rabindranath ekhane kokhono asen ni pdf part 4, 5, 6 to 20

অধ্যায় ৪

আইনপ্রয়ােগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করে গেলেও কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢােকার সৌভাগ্য হয়নি নুরে ছফার।  ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রভূমি এই অফিসটির ছােটোখাটো কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই কমবেশি ক্ষমতার দম্ভ আর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাবান হল প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের পদটি। এটা পেতে মারাত্মক রকমের লবিং করা হয়, মরিয়া হয়ে ওঠে শাসকদলের ভেতরে নানান গােষ্ঠী আর চক্র। যারা এখানে কাজ করার সুযােগ পায় তারা ধরেই নেয়, এটাই তাদের সারা জীবনের সবচাইতে বড়ো সাফল্য—বিশেষ করে ক্ষমতা আর অর্থোপার্জনকেই জীবনের সবচাইতে বড়ো সফলতা হিসেবে গণ্য করে যারা
।  এ মুহূর্তে নুরে ছফা বসে আছে এরকমই একজন সফল মানুষ, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের অফিসে। ভদ্রলােক কী একটা কাজে ব্যস্ত আছেন। একজন আরদালি এসে তাকে এক কাপ চা দিয়ে বলে গেছে, আর-একটু অপেক্ষা করতে হবে, একটু পরই চলে আসবেন পিএস।

ছফা যথেষ্ট অবাক হয়েছে আজকের এই কলটির জন্য। এর আগে, সুন্দরপুর থেকে যখন মুশকান জুবেরিকে ধরতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল তখন প্রথমবারের মতাে প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গে দেখা করেছিল তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। ভদ্রলােক তার মুখ থেকেই জানতে চেয়েছিল তদন্তের কী অবস্থা।

হাসিব নামের এক নিখোঁজ ছেলের মামা, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব কেসটার তদন্ত করতে বলেছিল ডিবিকে-নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিল, নুরে ছফা যেন কেসটা দেখে। ফলে ওখান থেকে ফিরে আসার পর তার কাছ থেকেই সবটা শুনতে চেয়েছিল ভদ্রলােক। তবে ছফা পুরােঘটনাটা বলেনি। সব কিছু বিবেচনায় নিলে, এটা কাউকে বলাও সম্ভব ছিল না। তাই সে বলেছিল, নিখোঁজ হাসিবের শেষ গন্তব্যস্থল ছিল ঢাকা থেকে বহু দূরে, সুন্দরপুরে অদ্ভুত নামের একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের মালিক মুশকান জুবেরি নামের রহস্যময়ী এক মহিলা। ছফা তদন্ত করে দেখেছে, ফেসবুকে এই মহিলার সঙ্গে হাসিবের পরিচয় হয়েছিল।

তাহলে ওখানে যাবার পর হাসিব কেন নিখোঁজ হল ?

এমন প্রশ্নের জবাবে ছফা তাকে জানায়, এ ব্যাপারে সে নিশিচত নয় তাই জোর কিছু বলতে পারছে না। তার কাছে শক্ত কোনাে প্রমাণও নেই, হাসিব নামের ছেলেটি কি ভাগ্য বরণ করেছিল তবে মুশকান জুবেরির ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে জানা গেছে  সে আমেরিকায় ছিল। পেশায় একজন ডাক্তার। তখন অবশ্য নাম ছিল মুশকান অনেকদিন আমেরিকায় থাকার পর দেশে চলে আসে। ঢাকার একটি প্রাইভেট
হাসপাতালে কাজও করেছে বেশ কিছু দিন। তারপর হুট করেই সেই চাকরি ছেড়ে দেয়। গুজব অনৈতিক কাজের সঙ্গে মহিলা জড়িত ছিল। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুনাম বজায় রাখার জন্য পুরাে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়, তাই সত্যিটা বের করা সম্ভব নয়।

যাই হােক, ওই হাসপাতালে কাজ করার সময়ই ক্যান্সারে আক্রান্ত এক রােগীকে বিয়ে করে মহিলা। পঞ্চাশাের্ধ রাশেদ জুবেরি ছিল উত্তরাঞ্চলের এক জমিদারের একমাত্র বংশধর। ওখানকার বিপুল পরিমাণের স্থাবর সম্পত্তির মালিক ছিল সে।এভাবে ভদ্রলােকের বিপুল সম্পত্তি করায়ত্ত করে নেয় মহিলা। পেশায় ডাক্তার হলেও মুশকান নামের ওই মহিলার ঝোঁক ছিল রান্নাবান্নার দিকে। অসাধারণ একজন কুক। মি.জুবেরি ক্যান্সারে মারা গেলে সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের অদ্ভুত একটি রেস্টুরেন্ট খােলে সে। তার খাবারের অসাধারণ স্বাদের কারণে ক্রমেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ছুটে যেতে শুরু করে ওখানে। ফলে, মফস্বল শহর হলেও ওই রেস্টুরেন্টের সুবাদে ভােজন রসিকদের কাছে সুন্দরপুর হয়ে ওঠে তীর্থস্থানে।  কিন্তু হাসিবের সঙ্গে মহিলার কী সম্পর্ক ছিল? প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ অধৈর্য হয়ে জানতে চেয়েছিল ছফার কাছে।  সে জানিয়েছিল, সম্ভবত ওই মহিলার সঙ্গে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল হাসিবের। মহিলা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

ঠিক আছে, সুন্দরপুরের এক রহস্যময়ী, সুন্দরী, গুণবতী মহিলার সঙ্গে ফেসবুকে হাসিবের ঘনিষ্ঠতা হল, তারপর একদিন সেখানে গেল মহিলার সঙ্গে দেখা করতে-কিন্তু ওখানে যাবার পর কী এমন ঘটনা ঘটল যে, সে নিখোঁজ হয়ে গেল? তার আসলে কী হয়েছিল?

আশেক মাহমুদের কাছ থেকে এমন যৌক্তিক প্রশ্ন যে আসবে সেটা আগে থেকেই জানত নুরে ছফা।জবাবটাও সে প্রস্তুত করে রেখেছিল। সে জানায়, খোঁজ নিয়ে জেনেছে, শুধু হাসিবই নয়, এই মুশকান জুবেরি আরও তিন-চারজনকে এভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে সখ্য তৈরি করে সুন্দরপুরে নিয়ে গেছে  তাদের কারােরই আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি।

অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল আশেক মাহমুদ-কেন? দুফা তখন আর-একটি মিথ্যে বলে-তাবশ্য এটা সত্যের অনেক কাছাকাছিঃ তার ধারণা মুশকান জুবেরি অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতাে, তবে পার্থক্য হল, সে ভিক্টিমের অর্গানও কালেক্ট করে!

একথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল পিএস। ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল তার চোখমুখ। ছফা আরও জানায়, স্থানীয় পুলিশ-এমপির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে মহিলাকে ধরা কঠিন ছিল তার পক্ষে। তারপরও সে যখন মুশকান জুবেরিকে তার বাড়িতে গিয়ে হাসিবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে, তখন মহিলা তার লােকজন দিয়ে ছফাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ওরা তার অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। ওই বাড়ির একটি ঘরে তাকে বন্দি করে রেখে পুরাে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় সেই মহিলা। কিন্তু ভাগ্য ভালাে, অল্পের জন্য প্রাণে বেচে গেছে, সেজন্যে সুন্দরপুর থানার ওসি আর ওখানকার এসপি-র কাছে সে কৃতজ্ঞ। তারা সঠিক সময়ে না এলে মারাই যেত।

ছফাকে এরকম গল্প বলতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। কারণ, তার কাছে এমন কোনাে প্রমাণ নেই যে, সে বলবে মুশকান জুবেরি মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ ভক্ষণ করে নিজের যৌবন দীর্ঘায়িত করে। নির্দিষ্ট সময় পর পর তাকে সেই অঙ্গটি খেতে হয়। এটাতে আসক্ত হয়ে পড়েছে মহিলা। হাসিবসহ আরও কয়েকজন নিখোঁজের ভাগ্যে এমন পরিণতিই ঘটেছে –তারা সবাই মুশকান জুবেরির শিকার। এ কথা শুনে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করবে। ভাববে, তদন্তে ব্যর্থ হয়ে, আসামিকে ধরতে না পেরে এমন গালগল্প ফাঁদছে সে। তারচেয়েও বড়ো কথা, আইনপ্রয়ােগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে, পুরােপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনাে ভিক্টিমের পরিণতি নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা যায় না। মুশকানকে যদি ধরতে পারত, তার কাছ থেকে জবানবন্দি আদায় করে নিতে পারত তাহলে নিশ্চিত করে সেটা বলা যেত। অন্যের জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে এরকম কোনাে ধারণা করা ঠিক হবে না।

ছফার কাছে একমাত্র যে প্রমাণটি ছিল সেটা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের স্বীকারােক্তি। সেটাও আবার সরাসরি নুরে ছফার কাছে স্বীকার করেননি তিনি, করেছিলেন ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খানের কাছে। সেই ডাক্তারও ঘটনার পর পর দেশ ছেড়েছেন। ছফা একবার ভেবেছিল, নিছক সন্দেহ হিসেবেই কথাটা বলবে কিনা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবকে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, ভিক্টিমের নিকটাত্মীয় হিসেবে কথাটা শুনে কী রকম অনুভূতি হতে পারে ভদ্রলােকের।

অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরি আমেরিকার কোথায় ছিল সেটা বের করতে সক্ষম হয়নি নুরে ছফা।তাছাড়া, আন্দিজের ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে হাতেগােণা যে কয়জন জীবিত আছে এখনও তাদের খোঁজ করাটাও সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এদের বেশির ভাগই বয়সের কারণে মারা গেছে। হাতেগােনা যে কয়জন বেঁচে আছে তারা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের নাগরিক। বর্তমানে কে কোথায় আছে কেউ জানে না।তারপরও কাকতালীয়ভাবে একজনকে পেয়ে গেছিল ফেসবুকে, কিন্তু ভদ্রলোক আলঝেইমার রােগে আক্রান্ত। অত আগের ঘটনা তাে দূরের কথা, সকালে নাস্তা করে কিনা সেটাই ভুলে বসে থাকে!  আন্দিজের প্লেন ক্রাশে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের নিয়ে পিয়ার্স পল রিড যে
বই লিখেছেন – অ্যালাইভ : দ্য স্টোরি অব দি আন্দিজ সারভাইভার্স – সেটাকে সব হিসেবে ধরেও কিছুটা খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু ভদ্রলােক ছফার মেইলের জবাবে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে যারা নিজেদের পরিচয় গােপন রাখতে চেয়েছে তাদের ব্যাপারে তিনি কোনাে রকম তথ্য দিতে পারবেন না।

“কী ব্যাপার, চা খেলেন না যে?” নম্রভদ্র কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ একটি কণ্ঠ শুনে ছফা সংবিৎ ফিরে পেল। তাকিয়ে দেখল প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব ঘরে ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে সালাম দিল সে।

ভদ্রলােক নিজের ডেস্কে বসে ছফাকেও বসার জন্য ইশারা করল। “আপনি বােধহয় একটু আগে চলে এসেছেন?”

“জি, স্যার,”বলল নুরে ছফা।“জ্যামের কারণে দেরি হতে পারে বলে একটু আগেভাগে রওনা দিয়েছিলাম, পরে দেখলাম আজকে তেমন একটা জ্যাম নেই।”

“পিএম অফিস শেষ করলেন একটু আগে,”কথাটা এমনভাবে বলল আশেক মাহমুদ, যেন জবাবদিহির মতাে না শােনায়।

ছফা কোনাে কিছু না বলে চুপ করে রইল। “কাজকর্ম কেমন চলছে?” “জি সব ভালােই।”

“ওই কেসটার আর কোনাে ডেভেলপমেন্ট হয়নি বােধহয়, তাই না?”

গভীর করে দম নিয়ে নিল ছফা। ব্যর্থতার কথা বলতে তার কখনও ভালাে লাগে না, জঘন্য রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। আর ক্ষমতাবানদের সামনে ব্যর্থতার কথা বললে নিজেকে কেমন তুচ্ছ, অপাংক্তেয় মনে হয় তার।  “কিন্তু কদিন আগে, পহেলা বৈশাখে সম্ভবত এক ঝলক দেখেছিলাম তাকে।”কথাটা বলার কোনাে ইচ্ছে না থাকলেও শেষ পর্যন্ত বলে দিল ছফা। নিজেকে পুরােপুরি ব্যর্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাইল না। সে যে এই কেসটা নিয়ে এখনও কতটা মগ্ন হয়ে আছে, কতটা মরিয়া, এই ক্ষমতাবান মানুষটি জানে না, তাকে জানানাে দরকার।

বিস্ময়ে ভুরু কপালে উঠে গেল আশেক মাহমুদের। “আপনি তাকে দেখেছেন!?”

মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা।“শাহবাগের দিকে আমি তখন রিক্সায় ছিলাম..মহিলা একটা প্রাইভেটকারে ছিল।”

“তারপর?” উৎসুক হয়ে উঠল পিএস। “আমি রিক্সায় ছিলাম বলে গাড়িটা ধরতে পারিনি।”

পিএস এখনও উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাটা শোনার জন্য।গাড়িটির নাম্বারটা টুকে রাখতে পারিনি উত্তেজনার চোটে।”দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশেক মাহমুদ। আরেকবার আশ্বস্ত করার মতাে সংবাদ শুনতে না পেয়ে হতাশই হল। “যাই হােক, আপনি তাে এতােদিনেও ওই মহিলার কোনাে ছবি জোগাড় করতে পারেননি?”

মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হল নুরে ছফা। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি-মুশকান বেরির কোনাে ছবি সে জোগাড় করতে পারেনি। যে হাসপাতালে সে কাজ করত সেখানকার এমপ্লয়ি ফাইল থেকে সব কিছু গায়েব হয়ে যায় মহিলার অন্তর্ধানের পর পর। আর এ কাজটা যে মহিলার ডাক্তার বন্ধু এবং সহকর্মী আসকার ইবনে সায়িদ করেছেন সে-ব্যাপারে তার মনে কোনাে সন্দেহ নেই।

“আমি তার ছবি জোগাড় করার অনেক চেষ্টা করেছি,” ছফা বলল। “কিন্তু মহিলা অনেক চতুর, সবখান থেকে নিজের ছবি সরিয়ে ফেলেছে। ছবি থাকলে কাজটা সহজ হত অনেক।”

“হুম,”গম্ভীর হয়ে মাথা দোলাল একান্ত সচিব। “এ-ব্যাপারে আমার মনেও কোনো সন্দেহ নেই।”কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে।“আপনি বলেছিলেন মহিলা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়  সুন্দরী  যে কোনাে পুরুষকে কাবু করার মতাে?”

“জি, স্যার।” মাথা নেড়ে সায় দিল পিএস। তারপর ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা এনভেলপ বের করে বাড়িয়ে দিল ছফার দিকে। “এটা দেখুন।”

একটু অবাক হয়েই ছফা এনভেলপটা হাতে নিল, খুলে দেখতেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেল সে। অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে গেল তার।

ছয় বাই দশ হবে। বেশ পুরােনাে হলেও ছবিটা সাদাকালাে নয়— রঙিন। সেই রং লালচে হয়ে গেছে।  “চিনতে পেরেছেন?”

আশেক মাহমুদের দিকে পলকহীন চোখে তাকাল নুরে ছফা। “এ-এটা তাে ”ঢোক গিলল সে।“মুশকান জুবেরি !”

“মুশকান সােহেলি!”দাঁতে দাঁত পিষে বলল পিএস। “এটাই তার আসল নাম।”

ছফা স্থির চোখে চেয়ে রইল কেবল।

এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে বলল আশেক মাহমুদ, “মাই গড! তাহলে বুবুর কথাই ঠিক!”


অধ্যায় ৫

দুনিয়াটা আসলেই ছােটো!

আশেক মাহমুদ মনে মনে বলল। নুরে ছফার হতভম্ব মুখটা দেখতে তার ভালো লাগছে।

ছফার ডানহাতে বহুকাল আগের রঙিন ছবিটি, সেই ছবি থেকে তার চোখ সরছে না। অবিশ্বাসে তার কপালে পড়েছে ঘন ভাঁজ। চোখদুটো প্রায় স্থির, পলক পড়ছে বেশ ধীর গতিতে।

“ওই মহিলা আমেরিকায় থাকার সময় তােলা ছবি  কমপক্ষে চল্লিশ-
পাঁচচল্লিশ বছর আগেকার ছবি।”

ছফা বুঝতে পারল সে বিপদে পড়ে গেছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হতে লাগল তার। দ্রুত খেলা করে গেল কিছু ভাবনা। মুখ তুলে তাকাল সে। প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মুখে বিজয়ীর হাসি।

“এ ছবি আপনি কোত্থেকে পেলেন, স্যার?”

“অনেক লম্বা গল্প,” বলল আশেক মাহমুদ। “তার আগে বলুন, আপনি এই মহিলা সম্পর্কে আর কী জানেন?”  ছফা নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করল। দ্রুত ভাবল পরবর্তী কথাগুলাে নিয়ে। সত্যিটা তাকে বিপদে ফেলে দেবে। আর মিথ্যেটা? সে জানে না। তার সামনে যে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বসে আছে সে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে কতটুকু জানে, তার কোনাে ধারণাই নেই। এই ছবিটাই বা কোত্থেকে জোগাড় করেছে তা-ও বুঝতে পারছে না।

নুরে ছফার আর-একটু সময় দরকার-কী বলবে সেটা গুছিয়ে নেবার জন্য। “আমি এই কেসটা তদন্ত করতে গিয়ে যতটুকু জেনেছি সবটাই আপনাকে বলেছি।” অবশেষে নিজের বক্তব্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্তই নিল সে। কোনাে কিছু না-জানাটা দোষের হতে পারে কিন্তু অন্যায় নয়। তবে জেনে বুঝে কোনাে কিছু লুকোনােটা ভীষণ অন্যায়-ছফা অবশেষে দুটোর মধ্যে প্রথমটাই বেছে নিল।

“তাহলে আমি বলব আপনি আসলে কিছুই জানেন না,”আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিল আশেক মাহমুদ।

হাফ ছেড়ে বাঁচল ছফা। ক্ষমতাধর মানুষেরা তাদের নীচের দিকে থাকা মানুষ

অযােগ্যতা আর  অক্ষমতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারলে এক ধরনের তৃপ্তির
ঢেকুর তােলে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব এখন সেই ঢেকুর তুলছে।

“আপনার এই মুশকান জুবেরি-মানে, ডাক্তার মুশকান সােহেলি কোনো অর্গ্যান পাচারকারী কিংবা সিরিয়াল কিলার নয়,” ঘােষণা দেবার ভঙ্গিতে বলল আশেক মাহমুদ। অবশ্য আপনার ধারণা পুরােপুরি মিথ্যেও নয়।” ক্ষমতাধর লােকটি বাঁকা হাসি দিল। “তার কর্মকাণ্ড অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতােই।”

ছফা আর-একটু আশার আলাে দেখতে পেল। উৎসুক হবার ভান করল সে। “আপনি তাে তিন বছর আগে তাকে দেখেছেন, তখন তার বয়স কত ছিল?”

একটু ভেবে নিল নুরে ছফা। তিন বছর আগে কী বলেছিল মনে করার চেষ্টা করল। মিথ্যে বলতে গেলে যে তুখােড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে হয় সেটা আর-একবার টের পেল হাড়ে হাড়ে। “উমম  ত্রিশ-বত্রিশের মতাে হবে?”

আশেক মাহমুদের ভুরু কপালে উঠে গেল। “তাহলে আপনি অবাক হচ্ছেন না কেন?”  “মানে?”ছফা হুট করেই বলে ফেলল। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকে
ভর্ৎসনা করল সে। ধ্যাত! এটা তার আগেই বােঝা উচিত ছিল।

“জি, স্যার. মহিলার মধ্যে তাে কোনাে পরিবর্তনই দেখছি না?” একেবারে নির্দোষ ভঙ্গিতে অবাক হবার ভান করে বলল। “আমি তাকে তিন বছর আগে এরকমই দেখেছি অথচ এই ছবিটা বেশ পুরােনাে!”

“পঁচাত্তর সালের দিকে তােলা,” আশেক মাহমুদ জানাল তাকে। “প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগেকার  ভাবতে পারেন ?!”

ছফা চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব আনার চেষ্টা করল। এই প্রথম অভিনেতাদেরকে ঈর্ষা করল মনেমনে। এর আগে তাদেরকে জোকার বলেই করুণা করত। “মাই গড!”বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ানাের জন্য ইংরেজিতে বলল এবার।“এটা কী করে সম্ভব!?”

বাঁকা হাসি দিল আশেক মাহমুদ। “অবিশ্বাস্য ঘটনা  বুঝলেন? কিন্তু এটাই ঘটেছে।” মাথা দোলাল নুরে ছফা। তার বিশ্বাস হচ্ছে না-এমন একটা ভঙ্গি করার চেষ্টা করল। “বলেন কী, স্যার!”

“হুম,”আশেক মাহমুদ ডান হাতটা ডেস্কের উপরে রেখে তর্জনি দিয়ে টোকা দিতে শুরু করল।“এখন আমি যেটা বলব সেটা আপনি বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।”

আমাকে আর নতুন করে কী অবিশ্বাস্য গল্প শােনাবেন? মনে মনে বলল সে, কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি একেবারেই ভিন্ন। “কী, স্যার?”

“বলব, তার আগে এক কাপ চা-কফি হয়ে যাক।”আশেক মাহমুদ ইন্টারকমটা তুলে নিল। “আপনি কী চা নেবেন নাকি কফি?”

