rabindranath ekhane kokhono asen ni pdf part 1,2,3
অধ্যায় ১
“স্যার আপনি!”
নুরে ছফা যারপরনাই বিস্মিত। যে মেয়েটার সঙ্গে তার ধাক্কা লেগেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাবেক ডিবি অফিসার কেএস খান।
“ইয়ে মানে ”
সলজ্জ মুখে কেবল বিব্রতকর হাসিটা ধরে রেখেছে ভদ্রলােক। যেন লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে!
“আপনি ওঁকে চেনেন?” শাড়ি পরা তরুণী অবাক হয়ে বলল, একবার নুরে ছফা আর-একবার কেএস খানের দিকে তাকাল সে। ‘আপনেরে বলছিলাম না ছফার কথা?” বিব্রত হাসিটা ধরে রেখেই বলল মি.খান। “এই হইল সেই নুরে ছফা।”
ছেলে-ছােকরাদের মতাে টকটকে লাল রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর পায়ে চপ্পল পরে আছে কেএস খান—একেবারে পহেলা বৈশাখের সাজে!
“আর ইনি হইলেন ডাক্তার লুবনা,” মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল কেএসকে। মুখে বিব্রত হাসিটা যথাসম্ভব দূর করার চেষ্টা করছে সাবেক ডিবি অফিসার। নুরে ছফা তরুণীর দিকে তাকাল আবার। মেয়েটার বয়স বেশি হলে ত্রিশ-বত্রিশ হবে। তবে সে নিশ্চিত নয়। মেয়েদের বয়স ধরার বেলায় সে যথেষ্ট আনাড়ি। তার কাছে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের মেয়ে হল সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর। কেএস খানের সঙ্গী মেয়েটিও একই রকম বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
“সরি ”অবশেষে একটা ঢোক গিলে আস্তে করে বলল, “.ম্যাডাম।” মেয়েটাকে ম্যাডাম’ সম্বােধন করা নিয়ে একটু দ্বিধা ছিল মনে, তারপরও অনেকটা মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে, সম্ভবত কেএস খানের উপস্থিতির কারণে। “আমি আসলে খেয়াল করিনি।”
“ইটস ওকে,”মিষ্টিকরে হেসে বলল ডাক্তার লুবনা। নিজের বিরক্তি আর রাগ হজম করে ফেলেছে পুরােপুরি, মুখে এখন সৌজন্যের হাসি।
“নুরে ছফা হইলেন ডিবির সবচেয়া ব্রিলিয়ান্ট অফিসার অনেক কঠিন কেস
সলভ্ করছেন,”মেয়েটাকে বলল মি.খান।
ছফা অবাক হয়েই লক্ষ করল, এমন সুন্দরী তরুণীর সান্নিধ্যেও কেএস খান সাবলীল ভঙ্গিতে চলভাষায় কথা বলছে।
ডাক্তার লুবনা যেন একটু স্মৃতি হাতরে নিল। “হুম, মনে পড়েছে আপনি মিস্ট্রিয়াস লেডি মুশকান জুবেরির কেসটা সলভ্ করেছিলেন,” মেয়েটার চোখ এখন প্রশংসার অভিব্যক্তি।
কেএস খান হাসি হাসি মুখ করে সায় দিল।
“আপনার ওই কেসটার কথা শুনেছি মি.খানের কাছ থেকে,”এবার আন্তরিত দিয়ে ছফাকে বলল তরুণী।“খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল, একেবারে ভয়ংকর কোনাে সিনেমার মতােই।”
নুরে ছফা মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করল। কেসটা যে সে পুরােপুরি সলভ্্ করতে পারেনি সেটা আর বলল না। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা — মেয়েটার সঙ্গে এস খানের সম্পর্ক কী? ভাগ্নি? ভাতিজি?
বান্ধবী? “আমি ডাক্তার লুবনার রুগি,” যেন ছফার প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিল কেএস খান। কথাটা বলেই বােকার মতাে হাসল ভদ্রলােক। “আমার যে কন্ডিশন রেগুলার তার কাছে যাইতে হয়।”
“আমি অবশ্য ওঁকে রােগী হিসেবে দেখি না। আই থিঙ্ক উই আর ফ্রেন্ড,”বলল সেই লাস্যময়ী তরুণী।
ছফার ভুরু অনিচ্ছাকৃতভাবেই কপালে উঠে গেল। বান্ধবী?
