এসব আর বিশ্বাস করতো না। স্যার আমাকেও কিছু কিছু শিখিয়েছেন, যদিও সেসব আমার বিশেষ মনে নেই, তবে…” বলে জানলা দিয়ে আকাশের দিয়ে চেয়ে একটু অন্যমনস্কই হয়ে গেলেন ভবেশবাবু। তারপর খেই ফিরে পেয়ে বললেন, “যদ্দূর মনে হচ্ছে, বুঝলে, এটা তিব্বতের জিনিস, থারটিন্থ সেঞ্চুরির বা আশেপাশের। তখন ভারতে ইসলামিক আক্রমণ শুরু হয়েছে, তার চাপে বৌদ্ধরা বেশ কোনঠাসা। বৌদ্ধ গুরুরা যাবতীয় পুঁথিপত্র নিয়ে পালালেন তিব্বতে। তিব্বতী বুদ্ধধর্ম, বা বজ্রযান শাখা নতুন ইন্ধন পেয়ে আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। এটা ওই সময়েরই, কারণ এর মধ্যে কিছু হিন্দু ইনফ্লুয়েন্স দেখতে পাচ্ছি। তার আগেকার বজ্রযানমূর্তিতে এত হিন্দু ইনফ্লুয়েন্স… উঁহু, এটা ওই থার্টিন্থ বা ফোর্টিন্থ সেঞ্চুরিরই জিনিস হে। কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সটা কি, সেটাই ধরতে পারছি না”, বেশ চিন্তিত দেখায় ভবেশ বাবুকে।
একটা টি শার্ট গলাতে গলাতে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে অতীন, “বজ্রযান বলতে?”
ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক দৃশ্যতই ভারি খুশি হয়ে ওঠেন, “বলি বুদ্ধধর্মের ইতিহাসটা মনে আছে তো? ফোর্থ সেঞ্চুরি বিসিতেই বৌদ্ধধর্ম দুটো ভাগ হয়ে গেলো, হীনযান অ্যান্ড মহাযান। অনেকে আবার এই হীনযান না বলে থেরবাদী বুদ্ধিজম বলেন, যদিও দুটো আলাদা, বুঝলে? তা বৌদ্ধধর্ম তো তারপর এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। যখন, ধরো থার্ড বা ফোর্থ সেঞ্চুরিতে বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে প্রবেশ করলো, তখন তার সঙ্গে স্থানীয় বঁ বা বন উপজাতির শামানিস্ট ধর্মগুরুদের সঙ্গে লাগলো লড়াই। এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, তরাই, উত্তর বিহার অ্যান্ড উত্তর বেঙ্গল, সিকিম, ইত্যাদি জায়গায় প্রচলিত বিভিন্ন তান্ত্রিক রিচুয়ালস আত্মীকরণ করে তিব্বতে মহাযানের নতুন রূপ হয়, নাম হয় বজ্রযান। এই বুদ্ধমত কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তান্ত্রিক বৌদ্ধমত। বিচিত্র সব দেবদেবীর পূজা, মুদ্রা মন্ত্র ও মণ্ডল নিয়ে নানা গোপন রিচুয়ালস, এই হলো এদের মুখ্য ধর্মাচরণ। বজ্র অর্থে কিন্তু এখানে ডায়ামণ্ড বা হীরে, ভাবার্থে ঈশ্বরপ্রাপ্তির পক্ষে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং শক্তপোক্ত যান বা বাহন। ওদের ভাষায় বলে দোরজে।
“বজ্রযান যাকে বলে সত্যিকারের স্টেট রিলিজিয়ন হয়ে ওঠে সিক্স ফিফটি নাগাদ, তিব্বতের তেত্রিশতম রাজা সং-শেন-গাম্পোর সময়ে, যিনি দুইজন বৌদ্ধ প্রিন্সেসকে বিয়ে করেন,একজন চায়নার, একজন নেপালের। এরপর আটশো সতেরো নাগাদ তিব্বতে আসেন তিব্বতীয় বুদ্ধিজমের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, গুরু পদ্মসম্ভব, ওরা বলে গুরু রিনপোচে। তান্ত্রিক বুদ্ধিজম নেভার হ্যাড টু লুক ব্যাক ফ্রম দেন। বাংলা আর বিহারে তখন পালরাজাদের আমল।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনছিলো অতীন। ভবেশবাবু থামলে বলে উঠলো “আর ইয়ে, অতীশ দীপঙ্কর বলে আরও কে একজনও যেন গেছিলেন না?”
