rabindranath ekhane kokhono asen ni pdf part 75 to 97

অধ্যায় ৭৫

কতক্ষণ ধরে যে অন্ধকার ঘরে পড়ে আছে, শ্যামল জানে না। সেই দুপুর থেকে তার হাত-মুখ-পা বেঁধে নীচতলার পরিত্যক্ত একটি ঘরে ফেলে রেখে গেছে লােকগুলাে। তারপর আর খোঁজ করতে আসেনি। প্রথম কয়েক ঘণ্টা তীব্র আতঙ্কে অসাড় হয়ে পড়ে ছিল সে। গ্রামের সহজ সরল ছেলে, জীবনে প্রথম বার ঢাকায় এসেই কিনা এমন পরিস্থিতির শিকার হল!

প্রচণ্ড খিদে আর পানির পিপাসায় জিভ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মৃত্যুভয়ে তটস্থ সে। তার মনে হচ্ছে না এ বাড়ি থেকে পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে বের হতে পারবে, ফিরে যেতে পারবে না সুন্দরপুরে।

দুপুরে যখন এখানে, এই পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটের বড়ো একটা ঘরের এককোণে তাকে ফেলে গেল তখন সে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। মশার কামড়ে জ্ঞান ফিরে এলে দেখতে পায়। কিছুটা আলাে তখনও আছে। এরপর নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এখন,এই কয়েক ঘণ্টা পর গাঢ় অন্ধকারে চোখ মেলে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। রাত কয়টা বাজে তার কোনাে ধারণাই নেই। এ কয় ঘণ্টায় তার মানসিক অবস্থার উত্থান-পতন দুটোই ঘটেছে। প্রাথমিক ভীতিটা তাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে সেই ভীতি অনেকটাই কেটে গেছে। এখন পালানাের চিন্তা করার মতাে সাহসও দেখাচ্ছে সে! অন্তত বিষয়টা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিগত এক ঘণ্টা ধরে।

শ্যামল খেয়াল করেছে, তাকে একবারের জন্যেও কেউ দেখতে আসেনি। সম্ভবত সুস্মিতাদিকে নিয়েই লােকগুলাে ব্যস্ত।

দিদিকে ওরা কী করছে? চিন্তাটা মাথায় আসতেই কান্না পেল তার। নিশ্চয় খারাপ কিছু করছে। এই দিদি শ্যামলকে খুব স্নেহ করে, তার খারাপ কিছু হােক সে চায় না। কিন্তু যারা তাদেরকে তুলে নিয়ে এসেছে এই বিরাণ বাড়িতে, তারা যে দিদির সঙ্গে খারাপ কিছু করবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে।

শ্যামল কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে নিল। দিদিকে রক্ষা করতে হলে তাকেই করতে হবে। ছােটোবেলায় পড়া রবিঠাকুরের ‘বীর পুরুষ’কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই ছােট্ট খােকা যদি মাকে রক্ষা করতে পারে কতগুলাে ডাকাতের হাত থেকে, তাহলে সেও পারবে। তবে এ কাজ সে ওই খারাপ লােকগুলাের সঙ্গে মারামারি করে পারবে না। জীবনে ওই একটা কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। সে হল রমাকান্ত মাস্টারের হাতে মানুষ হওয়া ছেলে, ছােটোবেলা থেকেই মাস্টার তাকে শিক্ষা দেবার পাশাপাশি – মানুষ হিসেবে গড়ে তােলার চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য ছেলেদের মতাে মারামারি করার অভিজ্ঞতা তার নেই। এ জীবনে কারও সঙ্গে ঝগড়াও করেনি কখনও। খুবই নরম স্বভাবের মানুষ সে।সুতরাং একটাই উপায় আছে—তাকে এখান থেকে পালাতে হবে।

টের পেল পায়ে মশা কামড়াচ্ছে। মশাদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাঁধা পা দুটো নড়াচড়া করার চেষ্টা করছে একটু পর পর। এভাবে করতে গিয়ে ধারালাে কিছুতে পা লেগে গেল। টের পেল ওটা এই ঘরের একটি পিলার। তার পা-টা সেই পিলারের খুব কাছেই, পিলারের নীচের দিকের অনেকটা অংশে প্লাস্টার খসে আছে, ফলে সেখানে পা লেগে ছিলে গেছে খানিকটা।

শরীরটা গড়িয়ে সেই পিলারের কাছে নিয়ে গেল শ্যামল, অনেক কষ্টে পিলারে ঠেস দিয়ে উঠে বসল সে। তার পিছমােড়া করে বেঁধে রাখা হাতদুটো পিলারের সেই ধারালাে অংশের নাগাল পাচ্ছে এখন। এরপর ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন দড়িরটা পিলারের ধারালাে অংশের সঙ্গে ঘষে ঘষে হেঁড়ার চেষ্টা করে গেল।

খুব আস্তে আর দেবে দেবে করল যেন দড়িটা ছিড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই পায়ের শব্দ শুনে থমকে গেল সে। সারাটা দিন কেউ এখানে আসেনি। আর যখন সিদ্ধান্ত নিল পালাবে, তখনই কিনা লােকজন চলে এল!

নিজেকে খুব অসহায় লাগল শ্যামলের, খুব কান্না পেল তার।

অধ্যায় ৭৬

ঘরে ঢুকেই বন্দির দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইল নুরে ছফা।

সে ভাবতেই পারছে না, এই মেয়েটাই আসলে মুশকান জুবেরি! চেহারা পুরােপুরি পালটে ফেলেছে! তাকে যারা চেনে তারা যদি এখন দেখে, বিশ্বাসই করতে চাইবে না। আগের মুশকানের সঙ্গে এখনকার চেহারার একটুও মিল নেই। সার্জন ডিপি মল্লিককে যে প্রচুর সার্জারি করতে হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই। ছফার ধারণাই ছিল না, এভাবে সার্জারি করে চেহারা আমূল পালটে ফেলা সম্ভব।’

কিন্তু অসম্ভব কাজটাই করেছে দয়াল প্রসাদ মল্লিক। মনে মনে সার্জনের প্রশংসা না করে পারল না। বেচারা যদি জানত কার চেহারাটা পালটে দেবার কাজ নিয়েছিল!

মাস্টার আর গানের শিক্ষিকার ফোন নাম্বার পেলেও তার সব মনােযােগ ছিল রমাকান্ত কামারের ওপরে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সে একেবারে নাগালের মধ্যেই আছে!

“আপনার কথাই ঠিক,”পিএস বলল বেশ সন্তুষ্টহয়ে। ঘরের একমাত্র ডাবল সােফাটায় বসে আছে সে, তার মুখে প্রসন্ন হাসি। আসলাম দাঁড়িয়ে আছে বন্দির পাশেই। “এই মেয়েটাই মুশকান। প্রথমে কোনাে কিছুই স্বীকার করছিল না, তবে একটু আগে সব স্বীকার করে নিয়েছে।”

নুরে ছফা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে এগিয়ে গেল বন্দির দিকে।  ‘বারবার নিজেকে ডাক্তার আসকারের মেয়ে বলে দাবি করছিল।শি
ওয়াজ অ্যা হার্ড নাট টু ক্র্যাক!”

এ ব্যাপারে ছফার মনেও কোনাে সন্দেহ নেই। তারপরই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল সে,“হ্যালাে, রুখসান!”

অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে ফেলল বন্দি। পিএস আশেক মাহমুদ আর আসলাম একে অন্যের দিকে তাকাল। তারাও যারপরনাই অবাক।

“ছফা, আপনি এসব–

হাত তুলে পিএসকে থামিয়ে দিল নুরে ছফা। তার দিকে ফিরে আশ্বস্ত করার ভঙ্গী করল সে। বন্দির দিকে ফিরল আবার। “তােমার নাম তাে রুখসানই….তাই না?”

‘বুল শিট! আমি সুস্মিতা….সুস্মিতা সমাদ্দার!” বেশ চেঁচিয়েই বলল।

মুচকি হাসি ফুটে উঠল ছফার ঠোটে। তবে সেই হাসিতে প্রশান্তিও আছে। “তো তুমি রুখসান নও?”

অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল বন্দি, “এই রুখসানটান কে? আপনি কার কথা বলছেন?”

ভ্র কপালে উঠে গেল ছফার।“কেন, ডাক্তার আসকার তাে আমাকে একথাই বলেছেন  তুমি আসলে রুখসান!”

বন্দির চোখ কুঁচকে গেল।

আশেক মাহমুদ কিছু বুঝতে না পেরে আসলামের দিকে তাকাল। সে কাঁধ তুলল। কেবল, মুখে কিছুই বললাে না। ছফার এমন কর্মকাণ্ডে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে সেটা কারাের কাছেই পরিস্কার নয়।

“আমি সুস্মিতা সমাদ্দার! ওকে? ইউ বাঞ্চ অব ব্লাডি ফুল!” তিক্তমুখে বলল সে। “একজন এসে আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে বলাতে চাইছে, আমি মুশকান….আর-একজন এসে বলছে, আমি রুখসান! হােয়াট দ্য হেল ইউ আর ট্রাইং টু ডু?”

মুচকি হাসল ছফা।স্থিরচোখে চেয়ে রইল মেয়েটার দিকে।“তােমার মায়ের নাম কী, বলাে তাে?”

বিস্মিত হল সুস্মিতা।

“আমি জানতে চাইছি, তােমার মায়ের নাম কী?” এবার ধমকের সুরে করা হল প্রশ্নটা।

গভীর করে দম নিয়ে নিল বন্দি।“শুভমিতা সমাদ্দার।”

– কপালে তুলে অবাক হবার ভান করল ছফা। “অবশ্য কলকাতা থেকে এরকমটাই শুনে এসেছি, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলবে তােমার মায়ের নাম মুশকান সােহেলি!”

ঘরে আলােড়ন তুলল কথাটা।একই সঙ্গে সুস্মিতা, পিএস আর আসলাম অবাক হল। “মুশকান আমার মা!? ইউ পিপল গন ম্যাড!” অবিশ্বাসে বলল বন্দি। মাথা দোলাল ছফা। “আমি না, পাগল তােমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ডাক্তার আসকার। ভদ্রলােক কখন কী বলেন নিজেও জানেন না বােধহয়।”

চোখ কুঁচকে তাকাল সুস্মিতা, কী বলবে ভেবে পেল না। নীচের ঠোট কামড়ে ধরল সে।

“এসব কী হচ্ছে?”অধৈর্য হয়ে বলে উঠল পিএস। ছফা তাকাল তার দিকে। “সরি, স্যার। আমি আসলে একটা তথ্য যাচাই করছিলাম।

আসলাম মাথা নেড়ে সায় দিল। এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। ডাক্তার আসকার তার সামনেই এই গল্পটা করেছিলেন, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না তখন।

এদিকে সুস্মিতা কিছুই বুঝতে পারছে না, সে চেয়ে আছে ছফার দিকে।

কীসের তথ্য?”জানতে চাইল পিএস। “ডাক্তার আসকার আমাকে বলেছিলেন, যে মুশকানকে আমি খুঁজছি, সে আসলে রুখসান। আর রুখসানের মা হল মুশকান।”

“কী বলছেন এসব?” বাদ দিন, স্যার। ওটা ছিল ডাক্তার আসকারের আর-একটি ধোঁকা।” হুম, তা ঠিক আছে, কিন্তু এই মেয়েটা  ও-ই তাে মুশকান?” মাথা নেড়ে পিএসকে আশ্বস্ত করল ছফা।“এ ব্যাপারে আমার মনে কোনাে সন্দেহ নেই এখন। কলকাতা থেকে সব জেনে এসেছি।”

“কী জেনে এসেছেন?” চেঁচিয়ে উঠল সুস্মিতা। বাঁকাহাসি দিয়ে মেয়েটার দিকে ফিরল সে। “তােমার সমস্ত কীর্তিকলাপ!” নীচের ঠোট কামড়ে ধরল বন্দি।

“প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিককে দিয়ে নিজের চেহারাটা বদলে ফেলার পর তাকে হত্যা করেছে,” একটু থেমে পিএসের দিকে তাকাল। “তারপরও থেমে থাকেনি, স্যার, সুকুমার রঞ্জন নামের আর-একজনকে শিকার বানিয়েছে এই ডাইনী।”

আশেক মাহমুদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

“ডাক্তার আসকার ওকে কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নিজের শ্বশুড় বাড়িতে। এমনকি, যে ডিপি মল্লিককে দিয়ে চেহারাটা বদলে ফেলেছে এই ডাইনী, তার খোঁজও ডাক্তারই দিয়েছেন।”

“ওই ডাক্তার ওর সব অপকর্মের সঙ্গী,” বলল পিএস। “অসুস্থতার ভান করে দেশ ছাড়তে চেয়েছিল, আমি আটকে দিয়েছি।”

সুস্মিতা স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল পিএসের দিকে। লােকটা কে সে সম্পর্কে তার কোনাে ধারণাই নেই। তবে সে বুঝতে পারছে, ক্ষমতাবান কেউই হবে।

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “স্যার, আপনি চাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে আপনার বোনকে এখন দেখাতে পারেন, হাসিবের হত্যাকারী”

ছফার কথা শেষ হবার আগেই আক্ষেপে মাথা দোলাল আশেক মাহমুদ।“এই ডাইনী তাে চেহারাটাই পালটে ফেলেছে আমার বােন তাকে দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না, ভাববে….”কথাটা শেষ করল না সে।

এবার ছফা বুঝতে পারল। মৃত্যুপথযাত্রী হাসিবের মা মুশকানের এই চেহারা দেখলে হয়তাে ভাবতে পারে, তার ভাই তাকে শেষ সময়ে এসে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চাইছে। মাথা থেকে চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিল সে।“আচ্ছা, ওর সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল সে কোথায়?” আসলামের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।

“নীচতলায় আছে,” ছােট্ট করে জবাব দিল সাবেক এসআই। “নিরীহ একটা ছেলে, ওকে ছেড়ে দিলেই ভালাে হয়।”

পিএস তাকাল আসলামের দিকে। “ওকে ছেড়ে দিলে সমস্যা হবে না?” গানম্যান সন্দেহের সুরে জানতে চাইল।

“কী সমস্যা করবে ও?” পালটা জানতে চাইল ছফা। “আমরা যাকে খুজছিলাম তাকে পেয়ে গেছি। এই আসামিকে এখন হাসিবের কেসে অ্যারেস্ট দেখাব, এর সঙ্গে এই ছেলেটার কোনাে সম্পর্ক নেই।”  কিছুই বলল না আসলাম।

“ওকে একটা সিএনজিতে তুলে বাসস্টেশনে পাঠিয়ে দিলেই ভালাে হয়,”ছফা প্রস্তাব দিল।“কিছু টাকা দিয়ে দিলে সুন্দরপুরে চলে যেতে পারবে ছেলেটা।”

কথাটা শুনে কিছুটা আশান্বিত হল সুস্মিতা।

সম্মতির জন্য পিএসের দিকে তাকাল আসলাম। আশেক মাহমুদের মধ্যে দ্বিধা দেখা দিলেও কী যেন ভেবে ছফার কথাটা মেনে নিল অবশেষে।

“ঠিক আছে  ছেড়ে দাও ওকে।” এটা পছন্দ হল না গানম্যানের। তারপরও কোনাে প্রতিবাদ না করে নীচে চলে গেল। “এ পর্যন্ত কয়জনকে শিকার বানিয়েছ কলকাতায় ?”বন্দিকে জিজ্ঞেস করল ছফা। গভীর করে দম নিল সুস্মিতা, কিন্তু কিছুই বলল না।

“আর হাসিবকে কী করেছাে সেটাও বলাে। এখন তােমাকে বলতেই হবে, না বলে উপায় নেই।”

সুস্মিতা মুখটা সরিয়ে নিল অন্যদিকে। “তুমি ভেবেছিলে আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে?”বন্দির দিকে একটু ঝুঁকে এল সে।“কলকাতায় গিয়ে নতুন চেহারা আর নতুন পরিচয় নিয়েছিলে কি সুন্দরপুরে ফিরে আসার জন্যই? ওখানকার পুলিশের নজরে পড়ে যাও বলে কলকাতা থেকে পালিয়ে আবার পুরােনাে জায়গায় ফিরে গেছিলে?”

বাঁকাহাসি দিল সুস্মিতা। আমি তাে ভেবেছিলাম ওঁ-ই পালের গােদা,” পিএসকে ইঙ্গিত করে বলল। “এখন দেখছি নতুন আর-একজন এসে হাজির!”

ছফা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “আমাকে তুমি চেন না? নাকি না চেনার ভান করছাে?”

ছফাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল সুস্মিতা। “চিনবাে না কেন, আমাদের স্কুলে  মাস্টারমশাইয়ের অফিসে দেখেছিনা কদিন আগে।”

অবাক হলো ছফা।“ক-দিন আগে!”কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল সে। “দারুণ। তিন বছর আগের স্মৃতি তাহলে বেমালুম ভুলে গেছ? নাকি ভুলে যাওয়ার ভান করছাে?”

এবার সুস্মিতার অবাক হবার পালা। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ছফার দিকে। কিন্তু বুঝতে পারছে না যেন।

পিএসকিছু বলতে যাবে অমনি ঘরে ঢুকল আসলাম। তার চোখেমুখে অস্থিরতা।

কী হয়েছে?”

ওই ছেলেটা ”ইতস্তত করল গানম্যান। ছফা আর সুস্মিতাও আগ্রহী হয়ে তাকাল। “ছেলেটা তাে নেই!” “কী!”পিএস আঁতকে উঠল। “নেই মানে কী?”জানতে চাইল ছফা। একট কাচুমাচু খেলাে আসলাম। “ওকে নীচ তলায় রেখেছিলাম, ওখানে গিয়ে দেখি নেই পালিয়েছে। সেলিম আর বদরুল কিছুই বলতে পারছে না।”

সুস্মিতা অবিশ্বাসে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কথাটা বিশ্বাসই হচ্ছে না তার। “হাত-পা-মুখ বাঁধা ছিল,” ব্যাখ্যা করল আসলাম। তাকে খুবই লজ্জিত দেখাচ্ছে এখন। “দড়ি খুলে পালিয়েছে।”

“মিথ্যে কথা!” প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল সুস্মিতা। ঘরের বাকি তিনজন পুরুষ অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। “ওরা শ্যামলকে খুন করেছে!”

অধ্যায় ৭৭

সুস্মিতার অভিযােগের কথা শুনে পিএস আশেক মাহমুদ আর আসলাম রেগেমেগে একাকার হলেও নুরে ছফার কেন জানি মনে হচ্ছে, আসলেই ছেলেটাকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে।

উইটনেস এলিমিনেশন? হতে পারে।

“আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল,”সুস্মিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল।“ওরা ওকে মেরে ফেলবে।”

“চুপ কর!” ধমক দিয়ে উঠল আসলাম। “ন্যাকামি চোদাবি না, মাগি! ওই ছেলে পালিয়েছে!”

“আমি বিশ্বাস করি না!” চেঁচিয়ে উঠল বন্দি। “ও খুবই সহজ-সরল একটা ছেলে, জীবনে প্রথম এ শহরে এসেছে।”

পিএস গভীর করে দম নিল, নিজের রাগ দমন করতে বেগ পাচ্ছে সে। কিন্তু ছফা কিছু বলে পিএস আর তার গানম্যানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে।  “আমি অনেক চেষ্টা করেছি শ্যামলকে বাঁচাতে  পারলাম না,” অশ্রুপাত করতে করতে বলল।“আমাকে ক্ষমা করে দিস শ্যামল।”  “মাগি, তুই
নাটক বন্ধ করবি নাকি”বলেই আসলাম তেড়ে গেল বন্দিকে মারতে।

“আসলাম!”বাধা দিল ছফা।পিএসের গানম্যানকে সরিয়ে দিয়ে বন্দির সামনে এসে দাঁড়াল সে।“ওই ছেলেকে এরা খুন করবে কেন? আশ্চর্য!”কিন্তু কথাটা নিজের কাছেই কেমন দুর্বল শােনাল। এ “আপনি আসার আগে এই লােক আমাকে হুমকি দিয়েছিল শ্যামলকে খুন করবে বলে!”কান্নার দমকে হাঁপাচ্ছে সুস্মিতা।

– “ওকে খুন করার হুমকি কেন দেবে?”

“কারণ,” পিএসের দিকে তাকাল বন্দি। “এই লােক কী সব জানতে চাইছিল আমার কাছে। যদি না বলি তাহলে শ্যামলকে খুন করার ভয় দেখিয়েছিল তখন।”

কুঁচকে গেল ছফার, পিএসের দিকে তাকাল সে। কেমন বিব্রত বােধ করছে আশেক মাহমুদ।

তারপর আবার মেয়েটার দিকে ফিরল। “কী জানতে চেয়েছিল?”

“ওর কথা বিশ্বাস করবেন না,” রেগেমেগে বলল পিএস। “উলটো-পালটা বলে আপনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে ডাইনীটা।”

পিএসের দিকে অবিশ্বাসে তাকালাে বন্দি। রাগে ঘেন্নায় চিৎকার করে বলে উঠল, “লায়ার!” আসলাম আবারও তেড়ে আসতে চাইল কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল ছফা।স্থিরচোখে বন্দির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “উনি কী জানতে চেয়েছেন তােমার

কাছে?”

“এই লােক কী সব বলছিল আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, বিশ্বাস করুন,”সুস্মিতা সমাদ্দার বলল। “শেষে শ্যামলকে বাঁচানাের জন্য কিছু একটা বানিয়ে বলে দিয়েছি। এছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না আমার।”

পিএস কথাটা শুনে নিজের অভিব্যক্তি লুকোতে পারল না, দাঁতে দাঁত পিষে চেয়ে রইল কেবল।

“উনি কী জানতে চেয়েছেন, বলাে?”তাড়া দিল ডিবির ইনভেস্টিগেটর।

“এই লােকটা বারবার জানতে চাইছিল, মানুষের শরীরের কোন অর্গানটা খেলে” বমির উদ্রেক করছে, এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখেমুখে।

সুস্মিতা কথাটা শেষ না করলেও ছফার বুঝে নিতে কোনাে সমস্যা হল না। অবিশ্বাসে তাকাল পিএসের দিকে।

অধ্যায় ৭৮

রাতের খাবার খেয়ে আবার বই নিয়ে বসেছে কেএস খান। এই বইটা চুম্বকের মতাে টেনে রেখেছে তাকে। প্রায় শতবর্ষের পুরােনাে একটি ক্লাসিক। এক বন্ধু কানাডা থেকে পাঠিয়েছে গত সপ্তাহে সেভেন পিলার্স অব উইজডম। লরেন্স অব অ্যারাবিয়া খ্যাত স্যার টিই লরেন্সের আত্মজৈবনিক এই বইটি আকারে যেমন বিশাল তেমনি সুখপাঠ্য। চোখের সামনে এরকম বই মেলে রাখতে পারলে অন্য রকম ভালাে লাগে তার। কিন্তু পাশের ঘর থেকে মটু পাতলু নামের নিচুমানের একটি হিন্দি কার্টুনের শব্দ বার বার বিরক্ত করছে তাকে। আইনস্টাইনের নতুন নেশার নাম এই মটু পাতলু। পারে তাে সারা দিনই টিভিতে এই কার্টুন দেখে সে। টিভির শব্দের পাশাপাশি আইনস্টাইনের বালখিল্য হাসির শব্দও শােনা যাচ্ছে একটু পর পর। ছেলেটার এই শিশুতােষ বিনােদনে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে চায় না সে, কিন্তু বারবার তার পড়ায় মনোযােগ নষ্ট করছে এটা।

“আইনস্টাইন?” জোরে ডাক দিল।“সাউন্ডটা একটু কমা!” কাজ হল এতে। টিভির ভলিউম কমিয়ে দিল ছেলেটি।

সন্তুষ্ট হয়ে খােদাদাদ শাহবাজ খান আবারও মনোযাগ দিল বইয়ের পৃষ্ঠায়। লরেন্সের রােমাঞ্চকর কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে ডুবে গেল সে। এই বই থেকেই বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র লরেন্স অব অ্যারাবিয়া নির্মাণ করা হয়েছিল। স্কুল পালিয়ে সেই ছবি মধুমিতা সিনেমা হলে গিয়ে দেখার স্মৃতিটা মনে পড়ে গেল তার। পিটার ওটুলের অসাধারণ অভিনয়, বেদুইন শেখের চরিত্রে ওমর শরিফের অদ্ভুত অ্যাকসেন্টে বলা ইংরেজি, মরুভূমির চমৎকার দৃশ্য, মরুঝড়, মরীচিকা, বেদুইনদের সঙ্গে যুদ্ধ—ডেভি লিনের বিশাল ক্যানভাসের মহাকাব্যিক চলচ্চিত্রটিকে পরিণত করেছে অল টাইম ক্লাসিকে।

এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলে একইসঙ্গে বিরক্ত এবং অবাক হল কেএস খান। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দশটার পর কে এল?  আইনস্টাইনকে কিছু বলতে হল না বলে খুশিই হল। দরজা খােলার শব্দ শুনে বুঝতে পারল, ছেলেটা তার প্রিয় কার্টুন রেখে দেখতে গেছে এই অসময়ে কে এসেছে।

ভাড়াটেদের কেউ হতে পারে। এরা পান থেকে চুন খসলেই সােজা তার কাছে চলে আসে। কারাের দরজার নবলুজ হয়ে গেছে তাে, কারাের বাথরুমের ট্যাপ কাজ করছে না। কেউ এসে বলবে-ফ্ল্যাশটা নষ্ট, কেউ জানাবে এ মাসে ভাড়া দিতে একটু দেরি হবে,কী একটা সমস্যা হওয়াতে হাত খালি হয়ে গেছে। মালিক হিসেবে সে যথেষ্ট উদার,অন্য সব বাড়িওয়ালাদের মতাে আচরণ করে না। আইনস্টাইনও যথেষ্ট সজাগ থাকে সব সময়, আর এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করে ভাড়াটেরা-রাত-বিরাতে এসে হাজির হয় সমস্যার কথা নিয়ে। যেন এক্ষুণি সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে!

তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল আনমনেই। বইটা বুকের ওপর রেখে শােনার চেষ্টা করল অসময়ে কে এল, কী অভিযােগ নিয়ে এল। কিন্তু কোনাে কিছুই তার কানে গেল না। শুধুমাত্র পাশের ঘর থেকে মটু পাতলুর মৃদু শব্দটা ছাড়া। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যে-ই না আইনস্টাইনকে ডাকতে যাবে, তখনই তার মনে হল শিয়রের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে!

চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল! এতক্ষণ ধরে আত্মজৈবনিক একটি বই পড়ছিল। কিন্তু এখনকার বাস্তবতাটা হরর গল্পের চেয়েও বেশি ভীতিকর!