সামনে থাকা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে চট করে তাকিয়ে বলল নুরে ছফা, “কফি।”

অধ্যায় ৬

নূরে ছফার চোখেমখে সত্যিকারের বিস্ময়ই ফুটে উঠেছে হাসিবের ক্ষমতাধর মামার থেকে মুশকান জুবেরির আন্দিজের প্লেন ক্রাশ আর ক্যানিবালিজমের কথা শােনার পর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই ক্ষমতাধর মানুষটি কী করে জানতে পারল এটা,আর পুরােনাে ছবিটাই বা কী করে জোগাড় করল কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

“আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার।” নুরে ছফা নিজেই অবাক হল, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে পড়লে যে, সে-ও দারুণ অভিনয় করতে পারে সেটা বুঝতে পারছে আজ। তবে নিজের সৌভাগ্যকেই কৃতিত্ব দিচ্ছে সে। প্রথমে ভেবেছিল, তার বলা মিথ্যেগুলাে বুঝি ধরা পড়ে গেল কিন্তু এখন অনেকটা নির্ভার লাগছে।

“আমি যখন প্রথম শুনলাম আমার অবস্থাও আপনার মতােই হয়েছিল,”এবার সামনের দিকে ঝুঁকে এল আশেক মাহমুদ। “বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। বিশেষ করে, মহিলা এতগুল বছর পরও কী করে নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”

নুরে ছফা মাথা নেড়ে সায় দিল। “সত্যি অবিশ্বাস্য!”  “শেক্সপিয়ার ঠিকই বলেছে, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন,” একটু থেমে আবার বলল, “কে বিশ্বাস করবে এসব কথা ?!”

কেউ না, স্যার, মনে মনে বলে উঠল ছফা। আর সেজন্যেই আমি আপনাকে এটা বলিনি। নিজের সিদ্ধান্তের পেছনে আর-একবার শক্তিশালী যুক্তিটা খুঁজে পেল।  “এই মহিলা আস্ত একটা ডাইনী!”দাঁতে দাঁত পিষে বলল পিএস।“প্লেন ক্র্যাশের পর বাঁচার জন্য নরমাংস খেয়েছিল, তারপর থেকে এর স্বাদ পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে ক্যানিবালিজম প্র্যাকটিস শুরু করে! ভয়ংকর ব্যাপার!”

ছফাও চোখেমুখে অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা করল। “আপনি এসব জানলেন কী করে, স্যার?” প্রশ্নটা না করে আর পারল না।

চোখেমুখে আমুদে ভঙ্গি ফুটে উঠল আশেক মাহমুদের। ক্ষমতাধরদের এমন ভঙ্গির সঙ্গে ছফা বেশ পরিচিত, তােমাদের ধারণাও নেই আমার হাত কত লম্বা—এরকম একা ভঙ্গি থাকে তাতে।

“হাসিবের মা, আমার বড়বােন ”আস্তে করে বলল আশেক মাহমুদ।” আপনি হয়তাে জানেন না, আমার বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে গত বছর।

”কথাটা শুনে সত্যি সত্যি দুঃখিত হল ছফা। এতক্ষণ ধরে অভিনয় করে গেছে, মন যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।

আমার এই বােন যুদ্ধের পর পরই স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় চলে যায়।ওখানেই ছিল।

হাসিব জন্ম নেবার পর বাকি সন্তানসহ তারা আবার চলে আসে দেশে।বুবুর বড় মেয়ে আর ছেলে পড়াশােনা করার জন্য কানাডায় চলে গেলেও হাসিব দেশেই থেকে যায়। আমার দুলাভাই আর বােনও দেশে ছিল দীর্ঘদিন, কিন্তু দশ বছর আগে তারা চলে যায় তাদের বড়ো মেয়ের কাছে কানাডায়।” একটু থেমে আবার বলল, “হাসিব তাে বিয়ে-শাদি করেনি, একা থাকত। বাবা-মাকে টেক কেয়ার করাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাদেরও বয়স হয়ে গেছিল. দু-জনেরই টেক কেয়ারের দরকার ছিল।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেল একনিষ্ঠ শ্রোতা নুরে ছফা।

“হাসিব নিখোঁজ হবার দু-মাস পরই আমার দুলাভাই হার্ট ফেইলিঁওরে মারা যান, একটু থেমে আবার বলল, “আর গত বছর বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর যখন ডাক্তার জানিয়ে দিল কোনাে আশা নেই, টার্মিনাল স্টেজে আছে রােগটা, তখন বুবু এখানে চলে আসে।এখন উঠেছেআমার বাসায়।”একটু থেমে কফির কাপে চুমুক দিল পিএস। “আমার ওয়াইফ আবার হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করছে এক বছর ধরে, ফলে তাকে দেখাশােনা করার জন্য সার্বক্ষণিক নার্স রাখতে হয়। আমি তাে সারা দিন ব্যস্ত থাকি  বুঝতেই পারছেন।” জবাবদিহি করার মতাে শােনাল তার শেষ কথাটা।  আরও একবার মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। তবে সে ভালাে করেই জানে, প্রধানমন্ত্রীর পিএস যা বলল তা পুরােপুরি সত্যি নয়। এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বহু মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে স্ত্রী-সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখনও চলছে সেই ধারা। এদের কর্মকাণ্ডের কারণেই কানাডার মন্ট্রিলের একটি এলাকার নাম হয়ে গেছে বেগমগঞ্জ—সব বেগমদের ঠিকানা! সন্তান-সন্ততি নিয়ে বেগমসাহেবারা উন্নত দেশে নিরাপদ জীবনযাপন করছে আর তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা
সঙ্কুল, দরিদ্র একটি দেশ লুটপাট করে, চুষে চুষে তাদের পতিদেবেরা স্ত্রী-সন্তানদের জন্য স্বর্গীয় আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে-এই স্বর্গে স্বামীরাও যােগ দেবে, ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে। কিংবা রক্ত খাওয়া শেষ হলে!

“কাল বুবু আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, তার ছেলের কেসটার কী অবস্থা।”  সংবিৎ ফিরে পেল ছফা, আবারও মনােযােগ দিল প্রধানমন্ত্রীর পিএসের কথাবার্তার
দিকে।

বুঝতেই পারছেন, খুব বেশি সময় তাে আর নেই,” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।আশেক মাহমুদ।“বুবু খুব করে চাইছে, তার ছেলের কী হয়েছিল সেটা জানতে  কে তার এতাে বড়ো সর্বনাশ করল, কেন করল।”

জি স্যার…এটা খুবই স্বাভাবিক।

কিন্তু এই অবস্থায় আমিতো কোনো খারাপ সংবাদ দিতে পারি না, পারি কি?”

“ মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা।

“আমি তাকে শুধু জানালাম, হাসিবের শেষ গন্তব্য ছিল মুশকান জুবেরির রেস্টুরেন্টটায়  কী যেন নাম  রবীন্দ্রনাথ
এখানে…?”

“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি”ছফা বলে দিল।

“হুম। বুবুকে বললাম, সুন্দরপুরের ওই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল হাসিব, তারপর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি তার।” একটু থেমে আবার কফির কাপে চমুক দিলো। তাকে বললাম, মুশকান কে, কী করে, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিল, একজন ডাক্তার। আগে তার নাম ছিল মুশকান সােহেলি  তখনই বুবু চমকে ওঠে।”

ছফাও চমকে উঠল সত্যি সত্যি। “উনি ওই মহিলাকে চিনতেন ?!” মাথা নেড়ে সায় দিল আশেক মাহমুদ। “হুম। কী আর বলব, আমেরিকায় যাওয়ার বুবুরা ওই মহিলারই প্রতিবেশী ছিল!”

“বলেন কী, স্যার!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভদ্রলােক। “দুনিয়াটা আসলেই ছােটো!”

কাকতালীয় আর ঘটনাচক্র নিয়ে ছফা বরাবরই অবাক হয় কিন্তু এরকম কাকতালীয় ঘটনার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সে। নিজের বিস্ময় আর লুকাতে পারল না।  “আন্দিজ থেকে বেঁচে যাওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা এটি,”বলল আশেক মাহমুদ। “মুশকান সােহেলির নরমাংস খাওয়ার কথাটা কীভাবে যেন বাঙালি কমিউনিটিতে জানাজানি হয়ে গেলে মহিলা রীতিমতাে একঘরে হয়ে পড়ে।”

ছফাও আনমনে তার কফির কাপটা তুলে নিল এবার।

“যাই হােক, এসব জানাজানির আগেই আমার বুবুর সঙ্গে ওই মহিলার বেশ সখ্য হয়ে গেছিল, প্রায় সমবয়সি ছিল তারা। যে ছবিটা দেখছেন সেটা তখনকার সময়ই তােলা। ওরা আরও কিছু বন্ধুবান্ধবসহ একটা পার্কে গেছিল পিকনিক করতে, তখন এই ছবিটা তুলেছিল আমার বুবু।”

ছফা অবাক হয়ে আশেক মাহমুদের দিকে তাকিয়েই কফিতে প্রথম চুমুকটা দিল। সে উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাগুলাে শােনার জন্য।

আশেক মাহমুদ যখন তার বােনের কাছ থেকে শুনতে পেল মুশকান সােহেলি নামের একজনকে সে চিনত বহুকাল আগে, তখন ভেবেছিল এটা হতেই পারে না। যে মুশকান হাসিবের অন্তর্ধানের জন্য দায়ী সে কোনাে যুবতিই হবে-তা না হলেও মাঝবয়সি কোনাে মহিলা হবে নির্ঘাত। কিন্তু সত্তর বছরের কোনাে নারী? অসম্ভব। এদিকে, নুরে ছফা  বলেনি মুশকান জুবেরির বয়স কত ছিল। কঠিন এক অনিশ্চয়তা আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় সে।

যাই হােক, তার বুবু ঘটনাটা কাকতালীয় ঘটনা মেনে নিতে পারেনি।কানাডায় ফোন করে বড় মেয়ের কাছে থাকা তার পুরােনাে ছবির অ্যালবাম থেকে মুশকানের একটি ছবি বের করে দিতে বলে, তারপর সেই ছবিটা দেখায় আশেককে। ছবি দেখে পিএস বিশ্বাস করেনি।কারণ পঁচাত্তর সালেও মহিলা পরিপূর্ণ যুবতি ছিল, প্রায় তার বুবুর বয়স। এরকম একজনের সঙ্গে কি করে হাসিব হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াবে কিন্তু ছফার কাছ থেকে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে যা যা শুনেছে সেগুলাের প্রায় মিলে যাচ্ছে-বিয়ের আগের নাম মুশকান সােহেলি। পেশায় ডাক্তার। আমেরিকায় ছিল দীর্ঘদিন।পরে দেশে চলে আসে! এটাকে যে কোনাে কান্তজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কাকতালীয় ঘটনা বলে মেনে নেবে না। এরপরই আশেক মাহমুদের বড়ো বােন জানায়, মুশকান

সোহেলী আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন। আর তার নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য, গা গুলিয়ে দেওয়ার মতাে ঘটনাটি।

নিশ্চিত হবার জন্য আশেক ছবিটা নিয়ে নেয় ছফাকে দেখাবে বলে। এখন সে দেখতে পাচ্ছে, তার বুবুর কথাই ঠিক।

“আস্ত একটা ডাইনী এই মহিলা,” কফির কাপ রেখে কথাটা আবার বলল আশেক মাহমুদ। “এতদিন আপনার কাছে তার কোনাে ছবি ছিল না, এখন আছে। আর ভাগ্য ভালাে, পুরােনাে ছবিটাই কাজে লাগবে। কারণ ওই ডাইনী অলৌকিকভাবেই নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”  মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরির কোনাে ছবি জোগাড় করতে পারেনি সে। এমনকি সুন্দরপুরের জমিদারের বিশাল সহায়সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দেওয়ার যে কাগজপত্র সেগুলাে খতিয়ে দেখেছে, কোনাে লাভ হয়নি। ছফা অবাক হয়ে দেখেছে, ওখানে মালিক হিসেবে মুশকান জুবেরির কোনাে ছবি নেই-রাশেদ জুবেরির ছবি দেওয়া! আর ট্রাস্টের সমস্ত কাগজপত্র রাশেদ জুবেরি মারা যাবার আগেই তৈরি করা হয়েছে!

“সে কোনাে সিরিয়াল কিলার নয়  মানুষখেকো এক ডাইনী,”দাঁতে দাঁত পিষে বলল আশেক মাহমুদ। “মানুষ খেয়ে খেয়েই সে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে। এছাড়া আর কোনাে ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।” এ ছফা চোখেমুখে বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি ধরে রাখলেও মুখে কিছু বলল না। নিজের
অভিনয় দক্ষতার উপরে তার খুব বেশি আস্থা নেই।

“আরেকটা ঘটনার কথাও বুবু আমাকে বলেছে।”  “কী ঘটনা, স্যার?” কৌতুহলী হয়ে উঠল ডিবির নুরে ছফা।

ঐ ডাইনী আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবার প্রায় বিশ বছর পর, বুবু আর দুলাভাই লন্ডনে গিয়েছিল কী একটা কাজে  হিথ্রো-তে তখন ওই মুশকানকে নাকি বুবু দেখেছিল!”

“বলেন কী!

“তখনও মহিলার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন দেখেনি বুবু  একদম অবিকল বিশ
বছর আগে যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছিল!”

ছফার ভুরু কপালে উঠে গেল।

“বুবু বলেছে, ওই মহিলা তাকে দেখামাত্রই সটকে পড়ে। আমার দুলাভাইকে বুবু এই কথা বললে, তিনি মােটেও বিশ্বাস করেননি। দুলাভাইয়ের ধারণা, ওটা বুবুর হ্যালুসিনে ছিল, নয়তাে লােকজনের ভিড়ে মুশকানের মতাে কাউকে দেখেছে।”

ছফা কী বলবে ভেবে পেল না।

“বুবুও ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবেনি  বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, যা দেখেছে ভুলই দেখেছে, কিন্তু আমার কাছ থেকে সব শােনার পর বুবুর মনে হয়েছে। ওইদিন তার সেই দেখাটা মােটেও ভুল ছিল না।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ডিবি অফিসার।

“যাই হােক, আপনি যে খুব একটা ভুল করেছেন তা-ও বলা যাবে না,”বলল আশেক মাহমুদ। “মহিলা সিরিয়াল কিলারদের মতােই পার্থক্য হল, সে তার শিকারদের নিছক খুন করে আনন্দ পায় না, তাদেরকে ”কথাটা আর শেষ করল না, তার কোনাে দরকারও নেই।

চুপ মেরে রইল নুরে ছফা।

“এখন যেভাবে পারেন ওই ডাইনীকে খুঁজে বের করুন। যত দ্রুত সম্ভব!” বলল আশেক মাহমুদ।“আমি চাই আমার বুবু যেন জেনে যেতে পারে, তার সন্তানের হত্যাকারীকে ধরা হয়েছে। তার উপযুক্ত শাস্তি হবে।”  মুখ তুলে তাকাল ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর। তিন বছরে যেটা করা সম্ভব হয়নি সেটা এই ছবি পাবার পর কি এত দ্রুত করা যাবে?  ‘বুবুর জন্য খুব বেশি সময় নেই,”একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব। “আপনাকে যত রকম সাহায্য সহযােগিতা করা দরকার করব। সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করব আমি। দরকার হলে ক্ষমতার বাইরে গিয়েও যা করার করব!”  নুরে ছফা স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আশেক মাহমুদের দিকে। পিএসের দৃঢ়তা সুস্পষ্ট। ব্যক্তিগত আবেগে ভাসছে।

“আপনি যা চাইবেন পাবেন। সব ধরনের সহযােগিতা,” একটু থেমে আবার বলল, “সব কিছু মানে সব কিছু!

এটাকে আমি লাইসেন্স টু কিল’ হিসেবে ধরে নেব কি? মনে মনে বলে উঠল নুরে ছফা। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে ভালােমতােই অবগত আছে সে। এরা চাইলে পারে না এমন কাজ নেই। পুলিশের বড় কর্তাদের বদলি থেকে শুরু করে টিভি স্টেশন-ব্যাঙ্ক-বীমার লাইসেন্স পাইয়ে দেবার কাজও অনায়াসে করে দিতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবিত করে কোনাে মন্ত্রীর গদিও টলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।

ছবিটার দিকে আবারও তাকাল ছফা। একটা মাত্র ছবি তাকে কতটুকু সাহায্য করবে, জানে না। তবে এটা দিয়ে নতুন করে আবার শুরু করা যাবে-এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব, স্যার।”

মাথা নেড়ে সায় দিল আশেক মাহমুদ। “আপনি একটা সরকারি প্লটের জন্য আবেদন করুন, আমি বাকিটা দেখব। আর প্রমােশন নিয়ে ভাববেন না। ধরে নিন, ওটা হয়ে গেছে।”  এরকম লােভনীয় প্রস্তাব শুনে ছফা বিব্রত বােধ করলেও অভিব্যক্তি লুকাতে পারল। এ দেশে কাউকে ম্যানেজ করতে হলে তিনটি জিনিসই ব্যবহার করা হয়—পদ, পদক আর প্লট। ছফাকে পদোন্নতি আর প্লটের টোপ দেওয়া হচ্ছে! পদকও হয়তাে জুটে যাবে।  “স্যার, এসবের জন্য না,”অবশেষে বিনীতভাবেই বলার চেষ্টা করল সে।“আমি এই কেসটা
সলভ্্ করার জন্যই মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করব। আমি চাই না আমার কোনাে কেস আনসলভ্্ থাকুক।”

– “দ্যাটস গুড,”বলল আশেক মাহমুদ।“খুঁজে বের করুণ এই ডাইনীকে  যত দ্রুত
সম্ভব!”

অধ্যায় ৭

অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে রােমানার আর ভালাে লাগছেনা। রিগ্যাল এয়ারওয়েজের সেল এক্সিকিউটিভ সে। তার ছােট্ট, কিউবিকল সদৃশ অফিসটি ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ভবনের নীচতলায় অবস্থিত। তারা মােট তিনজন কাজ করে এখানে। অসুস্থতার কারণে একজন অনুপস্থিত। আজকে সুমিত নামের এক জুনিয়র আর রােমানা কাজ করছে। তাতে অবশ্য কোনাে সমস্যা হচ্ছে না, এখন বলতে গেলে অফ সিজন। এই মরসুমে পর্যটক কম থাকে, ফলে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলাের ফ্লাইটের সংখ্যাও কমে আসে, কমে আসে তাদের ব্যস্ততাও।

শেষ ফ্লাইটটা ছিল বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে, এরপরও পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। কেউ কেউ মােবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রােমানা আবার বইয়ের পােকা, সাধারণত পকেটবুক সাইজের পেপারব্যাক বের করে পড়ে সে। এ নিয়ে তার কিছু কলিগ হাসাহাসি করে, খোঁচা মেরে তাকে প্রফেসর আপা বলে ডাকে। আজকেও সে পিডি জেমসের একটি ডিটেক্টিভ বই হাতে নিয়েছিল কিন্তু গল্পটা তাকে টানেনি। কম্পিউটারে বসে একটা গেম খেলারও চেষ্টা করেছিল, সেটা আরও বেশি বিরক্তিকর লেগেছে। অগত্যা চুপচাপ বসে আছে সে। আর এক ঘণ্টা পর ছুটি, এই এক ঘণ্টাকে সহ্য করতে একটু বেশিই কষ্ট করতে হয়। সারাটা দিন কাজে ডুবে থাকলে কী হবে, ছুটির আগের সময়টায় এসে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়, কখন বাড়ি যাব!

রােমানা ঠিক করল কফি খাবে, ছুটির আগে সব সময়ই এটা করে সে।

“কই যান, আপা?”জুনিয়র ছেলেটা তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জানতে চাইল। এতক্ষণ কম্পিউটারে সেলের হিসেব দেখছিল সে।

“একটু আসছি,”ইচ্ছে করেই কফির কথা বলল না,বললে এই ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে তার জন্যেও এক কাপ নিয়ে আসার জন্য-তার মানে পুরাে একশাে টাকা গচ্চা। কী দরকার, এই ছেলে তাে এখানে জয়েন করার পর থেকে খেয়েই যাচ্ছে, কখনও কি তার জন্য এক কাপ নিয়ে এসেছে?  রােমানা কিউবিকল থেকে বের হয়ে প্রথমেই কফি-বুথের দিকে গেল না, সে গেল ওয়াশরুমের দিকে। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই থমকে দাঁড়াল। তাকে
হাত নেড়ে ইশারা করছে তাদের এয়ারলাইন্সের কাস্টমার সার্ভিসের সুরভি নামের এক মেয়ে।

তিনমাস হল এখানে জয়েন করেছে, ফ্রন্টডেস্কে ডিউটি তার।

ফ্রন্টডেস্কের কাছে যেতেই সুরভি নীচুকণ্ঠে বলল, “আপা, একটু হেল্প করবেন?” রােমানা হাসিমুখে বলল, “কী ব্যাপার, বলাে।”

“আপনি কি একটু ডেস্কে বসবেন? আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে। কিন্তু ডেস্কে কেউ নেই এখন।”

“বাকিরা কোথায় গেছে?” অবাক হল রােমানা। ডেস্কে সাধারণত তিনজন থাকে। এখানেও দু-জন ছেলে একজন মেয়ে।

“ওরা সিগারেট খেতে গেছে।”

“ওহ” ছেলেগুলাে সুযােগ পেলেই যে এ কাজ করে। এয়ারপাের্টে সিগারেট খাওয়ার জন্য আলাদা জোন আছে, আর সেটা তাদের ডেস্ক থেকে বেশ দূরে। সুতরাং, ছুটির আগে একটু ফাঁকা হয়ে এলে ধূমপায়ী এমপ্লয়িরা হন্যে হয়ে ওঠে সিগারেট খাওয়ার জন্য। রােমানা কিছু না বলে ডেস্কের পেছনে চলে এল। “তুমি যাও।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, আপা,”চপল কিশােরীর মতাে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল সুরভি।  ডেস্কে বসে এদিক ওদিক তাকাল রােমানা। আজকের জন্য তাদের এয়ারওয়েজের সব ধরনের ফ্লাইট শেষ হয়ে গেছে। এখন পাত্তারি গােটানাের পালা। সবগুলাে বেসরকারি এয়ারলাইন্সই একটু পর বন্ধ করে দেবে নিজেদের কাউন্টার আর ফ্রন্ট ডেস্ক।

আনমনে ডেস্কের দিকে চোখ যেতেই রােমানা কিছু একটা দেখতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠল।

একটা ফটোগ্রাফ।

ছবিটা হাতে নিতেই ভুরু কুঁচকে গেল তার। নীচের ঠোট কামড়ে ধরল। এই ছবি এখানে কেন? এরকম ছবি সাধারণত পুলিশ আর গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে দিয়ে যায়। কেন দিয়ে যায় এটা এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই জানে।

ক্রিমিনাল! বিরােধী দলের পলিটিশিয়ান? নাকি জঙ্গি? আপনমনেই কাঁধ তুলল সে। তার অবশ্য সেরকমই কিছু মনে হচ্ছে।

“এইছবি এখানে কেন? কীসের জন্য?”সুরভি ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলে কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল রােমানা।

ছবিটা দেখে ভুরু কপালে তুলল সুরভি।“ওহ এটা আর বলবেন না, ডিবির এক অফিসার এসে দিয়ে গেছে আজকে।”

“মহিলা জঙ্গি নাকি?”