কেএস খানের মুখে বােকা বােকা হাসি, আর সেটা ঝুলে রইল কয়েক মুহূর্তের জন্য। “ডাক্তার আমারে জোর কইরা নিয়া আসল এইখানে।” কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল
– অবশ্য লাল টকটকে পাঞ্জাবি আর চপ্পল দেখে ছফার মনে হচ্ছে না ‘জোর’ শব্দটা এখানে খাটে। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে চলে এসেছে মি.খান।
“তা, আপনের খবর কী, ছফা? অনেক দিন কোনাে খোঁজখবর নাই।”
প্রায় দু-মাস হল মি.খানের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ডিবির অন্য অফিসারদের মতাে কোনাে কেসে নাকানি চুবানি খেলেই সাবেক এই ইনভেস্টিগেটরের শরণাপন্ন হয় না ছফা। এলিভেটরের ভেতরে অদ্ভুত এক খুনের ঘটনা আর মুশকান জুবেরির কেসের বেলায় পরামর্শ, সাহায্য বাদ দিলে বিগত কয়েক বছরে মি.খানের কাছে কোনাে কেস নিয়ে যায়নি সে। তবে ডিপার্টমেন্টে ক্রিমিনােলজির ক্লাস নেবার সময় তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাত হয়। সেটাও দু-মাস ধরে বন্ধ আছে ছফার অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কারণে। ডিবি অফিস এখন মিন্টো রােড থেকে ইস্কাটনের নতুন একটি ভবনে
বর্ধিত করা
হয়েছে। পুরােনাে ভবনে কেএস খান এখনও ক্লাস নেয়।
“এই তাে, স্যার ”বলল সে।“একটু ব্যস্ত আছি কিছু কেস নিয়ে।” “বাসায় আইসেন, এক কাপ চা খায়া যায়েন। অনেক দিন আলাপ হয় না।” “আসব, স্যার।” “এই সপ্তাহে কোনাে ক্লাস নাই ফ্রি আছি। আপনে চইলা আইসেন।” “ঠিক আছে, স্যার।” ডাক্তার লুবনা হাতঘড়ি দেখল। “মঙ্গল শােভাযাত্রা শুরু হয়ে যাবে,” কেএস খানকে মৃদু তাড়া দেবার সুরে বলল সে।
বিব্রত হাসি দিল সাবেক ডিবি অফিসার।
ছফা যারপরনাই বিস্মিত।মি.খান এক সুন্দরী তরুণীকে বগলদাবা করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাবেন?
না। নিজেকে শুধরে দিল। মেয়েটাই কেএস খানকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে!
“ঠিক আছে, স্যার আমি যাই, পরে কথা হবে,”বলল ছফা। ডাক্তার লুবনার দিকে চেয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিল।
বিদায় নেবার সময়ও বিব্রত হাসিটা লেগে রইল কে এস খানের মুখে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারল, মি.খানকে মনে মনে হিংসাই করছে সে। ডিভাের্সি এই ভদ্রলােক নিশ্চয় মেয়েটার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল তার ভেতর থেকে। কোনাে এক অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত ছফার জীবনে সেভাবে কোনাে নারীর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কী কারণে সে নিজেও জানে না।
তার রুক্ষ ব্যবহার? কর্মজীবনের ব্যস্ততা? নাকি মানবীয় সম্পর্কের ব্যাপারে তার উদাসীনতা? —ছফা জানে না।
সংবিৎ ফিরে পেতেই নিজেকে আবিষ্কার করল রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে রমনার উদ্যান থেকে বের হয়ে শিশুপার্কের দিকে যে অস্তাচল নামে গেটটা আছে, সেখানে চলে এসেছে কখন টেরই পায়নি। এখান থেকে কোথায় যাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। বাড়ি ফিরে যাবে? সারাটা দিন নিজেকে বন্দি করে রাখবে ঘরে? নাকি লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসির মতাে বৈশাখের প্রথম দিনটি পথেঘাটে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘােরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেবে?
