Books
ভাসান বাড়ি Pdf Download
লেখকঃ সায়ক আমান – ভাসান বাড়ি pdf download free link
or
or
আরও পড়ুনঃ
বই: হিয়ার দ্য উইন্ড সিং
I wish they all could be California girlsI wish they all could be CaliforniaI wish they all could be California girls—The Beach Boys
আমি যখন ক্লাস সিক্স অথবা সেভেনে পড়ি, তখন থেকেই কষ্টের কিছু হলেই কলম দিয়ে প্রত্যেকটি লাইন ধরে লিখতাম। নানু যেদিন মারা গেল, বাসার সবাই একপাশের ঘরে কাঁদছিল। আর আমি কলমটা ঘষে লিখছিলাম অনবরত। পৃষ্ঠার কালিগুলো জমাটবদ্ধ নীলাভ হয়ে যেত সাথে ঝরতে থাকা চোখের জলে। অজস্র দুঃখে অনেক কান্নার পরে যেমন অনুভব হত, লেখার পরেও আমার তেমন অনুভব হত। তখন আমার নিজেকে উদ্ভট মনে হত। যন্ত্রণাদায়ক মনে হত। সবাই কাঁদছে, আমিও ঠিক বুক ফাঁটিয়েই তো কাঁদি, তবে অক্ষরে ঝরে পড়ে সেসব বর্ষণ!
আজকে যে বইটি নিয়ে বয়ান করবো তার ভেতরেও এমন সত্ত্বা লুকিয়ে রয়েছে। যেখানে মুল চরিত্র বলে,
“আমার কাছে লেখালিখি ভয়াবহ ধরনের এক যন্ত্রণাদায়ক কাজ। মাঝে মধ্যে কেবল একটা বাক্য লিখতেই পুরো এক মাস সময় পার করে দেই আমি। আবার কখনো কখনো তিন দিন এবং তিন রাত একটানা লেখার পর আমি বুঝতে পারি যে, যা লিখেছি তার সবটাই আসলে ভুল।”
এই গল্পটির শুরু আঠারো দিনের এক উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে। গল্পের প্রোটাগনিস্ট একুশ বছরের নামহীন এক টগবগে যুবক। যার স্বপ্ন লেখক হওয়ার। জীবনে প্রেমের বসন্তে ভেসেছে তিন তিনটিবার। কিন্তু প্রত্যেকবারেই সম্পর্কগুলো স্থায়িত্ব পেতে ব্যর্থ হয়েছে। টোকিওর একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সে। প্রত্যেক সামার ভ্যাকেশনে নিজের বাড়িতে যায়। আমাদের গল্পেরও শুরু সেই সামার ভ্যাকেশনে। ১৯৭০ সালের ৮ আগস্ট থেকে শুরু করে প্রায় আঠারো দিনের গল্প, যার সমাপ্তি ঘটে একই বছরের ২৬ তারিখে। লেখক তার জন্মস্থানের শহরে যায় যেটি মুলত একটা বন্দর শহর। সমুদ্রের তীরে এই বন্দর শহরে রয়েছে তার প্রিয় বন্ধু, র্যাট। ঘটনাক্রমে দুই বন্ধু একি স্বপ্ন দেখে। র্যাটও লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। গোবরে পোকাকে নিয়ে সিরিয়াস ধরনের একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে তার। তার গল্পে দুটো বিষয় অতীত গুরুত্বপূর্ণ বলে সে দাবী করে। প্রথমত, কোনো যৌনতার বিবরণ দেওয়া যাবেনা। আর দ্বিতীয়ত, গল্পে কারো মৃত্যু দেখানো যাবে না। যদিও বাস্তবে লেখার এসবের কিছুই করে না। প্রতিদিনকার কাজের মধ্যে র্যাট জে নামে এক বড় ভাইয়ের বারে বসে বিয়ার খায়; আর পিনবল খেলে।
এদিকে, গল্পের মুল চরিত্র আমাদের লেখকের জীবনে চতুর্থ বারের মত আবারও প্রেমের বসন্ত আসে। এবারের প্রেমটি একদমই অন্যরকম। প্রথম তিনটি প্রেমের মধ্যে প্রথম প্রেমটি সতেরো বয়সে হয়েছিল। হাইস্কুল ক্লাসমেট। গ্রাজুয়েশন শেষ করার কয়েক মাস পরই বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় প্রেমের মেয়েটির সাথে লেখকের দেয়া হয় সাবওয়ের শিনঝুকু স্টেশনে। সেখানেই মেয়েটি থাকত। আধ ময়লা জামা, উস্কখুস্ক চুলে। কোথা থেকে এসেছে মেয়েটি কখনোই বলত না। এভাবেই অজানায় একদিন মিশে যায় স্মৃতি রেখে মেয়েটিও। তৃতীয় প্রেমটি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। লাইব্রেরিতে প্রথম দেখা। পরের বছর বসন্তের শুরুর দিকে টেনিস কোর্টের শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট বনে তাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ফাঁস দেওয়া অবস্থায়! এবার লেখকের জীবনে আবারও বসন্তের আগমন। গভীর এক রেশের শুরু। লেখকের এবারের বসন্ত কি এগোবে সামনে? নাকি মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের সত্ত্বা থেকেই পালিয়ে থাকতে চায়?