কাঁধ তুলল মেয়েটা। “আমাদেরকে তাে কিছুই বলেনি। তবে মনে হচ্ছে, কোনাে ক্রিমিনাল।”

“ক্রিমিনাল!”অবাক হল রােমানা।“কী করেছে?” “কীআর হবে, হয়তাে খুনটুন করেছে। টেররিস্ট কানেকশানও থাকতে পারে। আজকাল তো বেশির ভাগ কেস এমনই হচ্ছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল রােমানা। জঙ্গি-সন্ত্রাসী নিয়েই গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে আজকাল এয়ারপাের্টে বেশি আসে, এরকম ছবি দিয়ে যায় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সগুলােতে।  “আবার পলিটিশিয়ানও হতে পারে,”বলল সুরভি।  রােমানা অবশ্য সেরকম কিছু মনে করছে না। যদিও আজকাল এরকমটি প্রায়ই হচ্ছে-অমুক পলিটিশিয়ান যেন এয়ারপাের্টের ইমিগ্রেশন ক্র
স করতে না পারে, তমুক এলে যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানাে হয়-এরকম আদেশ-নির্দেশ হরদম দেয়া হচ্ছে।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল সে। “আজকে দুপুরে এক লেডি প্যাসেঞ্জার অদ্ভুত আচরণ করেছিল, বুঝলে?”

“কী রকম?”সুরভি আগ্রহ দেখাল।

“মহিলা সকাল দশটার ফ্লাইট মিস করে জ্যামের কারণে, পরে ফিফটি পার্সেন্ট ফাইন দিয়ে টিকিটটা রিসিডিউল করিয়ে নেয় পরের ফ্লাইটের জন্যে, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কী জান?” সুরভির কাছ থেকে কোনাে জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল, “মহিলা ওই ফ্লাইটটাও মিস করে। অথচ আমি তাকে ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি লাউঞ্জে বসে থাকতে।”

“বলেন কী!”অবাক হল সুরভি।“আপনি শিয়াের, মহিলা ফ্লাইট মিস করেছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিল রােমানা। “ফ্লাইট ছাড়ার পনেরাে-বিশ মিনিট আগে আমাকে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে জানানাে হয়েছিল আমি যেন ফোন করে ক্লায়েন্টকে ইনফর্ম করি। আমি তাকে ফোন করার পর পেয়েও যাই..কিন্তু মহিলা যখনই শুনতে পেল আমি এয়ারলাইন্স থেকে কল করেছি তখনই লাইনটা কেটে দিল।”

সুরভি অবাক হল কথাটা শুনে।“এটা কেন করল ভদ্রমহিলা আজব তাে!”

ঠোঁট ওলটাল রােমানা। “আসলেই আজব। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে কী জানাে, এই ছবির মহিলাই ছিল ওই প্যাসেঞ্জার।”

সুরভির চোখদুটো গােল গােল হয়ে গেল। “সম্ভবত লাউঞ্জে ওয়েট করার সময় ডিবি অফিসারকে দেখে সটকে পড়েছে।” মাথা নেড়ে সায় দিল সুরভি। “তা হতে পারে।” “আমি নিশ্চিত, এটাই হয়েছে,” রােমানা জোর দিয়ে বলল। “তাহলে কি আপনি বস-কে জানিয়ে দেবেন এটা?” “হুম। জানানাে তাে দরকার, তাই না?”

অধ্যায় ৮

তিন দিন ধরে সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজের মােবাইল ফোনটা পাচ্ছেনা খোদাদাদ শাহবাজ খান। ঠিক ভাবে মনেও করতে পারছে না, শেষবার ফোনটা কবে কখন ব্যবহার করেছিল। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, আগের বারের মতাে প্রশিক্ষিত কোনাে পিগমি বানর ঘরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে যায়নি।

এমন না যে, মােবাইল ফোন না থাকলে তার অনেক সমস্যা হবে, যােগাযােগ করতে পারবে না কারাের সঙ্গে। সত্যি বলতে, এই যুগেও তার সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষজন যােগাযােগ করে পুরােনাে আমলের ল্যান্ডফোনেই। কিন্তু একটা জিনিস হারিয়ে গেল আর তার ইনভেস্টিগেটর সত্তা সেটার খোঁজ করবে না তা কি হয়? অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর ব্যর্থ হয়ে এখন বসে আছে চুপচাপ।ভাবার চেষ্টা করছে জিনিসটা গেল কোথায়!  আইনস্টাইনও তার সঙ্গে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। এমন সব জায়গায় খুঁজে দেখেছে যেখানে কেবলমাত্র ইঁদুর আর টিকটিকির পক্ষেই ঢােকা সম্ভব এখন তাকে খোঁজাখুঁজিবাদ। দিয়ে চা আনতে পাঠিয়েছে।

এমন সময় ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলে কেএস খান আনমনেই ফোনটা তুলে নিল। “হ্যালাে”ডাক্তার লুবনার সুমিষ্টকণ্ঠটা বলে উঠল ওপাশ থেকে।

“আরে আপনে আছেন কেমন?”পহেলা বৈশাখের পর আর মেয়েটার সঙ্গে তার যােগাযােগ হয়নি। জরুরি একটা দরকারে গ্রামের বাড়িতে গেছিল।

“ভালাে আছি। আপনার কী অবস্থা?” “ভালােই  সামান্য সর্দি ছাড়া আর সব ঠিক আছে।” “অ্যালার্জি থেকে হয়েছে ঘরে অ্যালাট্রল আছেনা?”

“আছে মানে, আমার ঘর তাে ছােটোখাটো ডিসপেন্সারি,”কথাটা বলেই চওড়া হাসি দিল কেএস খান। যদিও ফোনে সেটা দেখতে পাবে না ডাক্তার লুবনা।

“আমি আপনার মােবাইল ফোনেও কল দিয়েছিলাম  বন্ধ পেলাম যে?” “বন্ধ না  আসলে খুঁইজা পাইতাছি না।” “হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?”

“পহেলা বৈশাখের পর থেইকা পাইতাছি না। সারা ঘর খুঁইজা শেষ। কই রাখছি মনে করবার পারতাছি না। আমার আবার মেমােরি খুব উইক।”

“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।” “আমার মেমােরি ?”বুঝতে না পেরে বলল সাবেক ডিবি কর্মকর্তা।

“আরে না,” হেসে বলল ডাক্তার। “ফোনের কথা বলছি। রমনা থেকে ফেরার পথে ফোনটা পিকপকেট হয়ে গেছে মনে হয়। আপনি তাে পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিলেন।
হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিল কেএস খান। চাকরিজীবনে পকেটমারদের সঙ্গে কয়েকবার মােলাকাত হয়েছে তার। এরকম এক পকেটমার তাকে একবার বলে, পাঞ্জাবি পকেটে কিছু রাখলে নাকি তারা ধরে নেয় জিনিসটা আসলে তাদের রাখা হয়েছে! “তাইলে সেইটাই হইছে পকেটমার মাইরা দিছে।”

“খারাপ লাগছে?”আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইল ডাক্তার।

“আরে না।” একটু থেমে আবার বলল সাবেক ডিবি অফিসার, “আমি টিনেজ পোলাপান নাকি, মােবাইল হারাইলে মুখ বেজার কইরা বইসা থাকুম? এর আগে কতবার ফোন হারাইছে! এইটা কোনাে ব্যাপারই না।”

“আমি যদি আপনাকে জোর করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে না নিয়ে যেতাম তাহলে ফোনটা হারাত না,” বিষন্ন কণ্ঠে ওপাশ থেকে বলল ডাক্তার।

“কী যে বলেন না,” কেএস খান সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল মেয়েটাকে। “ফোন তাে হারায়ই  এইটা আর এমন কী।”

একটু চুপ থেকে ডাক্তার লুবনা বলল, “ওইদিন আপনার ছাত্র ওই যে, নুরে ছফা  সে আমাদের একসাথে দেখে ফেলায় কি আপনার কোনাে সমস্যা হয়েছে?”

“আরে না,”কেএসকে বলল। “ছফা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ..এইটা কোনাে ব্যাপার না। আমি কার সঙ্গে কই যামু না যামু এইটা নিয়া সে ক্যান ভাবতে যাইব? আর ভাবলেই আমি পরােয়া করুম নাকি।”

“হুম। তা তাে ঠিকই,” সায় দিল ডাক্তার লুবনা। “আপনে এইটা নিয়া খামােখা ভাবতাছেন। এইটা কোনাে ব্যাপারই না।” “আসলে আমার মনে হল আপনি খুবই বিব্রত হয়েছিলেন, তাই বললাম।”

“আরে না, সেইরকম কিছু না বুঝতেই পারছেন, জুনিয়রদের সামনে পইড়া গেলে তাে একটু ইয়ে হয়-ই।”

ডাক্তার লুবনা হেসে ফেলল। “যাক, বাঁচলাম। আমি তাে ভেবেছিলাম আপনাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছি।” একটু চুপ থেকে আবার বলে উঠল সে, “কাল বিকেলে কি ফ্রি আছেন? ভাবছি, একটু কফি খেতে যাব।”

আনন্দে মুখে হাসি ফুটে উঠল সাবেক ডিবি অফিসারের। “আপনে ঢাকায় এখন?” “হুম। আজ দুপুরে এসেছি।”

চওড়া হাসি ধরে রেখেই বলল, “আমি তাে ফ্রি-ই আছি, কোনাে সমস্যা নাই।” “দ্যাটস গ্রেট।”উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল ডাক্তার লুবনা। “কয়টার দিকে বাইর হইবেন?” বিকেলে পাঁচটায়?” “ওকে  নাে প্রবলেম  কোন জায়গায় আসতে হইব, কন”

“ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরােবরে চলে আসুন। আমি ওখানেই থাকব।”

রাখি। বাই। কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে,” মিষ্টি করে হেসে বলল ডাক্তার লুবনা।

“বাই,”কলটা কেটে গেলেও কেএস খান ফোনটা কানে চেপে রাখল আরও কিছুক্ষণ। সেই সুপরিচিত হৃদস্পন্দনটা টের পেল। এক ধরনের ধুকপুকানি। নতুন প্রেমে পড়লে যেমনটা হয়। ডাক্তার লুবনার সঙ্গে প্রতিবার কথা বললেই এটা হয় তার।

ফোনটা রেখে ঘুরে দাঁড়ানাের আগেই আবার রিং বেজে উঠল, বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে নিল সে।

“কী খবর তােমার?” এবার নিয়মমাফিক কলটা এসেছে। “এই তাে  আছি,”বলল মহিলার সাবেক স্বামী। “তােমার ফোন খুঁজে পেয়েছ?”

গতকাল ফোন করলে সাবেক স্ত্রীকে মােবাইলফোন হারানাের কথা জানিয়েছিল সে। “না। ওইটা আসলে পিকপকেট হইছে মনে হয়।”

“বলাে কী!” অবাক হলাে ফোনের অপর পাশের কণ্ঠটা। “কাল না বললে হারিয়ে ফেলেছিলে?”

“হ  কিন্তু আজ মনে হইতাছে পয়লা বৈশাখে যে রমনায় গেছিলাম, সেইখান থেইকা ফিরা আসার সময় ”কথাটা শেষ করার আগেই কেএস খান বুঝে গেল বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। এখন কী প্রতিক্রিয়া আর প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটা বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগল না।

“পহেলা বৈশাখে রমনায় গেছিলে?!” বিস্ময় আর অবিশ্বাসটা একেবারেই সঙ্গত। বিবাহিত জীবনে কখনও ইনভেস্টিগেটর স্বামী তাকে নিয়ে পহেলা বৈশাখে বের হয়নি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস শােনা গেল। কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর অবশেষে খুবই ম্রিয়মান কণ্ঠে জানতে চাইল, “একা গেছিলে, নাকি?”

কেএস খান কী বলবে ভেবে পেল না। “ইয়ে মানে ”

“ওহ..ভুলে গেছিলাম,”কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল এবার।“জুবায়েরকে পড়াতে হবে এখন রাখি।”  কলটা কেটে যাবার পরও কেএসকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল জানালা দিয়ে। ঈর্ষা শব্দটি এখনও পুরােপুরি বুঝে উঠতে পারে না সে। এটার উৎপত্তির কারণ তার ভালাে করেই জানা আছে, কিন্তু এর ব্যাপ্তি
কতটা জানে না। তবে জানে, আগামী দুয়েকদিন তাকে আর কল করবে না এই মহিলা। ঈর্ষা হল আগুন, সেই আগুন স্তিমিত হতে একটু সময় লাগেই।

“স্লামালেকুম,স্যার।” জাঁদরেল একটি কণ্ঠ বলে উঠলে কেএস খান অনেকটা চমকে তাকাল দরজার দিকে।

অধ্যায় ৯

“তুমি শিয়াের?”রিগ্যাল এয়ারলাইন্সের অপারেশন হেড মঞ্জুর কাদের ভুরু কুঁচকে আবার জানতে চাইল।

“জি, স্যার।”জবাব দিল রােমানা। তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে ফ্রন্টডেস্ক থেকে একটু দূরে।

“মহিলা ফ্লাইট মিস করে আবার রিশিডিউল করে,” ডিবির সরবরাহ করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল মঞ্জুর কাদের।

রােমানা বুঝতে পারল না এটা প্রশ্ন কিনা, তারপরও মাথা নেড়ে সায় দিল সে।

“ছবির এই মহিলাই ছিল তাহলে?”মুখ তুলে তাকাল অপারেশন হেড। “তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়াের?”

রােমানা এবার ধন্দে পড়ে গেল। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শব্দটা তাকে সব সময়ই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। জগতের কোনাে কিছু সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যে টেকনিক্যালি ভুল এটা সে কর্মজীবনে প্রবেশ করেই বুঝে গেছে।

“না, মানে ” মঞ্জুর কাদের সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। “হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়াের কিভাবে হব, স্যার?” “কীভাবে হবেন মানে? আপনি না তাকে দেখেছেন?” “দেখেছি কিন্তু ওই মহিলার চোখ ছাড়া তাে কিছু দেখিনি।”

“কী!”অবাক হল অপারেশন হেড। “চোখ ছাড়া কিছু দেখেননি মানে!” “মহিলা হিজাব পরা ছিল, স্যার,”তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা দিল রােমানা। “হিজাব?”কপালে ভাঁজ পড়ল অপারেশন হেডের। “জি, স্যার  শুধু চোখদুটো দেখা গেছে।” গভীর করে দম নিয়ে মাথা দোলাল মঞ্জুর কাদের। আর তাতেই আপনি বুঝে গেলেন এটা সেই মহিলা?”

রােমানা ঢোক গিলল। “শুধু একজোড়া চোখ দেখে?” – “স্যার, একজন প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট মিস করার পর রিশিডিউল করল, তারপর সেটাও মিস করলো ইচ্ছাকৃতভাবে। ভদ্রমহিলাকে আমি ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগেও লাউঞ্জে ওয়েট

করতে দেখেছি।”

এ থেকেই আপনি ধরে নিলেন এই মহিলা কোনাে ক্রিমিনাল না হয়ে যায় না ডিবি যার ছবি দিয়ে গেছে এটা সে-ই হবে?”

মাথা নেড়ে সায় দিল রােমানা। “তাছাড়া আমি মহিলার চোখদুটো ভালাে করে দেখেছি,আমার কিউবিকলের খুব কাছেই বসেই ছিল  ছবির এই মহিলার মতােই, স্যার। তার অদ্ভ
ুত আচরণের ব্যাপারটা কনসিডার করলে একটা বিষয়ই মাথায় আসে আর সেটা—”

আপনি আসলে ওই মহিলার এই ব্যাপারটাকে সন্দেহজনক হিসেবে দেখেছেন,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল অপারেশন চিফ। “তাই তাে?”

“জি, স্যার।” “কিন্তু ওনার ফ্লাইট মিসকরার আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, এটা ভেবে দেখেছেন কী?”

বসের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রােমানা।

মঞ্জুর কাদের বুকে দু-হাত ভাঁজ করে গম্ভীর হয়ে বলল, “মনে করুন, একেবারে শেষ সময়ে মহিলার পরিবারে কোনাে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, ভদ্রমহিলা ফোন পেয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরকমটা কি হতে পারে না?”

রােমানা মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হল। অপারেশন হেডের সৃজনশীলতায় মুগ্ধ সে। এটার সম্ভাবনা আছে, তবে তার কাছে মনে হচ্ছে সেই সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।“স্যার, আমি আরও জানতে পেরেছি, ডিবি অফিসার যখন এসেছিল তার কিছুক্ষণ পরই ওই ফ্লাইটটা ছেড়ে যায়। তার মানে, মহিলা নিশ্চয় ওই অফিসারকে দেখে ভয় পেয়ে কেটে পড়েছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল মঞ্জুর কাদের। “বুঝলাম, আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি-আমি কেউই পুরােপুরি নিশ্চিত নই। নিশ্চিত না হয়ে সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের কোনাে কাস্টমারকে ঝামেলায় ফেলতে পারি না। বােঝা গেল আমার কথাটা?”

চুপসে গেল রােমানা। “জি, স্যার।”

“ওরা একটা ছবি দিয়ে গেছে”বলতে লাগল অপারেশন হেড।“আমাদের ফ্রন্টডেস্ক যদি ওই ছবির সঙ্গে মিল আছে এমন কাউকে প্যাসেঞ্জার হিসেবে পেত তাহলে আমরা ওদেরকে জানাতাম। কিন্তু আপনি দেখেছেন একজোড়া চোখ তার সঙ্গে পর পর দু-বার ফ্লাইট মিস করার ঘটনাটা জুড়ে দিয়ে মনে করছেন এই ছবির মহিলাই ওই প্যাসেঞ্জার হতে পারে। দ্যাটস নট এনাফ টু রিপাের্ট ইট।” “জি, স্যার,”বিমর্ষ মুখে বলল রােমানা।

মনে রাখবেন, আমাদের কাছে সবার আগে আমাদের কাস্টমার, ওই সব ল-ইনফোর্সমেন্টের রিকোয়েস্ট না। ওকে?”

মাথা নেড়ে সায় দিল সেল এক্সিকিউটিভ। আসল কথাটা এবার তার কাছে পরিষ্কার। খালি চোখে দেখলে কর্পোরেট দুনিয়ার আসল দেবতা হল টাকা, কিন্তু সেটা আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে না, ওগুলাে আসে কাস্টমারের পকেট থেকে! সুতরাং এখানে আসল দেবতা তারাই।

“আমরা পুরােপুরি নিশ্চিত না হয়ে কখনও আমাদের কোনাে কাস্টমারের বিরুদ্ধে কিছু করব না এটা সব সময় মাথায় রাখবেন।”

“জি, স্যার।” “ওই প্যাসেঞ্জার কী কারণে রিশিডিউল করা ফ্লাইট মিস করলেন সেটার ব্যাখ্যাও আমাদের খোঁজার দরকার নেই। আমরা আমাদের টিকেট বিক্রি করেছি, ফাইনের টাকা পেয়েছি, দ্যাটস ইট।”

চুপ মেরে রইল রােমানা। মঞ্জুর কাদের হাতঘড়ির দিকে তাকাল। “সময় হয়ে গেছে, বাসায় চলে যান।” “জি, স্যার,”কথাটা বলে রােমানা পা বাড়াল নিজের কিউবিকলের দিকে। ওখানে পাস আছে।

তার ব্যাগ-পার্স আছে।

“শুনুন?” পেছনে থেকে বসের ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াল সে। “এখন থেকে ডিটেক্টিভ নভেল একটু কম পড়বেন, ওকে?” অপারেশন হেড মাপা হাসি দিয়ে রােবটের মতাে ঘুরে চলে গেল।

এমন উপদেশ পেয়ে অপমানিত বােধ করল রােমানা। সেই অপমান হজম করে আবারও পা বাড়াল কিউবিকলের দিকে। মনে মনে বলল সে, জি, স্যার, এখন থেকে কম কম বই পড়ব আর আপনার মতাে রােবট হবার চেষ্টা করব।

অধ্যায় ১০

নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে কেএস খানের খােলা দরজার সামনে।

তাকে দেখেই ফোনটা ক্রাডলের উপরে রেখে দিল সাবেক ডিবি অফিসার। “আরে, ছফা যে ” এগিয়ে গেল দরজার দিকে। “আপনে যে আসবেন জানতাম না তাে।”

নুরেছফা ঘরের ভেতরে পা ফেলল। “আমি আপনার মােবাইলফোনে কল দিয়ে দেখি সেটা বন্ধ, তারপর ল্যান্ডফোনেও কল দিয়েছিলাম। আইনস্টাইন বলল, আপনি একটু বাইরে গেছেন হাঁটাহাঁটি করতে।”

“হ..রােজ বিকালে একটু হাঁটাহাঁটি করি পার্কে।” “তাকে আমি বলেছিলাম, আমি আসছি, সে আপনাকে বলেনি?”