অবশেষে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্তই নিল। আর-একটু হেঁটে শাহবাগের মােড়ে গিয়ে রিকশা নেবার জন্য পা বাড়াল সে। পথেঘাটে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে খুব দ্রুত। আর-একটু পরই এই পথঘাট জনস্রোতে তলিয়ে যাবে। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে পথের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নানান রঙের ছটা।
নুরে ছফা মানুষজনের ভিড় এড়ানাের জন্য ফুটপাত থেকে পথে নেমে পড়ল।
জনসাধারণের সুবিধার্থে এই রাস্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে যানবাহন প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
রােদের উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য সানগ্লাসটা বের করে পরে নিল সে, সেই সঙ্গে একটা সিগারেটও বের করে নিল প্যাকেট থেকে। হাঁটতে হাঁটতেই লাইটার দিয়ে আগুন ধরাল। প্রচণ্ড রােদে উত্তপ্ত ধোঁয়া টেনে নিল বুকে।
শাহবাগের মােড়ে, পিজি হাসপাতালের সামনে এসে একটা রিক্সা পেয়ে উঠে বসল তাতে। বেতারভবনের সামনে দিয়ে এগােতে শুরু করল রিকশাওয়ালা। প্রচুর যানবাহনের কারণে রিকশার গতি শ্লথ। কিছু দূর যাবার পর একটা রিংটোন বেজে উঠলে অবাক হল সে। তার ফোন সব সময় সাইলেন্ট থাকে, আজকেও তা-ই আছে।রিকশাওয়ালা প্যাডেল। মারার গতি কমিয়ে দিয়ে কোমর থেকে সস্তা একটি চায়নিজ মােবাইলফোন বের করলে মুচকি হাসল ছফা। মােবাইলফোন নেই এমন লােকজন আর চোখে পড়ে না আজকাল। “মুক্তাররে কইবেন আমি সামনের হপ্তায় বাড়ি আইতাছি ওর সব ত্যাজ আমি পুটকি দিয়া ভইরা দিমু!” রেগেমেগে বলল রিকশাওয়ালা। তার প্যাডেল মারার গতি এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। গতি জড়তার কারণে রিকশাটা ঢিমেতালে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিরক্ত হয়ে রাস্তার ডান দিকে তাকাল ছফা। প্রচুর গাড়ি-বাস-রিকশা। পুরাে শহরের মানুষ যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে। পহেলা বৈশাখ মানেই ঘর থেকে বের হওয়া-তারপর রমনা-শাহবাগসহ শহরের কিছু জায়গায় সারাদিন টো টো করে বাড়ি ফেরা। এসব অল্প বয়সি ছেলেছােকরাদেরকে মানায়, বুড়ো খােকাখুকিরাও যােগ দেয়, কিন্তু ছফার কাছে এখন এটা একেবারেই হাস্যকর লাগে। মুচকি হেসে সিগারেটে জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে। রােদের উত্তাপ বেড়ে গেছে, টের পেল শরীর ঘামতে শুরু করেছে। সূর্যের আলাে থেকে চোখ বাঁচাতে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে যে-ই না ডান দিকে তাকাল অমনি কিছু একটা ধরা পড়ল তার চোখে।
তার রিকশার পাশেই একটি প্রাইভেট কার, গাড়ির কাচ স্বচ্ছ বলে স্পষ্ট দেখতে পেল পেছনের সিটে বসে থাকা একমাত্র যাত্রীকে।
আজকের দিনের অনেক মহিলা-তরুণীর মতােই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায়। বেলিফুলের মালা, কপালে লাল টিপ, গলায় একটি মাটির তৈরি হার—পহেলা বৈশাখের সাজে। তবে চোখে সানগ্লাস আছে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না ছফা। একটু ঝুঁকে তাকাল সে। তার রিকশা আর প্রাইভেটকারটি এখন পাশাপাশি আছে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ে গেছে বলে থেমে আছে সব যানবাহন।
একমাত্র যাত্রী সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছফাকে লক্ষ্যই করেনি। মুশকান জুবেরি। তার মতােই ফিরে যাচ্ছে রমনা থেকে? ছফা টের পেল তার সমস্ত রােমকুপ দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে কিছু করার আগেই গাড়িটা আস্তে করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এদিকে ছফার রিকশাওয়ালা পারিবারিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ নিয়ে উত্তেজিত, গালাগালি করে যাচ্ছে মােবাইলফোনে, গতি বাড়ানাের দিকে তার কোনাে খেয়াল নেই।ছফা তার পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিল। একবার মনে হল রিকশা থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা, কিন্তু গাড়িটা ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে।
যেন মরীচিকার মতাে ছিল পুরাে দৃশ্যটি-ধরা দিয়েই উধাও! রিকশাওয়ালাকে আবারও তাড়া দিলে আর-একটু জোরে প্যাডেল মারল কিন্তু হতাশ হয়ে ছফা দেখতে পেল, তার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে গাড়িটা।
আক্ষেপে চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল তার। গাড়িটা ধরতে পারেনি বলে নয়, বরং একটি মূল্যবান জিনিস খেয়াল করেনি!
অধ্যায় ২
টাইটা আলগা করে নিল আশেক মাহমুদ, ড্রাইভারকে বলল গাড়ির এসিটা বাড়িয়ে দিতে।
“জি, স্যার,”তার আদেশ পালন করার আগেই বলল ড্রাইভার।
আজকালতার প্রায় সব আদেশ-নির্দেশের বেলায়-ই এই আনুগত্যপূর্ণ জি স্যার’বলা হয়। এখন যে সিস্টেমের অংশ, সেখানে স্যার-ম্যাডাম-মাননীয় বলাটা অলঙ্ঘনীয় আচার। মুচকি হাসল আশেক মাহমুদ। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
ক্ষমতা!