অধ্যায় ৭৯

প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, গুলশানের সেই গােপন আস্তানার এক ঘরে পড়ে ছিল শ্যামাল। চেষ্টা করছিল হাতের বাঁধনটা ছিড়ে ফেলতে কিন্তু কারাের পায়ের শব্দ শুনে থেমে যায়। একটু পরই টের পায় সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাবার শব্দ। হাফ ছেড়ে বাঁচে, আবারও মনােযােগ দেয় হাতের বাঁধনটা ছিড়ে ফেলার কাজে।

পনেরাে-বিশ মিনিটের সাধনার পর দড়িটা ছিড়ে যায় অবশেষে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের বাঁধনটা খুলে ফেলে। তারপর মুখের বাঁধন খুলতেই বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে শুধু নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে হাপিয়ে উঠেছিল। নিজেকে ধাতস্থ করতেই পায়ের বাঁধনটা খুলে পুরােপুরি মুক্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয় এই বাড়ি থেকে যতক্ষণ বের না হচ্ছে সে আসলে বন্দি!  সব সময় মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করবে—রমাকান্ত কামারের এই কথাটা স্মরণ করে শ্যামল। কিন্তু ঢাকায় এসে যে পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেরকম কোনাে কিছু তার গােটা জীবনে ঘটেনি। মানুষসহ সকল প্রাণীকেই সব কাজ প্রথম বারের মতাে করতে হয়। মাস্টারের আর-একটি কথা তার মাথার ভেতরে উচ্চারিত হয় তখন।  গভীর করে দম নিয়ে নিঃশব্দে, পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয় শ্যামল। একটা সুবিধা আছে এই সুনশান বাড়িতে- নীচতলার কোনাে ঘরেরই দরজা-জানালা নেই, সবগুলােই চৌকাঠসহ খুলে নেওয়া হয়েছে। তাকে রাখা হয়েছে একেবারে ভেতরের দিকে একটা ঘরে। সামনের দিকে যে ঘরটা আছে, সেখানে আসতেই দরজার খােলা অংশ আর জানালার ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে বাইরের দৃশ্যটা দেখতে পায়। একটা বাতি থাকার  কারণে ওখান থেকে মেইনগেটটা দেখতে পেয়েছিল গেটের সামনে এক লােককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিনতে পারে সে। দুপুরে এই লােকই তার হাত-পা-মুখ বেঁধেছিল। তার। মানে, কমপক্ষে আরও দু-জন লােক আছে।  যে ঘরে তাকে বন্দি করে রেখেছিল সেখানে আবারও ফিরে আসে শ্যামল। বুঝতে পারে, এটাই বাড়ির পেছন দিক। বড়ো দুটো জানালা ছিল যেখানে, সেটা একদমই ফাকা। সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখতে পায় বাড়ির পেছন অংশের সীমানা প্রাচীরটি মাত্র চার-পাচ হাত দূরেই। জায়গাটা অন্ধকার আর ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ। ঘর থেকে প্রাচীরের ওপাশে কী আছে দেখা যায় না। দেয়ালটা আট ফুটের মতাে উচু। গ্রামের ছেলে সে, বড়ো বড়ো
গাছ তর তর করে বেয়ে উঠতে পারে। আর এটা তাে একটা দেয়াল!  জানালার ফাঁকা অংশ দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায়, দু-হাত মাথার ওপরে তুলে দেয়ালের ওপরের প্রান্তটা ধরতে পারে কোনােমতে। এটাই যথেষ্ট ছিল তার জন্য। দেয়ালটা শক্ত করে ধরে, পুরাে শরীরটা ওপরে তুলে দিতেই ডান পা-টা উঁচু করে দেয়ালের ওপরে রাখে। এরপর খুব অনায়াসেই
উঠে আসে দেয়ালের ওপরে। সেখান থেকে নীচের অন্ধকারে ভালাে করে তাকিয়ে বুঝতে পারে, দুটো বাড়ির সীমানা প্রাচীরের মাঝখানে পাঁচ-ছয় ফুটের মতাে যে খালি জায়গাটা আছে সেটা একটা ড্রেন। জায়গায় জায়গায় কংক্রিটের স্ল্যাব বসানাে থাকলেও অনেক জায়গাই উন্মুক্ত।

শ্যামল আস্তে করে দেয়ালের প্রান্ত ধরে শরীরটা নামিয়ে দেয়। তার পা নীচের স্ল্যাবটা ছুইছুই করতেই হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে প্রায় বিনা শব্দে নেমে আসে। স্ল্যাবের ওপর নেমেই দু-দিকে তাকায়। ড্রেনটা কিছু দূর গিয়ে বাঁয়ে নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে সােজা চলে গেছে ছােট্ট একটি টিনের দরজার দিকে। খাটো সেই দরজার ওপর দিয়ে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। শ্যামল ওই দরজাটাই বেছে নেয় পালানাের জন্য।

কয়েক মিনিট পরই নীচু গেটটা খুলে ড্রেন থেকে ফুটপাতে উঠে আসে, বুঝতে পারে কোন রাস্তা দিয়ে গেলে কোথায় যাওয়া যায়, কিন্তু এটা বুঝতে পারে, সে এখন পুরােপুরি মুক্ত। বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে রাস্তার ডান দিক দিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা বেশ সুনশান, দু-পাশের সারি সারি বাড়িগুলাে আলােকিত। মাঝেমধ্যে রাস্তা দিয়ে কিছু প্রাইভেট কার আসা যাওয়া করছিল। রাস্তার বাম দিকে জ্বলজ্বলে একটি নিয়ন সাইন দেখতে পায় সেঃ তান্দুরি হাউজ। তার পাশের বাড়িটার হােল্ডিং আর রােড নাম্বার মুখস্ত করে নিয়ে হাটার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। তার পকেটে কিছু টাকা আছে, আর সেটাই যথেষ্ট একটা ফোন কল করতে।

অধ্যায় ৮০

নুরে ছফা বিস্ময়ে চেয়ে আছে পিএসের দিকে। তার ধারণা ছিল, ভদ্রলােক নিজের বড়ো বােনের ছেলে হাসিবের হত্যাকারীকে ধরতে চায়, মৃত্যুপথযাত্রী বােনকে শেষ একটি সুসংবাদ দিতে চায়—তার ছেলের হত্যাকারী ধরা পড়েছে।

কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, ব্যক্তিগত আবেগও হেরে যায় মানুষের লােভ আর স্বার্থের কাছে! যৌবন দীর্ঘায়িত করা কিংবা আয়ুবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষার মতাে লালসা দ্বিতীয়টি আছে কিনা ছফা জানে না। কেএস খানের সতর্ক বাণীটার কথা আর-একবার মনে পড়ে গেল তার। অভিজ্ঞ ইনভিস্টিগেটর যেন দিব্যদৃষ্টিতে সব কিছু আগেভাগে দেখতে পেয়েছিল।

আক্ষেপে মাথা দোলাল। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর, বিগত তিন বছরে হাতে গােনা কয়েকবার ফোন করেছিল প্রধানমন্ত্রীর পিএস,এছাড়া খুব একটা তাড়া দেয়নি। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী বােনের কাছ থেকে মুশকানের যৌবন দীর্ঘায়িত করার রহস্যের কথা জানতে পেরে কেন উঠে পড়ে লাগল— এবার সেটা পরিস্কার হয়ে উঠেছে তার কাছে।

সুস্মিতা নামের বন্দি মেয়েটি মুশকান জুবেরি কিনা সেটা নিশ্চিত হবার জন্য এই তথ্যটা নাকি জানতে চেয়েছিল আশেক মাহমুদ-ছফার কাছে এটা বিশ্বাসযােগ্য বলে মনে হয়নি। সুস্মিতা যে মুশকান সেটা প্রমাণ করার কিছু নেই। ছফা নিশ্চিত হয়েই কলকাতা থেকে এসেছে।

“আমাকে অনেক টর্চার করেছে এরা, শ্যামলকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে  অবশেষে বাধ্য হয়েই বানিয়ে টানিয়ে কিছু একটা বলে দিয়েছি।”

পিএসের মুখ কঠিন হয়ে গেলেও পরক্ষণেই অভিব্যক্তি পালটে হাসিমুখে বলল, “দেখলেন তাে….আবার ভোল পালটে ফেলেছে।”

মাথা নেড়ে সায় না দিয়ে পারল না ডিবির ইনভেস্টিগেটর। “তাহলে তুমি বলতে চাইছাে, তুমি মুশকান জুবেরি নও?”

“অবশ্যই না! আমি সুস্মিতা সমাদ্দার। ডাক্তার আসকার আমার বাবা!”

আক্ষেপে মাথা দোলাল নুরেছফা। পিএসআশেক মাহমুদ আর তার গানম্যান আসলাম মুচকি হাসছে।

“তাহলে প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিক আর সুকুমাররঞ্জনকে হত্যা করেছে কে?

প্রশ্নটা না করে পারল না।  গভীর করে দম নিয়ে নিল সুস্মিতা।

“আমি সব জানি। সুকুমাররঞ্জনের নিখোঁজ কেসে কলকাতার পুলিশ সল্টলেকের বাড়িতে গিয়েছিল তােমাকে ইন্টারােগেট করার জন্য। কিন্তু তারা দ্বিতীয়বার সেখানে যাবার আগেই তুমি পালিয়ে যাও।”

সুস্মিতা বিস্মিত হল, নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে পারল না পুরােপুরি।

“অবশ্য ডিপি মল্লিককে যে তুমিই হত্যা করেছে সেটা এখনও তারা জানে না।” একটু থেমে বন্দির চোখে চোখ রেখে জোর দিয়ে বলল সে, “কিন্তু আমি জেনে গেছি।”

কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না। ঘরে নেমে এল নীরবতা। “এসবের কী ব্যাখ্যা আছে তােমার কাছে?”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিল সুস্মিতা। “আমি না….মুশকান জুবেরি! ও খুন করেছে সুকুমারকে!”

নুরে ছফা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল। একই অবস্থা পিএস আর আসলামেরও।

“সব দোষ বাপাইর!”দাঁতে দাঁত পিষে বলল বন্দি।“ওর জন্যই আজকে আমার এই অবস্থা।”

“কে? কার কথা বলছ?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ছফা। “আমার বাবা….ডক্টর আসকার।”

মাথা দোলাল আক্ষেপে।“আমার তাে মনে হয় ডাক্তারের প্রতি তােমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। উনিই তােমাকে কলকাতায় আশ্রয় দিয়েছেন….এত কিছু করেছেন!”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল সুস্মিতা। “আমাকে আশ্রয় দিয়েছে? হােয়াট দ্য হেল ইউ আর টকিং! এই জেনে এসেছেন কলকাতা থেকে?” রাগেক্ষোভে মাথা দোলাল সে।“ওটা আমার মায়ের বাড়ি  সব্বাই জানে!”

বাঁকাহাসি দিল ছফা।“তাহলে মুশকান জুবেরি অন্য একজন?আর তুমি তাকে চেনাে?” গভীর করে নিশ্বাস নিল সুস্মিতা।“হ্যা, আমি ওকে চিনি।”

বন্দির কাছ থেকে আরও কিছু শুনতে চায় ছফা। দেখতে চায়, মুশকান জুবেরির নতুন কৌশলটা কীরকম।

“আপনি যাকে খুঁজে বের করেছেন সে মুশকান জুবেরি! আমি না! ওই যত নষ্টের মূল।রুটস অব ইভিল!” চোখমুখ বিকৃত করে বলল।

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল ছফা। “কী বলতে চাইছাে, তুমি?!”

আবারও গভীর করে দম নিয়ে নিল বন্দি।“বাপাই ওই মহিলাকে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েই যত বিপদ ডেকে এনেছে।”

নুরে ছফার মনে হল আবারও একটা গােলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে। ঘন সাদা ধোঁয়াময় এক অন্ধকার!

“ও চালাকি করছে,”আস্তে করে বলল পিএস।“ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।

ছফা মাথা নেড়ে সায় দিলেও জানতে চাইল বন্দির কাছে, “তাহলে প্লাস্টিক সার্জনকে তুমি চিনতে? সুকুমাররঞ্জনকেও?”

“সার্জনকে আমি চিনি না, কিন্তু সুকুমারকে চিনতাম….ও আমার ফ্রেন্ড ছিল।” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল ছফা।

“কিন্তু মুশকান ওকে কী করেছে জানি না।মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরই পুলিশ আসে, ওরা সুকুমারের নিখোঁজ হবার জন্য আমাকেই সন্দেহ করতে শুরু করে।”  “তুমি তাহলে জানাে না মুশকান জুবেরি ওকে কী করেছে?” কুঁচকে জানতে চাইল
ছফা।

“প্রথম দিকে কিছুই জানতাম না। বাড়িতে পুলিশ আসার পর বাপাইর কাছে জানতে চেয়েছিলাম  বাপাইও কিছু জানে না এ ব্যাপারে। তবে মুশকান পালিয়ে গেলে বুঝতে পারি কাজটা ও-ই করেছে। আমার কাছে সবটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে তখন।”

“এই ডাইনী সব নাটক করছে, ছফা!” রেগেমেগে উঠে দাঁড়াল পিএস।“ওর কোনাে কথা বিশ্বাস করবেন না। একেক সময় একেক কথা বলে বিভ্রান্ত করছে।”

ছফার কাছে অবশ্য তা মনে হচ্ছে না, তবে সে পুরােপুরি নিশ্চিত হতে চায়।

“সুকুমারের সঙ্গে ওই মহিলার ঠিক কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল আমি কিছু জানি না। বিশ্বাস করুন। প্রায় কেঁদেই ফেলল সে।“আমি যে সত্যি বলেছি, সেটা এক সময় না এক সময় ঠিকই বুঝতে পারবেন আপনারা। আর যখন বুঝতে পারবেন, খুবই পস্তাবেন!” বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কথাগুলাে। “আপনারা ভুল মানুষকে ধরে এনে কী সব উলটাপালটা কথা জানতে চাইছেন!”

ছফা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল বন্দির দিকে। এই মেয়ে দাবি করছে, প্লাস্টিক সার্জন আর সুকুমারের গুমের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। তারপরই ছফার মনে হল, সে এই মেয়ের সব কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে! কিন্তু মেয়েটার কথায় কিছু ফাঁক আছে। নড়েচড়ে বসল সে।

“তােমার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতায় ডাক্তার আসকারের শ্বশুড় বাড়ির দারােয়ান দু-জন মেয়ের কথা কেন বলেনি?” ছফা স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল বন্দির দিকে।

“আমার সব কথা আগে শুনুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।” “বলাে,কী বলবে।” আশেক মাহমুদ আর আসলাম অসন্তুষ্ট হলেও কিছু বলল না।

চোখ বন্ধ করে ফেলল সুস্মিতা, গভীর করে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল। “বছরখানেকেরও বেশি হবে, হুট করেই লন্ডন থেকে কলকাতায় চলে আসি আমি, বাড়িতে এসে দেখি তিনতলায় এক মহিলা এসে উঠেছে।বাপাই বলল, তার এক বন্ধুর মেয়ে। তাে, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালাে লাগেনি। আমি খুব প্রাইভেসি সচেতন, আর আমাদের বাড়িটা আসলে ডুপ্লেক্স, অনেক পরে ছাদের এক অংশে একটা রুম বানিয়েছিল পারমিতা মাসি  আমার মায়ের বড় বােন।” একটু থেমে আবার বলল, “মাসি মারা যাবার পর ওটা খালিই ছিল, ওখানে পরিবারের বাইরে কাউকে থাকতে দেওয়াটা আমার পছন্দ হয়নি। তবে বাপাইর কারণে আমি এ নিয়ে কিছু বলিনি।”  ছফা মনে করার চেষ্টা করল।সুকুমারের কেসটা যে অফিসার তদন্ত করছে, সে বলেছিল, তিন তলায় সুস্মিতার এক কাজিন থাকত। সুস্মিতা পালিয়ে যাবার পর সেই মহিলাও বাড়ি ছাড়ে। তাহলে কী ওটাই মুশকান ছিল? মেয়েটা সত্যি বলছে?

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল সে।“তােমার বাবা তখন কোথায় ছিলেন?” ছফার দিকে তাকাল বন্দি।“বাপাই তাে আজ এখানে কাল ওখানে সেই ছােটোবেলা থেকেই এমনটা দেখে আসছি। মাঝেমধ্যে আসত….ক দিন থেকে আবার চলেও যেত।”

কিছু বলল না ছফা।

“একই বাড়িতে থাকার কারণে ওই মহিলার সঙ্গে রােজই দেখা হত। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠল। আমার বাড়িতে যেহেতু বন্ধুবান্ধবের আড্ডা হত, ওই মহিলার সঙ্গে আমার কিছু বন্ধুর ভালােই সখ্য গড়ে ওঠে এক সময়। সুকুমারের সঙ্গেও বেশ ভালাে জানাশােনা ছিল ওর।”  ছফা স্থি
রচোখে চেয়ে রইল মেয়েটার দিকে। কেউ মিথ্যে কথা বললে সেটার ধরার মতাে প্রশিক্ষণ তার আছে, সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বােঝার চেষ্টা করছে, মেয়েটার কথা কতটুকু সত্যি।

“একদিন হুট করেই, কাউকে কিছু না বলে ওই মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল, তারপরই বাসায় এল পুলিশ। জানাল, সুকুমারকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখনও বুঝতে পারিনি কিছু। আর সুকুমার যে ওইদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিল সেটাও জানতাম না।তাই পুলিশকে বলেছি, ওইদিন ও আমাদের বাড়িতে আসেনি।”

“তারপর ?”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিল সুস্মিতা।“পুলিশ আসার কথা বাপাইকে বলার পরই ও আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। দ্রুত লন্ডন থেকে চলে আসে কলকাতায়। বাপাই-ই আমাকে কনভিন্স করে, তদন্ত এগােতে থাকলে নাকি আমি ফেঁসে যাবাে। কেননা সুকুমার আমার বন্ধু ছিল। পুলিশকে যদি এখন মুশকানের কথা বলিও তারা এটা বিশ্বাস করবে না। ভাববে, নিজেকে বাঁচানাের জন্য এমন এক ভুতের অবতারণা করছি যার অস্তিত্বই নেই।”

“কেন, তােমার বাড়ির দারােয়ান সাক্ষি দিতে পারত, তােমাদের বাসায় আর-একজন মহিলা থাকত তিন তলায়?”  মাথা দোলাল সুস্মিতা। “ওই মহিলা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর পর পুরােনাে
দারােয়ানকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেয় বাপাই। নতুন দারােয়ান ওই মহিলারা কিছুই জানত না।”

ছফা বুঝতে পারল, মুশকানকে বাঁচানাের জন্য ডাক্তার অসিকার এসব করে। অবশ্যই ওই মহিলার নির্দেশমতাে। মেয়েটার কথা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হচ্ছে এখন। এখনকার দারােয়ানও ইন্সপেক্টর অতনুুর কাছে স্বীকার করেছিল, সে এমনকি সুস্মিতাকে দেখেওনি। তার কথা শােনেনি। মুশকান তাে দূরের কথা! ইন্সপেক্টর অতনু যা কিছু জেনেছে পুরােনাে দারােয়ানের কাছ থেকেই জেনেছে।

“এ দেশে ঢােকার পর তুমি কি সরাসরি সুন্দরপুরেই চলে গেছিলে?”

“না। আমি ঢাকায় থেকেছি কয়েক মাস….হাঁপিয়ে উঠেছিলাম এখানে। এ শহরে বাপাই ছাড়া আমার কোনাে পরিচিত মানুষজন ছিল না, শহরটাও আমার একদম ভালো লাগত না। তাছাড়া, বাপাইও বাইরে যাবে বলে আমাকে একা রাখতে চায়নি এখানে। ও ঠিক বুঝতে পারছিল না কী করবে। এরকম সময়ে একদিন আমাকে নিয়ে সুন্দরপুরে গেল স্কুলটা দেখতে, জায়গাটা ভীষণ ভালাে লেগে গেল আমার। তখনই বাপাই বলেছিল, চাইলে এখানে গানের টিচার হিসেবে জয়েন করতে পারি আমি। অফারটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।”  ছফার লাই-ডিটেক্টিং প্রশিক্ষণ কাজে দিল না। ধন্দে পড়ে গেল সে। মেয়েটা সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে—সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। কিছু বলতে যাবে, অমনি তার ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে বের করল সেটা, কলার আইডি দেখে কিছুটা অবাকই হল। এই অসময়ে কেএস খান তাকে ফোন দিয়েছে! একান্ত অনিচ্ছায় কলটা রিসিভ করল।

“হ্যালাে, স্যার?” পিএস, আসলামসহ সুস্মিতাও আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকল তার দিকে।

একটু ইতস্তত করে ছফা বলল, “জি, স্যার।”ওপাশের কথা শুনে গেল সে। খুব দ্রুত তার অভিব্যক্তি পালটে গেল, রীতিমতাে চমকে উঠল যেন। “কী?!”

অধ্যায় ৮১

মুশকান জুবেরিকে শিয়রে দেখতে পেয়ে কেএস খান তার জীবনে সবচাইতে বড়ো ভয়টা পেয়েছিল।ভূত দেখলেও হয়তাে এতটা ভড়কে যেতনা সাবেক এই ইনভেস্টিগেটর। যে মহিলা মানুষ খেয়ে ফেলে তার সঙ্গে কি ভূতের তুলনা চলে?ভূত কখনও মানুষ খেয়েছে। বলে জানা নেই তার!  মহিলাকে দেখে মি.খানের ভয়ে জমে যাবার আরও কারণ ছিল মানুষখেকো মুশকান জুবেরির হাতে পিস্তলও আছে!

“একদম আওয়াজ করবেন না,”শান্তকণ্ঠে বলেছিল মিসেস জুবেরি।“আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।”

“আইনস্টাইনের কী করছেন?” ঢােক গিলে প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে জানতে চেয়েছিল কেএস খান।

কুঁচকে ফেলেছিল মহিলা।“কার কথা বলছেন!” ভুলটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল, “ওই পােলাটা….দরজা খুইলা দিছে যে।” “ওহমুশকান জুবেরি বুঝতে পেরে বলেছিল। “ওর নাম আইনস্টাইন?” আবারও ঢােক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল মি.খান।“হ….আমি দিছি নামটা।”

“সুন্দর নাম!” প্রশংসার সুরে বলে ওঠে মুশকান। তারপর দেয়ালে টাঙানাে আইনস্টাইনের জিভ বের করে রাখা কৌতুককর ছবিটার দিকে তাকায়।  খােদাদাদ শাহবাজ খান বুঝতে পারছিল না, নুরে ছফা তাহলে কোন মুশকানকে খুঁজে পেয়েছে কলকাতায় গিয়ে? আর সুন্দরপুরেই বা গেল কাকে ধরতে? ছফা তাকে জানিয়েছে, এই মহিলা কলকাতায় গিয়ে এক প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়ে নিজের চেহারাটাই বদলে ফেলেছে! শুধু তা-ই নয়, সেই সঙ্গে নতুন পরিচয় আর সুস্মিতা সমাদ্দার নাম নিয়ে ফিরে গেছে সুন্দরপুরে! ছফার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তার সামনে এখন যে আছে সে কে?  এই মহিলাকে মুশকান হিসেবে মেনে নিতে কোনাে দ্বিধা নেই তার। কদিন আগেই মহিলার ছবি তাকে দেখিয়েছিল ছফা। ওই ছবির সঙ্গে এই মহিলার চেহারা একদম….

“ওকে নিয়ে ভাববেন না।” মুশকানের কথায় কেএস খানের চিন্তায় ছেদ পড়ে। “কার কথা কইতাছেন?”

“আইনস্টাইন। ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ও এখন ঘুমােচ্ছে,” কথাটা বলে হাতঘড়িতে সময় দেখে নেয়। “আধঘণ্টা পর ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“ওরে আপনে কী করছেন?” আতঙ্কের সঙ্গে জানতে চায় সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

স্মিত হাসে মুশকান।“ও ঘুমিয়ে আছে, পাশের ঘরে বিছানায় রেখে এসেছি। “ঘুমায়া আছে!”আতঙ্কের সঙ্গে বলেছিল সে।

“ভয়ের কিছু নেই। এক ধরণের হার্ব ব্যবহার করেছি, তা-ও সামান্য পরিমানে ক্লোরােফর্ম ইউজ করিনি। ওর কোনাে ক্ষতিই হবে না।”

কী ঔষধি গাছের নির্যাস ব্যবহার করেছে সেটা জানতে চায়নি সাবেক ডিবি অফিসার, তবে একটা দৃশ্য কল্পনা করতে পেরেছিল সেঃ ছােট্ট আইনস্টাইন দরজা খুলে দেখতে পেল অপরিচিত এক মহিলা। সে কে, কী চাই জিজ্ঞেস করেছিল সম্ভবত। কিন্তু মুশকান জুবেরি সে প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল কিনা কে জানে।ঝট করে ছেলেটার মুখ চেপে ধরেছিল ভেষজ ওষুধ মাখানাে রুমাল দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আইনস্টাইন অচেতন হয়ে ঢলে পড়ে, তাকে কোলে তুলে নিঃশব্দে পাশের ঘরের বিছানায় রেখে পিস্তলটা হাতে নিয়ে চলে আসে তার শিয়রে— সে তখন বইয়ের জগতে ডুবে ছিল। যখন টের পেল, ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। – “আমার কাছে কী চান আপনে?”মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আসল প্রসঙ্গে চলে এসেছিল কেএস খান।

কথাটা শুনে মুচকি হেসেছিল মুশকান। “খুব সামান্য একটা জিনিস।তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে।“নুরে ছফাকে ফোন দিন।”

কেএস খান ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিনিয়ে তাকিয়েছিল কথাটা শুনে।“ফোন দিয়া কী বলব?” “এই যে, আমিএখন আপনার এখানে আছি।”

মি.খান বিশ্বাস করতে পারছিল না। সামান্য এই কাজের জন্য মুশকান জুবেরি তার ডেরায় হানা দিয়েছে। “খালি এইটাই বলব?”অবিশ্বাসে বলেছিল সে।

“উমম….”একটু ভেবে নেয় মুশকান। “ছফাকে বলুন, যে মেয়েটাকে তারা আটকে রেখেছে ওকে ছেড়ে দিতে।”

“আমি কইলেই কি সে ছাইড়া দিব?”সাহস করেই কথাটা বলেছিল কেএস খান।

“না, তা কেন করবে। মনে হয় না এত সহজে ছেড়ে দেবে।” এ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকমি.খান। – “ওকে বলবেন, ওই মেয়েটাকে না ছাড়লে আমি আপনাকে আর আইনস্টাইনকে

মেরে ফেলব।”

কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য খােদাদাদ শাহবাজ খানের হৃৎস্পন্দন থমকে গিয়েছিল।

“ভয় পাবেন না,”আশ্বস্ত করে বলেছিল মুশকান।“এটা ছফাকে কনভিন্স করার জন্য বলবেন, আমি আপনাদের কিছু করব না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

কথাটা অন্য কেউ বললে হয়তাে বিশ্বাস করত, কিন্তু মানুষটা যখন মুশকান জুবেরি তখন বিশ্বাস করা কঠিন।

আমার বয়সকী তার টার্গেট হওনের উপযুক্ত? এই ভাবনাটা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল।

অধ্যায় ৮২

ছফার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে ফোনের ওপাশে আছে মুশকান জুবেরি— যাকে সে হন্যে হয়ে খুঁজছে বিগত তিন বছর ধরে! তার চেয়েও বড়ো কথা, কলকাতায় গিয়ে মাত্রই সে আবিষ্কার করেছে, এইমহিলা নিজের চেহারা পালটে, সুস্মিতা সমাদ্দার সেজে সুন্দরপুরের নতুন স্কুলে গানের শিক্ষকতা করছে। সেই সুস্মিতা সমাদ্দার এখন তাদের হাতেই বন্দি!  ছফার মনে হচ্ছে, তিল তিল করে বানানাে বিশাল বড়ো একটি ভবন গুঁড়িয়ে পড়ছে চোখের নিমেষে-তাসের ঘরের মতাে! নিজেকে পরাবাস্তব জগতে আবিষ্কার করল সে। যে অসম্ভব গল্পের সন্ধান পেয়েছিল সেটা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। – “আমাকে ভেবে তুমি সুস্মিতাকে আটকে রেখেছ!” ফোনের ওপাশ থেকে কথাটা বলেই হেসে ফেলল মুশকান।  ছফার চোখেমুখে একইসঙ্গে বিস্ময় আর বিব্রত হবার অভিব্যক্তি। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল সে। বন্দির দিকে তাকাল। সুস্মিতা
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, বােঝার চেষ্টা করছে কিছু। আর আশেক মাহমুদ, আসলাম কৌতূহল নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।  “আমি জানি তুমি এখন ওর সামনেই আছ..
..ওকে ছেড়ে দাও!”শান্ত কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুরে বলল মুশকান।“মি.খান আর বাচ্চা ছেলেটা প্রাণে বেঁচে যাবে।”

নুরে ছফা কী বলবে ভেবে পেল না।  “এই কলটা কেটে গেলে ধরে নেব তুমি চালাকি করছ, পুলিশকে ইনফর্ম করার চেষ্টা করছ,” একটু থেমে কণ্ঠটা আরও গম্ভীর করে বলল, “এটা কোরাে না, করলে আমি বাধ্য হব ওদেরকে শেষ করে দিতে।”

“ওদের কিছু করবে না, খবরদার!”দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল ছফা। এ কথা শুনে ঘরের সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তার দিকে।

“সেরকম কিছু করার ইচ্ছেও নেই আমার, কিন্তু চালাকি করলে সেটা করতে বাধ্য হব আমি।” ফোনের ওপাশ থেকে বলল মুশকান।

পিএস ইংগিতে জানতে চাইল কার সঙ্গে কথা বলছে ছফা। এক হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমাকে একটু সময় দিতে হবে।”

“কীসের জন্যে?”

“সিদ্ধান্ত নিতে।” “তুমি নিজে কী যথেষ্ট নও? সুস্মিতা কী তােমার কাছে বন্দি নয়?”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ছফার ভেতর থেকে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।  ‘চালাকি কোরাে না। আমি জানি ও তােমার কাছেই আছে। এক্ষুণি সুস্মিতাকে ফোনটা দাও, আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই
….এক মিনিট।”

ছফা সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। “আমার হাতে সময় খুব কম!” ফোনের ওপাশ থেকে তাড়া দিল মুশকান।

মন্ত্ৰতাড়িতের মতাে সুস্মিতার কাছে গিয়ে ওর কানে ফোনটা চেপে ধরে দাঁতে দাঁতে পিষে বলল ছফা, “কথা বলাে।”

“কী করছেন?” পিএস আঁৎকে উঠল। আসলাম অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“প্লিজ,”হাত তুলে পিএসকে থামিয়ে দিল ছফা, মুখে আঙুল তুলে চুপ থাকার ইশারা করল।

“হ্যালাে? কে বলছেন?” সুস্মিতা বলে উঠল। তারপর ফোনের ওপাশে যে আছে। তার কথা শুনে গেল চুপচাপ। মেয়েটার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সামান্য। “হুম ” বলল সে।“ঠিকাছে।”কথাটা বলেই ফোন থেকে কানটা সরিয়ে নিল।

ওদের কথা শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে ফোনটা আবার নিজের কানে ঠেকাল ছফা।

“আর-এক জনের কণ্ঠ শুনলাম….ওকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব তােমার। এই কলটা না কেটেই তুমি সুস্মিতাকে মুক্তি দেবে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তােমাকে।”

“আমাকে কথা বলতে হবে, এত কম সময়ে হবে না,” রেগেমেগে বলে উঠল নুরে ছফা।

“এক মুহূর্তও নষ্ট কোরাে না। মনে রেখাে, পাঁচ মিনিট।” ছফা ফোনটা নামিয়ে পিএসের দিকে তাকাল।“এই মেয়ে মুশকান জুবেরি না, স্যার।” “কী?”বিস্ময়ে বলে উঠল আশেক মাহমুদ। “আমরা ভুল মানুষকে ধরেছি।” হতভম্ব হয়ে তাকাল পিএস।“কিন্তু আপনি তাে কলকাতা থেকে সব জেনে এসেছেন!”