হেসে ফেলল কেএসকে।“পােলাপান মানুষ, মনে হয় ভুইলা গেছে।” একটু থেমে আবার বলল, “বসেন।”নিজেও বসে গেল সােফায়। “আজকে কি আপনার অফ ডিউটি?”

“না, স্যার  ছুটি পেয়েছি।”

কেএস খান বুঝতে পারল না। তাদের পেশায় ছুটি নিয়েছি’ পরিচিত শব্দ কিন্তু ছুটি পেয়েছি,’এটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।“আচ্ছা,” কোনাে রকমে নিজের কৌতূহল দমিয়ে বলল সাবেক ডিবি অফিসার।

“ইয়াল্লা!”দরজার দিক থেকে একটা অল্প বয়েসি কণ্ঠ বলে উঠলে তারা দুজন সেদিকে তাকাল।

আইনস্টাইন জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা চায়ের ফ্লাস্ক। “আমি ভুইল্যা গেছিলাম  স্যারে আমারে ফোনে কইছিলাে আইবাে।” “থাক, তরে আর কিছু কইতে হইবাে না। যা, দুই কাপ চা দে তাড়াতাড়ি।

আইনস্টাইন দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার সময় নুরে ছফার দিকে তাকিয়ে নিস্পাপ হাসি দিয়ে গেল। ছফাও হেসে আশ্বস্ত করল তাকে।

“ছুটি পাইছেন মানে বুঝলাম না?”উৎসুক কেএস খান অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেলল। নুরে ছফা গম্ভীর হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

সাবেক ডিবি অফিসার ভাবল, ছফা কোনাে কারণে পানিশমেন্টের শিকার হয়েছে। কিনা।

“আমাকে স্পেশাল ছুটি দেয়া হয়েছে, স্যার।”

সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কেএস খান। “মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক ডাউন করার জন্য।” “এরজন্যই কি পহেলা বৈশাখে আপনে ছায়ানটের প্রােগ্রামে গেছিলেন, মাথা দোলাল ছফা। “না, স্যার। ছুটি আমি পেয়েছি আজকে।”

ওই দিন গিয়েছিলাম এমনি। হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল মুশকান জুবেরি ওখানে থাকতে পারে।

“বলেন কী ?”অবাক হল কেএস খান। “এইটা আপনের মনে হইল কেন?”

কাঁধ তুলল ছফা। “তা তাে জানি না। কেনজানি মনে হল মহিলা ওখানে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত। তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম, ছায়ানটের বর্ষবরণ নাকি কখনও মিস করেনি।”

“বুঝছি।” মাথা নেড়ে সায় দিল সাবেক ডিবি অফিসার। “মজার ব্যাপার কী জানেন, স্যার ? আমার ধারণা মােটেও মিথ্যে ছিল না।” “মানে?!”ডিবির সাবেক অফিসারকে বিস্মিত দেখাল। “ফেরার পথে ওই মহিলাকে আমি এক ঝলক দেখেছি  শাহবাগের দিকে।”

“একটা প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছিল  আমি ছিলাম রিকশায়।” গাল চুলকাতে শুরু করল সাবেক ইনভেস্টিগেটর। “তারপর?” “গাড়িটা ধরা সম্ভব হয়নি।” “নাম্বারটা দেখেন নাই? ওইটা ট্রেস করলে তাে—”

“না, স্যার  ওটার কথা খেয়াল ছিল না তখন, উৎসুক কেএস খানকে মাঝপথে দমিয়ে দিল ছফা।

“ওহ” একটু হতাশ হল সাবেক ইনভেস্টিগেটর। এমন সময় দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল আইনস্টাইন।

“কীরে, আইজকাল তাের চা আনতে এত দেরি হয় ক্যান?” জানতে চাইল কেএস খান।

চায়ের কাপ দুটো সােফার সামনে কফি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে জবাবদিহি করল ছেলেটা, “নীচের দোকান থিকা তাে এহন আর চা আনি না  ওই হালারপুতে মুর্দালাশে যে চা-পাতা দেয় ওইগুলা সস্তায় কিইন্যা আনে  ওয়াক থু! চিন্তা করছেন কারবারটা!”

“তরে এইসব কথা কে কইলাে?”  কেএসকের দিকে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকাল আইনস্টাইন
দিকে। “ওই হালারপুতেরে  এক বেটার কাছ থিইক্যা চা কিনতে দেখছি  পাঁচ কেজি কিনলাে মাত্র দুইশাে ট্যা
কা দিয়া।

আপনেই কন, অরিজিনাল চা কি এত সস্তা? তহনই আমি বুইজ্যা হালাইছি, হালারপুতে দুই নাম্বারি করে।”

“আইজকাল দেহি কথায় কথায় হালারপুত কস  ঘটনা কী?” কেএস খান ভুরু কপালে তুলে বলল।

জিভে কামড় দিল পিচ্চিটা। একটু শরমিন্দা হয়েছে সে, আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেল।

“চা নেন, ছফা,”নিজের কাপটা নেবার আগে বলল কেএস খান। “আপনে তারে খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখছেন,” কাপে চুমুক দিল মি.খান। “এইটা তে রিলায়েবল হইতে পারে না  অন্য কিছুও হইবার পারে।”

“কী রকম?”ভুরু কুঁচকে তাকাল ছফা। অমায়িক হাসি দিল কেএসকে। “আপনের তাে হেলুসিনেশানও হইবার পারে, পারে না ?”

ছফা একটুখানি বিষম খেল যেন। “হেলুসিনেশান?”

“অবাক হওনের কিছু নাই,” ছফাকে আশ্বস্ত করে চায়ে চুমুক দিল সাবেক ডিবি অফিসার। “আপনের ধ্যান-জ্ঞান হইলাে ওই মহিলা, তারে তিনটা বছর ধইরা পাগলের মতাে খুঁজছেন। এরকম সিচুয়েশনে হেলুসিনেশান তাে হইবারই পারে।”

ছফা চায়ের কাপটা তুলে নিল। “কিন্তু আমার মনে হয় না হেলুসিনেশান ছিল ওটা।”

খােদাদাদ শাহবাজ খানকে দেখে মনে হল আশ্বস্ত হতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। “সার্ভিসে জয়েন করার পর আমার তিন নাম্বার কেসটা খুব ভুগাইছিল, বুঝলেন?”

নুরে ছফা বুঝতে পারল অতীত রােমন্থনের মেজাজে চলে গেছে মি.খান। জোর করে আগ্রহী হবার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল চোখেমুখে।

“একটা মার্ডার কেস ছিল। আমি খুব দ্রুত বাইর করতে পারছিলাম খুনটা কে করছে, কিন্তু সাসপেক্ট ততােক্ষণে পগাড় পার।”

ছফা কিছু বলল না। জানে, গল্পটা শেষ হয়নি। চায়ে চুমুক দিল সে।

“এরপর কী হইলাে জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল আবার, “আমি যেইখানেই যাই ওই ব্যাটারে খুঁজি। এক পর্যায়ে তারে দেখতেও শুরু করলাম!”

“দেখতে শুরু করলেন মানে?”

“এই ধরেন, মানুষজনের ভীড়ে, পথেঘাটে মনে হইতাে তারে দেখছি।” একটু থেমে আবার বলল সে, “আসলে পুরাটাই ছিলাে হেলুসিনেশান। এইটারে আপনে ডিলুশনও কইবার পারেন।”

কাঁধ তুলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছফা। “হতে পারে ওটা হেলুসিনেশান। কিন্তু আমি আজকে সেজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আসলে, আপনার সঙ্গে জরুরি একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি, সেই সঙ্গে একটা জিনিসও দেখাতে এসেছি, স্যার।”

“কী জিনিস?” কৌতুহলী হয়ে উঠল সাবেক ইনভেস্টিগেটর।  কোনাে কথা না বলে চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে আনল নুরে ছফা।“এই যে, স্যার।”

কেএস খান আগ্রহভরে ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল কয়েক মুহূর্ত। “মুশকান জুবেরির ছবি!” বিস্ময়ে বলে উঠল সাবেক ডিবি অফিসার।

“জি, স্যার। এটাই মুশকান জুবেরি। অবশেষে তার ছবি আমি পেয়েছি।” “কই থেকা পাইলেন এই জিনিস?”

“একেবারেই অবিশ্বাস্য গল্প।আপনার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে।”ছফার মুখেরহস্যময় হাসি।

উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইল খােদাদাদ শাহবাজ খান।

অধ্যায় ১১

“তাজ্জব ব্যাপার!”

নুরে ছফার কাছ থেকে সবটা শুনে বললেন কেএস খান। বিশাল কাকতালীয় ঘটনাই বটে! মুশকান জুবেরির এক ভিক্টিম, হাসিবের মরণাপন্ন মা আবিষ্কার করেছে সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে আমেরিকায় যখন স্বামীর সঙ্গে থাকত তখন তাদের প্রতিবেশী ছিল মুশকান।

কেএস খানের বিস্ময়ের ঘাের যেন কাটছেই না।“পুরাই ড্রামা!”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। এ ব্যাপারে তার মনেও কোনাে সন্দেহ নেই। “আশেক মাহমুদ এখন চাচ্ছেন আমি যেন আবার নতুন করে কেসটা নিয়ে কাজ করি।”

মুশকানের ছবিটা একহাতে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। কেএস খান।

“ওঁর বােন আর বেশি দিন বাঁচবে না। সম্ভবত উনি চাইছেন এই সময়ের মধ্যে আমি যেন মুশকানকে ধরার ব্যবস্থা করি। এরজন্যে আমাকে সব ধরনের সাহায্য করবেন।”

ছবিটার দিকে তাকিয়েই বলল মি.খান, “এইভাবে টাইম-ফ্রেম কইরা দিলে কিন্তু ইনভেস্টিগেশন করাটা খুব টাফ হয়া যায়। তাছাড়া, আবেগ-টাবেগ দিয়া কোনাে ইনভেস্টিগেশন করাও ঠিক না। ভদ্রলােক ইমােশনাল হয়া গেছে।”  মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা। “ঠিক বলেছেন, স্যার। কিন্তু আমি এই সুযােগটা
নেব।”

ছফার দিকে তাকাল কেএস খান।“কিছু মনে কইরেন না, একটা কথা বলি।” “জি, স্যার  বলেন?”

“পলিটিশিয়ানদের সঙ্গে কাজ করনের ঝক্কি থাকে  আর এইটা বেশি ভােগায় সৎ অফিসারগাে  কাথাটা মাথায় রাইখেন।”তারপর একটু থেমে বলল, “বেসিক্যালি, অল অব দেম আর বাস্টার্ডস! আপনে তাে এখনও সার্ভিসে আছেন, আপনেও এইটা জানেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা।তদন্তে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ, নাক গলানাে, প্রভাব বিস্তার করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ নিয়ে তার নিজের মধ্যেও কম তিক্ততা নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করে, তাতে করে এই বাহনীতে কর্মরতদের মধ্যে কেএস খানের বলা কথাটার বেশ প্রচলন আছে।

“আমি সেটা জানি, স্যার। তারপরও, যেভাবে কেসটা এগােচ্ছিল তাতে করে তাে কোনাে কূলকিনারা করা যাচ্ছিল না, এখন যদি ক্ষমতাবান কারাের কাছ থেকে সব ধরনের সাপাের্ট পাওয়া যায় তাহলে কি সেটা কাজে লাগানাে উচিত না?”

ডিবির সাবেক কর্মকর্তা কিছুই বলল না। যাই হােক, এখন আপনের কাছে মুশকান জুবেরির একটা ছবি আছে।যদিও অনেক পুরানা কিন্তু মহিলার তাে তেমন একটা চেঞ্জ হয় নাই, একই রকম আছে, তাই এই ছবিটা অনেক কাজে দিবাে।”

“হুম,” সায় দিয়ে বলল ছফা। “ছবিটা হাতে পাবার পরই দ্রুত কাজে নেমে পড়েছি, স্যার। আমার দেখাটা হেলুসিনেশান নাকি সত্যি, সেটা যেহেতু নিশ্চিত করে জানি না তাই আমি আজকেই এয়ারপাের্টে গিয়ে সবগুলাে সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইন্সে ছবি দিয়ে এসেছি। দেশের সবগুলাে স্থলবন্দরে ফ্যাক্স করে দিয়েছি ছবিটা।”  ‘ভালাে করছেন,”একটু থেমে আবার বলল কেসকে।“ছবিটা সার্কুলে
ট করা জরুরি ছিল। ওই মহিলা যদি দেশে ঢােকে কিংবা বাইর হওনেরও চেষ্টা করে, তাইলে সে ধরা পড়বাে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল নুরে ছফা।“এখন তাে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না।”

কেএস খানের মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসি যেন বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। “সব সময় যেইটা আমি কই,”লম্বা করে সশব্দে চায়ে চুমুক দিল সে।“যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইব।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল নুরে ছফা। “আপনেরে ফিরা যাইতে হইবাে সুন্দরপুরে।”

“সুন্দরপুরে!”বিস্মিত ছফা ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিল। মুশকান পালিয়ে যাবার পর সুন্দরপুরে এমন কী আছে যে, ওখান থেকে মহিলাকে ট্র্যাক করবে? সুন্দরপুর থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর সমস্ত মনােযােগ নিবদ্ধ করেছিল ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের উপরে। কিন্তু ভদ্রলােক তার হাত থেকে বাঁচতে বিদেশে চলে যান।

“ওখানে গিয়ে আমি কী খুঁজব?” প্রশ্নটা না করে পারল না। “ওই মহিলার সঙ্গে সুন্দরপুরের কারাের কোনাে যােগাযােগ নেই। ঘটনার পর পরই ওখানকার মাস্টারের পেছনে আমার এক বিশ্বস্ত লােককে লাগিয়েছিলাম, কিছু পাইনি। ভদ্রলােক ট্রাস্টি হবার পর স্কুল বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হয় না, মুশকান জুবেরি তার সঙ্গে কোনাে রকম যােগাযােগ রাখে।”

“তারপরও, আপনেরে যদি এই কেসটা আবার শুরু করতে হয়, তাইলে ওইখান থেইকাই শুরু করন লাগবাে,” পুনরায় জোর দিয়ে বলল কেএস খান।

নুরে ছফা চুপ মেরে রইল। অভিজ্ঞ এই ডিবি অফিসারের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করতে পারছে না সে, কিন্তু এটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। – “আপনের কথায় লজিক আছে  তয় পুরানা বাংলা প্রবাদটায় যদি আস্থা রাখেন, তাইলে সেইখান থেইকাই আপনেরে শুরু করতে হইবাে আবার।”

অধ্যায় ১২

এক সময় দূর দুরান্ত থেকে যে রেস্তোরাঁয় ছুটে আসত লােকজন, সেটার উলটোদিকে, রাস্তার ওপারে চায়ের ছােট্ট টঙ দোকানের মালিক রহমান মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশ হল। কালাে মেঘের পুঞ্জ জড়ো হচ্ছে, শেষ বিকেলে ধেয়ে আসছে কালবােশেখি ঝড়। চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠল তার। ওয়াক থু শব্দ করে এক দলা থুতু ফেলল দোকানের পাশে।

আজ সারাটা দিন খুব গরম পড়েছিল, কাস্টমারও খুব বেশি পায়নি। বিকেলের দিকে, সন্ধ্যার পর গ্রামের মানুষজন রােদের তাপ কমলে যে আড্ডা দিতে আসবে, কালবােশেখি মনে হয় সেটা হতে দেবে না। আখের গুঁড়ের যে পিণ্ডটা আছে তার উপরে কিছু মাছি বসেছে কিন্তু অন্য সব দিনের মতাে সেগুলাে তাড়িয়ে দেবার তাগিদ অনুভব করল না। মনে মনে ঠিক করল, আকাশের অবস্থা আরেকটু খারাপ হলেই দোকানের ঝাপি ফেলে বাড়ি চলে যাবে।  আকাশের দিকে ভালাে করে তাকাল রহমান। সে নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় হবে, সেই সঙ্গে হবে বৃষ্টিপাত। এরইমধ্যে গুড়গুড় শব্দ তুলে মেঘ জানান দিচ্ছে সেটা। কালাে কালাে মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশে, পাগলা ষাঁড়ের মতাে ফুঁসে উঠছে যেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আনতেই একটা দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেল। তার টঙ দোকানের পাশ দিয়ে যে সড়কটা চলে গেছে তার ঠিক বামদিকে, পরিত্যক্ত পেট্রল পাম্পটার কাছে একটা ট্যাক্সিক্যাব এসে থেমেছে। গত আড়াই বছরে এটা বিরল ঘটনা। পাম্পটা বন্ধ হবার পর কোনাে গাড়ি সেখানে থামতে দেখেনি।

উৎসুক হয়ে দেখল, একটু পরই গাড়ি থেকে নামল একজন। লােকটাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারল সে। যদিও প্রায় তিন বছর পর দেখল তাকে। ক্ষমতাবান সেই লােকটি গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেটে দাঁড়িয়ে রইল রবীন্দ্রনাথের সামনে।

কয়েক বছর আগে এই লােক ঠিক এভাবেই এক বিকেলে এসে হাজির হয়েছিল সুন্দরপুরে, তারপর এখানে ঘটে যায় কিছু ঘটনা — জমিদার অলােকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়িটা আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়; গােরখােদক ফালু পালিয়ে যায় সুন্দরপুর থেকে; রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের রেস্টুরেন্টটি রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়; পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় এর মালকিন; এরপরই সুন্দরপুরের এমপি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করে।

রহমান মিয়ার মতাে এলাকাবাসিও জানে না এসব ঘটনার পেছনে আসল কারণগুলো কী। তারা কেবল নিজেদের মতাে করে ঘটনাগুলাে বয়ান করে। তবে প্রয়াত এমপির কালােহাত যে ছিল সে-ব্যাপারে কারাের মধ্যে সন্দেহ নেই।

জমিদারের নাতবৌ সেজে সুন্দরপুরে জেকে বসেছিল মুশকান নামের ওই মহিলা। তার রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করে বিক্রি করা হত! গােরখােদক ফালুকে দিয়ে কবরস্তান থেকে কঙ্কাল তুলে ব্যাবসাও করাত সে! – এ ধরণের কথা প্রথম দিকে সুন্দরপুরের অনেকে বিশ্বাস করলেও এখন খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে  বিশ্বাস করে। বরং ইদানীং মানুষজন বলে বেড়ায়, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহ ওই মহিলাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, যাতে করে জমিদার অলােকনাথের স
ব সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে। এমনকি ঢাকা থেকে এক ভাড়াটে পুলিশ এনে লেলিয়ে দিয়েছিল মহিলার পেছনে। শেষে, ওই লােক জমিদার বাড়িতে আগুন দিয়ে মহিলাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায় জমিদারের নাতবউ তার আগে এমপির আশার গুড়ে বালি দিয়ে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দান করে গেছে সুন্দরপুরে একটি স্কুল করার জন্য। ওদিকে হতাশ আর ব্যর্থ এমপি ঢাকায় রাগে-ক্ষোভে, হতাশায় মদ্যপান করতে গিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে, তার নাজুক হৃৎপিণ্ড আর সহ্য করতে পারেনি, মদে ডুবেই সাঙ্গ হয়েছে তার ভবের লীলা।  রহমান দেখতে পাচ্ছে, এমপির ভাড়া করা সেই পুলিশ, যার পেছনে ইনফর্মার আতর ল
াট্টুর মতাে ঘুরত, সেই লােক এখন রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবল বাতাসে লােকটার শার্ট-প্যান্ট লেপটে আছে শরীরের সঙ্গে, চুলগুলাে উড়ছে সেই বাতাসের ঝাপটায়।

রহমান মিয়ার কাছে এটা এক ধরনের অশনি সংকেত। তার অন্তরাত্মা বলে উঠল, এই লােক সঙ্গে করে ঝড় নিয়ে এসেছে সুন্দরপুরে! খারাপ কিছু হবার আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠল তার মনে।

****

একটু আগেও রােদের উত্তাপ ছিল, কোত্থেকে যে মেঘ এসে ভর করল আকাশে! এখন রীতিমতাে প্রবল বাতাস বইছে। সূর্য ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে, কমে এসেছে আলাে। প্রকৃতির যে রূপ সেটা দেখে ভােরের মতাে লাগছে নুরে ছফার কাছে।

একটুআগে দূর থেকে পেট্রল পাম্পটা দেখতে পেয়ে ট্যাক্সিক্যাবের ড্রাইভারকে বলেছিল, রাস্তার বামপাশে রাখতে গাড়িটা। ডাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। পেট্রলপাম্পটা যে পরিত্যক্ত সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি তার। যে কেউ দেখে বুঝতে পারবে, দীর্ঘদিন থেকেই ওটা আর সচল নেই। মাঝারি আকারের ফ্রিজের মতাে দেখতে ফুয়েল ডিসপেন্সরগুলাে ধুলােয় মলিন। অফিস ঘরটিও বন্ধ, বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। প্রবল বাতাসে পাম্প স্টেশনের পাকা ছাউনির উপরে কোনােমতে ঝুলে থাকা সাইনবাের্ডটা দুলছে ক্যাচক্যাচ শব্দ করে। সামনের প্রাঙ্গণে ছােটোখাটো ধুলাের ঝড় বয়ে যাচ্ছে এখন।  পেট্রল পাম্প স্টেশনটা পেরিয়ে, আর-একটু সামনে গিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখেছিল। তিনবছর আগের পরিচিত জায়গাটা এখনও রবীন্দ্রনাথ’ টিকে আছে।

এখন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টের সাইনবাের্ডের বেশির ভাগ অংশ হারিয়ে এখনও টিকে আছে শুধুমাত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ! আগে যেটা রেস্টুরেন্টের সামনের প্রাঙ্গণ আর পার্কিং এরিয়া ছিল সেটা এখন ছােটোখাটো বাগান। সেই বাগানের মাঝখান দিয়ে দশ-বারাে ফুটের মতাে প্রশ্বস্ত একটি রাস্তা চলে গেছে প্রধান ফটক পর্যন্ত। দু-পাশের ফুলের বাগানটি বড়ােজোর কয়েক মাস আগে করা।

ছফা ভেবেছিল এই স্থাপনাটি আর দেখতে পাবে না। কিংবা সেটা হয়তাে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাবে।

তিন বছর পর নুরে ছফা আবার পা বাড়াল রবীন্দ্রনাথের দিকে!