এ কয় বছরে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ হিসেবে সে বুঝে গেছে, এটার উত্তাপ কতটা তীব্র হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব সে। চাইলে যে কোনাে মন্ত্রী-এমপিকেও মৃদু বকাঝকা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে। এই তাে, আজ বিকেলেই, অফিস থেকে বের হবার ঘণ্টাখানেক আগে বিরাট বড়ো এক শিল্পপতিকে যা-তা ভাষায় ভৎর্সনা করেছে। জঘন্য একটা আবদার করেছিল লােকটি। তার আদরের ভাগ্নে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর হাতেনাতে রক্তাক্ত বটিসহ গ্রেফতার হয়েছে। এখন চিফ মেট্রোপলিটন কোর্টকে একটু বলে দিলেই ভাগ্নেটা জামিন পেয়ে যাবে, কষ্টকরে আর জেল খাটতে হবে না। বিচার বিচারের মতাে চলুক, সেটা পরে দেখা যাবে। আশেক মাহমুদ যে নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, তা নয়। কোনাে তদবিরে যে সাড়া দেয় না সেটাও বলার উপায় নেই। এইকয়বছরে কেবল
ঢাকাতেই কিনেছে তিনটি ফ্ল্যাট, কানাডাতেও আছে ব্যাংক-ব্যালান্স
,এক-দেড়শাে কোটি টাকার কম হবে না। এসবই হয়েছে দেশের ধনিকশ্রেণির কাছ থেকে পাওয়া ‘উপহার’-এর বদান্যতায়। সে এমন একটি পদে আছে, যেখানে কিছু চাইতে হয় না, চাওয়ার আগেই প্রাপ্তি এসে বসে থাকে তার কোলে। কিন্তু হত্যা-ধর্ষণের মতাে ঘটনা থেকে লাভবান হবার কোনাে ইচ্ছে তার নেই। কী দরকার,মােটা অঙ্কের ট্রাঙ্কজাকশনের বিনিময়ে এসব কাজ করে বিবেকের দংশন ডেকে আনা ! তার মধ্যে এখনও এসব ব্যাপার-স্যাপার রয়ে গেছে। অত নীচে নামা সম্ভব হয়নি।
অভাবি একটা মেয়ে, যার তিনকুলে কেউ নেই, পেটের দায়ে শহরে এসে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করত, তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে আর সেটা করেছে বড়ােলােকের বখে যাওয়া এক কুলাঙ্গার। সেই কুলাঙ্গারের মামা যত বড়ো টাকার কুমির হােক না কেন, তার আবদারে সাড়া দেবে না।
হয়তাে তার এমন পণ করার কারণও আছে। সকালে একটা ফোন পাবার পর থেকে নিজের ভাগ্নের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার।নিরীহ আর ভদ্র একটা ছেলে, অথচ তাকেই কিনা বরণ করে নিতে হল নির্মম পরিণতি! তার মতাে ক্ষমতাবান মামা থাকতেও নিরাপরাধ ভাগ্নের অন্তর্ধান রহস্য বের করে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। আর এদিকে, এক শিল্পপতির লম্পট ভাগ্নে ধর্ষণ-খুন করেও পার পেয়ে যাবে টাকার জোরে!
যাই হােক, প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিল্পপতি মামা ক্ষমতায় গেলে মানুষ কীভাবে বদলে যায়’ বহুল ব্যবহৃত সেই আপ্তবাক্য ঝেড়ে দু-কথা শুনিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল টেলিফোনে। দুর্মুখ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি আছে এই লােকের। তার বিখ্যাত ব্যবহারের কথাও সবার জানা। কিন্তু আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার পিরামিডের একদম শীর্ষবিন্দুর কাছে। এরকম একজনকে তােয়াক্কা না করলেও সে পারে। লােকটার ইতিহাসও তার ভালাে করেই জানা আছে – গাঁ-গ্রামের এক বেয়াড়া যুবক, অতীষ্ঠ করে তুলেছিল গ্রামের লােকজনের জীবন। শেষে, গ্রামের মসজিদে বসা এক সালিশে জুতাপেটার মতাে অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হয় তাকে। ওই ঘটনার রাতেই, প্রতিশােধ হিসেবে মসজিদের দানবাক্স ভেঙে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে।
আজব এক শহর ঢাকা। হাজার হাজার গলি ঘুপচি এখানে-সবগুলাে দৃশ্যমান নয় সবার কাছে। কোনটা দিয়ে ঢুকলে টাকার খনির সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানা থাকলে এখানে বড়ােলােক হওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে সহজতম কাজ। পৃথিবীর আর কোথাও মসজিদের দানবাক্স চুরি করা পুঁজি দিয়ে কোনাে লােক মাত্র দশ বছরে শিল্পপতি হতে পেরেছে কিনা আশেক মাহমুদের জানা নেই।
যাইহােক, লােকটার অতীত নিয়ে তীর্যক কথা বলেই শুরু করেছিল সে। তারপর ঢাকা ক্লাবে জুয়া খেলা, মদের আড্ডায় বেসামাল হয়ে পড়া আর নিত্যনতুন নারীসঙ্গের কথাও বাদ দেয়নি। ফোনালাপটি শেষ করেছিল এই বলেঃ“আমি যতদিন আছি, আপনি কীভাবে পিএমের অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান দেখে নেব। দেখি, কী বালটা ফেলতে পারেন!”