আধুনিক জাপানিজ সাহিত্যগুলো পড়লেই আমি মার্ক্সের এলিনিউশেন থিউরিটি যেন চরমভাবে উপলব্ধি করতে পারি। সম্পর্কগুলোর টানা-পোড়ন, অস্থিরতা বিশ্বায়নের এই গ্লোবাল ভিলেজের রূপে প্রতিনিয়ত মানসিক দৈন্যতাকেই যেন চিহ্নিত করে। হিয়ার দ্য উইন্ড সিং ও ঠিক তেমনি আঠারো দিনের বিষন্নতার এক যাত্রাপথ। উপন্যাসের মূল চরিত্র লেখক, যে পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষায় এখনো নিজের বাবার জুতো পলিশ করে দেয় অথবা স্পষ্ট করে বললে তাকে দিয়ে জুতো পলিশ করান। বাবা আর সন্তানের মাঝে যদিও মানসিক দুরত্বের বিশাল সেতু চলে এসেছে। এদিকে, বন্ধু র্যাট ধনীর সন্তান হয়েও এক তীব্র অনীহা তার ধনীদের প্রতি। প্রত্যেকে অপ্রাপ্তির মাঝেই যেন ক্রমশ ডুবে যায়।
“বিষণ্ণ আত্মার অধিকারী লোকজনের বিষণ্ণ স্বপ্ন ব্যতীত আর কিছুই নেই। বিষণ্ণ আত্মার অধিকারীদের সত্যিকার অর্থেই কিছু নেই কেবল স্বপ্ন ব্যতীত।”
এ উপন্যাসের রচয়িতাকে বিষণ্ণতার আকাশ বলা যায়। কিন্তু মোটেও মানুষটি কিন্তু প্রথম থেকেই লেখালেখির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন না। মুলতঃ গানবাজনা নিয়ে ছিল তীব্র আগ্রহ। তার ছিল একটি জ্যাজ বার। বয়স ঊনত্রিশের কিনারায়। সারাদিন জ্যাজ বারের পেছনেই কেটে যেত সময়। দুনিয়ার বাকি চিন্তার তার জীবনে কোনো অস্তিত্বই ছিলনা। সেই মানুষ একদিন গেলেন বেজবল খেলা দেখতে। খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ মাথায় একটা গল্প এল। এবং তিনি ভাবতে লাগলেন তিনি চাইলেই তো গল্পটি লিখতে পারবে। সে রাতে বাসায় ফিরেই তিনি লিখতে বসলেন। জ্যাজ বারে কাজের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু সময় পাওয়া তাতেই গল্পটির মেরুদণ্ড দাঁড়িয়ে গেল। এমননি, একটা কম্পিটিসনে পাঠালে গল্পটি প্রথম পুরষ্কার ও পেয়ে যায়৷ সাহিত্যজগতে “হিয়ার দ্যা উইন্ড সিং” এর আবির্ভাবটা এমনই। সেই সাথে আধুনিক সাহিত্য পেয়েছে বিষণ্ণতা আর পরাবাস্তবতার মোড়কে একটি নাম, হারুকি মুরাকামি।
হিয়ার দ্য উইন্ড সিং গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় জুন ১৯৭৯ এ। গুনজোর একটি ইস্যুতে। এবং পরের মাসে এটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজুকি ওমরি উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৮১ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মান করেন।