অধ্যায় ১৩

“ওইদিকে তাকায়া আছে ক্যান, মিয়া?”  কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠল রহমান, রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেল আতর আলি দাঁড়িয়ে আছে তার দোকানের সামনে। লােকটাকে দেখে অবাক হল মাথা যখন দেখা গেছে লেজটা তাে দেখা যাবেই!  “এক কাপ চা দাও,”দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চটায় বসে বলল আতর।
সাথে একটা বেনসনও দিও।”

আতর আর সেই আতর নেই, তার বেশভুষাও বেশ বদলে গেছে। আড়ালে আবডালে তাকে ইতর বলার লােকজনও দিন দিন কমে আসছে এখন। তবে রহমান মিয়ার কাছে সে সব সময়ই আস্ত একটা ইতরের বাচ্চা।

“এই অবেলায় এইহানে কী মনে কইরা?” প্রশ্নটার জবাব জানা সত্ত্বেও বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল রহমান। “ইট্টু বাদে তাে তুফান আইবাে।”  ‘কাম না থাকলে এই আতর মুততেও আইতাে না তােমার দোকানে,”তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল সুন্দরপুর থানার ইনফর্মার।

“তা, কী কাম তুমার এই ঝড়-তুফানের দিনে?” সিগারেটটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল দোকানি। “আজকাইল তাে এইহানে বেশি আহাে না  টাউনেই
নাড় গাঁড়ছো।”

সিগারেটটা লাইটার দিয়ে ধরাল আতর, দীর্ঘ একটা টান দিয়ে রহস্যময় হাসি দিল। “এত কিছু তােমার জানােনের দরকার নাই, তুমি চা বানাও।”

বাঁকাহাসি দিল রহমান। দ্রুত এক কাপ গুড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। কমদামি বিড়ি সিগারেট আর গুল খাওয়া আতর আলি এখন বেনসন ছাড়া অন্য কিছুমুখেই তােলে না। বিগত তিন বছরে তাকে কেউ গুল খেতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। সবই কপাল।শহর থেকে এক লােক এসে এই ইতরের ভাগ্যটাই বদলে দিয়েছে। এখন একটা বাইকও কিনেছে সে। সারাদিন ওটা নিয়েই ছুটে বেড়ায় সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকায়। একশাে সিসির ছােটোখাটো পুরােনাে সেই বাইকটা যখন ইনফর্মার চালায় তখন রহমানের কাছে মনে হয়, দুর্বল আর নিরীহ ছাগলের পিঠে বুড়ো একটা শেয়াল সওয়ার হয়েছে।

“তুমার ভটভটি কই?”

রহমানের দিকে তাকাল আতর। এই বদটা তার মােটরসাইকেলকে ভটভটি বলে ডাকে সব সময়। এটা যে ঈর্ষা করে বলে তা ভালাে করেই জানে। রাগ দমন করে বলল, “মিস্তিরির কাছে দিছি  এটু টেরাবল দিতাছিল।”

রহমান মিয়া দাঁত বের করে হাসল। “পুরানা জিনিস কিনলে তাে টেরাবল দিবােই।”  কিছু বলতে গিয়েও বলল না আতর। মানুষের এমন ঈর্ষা উপভােগ করে সে।কিন্তু এ মুহূর্ত
ে সেটা পুরােপুরি উপভােগও করতে পারছে না নিজের ভেতরে থাকা অস্থিরতার কারণে।

রহমান আড়চোখে দেখতে পেল ইনফর্মার বার বার সড়কের দিকে তাকাচ্ছে। পকেট থেকে মােবাইলফোনটা বের করেও একবার দেখে নিয়েছে এরমধ্যে।  “ক্যাঠায় আইবাে?” চামচ দিয়ে চায়ের সঙ্গে গুড় মেশাতে মেশাতে জানতে চাইল দোকানি। “কার লাইগ্যা এতাে পেরেশান হয়া আছাে?”

সিগারেটে টান দিয়ে একটু ঝারি মেরেই বলল আতর, “এত কথা কও ক্যান, অ্যা? আদার ব্যাপারী তুমি  খালি জাহাজের খবর নিতে চাও!”

মুখে সেই বাঁকাহাসি ধরে রেখেই চায়ের কাপটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিল রহমান মিয়া। “আমি ব্যাপারী অইতে যামু কুন দুঃখে! তয় আমি কইলাম আন্ধা না, সব কিছু দেখবার পারি।”

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল আতর, “কী দেখছাে তুমি?” তারপর পিরিচে চা ঢেলে সশব্দে আয়েশ করে চুমুক দিল।

“এই অবেলায় এইহানে ক্যান আইছাে আমি জানি,”বিজ্ঞের মতাে বলল রহমান।

আতর আলি পায়ের উপর পা তুলে একহাতে সিগারেট আর অন্য হাতে পিরিচ ধরে রেখেছে। চায়ের কাপটা রেখেছে তার পাশে বেঞ্চের উপরে। “কও কী, মিয়া!” কৃত্রিম বিস্ময়ের ভাব করল সে। “তুমিও কি নিজেরে বিবিচি ভাবােনি?”

পিরিচটা রেখে পকেট থেকে আবারও ফোনটা বের করে দেখে নিল, একটা নাম্বারে কল দিয়ে কানে ফোনটা ঠেকিয়ে রাখল কিছুক্ষণ, একটু পর চিন্তিত ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখল সেটা। রহমান মিয়াকে হাসতে দেখে অবাক হল সে।  “ওই মিয়া  হাসাে ক্যান?” একটু রেগেই বলল।

“না এমনেই,” দোকানি বলল হাসিমুখে।

“ঠিক কইরা কও তাে, হাসতাছাে ক্যান  মিজাজ খারাপ করবা না কইলাম!” মৃদু হুমকি দিয়ে বলল ইনফর্মার।

“আমি হইলাম আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর জানাই কেমতে!” ভুরু কুঁচকে ফেলল আতর।“বুঝলাম না, কী কও তুমি?” “যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছ সে তাে বেটির হুটেলে ঢুকছে এট্টু আগে।

রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে বলল রহমান।

অবাক হয়ে রাস্তার ওপারে তাকাল আতর। “ওইটা কি এহন আর হোটেল আছেনি অ্যা?”তারপরই টনক নড়ল তার। “কার কথা কইতাছাে তুমি? কে ঢুকছে ঐহানে?

“কইলাম না, তুমি যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছ।”

আতর আলি কয়েক মুহুর্ত ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল দাঁত বের করে দোকানির দিকে, তারপর হুট করেই উঠে দাঁড়াল।“ধুর মিয়া! খালি ফালতু প্যাচাল পারো আগে কইবা না!” কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হল সে।

“আরে, আমার ট্যাকা ?”

রহমান জোরে বলে উঠল পেছন থেকে কিন্তু আতর সে-কথা কানেই তুলল না হনহন করে ছুটে গেল রবীন্দ্রনাথের দিকে। এক কাপ চা আর সিগারেট বিক্রি করতে সে আসল কথাটা দেরি করে বলেছিল, কিন্তু কোনাে লাভ হল না। বাকির খাতায় যােগ হলো আরও কিছু টাকা।

‘ইতরের বাচ্চা ইতর!” চোখমুখ বিকৃত করে বলল সে। “কয়লা, ধুইলেও যায় না ময়লা। খাইসলত এহনও আগের মতােই আছে।”

অধ্যায় ১৪

প্রায়য তিন বছর আগে সুন্দরপুরে এসে যেখানে প্রথম প্রবেশ করেছিল, সেখানে পা রাখতেই বিস্মিত নুরে ছফা।

তখন তাকে প্রলুব্ধ করেছিল মাদকতাপূর্ণ খাবারের গন্ধ আর সুতীব্র কৌতূহল। এখনও তার মনে কৌতূহল রয়েছে, তবে সুস্বাদু খাবারের কোনাে গন্ধ পাচ্ছে না। যদিও পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী খাবারে পরিপূর্ণ আছে ঘরটা!

বই।

রবীন্দ্রনাথের ভেতরটা আর আগের মতাে নেই। আগের মতাে যে থাকবে সে আশাও করেনি, তবে চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি! পাতা ওলটানাের খসখসেশব্দটা শুনতে পেল।হাতেগােনা কিছু পাঠক একমনে বই পড়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরীর চিরায়ত দৃশ্য।  নুরে ছফা দরজা খুলে ঢুকতেই সেই ঝড়ো বাতাসের কিছুটা ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভেতরে। বই পড়ুয়ারা মুখ তুলে তাকালেও আবারও ফিরে যায় শব্দের জগতে। এক সময়কার রেস্টুরেন্টের দেয়ালগুলাে দখল করে আছে বইয়ের শেল্ফ। আর সেগুলােতে
ঠাঁই করে নিয়েছে অসংখ্য বই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিন বছর আগের দৃশ্যটার সঙ্গে এক ধরণের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিল সে–প্রথমবার দেখেছিল চার-পাঁচজন ভােজনরসিক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে খাবারের আস্বাদন নিচ্ছে, আর এবার দেখেছে অল্প বয়সি কিছু পাঠক ডুবে আছে বইয়ের পাতায়। চারপাশে বইয়ের শেলফের মাঝে দুটো বিশাল রিডিং টেবিলে বসে আছে নিবিষ্ট পাঠকের ছােট্ট দলটি। মাথার ওপরে ঘুরছে সিলিংফ্যান। সেগুলাের গুঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নেই।

একটু আগে রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ছফা খুবই অবাক হয়েছিল। রেস্টুরেন্টের সুদীর্ঘ নামটি একটিমাত্র শব্দে রবীন্দ্রনাথ’হয়ে এখনও টিকে আছে বলে।

সুন্দরপুরে এত কিছু ঘটে যাবার পর কী করে নামটা টিকে আছে!

যেহেতু এটা আর এখন রেস্টুরেন্ট হিসেবে নেই। তাই শুধু ‘খেতে’ নয়, এখানে কখনও আসেননি’ও বাদ দেওয়া হয়েছে— যদিও সুন্দরপুরের জন্য এটাই সত্যি।  পুরােনাে রবীন্দ্রনাথ’ সাইনটার নীচে ছােট্ট করে যুক্ত করা হয়েছে স্মৃতি গ্রন্থাগার
লেখাটি।

রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগার!

সুন্দরপুরের মতাে কোনাে অঞ্চলে এরকম একটি লাইব্রেরী আছে দেখে খুশিই ছফা। কাজটা যে মাস্টার রমাকান্তকামারের সেটা বুঝতে বাকি রইল না। যত বড়ো ক্রিমিনালই হােক না কেন, জায়গা-জমি যােগ্য একজনের হাতে।  ছফা দেখতে পেল ঘরের এককোণে বিশাল আকারে একটি গ্লোবও রা
খা বই ছাড়াও আছে বেশ কিছু মনীষীর ছবি। তার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বড়ো ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে চোখ গেল এবার। ওটাও একটা ছবির ফ্রেম তবে তাতে কোনাে ছবি নেই। বিশাল একটি বাদামি কাগজে কিছু লেখা। ছফা যেখানে আছে সেখান থেকে লেখাটা পুরােপুরি স্পষ্ট নয়। এই প্রথম সে টের পেল চল্লিশের আগেই চালশে অবস্থা তার। ছােটো ছােটো অক্ষরগুলাে পড়তে বেগ পাচ্ছে। আর-একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল। লেখাটা যেই না পড়তে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ পেছন থেকে বলে উঠল :

“স্যার! কখন আইলেন?”

কথাটা এত জোরে উচ্চারণ করা হল যে, নুরে ছফাসহ লাইব্রেরীতে থাকা চার-পাঁচজন পাঠকের প্রায় সবাই চমকে ঘুরে তাকাল।

“আমি তাে আপনেরে ফোন দিসিলাম কিন্তু ফোন-”

“আস্তে!”মৃদু ধমকের সুরে আতর আলিকে চুপ করিয়ে দিল ছফা। ভ্যাবাচ্যাকা খেল ইনফর্মার। তাকে নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে গেল ছফা।

“কী হইছে, স্যার?” আতর বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইল বাইরে এসে। তাকে কেন আস্তে কথা বলতে বলছে বুঝতে পারল না।

“আরে, দেখছোনা এটা একটা লাইব্রেরী,”বলল ছফা। “তাে কী হইছে!” আতর এখনও বুঝতে পারছে না। এই লােককে লাইব্রেরী কালচার নিয়ে জ্ঞান দেবার কোনাে ইচ্ছে নেই ছফার।

“কিছুনা,”বলেই রবীন্দ্রনাথের সামনের খােলা প্রাঙ্গণে কাছে এসে দাঁড়াল সে। প্রবল বাতাসের সঙ্গে ধুলাে উড়ছে এখন। বৃষ্টি আসি আসি করছে। অনেক দিন পর দেখা হল  এখন বলাে, কেমন আছ?”

দাঁত বের করে হেসে ফেলল আতর আলি।“আমি ভালাই আছি স্যার, আপনের ফোন বন্ধ পাইয়া আমি তাে অস্থির হয়া গেছিলাম।”

“আসার পথে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিল, তাই তােমাকে কল দিতে পারিনি। এর আগে ইনফর্মারের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল, সুন্দরপুর ঢুকেই তাকে কল দেবে।  বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই তারা দু-জন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রবেশদ্বারের সামনে শেডের নীচে এসে দাঁড়াল।  আপনে
কেমন আছেন, স্যার?”জিজ্ঞেস করল ইনফার। “এইদিকে তাে আর আসেনই না।”

কাজের অনেক চাপ,” ছফা বলল। “অনেকগুলাে কেস তদন্ত করছি, দম ফেলার সময় পাই না।”

আপনেরে দেইখ্যা কী যে ভালা লাগতাছে!”আন্তরিক ভঙ্গিতেই বলল আতর। মচকি হাসল ছফা। সুন্দুরপুরের ইনফর্মারের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে তার জামা-কাপড় একটু গােছালাে আর দামি। মাথার চুলগুলােও পরিপাটি।নিয়মিত গােসল করে বলেও মনে হচ্ছে।

তা, বলাে  এখানকার খবর কী?” এমনি জানতে চাইল। “খবর তাে
ভালাই,”বলল আতর, “কতকিছু যে হয়া গেছে, কী আর কমু আপনেরে।”

সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার পর আতরের সঙ্গে কয়েক মাস যােগাযােগ ছিল ছফার। মাস্টারের পেছনে লেলিয়ে দেবার পরও যখন দেখা গেল উল্লেখযােগ্য কিছু পাওয়া যাচ্ছে না তখন ধীরে ধীরে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে সে, আতরের সঙ্গেও যােগাযােগ কমে যেতে শুরু করে। এরপরও ইনফর্মার তাকে মাঝেসাঝে ফোন দিয়ে জানাত মাস্টারের স্কুল নিয়ে ব্যস্ততার কথা, সেসবের প্রতি কোনাে আগ্রহ তার ছিল না। এক পর্যায়ে আতরের ফোন ধরাও বন্ধ করে দেয় সময়ে অসময়ে ফোন দিত সে নানান ধরনের তদবির নিয়ে! উপরন্তু দু-বছর আগে পুরােনাে ফোন নম্বরটা পালটে ফেলায় আতরের পক্ষে আর যােগাযােগ করা সম্ভব হয়নি দীর্ঘদিন।

“রহমান মিয়ার টঙ দোকানটা দেখলাম আগের মতােই আছে।”

ছফার মুখ থেকে রহমান মিয়ার নামটা শুনে ভেতরে ভেতরে মর্মাহত হল আতর। প্রসঙ্গ পালটে ফেলার জন্য সে বলল, “মাস্টরের কিন্তু এখন বিরাট অবস্থা। এই যে দেখতাছেন ”রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করল, “এইটা তাে মাস্টরেরই কাম। বিরাট বড়ো একটা স্কুলও দিছে, কত কী যে ”

আতরকে এভাবে কথার মাঝখানে থেমে যেতে দেখে অবাক হলো নুরে ছফা।ইনফর্মারের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকাল। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, চোখে মােটা কাচের চশমা আর গালে শুভ্র লম্বা দাড়ি-গোঁফ-সৌম্যকান্তির অবয়বটি দেখেই চিনতে পারল সে।

মাস্টার রমাকান্তকামার বগলে চামড়ার ব্যাগ আর হাতে একটি কালাে রঙের ছাতা নিয়ে বের হয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে।

ছফা বুঝতে পারল লাইব্রেরীর ভেতরে যে ছােট্ট একটি অফিস ঘর আছে, এতক্ষণ নিশ্চয় সেখানে ছিলেন।

মােটা কাচের চশমার ভেতর দিয়েও বােঝা যাচ্ছে। ছফাকে দেখতে পেয়ে রমাকান্তকামারের চোখদুটোতে নেমে এসেছে বিস্ময়।

“আদাব, মাস্টারসাহেব  ভালাে আছেন?” বলল ছফা।

আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলােক। “আপনি?  এখানে ?!” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি।

অধ্যায় ১৫

নুরে ছফা চায়নি সুন্দরপুরে পা রাখতেই মাস্টার রমাকান্তকামারের  সঙ্গে দেখা হয়ে যাক।  সে জানত না লাইব্রেরীতে এ সময় মাস্টার থাকবেন। ভদ্রলােকের মুখােমুখি
হওয়ার চেয়েও, বেশি অস্বস্তিকর ছিল তার করা প্রশ্নটি।

আপনি এখানে? ছফা এর জবাবে কী বলবে ভেবে পায়নি। কয়েক মুহূর্ত লেগে গেছিল জবাব দিল “এইতাে একটা কাজে আসতে হল আবার।”একটু সময় নিলেও বলতে পেরেছিল। “বৃষ্টির কারণে এখানে আটকা পড়ে গেছি।”

মাকান্তকামার অবশ্য বেশি কিছু জানতে চাননি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ ফুটিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে যান।

“বিকালবেলা মাস্টর এইহানেই থাকে,”রমাকান্তকামার চলে যাবার পর বলল আতর আলি। “দুনিয়ার যত বই আছে কিইন্যা ভইরা ফালাইতাছে, পােলাপানের মাথা খাইয়া ফালাইছে এক্কেবারে।”

ছফা এ কথার জবাবে কিছু বলল না। আতর আলির মতাে লােকের কাছে কেন, অনেক ভদ্র আর সজ্জন মানুষও বই পড়াকেফালতু কাজ হিসেবে দেখে এ দেশে।তার ছােটোবেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার আগে গল্পের বই পড়তে গিয়ে বাবার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তারপর সে কী বকুনি! যেন বিশাল এক গর্হিত কাজ করে বসেছে।

আতর আরও বক বক করে গেল। সুন্দরপুরে বিগত তিন বছরে কী কী ঘটেছে তার সবটাই যেন এক লহমায় উগলে দিতে চাইছে সে। বাইরের বৃষ্টি দেখে দেখে কিছুটা আনমনা হয়ে ছফা তার কথা শুনে গেল।

এমপির মৃত্যু সুন্দরপুরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিন মাস পর উপনির্বাচনে নতুন যে এমপি নির্বাচিত হয়েছে, মানুষ হিসেবে সে বেশ সজ্জন। নতুন এমপি বয়সে তরুণই বলা চলে। রমাকান্তকামারের সাবেক ছাত্র সে। স্নেহধন্য ছাত্র এমপি হবার পর তার সাহায্যে খুব দ্রুতই জমিদারবাড়িতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয় নামে একটি স্কুল। এ অঞ্চলের সবচাইতে বড়ো আর অন্য রকম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গান-ছবি আঁকাসহ অনেক কিছুই শেখানাে হয়।

“আগের এমপি যেইসব জায়গা-জমি দখলে রাখছিল সেইগুলা দখল কইরা

স্কুলে দিয়া দিছে,”আতর বলতে লাগল।“বেটা তাে মরছেই, হের জায়গা-জমিও সব গেছে।এই যে, পেট্রল পাম্পটা আছে না  ওইটাও বন্ধ কইরা দিছে এমপিসাবে।
হুনতাছি, ওইটা নিজেই লিজ নিবাে।”

আগের এমপির ছেলেমেয়েরা বাধা দেয়নি, মামলা-মােকদ্দমা করেনি?”