বলাবাহুল্য, মসজিদের টাকা চুরি করা চোরটা আর কথা বাড়ায়নি। আশেক জানে, বদমাশটা এখন ভাগ্নেকে বাঁচানাের জন্য সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। ওই রাস্তাটাও সে বন্ধ করে দিয়েছে জায়গামতাে ফোন করে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। চোখের সামনে জন্ম নেওয়া নিজের ভাগ্নে হাসিবের কথা ভাবল। অফুরন্ত সম্ভাবনা ছিল ছেলেটার।চুপচাপ, শান্তশিষ্ট। কারও সাতে-পাঁচে নেই। ইউরােপ-আমেরিকায় বসবাস করার সুযােগ পেয়েও দেশে থেকে গেছিল কীসের টানে কে জানে! নিজের মতােই থাকত। স্বাবলম্বী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি ছেলে। ক্ষমতাবান মামার কাছেও কোনােদিন কিছু চায়নি, কোনাে তদবির নিয়ে আসেনি কখনও। এরকম ভদ্র আর নির্বিবাদি ছেলেরও যে শত্রু থাকতে পারে, কে জানত!
গাড়িটা গুলশান দুই নাম্বারে ঢুকতেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর পিএস। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরই বিব্রতপূর্ণ একটি প্রশ্নের মুখােমুখি হতে হবে তাকে।
অধ্যায় ৩
হাড্ডিসার বয়স্ক যে বৃদ্ধা বিছানায় শুয়ে আছে তার চোখে মৃত্যুর ছায়া সুস্পষ্ট।
পাশে বসে থাকা হাউজ নার্স মেয়েটি আরও একবার হাই তুলল। মেয়েলি – ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছে সে। সারা রাত জেগে থেকে এই রােগীর কষ্ট-যন্ত্রনা উপশম করার জন্য প্রয়ােজনীয় ওষুধপত্র দিতে হয় তাকে। মােবাইলফোন বের করে ফেসবুকে ঢু মারতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই। এই রােগী এটা বরদাস্ত করতে পারে না। কয়েক দিন আগে মহিলা ঘুমিয়ে পড়লে সে ফোন বের করে ফেসবুকে লগিং করতে গেছিল, তার অমনি চোখ খুলে ফেলে রােগী। দুর্বল গলায় কিন্তু কঠিন স্বরে বলে দেয়, তার সামনে যেন কখনও একাজ না করে। এমনকি, এ ঘটনার পর তাকে টিটকিরি মেরে ফেবুন্নেসা নামেও ডেকেছিল কয়েকটা দিন। সম্ভবত, অজানা কোনাে কারণে ফেসবুক জিনিসটা সহ্যই করতে পারে না বুড়ি। মহিলার ঘুম একদম পাতলা। এই পর্যায়ে এসে ঘুম বলে কিছু নেই আর তার মধ্যে। চোখে আই মাস্ক পরে নিথর দেহটা নিয়ে পড়ে থাকে, সম্ভবত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। একটু আগে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটানাের শব্দেও একবার নড়েচড়ে উঠেছিল তবে কিছু বলেনি, আবারও স্থির হয়ে গেছে। হঠাৎ পারফিউমের গন্ধ টের পেয়ে হাউজনার্স জেবুন্নেসা ফিরে তাকাল দরজার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগাজিনটা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। তার নিয়ােগকর্তা, এ বাড়ির মালিক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
“স্যার”
হাত তুলে মেয়েটাকে থামিয়ে দিল আশেক মাহমুদ, তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে এল বিছানার কাছে। “কখন ঘুমিয়েছে?” একেবারে ফিশফিশিয়ে জানতে চাইল সে। এ “এই তাে মেয়েটা নীচুকণ্ঠে জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেল।
“আমি ঘুমাইনি,”বৃদ্ধা বলে উঠল ঘরের দু-জনকে অবাক করে দিয়ে। “আমার কি আর ঘুম আসে!” চোখ থেকে আই-মাস্কটা কপালের উপর তুলে দিল রােগী। বােনের দিকে চেয়ে রইল আশেক মাহ
মুদ। তার ইচ্ছে করছে চোখ সরিয়ে ফেলতে, এককালের রূপবতি বড় বােনের এমন করুণ অবস্থা দেখতে চায় না।
“বুবু, কেমন আছ?” প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল ভুল হয়ে গেছে। মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে এ প্রশ্ন করা অনেকটা-তামাশার মতােই শােনায়।
এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল বৃদ্ধার মুখে। “এখনও মরিনি,” বেশ ক্ষীণ আর দুর্বল কণ্ঠে বলল। “তবে আজ সকালে মনে হচ্ছিল দুপুর পর্যন্ত দুনিয়ার আলাে দেখে যেতে পারব না।”
আশেক মাহমুদ চুপচাপ তার বােনের শিয়রে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। হাউজনার্স মেয়েটি বুঝতে পারছেনা তার এখন চলে যাওয়া উচিত কিনা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে।