এ উপন্যাসটি রেট ট্রিলজি-র প্রথম বই। তথ্যমতে, ধারাটির চারটি বইয়ের সবগুলোই ইংরেজিতে অনুদিত হয়। পিনবল ১৯৭৩, আ ওয়াইল্ড শিপ চেইজ কিছুটা পরিচিতি এনে দিলেও মুরাকামি জনপ্রিয়তার স্বাদ পায় “হার্ড বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দ্যা এন্ড অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” থেকে। কিন্তু, হিয়ার দি উইন্ড সিং ও পিনবল ছাড়া বাকীগুলো জাপানের বাইরে খুব বেশি পঠিতও হয়নি। মুরাকামি তার এক সাক্ষাৎ কারে এ উপন্যাস দুটিকে নিজের সবচেয়ে অপরিপক্ক সময়ের লেখা বলে অভিহিত করেন!
হিয়ার দ্য উইন্ড সিং বইটির পুরো কাহিনি জুড়েই আছে একের পর এক বিয়ারের বোতল খালি করা, র্যাটের বই পাঠ আর উপন্যাস লিখবার তাড়না। ডেরেক হার্টফিল্ড নামের এক জনপ্রিয় অজানা আমেরিকান লেখকের গল্প, যে কিনা একদিন আত্মহত্যা করেছিল এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বুকে জড়ানো ছিল হিটলারের একটা পোর্ট্রেট আর হাতে একটা ছাতা!
বইটির নামকরণটি বেশ অদ্ভুত। মুলতঃ ট্রুম্যান কাপোটির শেষ গল্প শাট এ ফাইনাল ডোর থেকে হিয়ার দ্য উইন্ড সিং নামটি এসেছে। শাট এ ফাইনাল ডোরের শেষ বাক্য “Think of nothing things, think of wind” থেকেই আগমন উপন্যাসের নামটির। তবে প্রথম প্রকাশ গুনজো সাহিত্য পুরস্কার কমিটির কাছে জমা দেওয়ার সময় নাম ছিল হ্যাপি বার্থডে এন্ড ওয়াইট ক্রিস্টমাস। মুরাকামির সাহিত্য গুলো আমার কাছে ডার্ক ওয়াটার ঘরানার মনে হয়।
এ বইটির অনুবাদ এ বছর বইমেলাতে এসেছে ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদের হাত ধরে। বিভিন্ন ওয়েবের মারফতে তার লেখা আমি আগেই পড়েছি। অনুবাদ সে হিসেবে এই প্রথম পড়া। সাবলীলতা তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেটা তিনি এ অনুবাদেও ধরে রেখেছেন। ছোট ছোট লাইনের মাধ্যমে গভীরতায় প্রকাশ করে। ভূমিকাতে তার হৃদয় উজাড় করা ভালবাসায় আপ্লূত করেছে প্রিয় মানুষদের। কিন্তু, বইটির প্রোডাকশন আমার কাছে মনে হয় আরো ভাল হতে পারত। পড়তে গিয়ে পৃষ্ঠা বাইন্ডিং থেকে ছুটে এসেছে। আপনি বিষণ্ণতার কারিগরের বই একবার পড়ে তো ফেলে রাখবেন না, বার বার পড়তে চাইবেন।
এ বছরে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, বিষণ্ণতার মাত্রাও তেমন জুড়েছে মানুষের অন্তরে। সেখানে হিয়ার দ্য উইন্ড সিং অনেকটা বিষে বিষক্ষয়ের মত হবে। জীবনের বিষণ্ণতার আরেক টোটকা হিসেবে ভালই শ্রান্ত করবে চিত্ত।