তেনারা তাে বিদেশে থাকে, এইসব নিয়া হাউকাউ ক্যামনে করবাে! কইরা কোনাে লাভ হইবাে? কাগজপত্রে ঘাপলা আছে না?”

“আচ্ছা, ফালুর কোনাে খবর জানাে? সে আর সুন্দরপুরে আসেনি?”

আতরের মুখ তিক্ততায় ভরে উঠল।“চুতমারানির পােলায় ” গালিটা দিতেই সামলে নিল সে। “আইছিল তাে রাইতের বেলায়  বইনের লগে দেহা করতে! চোরের মতাে আইছে আবার চোরের মতােই কাইট্টা পড়ছে। আমি যদি ওরে পাইতাম, মাটিতে পুইত্যা ফালাইতাম!” শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে বলল ইনফর্মার। ফালু যে তাকে জিন্দা কবর দেবার ব্যবস্থা করেছিল সেটা এখনও ভােলেনি।

“ওই রাতকানা মেয়েটা এখনও আছে?” একটু অবাক হল ছফা।

“হ। ওই মাইয়া এহন মাস্টরের স্কুলে কাম করে। স্কুলটা ম্যালা বড়ো  কতজন যে কাম করে জানেন না।”

“ফালু যে এখানে এসেছিল সে-কথা তুমি জানলে কীভাবে?”

দাঁত বের করে হেসে ফেলল আতর। “মাস্টরের স্কুলে আমার এক লােক আছে, স্যার,” খুবই গর্বিত ভঙ্গিতে জানাল কথাটা।“হে আমারে কইছে।”

গােরখােদক ফালুকে নিয়ে অবশ্য ছফার কোনাে আগ্রহ নেই, যেমনটা আগ্রহ আছে তার সিনিয়র কেএস খানের মধ্যে।  “আচ্ছা, এখানে আসার পর দেখলাম রহমান মিয়া আগের জায়গাতেই আছে,” প্রসঙ্গ পালটানাের জন্য বলল সে। “তার ব্যাবসা কেমন চলে এখন? রেস্টুরেন্টটা তাে নেই, মানুষজন আসে এখানে?”

“পাম্পটাও তাে বন্ধ,”আতর বলল।“এই রােডে এহন আর গাড়িঘােড়া থামে না  হের ব্যাবসা উঠছে চাঙ্গে। তয় অন্য কিছু তাে করবার পারে না, পারে খালি গুড়ের চা বানাইতে, আর গপসপ করতে। হেরে কইছিলাম, নতুন হােটেল দুইটার সামনে গিয়া নাড় গাঁড়ো, এইখানে তাে কেউ মুততেও আহে না সারাদিনে। কিন্তু হে তাে আইলসা, বইস্যা বইস্যা
থাকে”

“নতুন দুটো হােটেল হয়েছে মানে?”ইনফর্মারের কথায় বাধা দিয়ে জানতে চাইল ছফা।  জিভে কামড় দিল আতর আলি, যেন মূল্যবান একটি তথ্য জানাতে ভুলে গেছিল। “আপনেরে তাে কইনাই, বেটির হােটেলের দুই পােলায় বিরাট বড়ো আকাম করা ফালাইছে। গত বচ্ছর হিটলুু হারাম
জাদা বেটির হােটেলটা আবার দিছে, তারে দেইখ্যা ফজলুও আর-একটা দিছে। হালারপুতেগাে মাথায় চিকনা বুদ্ধি গিজগিজ করে!”

অধ্যায় ১৬

নিজের বাড়ির বারান্দায় ভেজা ছাতাটা মেলে রাখলেন রমাকান্তকামার। বৃষ্টির প্রকোপ এখন কমে এসেছে, আর কিছুক্ষণ পরই থেমে যাবে। এরইমধ্যে নেমে গেছে সন্ধ্যা।মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে রাত বলেই মনে হচ্ছে।

পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি।বিদ্যুৎ চলে গেছে, ঘরে ঢুকে পুরােনাে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে দিলেন। অন্ধকার তার কাছে সব সময়ই অপ্রিয়। তিনি পছন্দ করেন আলাে, সেই আলােয় অন্যকে আলােকিত করতে সারাটা জীবনই চলে গেছে এ কাজ করে করে। এখন জীবন সায়াহ্নে এসে হাতে একটি আলােকবর্তিকা পেয়ে গেছেন। সেটা দিয়ে যতটুকু সম্ভব অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মনেপ্রাণে চাইছেন, তার অনুপস্থিতিতেও যেন এই কর্মযজ্ঞ থেমে না যায়। কয়েক বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রম করে অবশেষে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। কিন্তু সবকিছু যখন গুছিয়ে নিয়ে এসেছেন, তখনই সুন্দরপুরে এসে হাজির হয়েছে ওই লােকটি।

নুরে ছফা।

একটু আগে তাকে লাইব্রেরীর সামনে দেখামাত্র এক ধরণের আশঙ্কা জেঁকে বসেছে। তার মধ্যে। মনে হচ্ছে, অশুভ কিছু ঘটবে আবার। বিগত তিন বছর ধরে এই লােকের কোনাে টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তাহলে কী কারণে আবার এসেছে এখানে?  ভাবনাটা মাস্টারের মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। তিনি এমন কিছু করেননি, এমন কিছুতে জড়িত নন যে, একজন পুলিশকর্মকর্তার আগমনে বিচলিত হয়ে উঠবেন। এসবই নিছক আশঙ্কা। সম্ভবত, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর তার মধ্যে সবকিছু হারানাের ভয় জেঁকে বসেছে। আগে তার কিছুই ছিল না, হারানােরও কোনাে ভয় ছিল না তখন।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। এই এক জীবনে কম তাে দেখলেন না।উত্থান আর পতনের খেলাটা যেন তার কাছে ঋতুচক্রের মতােই ” ফিরে আসে বার বার।

ঘরের জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরে তাকালেন। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার ভাবনায় খেলা করে যাচ্ছে অনেক কিছু। স্মৃতিভারাক্রান্তও হয়ে পড়লেন তিনি।

এক সময় তার অনেক কিছুই ছিল, তারপর সবকিছু কেড়ে নিল পাক হানাদারেরা।

তারপর কিছু ফিরে পেলেন স্কুলের ছােটোছােটো বাচ্চাগুলােকে আলােকিত করার জন্য। সেগুলােও এক সময় হাতছাড়া হয়ে গেল। সারাজীবনের যে ব্রত ছিল শিক্ষকতা করার, সেখান থেকেও বিতারিত করা হল তাকে। অবশেষে জীবনের শেষ সময়ে এসে, অনেকটা আচমকাই জাদুমন্ত্রের মতাে সবকিছু পালটে গেল চোখের নিমেয়ে। তিনি পেয়ে গেলেন তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সােনার চাবিকাঠি! আর সেটা এমন একজনের কাছ থেকে, যার ব্যাপারে তার মনে ছিল যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয়।শঠ আর ধান্দাবাজ মানুষজন তিনি সারাটা জীবন এড়িয়ে চলেছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন এতটাই বড়ো ছিল যে, তিনি আর এসব পরােয়া করেননি। নিজেকে এই বলে প্রবােধ দিয়েছেন, যা করছেন বৃহত্তর স্বার্থেই করছেন। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিছু করছেন না।

তাছাড়া মুশকান জুবেরি যা করেছে সেটা জমিগুলাের আসল মালিকের ইচ্ছের বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছু না। জমিদার বাড়ির সম্পত্তিগুলাে কখনও তার ছিল না। যখন বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতেও থাকবে না, তখন সেগুলাে যাকে দেবার তাকে দিয়ে চলে গেছে। রাশেদ জুবেরি মৃত্যুর আগেই বলে গেছিল, তার নামে থাকা বিশাল সম্পত্তির প্রায় সবটাই যেন ট্রাস্টে দিয়ে দেওয়া হয়। ওই মহিলা চাইলে তার রেস্টুরেন্টের জায়গাটাসহ আরও কিছু জমি রেখে দিতে পারত, কিন্তু সুন্দরপুরে যখন আর থাকা সম্ভব নয় তখন ওই সম্পত্তিগুলােও স্কুলের ট্রাস্টে দিয়ে দিয়েছে সে।  রাশেদ জুবেরির কথা মনে পড়ে গেল। বেশ সখ্য ছিল মাস্টারের সঙ্গে। তিনি ভালাে করেই
জানেন, মায়ের বাপের কাছ থেকে পাওয়া সুন্দরপুরের জমিজমাগুলাে নিয়ে রাশেদের মধ্যে কোনাে আগ্রহ ছিল না কোনাে কালে। মনেপ্রাণে চাইত জমিগুলাে যেন ভালাে কাজে ব্যবহার করা হয় মাস্টারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বেশ কয়েক বার রাশেদ তাকে বলেছিল, এখানকার জায়গাজমিগুলাের প্রতি তার কোনাে আগ্রহ না থাকলেও তার ঠাকুরদার বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। সে চায় না, ওগুলাে খারাপ লােকের খপ্পরে পড়ে থাকুক। বিশেষ করে যে-লােক তার মা-সহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করিয়েছে, তারই কুপুত্র ওগুলাে ভােগদখল করবে এটা কোনােভাবেই হতে দেবে না সে। জমিগুলাে উদ্ধার করে ভালাে কাজের জন্য দান করে দেবে। কী কাজে দান করা হবে সেটা জানতে ইচ্ছে করলেও মাস্টার জিজ্ঞেস করেননি কখনও। তবে রাশেদ নিজে থেকেই বলেছিল, সময় হলে নাকি মাস্টারই সবার আগে সেটা জানতে পারবেন।

মুশকান জুবেরি যে উদ্দেশ্যেই এখানে এসে থাকুক, যা-ই করে থাকুক, তার সঙ্গে রমাকান্তকামারের কিংবা অলােকনাথ বসুর সম্পত্তিগুলাের কোনাে সম্পর্ক নেই। ওগুলাের নিয়তিই হয়তাে এমন ছিল : কতগুলাে কালােহাত ঘুরে শেষমেষ ভালাে কাজের জন্যই ব্যবহৃত হবে।

মহিলা সুন্দরপুর না এলে অবশ্য এত কিছু ঘটত কিনা সনে হয়তাে ওই কোলাবরেটরের ছেলে আসাদুল্লাহর করায়ত্তেই থাকত। নুরে ছফা নামের লােকটা না এলেও মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে সহসা পালাতো কিনা সন্দেহ আছে। জমিগুলােও মাস্টারের কাছে দিয়ে যেত কিনা সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে ছফার কাছেও মাস্টার কিছুটা ঋণী। কিন্তু লােকটার চাতুর্য তার কাছে ভালাে লাগেনি।সুন্দরপুরে এমনও গুজব আছে, ওই লােক আসলে আসাদুল্লাহর হয়েই ঢাকা থেকে উড়ে এসে মহিলাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করার চেষ্টা করে শেষে উপায় না দেখে জমিদার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টাও করে। কিন্তু মহিলা প্রাণ নিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যায়।

।অবশ্য অন্য রকম গুজবও আছে।মুশকান জুবেরি নাকি বিরাট বড়ো এক অপরাধী।কী অপরাধ করেছে সে-ব্যাপারে সুন্দরপুরবাসীর কোনাে ধারণা নেই। তারা এমপির চক্রান্তের গল্পটাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে বিশ্বাস করে এখন।

আজ প্রায় তিন বছর পরে আবারও সেই লােক এসে হাজির হয়েছে সুন্দরপুরে। আবারও অশুভ কিছু ঘটবে বলেই আশঙ্কা করছেন মাস্টার। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনাে ঘটনাই যেন তার স্বপ্নের স্কুল আর লাইব্রেরীটাকে ছুঁতে না পারে।

অধ্যায় ১৭

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি।

তিক্ততার সঙ্গেই সাইনবাের্ডের লেখাটা পড়ল নুরে ছফা। বেশ বড়ো করেই লেখা হয়েছে নামটা। সাইনের ফন্ট অবিকল আগেরটার মতােই, তবে সেটার নীচে ছােট্ট করে লেখাঃ রেস্টুরেন্ট।

রবীন্দ্রনাথের উলটোদিকে তাকাল সে। মুশকান রেস্টুরেন্ট।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। সুন্দরপুর টাউনে, সুরুত আলির নােংরা হােটেল থেকে কয়েকশাে গজ দূরে, রাস্তার দু-পাশে এই দুটো রেস্টুরেন্ট ঝড়বাদলা শেষে, ভর সন্ধায়ও কাস্টমারের ভিড়ে গমগম করছে। দেখলেই বােঝা যায় বেশ নতুন।আকার এবং আকৃতিও প্রায় সমান। যেন অলিখিত একটি প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়েছে তারা।

আতর আলি তাকে বলেছে, এ দুটো রেস্টুরেন্ট দিয়েছে মুশকান জুবেরির সাবেক দুই কর্মচারী হিটলুু আর ফজলু-অন্য সব কর্মচারীর মতাে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি বন্ধ হবার পর বেকার হয়ে পড়েছিল তারা। একজন আগের রেস্টুরেন্টের নামটা প্রায় হুবহু বগলদাবা করলেও অন্যজন খােদ মুশকান জুবেরিকেই আত্মসাৎ করে ফেলেছে। চতুর ওই কর্মচারী আগের নাম থেকে ‘খেতে’ শব্দটা বাদ দিয়েছে সম্ভবত আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। যদিও ছফা নিশ্চিত, মুশকান কখনও রেস্টুরেন্টের নামটা দাবি করে আইনি পদক্ষেপ নেবে না, ফিরে আসবে না সুন্দরপুরে।

তিন বছর আগে, সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের কর্মচারীরা রাতারাতি বেকার হয়ে পড়েছিল। চাকরিহারা মানুষগুলাের সবাই নতুন কাজ জুটিয়ে নিতে পারেনি, বেশির ভাগই বেকার হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে কিছু দিন। এই অঞ্চলে এমন রেস্টুরেন্ট নেই, যেখানে কাজ করে, তারা আগের মতাে বেতন-ভাতাসহ সুযােগ-সুবিধা পাবে। তাে তাদের মধ্যে প্রথমে হিটলুু নামের এক কর্মচারী এগিয়ে আসে, সাহস করে দিয়ে বসে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট প্রায় হুবহু আগের নামটার মতােই।

দ্বিতীয়জনের বুদ্ধি খুলেছে একটু দেরিতে। সে রেস্টুরেন্টের নামটা করায়ত্ত করতে না পারলেও স্বয়ং এর মালকিনকেই নিয়ে নিয়েছে।

কর্মচারী দু-জন যেমন চালাক, তেমনি সৃজনশীলও বটে!

বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছে, অল্প খরচেই ছিমছাম সাজগােজ করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট দুটোর। সাধারণত অন্য রেস্টুরেন্টগুলােতে সামনের দিকটায় চুলা রাখা হয় গরম গরম পরােটা, লুচি, পুরি, ডিম ভাজার জন্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি আর মুশকান একটু ব্যতিক্রম, আগেরটার মতােই।

সামনের একচিলতে যে খালি জায়গাটুকু আছে, সেখানে ফুলের টব বসানো হয়েছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে জায়গাটার দু-পাশ ঘেরা। সেই বেড়াতে আবার সাদা লাল রং করা। রেস্টরেন্ট দুটো জমজ ভাই-বােনের মতােই দেখতে,শুধু লোলাতের তিলক দুটো আলাদা—আর সেটাই তাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে।

“দ্যাখছেন?”আতর আলি বলে উঠল।“দুইটাতেই কাস্টমারে গিজগিজ করতাছে “কিন্তু ওদের খাবার কি আগের রেস্টুরেন্টটার মতাে হয় ?” আতর দাঁত বের করে হাসল।“হয় তাে…  নাইলে কি অ্যাত মাই
নষে খাইতে আসে।

অবাক হল ছফা। তার ধারণা ছিল, মুশকান জুবেরির সমস্ত রেসিপিই সিক্রেট সেটা নকল করতে পারে না।

“তুমি না বলেছিলে, এর আগে ওই রেস্টুরেন্টের কিছু কর্মচারী চাকরি ছেলে নিজেরা রেস্টুরেন্ট করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ওরকম স্বাদের খাবার তৈরি করতে?”

আবারও দাঁত বের করে হাসল ইনফর্মার। “ঠিকই কইছিলাম, স্যার..তয় হিটলুু ফজলুর কপাল ভালা। বেটি যে রাইতে পলাইলাে, তার আগে ওগাের কাছে মেডিচিনগুলা দিয়া গেছিলাে  ওইগুলান দিয়াই তাে খাওনের স্বােয়াদ বাড়ায়।”

বুঝতে পারল ছফা। মুশকান জুবেরির রেসিপিগুলাে সিক্রেট ছিল না, তবে রান্না করার পর প্রতিটি খাবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সিরাপ মেশাত, আর সেটাই খাবারের স্বাদকে অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেত। এই সিরাপগুলাে কী দিয়ে তৈরি সেটা ওই মহিলা ছাড়া আর কেউ জানত না।

“ওই দুই বাটপার বহুত মাথা খাটায়া মেডিচিনগুলার নকল বানাইছে। মেডিচিনগুলা নিয়াই দুই হালারপুতের মইদ্যে যতাে ক্যাচাল।”

নুরে ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ শুনে চমকে তাকাল তারা। “আরে, আতরভাই যে!”  ছফা আর ইনফর্মার দেখতে পেল মাঝবয়সী হালকা-পাতলা গড়নের এক লােক এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, মুখে এঁটে রেখেছে কৃত্রিম হাসি। কিন্তু হাসির আড়ালে যে আশঙ্কা জেঁকে বসেছে সেটা পুরােপুরি লুকাতে পারেনি।

“স্লামালেকুম।” “ফজলুমিয়া নাকি,”আতর মুখ বেঁকিয়ে বলল।“ব্যাবসা তাে জমজমাট তােমার।” ফজলু নামের লােকটি অমায়িক হাসি দিল। “সব আপনাগাের দোয়া।”

“ধুর মিয়া, কী কও!”বাঁকাহাসি দিল আতর।“আমাগাে দোয়া হইবাে ক্যান, সব তােমার চিকনবুদ্ধির খেইল।ভালাই খেল দেখাইছাে তােমরা বেটির নাম ভাঙ্গাইয়া পকেটভরতাছাে!

বিব্রত বােধ করল ফজলু। “কী যে কন, আতরভাই।”

চোখমুখ নাচিয়ে নুরে ছফার দিকে তাকাল ইনফর্মার। “ইনি আমাগাে ছফাস্যার , বিরাট বড়ো ডিবি অপিসার  ঢাকা থিকা আসছেন  তগাে বেটি যার ডরে
হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা পলাইছিলাে!”

রবীন্দ্রনাথের সাবেক কর্মচারি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল একটু। সম্ভ্রমের সাথে বলে উঠল, “স্লামালাইকুম, স্যার  ভালাে আছেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা।  হিটলু কই, দেখতাছি না যে?”রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’র দিকে ইঙ্গিত করে বলল ইনফর্মার।

হের খবর আমি রাখি না!” তিক্তমুখে জবাব দিল ফজলু।

মুখােমুখি দুই রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রতিযােগিতাটি যে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে গড়িয়েছে তা বুঝতে বাকি রইল না ছফার।

“আমাগাে এই ফজলুমিয়া একটু লেট কইরা ফালাইছিলাে, স্যার, বুঝলেন?” ছফা কিছু বলল না।

“বেটি ভাগনের পর বেকার হয়া ঘুইরা বেড়াইতাে, তারপর গত বচ্ছর যখন দেখলাে তার ইয়ারদোস্ত হিটলুু কাম সাইরা ফালাইছে, তহন হের বুদ্ধি খুললাে।” ফজলু কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবার বলতে লাগল সে, “হিটলুু তাে হিটলারি বুদ্ধি নিয়া চলে বেটির হােটেলের নামটাই মাইরা দিছে।”বিচ্ছিরি হাসি দিল ইনফর্মার। যেন ফজলুর এই বােকামিতে সে ভীষণ মজা পেয়েছে।“হেয় আর কী করবাে, চোর ভাগনের পর বুদ্ধি খুলছে।তয়, হে-ও কম যায় না, এক্কেবারে বেটিরেই মাইরা দিছে!” শেষ কথাটা মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে অদৃশ্য কোথাও প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দেবার মতাে বিচ্ছিরি একটা ইঙ্গিত করে বলল আতর।

ফজলু একটু কাচুমাচু খেলাে। “আরে না, ভাই..আমি তাে আমার মাইয়ার নামে এইটা রাখছি। আমার মাইয়ার নাম —”

“রাখাে মিয়া!”কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল ইনফর্মার। “মিছা কও ক্যান! তােমার মাইয়া যহন পয়দা হইলাে, নাম তাে রাখছিলা গুলনাহার, হে আবার মুশকান হইলাে কবে থিকা?” ছফার দিকে তাকাল। “ওয় মনে করছে আমি এইসব বাইর করতে পারুম না। আরে, আমার নাম হইলাে বিবিচি  সুন্দরপুরে কী হয় না—হয় সব আমি জানি!” গর্বিত ভঙ্গিতে বলল সে।

“আতরভাই, আপনে ভুল কন নাই। গুলনাহার তার আসল নাম, ডাক নাম কিন্তু মুশকানই রাখছি।”

“এইসব বুজ আমারে দিয়া কাম হইবাে না, আমারে মদনা পাইছােনি!”

