Books
সেই সময় Pdf Free Download
Sei Somoy pdf বই পর্যালেচনাঃ
উপন্যাস সেই সময় pdf
লেখক- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বইঃ সেই সময় [ Download PDF link ]
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়, বই টি শেষ না করলেই বরং ভালো হয়.. কারণ এইসব বই পড়ার সময় এক ধরণের ঘোর লাগা, ভালো লাগা, স্বর্গীয় সুখ অনুভব হয়.. “সেই সময়” ঠিক তেমন একটি উপন্যাস.. প্রায় ২৫ দিন ধরে ৭০০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস শেষ করার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন অল্প অল্প করেই পড়তাম, যাতে খুব দ্রুত শেষ না হয়ে যায়..
ইতিহাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য ছিলো – সময়.. ১৮৪০-১৮৭০ সাল, এই সময় কে আঁকড়ে ধরার প্রয়োজনে লেখক এনেছেন অর্ধশত ঐতিহাসিক, কাল্পনিক চরিত্রের সংমিশ্রন.. উপন্যাস টি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ইংরেজ জাতি যদি ব্রিটিশ শাসন না করতো তাহলে আজ বাঙালি জাতি আরো অনেক পিছিয়ে থাকতো.. বইটির শেষে দেখলাম প্রায় ১২৩ টি বইয়ের সহায়তা নিয়ে লেখক এই উপন্যাস টি রচনা করেছেন.. বুঝাই যাচ্ছে লেখক কত খানি সময়, পরিশ্রম, জ্ঞান এই উপন্যাসের পিছনে ব্যয় করেছেন..
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ” আইন প্রনয়ণ, মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য রচনা, নবীনকুমার (কালীপ্রসন্ন সিংহ) এর মহাভারত অনুবাদের পাশাপাশি সমাজসেবা, বেথুন সাহেবের নারী শিক্ষা প্রসারের অবদান, ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের সমাজ সংস্কারক রীতিনীতি, হেয়ার সাহেব- বেথুন সাহেব- বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা প্রসারে অবদাব, গঙ্গাচরণ-দীনবন্ধু মিত্র-হরিশ মুখোপাধ্যায়ের নীল বিদ্রোহে অবদান, দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের উত্থান- কি ছিলো না এই উপন্যাসে সেটিই প্রশ্ন..
উপন্যাসের কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা-
সময়কে রক্ত মাংসে গড়ে তোলার জন্য একটি প্রতিক চরিত্র গ্রহণ করতে হয়ছে লেখককে.. উপন্যাসে নবীনকুমার ও ইতিহাসের পাতায় কালীপ্রসন্ন সিংহ নামেই বিখ্যাত এই মানুষটির সমাজসেবায় অবদান ছিলো অপরিসীম.. লেখক ২য় খন্ড এই কালীপ্রসন্ন সিংহের স্মরণে রচনা করেছেন.. মাত্র ২৯ বৎসরের জীবনকালে চঞ্চল, উদার এই মানুষটি উদার হস্তে নিজের সম্পদ বিলিয়ে গিয়েছেন গরীব দুখী মানুষদের সেবায়, সমাজ সংস্কারে.. বিদ্যোৎসাহিনী সভা চালুর মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা, মহাভারত অনুবাদ, হুতোম পেঁচার নকশার রচনার মাধ্যমে সমাজের কিছুদিক ব্যঙ্গ রচনার মাধ্যমে তুলে ধরা, বাংলা থিয়েটারের উত্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচুর অবদান রেখে গিয়েছেন.. উপন্যাসের শেষের দিকে নবীনকুমারের অকালমৃত্যু কিছুটা বিমর্ষ করে দিয়েছে আমাকে.. তাঁর বড় ভাই গঙ্গানারায়ণ ছিলেন স্বল্পভাষী স্বভাবের.. ম্যাকগ্রেগর সাহেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নীল বিদ্রোহের সুত্রপাত করেছিলেন..