গভীর করে দম নিয়ে নিল ছফা। তার পুরাে তদন্তটা যে এভাবে হাস্যকর হয়ে উঠবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। “আমার হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে  মনে হচ্ছে।”

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল পিএস। কী বলছেন এসব!” আসলামও সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।  “ওকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুক্তি না দিলে আমার এক সিনিয়র রিটায়ার্ড অফিসার কেএস খান আর তার কাছে থাকা এক বাচ্চা ছেলেকে মুশকান মেরে ফেলবে।ও ওদেরকে জিম্মি করে রেখেছে।”

“ফাজলামি করেন আমার সঙ্গে!” অবিশ্বাসে বলে উঠল আশেক মাহমদ। ছেড়ে দেব? পুরােপুরি কনফার্ম না হয়ে?”

“স্যার,”দাঁতে দাঁত পিষে বলল ছফা।“আমি কনফার্ম হয়ে বলছি, এই মেয়ে মুশকান জুবেরি না। মুশকানের সঙ্গে এইমাত্র আমার ফোনে কথা হয়েছে, এখনও লাইনে আয় সে।”

আশেক মাহমুদ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল ছফার দিকে। “ফাইন!”তারপর হাসিমুখে বলে উঠল, “তাহলে ওই মুশকানকে বলে দিন, সে ধরা না দিলে আমরা একে মেরে ফেলব।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইল ছফা।

“ওই ডাইনীকে ধরা দিতে হবে আমাদের হাতে,নইলে এই মেয়েটার সঙ্গে খুব খারাপ কিছু করা হবে।”

“স্যার, মুশকান ধরা দেবে না, বােঝার চেষ্টা করুন!”জোর দিয়ে বলল ছফা। “আমরা ভুল একজনকে ধরেছি। ওকে ছেড়ে না দিলে দুটো মানুষের জীবন….”

“দুটো কেন, চার-পাঁচটা মানুষ মরে যাক, আমার কী!”আশেক মাহমুদ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল। “আমি ওকে ছাড়ছি না।”

ছফা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল। পিএস যে এরকম কথা বলবে একদমই বুঝতে পারেনি। “আপনি বােঝার চেষ্টা করুন, স্যার!”

“এই মেয়েকে ছেড়ে দেবার চিন্তা বাদ দিন। আপনি ওই মুশকানকে ট্র্যাক করুন এক্ষুনি!”হুকুমের স্বরে বলল আশেক মাহমুদ।

“আমার হাতে সময় নেই।”

“কে আপনাকে সময় বেঁধে দিয়েছে?ওই মহিলা? ওই ডাইনীটা?” রেগেমেগে বলল পিএস।

ছফা নিশ্চুপ রইল। “আই সে, ট্র্যাক হার ডাউন।” প্রায় গর্জে উঠল পিএস।

আক্ষেপে মাথা দোলালাে সে, ডান হাত থেকে মােবাইলফোনটা বাঁ হাতে নিয়ে নিল, তারপর ঝট করে কোমর থেকে তুলে নিল পিস্তলটা, সােজা তাক করল আশেক মাহমুদ আর আসলামের দিকে। কয়েক পা পিছিয়ে গেল দু-জনকে নিশানায় রাখার জন্য।

“সরি, স্যার। আমার কিছু করার নেই।”

“হাউ ডেয়ার ইউ আর!” দাঁতে দাঁত পিষে বলল আশেক মাহমুদ। রাগে রীতিমতাে কাঁপছে।

আসলাম যেন বিস্ফোরিত হবে, তেড়ে আসতে চাইল সে। “খবরদার!”পিস্তলটা তার দিকে তাক করে বলল ছফা। “একদম নড়বে না।”

অধ্যায় ৮৩।

ডাক্তার আসকার অরিয়েন্ট হাসপাতালে নিজের অফিস রুমে বসে আছেন। তার শরীর আগের চেয়ে ভালাে তা বলা যাবে না। যদিও মনে হচ্ছে, রাত শেষ হবার আগেই তার নাজুক হৃৎপিণ্ড এত বেশি মানসিক চাপ সহ্য করতে পারবেনা।সুস্মিতা নিরাপদে আছে এটা না জানা পর্যন্ত বুকের এই ব্যথার উপশম হবে না।

সুস্মিতা এখন ক্ষমতাবান একজন মানুষের হাতে বন্দি। না জানি কতটা অত্যাচার আর নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা! সন্তানকে এই বিপদে ফেলে দেওয়ার জন্য তিনি নিজেই দায়ি! মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না।

ছফার আগমন টের পেয়ে নিজের সেলফোনটা ভেঙে কমােডে ফ্ল্যাশ করে দেন, আর সিমটা খুলে লুকিয়ে রাখেন কার্পেটের নীচে। ফলে, মেয়েটাকে জানাতেই পারেননি তিনি সুস্থ আছেন। সত্যি বলতে, সুস্মিতা যে তার খোঁজ করে, তাকে না পেয়ে ওয়াহাবকে ফোন দিতে পারে- এটা মাথায়ই ছিল না। অসুস্থতার ভান করতে গিয়ে ওয়াহাবকে তিনি সত্যিটা জানাননি। ছেলেটাকে সেজন্যে দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। সে যা দেখেছে তা-ই বলেছে সুস্মিতাকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আসকার। শুভমিতা আর তার লাভচাইল্ড এই মেয়ে। তার জন্যই শুভমিতার সঙ্গে বন্ধনটা পাকাপাকি করতে হয়েছিল। কতই না আদরের, কতই না যত্নে বড়ো করেছেন। আর আজ, সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করেও কিছুই করতে পারছেন না। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতেন, মুশকানকে সাহায্য করতে গেলে নিজের সন্তানের ওপর এত বড়ো বিপদ নেমে আসবে, তাহলে কী তিনি কখনও কলকাতায় মুশকানকে আশ্রয় দিতেন?

আর-একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। মুশকানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব সুদীর্ঘ কাল ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে যখনই দরকার পড়েছে, তারা একে অন্যেকে সাহায্য করেছে। তাদের বন্ধুত্বের এই শক্ত বন্ধন কখনও নড়বড়ে হয়নি, বরং দিনকে দিন সেটা পােক্ত হচ্ছে!

তার জীবনের একমাত্র ভালােবাসা শুভমিতার আগমন মুশকানের কল্যাণেই। লন্ডনে আসার পর শুভমিতার সঙ্গে মুশকানের বন্ধুত্ব হয় খুব দ্রুত। তারা দুজনেই ছিল রবীন্দ্র সংগীতের ভক্ত। ভালাে গাইতেও পারত। মুশকানই একদিন তার সঙ্গে শুভমিতার পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথম দেখাতেই আসকারের মনে হয়েছিল, সত্যিকারের ভালােবাসার সন্ধান পেয়ে গেছেন।মুশকানকে যখন কথাটা জানালেন, সে তাে হেসে খুন।এত দ্রুততম সময়ে? লজ্জা পেয়েছিলেন আসকার। তবে গল্প-সিনেমার মতােই তাদের সম্পর্ক প্রেমের দিকে গড়ায়, আর এক্ষেত্রে মুশকানের অবদানই ছিল বেশি।

অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে চাইলেন ডাক্তার। তিন বছর আগে, ওই কেএস খানের কথার ছলচাতুরিতে পড়ে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়ে যদি মুশকানের আন্দিজের ঘটনার কথাটা না বলতেন, তাহলে এত কিছু হত কিনা কে জানে! যদিও এই ভুলের মাশুল তিনি শুধরেছেন কয়েক দিন আগে ছফাকে আর-একটি নতুন উপাখ্যান শুনিয়ে। অবশ্য এই উপাখ্যানটির জন্ম হয়েছিল আরও অনেক আগে, যখন আমেরিকা থেকে অরিয়েন্ট হাসপাতালে এক ডাক্তার এসে মুশকানের সম্পর্কে গা শিউরে ওঠাকথা বলতে থাকে। তখনই জন্ম নেয় রুখসান আর মুশকানের গল্পটার। এটা মুশকানেরই আইডিয়া ছিল। তাকে বলেছিল, ওই ডাক্তারকে যেন এই গল্পটা বলা হয়। বলাই বাহুল্য, বেশ ভালােভাবেই ওটা কাজে দিয়েছিল। গল্পটা বিশ্বাস করেছিল ভদ্রলােক। কিন্তু ছফা সম্ভবত বিশ্বাস করেনি। সবটা শােনার পর সে-ও কিছুক্ষণ ধন্দে পড়ে গেছিল, তারপরই সমস্ত সন্দেহ কাটিয়ে ওঠে।

আর-একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আসকারের ভেতর থেকে। মুশকানকে তিনি যেমন সাহায্য করেন সব সময়, সে-ও তার যে-কোনাে বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। কলকাতায় সুস্মিতা যে দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছিল, সেটাও মুশকানই সামাল দিয়েছে ঠান্ডা মাথায়। তাই সব কিছুর জন্য নুরে ছফা আর প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদকেই দায়ী করছেন তিনি মুশকানকে নয়।’

এই লােকটা ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। ওই পিএস নাকি তার বােনের ছেলে হাসিবের নিখোঁজের জন্য মুশকানকে দায়ী মনে করে। ডিবি অফিসার ছফাও তাকে বলেছে, এই লােকের বড়ো বােন সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকায় মুশকানের প্রতিবেশী ছিল।

ভাবা যায়, কতটা কাকতালীয় ঘটনা!

মুশকানের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে কথা হয়েছে তার, ওই ভদ্রমহিলাকে চিনতে পেরেছে সে। শুধু প্রতিবেশীই নয়, তারা বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল।  সেই মহিলা,হাসিবের মা এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। মরণাপন্ন বােনের শেষ ইচ্ছা, তার সন্তানকে যে গুম করেছে, তাকে বিচারের মুখােমুখি হতে দেখবে-সেজন্যেই পিএস তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে যাচ্ছে।

মুশকান তাকে আশ্বস্ত করেছে, সুস্মিতাকে যে-করেই হােক মুক্ত করবে সে। কিও তার কথায় পুরােপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না তিনি। বিরাট ক্ষমতাবান একজনের সঙ্গে কী করে পেরে উঠবে মুশকান, তার মাথায় ঢুকছে না। ওর কাছে এমন কিছু নেই যে, পিএসকে বাধ্য করতে পারবে সুস্মিতাকে ছেড়ে দিতে।

নিজের ডেস্কের চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবে গেলেন তিনি। সত্যি বলতে, তার মাথা কাজ করছে না আর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুললেন। রাত গাঢ় হচ্ছে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুশকানের কাছ থেকে কোনাে ফোন আসেনি এখনও। মনে হচ্ছে না খুব শিগগির কোনাে সুখবর পাবেন। মুশকানকে কোনােভাবে যদি সাহায্য করা যেত!  আ
র-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ডেস্কের দিকে তাকালেন ডাক্তার। অনেকগুলাে ফাইল পড়ে আছে সেখানে দীর্ঘদিন থেকেই, একটাও ছুঁয়ে দেখেননি। তবে এই ফাইলগুলাে জরুরি কিছুও নয় যে, পড়ে থাকলে হাসপাতালের কাজকর্মে কোনাে ব্যাঘাত হবে। প্রায় তিন বছর ধরে হাসপাতালে অনিয়মিত তিনি। সেজন্যে এই প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ, পরিবর্ধন, নতুন নিয়ােগ, নতুন বিভাগ চালু করা, আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা- এরকম অসংখ্য প্রপােজালের ফাইল পড়ে আছে দীর্ঘদিন থেকেই। আরও কতদিন পড়ে থাকবে কে জানে!

আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে-ই না চোখ সরাবেন, তখনই একটা ফাইলের দিকে চোখ গেল তার।

হসপিস? সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাবনা খেলে গেল তার মাথায়।

অধ্যায় ৮৪

লােকটাকি পাগল হয়ে গেল?  পিএস আশেক মাহমুদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে নুরে ছফার মতাে ডিবির একজন ইনভেস্টিগেটর তার দিকে পিস্তল তাক করতে পারে! এই আত্মঘাতী কাজটা তাকে এবং তার সেই সিনিয়র কলিগ, কাউকেই রক্ষা করতে পারবে না। এটা বােঝার মতাে বুদ্ধি লােপ পেয়ে গেছে।

আসলামও অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে ছফার দিকে। রাগে ফেটে পড়বে যেন। হাত-পা বেঁধে চেয়ারে বসিয়ে রাখা সুস্মিতা বিস্ফোরিত চোখে একবার ছফার দিকে তাে আর-একবার পিএস আর আসলামের দিকে তাকাচ্ছে। ঘটনা কোনদিকে মােড় নিচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“পিস্তলটা নামান, ছফা,”চোয়াল শক্ত করে বলল আশেক মাহমুদ।

“সরি, স্যার,”জবাব দিল সে। “আমার হাতে সময় নেই। ভুল একজন মানুষের জন্য আমি দুদুটো প্রাণ শেষ হতে দিতে পারি না।” সুস্মিতার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “আমি এখন পুরােপুরি নিশ্চিত, ও মুশকান না!”  গভীর করে দম নিয়ে নিল পিএস। “আপনি এখান থেকে এই মেয়েটাকে নিয়ে বের হতে পারবেন না। খামােখা কেন এসব করছেন!” ” আসলামের দিকে তাকাল ছফা। পিস্তলটা এখন তার দিকেই তাক করা। কাঁধ তুলল। সে“দু-জন মানুষকে বাঁচানাের জন্য আমাকে এটা করতেই হবে। কেউ বাধা দিলে আমার কিছু করার থাকবে না।”

বাঁকা হাসি দিল পিএস।“আপনি কী আমাকেও গুলি করবেন?”

ছফা এ কথার কোনাে জবাব দিল না। হঠাৎতার মনে হল পাঁচ মিনিট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না, ফোনে মুশকান জুবেরি আছে। সঙ্গে সঙ্গে বামহাতে থাকা ফোনটা কানে চেপে ধরল। “হ্যালাে?”

“হ্যা  বলাে?” ওপাশ থেকে জবাব দিল মুশকান। হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। “আমাকে আর-একটু সময় দিতে হবে, প্লিজ!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুশকান। “ঠিক আছে  তবে কলটা কেটে দিও না। আর এক সতর্ক থেকো।”

ছফা কিছু না বলে ফোনটা আবার নামিয়ে রাখল। আসলামের দিকে তাকাল সে। সুস্মিতাকে ইঙ্গিত করে বলল, “ওর হাতে-পায়ের বাঁধন খুলে দাও।”  গানম্যান অবিশ্বাসে চোখ
কুঁচকে ফেলল। “তুই আমাকে অর্ডার দেবার কে?” রেগেমেগে বলল সে।  ছফা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সে নিজেই এগিয়ে গেল সুস্মিতার কাছে। মেয়েটার কোলে ফোনটা রেখে আসলামের দিকে পিস্তল তাক করেই এক হাতে বন্দির বাঁধন খুলতে শুরু করল।  “আপনি বিরাট বড় ভুল করছেন, ছফা।”শান্ত কণ্ঠে বলল পিএস।“এখনও সময় আছে, এসব বাদ দিন। আমি বুঝতে পারছি, আপনি ওই লােকটাকে বাঁচানাের জন্য মরিয়া, কিন্তু এভাবে ওই ডাইনীর দাবি মেটানাে ঠিক হবে না।” এ ছফা কথাগুলাে কানেই তুলল না। সে সুস্মিতার বাঁধন খুলতেই মনােযােগী। এক হাতে কাজটা করতে বেশ বেগ পাচ্ছে সে।  “ওই ডাইনীটাকে পাবার একটাই উপায় আছে,” আশেক মাহমুদ সুস্মিতার দিকে ইঙ্গিত করল।“এই মেয়েটাকে আমাদের কব্জায় রাখা। মুশকান নিজের দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়েছে, এটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?”

“বুঝতে পেরেছি,”সুস্মিতার বাঁধন খুলতে খুলতেই বলল ছফা। “কিন্তু কেএস খান আর ওই বাচ্চা ছেলেটার জীবন…. ” কথা শেষ করল না সে।  পিএস হতাশ হল একথা শুনে।“এই মেয়েকে ছেড়ে দিলেই যে ওইডাইনী ওদেরকে হত্যা করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?”

কথাটা শুনে থমকে গেল ছফা, পিএসের দিকে স্থিরচোখে তাকাল সে।

“কোনাে গ্যারান্টি নেই,” বেশ জোর দিয়ে বলল আশেক মাহমুদ। “কাজ বাগিয়ে নেবার পর ওই মহিলা তার কথা রাখবে না, ছফা। বােঝার চেষ্টা করুন।”

কথাটা একটু বিবেচনা করে দেখল সে।পিএস যে খুব ভুল বলছে তা নয়। কাজ শেষে মুশকান তার কথা না রাখলে কী করার থাকবে?

কিন্তু মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আবারও সুস্মিতার হাতের বাঁধন খােলার দিকে মনােযােগ দিল। মুশকানের দাবি মেটালে সে খুনখারাবি করতে যাবে না—এরকম বিশ্বাস তার আছে। সুতরাং এ মুহূর্তে এসব ভেবে সময় নষ্ট করার মানে দুদুটো মানুষের

জীবন ….

হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা ধেয়ে আসতে দেখতে পেয়ে চমকে তাকাল ছফা, কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে!

অধ্যায় ৮৫

প্রবল উত্তেজনায় কানে ফোন চেপে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে মুশকান।

এতক্ষণ ছফার সঙ্গে পিএসের কথােপকথনের সবটাই শুনেছে সে, বুঝতে পেরেছে ঘরে আর-একজন আছে—খুবই ষণ্ডা প্রকৃতির একজন মানুষ। আর সেই মানুষটাই সম্ভবত নুরে ছফার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটু আগে। ধস্তাধস্তির শব্দ আর সুস্মিতার চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। তার প্ল্যানটা যে ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। ঘুনাক্ষরেও ধারণা করতে পারেনি। ছফা ছাড়া আরও কিছু মানুষ থাকবে-যারা ছফার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখে!

মুশকানের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। ডাক্তার তাকে জানিয়েছে, সুস্মিতাকে অপহরণ করার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস জড়িত। নিজের বােনের ছেলের সঙ্গে যা ঘটেছে তার প্রতিশােধ নিতে চাইছে লােকটা।

মুশকান জানে, সুস্মিতাকে মুক্ত করার জন্য কেএস খানকে জিম্মি করাটা একেবারেই যথার্থ ছিল-ভুল একজন মানুষকে আটকে রেখে ছফা এ দু-জন নিরীহ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেবে না। তার ধারণাই ঠিক, কথামতােই কাজ করেছিল ছফা।কিন্তু পিএস তাতে বাগড়া দিয়ে বসে, তাকে বােঝানাের চেষ্টা করে, এটা করা একদমই ঠিক হবে না।

“একদম নড়বি না কুত্তারবাচ্চা! গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেব।”

ছফার ওপরে যে লোক হামলে পড়েছে, তার কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে প্রচণ্ড হতাশ হল মুশকান। ছফা পারেনি! পরাস্ত হয়ে গেছে ষণ্ডাটার কাছে। একটা গােঙানি শােনা গেল ফোনের ওপাশ থেকে। সম্ভবত ছফারই হবে সেটা।

“ওই খানকি, একদমনড়বি না!”

একই কণ্ঠ এবার হুমকির সুরে বলল। অবশ্যই সুস্মিতাকে! “হ্যালাে  মুশকান জুবেরি!”

অন্য একটা কণ্ঠবলে উঠল ফোনে, চমকে উঠল সে।বুঝতে পারল, এটা পিএসের কথাই হবে।

“তাের পাঁচ মিনিট তাে মনে হয় শেষ হয়ে গেছে, তাই না?” মুশকান কোনাে জবাব দিল না। “এখন চাইলে, তুই ওদের মেরে ফেলতে পারিস।” “না!” ফোনের ওপাশ থেকে নুরে ছফার আর্তনাদ শােনা গেল।

“এবার তােকে আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি মন দিয়ে শােন,”একই কণ্ঠটা বলল। “তুই যদি আমার কাছে ধরা না দিস তাহলে এই মেয়েটাকে কী করব জানিস?” একটু থেমে আবার বলল। “তিন তিনটা বাঘের কাছে একটা হরিণ ছেড়ে দিলে যা হয় আর কি!”

গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিল মুশকান। “ওর কিছু হলে অনেক পস্তাতে হবে  সবাইকে!”মুখ খুলল অবশেষে।

হা-হা-হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ওপাশে যে আছে। “তুই কিছুই করতে পারবি না। ধরা তােকে পড়তেই হবে। ভালাে হয়, নিজে এসে ধরা দিলে, তাহলে অন্তত এই নিরীহ মেয়েটা বেঁচে যাবে।”

গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিল মুশকান।টলে যাওয়া চিন্তাভাবনা সুস্থির করা দরকার।

“একটা ব্যাপারে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি-তুই ধরা দিলে এই মেয়েকে কিছুই করব না।” একটু থেমে আবার বলল, “তাের মতাে মানুষখেকো নই আমি, আমাকে বিশ্বাস করতে পারিস।”

চকিতে সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খানের দিকে তাকাল সে। এই লােককে নিয়ে মােটেও চিন্তিত নয়। দেখেই বােঝা যায়, কোনাে রকম ঝামেলা করার চেষ্টা করবে না। প্রখর বুদ্ধিই তার একমাত্র শক্তি। এখন পর্যন্ত কোনাে কথা না বলে চুপচাপ তাকে দেখে যাচ্ছে। শুধু তার চোখদুটোতে রাজ্যের যত কৌতূহল।

এভাবে বােকার মতাে নিজেকে সমর্পণ করার কথা সে ভাবতেও পারে না, আবার সুস্মিতার কিছু হােক সেটাও চাইছে না-কঠিন এক সংকটে পড়ে গেল মুশকান।

“আমি জানি, তুই কোথায় আছিস,”বলল কণ্ঠটা।“তাই তােকে আমি এক ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এর এক মিনিটও বেশি না।”

মুশকান আবারও তাকাল কেএস খানের দিকে। ভদ্রলােকের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। বােঝার চেষ্টা করছে পরিস্থিতিটা কি।

“গুলশানে এসে এই নম্বরে ফোন দিবি  এক ঘণ্টার মধ্যে। যদি না আসিস, এই মেয়েটার এমন হাল করব ” শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে বলল।

নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল মুশকান। হা-না কিছুই বলল না। কারণ, “এক ঘণ্টা….ঠিক আছে?” কলটা কেটে গেলে মুশকান দেখল কেএস খান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। “কী হইছে?”সাবেক ইনভেস্টিগেটর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জানতে চাইল।

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকাল মুশকান। “ওখানে চলে যান। কোনাে রকম শব্দ করবেন না।”

মাথা নেড়ে সায় দিল কেএস খান, আস্তে করে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।

তার সিদ্ধান্ত যাই হােক, এখানে থাকার কোনাে মানেই হয় না। সবার আগে এখান থেকে বেরােতে হবে।

পিস্তল আর কেএস খানের মােবাইলফোনটা পার্সে ভরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল মুশকান।

সাবেক ডিবি অফিসারের বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল সে কেন কী উদ্দেশ্যে কিছুই জানে না। কেএস খানকে নিয়ে তার কোনাে দুর্ভাবনা নেই। ওই লোক তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে না। বাচ্চা ছেলেটার জ্ঞান ফিরল কি ফিরল না সেটা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকবে। হয়তাে স্থানীয় কোনাে ডাক্তারও ডাকতে পারে।

মি.খানের ফোনটা ট্র্যাক করে তার অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে পারে ওই পিএস, তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে ফোনটা বের করে অফ করে দিল সে।

সুস্মিতাকে মুক্ত করার একমাত্র সুযােগটি যে এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, উলটো সে নিজেই ফাঁদে পড়ে যাবে, ভাবেনি।মাসখানেক আগে, এক জাতীয় দৈনিকে আমাদের শার্লক হােমস’নামে সাবেক ডিবি অফিসারের ওপরে বেশ তথ্যবহুল একটি ফিচার পড়েছিল। সেখান থেকেই জানতে পারে, লােকটা থাকে পুরােনাে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের পৈতৃক বাড়িতে। অল্পবয়সি এক ছেলে ছাড়া নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে। তিন বছর আগেই সে জেনেছিল, সাবেক এই ডিবি অফিসার ছফার খুবই ঘনিষ্ঠজন। এর পরামর্শ নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। ছফা যখন সুন্দরপুরে, তখন আসকারকে এই লােকই জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সে যখন ছফাকে কাবু করে ফেলে, তখন এই লােকই ফোন দিয়েছিল। তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা শুনেছিল তখন।

নুরে ছফার আর কোনাে দুর্বলতা আছে কিনা, সে জানে না। থাকলেও সেটা বের করে সদ্ব্যবহার করাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হত। কিন্তু তার দরকার ছিল দ্রুততম সময়ে কিছু একটা করার। এসব কারণে সময় নষ্ট না করেই মুশকান তার নিরাপদ আশ্রয় থেকে সােজা চলে এসেছিল ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। লােকজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা কেএস খানের বাড়িটা দেখিয়ে দেয়।

একটাদীর্ঘশ্বাস ফেলে মুশকান দেখতে পেল, সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলটা পেরিয়ে বাহাদুরশাহ পার্কের কাছে চলে এসেছে। কোথায় যাবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জীবনে খুব কম সময়ই এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখল। এরইমধ্যে দশ মিনিট ফুরিয়ে গেছে। বাকি সময়টাতে কিছু করতে পারবে না। সুস্মিতাকে রক্ষা করার একটা মাত্রই উপায়ই আছে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার। কিন্তু সেটা সে করতে পারে না। করলেও, সুস্মিতা যে মুক্তি পাবে তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই।তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফোনটা বেজে উঠল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কলার আইডি দেখে কয়েক মুহূর্ত ভেবে পেল না কী করবে-কী বলবে আসকারকে এখন!

“হ্যালাে।” বেশ কয়েকবার রিং হবার পর অনেকটা বাধ্য হয়েই কলটা রিসিভ করল সে। নইলে আসকার আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে।

উদ্বিগ্ন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলেন- সুস্মিতার কী অবস্থা এখন। তার মুক্তির ব্যাপারে কোনাে অগ্রগতি হয়েছে কিনা। অনেকক্ষণ ধরে মুশকান তাকে ফোন করেনি বলে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছেন তিনি।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল মুশকান। দুঃসংবাদটা শােনানাের কোনাে ইচ্ছে তার নেই, কিন্তু না বলেও পারছে না। এত ধকলও হয়তাে সামলাতে পারবে না বেচারি। তাই তাকে আর-একটু অপেক্ষা করতে বলল। খুব বেশি চিন্তা যেন না করে।

এ কথা শােনার পর ফোনের ওপাশে কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল, তারপর আস্তে করে ডাক্তার জানালেন, তিনি একটা তথ্য জানতে পেরেছেন, বুঝতে পারছেন না এ মুহূর্তে এটা তেমন কোনাে কাজে লাগবে কিনা।

মুশকান খুব একটা আগ্রহী না হলেও জানতে চাইল। এরপর আসকার ইবনে সায়িদ এক নাগাড়ে বলে গেলেন, হাসপাতালের হসপিস সার্ভিস সম্প্রসারণের জন্য, যে প্রজেক্ট ফাইলটা ছিল সেটা দেখে তার একটা বিষয় মনে পড়ে যায় একটু আগে। তারপর খোঁজ নিয়ে যা জানতে পেরেছেন তাতে বেশ অবাক হয়েছেন তিনি। তার কাছে মনে হয়েছে, এই তথ্যটা হয়তাে কোনােভাবে তার সাহায্যে আসতে পারে।  তথ্যটা পাবার পর মুশকান কয়েক মুহূর্ত মূর্তির মতাে জমে রইল। তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে এটা। একটু আগেও রীতিমতাে চোখে অন্ধকার দেখছিল সে। সিদ্ধান্তহীনতার চরম সংকটে ভুগছিল।

গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিল এবার। এখন তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। কোনাে ভুলই করা যাবে না। চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত একটা পরিকল্পনা করে ফেলল সে। শান্ত কণ্ঠে আসকারকে বলে দিল, কী করতে হবে। তার হাতে যেটুকু সময় আছে, এ কাজের জন্য যথেষ্ট।  ডাক্তারের সঙ্গে কথা শেষ করার পর গুলশানে গন্তব্য ঠিক করে নিয়ে একটা উবার ডাকল। ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিল বাহাদুরশাহ পার্কের কথা। জায়গাটা চিনতে বেগ পেল ড্রাইভার।মুশকান অবশ্য খুব একটা অবাক হলনা এতে। পুরােনাে নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক বললে অবশ্য চিনতে পারল ড্রাইভার। তাকে জানাল, সে এখন খুব কাছেই আছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।  কলটা শেষ করে আর-একবার নিজের পরিকল্পনাটা গুছিয়ে নিল মুশকান। রাতের সময় কোনাে জ্যাম নেই। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছােতে বড়ােজোর চল্লিশ মিনিট লাগবে। এই সময়ে আসকার বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে বলে তার বিশ্বাস।

বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে আসতেই দেখতে পেল উবার প্রিমিয়ারের সিলভার রঙের প্রাডাে গাড়িটা পার্কের মেইনগেটের সামনে চলে এসেছে। গাড়ির রংটা তার কাছে অন্য অর্থ বহন করল এ মুহূর্তে।

সিলভার লাইন ইন দ্য স্কাই। একটু আগে টলে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পেয়েছে মুশকান।

অধ্যায় ৮৬

ছফার ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে, মেঝেতে বসে আছে এখন। আসলামের মতাে বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী নয় সে, তাই বলে সশস্ত্র অবস্থায় নিরস্ত্র একজনের সঙ্গে পেরে উঠতে পারবে না, তা মেনে নিতে কষ্টই হচ্ছে।

কিন্তু সেটাই হয়েছে। কারণটাও তার জানা। সুস্মিতার হাতের বাঁধন খুলতে গিয়ে তাকে একটু উপুড় হতে হয়েছিল। কোনােভাবে হয়তাে পিস্তল তাক করে রাখা হাতটা সরে গিয়েছিল। আর আসলাম সুযােগ পেয়েই সদ্ব্যবহার করে ফেলেছে। চোখের নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। ছফাকে নিয়ে আছড়ে পড়েছিল মেঝেতে। আসলামের টার্গেট ছিল তার ডান হাতটা। সেই হাতের কবজি শক্ত করে ধরে ফেলে শূন্যের মধ্যেই, মেঝেতে পড়ার পর তাই ছফার পিস্তলটা বেহাত হয়ে যায়।  এর পর পিএসের গানম্যান পর পর দুটো ঘুসিতেই কাবু করে ফেলে তাকে। ছফা তেমন প্রতিরােধ করার সুযােগই পায়নি। প্রথম ঘুসিটা লেগেছিল ডান কানের পাশে। ঘুসিটা পড়তেই চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। এর পরই কোনাে রকম সময়ক্ষেপন না করে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দ্বিতীয় ঘুসিটা মারে তার মুখ বরাবর, ফলে ঠোঁট কেঁটে রক্ত বের হয়ে যায়। এখনও সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। এ ছফার পিস্তলটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে তার দিকে তাক করে রেখেছে আসলাম। কিছুক্ষণ আগে আশেক মাহমুদ সুস্মিতার কোল থেকে ফোনটা নিয়ে মুশকান জুবেরিকে পালটা আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে-এক ঘণ্টার মধ্যে ধরা না দিলে ডাক্তারের মেয়ের পরিণাম হবে ভয়াবহ। ছফা অবশ্য জানে না, মুশকান এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে কিনা।

এখন ফোনটা সােফার ওপরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পিএস ঘৃণাভরে তাকাল।“দেখলেন তো কীভাবে ডিল করতে হয়, পাশার দান উলটে দিতে হয়!”