“তুমি যাও,” বেশ মৃদু কণ্ঠে নার্সকে বলল রােগী। “রেস্ট নাও।” মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বােনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আশেক মাহমুদ। “খুব ব্যস্ত ছিলাম, বুবু। পিএম আজকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করেছেন.. .নইলে ”
‘বুঝেছি রে!” একটা নিশ্বাস ফেলে বলল বৃদ্ধা। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল দুপুরের পর আর… ” আশেক মাহমুদের বলতে ইচ্ছে করছিল— বুবু, এভাবে বােলাে না। কিন্তু কিছুই বলল না সে। বড়
বােনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পরম মমতায়। তার মনে পড়ে যাচ্ছে, ছেলেবেলায় ঠিক এভাবে তার বোন কতবারই না তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তার চেয়ে মাত্র দশ বছরের বড় এই বােন অকালে মাতৃহারা আশেককে সন্তানের মতাে কোলেপিঠে মানুষ করেছে। মায়ের সবটা আদর আর ভালােবাসা পেয়েছে এই বােনের কাছ থেকেই।
“আমি যে কোনাে সময় চলে যাবরে, আশেক!” বােনের এমন কথায় কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকল পি এস। “আমার মন বলছে কাল সকালটা দেখতে পারব না।”
আশেক মাহমুদের চোখ ছলছল করে উঠল। এরকম মুহূর্তে সান্ত্বনা দেওয়া, কিছু একটা বলে প্রবােধ দেওয়ার মতাে স্বভাব কোনাে কালেই তার ছিল না। জোর করে দিতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সে বরং এমন সময় চুপ করে থাকে। যদিও এ মুহূর্তে তার চোখদুটো অবাধ্য হয়ে উঠেছে, ঠেলেঠুলে বের হয়ে আসতে চাইছে অশ্রুজল।
“গতরাতে হাসিবকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে বলছিল, তুমি আসছ না কেন, মা? এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে!” _ পিএস নিশ্চুপ রইল। দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তার বুবু এরকম কথা বেশ কয়েকবার বলেছে। কানাডায় থাকার সময় যখন মারণব্যধি ক্যান্সার ধরা পড়ল তখন তার মাতৃসম বড়ােবােন সিদ্ধান্ত নিল নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বাকি সময়টা কাটাবে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে জন্মভূমিতেই। বােনকে কোনাে কিছু বলে সান্তনা দিতে পারছে না বলে নিজের কাছেই লজ্জিত আশেক। রাজনীতির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে এসব কায়দা-কানুন এখনও শিখতে পারল না, সেটা ভেবে অবাকই হয় সে।
“ভেবেছিলাম মৃত্যুর আগে হাসিবের কী হয়েছিল সেটা জেনে যেতে পারব,”
ক্যান্সারের রােগী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাকাল প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব।
“আমি জানি আমার ছেলেটা আর বেঁচে নেই,” কথাটা বলে উদাস হয়ে বললো, হাসিবের মা। “কিন্তু তার কী হয়েছিল? কে আমার এত বড়ো সর্বনাশ করল যেতে পারব না!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
এবার আশেকের কিছু বলার পালা কিন্তু গলার কাছে একটা গিট আটকে আছে “তুই আমাকে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারিরে, বুল্লা!”
ছােটোবেলার আদুরে ডাকটা অনেকদিন পর শুনতে পেয়ে আশেক মাহমুদ প্রবল আবেগে আক্রান্ত হল, ছলছল চোখে চেয়ে রইল বােনের দিকে। হাসিবের কী পরিণতি হয়েছে, কে তার জন্য দায়ী সেটা জানার পর পরই সে জানতে পারে তার বােনের শরীরে বাসা বেধেছে মারণব্যাধি ক্যান্সার। এমনিতেও খবরটা দিত কিনা সন্দেহ ছিল তার মনে, তবে ক্যান্সারের সংবাদ শােনার পর আর কোনাে দ্বিধা থাকেনি। পুরাে ব্যাপারটা চেপে যায় সে। তদন্ত হচ্ছে কিন্তু কোনাে কূলকিনারা করতে পারছেনা তদন্তকারী অফিসার এমন কথা বলে বােনকে প্রবােধ দিয়েছিল।
“আমার এই অবস্থায় হয়তাে খারাপ খবরটা জানাতে চাসনি,”আশেকের বুবু আস্তে করে বলল। “কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ধরেই নিয়েছি আমার হাসিব আর নেই।” একটু থেমে দম নিয়ে নিল মহিলা। “আমি শুধু জানতে চাই, আমার বুকটা কে খালি করেছে। কে এত বড়ো সর্বনাশ করল কেন করল!”