“আহ,” ইনফর্মারকে থামিয়ে দিল ছফা। বাদ দাও তাে এসব কথা।” সে বুঝতে পারছে, ফজলুর চিকন বুদ্ধির কাজকারবার। মুশকান জুবেরির খাবারের সুনাম ছিল, এটা অস্বীকার করবার জো নেই। মহিলার অনুপস্থিতিতে তার সুনাম ব্যবহার করার মতাে কেউ থাকবে না তা কি হয়? এই দেশে এরকমটা আশা করা যায় না। এখানে সফলতাকে অনুসরণ নয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে পুরােপুরি হাইজ্যাকও করে কেউ কেউ। রবীন্দ্রনাথের সাবেক দুই কর্মচারী সেটাই করেছে।

“স্যার, ফজলুর লগে কিন্তু আমাগাে মাস্টরের হট টেরাম,”আঙটার মতাে করে দই তর্জনি আঁটকে দেখাল আতর।

ছফা অবাক হয়ে তাকাল লােকটার দিকে।

মুশকানের মালিক ব্যাখ্যা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। “আতরভাই ভুল বুঝছে, স্যার। উনার স্কুলে তাে অনেক বাচ্চা  তিনবেলা খানা দিতে হয়, বিরাট আয়ােজন করা লাগে। মাস্টারসাব আমারে এই কাজের দায়িত্ব দিসেন। আমি তারে হেল্প করি।”

ছফা কিছু বলল না।

“উনি হইলেন এই এলাকার মুরুব্বি, মাইন্যগণ্য মানুষ। এমপিসাবে যখন আমারে বললেন, আমি যেন মাস্টারসাব্রে হেল্প করি, তখন কি না কইরা পারি, কন?”

এবার আতরের দিকে তাকাল নুরে ছফা, “চলাে, যাই।”

“কিছুনা খাইয়া যাইবেন, তা কি হয়?”ফজলু বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেও ছফার কাছে মনে হল লােকটা খাতির করে ভাব জমাতে চাইছে। “গরিবের হােটেলে আসছেন, একটু খানাপিনা কইরা যান?”  “এখননা, মাত্র এলাম।একটু ফ্রেশ হয়ে নেই তারপর আসব।”কথাটা বলেই আতরকে নিয়ে চলে গেল ছফা। ফজলু আর দ্বিতীয়বার অনুরােধ করার সুযােগ পেল না।  ‘আপনে উঠবেন কই? এসপির বাসায়?”হাঁটতে হাঁটতে আর-একটু সামনের দিকে যেতেই আতর আলি বলে উঠল।

“না, টাউনের হােটেলেই উঠব,”নুরে ছফা বলল।

“সুরুত আলির হােটেলে?” ইনফর্মার বিস্মিত হল। “ওইটা তাে এহন পুরা খান” জিভে কামড় দিয়ে দিল সে। আর-একটু হলে বেফাঁস কথাটা বলেই ফেলত। “যাউক গিয়া, আপনে যে-কয়দিন আছেন হােটেলটা ঠিকঠাকমতােই চলবাে, চিন্তার কিছু নাই।”

সুন্দরপুরের আগের এসপি বদলি হয়ে গেছে আগেই। নতুন এসপির বাংলােতে ওঠার কথা ভেবেছিল ছফা, কিন্তু উনি সপরিবারে থাকেন, তাই ওখানে ওঠার কোনাে ইচ্ছে নেই।

“দুইটার খাওন-দাওনই ভালা,”বলল আতর। “আমি মাজেমইদ্যে খাই।তয়, হিটলুুর চায়া ফজলুর হাত বেশি ভালা।”

ছফা কিছু বলল না। তার ধারণা, এই নতুন হােটেলে নিয়মিত খায়দায় ইনফর্মার, আর সেটা অবশ্যই বিনে-পয়সায়। তবে এখানে খাওয়ার কোনাে ইচ্ছে নেই তার। নাম দুটো তাকে একটি ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা এক ধরনের পুরােনাে ক্ষত, যেটার উপশম এখনও হয়নি।  যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইবাে—কেএস খানের কথাটা যেন মাথার ভেতরে উচ্চারিত হল আর-একবার। মনের অজান্তেই হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেল তার।

এখানেই আমি ব্যর্থ হয়েছি। এখান থেকেই আমাকে আবার শুরু করতে হবে নতুন করে, মনে মনে বলে উঠল নুরে ছফা।

অধ্যায় ১৮

সন্দরপুরে রাত নেমে এসেছে। নিরিবিলি হয়ে গেছে এর মহাসড়ক। থানা থেকে বেশ কিছুটা দুরে পরিত্যক্ত একটি বসত বাড়ির উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছে আতর আলি। এককালে এখানকার সম্ভ্রান্ত ভট্টাচার্য পরিবারের বাস ছিল। একাত্তরে তাদের যে কয়জন বেঁচে ছিল, সবাই চলে গেছিল কলকাতায়। কেউ আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে নানাজনের হাত ঘুরেছে এটা। কখনও কোনাে সারের ডিলারের গােডাউন, তাে কখনও আগের এমপির পােলাপানদের আখড়া। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে আছে। তবে শােনা যাচ্ছে, এই বাড়িটা সুন্দরপুরের ফেকু সরকারের অরিন্দম নাট্যসংঘের কাছে দিয়ে দেবে বর্তমান এমপি।  সিগারেটে আয়েশ করে টান দিচ্ছে আতর। একটু আগে নুরে ছফাকে হােটেল সানমুনে রেখে এসেছে। তখন বিস্তারিত কথা হয়েছে তার সঙ্গে। তাকে যে কাজ করতে বলেছে। সেটা খুবই অবমাননাকর। তবে সমস্যা নেই, সব ধরণের কাজের জন্যই মানুষ আছে এই দুনিয়াতে। একটু আগে আতর সেরকম একজনকে খবরও দিয়েছে। তারপরই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটোকল দেয় সে। এখন সেই দু-জন মানুষের অপেক্ষায় আছে।

পনেরাে-ষােলাে বছরের এক কিশাের এল এ সময়। মলিন জিনস আর টি শার্ট গায়ে। তার হাতে একটা ব্যাগ।

আতরের কাছে এসে চুপচাপ সালাম ঠুকে ব্যাগটা দিয়ে দিল তাকে। সেই সঙ্গে পকেট থেকে কিছু টাকাও। টাকাগুলাে না গুনেই পকেটে ভরে নিল সে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে বের করে আনল কেরু অ্যান্ড কেরু কোম্পানির একটি বােতল।

“কত দিছােস?”। “দুইশাে।” “আইজকা আমদানি এত কম ক্যানেরে, হারামজাদা?”

গালিটা গায়েই মাখল না কিশাের, যেন হররােজ এরকমটা শুনতে হয় তাকে। “আইজ তাে টাউনের বাইরে যাই নাই।”

“ক্যান, আলেকবর মেম্বারের মাইয়ার না বিয়া হইতাছে  ওইখানে যাস নাই?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইল সে।

মলিন মুখ করে মাথা দুলাল কিশোর।”ওই বাড়ির বেবাকতে আমারে চিনে,গেলেই ধরা খামু।

মাথা নেড়ে সায় দিল আতর। বয়স কম হলেও ছেলেটা যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন। “কাইলকার কামটা কিন্তু টাইম মতােন করন লাগবাে, মনে থাকে যেন একটু এদিক ওদিক হইছে তাে পুটকি দিয়া বাঁশ ঢুকামু।”

মাথা নেরে সায় দিল ছেলেটা।“ওইটা নিয়া আপনে এট্টুও টেনশন নিয়েননা ওস্তাদ।

আতর রেগেমেগে তাকাল। “ওই হালারপুত, আমারে ওস্তাদ কস ক্যান?”হারুকাটা, মারা যাবার পর এই পিচ্চি কিছু দিনের জন্য ওস্তাদ বানিয়েছিল গঞ্জের মজিদকে-বছর গড়াতে না গড়াতেই মজিদও পটল তুলেছে কম দামি স্পিরিট পান করে। সেই থেকে আতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর যাই হােক, বল্টুর ওস্তাদ হওয়া যাবে না।

গাল চুলকালাে ছেলেটা। ইনফর্মারের রাগের কারণটা ধরতে পারল না। “কিন্তু এখন তাে আপনেই আমার—”

কথার মাঝখানে হাত তুলে থামিয়ে দিল ছেলেটাকে। “আমি তাের বস..ওস্তাদ না। কথাটা খিয়াল রাখবি। এহন যা।”

চুপচাপ চলে গেল ছেলেটা।  প্রথম সিগারেটটা যখন প্রায় শেষ, তখনই পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকল হ্যাংলা মতােন এক লােক। তার পরনের জামা-কাপড় অবশ্য পরিপাটি। চুলগুলাে বেশ ছােটো করে ছাঁটা। পাতলা গোঁফেও যত্নের চিহ্ন সুস্পষ্ট।

“সালাম, আতর ভাই।”  বােতলটা পাশে রেখে নিঃশব্দে সালামের জবাব দিল ইনফর্মার। আগে এই বেয়াদপটা তাকে সালাম দিত না, কিন্তু এখন শুধু সালামই দেয় না, সম্ভ্রম
ও করে আর সেটা অবশ্যই ভয় থেকে।

সবই হল ক্ষমতা। এটা থাকলে মেথরও রাজা, না থাকলে রাজাও মেথর। “কিছু হইছেনি? এত জরুরি তলব করলেন যে?”

বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আতরের ঠোঁটে। এ ধরনের কাজের সময় তার ভাবভঙ্গি একটু বেশি নাটকীয় হয়ে যায়। ট্যাকা কামাইতে কামাইতে তাে আন্ধা হয়া গেছাে সুন্দরপুরে কী হইতাছে না হইতাছে, কুনাে খবর রাখাে?”

লােকটা কিছুই বুঝতে পারল না। চেয়ে রইল ইনফর্মারের দিকে। “উনি তাে আবার আইছেন!” গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বলল। “এহন কী করবেন সে জানে!”

“কার কথা কইতাছেন?”অবাক হল হ্যাংলামতো লােকটি।

যার ডরে তােমাগাে ম্যাডাম হােগার কাপড় মাথায় তুইল্যা সব ফালায়া-ফুলাইয়া পলাইছিল।” একটু থেমে আবার বলল, “তােমার হিটলারি মাথায় এহনও ঢুকতাছে না হিটলুুমিয়া?”

লােকটা ঢোঁক গিলল আলগােছে। “আবার কী হইছে?”

চোখ কপালে তুলল আতর।“কী হইছে মাইনে?”আক্ষেপে মাথা দোলাল। “এহনও বুঝবার পারো নাই?” পাশ থেকে বােতলটা তুলে নিয়ে মুখটা খুলতে শুরু করল সে। বেটির নামটা তাে পুরা মাইরা দিয়া বইয়া আছাে  এইবার ঠ্যালা সামলাও!” বােতল
খুলে দুই ঢোক পান করে গলাটা ভিজিয়ে নিল। কেরু মদের তেতাে স্বাদে সাময়িক চােখমুখ কুঁচকে ফেলল সে। “স্যারে আমারে কইছে, ওই ডাইনী পলানাের পর কার এত বড়ো সাহস হইল, তার হােটেলটা আবার দিছে!”

হিটলুু বাঝার চেষ্টা করছে আতরের কথার মর্মার্থ।

“তোমাগাে দুইজনের লুঙ্গি তুইল্যা পলানাের টাইম হয়া গেছে, বুঝলা?” বােতলটা পাশে রেখে দিল ইনফর্মার।

“ভাই, আমরা কী অন্যায়টা করছি, কন চুরি চামারি তাে করি নাই,কর্ম কইরা খাইতাছি।” কথাটা আতরের আঁতে ঘা বসাল। মনে হল তাকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে! একে তাে সাবেক চোর, তার ওপরে এই জীবনে নির্দিষ্ট কোনাে কাজকর্ম করেনি কখনও। আর পুলিশের ইনফর্মারগিরি যে কোনাে পেশা নয়, সেটা কে না জানে।  “চুরি করাে নাই মাইনে!” একটু তেতে উঠল আতর। “ওই হােটেলটা কি বেটি তুমারে লেইখ্যা দিয়া গেছে, অ্যা?”

হিটলুু ঢোঁক গিলল আবার।“না তা দিবাে ক্যান।” – “তাইলে তার হােটেলের নাম তুমি নিলা কুন সাহসে?”

“আমি তাে তার নাম নেই নাই। আমার হােটেলের নাম রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি। আর ওইটার নাম আছিলাে—”

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল আতর। “রাখাে তােমার দুই নম্বরি কথাবার্তা। এইসব। বুজ আমারে দিবা না, সুন্দরপুরের আবলা-ভ্যাবলা মানুষজনরে দিবা, তারা লুঙ্গির নীচ দিয়া পুটকি খাউজ্যাইতে খাউজ্যাইতে হ-হ কইরা তােমার কথা বিশ্বাস করব।”

হিটলুু একটু কাচুমাচু খেলাে।নামের এই বুদ্ধিটা সে পেয়েছিল মাস্টারের দেওয়া নতুন লাইব্রেরীর ভেতরে রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে একটি লেখা থেকে। কবি যে এই সুন্দরপুরে কখনও আসেননি সেটা নিয়েই ছিল লেখাটা।

“কিন্তু শহর থেইক্যা যে আইছে, তারে যদি তুমি এইসব কইতে যাও”কথাটা শেষ করে ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে রইল শিকারের দিকে।  হিটলুু একটু ভেবে নিল।“ভাই, তার লগে তাে আপনের বহুত খাতির, আপনে একটু দেখেন না ব্যাপারটা?”  আতর আলি বাঁকাহাসি দিল।“সব কিছু আমি দেখুম ক্যান? আমার কি ঠ্যাকা পড়ছে, অ্যা?”

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননির মালিক একটু কাছে এগিয়ে এল।“আপনের দিকটা আমি দেখুম, ভাই। আপনে খালি আমার দিকটা একটু দেখেন।”

আতর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। “হাজার দুয়েক দিমুনে, ঠিক আছে?”

কৃত্রিম আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল ইনফর্মার।“এত হিটলারি বুদ্ধি মাথায় রাখাে আর এইটা বােঝে না, এই কাম দুই-তিনে হইব না?”

চেহারাটা মলিন করে ফেলল হিটলুু।

“তুমি আসলেই একটা খাইষ্টা,”বােতলটা আবার তুলে নিল হাতে, ঢক ঢক করে পান করল।“তােমার চায়া ফজলু অনেক চিকন বুদ্ধি মাথায় রাখে, দিলদরিয়াও আছে। তারে আমি কিছুই বলি নাই, নিজ থেইক্যাই পাঁচ দিয়া গেল।”

একটু গাল চুলকে নিল হিটলুু।“হেয় তাে দাগি আসামির নামে হােটেল দিসে বেশি দিবারই পারে।”

চোখমুখ খিচে ফেলল আতর।“হে দাগি আসামির নামেদিছে, আর তুমি নাটকিরপােলা ওই আসামির হােটেলটার নামই মাইরা দিছ।ক্রিমিনাল তাে কেউ কারাের চায়া কম না।”  হিটলুু একটু ভেবে নিল।“তাইলে আমিও পাঁচ দিমুনে, কী কন”কথা আর বাড়াতে চাইল না সে।

“এতক্ষণে লাইনে আইছ,” বােতলটা পাশে রেখে দিল আবার। “এই জিনিস খালি খাইতে ভাল লাগে না, বুঝছ?”

হিটলুু কিছুই বলল না।

“তােমার হােটেলের গােরুর ভুনা তাে ফেমাচ একটা পােলারে দিয়া এক প্লেট পাঠায়া দিও এইখানে।”

“আচ্ছা, ভাই।” “আর ট্যাকাটা কাইলকার মইদ্যে দিতে হইব, তেড়িবেড়ি করবা না।” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেল হিটলুু।

আতরের ঠোটে হাসি ফুটে উঠল। একটু পর ফজলু আসবে, তাকেও একই কথা বলবে।পাঁচ পাঁচ দশ!একদানে এতগুলাে টাকা পাবার পর গঞ্জে যাবে সে খুব জলদি। গত সপ্তাহে শেফালি নামের নতুন যে মেয়েটা এসেছে, ওই শালি সুন্দরপুরের আশেপাশে যত লুঙ্গি আর গামছা ব্যাপারী আছে, সব শালাকে যেন গলায় গামছা বেঁধে টেনে আনছে। খুব ডিমান্ড তার। আর এবার তার ডিমান্ড মেটাবে!

বােতলটা তুলে নিয়ে লম্পট ঠোটটা ছোঁয়াল, আবারও পান করল ঢক ঢক করে।

অধ্যায় ১৯

ভ্রমণের ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও রাতে ভালাে ঘুম হল না ছফার। সুরুত আলির নােংরা আর জঘন্য আবাসিক হােটেলকে এজন্যে দায়ী করা যায় না। বৈশাখ মাসের খামখেয়ালি আবহাওয়া এমনই যে, বিকেলের ঝড় সন্ধ্যার পর পরই উধাও হয়ে যায়। রাতের বেলায় সুন্দরপুরে নেমে আসে ভ্যাপসা গরম। ওদিকে হােটেলের পাশে সদ্য দেয়া জনপ্রিয় দুটো রেস্টুরেন্টের খাবার পরিহার করার মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে। নামবিহীন এক খাবারের দোকানের খাবার খেয়ে পেট ফেঁপে গেছিল তার। এটাই তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

ভােরের দিকে ক্লান্তি থেকে আসা ঘুম ভাঙল সকাল নয়টারও পরে। তারপরও বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল রাতে এই হােটেলে ওঠার আগে আতরের সঙ্গে একটা জরুরি কাজ নিয়ে আলাপ করেছে সে। তাকে ভালাে করে বুঝিয়ে দিয়েছে, বেশ সতর্কতার সঙ্গে কাজটা করতে হবে, একদমই সময় নষ্ট করা যাবে না।

“এইসব কাম তাে আমি কবেই ছাইড়া দিছি,” অপারগতা প্রকাশ করে বলেছিল ইনফর্মার। “তয় চিন্তা কইরেন না, অন্য একজনরে দিয়া করামুনে।” “আরে না,” সঙ্গে সঙ্গে ছফা বলে উঠেছিল। সে চায়নি অন্য কেউ এ কাজ করুক। গােপন জিনিস যত কম জানা যায় তত ভালাে।“যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ করানাে যাবে না বুঝতে হবে এটা।”  “ওয় আমার হাতের মুটিতে থাকে,” আশ্বস্ত করে বলেছিল ইনফর্মার। “ওরে নিয়া কুনাে চিন্তা কইরেন না, স্যার।”  কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ছফা জানতে চেয়েছিল, “কে সে?”

“বল্টু। আমাগাে সুন্দরপুরের আলি বাবা! চল্লিশ চোরের কাম একাই করবার পারে সে। কব্বরে গেলেও এই কথা কাউরে কইব না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেও সন্দেহটা পুরােপুরি যায়নি ছফার। “কিন্তু লােকটা যদি ধরা পড়ে যায়?”

“লােকনা তাে পােলা,” শুধরে দিয়ে বলেছিল আতর।“ওর বয়স চৌইদ্দ-পনেরাে অইবাে।” ;

“কী!”অবাকই হয়েছিল সে। “তুমি একটা পিচ্চিকে দিয়ে এরকম কাজ করাবে?” “বয়সে পিচ্চি হইলেও ওর মতাে সেয়ানা এই সুন্দরপুরে দুইটা নাই। এই বয়সেই খানকি পাড়ায়”কথাটা শেষ না করে আবার বলে, “আপনে যেইটা চাইতাছেন ওইটা বই করবার পারবো। মাইনষের ভিড়ে কাম সাইরা ফালায় সে। আর এইটা তাে খালি বাড়ি  ওর কাছে ডাইলভাত।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল ছফা।

আতর আলি দাঁত বের করে হেসে বলে, “তাইলে ধইরা লন, আপনের কাম হয়া যাইব।”

এখন বিছানা থেকে নিজেকে জোর করে তুলে নিয়ে টয়লেটে চলে গেল ছফা। সে টের পেয়েছে, এই হােটেলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার ব্যাবসায় মন্দাভাব শুরু হয়ে গেছে। নতুন ম্যানেজারের বেজার করা মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে, তার উপস্থিতি যত প্রলম্বিত হবে এই মুখ ততই চুপশে যেতে থাকবে। নিশ্চয় ভদ্রলােককে সাবধান করে দিয়েছে আতর।  যাই হােক, হােটেল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সে চলে এল রবীন্দ্রনাথ আর মুশকানের সামনে। পথের দু-ধারে দুটো রেস্টুরেন্টে এই সাত সকালেও কাস্টমারের বেশ সমাগম হয়েছে। আতরের কাছ থেকে এখানকার খাবারের বেশ সুনাম শুনেছে সে। দেখেও মনে হচ্ছে, এদের খাবার-দাবার শুধু সুস্বাদুই নয়, বেশ স্বাস্থ্যসম্মতও হবে- যদি তারা মুশকান জুবেরিকে সত্যি সত্যি অনুকরণ করে থাকে তাে!