ছফা রক্তমাথা থুতু ফেলল মেঝেতে। তিক্ততায় নাকি আক্ষেপে বােঝা গেল না। “এতদিন ধরে ডিবি-তে চাকরি করে এই শিখেছেন!”ভর্ৎসনার সুরে বলল এবার।

এসব কথার জবাব দিল না ছফা। সে এখন ভূপাতিত। পরাজিত। আস্তে করে আশেক মাহমুদের দিকে তাকাল। লােকটার চোখেমুখে বিরক্তি। আসলামের ঠোঁটে লেগে রয়েহে তাচ্ছিল্যের হাসি।

“এরে কী করব, স্যার?”পিএসের কাছে জানতে চাইল গানম্যান।

নুরে ছফা অবিশ্বাসে তাকাল আশেক মাহমুদের দিকে। লােকটা কী বলবে বুঝতে পারছেনা, তবে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছে সে। এই লােক নিরীহ এক ছেলেকে গুম করে ফেলেছে এরইমধ্যে। তাকেও যে ওরকম কিছু করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে!

একটু গাল চুলকে নিল পিএস, যেন কঠিন কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। “ওকে– ”

অমনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল একজন। তাকে দেখে আশেক মাহমুদ আর আসলাম চমকে গেল।

“কী হয়েছে, বদরুল?” “স্যার, বাড়িতে পুলিশ আসছে!”

****

গুলশান থানার এসআই মিজান দাঁড়িয়ে আছেপিএসের গােপন আস্তানার সেই বাড়িটার সামনে। টহল পুলিশের একটি ইউনিট আছে তার সঙ্গে! আজকে তার রাতের ডিউটি পড়েছে, বিরক্তি নিয়েই টহলের মতাে একঘেয়েমির কাজটা শুরু করেছিল, কিন্তু একটু আগে থানা থেকে স্বয়ং ওসিসাহেব তাকে ফোন করে বলে দিয়েছেন, গুলশানের এই বাড়িতে রেইড দিতে হবে। বিরাট বড়ােসড়ো একটি ক্রাইম সংঘটিত হচ্ছে এখানে। এক মেয়েকে নাকি আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে-এক্ষুনি তাকে উদ্ধার করতে হবে।

সাধারণত গুলশান এলাকায় এরকম ক্রাইম হয় না। অভিজাত এলাকার অভিজাত মানুষগুলাের ক্রাইমের ধরনও হয়ে থাকে বেশ আলাদা। তার চেয়েও বড় কথা, এখানকার প্রায় সব অপরাধীই ভিআইপি! যাকেই ধরা হােক না কেন, তার সঙ্গে কোনাে না কোনাে ক্ষমতাবানের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়। কাউকে ধরে শান্তি নেই। ফোনের পর ফোন আসবে, অনুরােধ করবে আসামি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। এমন কি পুলিশকে হুমকি-ধমকিও দিয়ে বসে অনেকে।

কিন্তু এখন যে বাড়িটার সামনে চলে এসেছে, সেখানকার দারােয়ান যা বলছে সেটাকে তার কাছে মনে হচ্ছে ধাপ্পাবাজি।

প্রাইমিনিস্টারের পিএসের বাড়ি! রাগে তার গা কাঁপছে। ইচ্ছে করছে বদমাশ দারােয়ানকে কষে একটা চড় মারতে। গেটটা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে। লােকটার সাহস দেখে অবাক হচ্ছে। তাদেরকে এবাড়িতে ঢুকতে বাধা তাে দিচ্ছেই। সেই সঙ্গে বলছে অপেক্ষা করতে। স্বয়ং পিএস নাকি ফোন দেবে একটু পর।

মিজানের ইচ্ছে করছে দারােয়ানকে কিলঘুসি মেরে পুলিশ নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়তে। কিন্তু জায়গাটা গুলশান। এখানে কার সঙ্গে যে কোন মন্ত্রী-এমপির কানেকশন আছে বােঝা মুশকিল। তাই ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে সে। তবে আর-একটু দেখবে সে, তারপর যা করার করবে।

এমন সময় তার মােবাইলফোনটা বেজে উঠল। ওসিসাহেব ফোন দিয়েছে। সঙ্গে কলটা রিসিভ করল এসআই। “স্যার?”

“মিজান, ওই বাড়িতে ঢুইকো না চইল্যা আসাে এক্ষুনি।” ওসির কণ্ঠ কেমন ভয়ার্ত শােনাচ্ছে।“জি, স্যার?” “খবরটা ভুয়া ছিল বুঝছাে?”

“জি, স্যার  বুঝতে পারছি।” ওসিসাহেব কলটা কেটে দিলে তিক্তমুখে বাড়িটার দিকে তাকাল গুলশান থানার এসআই। যা ভেবেছিল তা-ই। আর-একটা হাে
মরাচোমরার আস্তানা!

“কী হইছে, স্যার?” একজন কনস্টেবল জানতে চাইল আগ্রহভরে।

“কিছুনা….সবাই গাড়িতে ওঠো,”বলেই গেট থেকে সরে পিকআপ ভ্যানের দরজায় হাত রাখল।

বাড়ির গেট ফাঁক করে যে দারােয়ান দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে হাসি হাসি ভাবটা দেখে পিত্তি জ্বলে গেল এসআইর। ক্ষমতার দাপট দেখাতে পেরে খুব মজা পাচ্ছে হারামজাদা।

কনস্টেবলরা কেউ কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসআই মিজান যে-ই না পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে যাবে, অমনি বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেল!

ছফার মনে হচ্ছে কিছু একটা করা উচিত,কিন্তু কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।

একটু আগে বদরুল নামের একজন এসে বললো বাড়িতে পুলিশ এসেছে।

কেন এসেছে?কি চায় তারা?

পিএসের এমন প্রশ্নে বদরুল কিছু জানাতে পারেনি।

“ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিওনা তুমি নীচে যাও,আমি দেখছি! কথাটা বলেই
পিএস বেরিয়ে যায় বদরুলকে নিয়ে।

একটু পকরে ফিরে এলেই আসলাম জানতে চায়, পুলিশ কেন এসেছিল। চোয়াল শক্ত করে পিএস বলে যে ছেলেটাকে আটকে রেখেছিলে, ওই পুলিশকে খবর দিয়েছে।আসলাম খুবই অবাক হয়েছিল, সেই সঙ্গে শরমিন্দাও।
ছফা আর সুস্মিতা কথাটা শুনে বিস্মিত হয়েছে। শ্যামল যে বেঁচে আছে, তার জন্য পুলিশ ডেকে নিয়ে এসেছে। এতে সার আলো ঢাকতে পায় মেয়েটি।

চিন্তার কিছু নেই ,আসলামকে আস্বস্ত করে বলে পিএস! ওরা চলে যাবে!”এ কথা শুনেই সুস্মিতা চিৎকার দিয়ে ওঠে!সঙ্গে সঙ্গে আসলাম তার মুখ চেপে ধরে!ছফা মেঝে থেকে উঠতে যাবে, অমনি পিস্তলটা তার দিকে তাক করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,একটুও যাতে  না নড়ে!  সুস্মি
তার মুখটা এখনও শক্ত করে চেপে ধরে আছে আসলাম। পেছনে দু-হাত বেধে রাখার কারণে মেয়েটা কিছুই করতে পারছেনা। পেছন থেকে একহাতে তার মুখটা শক্ত করে ধরে নিজের কাছে চেপে রেখেছে গানম্যান।

রেগেমেগে সুস্মিতার দিকে তাকালো পিএস! চিৎকার করলেও কেউ তােকে বাঁচাতে আসবেনা, বুঝেছিস!”তারপর ফোনটার দিকে তাকাল। কারাের কলের জন্য অপেক্ষা করছে। আর একটা আওয়াজ করবি তাে….”দাঁতে দাঁত পিষে রাগ দমন করার চেষ্টা করলো

“খানকি মাগী এবারলাম ফিশফিশিয়ে বলল।“মুখ খুললেই শেষ করে দেব।” পিস্তলটা এবার সুস্মিতার কপালে ঠেকাল। “বুঝতে পারছিস?”

“এখন থেকে পালিয়ে এক এমপিকে দিয়ে পুলিশ পাঠিয়েছে,”বলল আশেক মাহমুদ।

“গুলশান থানাকে বলে দিয়েছি, এ বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন পুলিশ না ঘেঁষে।”

হাসি ফুটে উঠল আসলামের মুখে।

পিএসের ফোনটা বেজে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করা হল। “হ্যা বলুন, ওপাশ থেকে শুনে গেল কিছুক্ষণ।“ওরা কিছুই শােনেনি  ওকে?” একটু থেমে আবার বলল, “আপনি আপনার লােকজনকে বাড়ির সামনে থেকে চলে যেতে বলুন।
এক্ষুনি। পরে আপনাকে সব বলব, ঠিক আছে?” ও পাশ থেকে আরও কিছু কথা শােনার পর বলল, “আচ্ছা।”

“স্যার, এর মুখ বেঁধে রাখি?” সুস্মিতাকে ইঙ্গিত করে বলল আসলাম।

“হুম,” সায় দিল।  পিএস এবার আর-একটা নম্বরে ফোন দিল।“ওরা কি চলে গেছে, বদরুল?”ওপাশের কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন।“তুমিও সেলিমের সঙ্গে গেটের কাছে থাকো, চোখ
কান খােলা রাখবে, ঠিক আছে?”ফোনটা কান থেকে সরিয়ে আসলামের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

গানম্যান ঘরের এক কোণ থেকে একটা স্কচটেপ নিয়ে এসে সুস্মিতার মুখটা পেঁচিয়ে দিল দক্ষতার সঙ্গে। এবার ছফার দিকে তাকাল সে।“স্যার?এর মুখটাও বন্ধ করা দরকার।”

মাথা দোলালাে পিএস।“দরকার নেই। অস্ত্র ছাড়া সে কীই বা করতে পারবে!” যেন ছফার অযােগ্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা হয়ে গেছে তার। “তবে উলটো-পালটা কিছু করলে সােজা গুলি করে দেবে।” শেষ কথাটা খুবই শীতল কণ্ঠে বলল আশেক মাহমুদ।

ছফার কাছে কথাটা আতঙ্কের চেয়ে অপমানের মতােই বেশি শােনাল। তবে সে কিছুই বলল না। কেএস খান আর নিরীহ ছেলেটাকে বাঁচানাের জন্য যা করার দরকার তা-ই করেছে, এ নিয়ে কোনাে অনুশােচনা নেই তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের কী হল কিছুই বুঝতে পারছে না।

“স্যার, আমার ফোনটা….” শুধু এটুকুই বলল ছফা। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল আশেক মাহমুদ। “কেএস খান আর ওই ছেলেটার কী হল…. ”এবারও কথা শেষ করতে পারল না। “একদম চুপ মেরে থাকুন।” ধমকের সুরে বলল পিএস। “আপনি আর কোনাে কথা বলবেন না।

একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সুস্মিতার দিকে তাকাল। মেয়েটা ভয়ে পাথরের মতাে জমে আছে।

“ওই ডাইনী যদি না আসে, এরে কী করব, স্যার?” সুস্মিতাকে ইঙ্গিত করে বলল আসলাম।

“তােমার যা খুশি তা-ই কোরো, ঠিক আছে?” পিএসের কথায় আসলামের চোখদুটো চকচক করে উঠল।

আঁৎকে উঠল সুস্মিতা। ছফা অবিশ্বাসে তাকাল আশেক মাহমুদের দিকে।

সােফায় গিয়ে বসে হাতঘড়িতে সময় দেখল পিএস। সােফার ওপর থেকে ছফার ফোনটা পকেটে ভরে নিল এবার। “আর ওর পিস্তলটা আমাকে দাও।”

আসলাম চুপচাপ ছফার পিস্তলটা পিএসকে দিয়ে দিলে ওটা হাতে নিয়ে কোলের ওপরে রেখে দিল সে।

আবারও হাতঘড়িতে সময় দেখে নিল পিএস। বােঝাই যাচ্ছে উত্তেজনার চোটে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। “আপনি অনেক ভালাে একজন ডিবি অফিসার, ছফার উদ্দেশ্যে বলল। “কলকাতায় মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক করতে গিয়ে এত বড়ো ভুল কী করে করলেন?” এ ছফা কিছুই বলল না। পুরাে বিষয়টা তার কাছে এখনও ধোঁয়াশা।

“এই মেয়েটা,”বন্দিকে দেখিয়ে বলল। “আপনি ভেবেছিলেন ও-ইমুশকান! প্লাস্টিক সার্জন দিয়ে চেহারা বদলে সেই সার্জনকে মেরে ফেলেছে! নতুন চেহারার সঙ্গে নতুন নাম-পরিচয় নিয়ে সুন্দরপুরে ফিরে গেছে! খুব বেশি সিনেমাটিক হয়ে গেল না?”

এবারও ছফা কিছু বলল না।কলকাতায় গিয়ে নিখোঁজদের তালিকা থেকে মুশকানের সম্ভাব্য দুটো শিকার ঠিকই খুঁজে বের করেছিল সে।সল্টলেকের ওই বাড়িতেই যে মুশকান ছিল সেটাও সত্যি। অথচ এখন দেখতে পাচ্ছে, মুশকান তার চেহারা পালটায়নি।

প্রথমবার মুশকান জুবেরি তাকে বােকা বানিয়ে সটকে পড়েছিল। তিন বছর পর তাকে রীতিমতাে হতবুদ্ধিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

যাই হােক, মুশকানকে এসব করতে সহায়তা করেছেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। তার সাহায্য না পেলে কোনােভাবেই এসব করা সম্ভব হত না ওর পক্ষে। একজন অপরাধীকে সাহায্য করার প্রতিদান তিনি এখন পাচ্ছেন তার নির্দোষ মেয়েটা পিতার অপকর্মের শাস্তি ভােগ করছে।

“আপনার সবচে বড়ো দুর্বলতা কি জানেন?” পিএস বলল। “আপনার মনটা বড় নরম। এত নরম মন নিয়ে কী করে যে ডিবি-তে আছেন, বুঝি না।”

বাঁকাহাসি ফুটে উঠল ছফার ঠোঁটে। “আপনার মতাে পলিটিক্স করলে হয়তাে অতটা নরম থাকতাম না।”

আসলাম তেড়ে আসতে চাইল কথাটা শুনে। সামান্য ডিবি অফিসারের এমন স্পর্ধা দেখে বিস্মিত সে-বিশেষ করে তার হাতে মার খাওয়ার পরও।

আশেক মাহমুদ মাথা দুলিয়ে আসলামকে নিরস্ত করল। তার মুখে হাসি। “অযােগ্যরা সব সময়ই অজুহাত দেয়।”  কথাটা হজম করে নিল ছফা, কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সুস্মিতার দিকে তাকাল সে। তাদের দুজনের চোখাচোখি হল অল্প সময়ের জন্য। মুখে স্কচটেপ লাগান আর হাতদুটো পিছমােড়া করে বাঁধা অসহায় মেয়েটির চোখদুটো ছল ছল করছে অজানা
আশঙ্কায়।

আশেক মাহমুদ আবারও হাতঘড়ি দেখল। “আসলাম, মনে হচ্ছে মুশকান জুবেরি আসবে না। এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে।এজায়গায় আর কিছু করা ঠিক হবে না। তুমি-”।

আশেক মাহমুদ কথা শেষ করতে পারল না। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠল। অবাক হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডিসপ্লের দিকে তাকাল সে। কলার আইডি দেখে বুকটা ধক করে উঠল তার। এত রাতে হাউজ নার্স তাকে ফোন দিয়েছে।

এর একটাই অর্থ-খারাপ কোনাে সংবাদ আছে! বুবুর কিছু হয়েছে!

মুহূর্তে চোখেমুখে শােকগ্রস্ত অভিব্যক্তি জেঁকে বসল তার। এই দুঃসংবাদটি শােনার প্রস্তুতি থাকলেও আজকের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।  পিএস কলটা রিসিভ করে দুর্বল আর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে?” সামান্য তােতলালাে সে।

“হ্যালাে, বুল্লা!” ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল একটি নারী কণ্ঠ।

অধ্যায় ৮৮

নিথর দেহ নিয়ে শয্যাশায়ী রােগী পড়ে আছে। দেখলে মনে হবে না দেহে প্রাণ আছে, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত এই মৃত্যু পথযাত্রীর প্রাণবায়ু এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।  প্রাণঘাতী ক্যান্সার যে হাল করেছে, তাতে করে আজ এত বছর পর তাকে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না। ক্রমশ কঙ্কালে রূপান্তরিত হচ্ছে যেন। মৃত্যুর করাল গ্রাসে প্রায় নিঃশেষিত একজন।

আর্জুমান্দ বেগমের চোখে আই মাস্ক থাকায় দেখতে পাচ্ছে না তার শিয়রে। একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে একজন। আধ-ঘুম আধাে-জাগরণে ধরেই নিয়েছে, ঘরে আছে। হাউজনার্স মেয়েটি। কিন্তু সে যদি চোখ মেলে তাকাত, তাহলে দেখতে পেত অনেক কাল আগের এক সুহৃদকে!  সালােয়ার-কামিজ আর চুড়িদারের ওপরে ডাক্তারদের সাদা অ্যাপ্রােন পরা মুশকান জুবেরি স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে আর্জুমান্দ বেগমের দিকে। তার ইচ্ছে করছে অসুস্থ এই রােগীর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে, কিন্তু ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে হল, পাছে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।

এই রােগীর প্রতি তার কোনাে ক্ষোভ নেই। যদিও চল্লিশ বছরেরও বেশি আগের পুরােনাে একটি ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল সে। যে-কারণে আমেরিকা ছেড়ে গ্রেট ব্রিটেনে পাড়ি দেয় মুশকান।  ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত? সত্যি বলতে, মুশকান জানেনা ঠিক কী কারণে
তার এক কালের বান্ধবী ওরকম কাজ করল।

আমেরিকায় আর্জুমান্দ বেগম আর সে থাকত পাশাপাশি বাড়িতে। প্রতিদিন দেখা হত।সপ্তাহে একদিন একসঙ্গে ডিনার করাটা রীতিতে পরিণত হয়েছিল এক সময়। আর্জুমান্দ বেগমের স্বামী স্থপতি রাগিব আহমেদ খুবই প্রাণখােলা মানুষ ছিলেন। মুশকানের সঙ্গেও তার ছিল ভালাে সম্পর্ক। একসঙ্গে তারা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ইয়েলােস্টোন্স ফরেস্ট, নায়াগ্রা ফল, লাস ভেগাস, ডিজনিল্যান্ড সহ কত জায়গায় বেড়াতে গেছে।

ঘনিষ্ঠতার কারণেই বিশ্বাস করে মুশকান তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো বিপর্যয়ের কথাটা আর্জুমান্দ বেগমকে একদিন বলে ফেলেছিল। সবটা শােনার পর সমব্যথীও হয়েছিল। তার বান্ধবী,কিন্তু কদিন পরই বুঝতে পারে, বিরাট বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে। তার আন্দিজ থেকে বেঁচে আসার গল্পটা বাঙালি কমিউনিটিতে জানাজানি হয়ে গেছে।তাদের নেইবারহুডে এটা চাউর হলেও সাদা চামড়ার মানুষগুলাে এটা শােনার পর তার প্রতি আরও বেশি করে সহানুভূতি দেখায়। কেউ বিরূপ আচরণ করেনি কিংবা খারাপ চোখেও তাকায়নি। কিন্তু স্বজাতিদের কাছে মুশকান রাতারাতি হয়ে উঠল অস্পৃশ্য একজন মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচেছিল! যেন এরচেয়ে ভালাে আর মর্যাদাপূর্ণ ছিল-না খেয়ে মরে যাওয়াটা! ওদের বিরূপ আচরণ তার জীবনটাই বিষিয়ে তুলল এক সময়। প্রথমে রাজ্য পালটালাে, অল্প কদিন পরই দেখল, ওখানকার বাঙালি কমিউনিটিও তার এই নরমাংস ভক্ষণ করে বেঁচে থাকার কথা জেনে গেছে। শেষে বাধ্য হয়েই আমেরিকা ছাড়ে।  আর্জুমান্দ বেগম কেন এ কাজ করেছিল সেটা নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছে সে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেনি। তার কেন জানি মনে হয়, এর পেছনে ছিল ঈর্ষা! নিজের স্বামীর সঙ্গে মুশকানের নিখাদ বন্ধুত্ব আর তার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যই এই ঈর্ষা সৃষ্টি করে সম্ভবত। হয়তাে স্বামীর কাছ থেকে মুশকানের প্রশংসা শুনে শুনে ঈর্ষার আগুনে পুড়ছিল সে। হয়তাে স্বামীকে মুশকানের সঙ্গে অতিরিক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে দেখেও আক্রান্ত হয়েছিল সুতীব্র ঈর্ষায় নিশ্চিত করে কিছুই জানার উপায় নেই এখন। সে শুধু জানে, কোনাে এক অজ্ঞাত কারণে আর্জুমান্দ বেগম মুশকানের নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকার কথাটা
রটিয়ে দিয়েছিল।

তবে বিশ্বাস করাে, মনেমনে বলে উঠল মুশকান। আমি যদি জানতাম হাসিব তােমার ছেলে,তাহলে ভুলেও….একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।এটা একেবারেই কাকতালীয় ব্যাপার  ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে। আমি প্রতিশােধ নেবার জন্য এ কাজ করিনি। তুমি কেন আমার অত বড়ো ক্ষতি করেছিলে আমি জানি না। তবে আমি এর শােধ তােলার কথা কখনও ভাবিনি। অন্তত এভাবে তাে নয়ই।

মাথা থেকে এসব ভাবনা দূর করে মনােযােগ দিল বর্তমানে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে একটু পরই সুস্মিতা মুক্তি পাবে। আর্জুমান্দ বেগমের ছােটোভাই, সেই বুল্লাই যে প্রধানমন্ত্রীর পিএস, সেটাও এ ঘরে ঢােকার পরই বুঝে গেছিল।শােবার ঘরে বারাে-তেরাে বছরের বুল্লা আর আর্জুমান্দ বেগমের একটি ছবি আছে। পিএসকে তার আদুরে নাম ধরে ডেকে ভড়কে দিয়েছে মুশকান। এখন এই ক্ষমতাশালী মানুষটি সুস্মিতাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য।যদিও মুশকান ভাগ্যে বিশ্বাস করে না, বরং বিশ্বাস করে সাহসী আর আত্মবিশ্বাসি মানুষের কাছেই সৌভাগ্য ধরা দেয়। আজকে আর-একবার সেটা প্রমাণিতও হয়েছে। হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা মানুষকে কঠিন পরিস্থিতিতেও বাঁচিয়ে রাখে- জীবনের শুরুতেই এই শিক্ষাটা পেয়ে গেছিল সে। তারপরও, একটু আগে কেএস খানের বাসা থেকে বের হবার সময় ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটবে। বলতে গেলে হাল ছেড়েই দিয়েছিল। ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল তার নার্ভ। তার পরই ডাক্তারের ফোন কল আর দুর্লভ একটি তথ্য পুরাে দৃশ্যপট বদলে দেয় মুহূর্তে।  মুশকানের ফোনটা এ সময় ভাইব্রেট করে উঠলে চেয়ার ছেড়ে উঠে
ঘরের এককোণে গিয়ে কলটা রিসিভ করল সে। কণ্ঠ যতটা সম্ভব নীচু করে কথা বলল, “হুম  আমি এখন অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে  ওর সামনেই আছি  চিন্তা কোরাে না  আমার সঙ্গে কথা হয়েছে”অন্য হাতে হাউজ
নার্সের ফোনটা দেখল সে।ওটার কল এখনও কেটে দেয়নি, তবে মিউট করে রেখেছে।‘সুস্মিতাকে এখনই ছেড়ে দেবে।”

অধ্যায় ৮৯

মাত্র ঘণ্টাখানেক হসপিস সার্ভিস ইভালুয়েশন অ্যান্ড এক্সপানশান’ফাইলটা দেখার পর ডাক্তার আসকার মূল্যবান একটি তথ্য জেনে নিয়েছেন।

অরিয়েন্ট হাসপাতালই এ দেশে প্রথম হসপিস সার্ভিস চালু করে। এখনও একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই সার্ভিসটি তারা দেয়। ক্যান্সারসহ কিছু অনিরাময় যােগ্য রােগে আক্রান্ত যে-সব রােগী নির্ঘাত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তাদের জীবনের শেষ সময়গুলাে যাতে অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রণাময় হয় তার জন্য সারা বিশ্বের অনেক হাসপাতালেই হসপিস সার্ভিস রয়েছে। অরিয়েন্ট হাসপাতালে মাত্র দুটো বেড আর পাঁচজন প্রশিক্ষিত নার্সের সমন্বয়ে গড়া ছােট্ট এই ডিপার্টমেন্টটি কয়েক বছর আগে শুরু হলেও প্রথম দিকে তেমন লাভজনক না হলেও ডাক্তার আসকারের আগ্রহের কারণে সার্ভিসটি বহাল থাকে।

সারা বিশ্বে হসপিসের রােগীদের প্রায় ষাট শতাংশ নিজেদের বাড়িতেই এই সার্ভিসটি নেয়, এদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে তাদের ক্লায়েন্টের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। সেই তুলনায় প্রশিক্ষিত নার্স আর বেডের সংখ্যা অপ্রতুল। তাই কয়েক দিন আগে এই সার্ভিসটি সম্প্রসারণ করার জন্য হাসপাতাল পরিচালনা কমিটি থেকে প্রপােজাল দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ফাইলটা ডাক্তারের চোখে পড়েনি। তিনি হাসপাতালে খুব একটা সময়ও দিতে পারছিলেন না আজকাল। সম্প্রসারণের মতাে কাজ যেহেতু মালিকপক্ষের অনুমােদন ছাড়া পাস হয় না, তাই ডাক্তারের বিবেচনার জন্য ফাইলটা পড়ে আছে তার ডেস্কে।

এই ফাইল দেখেই ডাক্তারের মনে পড়ে যায়, পিএসের বােনের কথা। নুরে ছফা তাকে বলেছিল, পিএসের বােন- সত্তরের দশকে যে কিনা মুশকানের প্রতিবেশী ছিল আমেরিকায়,এখন মৃত্যুপথযাত্রী। পিএস তাকে নিজের ফ্ল্যাটে রেখেই চিকিৎসা করাচ্ছে। জীবনের শেষ দিনগুলাে একটু কম যন্ত্রণা ভােগ করার জন্য।

হসপিস সার্ভিস নিচ্ছে না তাে?