আশেক বােনের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে।তার বুবুর দুচোখের কোণ দিয়ে আস্তে করে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। দু-হাতে বােনের হাতটা ধরে নিজের গালে ঠেকাল সে।
“বিশ্বাস কর, বুল্লা তুই যা ভাবছিস আসলে ঘটনা সেরকম কিছু না।” কথাটার মানে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইল আশেক মাহমুদ। ঢোঁক গিলে কোনােমতে বলল সে, “কী বলছ, বুবু? কীসের ঘটনা?”
“এই যে হাসিবের খারাপ পরিণতির কথা জানতে পারলে আমি খুবই কষ্ট পাব।” মাথা দোলাল পিএস। – “এই কয়েক বছরে প্রতিটি মুহূর্তে মা হিসেবে আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা কোনাে কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কষ্ট পেতে পেতে আমি প্রায় অবশ হয়ে গেছি, নতুন করে আর কী কষ্ট পাব!” একটু দম নিয়ে নিল বৃদ্ধা। “আসলে কী, জানিস?” ছােটোভায়ের কাছ থেকে কোনাে জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল, “সত্যিটা না জেনে, অপরাধীকে শাস্তি পেতে না দেখে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতেই বরং ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”
আশেক একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল।মনে হচ্ছে বােনকে অন্তিম মুহুর্তে সবটা বলে দেওয়া ভালাে, মা হিসেবে এটা জানার অধিকার সে রাখে। আবার একইসঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, খবরটা জানতে পারলে এই শেষ সময়ে, ক্যান্সারের ছােবলে যখন যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছে তখন তার কষ্ট বাড়িয়ে দেবার কোনাে মানেহ হয় না।
কেমােথেরাপি দেবার কারণে সব চুল পড়ে গেছে। মাথায় পরে আছে একটা স্কার্ফ। এককালের সুন্দর ভ্রুজোড়া এখন প্রায় নেই বললেই চলে। হাড্ডিসার হাতটায় কোনাে শক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও হঠাৎই আবিষ্কার করল, দুর্বল হাতটা আলতাে করে চেপে ধরার চেষ্টা করছে। হয়তাে তাগিদ দিচ্ছে তাকে, অনুনয় করছে!
“বু,” অবশেষে বলতে পারল আশেক মাহমুদ। “হাসিব নিখোঁজ হবার পর যখন পুলিশ কিছু বের করতে পারল না তারপরই আমি ডিবির এক ইনভেস্টিগেটরকে দিয়ে কেসটা তদন্ত করিয়েছিলাম।”
তার বুবু স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল, সবটা শােনার জন্য উন্মুখ সে।
“খুবই মেধাবি ইনভেস্টিগেটর সে,”একটু থেমে ঢোঁক গিলল।“ওই অফিসার আপ্রাণ চেষ্টা করে খুব দ্রুত বের করতে পেরেছিল হাসিব কোথায় গিয়ে উধাও হয়েছিল।”
আশেক মাহমুদ টের পেল তার বুবুর হাত আরও শক্ত করে ধরে আছে তার হাতটা, দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
“ঢাকা থেকে সুন্দরপুর নামের এক মফস্সল শহরে গেছিল হাসিব,”কথাটা বলে চুপ মেরে গেল আশেক। “কেন?”উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল তার শয্যাশায়ী বােন।“ওখানে কেন গিয়েছিল হাসিব ?!”
“একজনের সঙ্গে দেখা করতে।” “কার সঙ্গে?”
“এক মহিলার সঙ্গে।”
“মহিলা ?!”
বিস্মিত হল ক্যান্সারের রােগী। মাথা নেড়ে সায় দিল আশেক মাহমুদ। “রহস্যময়ী এক মহিলা। খুবই ভালাে একজন কুক অসাধারণ সব খাবার নাকি রান্না করত।”
“একজন কুকের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল হাসিব!”অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইল আশেকের বুবু। যে দুচোখে মৃত্যুর স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে, তাতে এখন অপার বিস্ময়। “মহিলা ওখানে একটি বারের রেস্টুরেন্ট দিয়েছিল খুবই সুস্বাদু খাবার পাওয়া যেত হাসিব ওখানেই গেছিল শেষবার। শুধু এটুকুই জানা গেছে।”
“তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস।ঠিক করে বল ওই মহিলার সঙ্গে হাসিব কেন দেখা করতে গেছিল? খাওয়ার জন্য নিশ্চয় সে যায়নি? আর যদি খেতেই গিয়ে থাকে তাহলে ফিরে এল না কেন!”