এরপর যে মানুষটি সারা উপন্যাস জুড়ে আমাকে আকৃষ্ট করেছেন তিনি হলেন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর.. লেখক ১ম খন্ড বিদ্যাসাগরের স্মরণেই রচনা করেছেন.. উনার ব্যক্তিত্ব দেখে আমার চোখে জল এসে গিয়েছে উপন্যাসের কিছু অংশে.. বাংলার নারী শিক্ষার প্রসারে উনি জীবনের অর্ধেকের ও বেশি সময় ব্যয় করেছেন.. অবদান রেখে গিয়েছেন বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নে.. গদ্যভাষা রচনায় বিদ্যাসাগরের অনবদ্য ভূমিকা ছিলো.. নিজের জীবনের প্রতি কোনো ভালোবাসা, মায়া ছিলো না.. ছিলো না অর্থের প্রতি লোভ.. এই মানুষটি থেকে বাঙালি জাতির অনেককিছু শেখার আছে..
ভালো লেগেছে ডেভিড হেয়ার সাহেব, বেথুন সাহেবকে.. বাঙালি জাতির উন্নতিতে ইংরেজ দের ভূমিকা কতটুকু ছিলো তা এই ২ জন মানুষকে দেখলেই বুঝা যায়.. হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় হেয়ার সাহেবের গুরত্বপূর্ণ অবদান ছিলো.. নারী শিক্ষা প্রসারে বেশকিছু চিন্তা করে গিয়েছিলেন.. পরবর্তীতে বেথুন সাহেবের প্রচেষ্টায় কলকাতায় সর্বপ্রথম মেয়েদের স্কুল “বেথুন সাহেবের স্কুল” নামে প্রতিষ্ঠিত হয়.. প্রথম ২ জন ছাত্রী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ২ কন্যা.. ব্রাহ্মণ হয়েও কোনো কুসংস্কার কে তিনি প্রশ্রয় দেন নি.. নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য আরো অনেক স্কুল বেথুন সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন.. মানুষটির সম্পর্কে যতই পড়ছিলাম ততোই মুগ্ধ হচ্ছিলাম.. উদ্যত মধুসূদন দত্তের নিকটে এই মানুষটি নিজ ভাষা সাহিত্যের গুরত্ব তুলে ধরেছিলেন..
উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষন ছিলো মধুসূদন দত্ত কে ঘিরে.. তাঁর নিজের ভুলের কারণেই সারাজীবন কেটেছে সংগ্রামে.. ছিলো বেশ গুরত্বপূর্ণ অবদান ও.. সম্পূর্ণ বাংলা বিরোধী এই মধুসূদন প্রয়োগ করেন বাংলা সাহিত্যে “অমিত্রাক্ষর ছন্দ”.. রচনা করেন অমর মহাকাব্য “মেঘনাদ বধ কাব্য”..
ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের বেশ ভালো লেগেছে আমার.. উদার, মুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন সবাই.. তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- প্যাঁরিচাদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন ববন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ ইত্যাদি..
ছিলো হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অবদান ও জীবন কাহিনী.. নীল বিদ্রোহে তাঁর জোড়ালো কলমের ভূমিকা ছিলো অনেক বেশি.. হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা তে তাঁর জোড়ালো কলমের পরিচয় পাওয়া যায়.. নীলকর দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কখনো পিছপা হয় নি এই দরিদ্র পরিবারের সন্তান.. পরবর্তীতে হরিশের মৃত্যুর পর এই পত্রিকার ভার নেন নবীনকুমার.. সেই সময়কালের দীনবন্ধু মিত্র রচিত “নীল দর্পন” এর কথাও এই উপন্যাসে পাওয়া যায়.. গঙ্গানারায়ণের নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা করা হয় “নীল দর্পন”.. যার প্রথম ইংরেজ অনুবাদ করছিলেন মধুসূদন দত্ত.. যার ফলে ইংরেজরা ক্ষ্যাপে গিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করেন.. এই ২ জনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন পাদ্রী লঙ সাহেব.. শাস্তি হয় জরিমানা, সেই জরিমানা প্রদান করেন নবীনকুমার…
উপন্যাসের সব চরিত্র নিয়ে নিজের মতামত শেয়ার করা সম্ভবপর নয়, তাই আমার ভালো লাগা কিছু চরিত্র সম্পর্কে বললাম.. উপন্যাস টি পড়ার সময় আমার একটি অনুরোধ থাকবে, প্রতিটি চরিত্র পড়ার সময় একবার তাঁর সম্পর্কে গুগুলে খোঁজ করে দেখবেন.. এতে চরিত্রটি সম্পর্কে বুঝতে অনেকটাই সহায়তা করবে…
ধন্যবাদ রিভিউটি পড়ার জন্য
*ব্যক্তিগত রেটিং- ৫ তারকা।।