প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারের মনে উঁকি দেয়। যদি তা-ই হয়, তাহলে এ দেশে। একমাত্র তারাই এই সার্ভিস দিয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমিনে ফোন করে তিনি জানতে চান, ‘হসপিস সার্ভিস অ্যাট হােম’ সেবাটি বর্তমানে ক-জন নিচ্ছেতাদের সমস্ত ডিটেল তার লাগবে। হাসপাতালটি কম্পিউটারাইজ বলে অ্যাডমিন থেকে এই তথ্যটি ডাক্তারের অফিসের পিসিতে পাঠাতে মাত্র তিন-চার মিনিট সময় লেগেছিল। আসকার ইবনে সায়িদ অবাক হয়েই দেখতে পান, বর্তমানে দু-জন রােগী এই সার্ভিসটি নিচ্ছে। তাদের একজন দেশের নামকরা শিল্পপতি, ডাক্তার তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন।

আর অন্যজন আর্জুমান্দ বেগম!  তবে রােগীর ছােটোভাই আশেক মাহমুদই তাদের ক্লায়েন্ট, সে-ই যাবতীয় খরচ বহন করে। আসকার ইবনে সায়িদ আরও দেখতে পান। আর্জুমান্দ বেগমকে দু-জন নার্স পালাক্রমে সেবা দিয়ে থাকে। তাদের একজন তরুণী, অন্যজন অপেক্ষাকৃত মাঝবয়সি।

ডাক্তার দ্রুত অ্যাডমিনে ফোন করে জেনে নেন, আজকের রাতে কোন নার্স ডিউটিতে আছে। নার্সের কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা নিয়ে নেন তিনি-তরুণী নার্সের নাম জেবুন্নেসা খাতুন।

সঙ্গে সঙ্গে মুশকানকে ফোন দিয়ে এই তথ্যটা জানিয়ে দেন ডাক্তার। সব শুনে মুশকান তাকে বলে, এখন ঠান্ডা মাথায় কিছু কাজ করতে হবে তাকে, আর এটা করতে পারলে সুস্মিতা খুব দ্রুতই মুক্তি পাবে বন্দিদশা থেকে।

ডাক্তার বুঝতে পারেন, তিনি একেবারে সঠিক সময়ে মূল্যবান একটি তথ্য দিয়েছেন।

এর পরই মুশকানের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেবুন্নেসা নামের নার্স মেয়েটাকে ফোন দেন ডাক্তার। হাসপাতালের একজন অ্যাডমিন পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন- ইন্টারন্যাশনাল হসপিস সার্ভিস অ্যাসােসিয়েশন অ্যান্ড মনিটরিং অর্গানাইজেশন থেকে ডেইজি হক নামের একজন ইন্সপেক্টর একটু পরই আর্জুমান্দ বেগমের অ্যাপার্টমেন্টে যাবে ইন্সপেকশন করার জন্য। তাকে যেন যথাযথ সহযােগিতা করা হয়। ওই মহিলার রিপাের্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জেবুন্নেসা যেন কোনাে রকম ত্রুটি না রাখে, দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে নেয়। আর অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে যে তাকে আগেভাগে এটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা যেন ঘুণাক্ষরেও ওই মহিলা জানতে না পারে। জেনে গেলে পুরাে ইন্সপেকশনটি বাতিল করা হবে। বিশাল অঙ্কের জরিমানা গুণতে হবে হাসপাতালকে। এমনকি, তাদের হসপিস সার্ভিসটিও বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে সাময়িক।  সব শুনে নার্স মেয়েটি সতর্ক হয়ে ওঠে। যদিও তার বিস্ময় টের পেয়েছিলেন ডাক্তার। সেটাই স্বাভাবিক। এরকম ইন্সপেকশন করার কথা মেয়েটি কখনও শােনেনি তার দেড় বছরের চাকরি জীবনে। তার চাইতেও বড়ো কথা, এত রাতে ইন্সপেকশন করা হচ্ছে বলে বেশ অবাক হয়েছে। সেজন্যে ডাক্তার তাকে আরও জানান, এই অর্গানাইজেশন গঠিত হয়েছে মাত্র আটমাস আগে। তাদেরকে সব রােগীর ডেটা সরবরাহ করার নিয়ম আছে। আর তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই ইন্সপেকশনের কাজ করে থাকে। তবে ওখানে ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ একজন কাজ করে বলে তিনি আগে থেকে জেনে নিতে পেরেছেন। হসপিস ইন্সপেকশনটি সাধারণত রাতেই বেশি করা হয়, কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সার্ভিসে নিযুক্ত নার্সরা রাতের বেলায় ঢিলেমি দিয়ে থাকে।

এসব বলে জেবুন্নেসাকে পুরােপুরি কনভিন্স করতে সক্ষম হয়েছিলেন ডাক্তার।

একটুআগে মুশকানকে ফোন করে আশ্বস্ত হয়েছেন তিনি। তাদের প্ল্যানটা ঠিকমতােই এগােচ্ছে। মুশকান এখন পিএস আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টের বােন আর্জুমান্দ বেগমের সামনে আছে।

অধ্যায় ৯০

নুরে ছফা এবং সুস্মিতা দু-জনেই বুঝতে পারছে কিছু একটা ঘটে গেছে।

একটু আগে ফোনকল পাবার পর পুরােপুরি ভড়কে গেছে পিএস আশেক মাহমুদ। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। হতভম্ব হয়ে আসলাম দাঁড়িয়ে থাকে ঘরে। এখনও সে বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করছে পিএসের কাছ থেকে কিছু শােনার জন্য।

এরইমধ্যে ছফার সঙ্গে সুস্মিতার চোখাচোখি হয়েছে বার কয়েক। তারও একটাই প্রশ্ন-কী হয়েছে?

কাঁধ তুলে ছফা জানিয়ে দিয়েছে, সে-ও কিছু বুঝতে পারছে না। তবে খারাপ কিছুর আশঙ্কাই করছে। ক্ষমতাধর পিএস এত সহজে ভড়কে যাবার কথা নয়। ছফা যখন তার দিকে পিস্তল তাক করেছিল তখনও লোকটা ভড়কে যায়নি, বরং রেগে গিয়েছিল। এখন ঘরের বাইরে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে নীচুস্বরে ফোনে কী কথা বলছে পিএস, সেসব শুনতে পাচ্ছে না এ ঘরের বাকি মানুষজন।

একটু পর ফোনটা হাতে নিয়ে আশেক মাহমুদ ঘরে প্রবেশ করল।তার চোখেমুখে বিপর্যস্ততার ছাপ সুস্পষ্ট।

“কী হয়েছে, বস”আসলাম জানতে চাইল উদ্বিগ্ন হয়ে।  পিএস
তার দিকে তাকালেও কিছু বলল না। এরপর ঘৃণাভরে তাকাল সুস্মিতার দিকে। “ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও  মুখের স্কচটেপটাও।”

আসলাম অবাক হয়ে চেয়ে রইল ক্ষমতাধর বসের দিকে।

“জলদি করাে  আমাদের হাতে সময় নেই।”

বাধ্য হয়েই সুস্মিতার মুখের স্কচটেপসহ হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল আসলাম। মেয়েটা মুক্ত হয়েও নিজের চেয়ারে বসে রইল চুপচাপ। সব কিছু বুঝে উঠতে তার কিছুটা সময় লাগছে।

পিএস নিজের ফোনটা সুস্মিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল, ওকে বলো, তােমাকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। আমার বােনের যেন কিছু না করে !”

পিএস কার কথা বলছে? নুরে ছফা যারপরনাই অবাক। মুশকানের? সুস্মিতাকে ছেড়ে দিতে বলছে যেহেতু….মাই গড! মুশকান জুবেরি পিএসের বােনকে জিম্মি করেছে।

মনে মনে বলে উঠল সে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। সুস্মিতার দিকে তাকাল।

মেয়েটার চোখেমুখেও অবিশ্বাস। চুপচাপ পিএসের ফোনটা কানে ঠেকিয়ে নীচুস্বরে কথা বলতে শুরু করল সে।

আসলাম আর ছফাকে ইশারায় বাইরে আসতে বলে নিজেও ঘর থেকে বের হয়ে গেল পিএস।

“কী হয়েছে?”ঘরের বাইরে এসে জানতে চাইল ছফা। ইচ্ছে করেই স্যার সম্বােধন করল না।“ফোনটা কী মুশকান করেছে?”

আসলাম অবিশ্বাসে চেয়ে রইল। তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে বিমর্ষ মুখে তাকাল আশেক মাহমুদ। “ওই ডাইনী আমার বােনকে জিম্মি করেছে।”

“ওই মহিলা কীভাবে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল?” ছফার কাছে সত্যি বিস্ময়কর ঠেকছে এটা। সুরক্ষিত অ্যাপার্টমেন্টে থাকে আশেক মাহমুদ। নীচের মেইনগেটের দারােয়ানের কাছে গেস্টকে পরিচয় দিতে হয়, তারপর দারােয়ান ইন্টারকমে জানায় অ্যালােটিকে ওখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেলেই কেবল ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। ছফা যতটুকু জানে, পিএসের অ্যাপার্টমেন্টে কমপক্ষে দু-তিনজন কাজের লােক আছে। একজন কুক আর অন্য দু-জন বাজার করা, ঘরদোর মােছর কাজ করে।

ঠোট ওলটাল পিএস।“আমার কোনাে ধারণাই নেই।”দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “তবে যেভাবেই হােক সে ঢুকে পড়েছে!”

“আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে?”

“হাউজনার্সের ফোন থেকে কল দিয়েছে, প্রমাণ হিসেবে আমার ফোনে একটা এমএমএসও পাঠিয়েছে  আমার বােনের একটা ছবি!”

মুশকান যে ছবিটা পাঠিয়েছে সেটা খুবই ভয়ংকর, গা শিউরে ওঠার মতােঃ তার বােন আই-মাস্ক লাগিয়ে শুয়ে আছে। আর মেয়েলি একটা হাত ঠিক তার গলার কাছে। ধরে রেখেছে কিচেন নাইফ!

পিএস আসলামের দিকে তাকাল।“ওই মেয়েটা যেখানে নেমে যেতে চাইবে সেখানেই নামিয়ে দিও। উলটো-পালটা কিছু কোরাে না, ঠিক আছে?”

অবাক হয়ে চেয়ে রইল গানম্যান। “স্যার, একটা কথা বলি?”ছফা কিছু বলতে চাইল। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাে আশেক মাহমুদ। “আসলামের বদলে আমি যাই? আমি ওই মেয়েটাকে….”।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল পিএস। “না। আসলামই যাক। মুশকান আপনাকে চেনে। তাছাড়া…. ”  “তাছাড়া কী?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশেক মাহমুদ। “কিছু না। আসলামই যাবে।” চুড়ান্ত রায় মতাে করে বলল সে।

পিএসের মনােভাব বুঝতে পারল ছফা। এ কাজে তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাবছে, সে হয়তাে কথামতাে কাজ করবে না, মুশকানের পিছু নেবে। সত্যি বলতে ছফার উদ্দেশ্য সেরকমই।

“তাড়াতাড়ি যাও। সময় মাত্র দশ মিনিট,” আসলামকে তাড়া দিল আশেক মাহমুদ তবে সেই ভঙ্গুর কণ্ঠে চেপে থাকা ক্রোধটা ঠিকই প্রকাশ পেল।

গানম্যানের চেহারায় তিক্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠল, একান্ত অনিচ্ছায় ঘরের ভেতরে চলে গেল সে।  মুশকান জুবেরি দশ মিনিট সময় বেঁধে দিয়েছে। নুরে ছফা যারপরনাই অবাক। বুঝতে পারল, ফোন কলটা এখনও কেটে দেওয়া হয়নি! সেই একই চালাকি, একই কৌশল-কলটা ড্রপ করা যাবে না। ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখার চমৎকার কৌশল!

এমন সময় সুস্মিতা তার পার্স আর পিএসের ফোনটা কানে চেপেই ঘর থেকে বের হয়ে এল আসলামের সঙ্গে। মেয়েটা চলে যাবার সময় একবার ছফার দিকে চকিতে তাকাল, তারপর দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে।

ওরা চলে যেতেই পিএসকে বলল ছফা,“কিছুই বুঝতে পারছিনা, এটা কীভাবে সম্ভব হল!”

কাঁধ তুলল আশেক মাহমুদ। “আমার মাথায়ও কিছু ঢুকছে না। ওই ডাইনী আমার ফ্ল্যাটে কী করে ঢুকল!”

“আপনি পুলিশকে ফোন করে জানিয়ে…. হাত তুলে ছফাকে থামিয়ে দিল পিএস।“সেই সময় নেই আমার হাতে। এই ঝুঁকিটা আমি নিতে পারব না।”আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সে, “মাত্র দশ মিনিট সময় দিয়েছে ওই ডাইনীটা কল কেটে দিলেই….”

পিএস কথাটা শেষ না করলেও ছফার বুঝে নিতে অসুবিধা হল না। পরিহাসের হাসি দিতে গিয়েও দিল না সে। একটু আগে যখন তার প্রিয়জন কেএস খান আর আইনস্টাইনের মতাে মাসুম এক বাচ্চাকে বাঁচানাের চেষ্টা করেছিল, তখন তাদের জীবনের কোনাে পরােয়া করেনি এই লােক, কিন্তু নিজের মৃত্যুপথযাত্রী বােনের জন্য এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি, সঙ্গে সঙ্গে মুশকানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে।  ছফা টের পেল পিএস তার কাঁধে হাত রেখেছে।

“আমি  সরি,” আস্তে করে বলল আশেক মাহমুদ। প্যান্টের পকেট থেকে ছফার পিস্তলটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল।

অস্ত্রটা নিজের কোমরে গুঁজে নিল ছফা। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে পেল আত্মবিশ্বাস। সেই সঙ্গে খুলে গেল জট পাকানাে চিন্তাভাবনার গিটটাও। “আমার ফোনটা দিয়ে পুলিশকে ইনফর্ম করে বলি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে….”  “না।”কথার মাঝখানে থামিয়ে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করে দিল পিএস।“এত কম সময়ে কিছুই করা যাবে না। আমি আমার বােনকে
…. ”তার গলা ধরে এল। “আমি এটা করতে পারি না,”মাথা দোলাল আশেক মাহমুদ। “বুবু আমার মায়ের মতাে!”

হতােদ্যম হয়ে পড়ল ছফা। সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা মাথায় আসতেই বলল সে, “কিন্তু স্যার, মুশকান জুবেরি যে তার কথা রাখবে সেটার কোনাে নিশ্চয়তা আছে?”  পিএস কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল ছফার দিকে। একটু আগে বলা তার নিজের যুক্তিটাই যেন দিচ্ছে ডিবি অফিসার। কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ছফাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকল।

“আপনি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করে জেনে নিন সব ঠিক আছে কিনা।” “আমার ফোনটা ওই মেয়ের কাছে।” “তাহলে আমার ফোন থেকে কল করুন, নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল সে।

“ওই হাউজনার্সের ফোন নাম্বারটা আমার মুখস্ত নেই, কিন্তু বাসার ল্যান্ডফোনের নাম্বারটা মনে আছে।”

“ওটাতে কল করুন,স্যার।” পিএস ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বর ডায়াল করে কানে চেপে ধরতেই তার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠল। ভয়ার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে তাকাল ছফার দিকে।

“ডিসকানেক্ট করে রেখেছে!”

ছফাকে তার ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে ফাঁকা ঘরটায় উদভ্রান্তের মতাে পায়চারি করতে শুরু করে দিল পিএস। এখন সেখানে একটি সােফা আর চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। সুস্মিতা যে চেয়ারে বন্দি হয়ে ছিল সেটার দিকে তাকাল তিক্তমুখে। ফাঁকা চেয়ারটা যেন তাকে পরিহাস করছে!

তার পরই দৃশ্যটা দেখতে পেল সে। চেয়ারের সামনে একটা দড়ি সাপের মতাে পাক খেয়ে পড়ে আছে। এটা দিয়ে সুস্মিতার পা বেঁধে রাখা হয়েছিল।

কিন্তু মেয়েটার হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল যে দড়িটা দিয়ে সেটা কোথায়?

ঘরের চারপাশে তাকাল। “কী খুঁজছেন, স্যার?” কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল ছফা। “দড়িটা  নেই!”

“কীসের দড়ি?”বুঝতে পারল না সে। দেখতে পেল, একটা দড়ি পড়ে আছে চেয়ারের নীচে। “ওই যে দড়িটা ?”

“কিন্তু আর-একটা কোথায়?”পিএস বলল।“মেয়েটার হাত-পা দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল!” ছফা কিছু বলার আগেই আবার বলল সে, “আসলাম নেয়নি তাে?” দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল তার কপালে।

“কিন্তু সে ওটা দিয়ে কী করবে?” ছফা বুঝতে না পেরে বলল।

আশেক মাহমুদের মনে একটা আশঙ্কা দ্রুত দানা বাঁধতে শুরু করেছে :আসলামের অন্য কোনাে উদ্দেশ্য আছে?না! এই ছেলে কখনও তার অবাধ্য হয়নি। সে ভালাে করে জানে, ওই মেয়েটাকে কথামতাে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে না দিলে তার অসুস্থ বােনকে মেরে ফেলবে ওই ডাইনী মহিলা।  পিএস স্থির চোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “আসলাম কি মেয়েটাকে নিয়ে অন্য কিছু
…. ”

“স্যার, আসলাম কেন এটা করবে? আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি না।” আশেক মাহমুদ মাথা দোলাল। “আপনি বুঝতে পারছেন না!”

এবার বুঝে গেল নুরে ছফা।“কিন্তু আসলাম এটা কীভাবে করবে, ওই মেয়েটা তাে…. ” নিজে থেকেই থেমে গেল। আজকে রাতে যেভাবে একের পর এক পাশার দান উলটে যাচ্ছে, তাতে করে আসলাম যে সুস্মিতাকে কব্জায় রেখে মুশকানের সঙ্গে কিছু করবে না সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সমস্যাটা হল গানম্যান আসলাম সম্ভবত দরজার বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছে সুস্মিতার কাছ থেকে সিক্রেট অঙ্গটার কথা জানতে চেয়েছিল পিএস।

রাগেক্ষোভে তাকাল পিএস। “ভুলটা আমারই হয়েছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। সে-ও জানে, যৌবন দীর্ঘস্থায়ী করা কিংবা চিরযৌবন লাভ করার আকাঙ্ক্ষার কাছে কোনাে আনুগত্যই টেকার কথা নয়। কেএস খান এটা তিন বছর আগেই বুঝতে পেরেছিল-তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল,কখনও যদি মুশকানকে কব্জায় নিতে পারে, ভুলেও যেন তার কাছ থেকে সিক্রেট অঙ্গটার কথা জানতে না চায়।

“স্যার, আপনার বাসায় চলুন। জলদি!”কিছু একটা মনে পড়তেই তাড়া দিয়ে বলল ছফা।

পিএস হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে।“ওই ডাইনী এতক্ষণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে, ছফা!”

“এটা আমিও জানি, স্যার।” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল পিএস।

“কিন্তু সে কোথায় গেছে, কীভাবে গেছে সেটা বের করা যাবে। দেরি করলে সেই সুযােগটাও হারাব।”

অধ্যায় ৯১

যে গাড়িতে করে সুস্মিতা আর শ্যামলকে অপহরণ করা হয়েছিল, সেই একই গাড়িতে করে আসলাম এখন সুস্মিতাকে পৌছে দিচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে-বনানীর দশ নম্বর রােডে। এইমাত্র মুশকান তাকে ফোন করে এটা বলে দিয়েছে।  গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে সুস্মিতা। রিয়ার মিরর দিয়ে বার বার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আসলাম। রাগে-ক্ষোভে তার চেহারাটা বিকৃত হয়ে আছে। যেন এক্ষুনি ছিড়ে খুবলে খাবে।

কিন্তু সুস্মিতা জানে, তার এই রাগ-ক্ষোভ নিছক আস্ফালন। লােকটা পােষা কুকুর। প্রভুর হুকুম ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। আর এখন তার প্রভু নিজেই বেড়াল হয়ে গেছে!

মুশকানের সঙ্গে এখনও কানেক্টেড থাকা ফোনটা সিটের পাশে রেখে নিজের হাতদুটোর দিকে তাকাল সুস্মিতা। দীর্ঘ সময় ধরে শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে তার নরম চামড়া কিছুটা কেটে গেছে। খুব ব্যথা করছে সেখানটায়। রক্ত চলাচলও বন্ধ ছিল অনেকক্ষণ। তাই এ-হাত দিয়ে ও-হাতে মেসেজ করতে শুরু করল সে।

রিয়ার মিরর দিয়ে আসলাম দৃশ্যটা পুরােপুরি দেখতে পেল না, কারণ সুস্মিতা তার কোলের ওপর হাতদুটো রেখে মেসেজ করে যাচ্ছে। চোখেমুখে সন্দেহ ফুটে উঠল পিএসের গানম্যানের।“কী করছিস?” কুঁচকে জানতে চাইল।

রিয়ার মিররে তাকাল সুস্মিতা, আসলামের চোখে চোখ রেখে হাতদুটো মুখের সামনে। তুলে ধরল। “দেখ গান্ডু  কী করেছিস আমার হাতদুটোর!” রেগেমেগে অভিযােগের সুরে বলল সে।  অনেক কষ্টে রাগ দমন করল পিএসের গানম্যান। রিয়ার মিরর থেকে চোখ সরিয়ে। গাড়ি চালানাের দিকে মনােযােগ দিল সে।তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। জীবন নিয়ে ফিরতে পারবি কিনা সেটা আগে ভেবে দেখ হাত নিয়ে যত চিন্তা! মনে মনে বলল
সে। ডানপাশের খােলা উইন্ডাে দিয়ে থুতু ফেলল ঘৃণাভরে। ‘

পিএস যখন তাকে বলল মেয়েটাকে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিতে, আসলাম সেটা মেনে নিতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় একটা চিন্তার উদ্রেক হয়—এই মেয়েটাকে জায়গামতাে পৌছে দিলেও তাে মুশকান জুবেরি নামের ওই ডাইনীটা পিএসের বােনকে হত্যা করতে পারে, পারে না? কাজ শেষে ওই মহিলা এটা করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? একটু আগে পিএস নিজেই এমন আশঙ্কার কথা বলেছিল ছফাকে যখন মুশকান তার সিনিয়রকে জিম্মি করেছিল।

একজন অসুস্থ মহিলা, যে-কোনাে মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, তার জীবন রক্ষার জন্যে নতি স্বীকার করে এই মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার কোনাে মানেই হয় না। মুশকান যদি পিএসের বােনকে হত্যাও করে, আসলাম তার একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে অনায়াসে মেয়েটাকে সে ছেড়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওই ডাইনী তার কথা রাখেনি।

আসলামের কোমরে গোঁজা আছে নাইন মিলিমিটারের একটি পিস্তল। পুরােপুরি লোডেড। এই মেয়েটার সঙ্গে এখন মুশকান নামের ওই ডাইনীটা কানেক্টেড আছে ফোনে। খেলাটা আবার উলটে দেওয়া যাবে। এই হালকা-পলকা মেয়েটাকে নিজের কব্জায় নিয়ে নিতে পারলে মুশকানকে বাধ্য করতে পারবে ওই সিক্রেটটা বলতে। সােজা আঙুলে ঘি উঠবে না সে জানে। কঠিন অত্যাচার করতে হবে একে। আর এটা করতে তার ভালােই লাগবে।ফোনে মুশকান সেই অত্যাচারের আওয়াজ শুনে ভড়কে যাবে। তারপরই আসলাম প্রস্তাব দেবে-মানুষের শরীরে কী এমন জিনিস আছে, যেটা খেলে যৌবন দীর্ঘায়িত করা যায়  আয়ু বাড়ানাে যায়? মহিলা তার প্রস্তাবে রাজি হােক আর না হােক, মেয়েটাকে ইচ্ছেমতাে ভােগ করতে পারবে সে।

শুনসান গুলশান অ্যাভিনিউ থেকে বামদিকের একটি রােডে ঢুকে পড়ল আসলাম। রাতের এ সময় ওটা আরও বেশি ফাঁকা আর জনমানবহীন থাকে।

“এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?” পেছনের সিট থেকে বলে উঠল সুস্মিতা।

“শর্টকাটে যাচ্ছি।” বলল আসলাম। মেয়েটা যে ভয় কাটানাের জন্য তুই-তােকারি করছে বুঝতে পারল।

“উলটাপালটা কিছু করার কথা চিন্তা করবি না, গান্ডু!” মুচকি হাসি দিল আসলাম। একটু পর সে কী করবে এই মেয়ের কোনাে ধারণাই নেই। “উলটাপালটা কিছু করেছিস তাে, তাের বসের বােনকে শেষ করে দেবে মুশকান।” রিয়ার মিরর দিয়ে তাকাল, কিছু বলতে গিয়েও বলল না। গভীর করে দম নিয়ে নিল। একটু সামনেই নির্জন একটি রাস্তা আছে-রাতের এ সময়ে ওটা একদম ভুতুড়ে হয়ে যায়। আবাসিক এলাকা সত্ত্বেও গুলশানের অন্যান্য অংশের মতাে এই রাস্তাটার দু-পাশে প্রায় সবগুলাে বাড়িই অফিস আর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে, রাত নয়টা-দশটার পর থেকে জনমানবহীন হয়ে পড়ে।

হঠাৎ করে একটা গান ভেসে আসতেই চমকে উঠল আসলাম।

“চাই গাে আমি তােমারে চাই

তোমায় আমি চাই….”

অবিশ্বাসে রিয়ার মিরর দিয়ে তাকাল সে। অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটা গান গাইছে গুণগুণ করে!

“এই কথাটি সদাই মনে বলতে যেন পাই।

আর যা-কিছু বাসনাতে ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে”

মেয়েটাকে এখন দেখে মনে হচ্ছে, মাথা আউলে গেছে। কিংবা ভয় থেকে মুক্তি পাবার জন্যে গান ধরেছে!

বাঁকাহাসি ফুটে উঠল আসলামের ঠোঁটে।

“মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগাে তােমায় আমি চাই….”

আমিও তােকে চাই! পিএসের গানম্যান বলে উঠল মনে মনে।তাকে মানতেই হল, মেয়েটার কণ্ঠ বেশ ভালাে, গায়-ও চমৎকার। নির্জন রাস্তাটায় ঢুকেই বামদিকে ফুটপাত ঘেঁষে গাড়িটা থামিয়ে দিল সে।

“অ্যাই, গাড়ি থামিয়েছিস কেন!” গান থামিয়ে এবার আঁতকে উঠল মেয়েটি।

হ্যান্ডগিয়ারটা টেনে দিল আসলাম। ডানদিকের ড্রাইভিং ডােরের কাচটা তুলে দিল সুইচ টিপে রিয়ার মিরর দিয়ে তাকিয়ে দেখল মেয়েটাকে। অবাক করার মতাে বিষয় হল, সুস্মিতা হঠাৎ করেই চুপসে গেছে। তার মধ্যে সুতীব্র ভয় জেঁকে বসেছে সম্ভবত।  “কোনাে রকম চালাকি করলে কিন্তু তাের বসের বােন মারা যাবে, তাকে আরও একবার সাবধান করে দিল।

“ওই মহিলা এমনিতেই মরবে,”বাঁকা হাসি দিয়ে বলল আসলাম। “কয় একটা দিন আগে মরলেই ভালাে  কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে!”

অধ্যায় ৯২

জেবুন্নেসা নামে হাউজনার্স মেয়েটি পাশের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। মুশকান তাকে আর তার রােগীর সেবা দান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছে একটু আগে-একেবারে ইন্সপেক্টরদের মতাে! তারপর মেয়েটার মােবাইলফোন দেখতে চাইলে বিনাপ্রতিবাদে নিজের ফোনটা তাকে দিয়ে দেয়। ফোন চালু আছে দেখতে পেয়ে কপট রাগ দেখিয়েছিল সে।

“তােমাকে কী তােমার ডিপার্টমেন্ট বলে দেয়নি, ডিউটির সময় ফোন বন্ধ রাখার জন্য?”

‘জি বলেছিল তাে,”কাঁচুমাচু খেয়ে বলেছিল মেয়েটি। “তাহলে তুমি বন্ধ রাখােনি কেন?”