হাতঘড়িতে সময় দেখল ছফা। এখনও বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় হাতে আছে। গতকালের নামবিহীন খাবারের দোকানে নাস্তা করার কোনাে ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া দুটো রেস্টুরেন্ট থেকে যে ঘ্রাণ ভেসে আসছে, সেটা তার খিদেটাকে চাগিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে প্রবােধ দিল-নামে কী আসে যায়! রেস্টুেরেন্ট দুটোর মালিক ব্যবসায়িক দিক মাথায় রেখে নামদুটো নিয়েছে, এর সঙ্গে আগের রেস্টুরেন্ট কিংবা তার মালকিনের কোনাে সম্পর্ক নেই। অগত্যা, অনেকটা হুট করেই সে ঢুকে পড়ল মুশকানের ভেতরে! রেস্টুরেন্টের প্রায় সব সিটই দখল করে রেখেছে ভােজন রসিকেরা, তারপরও একটা সিট খালি পেয়ে বসে পড়ল সে। ওয়েটারকে দ্রুত অর্ডার দিল নাস্তার জন্য—সবজি, রুটি আর ডিম ভাজি। সেই সঙ্গে এক কাপ চা।

রবীন্দ্রনাথের খাবারের মতাে সুস্বাদু না-হলেও মুশকানের স্বাদ বেশ ভালাে। তৃপ্তি নিয়েই খেলাে নুরে ছফা।ঝটপট নাস্তা সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগােতেই একটা শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকাল সে।

আতর আলী বাইক নিয়ে চলে এসেছে। বাইক থামিয়ে হাসিমুখে বলল ইনফর্মার, “নাস্তা করতে আইছিলেননি?”

সত্যিটা বলবে কিনা বুঝতে পারল না ছফা, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আতর আবার বলে উঠল।

“এগাের খাওন-দাওন কিন্তু মাশাল্লাহ। কিন্তু ভুলেও ইমামুদ্দির হােটেলে খায়েন না।

হাতে এক্কেবারে লোটা ধরায়া দিবাে।”

ইমামুদ্দির ব্যাপারে আতর আলির কথাটা যে সত্যি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গত রাতে।

দেখছেন, সকাল সকাল পিপড়ার মতাে ভীড় লাইগ্যা গেছে, রাস্তার দু-পাশে

রেস্টুরেন্টের দিকে ইঙ্গিত করে বলল ইনফর্মার। “এইহানেই খাওন-দাওন কইরেন।

আমি ফজলুরে–”

এটা কবে কিনলে?” প্রসঙ্গ বদলানাের জন্য বাইকটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল ছফা।

“কিনছি তাে তিন মাস হইলাে। আমাগাে টাউনের সেকান্দার মিয়ার আছিলাে এইটা, এর আবার ট্যাকার খুব দরকার পড়লাে  আমারে কইলাে, দোস্ত, কিছু টাকা দেও  হুন্ডাটা রাখাে। আমি দেখলাম, এত সস্তায় এই জিনিস আর পামু না, তাই কিইন্যা ফালাইলাম।” নিজে থেকেই বাইক কেনার গল্পটা বলে গেল আতর। ছফা চাচ্ছে না, এইসব বানােয়াট গল্পের পরিসর আরও বাড়ুক। “চলাে, আমাদের কাজে নেমে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

দাঁত বের করে হেসে ফেলল ইনফর্মার। “উইঠ্যা পড়েন, স্যার।” ছফা চুপচাপ উঠে বসল আতরের বাইকের পেছনে। ইনফর্মারের চোখেমুখে গর্বিত ভঙ্গি ফুটে উঠল। এলাকার অনেকেই দেখবে, ঢাকা থেকে আসা মহাক্ষমতাধর পুলিশ অফিসার তার বাইকের পেছনে বসেছে।

সুন্দরপুরের মহাসড়ক দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতরের বাইকটা চলে এল রহমান মিয়ার টঙ দোকানের সামনে।

“অনেকদিন বাদে আইলেন আছেন কিমুন?”তাকে দেখে গদগদ হয়ে বলল দোকানি। ‘আছি ভালােই। আপনি কেমন আছেন?” ছফা বাইক থেকে নেমে জানতে চাইল। দাঁত বের করে চওড়া একটা হাসি দিল রহমান। “আছি আর কি  গরিব মানুষ।”

আতরের চোখমুখ বিরক্তিতে সামান্য কুঁচকে গেল। টঙের সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল ছফা।

“তা, এতদিন পর আইলেন যে, কিছু হইছেনি আবার?” ‘দুই কাপ চা বানাও, মিয়া,”বাইকটা স্ট্যান্ডের উপর রাখতে রাখতে বলল আতর। তার চোখেমুখে বিরক্তি।“খালি বেশি কথা কও।”

রহমান আর কিছু না বলে চা বানাতে মনোযােগী হল। “আপনার ব্যাবসা কেমন যাচ্ছে?”জানতে চাইল ছফা।

রহমান মিয়া মুখ কালাে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর ব্যাবসা! ওই হুটেল বন্ধ হওনের পর আমার ব্যাবসা উঠছে চাঙ্গে।” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করল। “এহন তাে এইদিকে কেউ খাইতে আহে না, যারা আহে তারা সব পণ্ডিত, খালি বই পড়ে।”

আতর আলি ছফার পাশে এসে বসল।“বেটির হােটেলটারে তাে দুই চক্ষেও দেখবার পারতা না, ওইটা যখন বন্ধ হয়া গেল ঈদের মতাে খুশি হইছিলা, এহন আবার এই গীত গাইতাছাে ক্যান, মিয়া।”

বিরক্ত হয়ে তাকাল রহমান। “আমি খুশি হইছি তুমারে কে কইলাে? খালি আজাইরা কথা!”

ইনফর্মার দাঁত বের করে হাসল।  “আপনি নতুন রেস্টুরেন্ট দুটোর পাশে টঙটা সরিয়ে নিলেই পারেন,” বলল ছফা। “ওখানে তাে ভালাে কাস্টমার পাবেন।”

রহমান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আতর আলি কথা কেড়ে নিল।“আপনে ওরে যতাে বােকা ভাবেন ওয় আসলে অতাে বােকা না, স্যার। ইচ্ছা কইরা এইহানে পইড়া আছে। এত সহজে ওইখানে যাইবাে না।” _ রহমান মিয়া ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইল আতরের দিকে।অবাক হল ছফা।“কেন?”

“এইহানে থাকলে তাে বইসা বইসা কামাইতে পারে, বুঝলেন না?”  “কী কও এইসব?” প্রতিবাদ করে উঠল দোকানি।

বিজ্ঞের মতাে হাসি দিল ইনফর্মার। “মনে করাে আমি কুনাে খবর রাখি না,”তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে ছফার কাছে বয়ান করল সে, “হিটলুুর লগে হের হট টেরাম, বুঝলেন? হেয় ওরে কইছে, খিচ মাইরা যেইহানে আছাে সেইহানে পইড়্যা থাকো, রহমান। শহর থিকা লােকজন বেটির হােটেলের খুঁজ করলে তুমি আমার নতুন হােটেলটার কথা কইবা। ফজলুরটা নকল  আমারটা আসল।”“সব মিছা কথা!” প্রতিবাদ করে উঠল টঙ দোকানি। “এইসব কথা ক্যাঠায় কইছে
তুমারে?”

“আরে, আমি সব খবরই রাখি। তুমি হিটলুুর কাছ থিকা কমিশন পাও।” বিস্মিত রহমান মাথা দোলালাে। ছফার দিকে ফিরে তাকাল সমর্থন পাবার আশায়, “ছার, বিশ্বাস করেন মিছা কথা”  হাত তুলে থামিয়ে দিল নুরে ছফা। আতর আলির দিকে তাকাল সে, “এসব বাদ দাও
তো।”তারপর আবার দোকানির দিকে ফিরল, “এক প্যাকেট বেনসন দিন।”

রহমান মিয়া ঝটপট সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল ছফার দিকে, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল চা বানাতে। কমিশনের আলাপ থেকে মুক্ত হতে চাইছে যেন।  একটা সিগারেট ঠোঁটে নিতেই আতর আলি নিজের পকেট থেকে লাইটার বের করে বাড়িয়ে দিল। মুচকি হেসে সিগারেটটা ধরাল ছফা।রহমান মিয়া গুঁড়ের চা বানিয়ে দু-জনের দিকে বাড়িয়ে দিলে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে শুরু করল ছফা। আতরের দিকে আড়চোখে তাকাল একবার।

জোরে জোরে চুমুক দিয়ে চা-টা দ্রুত শেষ করে উঠে দাঁড়াল ইনফর্মার। “আর, আমি তাইলে যাই,”ছফার উদ্দেশ্যে বলল। “আমার একটা কাম আছে টাউনে।”

“আচ্ছা পরে দেখা হবে।” পকেট থেকে টাকা বের করে রহমান মিয়াকে দিয়েই চুপচাপ বাইকটা স্টার্ট দিয়ে চলে

গেল আতর।

“এখনকার এমপি মানুষ হিসেবে কেমন?”ইনফর্মার চলে যাবার পর রহমান মিয়াকে জিজ্ঞেস করল ছফা।

“মানুষ ভালাই, তয় বয়স অনেক কম,”জানাল দোকানি। “আসাদুল্লাহ যহন বাইচ্যা আছিল তহন হে সুবিধা করবার পারে নাই। মামলা-মুমলা দিয়া বহুত পেরেসানে রাখছিল  তহন হে ঢাকায় থাকত। ফেরাউনটা মরনের পর গেরামে ঢুকছে, তারপর কেমনে কেমনে এমপিও হইয়াও গেল। সবই কপাল।”

“তারা দু-জন কি একই পার্টি করত না?” সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইল ছফা।

“হ, একই পার্টি করত কিন্তু বনিবনা আছিল না। আসাদুল্লাহ এন্টি পাটির লুকজনরে যিমুন পেরেসানিতে রাখত, নিজের পাটির অনেকরেও দৌড়ের ওপর রাখছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা।“শুনলাম মাস্টারের সঙ্গে নাকি নতুন এমপির খুব খাতির?”

“হ। জোনায়েদ ভাই তাে মাস্টরের কাছে ছুটকালে পড়ছে  খুবই মাইন্যগণ্য করে তারে।”

“মাস্টারের এখন কী অবস্থা?”

“সুন্দরপুর তাে এহন মাস্টরই চালায়,” হেসে বলল রহমান।“পুলিশ-ডিচি-এচপি টিএনও, সব হের পকেটে থাহে। আমাগাে নয়া এমপিও হের কথায় উঠে আর বহে।”

ছফা বুঝতে পারল আবারও ক্ষমতাধর একজনকে মােকাবিলা করতে হবে তাকে। তবে এদের চেয়েও প্রবল ক্ষমতাধর মানুষ আছে তার মাথার ওপরে। বাধাবিপত্তি যতই আসুক না কেন, সব কিছু সামলাবে ওই লােক। যদিও স্থানীয় ক্ষমতাবানদের কিছু সুবিধা থাকে। অনেক সময় তাদেরকে ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে ওঠে না। তাই ছফাকে এবারও সতর্ক থাকতে হবে।

“তয় মাস্টর মাটির মানুষ, হে আগের মতােই আছে,” বলল দোকানি। “চাইলে, সুন্দরপুরে যা খুশি করবার পারে কিন্তু স্কুল আর লাইবেরি লইয়াই পইড়া থাহে সারা দিন, কারও আগে পিছে কুন কালেই হে ছিল না, এহনও নাই।” ” কথাটা মেনে নিতে কষ্টই হল ছফার। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার আগে এই ভদ্রলােককে ডেকে নিয়ে কথা বলেছে। তার ধারণা, এখনও এই লােকটার সঙ্গে মহিলার কোনাে না কোনাে যােগাযােগ আছে—তবে সেটা তিনি করেন খুবই সঙ্গোপনে। ভদ্রলােক নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট থাকেন।

“মাস্টরের স্কুল খালি আমাগাে গেরামেই না, বাইশ গেরামের মইদ্যে সেরা।”

রহমানমিয়ার কথায় সংবিৎ ফিরে পেল ছফা।

“বাপ-মায়েরা পােলাপান নিয়া আইস্যা পড়ে মাস্টরের কাছে। ছার, আমার পােলাটাতে মানুষ কইরা দেন  ওরে আপনের কাছেই দিয়া গেলাম।” দোকানি এমনভাবে কথাটা বলল যেন ঘটনাগুলাে তার চোখের সামনেই ঘটে। “স্কুলের আবার হুস্টেলও আছে। এর বড়ো জমিদারবাড়ি জায়গার অভাব আছেনি?”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল ছফার মুখে। “স্কুল দিতে না দিতেই এত সুনাম।”

“স্কুল নতুন হইবার পারে, মাস্টর তাে নতুন মানুষ না। হেরে চেনে না এমুন মানুষ আছে এই এলাকায়? পােলাপানগাে হে গানও শিখায়, ছবি আঁকায়  কত্তো কী যে করায়। ঢাকা-কলিকাতা থেইক্যাও মাস্টর নিয়া আসছে। এলাহি কাজ-কারবার।”

নুরে ছফা উঠে দাঁড়াল। “আসলেই বিরাট কাজকারবার।”

ছফার কথাটার সুর বুঝতে পারল রহমান। এই লােক যে মাস্টারকে খুব একটা পছন্দ করে না, সেটাও তার অজানা নয়।

“কত হয়েছে আমার?” চওড়া হাসি দিল দোকানি। “আতর তাে বিল দিয়া দিছে।” “ওহ”ছফা আর কোনাে কথা না বাড়িয়ে টঙ দোকান থেকে পা বাড়াল রাস্তার দিকে।

রহমান ঘাড় উঁচু করে সেদিকে চেয়ে রইল। রাস্তা পার হয়ে নতুন স্কুলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নুরে ছফা।

‘মাস্টারের কথা হুনলে তাে মুখ কালা হয়া যায়,” বিড় বিড় করে বলল দোকানি। “আবার দেহি হের কাছেই যায়!”

অধ্যায় ২০

তিন বছর পর এলেও পথটি তার ঠিকই মনে আছে। যদিও অনেক কিছু বদলে গেছে এই সময়ে।

রবীন্দ্রনাথের পাশ দিয়ে যে মেঠো পথটি চলে গেছিল জমিদার অলােকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়ির দিকে, সেটা এখন পাশাপাশি দুটো রিকশা যেতে পারে এমন প্রশস্ত পিচঢালা পথ। খুব বেশি হলে এক বছরের পুরােনাে হবে রাস্তাটি। পথের দু-ধারে কিছু দিন আগে লাগানাে হয়েছে গাছের চারা, সেগুলাে ছােটোছােটো গােলাকার বাশের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত।

নুরে ছফা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে গেল সেই পথ দিয়ে। পথের দু-পাশের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি আগের মতােই রয়েছে। মহাসড়ক থেকে সবুজ ফসলি জমির বুক চিরে চলে গেছে কালাে পিচের রাস্তা। মাথার ওপরে দগদগে সূর্য। চোখ ধাঁধানাে প্রকৃতি চারপাশে। তার নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিটি গ্রামই প্রায় একই রকম লাগে তার কাছে।

হাঁটতে হাঁটতে জমিদারবাড়ির কাছে চলে এলে দেখতে পেল, সদর দরজাটা আর আগের মতাে নেই। বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটিও বেশ বদলে গেছে। দেখেই বােঝা যায়, নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এক সময়কার জমিদার বাড়ির মূল ফটকটি এখন শক্ত মজবুত লােহার গ্রিলের বিশাল দরজায় বদলে গেছে। সেই দরজার ওপরে অর্ধ-বৃত্তাকারের খিলান সদৃশ একটি সাইনবাের্ড :সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়।

ভ্রু কপালে উঠে গেল নুরে ছফার।এমন রবীন্দ্রপ্রীতির গূঢ় রহস্য কি বুঝে উঠতে বেগ পেল না।মুশকান জুবেরির ভূত মাস্টারের ঘাড়েও চড়ে বসেছে! নাকি মুশকান জুবেরির ইচ্ছে বাস্তবায়ন করেছেন রমাকান্ত মাস্টার? প্রশ্নটা ছফার মনে উদয় না হয়ে পারল না।

স্কুলগেটটা আগলে রেখে যে দারােয়ান দাঁড়িয়ে আছে, সে যেমন বলশালী তেমনি কঠিন। চোখেমুখে সেই কাঠিন্য ধরে রেখে যেন জানান দিচ্ছে, এখান দিয়ে অযাচিত কেউ ঢােকার কথা স্বপ্নেও যেন না ভাবে।

ছফা পা বাড়াল সেদিকে।“গেট খােলাে,” হুকুমের স্বরে বলল সে।

মনে হল দারােয়ান এমন হুকুম শুনতে অভ্যস্ত নয়। চোখদুটো গােল গােল করে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “আপনে কে  কী জন্যে আসছেন?” বেশ ঝাঁঝাল কণ্ঠে
জানতে চাইল সে।

“আমি ঢাকার ডিবি অফিস থেকে এসেছি।”  দারােয়ান সন্দেহের দৃষ্টিতে ছফাকে আপাদমস্তক দেখে নিল। “আইডিকার্ড আছে?”

কথাটা শুনে খুব অবাক হল, তারপরও পকেট থেকে পরিচয়পত্রটা বের করে দেখাল লােকটাকে। সম্ভবত দারােয়ান এর আগে কোনাে পুলিশের পরিচয়পত্র দেখেনি। ছফার আইডিটা হাতে নিয়েও সন্দেহ দূর হল না তার।

কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিল দারােয়ান।“এই কার্ডটা যে নকল না সেইটা কেমনে বুঝুম?”ভ্রু  কপালে উঠে গেল ছফার। গ্রামের স্কুলের দারােয়ানের কাছ থেকে এমন কথা শােনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। ঢাকা শহরের শিক্ষিত আর কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজনও কখনও তার কার্ড দেখে এই প্রশ্ন করেনি। বলতে গেলে, পুরাে কর্মজীবনে এই কার্ডটা হাতেগােনা মাত্র কয়েকবারই দেখিয়েছে। আর যাদেরকে দেখিয়েছে তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করে নিয়েছে।

“তুমি কি আমার সঙ্গে মশকরা করছ?”দাঁতে দাঁত পিষে বলল সে।  আইডিকার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে দারােয়ান বলল, “আপনের কার্ড দেইখ্যা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, ভাই। এইটা নকলও হইতে পারে।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইল ছফা। লােকটা যে তাকে ভাই বলে সম্বােধন করছে সেটাও খেয়াল করেছে। তার মানে, সত্যি সত্যি সে বিশ্বাস করছে না ছফা পুলিশের লােক। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে বলল, “এটা তাে স্কুল, নাকি?”

মাথা নেড়ে সায় দিল দারােয়ান। “হ। এখন বলেন, আপনে এইখানে কার কাছে। আসছেন?”

“মাস্টারসাহেবের কাছে এসেছি উনি আছেন না স্কুলে?” হ, “উনি ভিতরে আছেন. অফিসে,”দারােয়ান লােকটা বলল।

“তাহলে ওঁনার কাছে খবর পাঠাও,”আদেশের সুরে বলল সে। “বলাে, ঢাকা থেকে নুরে ছফা আসছে।”

“নুরে সাফা?” দারােয়ান তার নামটা ধরতে পারল না। মাথা দোলালো নামের মালিক।এটা তার জন্য মােটামুটি নিয়মিত একটি ব্যাপার। প্রথমবার খুব কম মানুষজনই তার নামটা ঠিকমতাে ধরতে পারে।“সাফা না, ছফা…ঠিক আছে?”  মাথা নেড়ে সায় দিল দারােয়ান, তারপরই গেটের ভেতরে ঢুকে কাউকে ডাকল সে। ছফা দেখতে পেল বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক দৌড়ে চলে এল গেটের কাছে।

“মাস্টরসাবরে গিয়া বলাে, ঢাকা থিইক্যা নুরে ছফা নামের এক পুলিশ আইছে  স্যারের লগে দেখা করতে চায়।”দারােয়ানের কথা শুনেই ছেলেটা আবার দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।

“ক-দিন ধরে এখানে কাজ করাে?” জানতে চাইল ছফা।

ইস্কুলের শুরু থেইক্যাই আমি আছি,” গর্বিত ভঙ্গিতে জবাব দিল দারােয়ান।“দেড় বছর তাে অইবােই।”

“এর আগে কোথায় চাকরি করতে?” “এইটাই আমার প্রথম চাকরি।” তাই নাকি? তােমার ভাবসাব দেখে তাে মনে হচ্ছে বেশ অভিজ্ঞ এই কাজে।” দারােয়ান কিছু বলল না।

গ্রিলের গেটটা দিয়ে ভেতরে তাকাল ছফা। জমিদার বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটি বেশ বদলে গেছে। মাঝখানে যে ফোয়ারাটা ছিল সেটা আর নেই।সবুজ ঘাসের জায়গাটি এখন ইট বিছানাে একটি চত্বর। জমিদার বাড়ির সেই পুরােনাে ভবনটিও নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে একতলার একটি টিনশেড ভবন।

ছফার মনে পড়ে গেল তিন বছর আগে এক রাতে কীভাবে সে দেয়াল টপকে এখানে ঢুকেছিল, ফোয়ারাটার কাছে এসে ঘাপটি মেরে ছিল কিছুক্ষণ। রােমাঞ্চকর একটি অভিযান ছিল সেটা। গল্প করার মতােই ঘটনা। কতটাই না ভড়কে গেছিল ভবনের পেছনে, জোড়পুকুরের পাশে মাটি চাপা দেবার দৃশ্যটা দেখে। তারপর, মুশকান জুবেরির সেই চাহনী, দ্রুত ঝোপের আড়াল থেকে পালিয়ে যাওয়া

“আসেন।” দারােয়ানের কথায় স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এল সে। “স্যার আপনেরে ভিরে যাইতে বলছেন।”

ছফা মুচকি হাসি দিয়ে গেটের ভেতরে পা রাখল। সেই বিশ-বাইশ বছরের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে। সম্ভবত তার পুলিশ পরিচয়ের কারণে।

“তুমি উনারে স্যারের কাছে নিয়া যাও শ্যামল,” ছেলেটাকে বলল দারােয়ান। তিন বছর পর নুরে ছফা মেইন গেটটা পেরিয়ে এক  সময়কার জমিদারবাড়ির ভেতরে পা রাখল আবার।

Back to top button
error: Content is protected !!