আশেক মাহমুদ আলতাে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।“আসল সত্যটা ওই অফিসারও বের করতে পারেনি, তবে তার ধারণা, হাসিবের সঙ্গে ওই মহিলার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে, তাদের মধ্যে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়েছিল।”
ফেসবুকের কথা শুনে তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠল হাসিবের মায়ের। এই ফালতু জিনিসটা মানুষকে মানুষের কাছে এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু কাজ করে তার ঠিক উলটোটা।
কাছের মানুষদের দূরে সরিয়ে, দূরের মানুষকে কাছে এনে মিথ্যে এক জগৎ আর দিন দিন সেই জগতে বন্দি হয়ে পড়ছে মানুষজন। কানাডায় যখন মেয়ে দেখেছে, তার টিনএজার নাতি-নাতনিরা সারাদিন ডুবে থাকে এই ফেসবুক খোঁজ নেবারও সময় পেত না। কিন্তু যেদিন অসুস্থ নানির সঙ্গে সেলফি তুলে নাতি-নাতনিরা ফেসবুকে পােস্ট দিল ‘প্রে ফর মাই গ্র্যান্ডমাদার, সেদিনই আর্জুমান্দ যে বুঝে গেছিল, পৃথিবীটা আসলেই রসাতলে তলিয়ে গেছে। গভীর করে দম নিয়ে বলল বৃদ্ধা, “ঠিক আছে, হাসিব ওই মহিলার সঙ্গে দেখা গেছিল..এর সঙ্গে তার নিখোঁজের কী সম্পর্ক? কী এমন ঘটনা ঘটেছে ওখানে সে আর ফিরে এল না?”
বুবুর দিকে চেয়ে রইল আশেক মাহমুদ। তারপরই মিথ্যেটা বলল, “সেটা তাে জানা যায়নি, তবে ওই অফিসার মনে করছে, মহিলা কোনাে চক্রের সঙ্গে জড়িত।”
“কীসের চক্র?”
বলতে একটু ইতস্তত করল আশেক। “মহিলা এক সময় ডাক্তার ছিল, বুবু। পরে কোনাে এক কারণে চাকরি ছেড়ে দেয়।বয়সে বড়ো, এক ধনী লােককে বিয়ে করে অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে যায় সে। ওই লােকের পূর্বপুরুষেরা সুন্দরপুর নামে এক এলাকার জমিদার ছিল।” “কিন্তু ওই মহিলা কেন হাসিবকে ” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। “কারণ কী? কীসের জন্য সে এটা করল? টাকার জন্য নিশ্চয় এ কাজ করেনি সে?” মাথা দুলিয়ে জবাব দিল আশেক মাহমুদ। “জানি না, বুবু।” বােনের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে। যদিও নুরে ছফা তাকে বলেছিল, মহিলা সম্ভাব্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারী দলের সদস্য কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী বােনকে সে কথা বলা মানেই স্বাভাবিকভাবে তার মনে কিছু ভয়ংকর দৃশ্যকল্প
উস্কে দেওয়া। বিভৎস সেই দৃশ্য। এমন নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে, নিজের সন্তানকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাবা নিশ্চয় সুখকর হবে না। কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেল, তারপর সেই অসহ্য নীরবতা ভাঙল আশেক মাহমুদ নিজেই। “রহস্যময়ী এক নারী। পেশায় ডাক্তার।” আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল পিএস, “আসল নাম মুশকান সােহেলি, বিয়ের পর হয়ে যায় মুশকান জুবেরি। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকলেও এক সময় দেশে চলে আসে, ঢাকার এক হাসপাতালে চাকরি নেয়। ওই ইনভেস্টিগেটর আমাকে শুধু এটুকুইজানাতে পেরেছে, বুবু।” পরক্ষণেই পিএস টের পেল তার বােনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে তার হাত। অবাক হয়ে
ফিরে তাকাল বােনের দিকে। – আর্জুমান্দ বেগমের নিষ্প্রাণ চোখের মণিদুটো শুধু জ্বল জ্বলই করছে না, দুটো বিন্দু যেন অস্থির হয়ে লাফাচ্ছে শুন্যে! রাগে না ক্ষোভে, বুঝতে পারল না।
রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে কঙ্কালসার হাতটি।