“আ-আমার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা আছে ছােটোবােনের কাছে থাকে, ওর খোঁজ নিতে ফোনটা চালু রাখি। কিন্তু মিউট করে রাখি  ভাইব্রেশনও অফ করা থাকে  চেক করে দেখেন।”  মাথা দুলিয়েছিল মুশকান।“এরকম এক্সকিউজ দেবে না আর। ডিউটিতে থাকার সময় অলওয়েজ ফোন অফ করে রাখবে, ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল মেয়েটি।

এরপর নার্সের ফোন আর ইয়ারফোনটা নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায় মুশকান। ফোনের সঙ্গে ইয়ারফোন কানেক্ট করে কানে গুঁজে দিয়ে ডায়াল করে পিএসের নাম্বারে, তাকে জানিয়ে দেয়, সুস্মিতাকে ছেড়ে না দিলে তার বােনকে মেরে ফেলা হবে। ক্ষমতাধর লােকটার নার্ভ গুড়িয়ে দেবার জন্য তার অসুস্থ বােনের একটা ছবি তুলেও পাঠায়। রান্নাঘর থেকে একটা কিচেন নাইফ নিয়ে ঘুমন্ত রােগীর গলার কাছে ধরে ছবিটা তােলে সে।

ডাক্তার আসকারই পিএসের নাম্বারটা তাকে দিয়েছিল হাসপাতালের ফাইল থেকে। ভদ্রলােককে কল করার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার ফোনের সঙ্গে কানেক্টেড আছে সে। কিছুক্ষণ আগে পিএস তার কথামতাে সুস্মিতার কাছে হস্তান্তর করেছে ওই ফোনটা। তাকে এখন গাড়িতে করে জায়গামতাে পৌছে দেবে পিএসের এক লােক। তবে সুস্মিতা পুরােপুরি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কলটা কাটবে না।

এখন পাশের ঘর থেকে আর্জুমান্দ বেগমের ঘরে ঢুকতেই টের পেল মহিলার ঘুম  ভেঙে গেছে আবার। একটু নড়াচড়া করছে সে। ঘুম হয় না বলে আই মাস্ক লাগান আছে
তার চোখে, ফলে দেখতে পাচ্ছে না। “কে?”অস্ফুট স্বরে বলল রােগী।

মুশকান তার পাশে চুপচাপ বসে রইল। চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যে পুরােপুরি মুক্তি পেয়ে যাবে সুস্মিতা।

“কথার জবাব দিচ্ছাে না কেন?” মৃত্যুপথযাত্রী রােগী একটু জোরেই বলার চেষ্টা করল, যদিও ভঙ্গুর কণ্ঠে তেমন জোর নেই। “আবারও ফেসবুক ইউজ করছ আমার সামনে?”

মুশকান অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

“তােমাকে জেবুন্নেসা না ডেকে ফেবুন্নেসা ডাকাই উচিত,”ভঙ্গুর কণ্ঠে বলল আর্জুমান্দ বেগম।

নিঃশেব্দ হেসে ফেলল মুশকান। আগের মতােই টিটকারি মারার স্বভাব রয়ে গেছে। এমন সময় দেখতে পেল, রােগী তার চোখের ওপর থেকে আই মাস্কটা খুলে ফেলতে উদ্যত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আর্জুমান্দ বেগমের হাতটা খপ করে ধরে ফেলল সে।

“কে?!”ভড়কে গেল পিএসের বােন। অন্য হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করল মুশকানের হাতটা।

“একদম শান্ত থাকো….আরজু!”

অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল রােগীর চেহারায়। “বন্ধু!”কথাটা পুনরুক্তি করল সে।“কে?!”ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইল এবার।

“অনেক পুরােনাে বন্ধু। হয়তাে তােমার স্মৃতিতে সে আর নেই!”

অস্থির হয়ে উঠল রােগী।“কে? কে কথা বলছে?নাম বলাে….নাম বলাে!”হাঁপাতে হাঁপাতে বলে গেল রােগী।

“আহ”আস্তে করে বলল মুশকান।“এত অস্থির হলে তােমার শরীর খারাপ করবে। শান্ত হও। তােমার কোনাে ভয় নেই।”  “আমি তােমাকে দেখতে চাই!”দৃঢ়তার সঙ্গে বলল রােগী। “আমার আই মাস্কটা খুলে দাও।”

মুশকান কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিল। রােগীকে দেখা দেবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেছে সে, কিন্তু তার সমস্ত দ্বিধা উবে গেল মুহূর্তে। হঠাৎ করেই ইয়ারফোনে শুনতে পেল সুস্মিতা গান গাইছে!

মেয়েটার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এটা না ভেবে পারল না। এরপর পিএসের যে লােক গাড়িতে করে তাকে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দেবে তার সঙ্গে কথাবার্তা কেমন অন্য দিকে মােড় নিচ্ছে সেটাও কানে গেল।

লােকটা তার মত বদলে ফেলেছে। সে সুস্মিতাকে মুক্তি দিতে চাইছে না! উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল মুশকান।“হ্যালাে?!” প্রায় ফিশফিশিয়ে বলল। “সুস্মিতা!”

কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল ফোনটা সুস্মিতার কানে নেই। সুস্মিতা আর সেই লোক কথাবার্তা শুনে মুশকানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারছে না। এরপর ধস্তাধস্তির শব্দটা শুনতে পেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল কলটা!

মাই গড!

দ্রুত নাম্বারটায় আবার ডায়াল করল মুশকান। ওপাশ থেকে যখন অটোমেটের অপারেটরের কণ্ঠটা বলল সংযােগ বন্ধ আছে, তখন আর দেরি না করে দ্রুত বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

কিন্তু সে জানতেই পারল না, এক ঝলকের জন্য আর্জুমান্দ বেগম হাত দিয়ে চোখের ওপরে থাকা আই মাস্কটা খুলে তাকে দেখে ফেলেছে!

মৃত্যুপথযাত্রী রােগী সুতীব্র ভয় আর অবিশ্বাসে কাঁপতে শুরু করল রীতিমতাে। যেন দুঃস্বপ্ন দেখেছে!

অধ্যায় ৯৩

আশেক মাহমুদের গাড়িটা ছুটে চলেছে তার গুলশান দুই নাম্বারের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।

একমাত্র দারােয়ান বদরুলকে ওই শুনসান বাড়িতে রেখে ড্রাইভার সেলিমকে নিয়ে রওনা দিয়েছে পিএস। অন্য কোনাে সময় হলে এই সরকারি গাড়িটা চালাত নিয়মিত একজন ড্রাইভার, কিন্তু আজকের রাতের জন্য আশেক মাহমুদ বেছে নিয়েছে তার আর-একজন বিশ্বস্ত লােক সেলিমকেই।

পিএস বসে আছে পেছনের সিটে, ছফা বসেছে ড্রাইভারের পাশে। গাড়িটা পথে নামতেই শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। প্রথমে বড়ো বড়ো ফোঁটায়, তারপর ঝমঝম করে। এরই মধ্যে ছুটে চলেছে তাদের গাড়িটা। বিরূপ প্রকৃতি পিএসকে পরিহাসের সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সব কিছুই তার বিপক্ষে চলে গেছে এখন।

একটু আগে ছফা তার জুনিয়র জাওয়াদকে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে আসতে বলেছে। পিএসের গুলশানের অ্যাপার্টমেন্টে। যে কাজটা করতে হবে তাতে জাওয়াদ ছাড়াও আরও অনেক লােকবল লাগবে। তবে সবার আগে পিএসের অ্যাপার্টমেন্টে পৌছােতে হবে তাকে, ওখান থেকেই শুরু করতে হবে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের।

– আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টের মেনগেটের সামনে তাদের গাড়িটা থামতেই পিস্তলের সেফটি লক খুলে পেছনে ফিরে তাকাল ছফা।

“আপনি এখানেই থাকুন, স্যার।” পিএসের চোখেমুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। “আপনি কি মনে করছেন, ওই মহিলা এখনও আমার অ্যাপার্টমেন্টে আছে?”  “না,”কথাটা বলেই
ছফা গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হল বৃষ্টির মধ্যেই।“কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে ওখানে ঢােকা ঠিক হবে না।”

অ্যাপার্টমেন্টের গেটের পাশে যে ছােট্ট ওয়াচরুমটা আছে, সেখানে ডিউটিতে থাকা দারােয়ান পিএসের গাড়িটা দেখে বের হয়ে এসেছে এতক্ষণে।  বৃষ্টির ছটা থেকে বাঁচতে ওয়াচরুমের শেডের নীচে এসে দাঁড়াল ছফা।“একটু আগে কী একজন মহিলা বের হয়ে গেছে এখান থেকে?  কিছুক্ষণ আগে ঢুকেছিল সম্ভবত?”

দারােয়ান মাথা নেড়ে সায় দিল। “জি, স্যার। একটু আগেই বাইর হইসে।” “কতক্ষণ আগে?”

একটু ভেবে নিল দারােয়ান।“দশ-বারাে মিনিট তাে হইবােই?”

ছফা জানত এমন জবাবই পাবে। “কোনদিক দিয়ে গেছে ওই মহিলা  দেখে
ছ, পিএসের গাড়িটা যেদিকে মুখ করা সে দিকটায় আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল।“ ওই দিকে স্যার।”

“গাড়িতে করে নাকি পায়ে হেঁটে?” “হাঁইট্যাই তাে গেল দেখলাম।” মাথা নেড়ে সায় দিল ছফা। “আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টে কল দাও।”

অবাক হয়ে ইন্টারকমটা তুলে নিল দারােয়ান। সে বুঝতে পারছেনা, ক্ষমতাধর পিএস তার গাড়ি নিয়ে সরাসরি এই ভবনে না ঢুকে নিজের ফ্ল্যাটে কল দিচ্ছে কেন। যাই হােক, কয়েকবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে কেউ ধরল ইন্টারকমটা। “নেন, কথা বলনে, স্যার ”ছফার দিকে বাড়িয়ে দিল।

“হ্যালাে, আমি ডিবি থেকে বলছি  আপনি কে বলছেন?”জিজ্ঞেস করল সে। “আমি জেবুন্নেসা  হাউজ
নার্স।” মেয়েটা একদমই ভড়কে গেছে। “একটু আগে একজন মহিলা এসেছিল ?” “জি, স্যার।” “তাকে অ্যাপার্টমেন্টে কে ঢুকতে দিয়েছে?” “ইয়ে মানে,”আমতা আমতা করল মেয়েটি। “আমিই, স্যার।” “আপনি তাকে কেন ঢুকতে দিলেন?” “উনি হসপিস সার্ভিস ইন্সপেকশন করতে এসেছিলেন।” কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না ছফা। “কী সার্ভিস, বললেন?”

মেয়েটা তাকে সংক্ষেপে জানাল বিষয়টা।সব শুনে থমকে গেল সে।মুশকান জুবেরির কৌশলটা এরকম অভিনব হবে ধারণাও করতে পারেনি। কিন্তু এত দ্রুত কীভাবে এটা করল বুঝতে পারছেনা।

“আশেক সাহেবের বােনের কী অবস্থা এখন?”

“ওই ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর থেকেই পেশেন্ট পাগলের মতাে আবােল তাবােল বকছেন, স্যার। বার বার মুশকান নামের একজনের কথা বলছেন….কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, মনেমনে বলে উঠল ছফা।“ঠিক আছে।”বলেই ইন্টারকম রেখে দিল। পিএসের অ্যাপার্টমেন্টটা এখন নিরাপদ মুশকান সেখানে নেই।

উপুড় হয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের কাচ নামানাে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে পিএসকে বললো” “স্যার, মুশকান জুবেরি একটু আগে চলে গেছে। আপনার বােনের কিছু হয়নি। আর রাতে আপনি আপনার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আর বের হবেন না, কাউকে ঢুকতেও দিবেন না।

আমি আপনার সঙ্গে যােগাযােগ রাখব,” পকেট থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড বের করে পিএসকে দিয়ে বলল, “এই নাম্বারে কল দেবেন একটু পর, আপনার সাহায্যের দরকার আছে আমার।”

পিএস খুবই অবাক হয়ে চেয়ে রইল।“আপনি কী করবেন?কিছুই তাে বুঝতে পারছি না।

“মুশকানকে ট্র্যাক করব।” “কীভাবে?” ছফা তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমার ওপরে ভরসা রাখুন,” বলেই দারােয়ানকে গেট খুলে দিতে বলে আশেক মাহমুদের ড্রাইভারকে ইশারা করল গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য।  পিএসের অ্যাপার্টমেন্টের মেইনগেটটা বন্ধ হয়ে গেলে ছফা গভীর করে দম নিয়ে নিল। তার সহকারি জাওয়াদ থাকে বাড্ডায়।বাইক
নিয়ে এখানে চলে আসতে দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। যে-কোনাে সময়ই ছেলেটা চলে আসবে। তবে তার জন্য অপেক্ষা করে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে আশেপাশে তাকাল।এক দু-জোড়া চোখ ফাঁকি দেওয়া সম্ভব কিন্তু অসংখ্য চোখ ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব!

মুশকান, তুমি কোনাে না কোনাে চোখে তাে ধরা পড়বেই!

অধ্যায় ৯৪

পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তড়িঘড়ি বের হয়েই মুশকান দেখতে পায় বৃষ্টি পড়ছে। একটু দূরে, কয়েকটি ভবনের পরই অপেক্ষা করছে ওই গাড়িটা।

পুরােনাে ঢাকা থেকে উবারে করে গুলশানে আসার পথেই হসপিসের তথ্যটা পাবার পর দ্রুত পরিকল্পনাটা করেছিল। ডাক্তারকে বলেছিল, একটা প্রাইভেটকার আর বিশ্বস্ত ড্রাইভার দরকার তার, সেই সঙ্গে ডাক্তারদের একটি অ্যাপ্রােন।

পুরােনাে ঢাকা থেকে গুলশানে যাবার পথেই ডাক্তার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন সেটা। উবারের গাড়িটা গুলশানের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় এসে ছেড়ে দেয় সে, তারপর উঠে পড়ে আসকারের পাঠানাে গাড়িতে। ওটা দিয়েই চলে আসে আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টের কাছে।

এখন পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে অনেকটা পথ সামনে গিয়ে ওই গাড়িতে উঠে বসেছে। সুস্মিতাকে নির্দিষ্ট একটি রাস্তায় নামিয়ে দেবার কথা। সেখান থেকে এই গাড়িতে করে তাকে তুলে নেবে মুশকান,কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কিছু একটা গড়বর হয়ে গেছে! সুস্মিতার সঙ্গে কথােপকথনের এক পর্যায়ে পিএসের ওই লােকটা বলেছিল, সে একটা লেনদেন করতে চায় তার সঙ্গে। এর পরই ধস্তাধস্তির শব্দ শুনেছে। কিছুক্ষণ পর তাকে ভড়কে দিয়ে সুস্মিতার ফোনটাও বন্ধ হয়ে যায়।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। আর একটু সতর্কতার সঙ্গে কাজ করা দরকার ছিল।পিএসের লােকটার বদলে নুরে ছফাকে দিয়ে সুস্মিতাকে নির্দিষ্ট পথে নামিয়ে দেবার চিন্তাটা বাতিল করে দিয়েছিল এই ভেবে যে, নাছােরবান্দা ছফা এ কাজের জন্য মােটেও নিরাপদ নয়। মাঝপথে সে হয়তাে বাগড়া দেবে। পিএসের কথার অবাধ্য হয়ে মুশকানকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে সে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।  নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার চেষ্টা করল মুশকান। সুস্মিতার নম্বরে আবারও দিল। নাম্বারটা এখনও বন্ধ আছে। মেয়েটার সঙ্গে খারাপ কিছু হলে তাকে কল
দিত ওই লােক,কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা করেনি। মুশকান আর ভাবতে পারল না। গভীর করে স্বাস নিয়ে নিজের নার্ভকে শান্ত রাখতে চাইল। আজকে রাতে চেষ্টার কোনাে ত্রুটি করেনি সে। বলতে গেলে সাধ্যের বাইরে গিয়ে সব কিছু করেছে। এর পরও যদি শেষটায় এসে খারাপ

কিছু ঘটে যায়, তার কীই বা করার থাকবে!

হঠাৎ চমকে উঠল সে। তার ফোনটা বাজছে! পিএস?!  না। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে শুধরে দিল। প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে ভুলেই গেছিল, এই ফোনটা এখন সুস্মিতার কাছে আছে।

নাকি বেহাত হয়ে গেছে মেয়েটার কাছ থেকে? পিএসের ওই লােক না তাে?

একটা আশঙ্কা জেঁকে বসলেও কলটা রিসিভ করার আগে মনে মনে কেবল একটা প্রার্থনাই করল সেঃ ফোনের ওপাশে যেন সুস্মিতার কণ্ঠটাই শুনতে পায় !

অধ্যায় ৯৫

কিছুক্ষণ আগে পিএসের গানম্যান যখন সুস্মিতাকে মুক্তি না দেবার কথা জানাল, তখন সে ভড়কে গেলেও তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিল, তার এমন কর্মকাণ্ডের ফলাফল কী হতে পারে। আসলাম সেটা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, মৃত্যুপথযাত্রী একজনের জীবন নিয়ে তার কোনাে মাথা ব্যথা নেই।

তারপরও সাহস করে পিএসের ষন্ডাটাকে বলেছিল সুস্মিতাঃ “ভালােয় ভালাে যেমনটা বলেছি, আমাকে বনানীর পাঁচ নম্বর রােডে নামিয়ে দে তুই কোন মতলবে যে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস সেটা কিন্তু বুঝে গেছি!”  রিয়ার মিররে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল আসলাম। কী বুঝে গেছিস?”

বাঁকাহাসি দিয়েছিল সুস্মিতা। “আমাকে একা পেলে কী করতে চাস ভেবেছিস আমি জানি না?”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তিতে কপালে তােলে গানম্যান। “তাই নাকি!”

“কিন্তু তাের সেই আশা পূরণ হবে না মনে হচ্ছে! মুশকান কিন্তু এখনও ফোনে। কানেক্টেড আছে সব শুনতে পাচ্ছে।”কথাটা বলেই পাশে রাখা ফোনটার দিকে ইঙ্গিত করে সে।

এ কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আসলাম। “তাের মুশকানকে বল আমি তােকে ছাড়ছি না। আমার সঙ্গে তাকে একটা লেনদেন করতে হবে।”

সুস্মিতা অবিশ্বাসে তাকায় গানম্যানের দিকে। তারপর হঠাৎ করেই স্মিত হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোটে।“তাহলে কথাটা তুই নিজেই ওকে বল”

এ কথা শুনে সঙ্গত কারণেই সুস্মিতার পাশে রাখা ফোনটার দিকে তাকায় আসলাম।

মুচকি হেসে মাথা দোলায় মেয়েটি। তারপর আচমকা গাড়ির সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, “ফোনে না, মুশকান তাের সঙ্গে সশরীরে কথা বলার জন্য চলে এসেছে!  ওই
কথাটা শুনে চমকে উঠে মেয়েটার দৃষ্টি অনুসরণ করে গাড়ির সামনের দিকে তাকায় আসলাম, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে নিজের ভুলটা।

রাস্তায় কেউ নেই! ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে! টের পায় তার গলায় কিছু একটা চেপে বসেছে।

মুহূর্তে প্রবল জোরে হ্যাচকা টান খেয়ে পিছিয়ে যায় তার মাথাটা। হাত দিয়ে গলায় চেপে ধরা নাইলনের চিকন দড়িটা ধরার চেষ্টা করে সে, কিন্তু ততক্ষণে দড়িটা দেবে গেছে তার গলায়! রিয়ার মিররে তাকিয়ে সুস্মিতাকে দেখতে পায় সে। মেয়েটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দু-হাতে দড়ির দুই প্রান্ত ধরে টেনে যাচ্ছে, আর এ কাজে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে তার পা দুটো!

আসলামের সিটের পেছনে পা দুটো ঠেকিয়ে সমস্ত শক্তি প্রয়ােগ করে ধনুকের মতাে বাঁকা শরীরটাকে সােজা করার চেষ্টা করতে থাকে সুস্মিতা। তার শরীর যত সােজা হচ্ছিল আসলামের গলার ফাঁস ততই চেপে বসতে শুরু করেছিল। দু-হাতে গলা থেকে দড়িটা ধরে টানার চেষ্টা করে যায় সে, কিন্তু সুস্মিতা আরও জোরে হ্যাচকা টান দিতেই সেটা বেশি করে দেবে যায় তার গলায়। ড্রাইভিং সিটের হেডরেস্টটার কারণে বেকায়দায় পড়ে যায় আসলামের মাথাটা।আতঙ্কের সঙ্গেই সে টের পায়, তার গলার চামড়া কেটে নাইলনের দড়িটা দেবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে,বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নিশ্বাস। মেয়েটা দু-হাত আগেপিছে করে প্রবল শক্তি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলার চেষ্টা করতে শুরু করছে।

“তােকে আমি অপচয় করব না  গান্ডু!” দাঁতমুখ খিচে বলে সুস্মিতা।“পুরােপুরি সদ্ব্যবহার করব।”

কথাগুলাে খুব বেশি ভীতিকর শােনায় আসলামের কাছে। মেয়েটা কী বলতে চাইছে। -বুঝতে পারে না সে। কিন্তু এর পরের কথাটা শুনে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।

“খাওয়ার জন্য তুই একদম উপযুক্ত!”

কথাটা শুনে গানম্যানের দু-চোখ যেন বিস্ফোরিত হবার উপক্রম হয়। তীব্র গােঙানি দেয় সে।  একটা পা সিটের পেছন থেকে একটু তুলে হেডরেস্টের পেছনে ঠেকায় সুস্মিতা, তারপর দড়িতে আরও জোরে টান দেয়। বাঁকা হয়ে থাকা শরীরটা পুরােপুরি সােজা করে ফেলে। অস্ফুট কিন্তু জান্তব গােঙানি বের হয়ে আসে মেয়েটার ভেতর থেকে। সেই গােঙানির সঙ্গী হয় মাহবুব আসলামের ভোঁতা আর্তনাদটি।

অন্তিম সময়ে তার মনে পড়ে যায় তার কোমরে গোঁজা আছে নাইন মিলিমিটারের একটি পিস্তল! কিন্তু ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, সে-ও তার গলায় ফাঁস হয়ে থাকা দড়িটা দু-হাতে টেনে ধরতে মরিয়া তখন। ভালাে করেই জানত, একটা হাত ছেড়ে দিলেই দড়িটা আরও জোরে চেপে বসবে তার গলায়। তারপরও বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে দড়িটা ছেড়ে বাম হাত দিয়ে কোমর হাতড়াতে শুরু করে উদ্ভ্রান্তের মতাে। সঙ্গে সঙ্গে টের পায়, সুস্মিতা আবারও তার দু-হাত আগেপিছে করে গলা কাটতে শুরু করে দিয়েছে। এবার আরও জোরে জোরে!

রিয়ার মিররে তাকায় আসলাম, দেখতে পায় তার গলা কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরােচ্ছে!

কোমরের পিস্তলটার নাগাল পেতেই দু-চোখে অন্ধকার নেমে আসে।বাতাস তার ফুসফুস ফেটে যেতে চাইছিল যেন। কাঁপতে থাকা হাতে তবুও পিস্তলটা  নিতে পারে সে, কিন্তু দড়িতে আর একটা হ্যাচকা টান পড়তেই হাত থেকে
ছুটে যায় অস্ত্রটা! সিটের ওপর হাতড়ানাের চেষ্টা করলেও নাগাল পায় না আর। অস্ত্রটার আশা বাদ দিয়ে আবারও দড়িটা ধরে ফেলে দু-হাতে। আতঙ্কের সঙ্গেই রিয়ার মিররে দেখতে রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার গলা আর বুক। শ্বাসনালী কেটে ভোশভােশ শব্দ হচ্ছে।

আসলাম টের পায়, চোখ খােলা রাখলেও অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে। সেই অন্ধকারে ভেসে উঠল তার ছেলে আরাফের মুখটা! কতদিন তাকে দেখেনি। স্ত্রী হত্যার ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তার ছেলেকে ওর নানা-নানি নিজেদের কাছে নিয়ে নেয়।

আরও দুটো মুখও ভেসে উঠল এরপর! তার স্ত্রী সােমা! আর মনিষা দেওয়ান! এদের সবাইকে সে হারিয়েছে। এখন সে-ও হারাবার পথে!

“মুশকানকে পেলে কী করবি সেটাই শুধু মাথায় রেখেছিলি!”দম ফুরিয়ে গেলেও কিড়মিড় করে কথাটা বলে সুস্মিতা।“কিন্তু তােদেরকে পেলে”আর-একটু জোরে টান দিয়ে বলে, “আমরা কী করব  একদমই ভাবিসনি!”

আমরা!  অন্তিম মুহূর্তে আসলামের মনে হয়, একজন নয়, দুদু-জন মুশকান জুবেরির খপ্পরে পড়েছে সে!

এরপরই পরিস্থিতিটাকে আরও বেশি রােমহর্ষক করে দিয়ে একটু আগে গাওয়া গানটার বাকি অংশ গাইতে শুরু করে সুস্মিতাঃ

“রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে আলাের প্রার্থনাই তেমনি গভীর মােহের মাঝে তােমায় আমি চাই….”

আসলাম টের পায় অপার্থিব এক ভয় জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। এর পর সুস্মিতা গাইল কী গাইলনা,বুঝতে পারেনি। আর কোনােশব্দ তার কানে ঢােকেনি। দৃশ্যের পর শব্দও উধাও হয়ে যায়! শুধু ভাে ভাে আওয়াজ শুনতে পায় সে।

এর কয়েক মুহূর্ত পরই স্থির হয়ে যায় মাহবুব আসলামের পঁয়ত্রিশ বছরের সুঠাম দেহটি।

অধ্যায় ৯৬

মুশকান বসে আছে একটি ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টে।

বৃষ্টি এখন কমে এসেছে। জায়গাটা গুলশান আর বনানী থেকে খুব কাছেই, বারিধারার একটি অ্যাপার্টমেন্ট অরিয়েন্ট হাসপাতালেরই সম্পত্তি। প্রায়শই বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট আর গেস্ট ডাক্তাররা আসে। তাদের থাকার জন্য স্থায়ীভাবে এই অ্যাপার্টমেন্টটি কেনা হয়েছে। আজকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক ভারতীয় কার্ডিয়াক স্পেশালিস্ট ছিলেন, এখন একদম ফাঁকা।  শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মতােই কাজটা করতে পেরেছে সে।কাজ শেষে ওখান থেকে বের হয়ে গাড়িতে সােজা বারিধারার এই অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসে
। মুশকান সুস্মিতাকে পিক করে নিয়ে আসার কথা ছিল, কিন্তু মেয়েটার ফোন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করে। কল কেটে যাবার আগে সুস্মিতা আর পিএসের ওই লােকটার কথা। শুনেছে- নির্ঘাত বিপদে পড়েছে মেয়েটি আবার! তার এই পরিকল্পনাটিও ভণ্ডুল হয়ে গেল বুঝি! তাই গুলশান দুই নম্বরে পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসকারের পাঠানাে গাড়িতে উঠে বসলেও তার জানা ছিল না কোথায় যাবে।এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সুস্মিতাকে যেখানে নামিয়ে দেবার কথা বলেছিল সেখানে গিয়েই অপেক্ষা করা উচিত।  আসকারের পাঠানাে লােকটাকে সে কথা বলতেই গাড়িটা ছুটে যায় বনানীর পাঁচ নাম্বার রােডের দিকে। রাতের এ সময়ে পথঘাট ফাঁকা পেয়ে অল্প কিছুক্ষণ পরই চলে যায় সেখানে। রাস্তার এক পাশে গাড়িটা পার্ক করে অপেক্ষা করতে থাকে
মুশকান।এছাড়া আর কিছু করারও ছিল না তার।

কয়েক মিনিট পরই, তার নার্ভের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে। কলার আইডি দেখে সে ভেবেছিল পিএস। পরক্ষণেই বুঝতে পারে, এই ফোনটা সুস্মিতার কাছে ছিল বন্দিদশা থেকে মুক্ত হবার সময়।

সুস্মিতার কণ্ঠ শােনামাত্রই মুশকানের সমস্ত উদ্‌বেগ-উৎকণ্ঠা উবে যায় এক মুহূর্তে। মেয়েটা জানায়, সে একটা রিকশা নিয়ে রওনা দিয়েছে বনানীর পাঁচ নম্বর রােডের উদ্দেশ্যে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওখানে চলে আসে সুস্মিতা। দূর থেকেই দেখতে পায়, বৃষ্টিতে ভিজে জবুথুবু হয়ে রিকশায় করে আসছে মেয়েটি। প্যাসেঞ্জার ডােরটা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে মুশকান। সুস্মিতা দেখতে পেয়ে রিকশাটা থামায় গাড়ির পাশে। ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটা গাড়িতে ওঠার পরই মুশকান দেখতে পায় তার চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেছে, আর তার জামায় লেগে আছে রক্ত!

“কী হয়েছে তােমার ? তুমি ঠিক আছে তাে?” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে সে। “আমি ঠিক আছি  ডােন্ট ওরি,”শান্ত কণ্ঠে বলে সুস্মিতা।“পরে সব বলব।” যাই হােক, বারিধারার এই অ্যাপার্টমেন্টে আসার পথে গাড়িতে তারা এ নিয়ে আমি কোনাে কথা বলেনি আসকারের লােকটার উপস্থিতির কারণে। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে
থাকতে মুশকান প্রথমে জানতে চায়, সে কেন ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছিল হুট করে ? তার শরীরে কীসের রক্ত লেগে আছে? – এমন প্রশ্নে রহস্যময় হাসি দিয়েছিল সুস্মিতা। তাকে জানায়, আগে ভেজা কাপড় ছেড়ে তারপর সব খুলে বলবে তাকে – এ কথা বলেই বাথরুমে ঢুকে পড়ে সে।

এখনও বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছে সুস্মিতা। – মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত! মনে মনে বলল মুশকান। খুব বেশি দিন হয়নি তার সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু এখন এই পৃথিবীতে ডাক্তার আসকার ছাড়াও আর-একজন ঘনিষ্ঠজন রয়েছে তার। কিন্তু মেয়েটার কিছু কিছু আচরণে সে যেমন দুশ্চিন্তায় থাকে, তেমনি অস্বস্তিও বােধ করে!