মোটা চশমার ওপর দিয়ে ভবেশবাবু খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে অতীনকে নিরীক্ষণ করেন, তারপর রুমাল বের করে কপালের ঘাম মোছেন, “অতীশ দীপঙ্করকে ‘কে একজন’ বলছো অতীন? আমাদের বাঙালিদের দুর্ভাগ্য, আমরা পৃথিবীর খবর রেখে বিশ্বনাগরিক সাজতে ভালোবাসি, কিন্তু নিজেদের ইতিহাস জানি না। বা জানলেও বলতে লজ্জা পাই। বলি বাঙালিদের মধ্যে অমন মেধাসম্পন্ন, ধীশক্তির লোক খুব কমই জন্মেছেন, সেটা জানো কি? হ্যাঁ, উনিও তিব্বতে যান ধর্মপ্রচার করতে, খুব সম্ভবত হাজার বেয়াল্লিশ সাল নাগাদ।”
অতীন একটু মিইয়ে গেছিলো। ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে, “তা এর সঙ্গে এই মূর্তির সম্পর্ক?”
ভবেশবাবু একটু গম্ভীর হয়ে যান। “তান্ত্রিক বুদ্ধিজম বিশাল শাস্ত্র হে। উড্ডীয়ান, কামাখ্যা, শ্রীহট্ট অর্থাৎ সিলেট ও পূর্ণগিরি, এই পাঁচটি হচ্ছে তান্ত্রিক বুদ্ধিজমের সবচেয়ে রেসপেকটেড প্লেস। এই মতে তথাগত বুদ্ধের অবদান যতটা, ততটাই অবদান বাংলার তন্ত্রসাধনার ঐতিহ্যের। বাংলার মাতৃসাধনাকেন্দ্রিক তন্ত্রাচারে যেমন অনেক ভয়ানক ও শক্তিশালী দেবদেবীদের নাম শুনেছো, এখানেও একই কেস। এই মতে আদিবুদ্ধের পাঁচটি ধ্যানমূর্তি আছে, বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি এবং অক্ষোভ্য। এঁদের প্রত্যেকের আবার বিভিন্ন মন্ত্রপদ, মুদ্রা, বাহন এবং প্রতীকচিহ্ন আছে। আর বিভিন্ন মূর্তির জন্যে আছেন বিভিন্ন শক্তি, মানে দেবীরা। এঁদের অনেকেই খুব রাগী এবং ভয়ংকর। যেমন বজ্রবারাহী, হেরুক বা তাঁর বিভিন্ন রূপ যেমন বুদ্ধকপাল সম্বর, এছাড়া যমারি, বজ্রচর্চিকা, ইত্যদি।
খেয়াল করলে দেখা যায় হিন্দু তন্ত্রের সঙ্গে এই সব দেবদেবীদের কোথাও একটা যোগসূত্র আছেই। অনেক তন্ত্রের নামও একই, যেমন ধরো ভূতডামর। অনেক দেবদেবীদের নামও সেম, যেমন মহামায়া। কোনও কোনও জায়গায় নাম এক না হলেও মূর্তি এক, যেমন দেবী বজ্রযোগিনীর বর্ণনা এক্কেবারে দেবী ছিন্নমস্তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।”
এতটা বলে থেমে যান ভবেশ বাবু, তারপর উঠে দাঁড়ান, “কিন্তু এই মূর্তিটা স্পেশাল হে। কোন ক্যাটেগরিতে ফেলবো বুঝতে পারছি না। দাঁড়াও বাপু, একটু পড়াশোনা করে নিই। কোথায় যে এর রেফারেন্স পাবো…” বলতে বলতে দরজার দিকে এগিয়ে যান বৃদ্ধ প্রফেসর, “তদ্দিন আর বিশেষ নাড়াঘাঁটা করো না বাপু, কোথাও একটা ক্যাচ আছে, বুঝলে। অদ্ভুত দেবীমূর্তি, দোকানদার তোমাকে এমনিই দিয়ে দিলো, তাকে আবার পুরোনো জমিদারবাড়ির তান্ত্রিক পুরোহিত এমনিতেই দিয়েছে, না হে, কিছু তো একটা…”
সেদিন রাতেই অতীন স্বপ্নে দেখলো এক দেবীমূর্তি। অসাধারণ অপরূপা এক দেবী অতীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন “আমাকে এভাবে রেখো না অতীন। যখন ঘরে এনেছো, আমার পূজা করো। তোমার কল্যাণ হবে।”
পরপর তিনরাত ঠিক একই স্বপ্ন দেখলো অতীন।
Back to top button
error: Content is protected !!