মাথার চুল টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে মুশকানের বিপরীতে একটি সিঙ্গেল সােফায় বসল সুস্মিতা।

“ও আসবে না?”জানতে চাইল সে।

অবাক হয়ে তাকাল মেয়েটার দিকে। তার মধ্যে কোনাে বিকারই নেই। অথচ আজকে দুপুর থেকে একটু আগ পর্যন্ত কতগুলাে পিশাচের হাতে বন্দি ছিল সে। টর্চারেরও শিকার হয়েছে। কে জানে কতটা ভয়াবহতার ভেতর দিয়ে গেছে!

“ও এখানে আসবে না,”শান্ত কণ্ঠে বলল মুশকান। একটু আগে ডাক্তার আসকারের সঙ্গে কথা হয়েছে তার, বলে দিয়েছে তারা দুজনেই নিরাপদে আছে।

“কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে তাকাল।“কারণ ওকে ফলাে করে নুরে ছফা আর তার লােকজন এখানে চলে আসতে পারে।”

“ও,”আর কিছু না বলে ভেজা চুলগুলাে টাওয়েলে মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সুস্মিতা। মুশকানের দিকে চোখ গেল। স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।“কী হয়েছে? ওভাবে তাকিয়ে আছাে কেন?”

গভীর করে দম নিল মুশকান। একটা অস্বস্তি পেয়ে বসেছে তাকে, কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলতে পারছে না।

“ফোনটা কেন বন্ধ হয়ে গেছিল, তাই তাে?” মুশকান কিছু বলল না।

“ওই গান্ডুটাকে ইয়ে করার সময় সিট থেকে পড়ে গেছিল ওটা,”নির্বিকার কণ্ঠে বলল সুস্মিতা। “তখনই বন্ধ হয়ে যায়।”

পিএসের লােকটার সঙ্গে সুস্মিতার ধস্তাধস্তির আওয়াজ মুশকানও শুনেছে। “তুমি তাকে কী করেছাে?” কুঁচকে জানতে চাইল।

রহস্যময় হাসি দিল সুস্মিতা সমাদ্দার। “হেঁয়ালি না করে স্পষ্ট করে বলাে।”

“অমন করে তাকাবে না আমার দিকে,” চুল মুছতে মুছতে বলল। “তুমি হলে যা করতে, তা-ই করেছি।”

সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মুশকান।

“সামান্য একটা নাইলনের দড়ি দিয়েই ঘায়েল করেছি। ওটা দিয়েই আমাকে বেঁধে রেখেছিল। ওখান থেকে বের হবার সময় ওটা নিয়ে নিয়েছিলাম, ওদের কেউ দেখেনি।” মুশকান কিছু বলছে না দেখে আবার বলল, “ওই লােকটা খুব বাজে ছিল। আমারও সন্দেহ হচ্ছিল, সে উলটাপালটা কিছু করতে পারে তাই দড়িটা নিয়ে নিয়েছিলাম।”

“তুমি ওকে মেরে ফেলেছ!”সরাসরিই জিজ্ঞেস করল এবার।

“বললাম তাে, কিচ্ছু করার ছিল না। ও আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল  খুব বাজে ইনটেনশান ছিল ওর…..বিলিভ মি।” – দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুশকান। “ঠিক আছে, বুঝলাম কিন্তু ” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

“কী?” “তুমি আর কিছু করােনি তাে?”

সুস্মিতা স্থিরচোখে চেয়ে রইল মুশকানের দিকে। তারপর কাঁধ খুলে বলল, “আর কী করব?”

গভীর করে দম নিয়ে নিল মুশকান। “ওই লােকটার ডেড বডি অটোপসি করলে—”  কথার মাঝে হেসে ফেলল সুস্মিতা। “তুমি আমাকে এতটা ইম্যাচিউর ভাবাে কেন বুঝি না,”চুল মুছতে মুছতে স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বলল।“ওকে গাড়িটাসহ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”

ভ্রু কপালে তুলল মুশকান।“কিন্তু বৃষ্টির কথাটা কি মাথায় আছে তােমার?” “বৃষ্টি নেমেছে তার একটু পরে।” “তােমার কি ধারণা, ততক্ষণে লাশটা পুরােপুরি পুড়ে গেছে?”

কাঁধ তুলল সুস্মিতা। “আই ডােন্ট হ্যাভ এনি আইডিয়া।”তারপর রহস্য করে বলল, “প্রথমবার পােড়ালাম তাে, বুঝতে পারছি না কতক্ষণ লাগতে পারে।”

আক্ষেপে মাথা দোলালাে মুশকান। “তােমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।” ঠোট ওলটালাে মেয়েটা।

অস্বস্তিটা জোর করে মাথা থেকে তাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সে। “আমরা একটু পরই এখান থেকে চলে যাব।”

“কোথায়?”অবাক হয়ে জানতে চাইল।

“এসব তােমার না জানলেও চলবে।” কাঁধ তুলল আবার। “ওকে। আমরা দুজন একসঙ্গে থাকব, এটাই বড়ো কথা। কিছুই বলল না মুশকান।এই মেয়েটার সঙ্গে থাকার কোনাে ইচ্ছে তার নেই কিন্তু পরিস্থিতি এমনই, সেটা করতে হবে এখন। অন্তত কিছু দিনের জন্য।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল সে। প্রায় সারাটা জীবন যাযাবরের মতাে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়াল। দীর্ঘ যৌবন দীর্ঘ জীবনও পাবে সম্ভবত, কিন্তু থিতু হওয়া তার কপালে নেই!

– “আচ্ছা, ওই নুরে সাফা লােকটা কীভাবে সার্জনের কথা জেনে গেল?”

সুস্মিতার কথায় ফিরে তাকাল মুশকান। এটা নিয়ে সে-ও অনেক ভেবেছে, কোনাে সদুত্তর পায়নি। সুকুমারের ব্যাপারটা না-হয় কলকাতার পুলিশের নজরে চলে এসেছিল, কিন্তু ডিপি মল্লিকের নিখোঁজের ঘটনায় ওখানকার পুলিশ তাকে সন্দেহ করেনি। আসকার তাকে শুধু বলেছে, কীভাবে যেন মাস্টারকে লেখা চিরকুটটা ছফা হস্তগত করে ফেলেছে, তারপর সেটার সূত্র ধরেই ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিনকে পাকড়াও করে সে। ওই লােকই খোঁজ দিয়ে দেয় আসকারের, কিন্তু তার কাছ থেকে কোনাে কিছুই আদায় করতে পারেনি ডিবি অফিসার। এবার বেশ শক্ত ছিল ডাক্তার, আগের বার কেএস খানের কথার ফাঁদে পড়ে নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার হয়েছিল সে।তবে আসকারের দেশি পাসপাের্টটা জোর করে নিয়ে নেয় ছফা। ওই পাসপাের্ট দেখে না-হয় ডিবি অফিসার বুঝে গেল, ওর কলকাতায় ঘন ঘন যাতায়াতের কথাটা, কিন্তু মুশকান কোথায় থাকে, ডিপি মল্লিকের নিখোঁজ হবার সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথা জানল কীভাবে?

_ তার চেয়েও বড়ো কথা, আসকারের বাড়িতে হানা দেবার আগেই ছফা টের পেয়ে গেছিল সে ঢাকায় গেছে! পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গেছিল সে, দু-দিন পর ঢাকা থেকে যশােরের ডােমেস্টিক ফ্লাইট ধরার জন্য রওনা দিয়ে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে যায়, ফ্লাইটটা মিস করে বসে। ফাইন দিয়ে ফ্লাইটটা যখন রি-শিডিউল করে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিল তখনই দেখতে পায় নুরে ছফা বিমানবন্দরে চলে এসেছে। হাতে একটা ছবি নিয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে কথা বলছে সে।

ভাগ্য ভালাে, পরহেজগার মহিলার বেশে ছিল, তাই ছফা তাকে দেখতেই পায়নি। তবে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসেই দূর থেকে ছবিটা দেখে চিনতে পারে।

অবিশ্বাস্য! ছফা কীভাবে এ ছবি পেল?কীভাবে জেনে গেল, সে এখন ঢাকায়? এসব প্রশ্নের কোনাে উত্তর জানা ছিল না তার। তবে এখন সেই প্রশ্নের উত্তর সে জানে আর্জুমান্দ বেগম।ওই ছবিটা দিয়েছে ছফাকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুশকান, সুস্মিতার দিকে তাকাল সে। তার চোখে ভেসে উঠলো সেই দিনগুলাের দৃশ্য। সত্যি বলতে, সুন্দরপুর থেকে পালানাের বছরখানেকেরও বেশি পরে, যেদিন এই মেয়েটা হুট করে চলে এল কলকাতায়, সেদিনই ওর নিয়তি নির্ধারীত হয়ে গেছিল।

অধ্যায় ৯৭

মুশকানের কলকাতা পর্ব

সুন্দরপুর থেকে ঢাকায় চলে আসার পর এমপি আসাদুল্লাহর সঙ্গে লেনদেন চুকিয়ে বোর্ডের দিয়ে কলকাতার সল্টলেকের ডাক্তার আসকারের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল মুশকান।চাইলে সে পাসপোর্ট বেবহার করেই যেতে পারতো, ছফা তখনও হাসপাতালে, পুরােপুরি সুস্থ হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্ত করলে সে জেনে যেত সে কলকাতাতে গেছে।

অস্কারের স্ত্রী শুভমিতা মারা যাবার ও তার বড় বােন পারমিতা থাকত সল্টলেকের বাড়িতে। সে-ও যখন মারা গেল তখন থেকে বাড়িটা খালিই পড়েছিল।ফলে ওই বাড়িটা হয়ে ওঠে মুশকানের নতুন ঠিকানা, উপযুক্ত একটি আশ্রয়! ওখানে গিয়ে প্রায় এক বছরের মতো চুপচাপ ছিল মুশকান।তারপরই সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে একজায়গা থেকে আর এক জায়গায় পালিয়ে আর থাকবে না।

চেহারাটা পালটে ফেললে আর নতুন একটি নাম-পরিচয় থাকলে সব দিক থেইে সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে।নুরে ছফার হাত থেকে তাে বাচঁবেই, এমনকি দেশে গিয়েও থিতু হতে পারবে।

কিন্তু এরকম কাজের জন্য অভিজ্ঞ সার্জনের থেকে বেশি দরকার ছিল বিশ্বস্ত একজন ডাক্তারের।কলকাতায় ডিপি মল্লিক নামে এক প্লাস্টিক সার্জনের সঙ্গে আসকারের বেশ ভালাে জানাশোনা ছিল।তার মধ্যেই কাজটা করা যাবে।

তো একদিন ডিপি মল্লিকের সাথে  ফোনে
কথা হয়,মুশকানের কাছ থেকে জেনে নেয় সে কি চায়।

সার্জন জানায় তার চেহারার অনেকটুকুই পালটে ফেলা যাবে, এর জন্য দোকার হবে অনেকগুলো সার্জারির। মোট কত খরচ হবে সেটাও জানিয়ে দিয়েছিল ভদ্রলোক।ব্যস্ত শিডিউল দেখে খুব শিগগিরই জানিয়ে দেবে কবে থেকে কাজ শুরু করবে।কিন্তু কয়েকদিন   পর সল্টলেকের বাড়িতে
ডিপি মল্লিক আসে কথাবার্তা চূড়ান্ত করার জন্য,তখন মুশকানের পিলে চমকে দেয়।

আমি জানি আপনি কে?

আপনি রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননির সেই কুক!সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে এসেছেন..পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।

মুশকান স্তব্ধ হয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি,কলকাতার এই সার্জন চিনে ফেলবে তাকে।সত্যিটা হল, বেশ কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে, ডাক্তার আসকারের আমন্ত্রণে অরিয়েন্ট হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারির ওপরে একটি সেমিনারে অংশ নিতে ঢাকায় গিয়েছিল ডিপি মল্লিক। তখন ডাক্তারই সুন্দরপুরে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথে লাঞ্চ করান। কিন্তু ঘটনা এখানে থেমে থাকলে সমস্যা হত না। এই ডিপি মল্লিক নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টসহ তার পেজে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ নামের অদ্ভুত রেস্টুরেন্টের ছবি আর খাবারের প্রশংসা করে পােস্ট দিয়েছিল। এই পােস্টে সুন্দরপুরের এক তরুণ কমেন্ট করে, সেই সূত্রে সার্জনের সঙ্গে তার পরিচয়ও হয়।ঠাঁই করে নেয় ভদ্রলােকের ফ্রেন্ডলিস্টে।পরবর্তীতে ওই তরুণই তাকে জানিয়েছিল, কী এক কারণে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মালকিন সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যাবার পর রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে গেছে। মহিলা এখন ফেরারি আসামি। তবে ঠিক কী কারণে পুলিশ তাকে খুঁজছে সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।

এরকম খবর শােনার পর ভােজনরসিক মল্লিক একটু কষ্টই পেয়েছিল, সেই সঙ্গে কৌতূহলীও হয়েছিল মুশকানের ব্যাপারে। এরকম গুণী মহিলা কী এমন কাণ্ড করল যে, তাকে ফেরারি হতে হল! – ডাক্তার আসকার তাকে অনুরােধ করে বলেছিলেন, তামান্না রহমান নামে তার এক আত্মীয়ার সার্জারি করে দিতে হবে, সে এখন কলকাতায়ই আছে। কাজটা করতে হবে সর্বোচ্চ গােপনীয়তার সঙ্গে।কিন্তু সল্টলেকের বাড়িতে মুশকানকে দেখেই ডিপি মল্লিক চিনে ফেলে-এ হল রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’র সেই বিখ্যাত কুক! যার খাবার খেয়ে এবং যাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ডিপি মল্লিকের বুঝতে সমস্যা হয়নি ঘটনা আসলে কী— মুশকান গুরুতর কোনাে অপরাধ করে দেশ থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে।মুশকান প্রথমে ভেবেছিল লােকটা ব্ল্যাকমেল করে মােটা অঙ্কের টাকা দাবি করবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সার্জন জানায়, তার চাওয়া খুবই সামান্য একটু সান্নিধ্য

পেতে চায় তার ! আর কিছু না।

এর অর্থ বুঝে নিতে কোনাে সমস্যাই হয়নি তার। প্রস্তাবটি পেয়ে কোনাে রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, বরং একটু ভেবে, লােকটাকে অবাক করে দিয়ে জানায়, সে রাজি আছে তবে কিছু শর্ত আছে তার। উদগ্রীব হয়ে মল্লিক জানতে চায় শর্তগুলাে কী।মুশকান জানায়, এটা একবারই হবে, এরপর আর কখনও ব্ল্যাকমেল করবে না, কোনােভাবেই না! এই ব্যাপারটা পুরােপুরি গােপন রাখতে হবে, যেমন গােপন রাখতে হবে তার প্লাস্টিক সার্জারির কথাটাও। যত দ্রুত সম্ভব করে দিতে হবে সেটা!

ডিপি মল্লিক কোনাে রকম কালক্ষেপন না করেই শর্তগুলাে মেনে নেয়। তবে সে-ও পালটা একটি শর্ত দিয়ে বসে :মুশকানের সান্নিধ্য পাবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের জাদুকরি রান্নার আস্বাদনও নিতে চায়।

তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় সল্টলেকের বাড়িতে হাজির হয় সার্জন। মুশকান প্রথমেই ডিপি মল্লিকের কাছে জানতে চায়, এখানে আসার কথাটা সে গােপন রেখেছে কিনা। মল্লিক তাকে আশ্বস্ত করে, এ কথা কেউই জানে না। আলাপচারিতা শুরুর এক পর্যায়ে ডিপি মল্লিক জানায়, কয়েক বছর আগে মুশকানকে সে স্বল্প সময়ের জন্য দেখেছিল তার রেস্টুরেন্টে, ডাক্তার আসকার তাকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন তখন। সেই থেকেই নাকি তার প্রতি তীব্র কৌতূহল আর আকর্ষণ বােধ করছিল। মুশকান স্মিত হেসেছিল কেবল। সত্যি বলতে, ডাক্তারের সঙ্গে তার পরিচয়পর্বের কথা মনে নেই। রবীন্দ্রনাথে প্রায়শই এরকম গেস্ট আসত, সবার কথা মনে রাখা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে সার্জনকে খাবারের টেবিলে আমন্ত্রণ জানায় সে, তার জাদুকরি রান্নার স্বাদ গ্রহণ করে ডিপি মল্লিক। কিন্তু খাবারের চেয়েও তার কাছে লােভনীয় ছিল মুশকানের সান্নিধ্য! ডিনার শেষে রেড ওয়াইনের বােতলের ছিপি খােলে মুশকান। লালচে মদের মাদকতায় আচ্ছন্ন ডিপি মল্লিকের লালসা প্রকট হয়। অস্থির হয়ে মুশকানকে জাপটে ধরে ফেলে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলে-এভাবেনা।রুচিশীল মানুষের মতাে যেন আচরণ করে। ধীরে ধীরে, মার্জিতভাবে!

ডিপি মল্লিক নিজের এমন ছেলেমানুষি আচরণের জন্য লজ্জিত বােধ করে। মুশকান যেভাবে চায় সেভাবেই হবে- ধীরে ধীরে! কিন্তু রাত গাঢ় হবার আগেই সার্জন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক সময় পুরােপুরি নিথর।  রেড ওয়াইনে কোনাে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশায়নি মুশকান। বাড়ির ছাদে যে ওষধি বাগানটা আছে, সেখানে একটি টবে প্রাণঘাতী বিষাক্ত অরিয়েন্ডার ছিল, সেটার ফুল খুবই – বিষধর, মল্লিকের গ্লাসে সেই ফুলের রস মিশিয়ে রেখেছিল। ধীরে ধীরে ওটা সমস্ত শরীর
অবশ করে দেয়। মল্লিকের ফোনটা চেক করে দেখে সে। তার ফেসবুকে ঢােকাটা যে এত সহজ হবে কল্পনাও করতে পারেনি সার্জন ফেসবুক থেকে লগ অফ করার ধার ধারত না। মল্লিকের আইডিটা ডিলিট করে দেয়, নষ্ট করে ফেলে ফোন আর সিমটা। পালস চেক করে দেখে সার্জন তখনও বেঁচে আছে। নিস্তেজ মল্লিকের ঘাড়টা মটকে দিতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।

ডিপিমল্লিককে অপচয় করার মতাে বােকামি করেনি সে।সার্জনের বয়স, সুস্বাস্থ্য, সব কিছুই তার শিকার হবার জন্য উপযুক্ত ছিল। তাই প্রয়ােজনীয় প্রত্যঙ্গটি রেখে মৃতদেহ টুকরাে টুকরাে করে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে রেখে দেয়। আগের দিনই এরকম একটি খালি কেমিক্যালের ড্রাম আর কয়েক কেজি চুন কিনে এনেছিল দারােয়ানকে দিয়ে, বলেছিল ছাদের বাগানে পানি সংরক্ষণ করবে, চুনগুলাে ব্যবহার করবে সার হিসেবে।

চুন আর পানি মিশিয়ে ডিপি মল্লিকের দেহের খণ্ডিত অংশগুলাে ড্রামে রেখে দেয়। তিন তলার অ্যাটাচড বাথরুমে সেই ড্রামটি এক মাসের মতাে রাখা ছিল। সে জানত, মাসখানেক পর ড্রাম খুললে দেখতে পাবে চুনের সঙ্গে গলেটলে সব একাকার হয়ে গেছে ঘন তরল ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আর ঠিক সেটাই হয়েছিল। মুশকান সেই ঘন আর ভারী তরল বাথরুমের কমােডে ঢেলে ফ্ল্যাশ করে দেয়, পৃথিবীর বুক থেকে উধাও হয়ে যায় দয়ালপ্রসাদ মল্লিক!

বাড়ির দারােয়ান যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেজন্যে সামান্য একটু চালাকি করেছিল মুশকান। সার্জনকে ঘায়েল করার পর রাতের এক পর্যায়ে দারােয়ানকে দরকারি একটা জিনিস কিনতে পাঠিয়ে দেয় সে। লােকটা ফিরে এলে জানায়, গেস্ট চলে গেছে, সে যেন মেইনগেটটা তালা মেরে বন্ধ করে দেয় আজকের মতাে।ডিপি মল্লিকের অন্তর্ধানের খবরটি পত্রপত্রিকায় এসেছিল, তারপর সংবাদপত্র জগতের নিয়ম মেনে ওটা খুব দ্রুতই উধাও হয়ে যায় অন্য কোনাে খবরের ভিড়ে।মল্লিকের অন্তর্ধানের প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পর ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যখন কলকাতায় এলেন মুশকান তাকে সব খুলে বলেছিল। সব শুনে নিজেকেই দায়ী মনে করেন ডাক্তার—অনেক বছর আগে, মল্লিককে যে রবীন্দ্রনাথে নিয়ে গেছিলেন এটা তার মনেই ছিল না। মুশকান অবশ্য তাকে প্রবােধ দিয়ে বলেছিল, এখানে তার কোনাে দোষ নেই। অনেক দিন আগের কথা, মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু এরপর দিন বিকেলেই, একেবারে বিনা নােটিশে সুদূর লন্ডন থেকে চলে আসে তার একমাত্র সন্তান সুস্মিতা।শান্তি নিকেতনে পড়াশােনার পাট না চুকিয়েই লন্ডনে চলে গেছিল সে। অস্থিরচিত্তের এই মেয়ে বুঝতে পারছিল না কোথায় সেটেল করবে। এ নিয়ে ডাক্তারও খুব চিন্তায় ছিলেন। মেয়েকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার এক বন্ধুর মেয়েকে কিছু দিন সল্টলেকের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমেরিকান প্রবাসী এই মেয়ে রবীন্দ্রনাথের ওপরে গবেষণার কাজে কয়েকটা মাস কলকাতায় থাকবে।  সুস্মিতা জানত না তার বাবাও এখন কলকাতায় আছে। বাড়িতে এসে দারােয়ানের কাছ থেকে এটা জানতে পেরে খুবই অবাক হয়েছিল সে। কিন্তু তার বিস্ময় দ্রুত বদলে যায় সন্দেহে, যখন বাবাকে ঘরে দেখতে পায় না। অন্য কিছু সন্দেহ করে সে। কৌতূহল থেকে দোতলায় উঠে যায় চুপিসারে। তার বাপাই আর ওই মহিলা গেস্টের কথা শুনে থমকে যায়। ডাক্তার কিংবা মুশকান কেউই অতটা সতর্ক ছিল না, ফলে তাদের বেশির ভাগ কথাই শুনে ফেলে সুস্মিতা। সব শুনে বিস্ময়ে থ-বনে যায় সে। বাপাই আর ওই গেস্ট টের পাবার আগেই নিজের ঘরে ফিরে আসে দ্রুত।বলা বাহুল্য, তাকে দেখে ডাক্তার ভূত দেখার মতােই চমকে উঠেছিলেন। মেয়েকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, জরুরি একটা কাজে কলকাতায় এসেছেন কয়েক দিনের জন্যে।সুস্মিতাও জানায়, হুট করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শান্তিনিকেতনের কোর্সটা শেষ করবে এবার।ডাক্তার আর এ নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু সন্দেহ তৈরি হয়ে গেছিল সুস্মিতার মধ্যে।

তার বাপাই বলেছিল, ওই গেস্টের নাম তামান্না রহমান, কিন্তু আসকার তাকে মুশকান বলে সম্বােধন করছিলেন। একজন প্লাস্টিক সার্জনকে নিয়েও কথা বলছিল তারা। সবটা শুনতে না পেলেও, যেটুকু বুঝেছে, ওই লােক মুশকান নামের মহিলাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছিল।  বাপাই কেন মহিলার নামটা মিথ্যে বলেছে? আর কীসের জন্য তাকে ব্ল্যাকমেল করেছে ওই সার্জন?-সবটা তার কাছে পরিষ্কার ছিল না, সে-কারণেই মুশকানের ব্যাপারে প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে ওঠে সুস্মিতা। আর একটা ব্যাপার তার মনে খটকার সৃষ্টি করেঃ তার মায়ের বহু পুরােনাে ছবির অ্যালবামে মুশকানের মতাে একজনকে সে দেখেছে অনেক দিন আগে! মায়ের মৃত্যুর পর স্মৃতি সংরক্ষণের সমস্ত প্রিন্টেড ছবিগুলাের ডিজিটালাইজ করে ফেলেছিল লন্ডনে থাকতেই, সেগুলাে ফোটো অ্যালবাম বানিয়ে স্টোর করে রেখেছিল তার ল্যাপটপে।

ওইদিনই ফোটো অ্যালবামটি ঘাঁটতে শুরু করে দেয় সে। অনেক ছবি, অনেক স্মৃতি। কিছুক্ষণ পরই সুস্মিতা আবিষ্কার করে, তার বাবা-মায়ের দু-জনেরই কমনফ্রেন্ড হল এই মুশকান! মুশকান সােহেলি! বেশ কয়েকটি ছবির পেছনে তার মা নিজেদের নামের সঙ্গে ওই নামটাও লিখে রেখেছিল। কিন্তু সেই ছবিগুলাে সুস্মিতার জন্মেরও আগে, প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের পুরােনাে! এতগুলাে বছরে মহিলার মধ্যে কোনাে পরিবর্তনই হয়নি!

সুস্মিতা জানে না কতক্ষণ সে হতভম্ব হয়ে বসেছিল। এটা কী করে সম্ভব! কীভাবে ওই মহিলা এতগুলাে বছরেও একই রকম আছে? আড়াল থেকে শােনা তার বাপাই আর মুশকানের কথাবার্তার অনেক কিছুই বােধগম্য ছিলনা, ছবির অ্যালবাম দেখার পর সেগুলাে আরও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সুস্মিতার মনে পড়ে যায়, এক পর্যায়ে রহস্যময়ী ওই মহিলা তার বাবাকে বলেছিল, পরশু ডিনারের আয়ােজন করবে। কথাটা শুনে তার বাপাইর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারচেয়েও বড়ো কথা, মহিলার বলা ‘ডিনার’ শব্দটির উল্লেখও কেমন ইঙ্গিতেপূর্ণ ছিল!  এরপরই সুস্মিতা চালাকি করে বাবাকে বলে, আগামীকাল মুকুন্দপুরে এক বন্ধুর বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ আছে, ফিরতে একটু রাত হবে। কথাটা শুনে তার বাপাই খুশিই হয়েছিল বলেই তার ধারণা। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেও রাত সাড়ে আটটার আগেই ফিরে আসে। বাপাইকে ঘরে দেখতে না পেয়ে চুপিসারে উঠে যায় তিন তলায়।

তাদের বাড়ির তিন তলার কেবলমাত্র একটি অংশে বড়ো একটা ঘর তুলেছিল তার পারমিতা মাসি। সিঁড়ির ডান পাশে, ছাদের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ওষুধি গাছের বাগানও করেছিল। মাসি মারা যাবার পর থেকে সেটার আর যত্ন নেওয়া হয়নি। তবে সে দেখতে পায়, মুশকান তাদের বাড়িতে ওঠার পর বেশ যত্ন নিয়েছে বাগানটার।

বাগানের উত্তরে, সিঁড়ি ঘরের পেছন দিকে সরু একটা প্যাসেজ চলে গেছে, ওটা থেমেছে ছাদের পুবদিকে একমাত্র ঘরটির পশ্চিম দিকের দেয়ালে গিয়ে। দেয়ালের একেবারে ওপরে ছােট্ট একটি ভেন্টিলেটর আছে, বাগানে থাকা একটা চেয়ার করেও পাঁচ ফিট চার ইঞ্চির সুস্মিতার পক্ষে সেই ভেন্টিলেটরে চোখ রাখা সহজ দ্রুত নীচতলায় চলে যায় সে, চেয়ারের মতাে কিছু না পেয়ে আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্র চোখে পড়ে তার। গানবাজনার প্রয়ােজনে শখ করে কিনেছিল ওটা। চেয়ারের ওপর কাহনটা রেখে তার ওপরে দাঁড়ানাের পর ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরের দেখতে পায় সুস্মিতা।

তার বাপাই আর মুশকান সােহেলি নামের ওই মহিলা ডিনার করছে। তাদের মধ্যে খুব কমই কথা হচ্ছিল তখন। ডিনারের শেষে মুশকান বিশেষ একটি বাটি হাতে নিয়ে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকায় আসকার ইবনে সায়িদের দিকে। সুস্মিতা দেখতে পায়, তার বাপাইর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাটির খাবারটা যে মাংসজাতীয় কিছু সেটা বুঝতে পেরেছিল দূর থেকেও। সেই রান্না করা মাংসের অনেকটুকু অংশ তার বাপাই-এর পাতে তুলে দেয় মহিলা, তারপর রেড ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে চিয়ার্স করে।

এ সময় সুস্মিতাকে অবাক করে দিয়ে তার বাপাই বলে ওঠেঃ “সার্জনেরটা?” মুশকান শুধু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

সার্জনেরটা মানে? এ প্রশ্ন যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই তার বাবার আরও কিছু কথা তাকে আগ্রহী করে তােলে।

“তাহলে তােমার সার্জারির ব্যাপারটা কী করবে?”

“সেটা কী এখানে করা সম্ভব?” ডাক্তার আসকার একটু ভেবে নেন।“সাউথ কোরিয়াতে খুব সহজেই করা যাবে। ওখানে এসব কাজ প্রচুর হয়….ভালাে সার্জনও আছে অনেক।”

“এখান থেকে কীভাবে যাব? আমার পাসপাের্ট দিয়ে তাে এখানে আসিনি। দেশে গিয়ে ওটা ইউজ করাও যাবে না  খুবই রিস্কি।”

“এখানকার পাসপাের্ট করা যাবে, কিন্তু সময় লাগবে একটু। ততদিন না-হয় অপেক্ষা করাে?”

কিছুক্ষণ চুপচাপ দু-জনেই খেয়ে যায় ওই রহস্যময় খাবারটি।

“সার্জনেরটা দিয়ে কতদিন চলবে?” খাবারের বাটিটার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন ডাক্তার।

ঠোট ওলটায় মুশকান। “দু-জনের জন্য দুবারের বেশি হবে না।” কথাটা শুনে ডাক্তারের চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। “তাহলে এর পর কী করবে? মুশকান কোনাে জবাব না দিয়ে মুখে খাবার নিয়ে ভেবে যায় কিছুক্ষণ।“চিন্তা কোরাে না….একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু এখানে আর কিছু করা ঠিক হবে না। শহর এলাকা  বুঝতেই পারছাে।”

“হুম।” খেতে খেতে বলেন ডাক্তার। “সার্জনেরটা ঘটনাচক্রে পেয়ে গেছি, নইলে এখানে কিছু করার কথা ভাবিনি।”

মাথা নেড়ে সায় দেন আসকার।“তােমার পাসপাের্টটা করা লাগবে দ্রুত।আমি একজনের সঙ্গে কথা বলেছি, ও বলেছে করে দিতে পারবে।”

প্রসঙ্গ পালটায় মুশকান।“আচ্ছা, তােমার মেয়ে হুট করে চলে এল কেন?কিছু হয়েছে নাকি?”  ঠোঁট ওলটান আসকার। “ও তাে কিছু বলেনি।” একটু থেমে আবার বলেন, “ও ওর মায়ের মতােই একটু খেয়ালি স্বভাবের হয়েছে। যখন যা ইচ্ছে তা-ই করে।”

“আমাদেরকে নিয়ে সন্দেহ করছে না তাে?”

অবাক হন ডাক্তার। “কীসের সন্দেহ করবে? আমি সত্তরাের্ধ এক বৃদ্ধ, আর তুমি আমার মেয়ের বয়সি,”বলেই হেসে ফেলেন।“ও জানে তুমি আমার বন্ধুর মেয়ে, সন্দেহ করার প্রশ্নই ওঠে না।”

“তুমি ধরেই নিয়েছ, তুমি যা বলেছও সেটা বিশ্বাস করে নেবে?” “নিতে হবে, কারণ তােমার সঙ্গে আমার ওরকম কোনাে সম্পর্ক নেই।” “কিন্তু ও সেটা না-ও বুঝতে পারে?”

“ওর কথা বাদ দাও।ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। দেখবে, কিছুদিন পরই লন্ডনে ফিরে গেছে। ও খুব অস্থির  দ্রুত বােরিং হয়ে যায়।”  মুশকান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানতে চায়, “আচ্ছা, তুমি তাে প্রায় পাঁচ বছর ধরে খাচ্ছাে, কোনাে পরিবর্তন লক্ষ করছ কি?”

“না,”কথাটা বলেই মুচকি হাসি দেন ডাক্তার।“কোনাে পরিবর্তনই লক্ষ করছি না!” মুশকানও হেসে ফেলে। “তাহলে তাে তােমার বেলায়ও কাজ করতে শুরু করেছে!”

রেডওয়াইনের গ্লাসটা তুলে নেন ডাক্তার। “থ্যাঙ্কস ইউ, ফ্রেন্ড।” একটু থেমে তার বাপাই আবার বলে, “আমার নার্ভও আগের চেয়ে স্ট্রং হয়েছে।”

আশ্বস্ত করার হাসি দিয়েছিল মুশকান।

বাবা আর ওই রহস্যময়ী নারীর কথাবার্তা শুনে সুস্মিতার পাদুটো টলে গেছিল, আর একটুর জন্যে চেয়ারের ওপরে রাখা কাহন থেকে পড়েই যেত সে।  ওদের আরও কিছু কথাবার্তা থেকে যা বুঝতে পারে-ওই মহিলা একজন সার্জনকে কিছু করেছে, আর সেটা তাকে ব্ল্যাকমে
ইল করার শাস্তি হিসেবে। কিন্তু লােকটাকে কী করেছে না জানলেও,এটা বুঝতে বাকি নেই, সে আর এই জগতে বিচরণ করছে না! তার চেয়েও বড় কথা, অজ্ঞাত একটি রেসিপি খেয়ে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে, মহিলা আসলে তার বাবার বয়সি প্রায় ! আর তার বাপাইও পাঁচ বছর ধরে এই রেসিপিটা খাচ্ছে। কিন্তু বয়স ধরে রাখার এই গােপন কৌশলটা কী সেটা আন্দাজ করতে গিয়ে সুস্মিতা ধন্দে পড়ে যায়। ওদের কিছু কথা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায় ;

সার্জনেরটা? সার্জনেরটা দিয়ে কতদিন চলবে?

গা শিউরে ওঠে তার। দুর্নিবার কৌতূহলে আক্রান্ত হয় সে। সত্তর বছরের এক নারী। অথচ দেখলে মনে হবে প্রায় তার বয়সি কেউ!

কয়েক দিন পর তার বাপাই আবার কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে যান। এর পর সুস্মিতা অন্য একটি কৌশল বেছে নেয় :মুশকানের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বাড়াতে শুরু করে সে। দেখতে তারা প্রায় সমবয়সি, একই বাড়িতে থাকে। সুতরাং ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি। একসঙ্গে তারা কলকাতা এবং এর আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। তাদের অখণ্ড অবসরে কেনাকাটা, বাজার করা, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, এসব হয়ে ওঠে নিয়মিত কাজ।বাড়িতে সুস্মিতার বন্ধুদের আড্ডা বসলে সেখানে মুশকানও যােগ দিতে শুরু করে। সুস্মিতা তাকে তার কাজিন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় বন্ধুদের কাছে।

বেশ ভালাে গান করে সুস্মিতা, কিছু বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারে। তার ঘরে সেতার, হারমােনিয়ামসহ কিছু ইন্সট্রুমেন্ট আছে। সে অবাক হয়ে দেখে, তার মতােই রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভক্ত মুশকান, আর গানও গায় চমৎকার। ডিনারের পর তারা দুজন একের পর এক গান করে সময় কাটিয়ে দিত। খুব দ্রুতই মুশকানের মধ্য আর একটি গুণ আবিষ্কার করে সুস্মিতা তার হাতের রান্না অসাধারণ!  সুস্মিতা দীর্ঘদিন লন্ডনে থেকেছে, ইউরােপ-আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে গেছে, নানারকম খাবারের সঙ্গে সেপরিচিত, ভারতীয় খাবারও কম চেখে দেখেনি, কিন্তু মুশকানের হাতে এক একটি পদ যেন অমৃত। তাদের বাসায় এক মহিলা কুক এসে রান্না করে দিয়ে যেত, কিন্তু সেসব খাবার খুব একটা ভালাে লাগত না সুস্মিতার। মুশকানের জাদুকরি হাতের রান্নার স্বাদ পাবার পর থেকে তার খাওয়ার রুচি বেড়ে যায়।

একদিন কী একটা কাজে মুশকান বাইরে গেলে সুস্মিতা হানা দেয় তিন তলায়। আগেই মুশকানের ঘরের চাবির ছাপ নিয়ে রেখেছিল সাবানের টুকরাের ওপরে, সেটা থেকে নকল একটা চাবিও বানিয়ে নিয়েছিল। ওই চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করে সে, কিন্তু রহস্যময় সেই খাবারটি আর পায় না। অবশেষে বইয়ের সেলফের দিকে নজর যায় তার।মুশকানের ঘরে প্রচুর বইপুস্তক। বুকসেলফের প্রতিটি বইসরিয়ে সরিয়ে দেখেসুস্মিতা। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসমগ্রের পেছনে দেখতে পায় সেই বয়ামটি তার বাপাইকে যেখান থেকে রহস্যময় খাবার তুলে দিয়েছিল মুশকান। বয়ামটা খুলে দেখে, অনেকটা আচারের মতাে সামান্য কিছু বস্তু আছে তখনও, তবে সে জানত, ওগুলাে আচার নয়। খাবারটা দেখে তার মধ্যে এক ধরণের ভীতি জেগে ওঠার কথা, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল যৌবন দীর্ঘায়িত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে সেই ভীতি পরাভূত হয়। ওই রহস্যময় বস্তুটার এক টুকরাে মুখে দিতেই বুঝতে পারে, মুশকানের জাদুকরি হাতের · ছোঁয়া এখানেও বজায় রয়েছে।

এটা কীসের মাংস? সার্জনের! ভাবনাটা আসতেই তার গা শিউরে ওঠে। নাকি অন্য কিছু? তড়িঘড়ি বয়ামটার মুখ লাগিয়ে জায়গামতাে রেখে দেয় সে। যদিও তার লোভ জেগেছিল আর একটু চেখে দেখার, কিন্তু নিজেকে বিরত রাখে বহু কষ্টে, নইলে মুশকান টের পেয়ে যাবে।

এক বিকেলে অটো থেকে নেমে বাসায় ঢােকার সময় সুস্মিতাকে তার নাম ধরে কেউ ডেকে ওঠে। অবাক হয়ে দেখে, তার শান্তিনিকেতনের এক বন্ধুর বন্ধু সুকুমাররঞ্জনকে। বেশ কবছর আগে তাদের বন্ধুদের সার্কেলটি যখন দলবেঁধে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিল তখন এই ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হয়। সুকুমার জানায়, সে কয়েক দিন আগে কলকাতার এক ডেটা অ্যানালিসিস ফার্মে জয়েন করেছে। কী একটা কাজে এসেছিল সল্টলেকে। সৌজন্যতার খাতিরে সুস্মিতা তাকে সমাদ্দার ভিলায় নিয়ে এসে কফি দিয়ে আপ্যায়ন করে। এই ঘটনার পর ছুটির দিনে প্রায়ই সুকুমার আসতে শুরু করে তাদের বাড়িতে।

সুস্মিতার সঙ্গে তার বন্ধুত্বটাও গাঢ় হতে শুরু করে।

এমনই এক রবিবার সন্ধ্যায় সুকুমার আসে সমাদ্দার ভিলায়। সুস্মিতার যে ভালাে হুইস্কির প্রতি আসক্তি ছিল সুকুমার সেটা জানত, তাই সঙ্গে করে প্রিয় ব্র্যান্ডের হুইস্কি নিয়ে এসেছিল সে। ওই দিন কী একটা কাজে বাড়ির বাইরে গেছিল মুশকান। বাড়িতে দারােয়ান ছাড়া আর কেউ ছিল না। দোতলার বিশাল ড্রইংরুমে বসে সুস্মিতা আর সুকুমার হুইস্কি পান করতে শুরু করে। মদ্যপানের এক পর্যায়ে সুকুমার আবেগাক্রান্ত হয়ে জানায়, সুস্মিতার প্রেমে পড়ে গেছে সে।  সুকুমাররঞ্জন দেখতে স্মার্ট আর শিক্ষিত একটি ছেলে, যথেষ্ট ভালাে চাকরি করে সুস্মিতাও বেশ পছন্দ করে তাকে, কিন্তু তারপরও সুকুমারকে ফিরিয়ে দেয় সে। ছােটোবেলা থেকেই টমবয়, ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেল-বাইক চালাত। মাউন্টেনিং করা, মার্শাল আর্ট শেখা, খেলাধূলা, সবই করেছে। তার ছেলেবন্ধুদের কেউ যে তার দিকে অন্যদৃষ্টিতে তাকায়নি তা নয়, তবে সুস্মিতা এ ধরণের ব্যাপারগুলাে পাত্তাই দিত না
কখনও।

প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুকুমার হতাশ হয়ে জানতে চায়, সে কোন দিক থেকে তার অযােগ্য?অনেক চাপাচাপির পর সুস্মিতা অবশেষে নিজের সেই গােপন কথাটা জানায়, যা আর কাউকে এর আগে কখনও বলেনি।

আমি সম্ভবত লেসবিয়ান। কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে সুকুমার।

পনেরাে-ষােলাে বছর বয়স থেকেই সুস্মিতা টের পেয়েছিল, ছেলেদের প্রতি উঠতি বয়সি মেয়েদের যে স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে সেটা তার মধ্যে নেই। কিন্তু সময় গড়ালে বুঝতে শুরু করে, কিছু কিছু মেয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বােধ করছে! তবে নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন নিয়ে পুরােপুরি নিশ্চিতও ছিল না।

একথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে নেয় সুকুমার। “তুমি তাহলে পুরােপুরি শিয়াের নও?”

এমন প্রশ্নে দ্বিধায় পড়ে গেলেও মাথা নেড়ে সায় দেয় সুস্মিতা, আর তখনই সুকুমার অদ্ভুত একটি প্রস্তাব দেয় তাকে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ ফোরপ্লে করবে, সুস্মিতা যদি জেগে ওঠে তাহলে ধরে নেবে সে আসলেই লেসবিয়ান। আর জেগে উঠলে বুঝবে, ওটা আসলে দীর্ঘদিন টমবয়গিরি করার ফলে সৃষ্ট এক ধরণের আচরণগত সমস্যা-সমকামীতা নয় মােটেও।

সুস্মিতা ধন্দে পড়ে যায়, হুইস্কির প্রভাবে তখন কিছুটা বেসামালও, তার এই  সিদ্ধান্তহীনতার সুযােগ নিয়ে তাকে আদর করতে শুরু করে সুকুমার, ধীরে ধীরে খুলে ফেলে শরীর থেকে সব পােশাক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সুস্মিতা বুঝতে পারে, সুকুমারের এমন স্পর্শেও তার শরীর সাড়া দিচ্ছে না। কেমন গা ঘিনঘিন করা অনুভূতি তৈরি হচ্ছে বরং! সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বসে সে।

“না, সুকুমার  না! থামাে!”  আকুতিভরা কণ্ঠে
বলেছিল সে, কিন্তু মাঝপথে এভাবে বাধা পেয়ে ক্ষেপে যায় সুকুমার, জোরাজুরি করতে শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে সুস্মিতা চিৎকার দিতে চাইলে তার মুখ চেপে ধরে। একটু আগের বন্ধু মুহূর্তে ধর্ষকে পরিণত হয়! কিন্তু সুস্মিতার চিৎকার নীচের গেটের কাছে থাকা দারােয়ানের কানে পৌছােয় না।

ড্রইংরুমে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঝেমধ্যেই গানবাজনা করত সুস্মিতা, আশেপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের কাছে এটা উৎপাত মনে হতে পারে বলে ওর এক মিউজিশিয়ান বন্ধু ঘরটা পুরােপুরি সাউন্ডপ্রুফ করে দিয়েছিল কিছু দিন আগে। সুতরাং, সে বুঝতে পারে, তার চিৎকার কিংবা ধস্তাধস্তির আওয়াজ নীচে যাচ্ছেনা, দারােয়ানের কানে সেটা পৌছােবেও না, তখন প্রবলভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু শক্তিতে পেরে ওঠে না। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই মার্শালআর্টের দক্ষতা প্রয়ােগ করে সুকুমারের কুঁচকিতে হাঁটু দিয়ে আঘাত করে বসে। তীব্র ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে ছেলেটা, রেগেমেগে সুস্মিতার গালে চড়থাপ্পড় মারতে শুরু করে দেয়, সেই সঙ্গে উগলে দেয় জঘন্য সব খিস্তি। পাশবিক শক্তি নিয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।  অনেক চেষ্টা করেও সুকুমারকে পরাস্ত করতে পারেনি সুস্মিতা, তীব্র
ভীতিতে আক্রান্ত হয় সে। শৈশব থেকে যে আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি মেয়ে বেড়ে ওঠে। সেই ধর্ষণ যখন অনিবার্য, তখনই দেখতে পায় হাতের কাছে হুইস্কির বােতলটা পড়ে আছে। সুকুমার তখন এক হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে রেখেছে, অন্য হাত দিয়ে নিজের উদ্যত অঙ্গটি প্রবেশ করাতে ব্যস্ত। আর কোনাে উপায় না পেয়ে, হুইস্কির বােতলটা হাতে তুলে নেয়, সুকুমারের মাথার পেছনে সজোরে আঘাত করে বসে। পর পর বেশ কয়েকটি।কতগুলো, সে নিজেও জানে না।

কিছুক্ষণ পরই টের পায়, উপগত হওয়া সুকুমার নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। প্রায় অসাড়, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে, ছেলেটা একদমই নড়ছে না তখন ভড়কে যায়। মুশকান যে একজন মেডিকেল ডাক্তার এত দিনে সেটা জেনে গেছিল। সম্ভবত এতক্ষণে বাড়িতে ফিরেও এসেছে। ব্রা আর প্যান্টি পরা অবস্থায়ই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে তিন তলায় চলে যায় সে। দেখতে পায় মুশকান সবেমাত্র ঘরে ফিরে এসে ফ্রিজ খুলে সবজি আর ফলমূল রাখছে। সুস্মিতাকে এরকম অবস্থায় দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয় সে। সুস্মিতা হরবর করে তাকে জানায় কী হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে দোতলায় নেমে আসে মুশকান। সুকুমারের পালস্ চেক করে দেখে সে, কিন্তু ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ছেলেটি।

মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে শুরু করে মুশকান। পুলিশকে খবর দিলে, তারা জেনে গেলে কী হতে পারে সেটা তার চেয়ে ভালাে আর কেউ জানত না। সুস্মিতা যদি সব কিছু স্বীকারও করে, আইনের কাছে নিজেকে পুরােপুরি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ আত্মরক্ষার জন্যে কাউকে আঘাত করা যেতে পারে, রাগের মাথায় হুট করে মেরে বসাও স্বাভাবিক, কিন্তু সুকুমারের মাথা যেভাবে থেতলে গেছে, সেটা স্পষ্ট বলে দেবে-সুস্মিতা কেবল আত্মরক্ষার জন্যে আঘাত করেনি! তার উদ্দেশ্য ছিল হত্যা করা! যদিও ভালাে একজন আইনজীবি নিয়োগ দিলে সে হয়তাে যুক্তিতর্ক দিয়ে আদালতকে বােঝাতে পারবে, ওরকম মুহূর্তে মারাত্মক ‘প্যানিক’ হয়ে সাময়িক হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল মেয়েটি। আদতে যে সেরকমই কিছু হয়েছিল, তাতে অবশ্য মুশকানের কোনাে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু পুলিশের কাছে সব খুলে বললেও মেয়েটি মামলা-মােকদ্দমার হয়রানি থেকে বাঁচতে পারবে না। সামাজিকভাবে খুনি হিসেবে তকমা পাওয়া থেকেও রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠবে। তার চেয়েও বড়ো কথা, সুস্মিতার কাছ থেকে যখন জানতে পারে, সুকুমারের বাবা একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তখন মুশকান বুঝে যায় আইনের মারপ্যাচে ফেলে, অপব্যবহার করে মেয়েটার জীবন বিষিয়ে তুলবে ওই লােক। নিজের সন্তান যে ধর্ষক না সেটা প্রমাণ করার জন্য যা করার তাই করবে।

এদিকে বাড়িতে তার উপস্থিতিও একটা সমস্যা। পুলিশ তার ব্যাপারেও জানতে চাইবে, খোঁজ নেবে। আর সেরকম কিছুকী হতে পারে, ভালাে করেই জানতমুশকান। সে যে অবৈধভাবে কলকাতায় এসেছে, মিথ্যে পরিচয় নিয়ে বাস করছে, এসব জেনে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এরকম ঝুঁকি সে-ও নিতে পারে না।

সুস্মিতার বাবা আসকারের সঙ্গে আর যােগাযােগ করেনি মুশকান। ভালাে করেই জানত – দূর থেকে বেচারা না পারবে কোনাে বুদ্ধি দিতে, না পারবে কোনাে সাহায্য করতে। তাই মুশকান সিদ্ধান্ত নেয়, বন্ধুর মেয়েকে বাঁচাতে হবে। যে বন্ধু তাকে বিপদে আপদে বারবার রক্ষা করেছে, সাহায্য করেছে, তার মেয়েকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতেই হবে।

সুস্মিতাকে আশ্বস্ত করে সে চিন্তার কিছু নেই। সব কিছু সামলে নেবে সে। এরপর সুকুমারের নিথর দেহটা দু-জনে মিলে ধরাধরি করে তিনতলায় নিয়ে যায়। ডিপি মল্লিককে যেভাবে উধাও করেছিল ঠিক একই কায়দায় সুকুমারকেও উধাও করে মুশকান।

এই ঘটনার কয়েক দিন পর, এক বিকেলে কী একটা দরকারে বাইরে গেছিল মুশকান, কিন্তু অনেকটা পথ যাবার পর বুঝতে পারে টাকা রাখার পার্সটা ফেলে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফিরে আসে সে। আর তখনই একটি দৃশ্য দেখে ভয়ংকরভাবে কেঁপে ওঠে:তার ঘরে বইয়ের শেলফের পেছনে লুকিয়ে রাখা সেই বয়ামটার মুখ খুলছে সুস্মিতা!

হাতেনাতে ধরা পড়ার পর মেয়েটা ঘাবড়ে না গিয়ে বরং মুশকানকেই ভড়কে দেয়। “আমিও তােমার মতাে হতে চাই!” কয়েক মুহূর্তের জন্য মুশকান কথাটার মানে বুঝতে পারেনি। “দীর্ঘ যৌবন পেতে চাই।”ভ্রু কুঁচকে যায় তার। বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে। “আমি তােমার সব কথা জানি!”

তারপরই সুস্মিতা তাকে অভয় দিয়ে বলতে শুরু করে-একেবারে আন্দিজের ঘটনা থেকে শুরু করে সার্জনকে গুম করা, তার বাপাই-এর সঙ্গে রহস্যময় খাবার খাওয়া, তাদের অদ্ভুত সেই কথােপকথন, সর্বোপরি দীর্ঘ দিন ধরে মুশকান যে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে—সব। থ বনে যায় মুশকান। সুস্মিতার জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে হয়তাে ডিপি মল্লিকের মতােই কিছু করত, কিন্তু এই মেয়ে তার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র সন্তান!

পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিল হয়তাে তার ঠোটে। সুস্মিতার মা শুভমিতা ছিল তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু এক সময় সতর্কতার কারণেই নিজেকে সেই বন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল সে, চলে গেছিল ইউরােপের অন্য একটি দেশে, সেখান থেকে নিজ দেশে। কোনাে রকম যােগাযােগ রাখেনি সে। আসকার তার স্ত্রীকে বলেছিল, মুশকান কোনাে এক বিদেশিকে বিয়ে করে কোথায় চলে গেছে সে নিজেও জানে না। মুশকান যদি এভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে না নিত তাহলে শুভমিতাও টের পেয়ে যেত তার বয়স বাড়ছে না! নিয়তির নির্মম পরিহাস, এখন সেই শুভমিতার মেয়েই কিনা জেনে গেল সেটা!  কয়েকমুহূর্তের জন্য ভীষণ অসহায় বােধ করে সে।বুঝতে পারে, এখন সুস্মিতাকে
না পারবে ভুলভাল ব্যাখ্যা দিতে, না পারবে তার মুখ বন্ধ রাখতে-তার কাছে কেবল একটাই পথ খােলা আছেঃ মেয়েটাকে নিজেদের দলে নিয়ে নেওয়া। এতদিন যে দলটির সদস্য ছিল মাত্র দু-জন : সে আর আসকার।

যাই হােক, সব কিছু সামাল দেবার পরই ডাক্তারকে মুশকান জানিয়েছিল, নির্জন বাড়িতে একা পেয়ে সুস্মিতার এক ছেলেবন্ধু তাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করলে ঘটনাচক্রে ওই ছেলে মারা যায়। সব শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন ডাক্তার। মুশকান আরও জানায়, সুস্মিতাকে বাঁচানাের জন্য যা করার তা-ই করেছে। এখন এ বাড়ির দারােয়ানকে বদলে ফেলতে হবে আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবে, কারণ সুকুমার যে এ বাসায় এসেছিল সেটা দারােয়ান দেখেছে। মুশকান জানত, পুলিশ খুব শিগগিরই জেনে যাবে সুকুমারের বন্ধু ছিল সুস্মিতা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাড়িতে চলেও আসবে হয়তাে। তখন সুস্মিতা অস্বীকার করে বলবে, ওইদিন সুকুমার এ বাড়িতে আসেনি। কিন্তু এখনকার দারােয়ান থাকলে সমস্যা। পুলিশ তার কাছ থেকে এটা জেনে যাবে। এ ঝুঁকি নেওয়া যায় না।  মুশকানের কথাটা বুঝতে পারেন আসকার। শুভমিতার বড়ােবােন পারমিতা মারা গেলে সমাদ্দার ভিলার দেখাশােনা করতে সুস্মিতার মায়ের দূরসম্পর্কের এক কাজিন, ভদ্রলােক থাকে বারাসাতে। তার মাধ্যমেই
নতুন একজন দারােয়ান নিয়োগ দেন ডাক্তার।

মুশানের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত করে দিয়ে একদিন সমাদ্দারভিলায় হাজির হয় পুলিশ। সুকুমাররঞ্জনের নিখোঁজ কেসে সুস্মিতাকে জেরা করে তদন্তকারী অফিসার। সুস্মিতা জোর দিয়ে বলে, সুকুমারের সঙ্গে ওইদিন তার দেখা হয়নি। সে কেন সল্টলেকে এসেছিল তা-ও জানে না। তারপরও পুলিশ তাকে বলে দেয়, কলকাতার বাইরে গেলে সে যেন লােকাল থানায় অবশ্যই ইনফর্ম করে।  পুলিশ বাড়ি থেকে বের হবার পর তিন তলায় নিজের ঘরের জানালা দিয়ে মুশকান দেখে, তাদের বাড়ির দারােয়ানের সঙ্গে কথা বলার পর আশেপাশের বাড়িগুলাের দারােয়ানদের সঙ্গেও কথা বলছে ওই তদন্তকারী অফিসার। পুলিশ চলে যেতেই মুশকান ওই দারােয়ানকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়, ইন্সপেক্টর কী জানতে চেয়েছিল তার কাছে।  সাদ্দারভিলার আগের দারােয়ানের নাম-ঠিকানা? আর লােকটা সেই তথ্য দিয়েও দিয়ে
ছে !

সতর্ক হয়ে ওঠে মুশকান। সুকুমারের কেসে যে সুস্মিতা ফেঁসে যাবে বুঝতে পারে, আর সেটা হলে প্রকারান্তরে সে নিজেও ফেঁসে যাবে- লাশটা তাে সে-ই গুম করেছে!  আসকারকে ফোন করে সব জানায় সে। ডাক্তার তাদের সাময়িক আশ্রয়ের একটি ঠিকানা দিয়ে দিলে তরিঘড়ি দরকারি সব জিনিসপত্র নিয়ে সুস্মিতা আর সে বাড়ি ছাড়ে
ওই দিনই।

সন্ধ্যার দিকে আবারও বাড়িতে পুলিশ আসে। এবার ওই অফিসারের হাতে শক্ত প্রমাণ আছে-সুস্মিতা পুলিশকে মিথ্যে বলেছে। সুকুমাররঞ্জন নিখোঁজ হবার আগে শেষ যে জায়গায় গেছিল সেটা সল্টলেকের সমাদ্দারভিলা। কিন্তু ততক্ষণে বাড়ির বাসিন্দারা কোথায় চলে গেছে দারােয়ানও জানাতে পারেনি।

এ ঘটনার পর দিনই আসকার ঢাকা থেকে চলে আসেন কলকাতায়, পরিচিত এক লােকের মাধ্যমে। টাকার বিনিময়ে মুশকান আর সুস্মিতাকে বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানাের ব্যবস্থা করেন তিনি।

মুশকান যেহেতু ঢাকা শহরে নিরাপদ নয়, ছফার চোখে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই তাকে অন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়ে, সুস্মিতাকে ঢাকার বনানীর বাড়িতে তােলেন তিনি। এই বাড়িটা আর কারাের নয়, রাশেদ জুবেরির পৈতৃক বাড়ি। রাশেদের মৃত্যুর পর মুশকানের সম্পত্তি হয়ে ওঠে বাড়িটা।ওখানে কিছুদিন থাকার পরই হাপিয়ে ওঠে সুস্মিতা। এরকমই এক সময়ে সুন্দরপুরের নতুন স্কুল পরিদর্শন করতে গেলে মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যান আসকার।তখন ট্রাস্টি রমাকান্ত কামার কথায় কথায় জানান, সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলের জন্য একজন গানের টিচার খুঁজছেন। এ কথা শােনার পর ডাক্তারের মাথায় আসে নিজের মেয়ের কথা। প্রস্তাবটা পেয়ে লুফে নেয় সুস্মিতা। প্রকৃতি তার কাছে সব সময়ই ভালাে লাগে, আর সুন্দরপুর স্কুলটাও তার কাছে ছিল এক টুকরাে শান্তিনিকেতনের মতােই।

Back to top button
error: Content is protected !!